সামাজিক ইতিহাসের আকর: 'বেগম' পত্রিকা

আমার মায়ের বইপত্র পড়াকে ঘিরে আশৈশব যে স্মৃতি আজও মনের পটে আঁকা আছে, সেটা হচ্ছে মায়ের পাঠমগ্ন দৃষ্টির সামনে মেলে ধরা সচিত্র বেগম। কাজ-খাওয়াদাওয়া শেষে পানের রসে সিক্ত টুকটুকে লাল ঠোঁটে মুখভরা হাসি নিয়ে দিবানিদ্রার আগে মা কখনো হাতে তুলে নিতেন নানা ধরনের প্রিয় গল্পের বই—নিয়মিত তাঁর হাতে থাকত বেগম পত্রিকা। প্রচ্ছদে ছবি থাকত একজন স্বনামখ্যাত বাঙালি নারীর। সেই নারীর উত্সুক চোখ বহির্জগতের দিকে প্রসারিত।

বালিকা বয়সে কৌতূহল নিয়ে যে বেগম উল্টিয়ে দেখতাম, সেই বেগম আজ অবধি আমার অবশ্যপাঠ্য তো বটেই, তদুপরি এখন পর্যন্ত সেই পত্রিকার ঈদসংখ্যার নিয়মিত লেখক হয়ে আছি।

অর্ধশতাব্দীর বেশি কাল ধরে বেগম প্রসঙ্গে এই প্রাক্কথন আমাকে প্রাণিত করেছে বেগম-এ প্রতিফলিত সমাজচিত্র, নারীপ্রগতি, আন্দোলন, শিক্ষা, অর্থনীতি, রাজনীতি ইত্যাদি বিষয়ে এই নিবন্ধটি লেখার জন্য। পাঠকের মতামতেই অর্ধশতাব্দীর অধিক কালের ইতিহাস হয়ে আছে বেগম পত্রিকা। সেই ইতিহাসেই শোনা যাবে বাঙালি নারীর সোচ্চার কণ্ঠস্বর।

ইতিহাস যখন নব নব বাঁক নেয়, তখন তা এগোতে থাকে পুরোনো ইতিহাস ভেঙে তার নবীকরণ করতে করতে। ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে যুগে যুগে ইতিহাসের রাজপথ তৈরি হয় নানা মাধ্যমে। সাময়িক পত্রিকা তেমনই একটি মাধ্যম। বেগম সাময়িক পত্রিকাটি উনিশ শতক, বিশ শতকের সাময়িক পত্রিকার ইতিহাসের মধ্যে নিজেই ইতিহাস হয়ে উঠেছে। অর্ধশতাব্দীর খণ্ড ইতিহাসের একটি প্রকাণ্ড আকররূপে বেগম বিবেচিত হয়েছে।১

৬৩ বছর ধরে (১৯৪৭-২০১০) বাংলাদেশের নারী ও সমাজপ্রগতির ক্রমবিবর্তিত বিবরণ পরিবেশন করছে বেগম। সমাজ-ইতিহাসের সচল দলিলরূপে বেগম ‘নারীর ইতিহাস’ অধ্যয়ন ও গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

‘নারীর ইতিহাস’বিষয়ক গবেষকদের কাছ থেকে জেনেছি যে র্যাডিক্যাল সামাজিক ইতিহাস বা তল থেকে দেখা ইতিহাস রচিত হয়েছিল সত্তর-আশির দশকে (১৯৭০-১৯৮০) ইউরোপে। এই ইতিহাসপ্রণেতারা অনুসরণ করেছিলেন ইংরেজ মার্ক্সবাদী ইতিহাসবিদ ক্রিস্টোফার হল, এডওয়ার্ড টমসন, এরিক হবসবমকে। এর ফলে ইতিহাস রচনায় বাদ পড়ে যাওয়া অনেক ঘটনা, ব্যক্তির অবদান দৃশ্যমান হয়েছিল। তবু দেখা গেছে, এসব ক্ষেত্রে উচ্চবর্গীয় ব্যক্তি ও ঘটনাই প্রাধান্য পায়। সবচেয়ে বেশি সমস্যা দেখা যায় ইতিহাসে নারীর সত্য অবস্থানকে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে।২

‘নারীর ইতিহাস’ বিষয়ে সমস্যা দূর করার জন্য গবেষকেরা শুরু করেন তত্ত্বগত আন্দোলন। জন কেলি এ ক্ষেত্রে তত্ত্বগত কাঠামো নিয়ে গভীর বিশ্লেষণ করে এই প্রত্যয়ের দুটি লক্ষ্যমাত্রা বিষয়ে বলেছেন যে ১. ‘নারীর ইতিহাস’ পর্যালোচনায় নারীকে নিয়ে আসা, ২. ইতিহাস রচনাকে নারীর কাছে নিয়ে যাওয়া। এই বিষয়গুলোকে ঘিরে যে তিনটি মৌলিক প্রশ্ন তুলেছে ‘নারীর ইতিহাস’ সেগুলো হচ্ছে: (ক) ঐতিহাসিক কাল বিভাগ (খ) সামাজিক বিশ্লেষণের পর্ব (গ) সামাজিক পরিবর্তনের তত্ত্ব।৩ এই তাত্ত্বিক কাঠামো অনুসরণ করে বেগম পত্রিকার ঐতিহাসিক পর্যালোচনা করতে আগ্রহী হয়েছি।

বিগত সময়ের নারীজাগরণের ইতিহাস ও দুষ্প্রাপ্য তথ্য-দলিলরূপে বেগম বিবেচ্য বলে মনে করি। বর্তমান সময়ের পাঠকের অনুসন্ধিত্সা থাকলেও হাতের কাছে বেগম পান না বলে তাদের পক্ষে বেগম-এর ইতিহাস জানাও সম্ভব হচ্ছে না। এই লেখায় সে বিষয়ে জানানোর আগ্রহ থেকে কয়েকটি শিরোনামে প্রবন্ধটিকে সাজিয়েছি।

প্রথম অংশের শিরোনাম দিয়েছি ‘বেগম-এর পশ্চাত্পট’। এখানে অল্প পরিসরে পাঠককে জানাতে চেয়েছি বেগম প্রকাশিত হওয়ার ইতিহাস। দ্বিতীয় অংশে বেগম-এর যাত্রা শুরু ও সাময়িকপত্রের ইতিহাসে এর অবদান বিশ্লেষণ করেছি। বেগম নিজেই কীভাবে ‘ইতিহাস’ হয়ে বিরাজ করছে, সে বিষয়ে আলোচ্য অংশে বলা হয়েছে।

বেগম পত্রিকাটি প্রথমে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়েছে ১৯৪৭ সালে। ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত তিন বছর কলকাতায় প্রকাশিত পত্রিকাটি ধারণ করেছে দেশ ভাগের আগে ও দেশ ভাগের সময়ের রাজনৈতিক-সামাজিক-সাম্প্রদায়িক সংকটের মধ্যে নারীর দুর্ভোগের ইতিহাস। সে জন্য ভিন্ন অংশে আলোচনা করেছি বেগম পত্রিকার প্রথম তিন বছরের বিবরণ ও বৈশিষ্ট্য বিষয়ে।

১৯৫০ সালে দেশ ভাগের সমূহ সংকট ধারণ করে বেগম ঢাকায় স্থানান্তরিত হলো প্রকাশক-সম্পাদকদের কলকাতা থেকে চিরতরে ঢাকায় চলে আসার কারণে। এই অংশের ইতিহাসটুকু বর্ণিত হয়েছে ‘অতঃপর ঢাকায় বেগম’ শিরোনামে।

এই পশ্চাত্পটের ইতিহাস বলার পর বেগম বিষয়ক মূল আলোচনা-বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন সংযুক্ত হয়েছে ‘বেগম পত্রিকার চিন্তাচর্চা’ শিরোনামের অংশে। শেষে একটি উপসংহার সংযোজনা করে লেখাটি শেষ করেছি।

মূলত এই প্রবন্ধে পাঠকের অনুসন্ধিত্সা পূরণের জন্য কিছুটা চেষ্টা করেছি।

‘বেগম’-এর পশ্চাত্পট

মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন দীর্ঘকালের লালিত স্বপ্ন সফল করলেন বেগম পত্রিকা প্রকাশ করে। বেগম উদিত হয়েছে ১৯৪৭ সালের ২০ জুলাই। হঠাত্ করে এর আবির্ভাব ঘটেনি। মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন ১৯১৮ সালে সওগাত পত্রিকা প্রকাশ করার সময় থেকেই মুসলিম নারীশিক্ষা, নারীজাগরণ ও সাহিত্য-সাধনায় নারীকে উত্সাহিত করার বিষয়ে তত্পর ছিলেন। সওগাত-এর সাতটি নীতির অন্যতম ছিল, ‘নারীশিক্ষা ও নারীজাগরণমূলক প্রবন্ধাদি ও “চিত্রে মহিলাজগত” প্রকাশ করা। মহিলাদেরও সাহিত্য-সাধনায় উত্সাহিত করা।’৪

সওগাত-এর সামাজিক-জাতীয় (Social and National) রণধ্বনি (Slogan) ছিল ‘নারী না জাগলে জাতি জাগবে না’।৫ সওগাত-এর প্রতিষ্ঠাযুগ থেকে বেগম-এর আবির্ভাবকালের মধ্যে ব্যবধান ২৯ বছরের। সওগাত ও বেগম-এর মধ্যে একটি যোগসূত্রের সেতু তৈরি করেছিলেন মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন। সওগাত-এর ক্রমবিকশিত রূপায়ণ এবং সওগাত ঘরানারই অভিন্ন অথচ ভিন্নতর একটি পদক্ষেপ হিসেবে বেগম স্বাতন্ত্র্য অক্ষুণ্ন রেখেছে।

মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন ইতিহাসবিদ নন, তিনি সাংবাদিক-প্রকাশক। সওগাত, মহিলা সওগাত ও বেগম—এই তিন পর্যায়ের ক্রমপ্রকাশিত লেখা-সাহিত্য-সামাজিক-নারী আন্দোলন জাগরণের বিবরণ সাক্ষ্য দিচ্ছে যে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন প্রকৃতপক্ষে একজন নিষ্ঠাবান ও সত্ সমাজ-সংস্কারক এবং সেই সূত্রে তিনি স্বয়ং ইতিহাস রচনা করেছেন। মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন যখন সওগাত-এর মাধ্যমে সামগ্রিকভাবে মুসলিম সমাজের, বিশেষ করে মুসলিম নারীসমাজের জাগরণের বিষয়ে উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তখন রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন নারীমুক্তির বিষয়ে বহু ধারায় কাজ করছিলেন এবং এই তত্ত্বটি সবর্জনগ্রাহ্য করে তুলেছিলেন যে নারীরা সমাজেরই অর্ধাঙ্গ। নারীরা পড়ে থাকলে সমাজ উঠবে কীরূপে? কোনো ব্যক্তির এক পা বেঁধে রাখলে সে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কত দূর চলবে? পুরুষের স্বার্থ ও নারীর স্বার্থ ভিন্ন নয়—একই।৬ মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন সওগাত প্রকাশের সময় রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের উল্লিখিত তত্ত্বটি সর্বান্তকরণে আত্মস্থ করেছিলেন। তাঁর ভাষায় রোকেয়ার কণ্ঠস্বর শোনা গেল, যখন তিনি বললেন, ‘আমি এটা স্পষ্টই বুঝতে পেরেছিলাম যে এক পা দিয়ে মানুষ যেমন দৌড়াতে পারে না, তেমনি এক অংশকে অন্ধকারে ফেলে রেখে একটি সমাজ এগিয়ে যেতে পারে না।’৭ আর এ কারণেই সওগাত প্রকাশের সময় থেকেই নারীসমাজের প্রাপ্য যথার্থ সম্মান তিনি উপস্থাপন করেছেন। রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের ‘সওগাত’ কবিতাটি সওগাত পত্রিকার প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যায় প্রথম লেখা হিসেবে সম্মানের সঙ্গে ছাপা হয়েছিল।৮ এর পরের ধাপটি নারীজাগরণের লক্ষ্যে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের কাছে ছিল কঠিন এক চ্যালেঞ্জ। নির্ভীক কণ্ঠে তিনি বলেছিলেন:

ধর্মের নামে অধর্ম, অশিক্ষা, কুসংস্কার—এসব অন্যায়ের মূল উত্পাটনের লক্ষ্যে সওগাত-এ “বিশেষ সচিত্র মহিলা বিভাগ” চালু করেছিলাম এবং পরে তাঁদের জন্য সচিত্র মহিলা সওগাত বের করি। আমার প্রকাশিত বার্ষিক ও সাপ্তাহিক সওগাত পত্রিকায় মহিলাদের লেখার অগ্রাধিকার প্রদান করেছিলাম। মহিলাদের জন্য আমার সর্বশেষ প্রচেষ্টা সচিত্র সাপ্তাহিক বেগম।৯

‘বেগম’-এর যাত্রা শুরু ও সাময়িকপত্রের ইতিহাসে এর অবস্থান বিশ্লেষণ

১৯৪৭ সালের ২০ জুলাই বেগম প্রথম প্রকাশিত হলো কলকাতা থেকে। প্রথম সম্পাদক ছিলেন সুফিয়া কামাল। সহযোগী সম্পাদক ছিলেন নূরজাহান বেগম। রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন ১৯৩২ সালে পরলোকগত হন। বাঙালি মুসলিম নারীজাগরণের ও নারীমুক্তি আন্দোলনের পথিকৃত্ রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের লক্ষ্যে পূর্ণাঙ্গ একটি ছবি বেগম-এর প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদে সুশোভিত করে মুদ্রিত হলো। বেগম-এর এই যাত্রা শুরুর ইতিহাসে ঐতিহাসিক ব্যক্তিবর্গের ভূমিকা ও অবদান এবং সংবাদ-সাময়িকপত্রের ইতিহাসে বেগম-এর অবস্থান উপেক্ষিত রয়েছে। এই উপেক্ষার বিষয়টি নারীবাদী গবেষকদের ভাষায় ‘ইতিহাসে উপেক্ষিতা নারী’ এবং সেটি জেন্ডার বৈষম্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য অভিধা। বেগম যখন ৬৩ বছর ধরে বাঙালি নারীর আত্মপরিচয় ধারণ করে প্রথমে কলকাতায়, দেশ বিভক্তির পর ১৯৫০ সাল থেকে পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকায়, এবং স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে আজ অবধি প্রকাশিত হচ্ছে, তখন সাময়িকপত্রের সামগ্রিক ইতিহাসে শুধুই ‘নারী সম্পাদিত নারীবিষয়ক পত্রিকা’ পরিচয় প্রমাণ করে, নারীর অধস্তনতা কীভাবে সমাজকাঠামোর পিতৃতান্ত্রিক-পুরুষতান্ত্রিক মতাদর্শের শিকার হয়ে চলেছে। এই মতাদর্শ আকিমুন রহমানের কণ্ঠস্বরে ও কলমে বিকৃত মানসিকতায় পর্যবসিত হয়েছে।১০

এ ধরনের মতাদর্শের ঊর্ধ্বে রয়েছেন পুরুষ-নারী অনেকেই। তাঁদের কথাও আমাদের জানতে হবে। এঁদের প্রতিনিধিস্থানীয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের পর্যালোচনা প্রণিধানস্বরূপ। তাঁর ভাষায়:

এই পত্রিকার লক্ষ্য ছিল বাঙালি মুসলিম নারীদের কাছে পৌঁছানো—তার চেয়ে বড়ো পরিসরে যদি যায়, তা হবে উপরি পাওনা। আশা করা গিয়েছিল, যাঁদের উদ্দেশে পত্রিকা প্রকাশ করা, এটি হয়ে উঠবে তাঁদের কণ্ঠস্বর। শিক্ষিত পুরুষ ধরে নিয়েছিল, এটি মেয়েদের রান্না-বান্না, জীবনকর্ম ও শিশুপালনের জ্ঞানদায়ক; যেসব মেয়ের লেখা অন্য কোথাও প্রকাশ পায় না, তাঁদের শখের সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্র; অথবা যেসব পুরুষ নিজের নামে লিখতে চান না, স্ত্রীর নামে লেখা ছাপিয়ে সন্তোষ লাভ করতে ভালোবাসেন, এটি তাঁদের জন্য।...

বেগম, দেখা যাচ্ছে খণ্ড ইতিহাসের প্রকাণ্ড আকর। ৫০ বছর বা তার কিছু বেশি কাল ধরে বাংলাদেশে নারীসমাজের যে ধীর অগ্রগতি হয়েছে, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ ধারণ করে রেখেছে এই পত্রিকা। আসলে, প্রতিদিন সংবাদপত্র পড়ে যখন আমরা তা ফেলে রাখি কিংবা সাময়িকপত্রের পাতা উল্টে যাই, তখন অনেক সময়ই আমরা টের পাই না যে সেসবের মধ্যে রচিত হচ্ছে প্রতিদিনের ইতিহাস, আর আমরা পাঠকেরা হচ্ছি সেই নির্মীয়মাণ ইতিহাসের রীতিমতো সাক্ষী। অনেক কাল পরে, আমাদের স্মৃতি যখন অস্পষ্ট হয়ে ওঠে, তখন যদি কেউ সেই পত্রিকার সংকলন তুলে ধরেন, মনে হয়, এমনই হয়েছিল নাকি—তখন তো আমি ছিলাম এরই আশপাশে। ...তাতে (বেগম-এ) নারীর অগ্রগতির ইতিহাস যেমন ধরা পড়েছে, নারীর প্রতি বহু প্রতিকূলতার কথাও তাতে আছে। তবু শেষ পর্যন্ত মনে হয়, নারীর প্রগতি বোধ হয় আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে তাত্পর্যপূর্ণ ঘটনা। আজও বাংলাদেশে চেষ্টা চলে গৃহকোণে নারীকে আবদ্ধ করে রাখার। তবে এই সংকলিত ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, আপনভাগ্য জয় করার সংগ্রামে নারী অপ্রতিরোধ্য।১১

অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলাম লিখেছেন:

সওগাত-এর মালিক-সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন আমাদের ঠাঁই করে দিয়েছিলেন তাঁর আশ্রয়ে। প্রায়ই সেখানে চলত আমাদের দিনভর আড্ডা। মধ্যমণি ছিলেন কবি হাসান হাফিজুর রহমান। আজ শুনতেও কেমন ঠেকতে পারে, ওই সময়টায় (১৯৫২, ঢাকা) হাসান ছিলেন কিছু কালের জন্য মহিলা সাপ্তাহিক বেগম পত্রিকার ‘ঘোস্ট এডিটর’। দেখাশোনার কাজে তখন (দাদাভাই) রোকনুজ্জামান খানও বসতেন। তবে অবশ্যই সর্বোপরি নিখুঁত ম্যানেজমেন্টে ও নিয়মিত প্রকাশনায় মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন।

আর্থিক টানাটানির ওই দুর্দিনে আমারও কাজ জুটে গিয়েছিল ওইখানে। বেগম পত্রিকায় সপ্তাহে-সপ্তাহে কলাম লেখার কাজ। লিখতে হবে ছায়াছবির কথা এবং অবিশ্বাস্য অবাক করা আরও যে, সেলাইয়ের কাজ, ঘরকন্না, রান্নাঘর ইত্যাদি সব।১২

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী লিখেছেন, ‘ঢাকার সাহিত্য সংসদে সওগাতের ভূমিকা’ শিরোনামে:

১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হওয়ার পর সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন কলকাতা থেকে সপরিবারে ঢাকায় চলে আসেন।...সওগাত-এর গ্রুপ প্রকাশনা ছিল। যেমন মাসিক সওগাত, শিশু সওগাত, সাপ্তাহিক সওগাত, সাপ্তাহিক বেগম। সম্ভবত অবিভক্ত বাংলাতেও বেগমই ছিল প্রথম মহিলা সাপ্তাহিক।

ঢাকায় এসে নাসিরউদ্দীন সাহেব প্রথমে সাপ্তাহিক বেগম পুনঃপ্রকাশ করলেন। ১৯৫২ সালে আমি যখন দৈনিক সংবাদ-এর বার্তা বিভাগে কাজ করি, তখন খবর পেলাম, নাসিরউদ্দীন সাহেব বেগম-এর কাজ দেখাশোনার জন্য একজন পার্টটাইম লোক খুঁজছেন।...নাসিরউদ্দীন সাহেবের সঙ্গে গিয়ে দেখা করলাম।

...বেগম-এর কাজ মানে মেয়েদের কবিতা বা গল্প ইত্যাদি দেখে মনোনীত এবং কোনো কোনো ফিচার তৈরি করা, এতেও কাজ শেষ হতো না। রওশন (একাধারে প্রেসের বয়, বেয়ারা, ম্যানেজার; কখনো প্রুফ তোলে, এমনকি মেশিন চালায়। মালিকের ফরমাশ খাটে, প্রেসের কম্পোজিটর ও মেশিনম্যানদের হুকুম দেয়) গাদা গাদা প্রুফ এনে হাজির করত।১৩

বেগম বিষয়ে তথ্য জানিয়েছেন পত্রিকাটিতে ১৯৫৫ থেকে কিছুকাল পর্যন্ত কর্মরত সাংবাদিক সৈয়দ জিয়াউর রহমান। পরবর্তী সময়ে তিনি ওয়াশিংটনে ভয়েস অব আমেরিকায় যোগ দেন। এক সাক্ষাত্কারে১৪ তিনি বলেছেন যে, ১৯৫০ সালে যখন বেগম স্থানান্তরিত হয় ঢাকায় (কলকাতা থেকে), তখন বিভিন্ন লেখা সাজানোর ক্ষেত্রে (যেমন—‘মহিলাজগত’, ‘দেশ-বিদেশের খবর’ ইত্যাদি) রোকনুজ্জামান খান (দাদাভাই), মাসুদা চৌধুরী, কামরুন্নাহার লাইলী, ফরিদা মীর্জাসহ কয়েকজনকে তিনি সহযোগিতা করেছেন। দু-একবার ছদ্মনামে (মহিলা) প্রবন্ধ লিখেছেন।

তিনি বলেছেন যে, ১৯৫০ থেকে যখন ঢাকায় বেগম প্রকাশিত হতে থাকে, তখন কয়েক বছর সওগাত ও বেগম পত্রিকায় সাংবাদিকতার কাজে কর্মরত ছিলেন কবি আহসান হাবীব, কবি হাবিবুর রহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী (সাময়িকভাবে দেড় বছর), বেলাল চৌধুরী প্রমুখ।

বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়, বেগম পত্রিকা যখন নারী লেখক ও সাংবাদিক তৈরির প্রশিক্ষণ দিচ্ছিল, তখন পাশে ছিলেন পুরুষ কলমযোদ্ধারা। তাঁদের অনেকের স্মৃতিতে এই সময়কালটা দেদীপ্যমান হয়ে আছে। সাহিত্য-সংবাদ-সাময়িকপত্রের ইতিহাসে উনিশ শতক উজ্জ্বল পথিকৃত্ যুগ হিসেবে স্বীকৃত। সংবাদ প্রভাকর (১৮৩১), তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা (১৮৪৩), মাসিক পত্রিকা (১৮৫৪), বামাবোধিনী (১৮৬৩), অবলা বান্ধব (১৮৬৯) প্রভৃতি পত্রিকা আমাদের চমক জাগায় শুধু নামকরণের জন্য নয়। বাঙালি নারীর জাগরণের লক্ষ্যে পুরুষ সম্পাদকদের আগ্রহের গুরুত্ব জেনেও আমরা চমকিত হই। আরও চমকিত হই এই পুরুষ সম্পাদকদের পথ ধরে নারী সম্পাদক পত্রিকা সম্পাদনায় অগ্রসর হন—এই তথ্য জেনে। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সাময়িকপত্র সম্পাদনে বঙ্গনারী প্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘মহিলা-সম্পাদিত প্রথম সাময়িকপত্র বঙ্গ মহিলা নামে একখানি পাক্ষিক সংবাদপত্র, খিদিরপুর-নিবাসিনী জনৈক মহিলার সম্পাদনায় ১২৭৭ সালের পয়লা বৈশাখ (১৮৭০, এপ্রিল) প্রকাশিত হয়। শুনিয়াছি ইনি মোক্ষদায়িনী মুখোপাধ্যায়।’১৫

সে সময় বাঙালি নারী সম্পাদিত আরও পত্রিকার তালিকা দিয়েছেন ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। সেগুলো হচ্ছে: অনাথিনী (১৮৭৫), হিন্দুললনা (১৮৭৫), ভারতী (১৮৭৭), পরিচারিকা (১৮৭৮), বঙ্গবাসিনী (১৮৮৩), সোহাগিনী (১৮৮৪), বালক (১৮৮৫), বিরহিনী (১৮৮৮), পুণ্য (১৮৯৭), অন্তঃপুর (১৮৯৮)। এসব পত্রিকায় নারীকণ্ঠে নারীর অভাব-অভিযোগ, কর্তব্য ও অধিকারের কথা ফুটে উঠেছিল।১৬

এই সূত্রে বলা যায় যে বাঙালি নারী সম্পাদিত সাময়িকপত্রের বিদ্যুত্প্রভা যখন আমাদের আনন্দিত করে, তখন অন্ধকারের ছায়াপাতেও আমরা আশঙ্কিত হই। দুঃখজনক যে একই সময়ে মুসলিম নারীর জীবন ও মানসজগতে এই বিদ্যুত্প্রভার সূচনা ঘটেনি।

উনিশ শতকের শেষে বাঙালি মুসলিম মানসের নবজাগরণ ঘটেছে এবং বিশ শতকের শুরু থেকে বাঙালি মুসলিম নারীসমাজের নবজাগরণের লক্ষ্যে বাঙালি মুসলিম পুরুষ সম্পাদকেরা প্রণোদিত হয়েছিলেন। বহু বছরের ব্যবধানে বাঙালি মুসলিম নারীর জাগরণ ঘটলেও তাঁদের সম্পাদিত সাময়িকপত্র-পত্রিকার মাধ্যমে জানা যায় যে সময়ের ব্যবধান ঘুচিয়ে প্রগতির মশাল হাতে, কলমের ঝরনাধারায় ব্যাপকসংখ্যক বাঙালি মুসলিম নারী অভিষিক্ত করেছেন বঙ্গীয় বুদ্ধিজীবীর মানসজগত্। সাময়িকপত্র সম্পাদনে বঙ্গনারীর ইতিহাসে বাঙালি মুসলিম নারী সম্পাদিত পত্রিকাগুলোর প্রসঙ্গ আনা দরকার। সোফিয়া খাতুন, শামসুন্নাহার মাহমুদ, সুফিয়া কামাল, জাহানারা আরজু, মাহফুজা খাতুন, জাহানারা ইমাম, রাবেয়া খাতুন প্রমুখ সম্পাদিত যথাক্রমে উল্লিখিত আল্লেখা (১৯২১), বুলবুল (১৯৩৩), বেগম (১৯৪৭), সুলতানা (১৯৪৯), নওবাহার (১৯৫০), খাওয়াতীন (১৯৫২) উল্লেখযোগ্য।

ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এই পত্রিকাগুলোর সংবাদ লিপিবদ্ধ করেছেন।১৭ উল্লেখযোগ্য যে হিন্দু-মুসলিম জনগোষ্ঠী হিসেবে বিভাগ-পূর্বকালে ও পরে (১৯৪৭-এর আগে ও পরে) এই উপমহাদেশের বাঙালি নারীজাগরণের ইতিহাসে প্রায় ৫১ বছরের সময়-ব্যবধান লক্ষিত হলেও বিকাশের ধারাটি ছিল প্রায় একই বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। অর্থাত্ দুই সম্প্রদায়ের নারীজাগরণেই পুরুষদের উদ্যোগ লক্ষ করা যায়।

বেগম পত্রিকাটি উল্লিখিত পত্রিকাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এর দীর্ঘ সময়ের সচলতার জন্য তো বটেই, তা ছাড়া এই পত্রিকার ব্যতিক্রমী উপস্থাপনা, লেখার গুণমান, অব্যাহতভাবে নারীজাগরণ ও আন্দোলনের পাশাপাশি জাতীয় জীবনের আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বিকাশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য বেগম বিশ শতকের শেষাবধি নিজেই ইতিহাস হয়ে বিরাজিত।

‘বেগম’ পত্রিকার প্রথম তিন বছরের বিবরণ ও বৈশিষ্ট্য পর্যালোচনা

২০ জুলাই, ১৯৪৭ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত বেগম-এর প্রথম বর্ষ ১, ৪২ সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে কলকাতার ১২ নম্বর ওয়েলেসলি স্ট্রিট থেকে। এরপর দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষের সব সংখ্যা প্রকাশিত হয় স্থানান্তরিত ও নিজস্ব ভবনে প্রতিষ্ঠিত বেগম কার্যালয়ে অর্থাত্ ২০৩ নম্বর পার্ক স্ট্রিট, কলকাতা থেকে।

বেগম-এর যাত্রা শুরু কষ্টসাধ্য হলেও মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন সচিত্র সাপ্তাহিক বেগম প্রকাশে বদ্ধপরিকর হয়েছিলেন এই আশায় যে অনেক লেখিকা ও সমাজকর্মীর আবির্ভাব সম্ভব হবে পত্রিকার মাধ্যমে। লেখিকাদের ছবি ছাপানোর উদ্দেশ্য ছিল, পাঠকের মনের বিভ্রান্তি বা সংশয় যেন দূর হয় যে, বেগম-এর গল্প-প্রবন্ধ-কবিতা ইত্যাদির রচয়িতা সত্যি সত্যিই নারী।

নূরজাহান বেগম বলেছেন:

বেগম প্রকাশের কথা বলি। একদিন বেগম সুফিয়া কামালকে ডেকে বাবা বললেন, ‘বছরে একবার মহিলা সওগাত বের হলে তো মহিলারা খুব বেশি লিখতে পারবে না। তাই মেয়েদের জন্য একটি আলাদা পত্রিকা প্রকাশ করা উচিত। তুমি কী বলো?’

বাবার প্রস্তাবে বেগম সুফিয়া কামাল সোত্সাহে সায় জানালে তিনি বললেন, ‘এখন পত্রিকার সম্পাদক কে হবে? নূরজাহান তো সবে কলেজ থেকে বেরিয়েছে। ওকে সম্পাদক করা ঠিক হবে না। ও থাকুক ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে আর সম্পাদকের দায়িত্ব তুমিই পালন করো।’ বেগম সুফিয়া কামাল রাজি হলেন।১৮

প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যা বেগম-এর সম্পাদক সুফিয়া কামাল সম্পাদকীয় লিখলেন, পাঠকদের শুভেচ্ছা জানালেন। সম্পাদকীয়তে লিখলেন:

সুধী ব্যক্তিরা বলেন, জাতি গঠনের দায়িত্ব প্রধানত নারীসমাজের হাতে—কথাটা অস্বীকার্য নয় এবং এই গুরুদায়িত্ব পালন করতে হলে পৃথিবীর কোনো দিক থেকেই চোখ ফিরিয়ে থাকলে আমাদের চলবে না, এ কথাও মানতে হবে। শিল্প-বিজ্ঞান থেকে আরম্ভ করে গৃহকার্য ও সন্তান পালন—সর্বক্ষেত্রে আমরা সত্যিকার নারীরূপে গড়ে উঠতে চাই।১৯

পাঠকসমাজকে শুভেচ্ছা জানিয়ে লিখলেন:

কৃষ্টির ধারা বহন ও সমৃদ্ধি সাধনের একমাত্র সহায় সাহিত্য, সেই সাহিত্যের ক্ষেত্রে আজও আমরা প্রায় উদাসীন। মুসলিম নারীসমাজে সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রসার হইতে পারে আমাদের নিজস্ব এমন কোনো বাহনের প্রতিষ্ঠা আজ পর্যন্ত হয় নাই। বর্তমানের এই নবজাগরণের দিনে, নতুন জাতীয় সংগঠনের যুগসন্ধিক্ষণে মুসলিম নারীদের এই লজ্জাকর দারিদ্র্য আরও করুণ চেহারায় আমাদের অন্তর ব্যথিত করিয়া তুলিয়াছে। এই জন্যই বহুবিধ বাধাবিঘ্ন ও অসুবিধা থাকা সত্ত্বেও সাপ্তাহিক বেগম মুসলিম নারীসমাজের খেদমতে হাজির হইল।...সকলের সমবেত চেষ্টায় বেগম মুসলিম নারীসমাজের সত্যিকারের খেদমতের যোগ্য হইয়া উঠুক।২০

বেগম প্রথম সংখ্যায় শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন অধ্যাপিকা শামসুন্নাহার মাহমুদ এম এ, মিসেস বদরুন্নেসা আহমেদ, মিসেস এইচ এ হাকাম এমএলএ, বেগম সৈয়দা ফেরদৌস মহল সিরাজী, মিসেস জাহান আরা মজিদ, কাজী লুত্ফুন্নেসা হারুন, বেগম ফিরোজা রহমান, নূরজাহান বেগ, বেগম জোবেদা খাতুন, মিসেস আমিনা চৌধুরী, মিসেস আনোয়ারা বেগম।২১

কলকাতা থেকে প্রকাশিত বেগম পত্রিকার তিন বছরের নিয়মিত বিভাগগুলো হচ্ছে: সম্পাদকীয়, প্রবন্ধ, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, জীবনী, সচিত্র মহিলাজগতের খবর, স্বাস্থ্য ও সৌন্দর্য, প্রশ্ন ও উত্তর, ডাক্তার বলেন, রম্য রচনা, সেলাই, রান্না, হালচাল, চিঠিপত্র, পুস্তক সমালোচনা, ছায়াছবির কথা, সংক্ষিপ্ত সংবাদ, কয়েকটি সচিত্র বিভাগ।২২

প্রথম বর্ষ ১২ সংখ্যা বেগম প্রকাশের পর দেশ ভাগ হয়ে যাওয়ায় সুফিয়া কামালকে কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় যেতে হলো স্থায়ীভাবে থাকার জন্য। তাঁর স্বামী কামাল উদ্দীন সাহেব সরকারি চাকরিজীবী হওয়ায় কলকাতা থেকে ঢাকায় বদলির প্রস্তাব দিলেন এবং ঢাকায় চলে গেলেন সপরিবারে। সেই সময়ে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক নূরজাহান বেগম পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করলেন। সহসম্পাদিকা ছিলেন লায়লা সামাদ। সব কাজে সহযোগিতা করেছিলেন দুই বোন—নাসিমা বানু ও তাহমিনা বানু।২৩ লেখার অভাবের জন্য বেগম প্রকাশের ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছিল। সে সময় কলকাতায় দাঙ্গা-হাঙ্গামার জন্য হিন্দু-মুসলমান পাড়াগুলো ভাগ হয়ে গিয়েছিল। এক এলাকার বাসিন্দারা অন্য এলাকায় যেতে পারছিল না। সে সময় নূরজাহান বেগম ও অন্য সহযোগীরা ইংরেজি পত্রিকা থেকে প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো অনুবাদ করে বেগম পত্রিকা প্রকাশ করছিলেন।২৪ সে সময় থেকেই বেগম-এর ঈদসংখ্যা প্রকাশিত হতো। ১৯৪৮ সালে প্রকাশিত ঈদসংখ্যায় যাঁরা লিখেছিলেন, তাঁদের একটি তালিকা নূরজাহান বেগম জানিয়েছেন:২৫ তাঁরা হলেন—সুপ্রভা সেন, প্রতিমা সেন, ইন্দিরা দেবী, ক্ষণপ্রভা দেবী, প্রশান্তি দেবী, রানু চক্রবর্তী, অন্নপূর্ণা গোস্বামী, দীপ্তি রানী সেন, নীলিমা গঙ্গোপাধ্যায়, প্রভাবতী দেবী সরস্বতী, হাসিরাশি দেবী, সতী সিংহ, প্রতিমা গাঙ্গুলী, মিসেস এ গাফ্ফার, কবি শেফালিকা শেঠ, মিসেস মরিয়ম রশীদ, কবি সৈয়দা মোতাহেরা বানু, মিসেস রাবেয়া হায়দার প্রমুখ।

বেগম ২০৩ নম্বর পার্ক স্ট্রিটের কার্যালয় থেকে প্রকাশের শুরুতে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। সেই প্রীতি সম্মিলনে অধ্যাপিকা কল্যাণী সেন প্রধান অতিথি ছিলেন। সম্পাদিকা নূরজাহান বেগম তখন বলেছিলেন:

মেয়েদের পরিচালিত এই পত্রিকার উন্নতির জন্য সর্বস্তরের মহিলাদের সাহায্য কামনা করি। মেয়েরা সাহিত্যচর্চা করুক—এ উদ্দেশ্য নিয়েই বেগম-এর প্রকাশ। বেগম চায় দেশের মেয়েদের মধ্য থেকে কুংস্কার দূর করে, অশিক্ষার অন্ধকার দূর করে, জীবনের সমস্ত ভার স্বেচ্ছায় ও সাহসের সঙ্গে, সার্থকতার সঙ্গে বহন করার বাণী শোনাতে।২৬

১৯৪৭ সালের ২০ জুলাই থেকে ১৯৪৯ সালের ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকাশিত প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যা থেকে তৃতীয় বর্ষ ১৮ সংখ্যা পর্যন্ত বেগম-এ প্রকাশিত সূচিপত্র পাঠে আমরা বিস্মিত হই যে নানা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বাধাবিপত্তির মধ্যেও কীভাবে এত বৈচিত্র্যময়, গুরুত্বপূর্ণ সচিত্র বেগম প্রকাশ করেছিলেন মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন এবং তাঁর মেয়ে নূরজাহান বেগম!

আলোকদূতী রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের স্মরণে শ্রদ্ধা নিবেদন করে তাঁর সাহিত্য-সাধনা এবং নারীজাগরণের ক্ষেত্রে তাঁর অবদানের কথা লিখলেন রাবেয়া মাহমুদ। পথিকৃত্ সাহিত্যিক, নারীশিক্ষার জন্য পথ তৈরির কারিগর রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের (১৮৮০-১৯৩২) প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বেগম যাত্রা শুরু করে। তিন বছর ধরে প্রকাশিত সংখ্যাগুলোর বিশেষ কয়েকটি লেখার শিরোনাম তুলে ধরছি: বাংলার প্রাচীন রাজধানী ঢাকা, নারীরা অন্তঃপুরে না বাহিরে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা, শিক্ষিতা মহিলাদের দরবারে, ইতিহাসে মুসলিম নারী, আমাদের শিক্ষা, বিবাহিত জীবনের সুখ-দুঃখ, নারী ও পুরুষ, নারী স্বাধীনতার আন্দোলন, পূর্ব পাকিস্তানের লুপ্ত শিল্প ঢাকার মসলিন, পকিস্তানের নারীর আজাদী, মাতৃত্বের প্রথম বিকাশ, নারী স্বাধীনতা ও ইসলাম ধর্ম, সমাজের প্রতি কর্তব্য, পারিবারিক শান্তি ও শৃঙ্খলা, আধুনিকা মেয়ে, বয়স্কা নারীদের শিক্ষা, বসতবাটি সমস্যা ও নারী, উপনিবেশে নারী আন্দোলন, ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ও নারী সদস্য, সমাজ ও রাষ্ট্রে নারীর অধিকার, প্রগতি ও বাঙালি মুসলিম নারী, মেয়েদের জীবিকা নির্বাহ সমস্যা, বিবাহব্যবস্থা ও মুসলমান সমাজ, স্ত্রীশিক্ষার একটি দিক, শিল্পায়নে নারীর দায়িত্ব, কারা সংস্কার, সহ-অধ্যয়ন বা কো-এডুকেশন, নারীর আজাদী ও মুসলমান সমাজ, শিক্ষিতা নারীর প্রয়োজন ও মুসলিম নারী ও পর্দাপ্রথা, জাতীয় জীবনে নারী, রাজনীতি ও নারী, মেয়েদের জীবনে উচ্চশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা, স্ত্রী স্বাধীনতা ও নারীর সমানাধিকার, ইসলাম ধর্মে বহুবিবাহের তাত্পর্য ইত্যাদি।

যাঁরা লিখেছিলেন তাঁদের নাম: রাবেয়া মাহমুদ, মিসেস রোকেয়া আনওয়ার, আমিনা হোসেন, মায়া গুপ্ত, লতিকা ঘোষ, বেগম ফাতেমা সালাম, খায়রুন্নেছা, ফিরোজা বেগম, কানিজ ফাতেমা, হোসনে আরা, খালেদা খানম বিএ, বেগম সাজেদা খানম বিএ, কাজী রওশন আরা বিএ, প্রতিমা সরকার, লতিকা সেন, বীণা সেন এমএ প্রমুখ।

প্রথম তিন বছর বেগম নানা অস্থির সময় ও পরিবেশের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল। মুসলিম নারীসমাজের শিক্ষাবঞ্চিত অবরোধে জীবনযাপন ও কুসংস্কারে পূর্ণ জীবনের বিষয়ে দৃষ্টি দিয়ে বেগম হঠাত্ করে প্রগতিশীল কথা বেশি না বলে সহনশীলভাবে নারীসমাজের কাছে তথা সমগ্র সমাজের কাছে তুলে ধরেছিল মেয়েদের অধিকার প্রতিষ্ঠার আবেদন। (দ্বিতীয় বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৪৮) বেগম-এর সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছিল যে নারীসমাজের প্রাথমিক কর্তব্য উপযুক্ত গৃহিণী তৈরি করা—ধাত্রী, শিক্ষয়িত্রী ও ডাক্তার তৈরি করা। শিক্ষার প্রসার বাড়লে সমাজে সচেতনতা জাগবে এবং নতুনতর ও উন্নততর আয়ের সন্ধানও পাওয়া যাবে।

সে সময়ের সমাজব্যবস্থার পুরুষতান্ত্রিকতাকে চ্যালেঞ্জ করার মতো শিক্ষাদীক্ষায় ও অধিকার সচেতনতায় জাগ্রত নারীসমাজ সংখ্যায় কম ছিল। রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন বহু আগেই বলেছেন যে নারীর সমকক্ষতা অর্থে আমরা বুঝব পুরুষের সমকক্ষতা। বেগম এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার মতো অগ্রসর কথা ধীরে ধীরে বলেছে। ১৯৪৮-৪৯ সালে সদ্য দেশ ভাগ ও পিছিয়ে থাকা মুসলিম সমাজের কূপমণ্ডূকতাকে আঘাত করার মতো নারীশক্তি বেগম অর্জন করতে পারেনি। তাই সে সময়ের সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছিল, ‘কাজের স্বাধীনতা মানেই পুরুষের সমকক্ষতা অর্থাত্ তার উপযুক্ত কাজগুলোতে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার অস্বাভাবিক চেষ্টা নয়। নিজের উপযুক্ত কাজ করার ক্ষমতা অর্জন এবং স্বাধীনভাবে তা করতে পারার নামই স্বাধীনতা। মেয়েদের সে কাজ বাইরের চেয়ে গৃহে বেশি, কারখানার চেয়ে হাসপাতালে বেশি, আইনসভার চেয়ে স্কুল-কলেজে বেশি।’

এটা সুস্পষ্ট, সে সময় বেগম প্রগতিশীল পদক্ষেপ নিয়েছিল নারীজাগরণের জন্য সাময়িক পত্রিকা প্রকাশ করে। কিন্তু তেমন প্রগতিশীল সম্পাদকীয় লেখার পদক্ষেপ বেগম নিতে পারেনি।

রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন সওগাত ও মহিলা সওগাত এবং বেগম-এর পথপ্রদর্শকরূপে চিরজাগরূক ছিলেন কিন্তু তাঁর সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক চ্যালেঞ্জ বেগম প্রথম তিন বছর কার্যকরভাবে গ্রহণ করতে পারেনি।

তাই বলে বেগম-এ পশ্চাত্পদ ধ্যান-ধারণা ছিল, সেটাও বলা যাবে না। তিন বছর ধরে কলকাতার নানা বাধা ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা, লেখকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার সমস্যা সত্ত্বেও বেগম নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে এবং লেখিকারা লেখার মধ্য দিয়ে প্রগতিশীল চিন্তার বিস্তার ঘটিয়েছেন, সেটা বেগম মূল্যায়নের সময় মনে রাখা দরকার। ১৯৪৭ সালের আগে ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ নেওয়া স্মরণীয় বিপ্লবী নারীদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি বেগম-এ প্রকাশিত হয়েছে ১৯৪৮ সালের ২৮ মার্চ, ১১ এপ্রিল, ২২ আগস্ট সংখ্যায়। গান্ধীজির মুক্তিসংগ্রামের নারী সৈনিকদের পরিচয় পাওয়া যায় ১৯৪৯ সালের ১৪ আগস্ট সংখ্যায়।

১৯৪৭ থেকে ১৯৪৯-এর সংখ্যাগুলোতে সংবাদ ও সম্পাদকীয়তে সে সময়ের রাজনৈতিক বিষয়, উদ্বাস্তু সমস্যা, পাকিস্তান গণপরিষদ গঠন, স্ত্রীলোক ও শিশুদের পুনর্বসতি অপহূতা রমণী উদ্ধার, স্পেশাল মহিলা পুনর্বসতি অফিসার ইত্যাদি প্রকাশের গুরুত্ব আমাদের অনুধাবন করতে হবে।

বেগম কর্তৃপক্ষ এই তিন বছর অব্যাহতভাবে বেগম প্রকাশ করেছে এবং মুসলিম নারীজাগরণের পথ প্রশস্ত করেছে।

অতঃপর ঢাকায় ‘বেগম’

কলকাতা থেকে ১৯৫০ সালে ঢাকায় যখন বেগম স্থানান্তরিত হয় প্রকাশের জন্য, তখন ঢাকায় প্রকাশিত হতো মাহফুজা খানম সম্পাদিত ও কবি গোলাম মোস্তফা পরিচালিত পত্রিকা নওবাহার (১৯৫০-৫৩)। পত্রিকাটি চার বছর ছয় সংখ্যা পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছিল। পত্রিকাটি পাকিস্তানবিরোধী কোনো লেখা ছাপাবে না বলে নীতিমালায় লেখা ছিল। এর আগে ১৯৪৯ সালের জানুয়ারি মাসে সুফিয়া কামাল ও জাহানারা আরজু সম্পাদিত সুলতানা প্রকাশিত হয়েছিল ঢাকা থেকে। এপ্রিল মাসে বন্ধ হয়ে যায় স্বল্পায়ুর এই পত্রিকাটি।

তারও আগে ১৯২১ সালে চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত হয়েছিল সোফিয়া খাতুন সম্পাদিত আননেছা (আরবি শব্দটির অর্থ ‘নারী’)। দুর্লভ এই পত্রিকাটি পরে আন্বেষা নামে উদ্ধৃত হয়েছে।

১৯৩১ থেকে ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল লীলা নাগ (রায়) সম্পাদিত জয়শ্রী পত্রিকা। নারীদের পরিচালিত এই পত্রিকাটি রাজরোষে পড়েছিল এর রাজনৈতিক বৈপ্লবিক ইংরেজ শাসকবিরোধী ভূমিকার কারণে। ১৯৩৫ সালে পত্রিকাটি সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ হয়ে যায়। ১৯৩৮ সাল থেকে জয়শ্রী কলকাতায় প্রকাশিত হতে থাকে। ধর্মভিত্তিক দেশ ভাগের পর সরকারি চাকরিজীবী মুসলিম নারী ও পুরুষ পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। বেগম কর্তৃপক্ষও ঢাকায় বসবাস করার জন্য তত্পর হলো এবং বেগম ও সওগাত প্রকাশনার জন্য ঢাকায় প্রেস ও আনুষঙ্গিক ব্যবস্থাদি শুরু করে। ১৯৫০ সালের মে মাসে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন সপরিবারে এবং প্রেস-প্রকাশনার সঙ্গে সম্পৃক্ত যাঁরা ঢাকায় আসতে চেয়েছেন, তাঁদের নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। স্থানান্তরের নানা সমস্যার জন্য বেগম কয়েক মাস প্রকাশিত হয়নি। ১৯৫০ সালের ৩ ডিসেম্বর থেকে (চতুর্থ বর্ষ প্রথম সংখ্যা) বেগম পুনরায় প্রকাশিত হতে থাকে। এ উপলক্ষে ১০ নভেম্বর বিকেলে বেগম সম্পাদিকা নূরজাহান বেগমের ঢাকাস্থ বাসা ৩৮ নম্বর শরত্ গুপ্ত রোডে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয়। ঢাকা শহরের প্রখ্যাত, স্বনামখ্যাত, শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী, কবি-সাহিত্যিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠানটি তাত্পর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। পূর্ব পাকিস্তানের সমাজব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা, ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির ব্যবস্থাদির ওপর পাকিস্তান রাষ্ট্রীয় মুসলিম লীগ সরকারের প্রতিক্রিয়াশীল নীতিমালায় আঘাত পড়তে থাকে। সেই রকম অবস্থায় বাঙালি প্রগতিশীল নারী-পুরুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের কেন্দ্র হয়ে উঠল বেগম ও সওগাত পত্রিকা।

সে সময় যাঁরা মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের পদক্ষেপকে সাদরে গ্রহণ করে তাঁকে সহযোগিতা করেছিলেন, তাঁদের প্রগতিশীল ভূমিকা জননন্দিত হয়ে আছে।

শামসুন্নাহার মাহমুদ, সুফিয়া কামাল, মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা, হামিদা খানম, হোসনে আরা মোদাব্বের, লায়লা আর্জুমান্দ বানু, মাজেদা আলী, হুসনা বানু খানম, ফওজিয়া সামাদ, শাহজাদী বেগম, লায়লা সামাদ, লিলি খান প্রমুখ শুধু অনুষ্ঠানেই নয়; সব কাজের মাধ্যমে, লেখার মাধ্যমে বেগমকে সহযোগিতা করেছেন।২৭

পুরুষ ব্যক্তিত্বরা লেখা দিয়ে নয় কিন্তু বক্তব্য দিয়ে, পরামর্শ দিয়ে, সহযোগিতা দিয়ে বেগম-এর প্রায় সব অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণে উপস্থিত থাকতেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখ্য হচ্ছেন: ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ, মন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহার, মোহাম্মদ মোদাশ্বের, কবি আহসান হাবীব, কবি খান মোহাম্মদ মঈনুদ্দীন, খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস, কবি ফয়েজ আহমদ, ফজলে লোহানী, আবুল হোসেন, আবদুল্লাহ আল মুতী প্রমুখ।২৮

১৯৫০ থেকে বেগম-এর সম্পাদকীয় ও প্রবন্ধগুলোর বক্তব্যে নতুন দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটেছে। অর্থাত্ নারীর ভূমিকা শুধু গৃহেই নয়, বহির্জগতেও তাঁর ভূমিকা ও অবদান রাখার প্রয়োজন বিষয়ে সম্পাদকীয়তে এবং বিভিন্ন লেখায় গুরুত্ব দেওয়া হয়। পুরুষের বাধা ও পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা করা হয়। এ সময় বেগম পত্রিকায় নারীবিষয়ক প্রগতিবাদী ও চিন্তার প্রতিফলন ঘটেছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অবরোধ প্রথার শিকার নারীদের সচেতন করার ব্রত নিয়েছিল বেগম। নারীসমাজকে পশ্চাত্পদ অবস্থা, অধস্তন অবস্থা, সমস্যা ও অধিকার বিষয়ে সচেতন করাই ছিল বেগম-এর লক্ষ্য।

পূর্ব বাংলার তথা পূর্ব পাকিস্তানের গ্রামাঞ্চলের মেয়েদের জীবনযাত্রার সব ধরনের মানোন্নয়নের কাজে সরকারকে দায়িত্ব পালন করার কথা বলেছে বেগম। সঙ্গে সঙ্গে বেগম জাগাতে চেয়েছে সমাজের বিবেককে। কাব্যে নারীর গুণগান করা হলেও বাস্তবজীবনে নারীর সহযোদ্ধা হিসেবে পুরুষ কখনো আগ্রহ দেখায় না।২৯

সামাজিক প্রবণতা ছিল নারীদের গৃহবন্দী রাখা। বাইরে বের হলেই নারীর পর্দা নষ্ট হয় বলে মনে করত সমাজের হীনম্মন্য পুরুষেরা। পথে বের হলে ঘোড়ার গাড়ির জানালা খোলা রাখতে পারতেন না নারীরা। পথঘাটের পুরুষেরা চিত্কার করত এবং বিভিন্নভাবে উত্ত্যক্ত করত। শহরের তুলনায় গ্রামের নারীদের অবস্থা আরও খারাপ ছিল। বেগম আহ্বান জানাত শহরের নারীদের কাছে, তাঁরা যেন গ্রামে যান এবং গ্রামের মেয়েদের জাগিয়ে তোলার উদ্যোগ নেন।৩০

ঢাকায় প্রকাশ শুরুর সময় থেকে উদার ও আধুনিক চেতনার প্রকাশ ঘটিয়েছে বেগম। মেয়েদের শিক্ষা-চেতনা বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে বেগম। এটাও বলেছে যে সমাজের প্রতিও নারীসমাজের দায়িত্ব আছে।

‘বেগম’ পত্রিকার চিন্তাচর্চা: ১৯৪৭-২০০০

১৯৪৭ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত বেগম পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে; মাঝে কিছু কিছু সময় ছেদ পড়েছে প্রকাশনায়। ২০০০ সাল থেকে শুধু ঈদসংখ্যা, বিশেষ সংখ্যা হিসেবে প্রকাশিত হচ্ছে। নিয়মিত সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করা আর্থিক কারণে সম্ভব হচ্ছে না।

প্রথম তিন বছর কলকাতা থেকে প্রকাশের পর ঢাকায় স্থানান্তরিত হওয়ার সময় নতুন প্রস্তুতিকালে কিছুটা ব্যাঘাত ঘটেছে বেগম প্রকাশনায়। ১৯৫০ সালের ৩ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে প্রথম প্রকাশিত বেগম-এর প্রচ্ছদে লেখা ছিল চতুর্থ বর্ষ, প্রথম সংখ্যা। সেই হিসাবে ১৯৯৭ সালে বেগম-এর ৫০ বছর পূর্তি হয়েছে এবং ২০০০ সালে বেগম পদার্পণ করেছিল ৫৩ বছরে।

সংখ্যার হিসাব-নিকাশ বাদ দিলেও আমরা জানি, বাংলাদেশের দীর্ঘ সময় ধরে অব্যাহতভাবে প্রচারিত সাময়িক পত্রিকাগুলোর মধ্যে বেগম ‘সাময়িক পত্রিকা’ হিসেবেই স্থান করে নিয়েছে। নিছক নারীবিষয়ক হিসেবে নয়। সময়ের হিসাবে ৫৩ বছর ধরে একাদিক্রমে সপ্তাহে একবার প্রকাশিত হওয়ার পর মাসে একবার এবং বছরে একবার মহাকলেবরে ‘ঈদসংখ্যা’ প্রকাশিত হয়েছে। মাঝে অনিবার্য কারণে কখনো কখনো বেগম প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি বলেই ১৯৯৯ সালের ৪ জুলাই প্রকাশিত সংখ্যার প্রচ্ছদে লেখা ছিল ৫০ বর্ষ, প্রথম সংখ্যা। সেই সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে বেগম পত্রিকার প্রথম সম্পাদিকা সুফিয়া কামালের ‘বিশেষ বাণী’। তিনি লিখেছেন:

আলোকদূতী চিরস্মরণীয়া বেগম রোকেয়ার আদর্শ স্মরণ রেখে বেগম-এর প্রথম প্রকাশ, সেই বেগম আজ পঞ্চাশোত্তীর্ণ হতে চলেছে। বেগম-এর আদর্শ ছিল নারীমুক্তি, নারীকল্যাণ, সংসার, সমাজ, দেশ ও জাতির কল্যাণ কামনা নিয়ে নারীজাতি আপন মহিমায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবে।

বেগম কতখানি করতে পেরেছে তা আমাদের বিচার্য নয়। আজ বেগম-এর পঞ্চাশ বছরে পদার্পণ উপলক্ষে নতুন যে প্রজন্ম, তারা যেন বেগম রোকেয়ার আদর্শ নিয়ে বেগম যে পথে অগ্রসর হয়েছে, সেই পথে পরিচালিত হয়। এই আমার আশা ও ভরসা।৩১

সুফিয়া কামালের এই বাণী নতুন প্রজন্মের নারী-পুরুষনির্বিশেষে সবার জন্যই অত্যন্ত শিক্ষণীয় আদর্শ। বেগম একাদিক্রমে ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের যে সমাজচিত্র ও চিন্তাচর্চা ধারণ করেছে, সেটাই প্রমাণ করবে বেগম কী করতে পেরেছে। বেগম-এর প্রবন্ধ, সম্পাদকীয়, সংবাদ, চিঠিপত্র, গল্প, কবিতা, দেশ-বিদেশের খবর ইত্যাদি পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, ৫৩ বছরে নানা বিচিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, মতাদর্শ চিন্তাধারার মাধ্যমে ক্রমবিকশিত ও পরিবর্তনীয় যুগচিত্র ধারণ করেছে পত্রিকাটি।

বিষয়ভিত্তিক শিরোনামে বেগম-এর ৫৩ বছরের প্রবন্ধ, সম্পাদকীয়, সংবাদ ইত্যাদির সূচিপত্র পাওয়া যাচ্ছে নির্বাচিত বেগম, অর্ধশতাব্দীর সমাজচিত্র ১৯৪৭-২০০০ শীর্ষক সংকলন গ্রন্থে।৩২

সূচিপত্রটি এরূপ:

১.            সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামে নারী: ভারত ১৯৪৭-এর আগে, দেশ ভাগ: ১৯৪৭, সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি, রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে, মুক্তিযুদ্ধ (১৯৭১)।

২.         শিক্ষা: নারী/সহশিক্ষা, শিশুশিক্ষা, বয়স্কশিক্ষা, নিরক্ষরতা দূরীকরণ, সাক্ষরতা, সমস্যা।

৩.             নারীসমাজ ঘরে ও বাইরে: রূপচর্চা, স্বাস্থ্য, খেলাধুলা, ক্লাব, পর্দাপ্রথা, কুসংস্কার, রাজনীতি, সমাজসেবা, নাগরিক কর্তব্য, মুসলিম নারী, সংগঠন, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, আন্দোলন, নারীপ্রগতি, পারিবারিক আইন, অনুষ্ঠান।

৪.         কৃতী মহিলা।

৫.         নারীর পেশা: উপার্জন/নতুন নতুন ক্ষেত্র, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, নারীর পেশাগত সমস্যা, নার্সিং, পুলিশ ক্যাডেট কোরের নারী বাহিনী, শ্রমিক ও মজুরি, শিল্পালয়, পতিতাবৃত্তি।

৬.         নারী নির্যাতন: অপহরণ, ধর্ষণ, পাচার, এসিড নিক্ষেপ, হয়রানি।

৭.         নারী-পুরুষ, সহমর্মিতা: সমানাধিকার।

৮.             সংস্কৃতিচর্চা: সাহিত্যচর্চা, চিত্রকলা, আলোকচিত্র, চলচ্চিত্র।

৯.         বিবাহ ও দাম্পত্যজীবন: বিবাহপ্রথা দাম্পত্য সমস্যা, নির্যাতন, পরিবার, পরিকল্পনা, যৌতুক নির্যাতন, বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ, তালাক, গার্হস্থ্য, মাতৃত্ব।

১০.       শিশু ও ভবিষ্যত্ নাগরিক: শিশুমঙ্গল, শিশুস্বাস্থ্য, শিশুশ্রম, সংগঠন-অনুষ্ঠান।

১১.        রাষ্ট্রীয় উদযোগ।

১২.       সমকালীন বিশ্ব: জাতিসংঘ, মহিলা সম্মেলন ও বিশ্ব নারীবর্ষ।

১৩.       দেশ-বিদেশের নারী: নোবেল পুরস্কার, এশিয়া, আফগানিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, চীন, হংকং, জাপান, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, বার্মা, ভারত, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, তুরস্ক, দ. কোরিয়া, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, সিঙ্গাপুর, ইউরোপ, জার্মানি, স্পেন, ফ্রান্স, গ্রেট ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র, বিশ্ব সংবাদ (তৃতীয় বিশ্ব)।

            মধ্যপ্রাচ্য: ইসরায়েল, ইরান, প্যালেস্টাইন, লিবিয়া, জর্ডান, আলজেরিয়া, আরব, কুয়েত, মিসর, ইরাক, আফ্রিকা, সোভিয়েত ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড।

১৪.       ইতিহাসে নারী।

১৫.       বিবিধ।

১৬.       শোক।

কলকাতা থেকে প্রকাশিত হলেও ১৯৪৭ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত তিন বছরের বেগম-এ পূর্ব পাকিস্তানের নারীসমাজের অবস্থা বিষয়েও সংবাদ পরিবেশিত হয়েছে। ধর্মভিত্তিক দেশ ভাগের ফলে কলকাতা থেকে পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকায় ও অন্যান্য শহরে চলে এসেছিল মুসলিম জনগণ এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা। বেগম পত্রিকার সম্পাদিকা সুফিয়া কামাল এবং লেখিকা, সাহিত্যিক ব্যাপকসংখ্যক নারী স্বামী-বাবার পেশাগত কারণে এবং নিজেদের পেশাগত রাজনৈতিক কারণে কলকাতা থেকে পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। দেশ ভাগের বিপন্ন সংকটে উদ্বাস্তু সাধারণ নারীর জীবনে নেমে এসেছিল অপহরণ, নির্যাতন, ধর্ষণ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ইত্যাদি সংকট।

এই সংকটের সময়ে ভারতে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দু সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষ-শিশুরা। ভারত ও পূর্ব পাকিস্তানের বাস্তুহারা নারীদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য বেগম আহ্বান জানিয়েছিল জনগণ ও সরকারকে।

যে স্বাধীনতা ছিল দেশবাসীর আকাঙ্ক্ষিত, সেই স্বাধীনতা অর্জনের পর দেখা গেল, রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে রাজনৈতিক হিন্দু-মুসলিম দেশ ভাগের পাঁয়তারা; কিন্তু দেশবাসী হিন্দু-মুসলিম একসঙ্গে স্বাধীনতা দিবস পালন করেছে, সেই খবরটি বেগম গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করেছে।৩৩

কলকাতায়, ঢাকায়, পাবনায় অনুষ্ঠিত হয়েছে হিন্দু-মুসলিম মহিলাদের প্রীতি সম্মিলন—সেই খবরটি শান্তি প্রতিষ্ঠায় নারীসমাজের অসাম্প্রদায়িক ভূমিকার বিষয়ে তথ্য তুলে ধরেছে। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তানে সে সময় বসবাসকারী কয়েক লাখ হিন্দু নারীসমাজের কাছে বেগম উদাত্তভাবে আবেদন জানিয়েছে যে শিক্ষায়, প্রগতিতে মুসলিম নারীর তুলনায় হিন্দু নারীসমাজ যেহেতু অগ্রগামী, তাই মুসলিম নারীর শিক্ষায় ও প্রগতিতে এগিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে যেন তারা অগ্রণী ভূমিকা নিয়ে সহায়তা করে। বেগম সে সময় থেকেই অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি লালন করে চলেছে। ‘ধর্ম, ঐতিহ্য বা দৃষ্টির প্রশ্নে’ হিন্দু-মুসলিম নারীর মধ্যে বৈষম্য যদি কখনো দেখা দেয়, তা মূল জীবনবোধের আলোকে সমাধান করার আশা পোষণ করেছেন বেগম পত্রিকার সম্পাদিকা ও লেখকবৃন্দ (১:১৪: ১৪ নভেম্বর, ১৯৪৭)। মূলত নারী হিসেবে ধর্মনির্বিশেষে সবার জীবন-সমস্যা এক ও অভিন্ন—এই মতাদর্শে লালিত বেগম সবার কাছেই গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে।

দেশ ভাগের ফলে নারীদের দুর্ভোগ সহ্য করতে হয়েছে অত্যধিকভাবে ‘অপহরণের’ মতো সম্ভ্রমহানিকর নির্যাতনের কারণে। নারীসমাজের এই সম্ভ্রমহানিকর অপহরণের বিষয়ে হিন্দু-মুসলিম নারীনেত্রীরা যুক্তভাবে একটি আবেদন প্রচার করে বলেছেন যে অপহূত নারীদের উদ্ধার করে সমাজে সসম্ভ্রমে প্রতিষ্ঠা না করে ভারত ও পাকিস্তানের নারীসমাজ নিরস্ত হবে না। নারী ও শিশু হত্যা, অপহরণ এবং বলপূর্বক ধর্মান্তরিতকরণ ও বিবাদের বিরুদ্ধে সব ধর্মের নারীসমাজ যদি রুখে না দাঁড়ায়, তাহলে নারীর উন্নতি বাধাগ্রস্ত হবে। এই প্রচারপত্রে যাঁরা স্বাক্ষর করেছিলেন, তাঁদের নাম ছাপিয়ে বেগম দুর্লভ একটি তথ্যসূত্র জনসমক্ষে তুলে ধরেছে।৩৪

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, হাঙ্গামা, লুটপাট, নারী হরণের ঘটনায় পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভীতির খবর জানা যায় বেগম-এর সম্পাদকীয় থেকে। নারীসমাজের পক্ষ থেকে এই পরিস্থিতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন বরিশালের স্নেহলতা দাস ও তাঁর সহযোগী নারীরা। এই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র যেন নারীরা সংগঠিত হয়ে সংঘ-সমিতির মাধ্যমে সাম্প্রদায়িকতা রুখে দাঁড়ান, সেই আহ্বান সম্পাদকীয়তে জানিয়েছে বেগম।৩৫

সেই সঙ্গে বেগম উদ্ধৃত করেছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাণী, যা তিনি পাঠিয়েছিলেন ১৯২১ সালে ‘সর্ববঙ্গ মুসলিম ছাত্র সম্মিলনী’কে। বাণীতে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘যে-শিক্ষা লাভ করছি, ভাগ্যদোষে সেই শিক্ষাই বিকৃত হয়ে আমাদের ভ্রাতৃবিদ্বেষের অস্ত্র জোগাচ্ছে। আজ অন্ধ অমারাত্রির অবসান হোক।’৩৬

দেশ ভাগ-সংকটের সময় প্রকাশিত বেগম প্রশ্নাতীতভাবে গঠনমূলক বলিষ্ঠ প্রগতিশীল ভূমিকা রেখেছে। সে সময়ের বেগম-এর সম্পাদকীয়, সংবাদ, প্রবন্ধগুলোর শিরোনাম উল্লেখ করছি: ‘আমাদের কাজ’, ‘সামাজিক ভাঙন’, ‘অপহূতা নারী উদ্ধার’, ‘দেশের ভবিষ্যত্ ও নারীর দায়িত্ব’, ‘এক বছরের স্বাধীনতা ও নারী’, ‘ঢাকায় মহিলা প্রতিষ্ঠান’, ‘শান্তি অভিযানে নারীদের দায়িত্ব’, ‘সাম্প্রতিক বিশৃঙ্খলা ও আমাদের কর্তব্য’, ‘নারীজাতির অসম্মান’। উল্লিখিত শিরোনাম থেকেই পাঠক বুঝতে পারবেন যে দেশ ভাগের সময়ে বেগম অত্যন্ত সচেতন, দেশপ্রেমিক ভূমিকা নিয়ে সমাজ, রাষ্ট্র ও নারীদের সচেতনতা ও জাগরণ ঘটানোর প্রয়াস করেছে।

লীলা রায়কে যখন পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে চলে যেতে বাধ্য করা হয়, তখন তিনি প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছেন, ‘এক রাষ্ট্রের সংখ্যালঘুদের প্রতি অত্যাচারের প্রতিবাদে অপর রাষ্ট্রের সংখ্যালঘুদের ওপর উত্পীড়ন কাপুরুষোচিত ও অবিবেচকের কাজ। তিনি বলেছিলেন যে লোক বিনিময়ের ব্যবস্থায় ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের বুনিয়াদ মজবুত হবে না।৩৭

লীলা রায়ের এই বক্তব্য প্রকাশ করে বেগম সময়োচিত পদক্ষেপ নিয়েছে। লীলা রায় (নাগ) পূর্ববঙ্গের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, নারীশিক্ষার প্রতিষ্ঠা ও প্রসারে বহু স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা, নারী সমিতির মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষ নারী আন্দোলনের নেত্রী, জয়শ্রী পত্রিকার সম্পাদিকা। তাঁকে পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম লীগ সরকার ১৯৫০ সালে বলপূর্বক পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগে বাধ্য করে মূলত সাম্প্রদায়িক ভূমিকা নিয়েছিল।

দেশ ভাগ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বেগম যে সাহসিকতার ভূমিকা পালন করেছিল, তা সর্বজনীন রাজনৈতিক প্রগতিশীলতার পরিচায়ক। ১৯৪৭ সাল থেকেই পূর্ব পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ছাত্র-জনতার আন্দোলন বিস্তৃত হতে থাকে। রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে বেগম-এ অত্যন্ত সোচ্চারভাবে বাংলা ভাষার সমর্থনে সংবাদ, সম্পাদকীয়, প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার সমর্থনে ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র-জনতার মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণের তীব্র নিন্দা জানিয়ে বেগম প্রগতিশীল চিন্তাধারার ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠা করেছে। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত প্রবন্ধ, সংবাদ ও সম্পাদকীয় পড়ে জানা যায়, রাষ্ট্রভাষা বাংলার সমর্থনে বেগম বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানের মহিলা সমিতি, সংগঠনের নেত্রী ও সদস্যরা এবং শহরে শহরে ছাত্রী ও নারীসমাজ যে প্রতিবাদ সভা ও মিছিল করেছে, সে খবরও গুরুত্বের সঙ্গে বেগম প্রকাশ করেছে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে নারীসমাজের আন্দোলনের তথ্য থেকে আমরা জানতে পারি যে জাতীয় দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানের নারীসমাজ সচেতন ও সংগঠিত হয়ে উঠছিল। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য ছিলেন দুজন ছাত্রী। রাষ্ট্রভাষার আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরাও যুক্ত হয়েছিলেন। নারীনেত্রী ও রাজনীতিবিদ জোবেদা খাতুন চৌধুরানী, দৌলতন নেসা খাতুন, নজিবুন্নেসা খাতুন, সুফিয়া কামাল প্রমুখ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলন করেছিলেন। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলনের বিষয়ে বেগম অল্প পরিসরে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে তথ্যাদি সংযুক্ত করেছে।

মুক্তিযুদ্ধে নারীর অংশগ্রহণ ও ভূমিকার বিষয়ে বাংলাদেশের সরকার, রাজনৈতিক সংগঠন, নারী আন্দোলন ও জনগণ গুরুত্ব দিয়েছে ১৯৯০-এর সময় থেকে। বেগম-এর পাতায় ১৯৭০-এর ১৪ মার্চের সম্পাদকীয়তে বাংলার নারীসমাজকে আহ্বান জানিয়ে লেখা হয়েছিল: ‘জাগো বাংলার নারী’। ঢাকার তত্কালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘোষিত স্বাধীনতাসংগ্রামের আহ্বানে উদ্দীপ্ত সম্পাদকীয়টিতে সারা দেশের নারীসমাজের সংগ্রামী চেতনা ও তত্পরতার বিবরণ থেকে জানা যাবে, সেই সময়ে সংগ্রামী জনতার কাতারে নারীসমাজ অংশ নিয়েছে নিজ নিজ অবস্থান থেকে। সম্পাদকীয়টি খুবই মূল্যবান একটি দলিল হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। বেগম-এর সম্পাদকীয়তে পূর্ব পাকিস্তান নয়, ‘বাংলাদেশ’ বলে আখ্যায়িত হয়েছিল এ দেশ। নারীসমাজ শুধু সংসারের গণ্ডিতেই আবদ্ধ না থেকে দেশমাতৃকার স্বাধীনতার জন্য বীরত্বের সঙ্গে বেরিয়ে এসেছিল রাজপথে, ময়দানে। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানেও তাই ডাক এসেছিল তাঁদের জন্য: ‘বাংলার ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলবেন।’

বেগম সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল, বীরাঙ্গনা শহীদ প্রীতিলতা এই বাংলাদেশেরই মেয়ে ছিলেন।মুক্তিযুদ্ধের পুরো বছর বেগম প্রকাশিত হলেও সে সময় রাজনৈতিক আলোচনা প্রকাশিত হয়নি। সেই সময়ের জান্তা সামরিক বাহিনীর দমননীতির কারণেই সেটা সম্ভব হয়নি। ১৯৭২ সালের জানুয়ারি থেকে মুক্তিযুদ্ধে নারীর অংশগ্রহণ বিষয়ে, লাঞ্ছিত মেয়েদের পুনর্বাসন বিষয়ে বিভিন্ন লেখা, সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। পরবর্তী সময়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা নারীদের সভা-সমাবেশ ইত্যাদির খবর প্রকাশের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে বেগম-এর দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট ইতিবাচকরূপে প্রতিভাত হয়েছে।

বেগম-এর প্রধান ভূমিকা ছিল নারীসমাজের জাগরণ ঘটিয়ে জীবনের নানা ক্ষেত্রে নারীর বিকাশের সম্ভাবনার পথ তৈরি করা এবং তা অব্যাহত রাখা। সেই লক্ষ্য থেকেই সমাজে নারীর অবস্থা যেমন পর্যালোচিত হয়েছে, তেমনি সেই অবস্থার ক্রমবিকাশের পথও নির্দেশিত হয়েছে। নারীমুক্তির প্রশ্নে সমাজ অনুদার ছিল পঞ্চাশ-ষাট-সত্তরের দশকে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও নারীর স্বাধীনতার প্রশ্ন অমীমাংসিত রয়ে গেছে বিশ শতকে তো বটেই, বর্তমানে একুশ শতকেও। পদে পদে স্বাধীন চলাফেরা থেকে শুরু করে মতামত প্রকাশ এবং ঘরে-বাইরে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রেও নারী দীর্ঘকাল ধরে পরাধীন। এ অবস্থার প্রকাশ ঘটেছে বেগম পত্রিকায় বিভিন্ন লেখিকার লেখায়। পর্যালোচিত হয়েছে পর্দাপ্রথা, কুসংস্কার কীভাবে নারীর বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে তুলেছে। কুসংস্কার ও পর্দাপ্রথা বিষয়ে বেগম পত্রিকায় ১৯৪৭ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত লেখিকাদের যে চিন্তাচর্চা ও মতামত-দ্বন্দ্ব প্রকাশিত হয়েছে, তাতে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে কুসংস্কার ও পর্দাপ্রথা-অবরোধ আজও নারীর মন, চেতনা-চিন্তা ও জীবন কেন আচ্ছাদিত করে রেখেছে।

কুসংস্কার ও পর্দাপ্রথার বিরুদ্ধে অব্যাহতভাবে সংগ্রাম চালিয়েছেন লেখিকারা। নানাবিধ সামাজিক কুসংস্কার নারীর ওপরই চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে গ্রাম ও শহরের নারীদের মধ্যে সামান্য পার্থক্য দেখা যায় শিক্ষার কারণে। গ্রাম ও শহরের কূপমণ্ডূক, রক্ষণশীল ও দরিদ্র সমাজের নারীরা নিরক্ষর অথবা শিক্ষাবঞ্চিত থাকেন বলে তাঁদের মনমানসিকতা কুসংস্কারাচ্ছাদিত থাকে। অর্থনৈতিক সংকট ও পুরুষ আধিপত্যের দমননীতিতে নারীরা সব রকম সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকেন। নারীর অবরোধের বিরুদ্ধে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন যে সংগ্রাম করে গেছেন, বেগম-এর লেখিকারা সেই ঐতিহ্য অনুসরণ করে দীর্ঘ ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে সংগ্রাম করে গেছেন।

মেয়েদের মন, চেতনা ও বিশ্বাসের পরিবর্তন ঘটানোর জন্য তাঁরা গল্প, কবিতায় প্রগতির পথ রচনা করেছেন।লেখিকারা দেশ-বিদেশের আদর্শস্থানীয়, প্রতিষ্ঠিত, স্বনামখ্যাত, কৃতী নারীদের জীবনী লিখেছেন এই লক্ষ্যে, যেন সমাজের রক্ষণশীল পুরুষ ও নারী সবাই প্রগতির ধারায় বিশ্বাস গড়ে তুলতে পারেন। নানা প্রবন্ধে, সংবাদে, সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছে যে মেয়েদের অদ্ভুত কুসংস্কার দূর করতে হবে শিক্ষা ও সংস্কৃতির আলো দিয়ে। তাঁরা বলেছেন, কুসংস্কার চিরদিনই অগ্রগতির পথ বন্ধ করে রাখে। বিজ্ঞান ও যুক্তি দিয়ে সমস্যা সমাধানের কথা না ভেবে সমাজের পিছিয়ে থাকা রক্ষণশীল পুরুষ-নারী সবাই ভুয়া পীর, সাধু, পুরোহিত, গণক, ওঝাদের কাছে যান এবং তাদের কথা বিশ্বাস করে প্রগতির অন্তরায় হয়ে দাঁড়ান। কুসংস্কারের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী আন্দোলনের ডাক দিয়ে লেখিকারা বলেছেন, নারীসমাজকে বেরিয়ে আসতে হবে পরনির্ভরতার বন্দী অবস্থা থেকে।

বিয়ের আগে বাবার অথবা ভাইয়ের, বিয়ের পর স্বামীর আর তৃতীয় পর্যায়ে ছেলেমেয়ের ‘শেল্টারে’ থাকা লাখ লাখ নারী ভাবতে পারেন না যে তাঁর নিজেরও মানুষ হিসেবে অস্তিত্ব আছে। সেই অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম নারীকেই করতে হবে। বেগম-এর লেখিকারা দৃঢ়ভাবে বলেছেন, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, সরকার—সবাইকেই এগিয়ে দিতে হবে নারীকে স্বনির্ভরতা ও মুক্তির পথে।

নারী ঘরে যেমন সংসারে নিবদ্ধ, তেমনি বাইরে সমাজসেবামূলক কাজে, সমিতি-সংগঠনের কাজে যুক্ত। উপরন্তু, নাগরিক কর্তব্য সাধনেও নারী পিছিয়ে নেই। রাজনীতিতে নারী যেমন ভোটার হিসেবে দক্ষ, তেমনি নির্বাচনে দাঁড়িয়ে সংসদে, ইউনিয়ন পরিষদেও নির্বাচিত হচ্ছেন; জনপ্রতিনিধি হয়ে দেশের কাজেও পুরুষের সমকক্ষ হয়ে উঠেছেন।

এই পথপরিক্রম, অর্থাত্ ঘর থেকে বাইরের জগতে, চলতি বিশ্বাসে, যা পুরুষের জগত্ নারীর পদচারণের জন্য যেমন নারী সংগঠন আন্দোলন কার্যকর প্রেরণা ও ক্ষমতা জুগিয়েছে, তেমনি বেগম-এর লেখায়, দৃষ্টিভঙ্গিতে, চিন্তাচর্চার ক্ষেত্রে নারীপ্রগতির পথপ্রস্তুতির প্রমাণ পাওয়া যায়।

সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তাচেতনার কাঠামোটা পিতৃতান্ত্রিক অনুশাসনে জর্জরিত। নারীর শিক্ষা, পেশা, খেলাধুলা, সংস্কৃতিচর্চা, গান ও নাচের চর্চা, অভিনয় ও নাট্যচর্চা ইত্যাদি প্রশ্নে বাংলাদেশের সমাজ দ্বিধাবিভক্ত। ইসলাম ধর্মের দোহাই দিয়ে সমাজের একাংশ বলছে, নারীর স্থান ঘরের ভেতরে, মাতৃত্বই নারীর ভূষণ, স্বামীসেবা, সন্তান প্রতিপালন, একান্নবর্তী পরিবারের শ্বশুর-শাশুড়ি, দেবর-ননদ—সবার প্রতি দায়িত্ব পালনে ঘরের বধূটির ভূমিকা নির্দেশ করে দেয় সমাজ। অন্যদিকে নারীর ভূমিকা বিষয়ে ইসলামের উদার ইতিবাচক আদর্শের উদাহরণ তুলে ধরে সমাজের প্রগতিবাদীরা বলেন, ইসলাম নারীকে যেসব অধিকার দিয়েছে, সেসব যেন আর লঙ্ঘিত না হয় তার ব্যবস্থা করা দরকার।

সেই লক্ষ্যে তুরস্ক, রাশিয়ার উদাহরণ দিয়ে বেগম-এর সম্পাদকীয়তে সুস্পষ্টভাবে লেখা হয়েছে যে নারীকে গৃহে বন্দী না রেখে পূর্ণ মনুষ্যত্বের অধিকার দেওয়া প্রয়োজন। দেশ ভাগের পর থেকেই বেগম সুদূরপ্রসারী চিন্তা প্রকাশ করেছে যে পাকিস্তান রাষ্ট্রে নারীর সম-অধিকার দেওয়া দরকার।

দেশের রাজনীতির ঘটনাপ্রবাহে নারীর অবস্থান এবং নারীর রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ে সুচিন্তিত প্রবন্ধ লিখেছেন রেবেকা সুলতানা চৌধুরী, বেগম এ খাতুন, কল্যাণী দত্ত, হামিদা আখতার চৌধুরী, দিলারা খানম বিএ, ড. নীলিমা ইব্রাহিম, ড. খালেদা সালাহউদ্দিন প্রমুখ।

এঁদের লেখায় আমরা পাই রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণের সমর্থনে সুচিন্তিত বক্তব্য। রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ বিশ শতকের পঞ্চাশের দশক থেকেই উল্লেখযোগ্য হয়ে আছে। সেই সময়ের রাজনীতিবিদ আনোয়ারা খাতুন, আশালতা সেন, শায়েস্তা একরামুল্লাহ, শামসুন্নাহার মাহমুদের কর্মকাণ্ড এবং সরকারের ভূমিকা বিষয়ে তাঁদের বক্তব্য বেগম নিয়মিত প্রকাশ করে দেশের সবার কাছে পৌঁছে দিয়েছে। সে সময় রাজনীতিবিদ ও রাজনীতিসচেতন নারীসমাজ সভা-সমাবেশ করে আইন পরিষদে নারী প্রতিনিধির সংখ্যা বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে। নির্বাচিত কয়েকজন নারী সদস্যের সম্মানে পূর্ব পাকিস্তান ফেডারেশনের ময়দানে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের নারীদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। জানা যায়, বদরুন্নেসা আহমেদের সভানেত্রীত্বে অনুষ্ঠিত সভায় নূরজাহান মুরশিদ, দৌলতুন্নেসা, রাজিয়া বানু, মেহেরুন্নেসা বেগম প্রমুখ পরিষদ সদস্যরা উপস্থিত থেকে বলেছিলেন, যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা ও নারীসমাজের দাবিদাওয়া বাস্তবায়ন করতে হলে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন।

সভায় গৃহীত গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবগুলো প্রণিধানযোগ্য: পাকিস্তানের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা রক্ষার্থে পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি সরাসরি প্রত্যাখ্যান, সমস্ত কালাকানুন বাতিল, রাজবন্দীদের মুক্তি এবং ব্যক্তিস্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা, বিনা খেসারতে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ, মেয়েদের জন্য বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন, মেয়েদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পুনর্গঠন, প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে মেয়েদের জন্য হাসপাতাল ও মাতৃসদন স্থাপনেরও দাবি জানানো হয়। সভায় ইলা মিত্রের রোগমুক্তি কামনা এবং তাঁর ওপর থেকে সমস্ত বিধিনিষেধ উঠিয়ে নেওয়ার দাবি করা হয়।৩৮

এ রকম প্রকাশ্য সভার বিরুদ্ধে রক্ষণশীল জনগোষ্ঠী ও রাজনৈতিক বিরুদ্ধ পক্ষের চরম বাধা ছিল। সভাটি হওয়ার কথা ছিল পল্টন ময়দানে। এই সভার বিরুদ্ধে একটি পুরুষ-মিছিল হওয়ায় নারী সমাবেশটির স্থান বদল করা হয়। প্রগতিবাদী পুরুষেরাও সমাবেশে যোগ দিয়েছিলেন। বেগম এই সংবাদগুলো মহিলাজগত্ সংবাদ ও সম্পাদকীয়তে বিশদ মন্তব্যসহ প্রকাশ করেছে এবং নারীসমাজের প্রগতির পক্ষে সমর্থন দৃঢ় করেছে। নারীসমাজের প্রতিনিধিস্থানীয় নেত্রী ড. নীলিমা ইব্রাহিম ‘মৌলিক গণতন্ত্র ও পাকিস্তানি নারী’ শিরোনামে লেখা প্রবন্ধে মৌলিক গণতন্ত্রের সমালোচনা করেন এবং নারীসমাজকে আহ্বান জানিয়েছেন যেন তারা সঠিক প্রতিনিধিকে নির্বাচিত করে।৩৯

দেশে যখন সামরিক শাসন চলছে, তখন নারীর রাজনীতির চর্চা বিষয়ে বেগম সাহসের সঙ্গেই গণতন্ত্রের সমর্থনে প্রবন্ধ, সংবাদ, সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছে।নারীর মুক্তিসাধনের লক্ষ্যেই বেগম-এ লেখিকারা প্রবন্ধ লিখেছেন, প্রত্যন্ত অঞ্চলের সংবাদ পাঠিয়েছেন, মহিলাজগতের পাতার জন্য লিখেছেন। শিক্ষার আকাঙ্ক্ষা, উচ্চশিক্ষা, সহশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা নারীর চেতনা জাগানোর জন্য উপলব্ধি করেছিলেন শিক্ষায় অগ্রগামী লেখিকারা। নারীশিক্ষা, সহশিক্ষা, শিশুশিক্ষা, বয়স্কশিক্ষা ও সাক্ষরতা বিষয়ে বেগম-এর লেখক ও পাঠকসমাজের আকাঙ্ক্ষা জানা যায় প্রবন্ধ, সংবাদ ও চিঠিপত্র কলামের লেখা থেকে।

৫০ বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে নারী-শিশুর পথ প্রশস্ত করে তৈরি করা হয়েছিল বহু নিবেদিত শিক্ষয়িত্রী ও শিক্ষা সংগঠক। দেশ ভাগের পর যখন বাংলাদেশ থেকে ভারতে চলে গেলেন প্রতিষ্ঠিত বহু শিক্ষয়িত্রী ও ছাত্রীসমাজ, তখন সেসব শিক্ষাকেন্দ্র পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন কলকাতা থেকে পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসা শিক্ষয়িত্রীরা, যাঁরা সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুলের ছাত্রী ও শিক্ষয়িত্রী ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানে মুসলিম পরিবারে নারীশিক্ষার প্রচলন কম ছিল। রক্ষণশীলতা, পর্দা-অবরোধ, কুসংস্কার, বাল্যবিবাহ—এসব নারীশিক্ষার পথে বাধা হিসেবে ছিল। এরই সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত ছিল নারীর ভূমিকা ও দায়িত্ব বিষয়ে রক্ষণশীল মনোভাব। নারীর কর্তব্যও গৌরবজনক ভূমিকা হিসেবে সংসারের ও মাতৃত্বের গুরুত্ব নারী-পুরুষনির্বিশেষে ব্যাপক মানুষের মনে, সরকারের নীতিনির্ধারকদের মানসিকতার গভীরে প্রোথিত করেছিল। তাই নারীদের জন্য পাঠ্যসূচি কী হবে, সে বিষয়ে বিতর্ক-আলোচনা করেছিল পরিবার-সমাজ-শিক্ষাকেন্দ্রে। সেসব মুক্ত আলোচনা বেগম ধারণ করেছে। ‘স্ত্রীশিক্ষা’ শিরোনামে বেগম সালেহা আনোয়ার তাঁর প্রবন্ধে লিখেছেন:

এই সভ্য জগতে ও আমাদের দেশে স্ত্রীশিক্ষা নিয়ে নানাভাবে তর্কবিতর্ক চলছে। স্কুল-কলেজের তর্কসভাগুলোতেও এ নিয়ে বিতর্কের অন্ত নেই। কেউ লেখেন বা বক্তৃতা দেন স্ত্রীশিক্ষার পক্ষে আবার কেউ বিপক্ষে। সাধারণত স্ত্রীশিক্ষার বিরোধীরা বলে থাকেন যে শিক্ষার প্রয়োজন একমাত্র পুরুষেরই আছে। স্ত্রীলোকের পড়াশোনা করার কোনো প্রয়োজন নেই। তাঁরা এই মতও প্রকাশ করেন যে নারীজাতিকে শিক্ষা দিলে ক্ষতি হবে, তারা উচ্ছৃঙ্খল হয়ে পড়বে।...আমাদের একটি বদ্ধমূল ধারণা, নারীজাতিকে শিক্ষা দিতে গেলে তাদের পর্দা নষ্ট হবে।...কিন্তু উপরোক্ত মতামতসমূহ একেবারেই ভুল। ইহা অজ্ঞানতা, কুসংস্কার ও সংকীর্ণতা বৈ কিছুই নয়। পুরুষের সাথে স্ত্রীকেও শিক্ষা দেওয়া ইসলামেরও আদেশ।৪০

পাঠ্যসূচি বা কারিকুলাম ও পাঠ্যবই নিয়ে আলোচনা লিখেছেন অনেকেই। নারী কি পুরুষের মতো একই পাঠ্যবই পড়বেন, নাকি ভিন্ন কারিকুলাম বা বিশেষ বই পড়বেন, এ প্রশ্নও উঠেছে ১৯৫০-১৯৭০ সালের মধ্যে। প্রগতিবাদী নারীরা তাঁদের শিক্ষার পক্ষে লিখলেও জোর দিয়েছেন পুরুষের শিক্ষা থেকে ভিন্ন রকম শিক্ষার কারিকুলামের পক্ষে। লিখেছেন:

কতকগুলো বিষয়ে নারীর ভিন্নরকম শিক্ষা দরকার।...স্বামী-ভ্রাতা-পুত্র-পরিজন যেন এই দুঃখময় সংসারে নারীর থেকে পেতে পারে সান্ত্বনা, সেবা এবং মধুর বাণী—এরূপ সর্বাঙ্গীণ শিক্ষা পাওয়াই নারীজাতির উচিত। এতেই প্রতি গৃহে গৃহে দেবে পূর্ণ শান্তি, শৃঙ্খলা এবং সুখ।৪১

অন্যদিকে ভিন্ন স্বর শোনা গেল সোচ্চার এক লেখায়:

নারীশিক্ষা, নারী-আন্দোলন, নারীপ্রগতি, নারীস্বাধীনতা—এই রকম কথা সমাজের রক্ষণশীল মনোভাবাপন্ন ব্যক্তি শুনলে বেশ খাপ্পা হয়ে ওঠেন।...এঁদের ধারণা, নারীসমাজের স্বাধীনতা বা শিক্ষার মানে স্বেচ্ছাচারিতার প্রশ্রয় দেওয়া।...স্বাধীনতা ও স্বেচ্ছাচারিতা এক কথা নয়, সুতরাং এতে ভয়াবহ কিছু লুক্কায়িত নেই। প্রকৃত শিক্ষাই একটি জাতির পক্ষে আত্মনির্ভরতার প্রধান সহায়ক।...শুধু সংসারেই স্ত্রীজাতি নিয়োজিত থাকবে, তার কোনো মানেই নেই। এর বাইরে তার একটা বিরাট স্থান আছে, যা তাকে দখল করতে হবে বইকি। রাষ্ট্রের মঙ্গল কামনায় তাকে পূর্ণ স্থান পেতে হবে। তাই স্ত্রীজাতিকেও রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমরনীতিতে পারদর্শী করতে হবে। এ ছাড়া স্ত্রীজাতির বিকাশের সম্ভাবনা কোথায়?৪২

নারী সংগঠন, নারী আন্দোলনে তখন সচেতন রাজনীতিবিদ, সমাজসেবী, কবি, সাহিত্যিক, লেখক নারী ব্যক্তিত্বরা নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। তাঁরা নিজ উদ্যোগেই নারী শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন, উদ্বোধন ও পরিচালনা করেছেন। সেই সব খবর বেগম গুরুত্ব সহকারে ‘সংবাদ’ ও ‘মহিলাজগত্’ বিভাগে প্রকাশ করেছে।

শুরুতে যা ছিল তর্ক-বিতর্কের বিষয় এবং উচিত-অনুচিতের বেড়াজালে আবদ্ধ, সেই নারীশিক্ষার ক্ষেত্র বিস্তৃত হতে থাকে ষাটের দশকেই। নারীর সহশিক্ষার প্রশ্নে মুসলিম সমাজে-পরিবারে নিষেধাজ্ঞা অব্যাহত থাকায় বেগম-এর সম্পাদকীয়তে, লেখিকাদের প্রবন্ধে জোর দিয়ে দাবি জানানো হচ্ছিল যে মেয়েদের জন্য মেডিকেল স্কুল, কারিগরি শিক্ষাকেন্দ্র চালু করা হোক। কিন্তু পাকিস্তান সরকার সেই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে। এই খবরে বেগম তীব্র ভাষায় প্রতিবাদ জানিয়ে সম্পাদকীয়তে লিখেছে:

এ সংবাদ সত্য হলে আমরা তার প্রতিবাদ না করে পারি না।...আমরা চিকিত্সা-শিক্ষার ক্ষেত্রে সহশিক্ষাপ্রথার বিরোধী নই। কিন্তু যে-পরিমাণ সামাজিক কুসংস্কার এখনো আমাদের দেশে বর্তমান রয়েছে, তাকে উপেক্ষা করলেই সহশিক্ষা চালু হবে না; তার ফলে বরং চিকিত্সা-শিক্ষাই বাধাগ্রস্ত হবে।৪৩

এরপর বহু বছর ধরেই শিক্ষা, উচ্চশিক্ষা, সহশিক্ষার ক্ষেত্রে নারীর অনুপ্রবেশ বাধাগ্রস্ত ছিল। বাধা অতিক্রম করে সমাজ অগ্রগতির সঙ্গে নারীশিক্ষার হার বেড়ে, ফলাফলের ক্ষেত্রেও নারীদের অগ্রগামী অবস্থান বাংলাদেশের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার ফলাফল বিবরণীতে পাওয়া যাচ্ছে। তবু রয়ে গেছে নানা সমস্যা।

প্রয়োজনের তুলনায় মেয়েদের শিক্ষাকেন্দ্র কম, গ্রামাঞ্চলে বসতবাড়ি থেকে বহু দূরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অবস্থিত বলে যাতায়াতের সমস্যা, পথেঘাটে বখাটেদের উত্পাতে আজও মেয়েদের শিক্ষা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে একুশ শতকের প্রথম দশকে স্কুল-কলেজের ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করা বেড়েছে। নির্যাতিত ছাত্রীদের আত্মহত্যার ঘটনাও বেড়েছে। ফলে গ্রামবাংলাজুড়ে লাখ লাখ অভিভাবক মেয়ের পড়া বন্ধ করে দিয়েছেন।

৫০ বছরের বেশি সময় ধরে নারীশিক্ষার যাত্রাপথটি কুসুমাস্তীর্ণ হলো না কেন, সেই তথ্যও বেগম পত্রিকায় পাওয়া যাচ্ছে। বর্তমানে নারীশিক্ষা-বয়স্কশিক্ষা-সাক্ষরতা-সহশিক্ষা-শিশুশিক্ষার সঠিক চিত্রটি যেমন নিরাশাব্যঞ্জক, তেমনি আশাব্যঞ্জকও বটে। এই আশার ক্ষেত্র সন্ধানে বেগম-এর মসিযুদ্ধ যখন দৃশ্যমান হয়ে ওঠে, তখন জানা যায়, অবরোধ মুক্তির পথে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের আদর্শ-অনুসারী হয়ে ঘরে ঘরে কীভাবে শিক্ষার দীপ জ্বালিয়ে দিয়েছিল বেগম।

শিক্ষা যখন নারীর চেতনাকে জাগিয়ে তুলল, তখন পরিবারের অভিভাবক ও সমাজের অভিভাবক নারীর বিরুদ্ধে রক্তচক্ষু দিয়ে শাসন করে তাঁদের আর অবরুদ্ধ রাখতে পারেননি। সচেতন নারীর আবির্ভাব ঘটল ঘরে এবং পদচারণ ঘটল বাইরে। এই যাত্রাপথে যেমন রক্ষণশীলতার কুসংস্কারের কাঁটা বিছানো ছিল; যেমন ছিল পর্দা-অবরোধ, অধিকার-বঞ্চনা, বৈষম্য-বাধা; তেমনি ছিল প্রগতির অপ্রতিরোধ্য সংগ্রাম এবং রূপচর্চা, স্বাস্থ্যমূলক, সাংস্কৃতিক, ক্রীড়া অনুষ্ঠান, সংগঠন-ক্লাব-সমাজসেবা-রাজনীতি-আইনি অধিকার নিয়ে আন্দোলন, নাগরিক কর্তব্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে নারীসমাজের নানা বিচিত্র ইতিবাচক কর্মকাণ্ড। পূর্ব পাকিস্তানে নারী জাগরণের, প্রগতির এই স্বর্ণ অধ্যায়টি নানা বিষয়-সম্ভারে উপস্থাপিত হয়েছে বেগম পত্রিকায়।

এ পর্যায়ে বাংলাদেশের পরিবার-সমাজ-প্রতিষ্ঠান-রাষ্ট্র—নানা ক্ষেত্রে দেদীপ্যমান কৃতী নারীর নিজস্ব পেশাগত ও স্বেচ্ছা কাজের পরিচিতি স্থান করে নিতে থাকে। বহু সন্তানের মা যখন উনিশ শ চল্লিশ-পঞ্চাশের দশকে শিক্ষাগত প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি অর্জন করছিলেন, পেশাগত কৃতিত্ব অর্জন করছিলেন, তখন কৃতী নারীর সাফল্য সমাজের চেহারাটা পাল্টে দিচ্ছিল। কৃতিত্বের এই স্বরূপ ৫০ বছরের বেশি সময়ব্যাপী বেগম-এ উপস্থাপিত হয়েছে।

পরবর্তী সময়ে কৃতী নারীর পরিচয় শিক্ষক, নার্স, ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত সদস্য, চিকিত্সক, স্থপতি, বিচারক, ব্যারিস্টার, আইনজীবী, ব্যবসায়ী, সংসদ সদস্য, থানা প্রশাসক, পুলিশ, এসপি, সামরিক সেনাসদস্য, প্রশাসনিক নীতিনির্ধারক, রাজনৈতিক দলের শীর্ষস্থানীয় নেত্রী, রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীরূপে দেদীপ্যমান হতে থাকে। তখন সেই কৃতী নারীর ভূমিকা পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্রের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে নতুন অধ্যায় সৃষ্টি করতে থাকে।

পেশা ও উপার্জনের নতুন নতুন ক্ষেত্র নারীর স্বনির্ভরতার সূচনা করেছিল। শহরের শিক্ষিত নারী যেমন নানা ক্ষেত্র খুঁজে পেলেন, তেমনি গ্রামীণ নারী দারিদ্র্যমুক্তির জন্য অর্থনৈতিক কাজের খোঁজে কৃষি, শিল্প, গার্মেন্ট, কুটিরশিল্প প্রভৃতি ক্ষেত্রে মজুর-শ্রমিক-কর্মী হতে থাকলেন। ৫০ বছর ধরে অর্থনৈতিক পেশায় উপার্জনের ক্ষেত্রে নারীর পথ যেমন প্রশস্ত হয়েছে, তেমনি নানাবিধ সমস্যাও যুক্ত হয়েছে। প্রতি সপ্তাহে, প্রতি মাসে সেসব বিষয়ে বেগম প্রবন্ধ, খবর, সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছে।

নারীসমাজ যখন বহির্জগতে স্থান করে নিতে থাকল, তখন নারী নির্যাতনের নৃশংসতা তাকে আক্রমণ করতে থাকে। অপহরণ, ধর্ষণ, পাচার ও এসিড নিক্ষেপে নারীর শারীরিক-মানসিক অত্যাচার, সামাজিক-রাষ্ট্রীয় সহিংসতার রূপ নিয়েছে নানা প্রক্রিয়ায়। সেসব বিষয়ে বেগম প্রকাশ করেছে খবর, প্রবন্ধ; তীব্র প্রতিবাদে সম্পাদকীয় হয়ে উঠেছে আন্দোলনের প্রতীক।

নারীসমাজের প্রতি নির্যাতন-সহিংসতার কারণ অনুসন্ধানে জানা যায়, নারী ও পুরুষের সমানাধিকার পরিবার-সমাজ-প্রতিষ্ঠানের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। নারীসমাজের প্রতি আরোপিত সামাজিক বৈষম্য ও অসাম্যকে ধর্মীয় বিধানের অজুহাতে পরিবার-সমাজ-সরকার প্রশ্রয় দিয়ে চলেছে। নারী-পুরুষের সমানাধিকার বিষয়ের পক্ষে-বিপক্ষে একুশ শতকেও পরিবার, ব্যক্তি, সমাজ, ধর্ম, রাষ্ট্র, আইনে তর্ক-বিতর্ক অব্যাহত রয়েছে। বেগম-এর পাঠকসমাজের চেতনা জাগরণের লক্ষ্যে এবং সমাজ থেকে, রাষ্ট্র থেকে নারীর সমানাধিকারের বিরুদ্ধতা দূর করার জন্য নানা প্রবন্ধে, গল্পে, কবিতায়, সম্পাদকীয়তে বেগম মসিযুদ্ধ করেছে অব্যাহতভাবে। প্রগতির চিন্তাচর্চা তো বটেই, রক্ষণশীল মতাদর্শের বিরুদ্ধতাও এই প্রচেষ্টার মধ্যে লক্ষ করা যায়। বলতেই হয়, বেগম এ ক্ষেত্রে সমাজদর্পণরূপে ভূমিকা রেখেছে।

পরিবারের মধ্যে নারী যখন দাম্পত্য জীবন যাপন করেন, তখন স্ত্রী হিসেবে, মা হিসেবে যেমন আনন্দ পান, তেমনি বিবাহপ্রথার নানা জালে আবদ্ধ হন; নানা জটিলতায়, সমস্যায় ভুক্তভোগী হন। সমাজ-সংস্কৃতি-ধর্ম-আইন-রাষ্ট্র নারীর জন্য বৈষম্য-বঞ্চনা আরোপ করে। ধর্ম, সমাজ, পারিবারিক আইন প্রণয়নের নামে বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ, তালাক, বিবাহ পুনরুদ্ধার, সন্তানের অভিভাবকত্ব ইত্যাদি প্রশ্নে নারীর মানবাধিকার হরণ করে চলেছে সমাজ ও রাষ্ট্র। বিবাহপ্রথায় যৌতুক-নির্যাতন, শারীরিক-মানসিক নির্যাতন এবং গার্হস্থ্য ও মাতৃত্বের দায়িত্ব, কর্তব্য নারীর ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে এবং পিতার ভূমিকা উহ্য রাখা হচ্ছে। বিষয়টি সামাজিকীকরণ-প্রক্রিয়ায় পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাকে অব্যাহত রাখা হচ্ছে। বেগম-এর সাহিত্যিকেরা গল্প-কবিতায় এ বিষয়গুলো নিয়ে চর্চা করেছেন, প্রবন্ধ লিখেছেন। সম্পাদকীয় লেখা হয়েছে নারীর মানবাধিকার হরণের বিরুদ্ধে।

পরিবারে শিশুর আগমন আনন্দ বয়ে আনে। শিশুর জন্ম ও বিকাশে ভবিষ্যত্ নাগরিকের গুরুত্ব নিয়ে রাষ্ট্রকেও ভাবতে হয়। শিশুদের সংগঠিত করে শিক্ষা-সংস্কৃতিচর্চায় সম্পৃক্ত করা, শিশুর অংশগ্রহণে সমৃদ্ধ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা ইত্যাদি শিশুর জীবন-মন সুন্দর করে তোলে। এর পরও দেখা যায়, দারিদ্র্যের কশাঘাতে এবং সমাজের অনুদারতায় বাস্তবে শিশুর অবস্থা নারীর মতোই সঙ্গিন হয়ে ওঠে। শিশু অপহরণ, শিশুশ্রম, শোষণ, শিশু নির্যাতন—এসব করুণ বাস্তব ঘটনার নিদর্শন বেগম প্রতিনিয়ত, প্রতি সংখ্যায় প্রকাশ করেছে নানা নিবন্ধে শিশুমঙ্গলের আকাঙ্ক্ষায়।

সমকালীন বিশ্বে নারীসমাজের কৃতিত্ব, জীবনধারা, নারী আন্দোলন ও প্রগতির বিষয়ে বেগম গুরুত্ব দিয়ে নিবন্ধ প্রকাশ করেছে; বাংলাদেশের শহর ও গ্রামের নানা স্তরের নারীসমাজের চিন্তাচেতনার বিকাশ ঘটানোর লক্ষ্যে। বেগম-এর মূল লক্ষ্যের অন্যতম ছিল, নারীদের সাহিত্য রচনায় উদ্বুদ্ধ করে নারী-সাহিত্যিক গড়ে তোলা। সাহিত্য-সাময়িকী পত্রিকায় পুরুষের আধিপত্যের কারণে নারীর লেখা প্রকাশিত হওয়ার পথ রুদ্ধ ছিল। মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন সওগাত, মহিলা সওগাত এবং পরে বেগম পত্রিকার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত লেখিকাদের পাশাপাশি নতুন লেখিকাদের গল্প-কবিতা লেখার চর্চার ক্ষেত্রে উত্সাহ দিয়েছেন; সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চায় নারীরা এগিয়ে এলেন।

বেগম পত্রিকায় রম্য রচনা, ব্যঙ্গ, হাসি, সুচিকাজ, ব্যায়াম শিক্ষা ইত্যাদিও প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত হয়েছে বিরল স্বনামখ্যাত ব্যক্তিদের সাক্ষাত্কার।

এককথায় বেগম পত্রিকা যুগকালের সমাজচিত্র ধারণ করেছে লেখার মাধ্যমে। প্রগতিবাদী পদচারণ ও ভূমিকায় বিশ শতকের শেষার্ধ যুগের ইতিহাস হয়ে আছে বেগম।

উপসংহার

বেগম বিষয়ে কাজ করতে গিয়ে সম্প্রতি কথা বলেছি বর্তমান সম্পাদিকা নূরজাহান বেগমের সঙ্গে। প্রথম সম্পাদিকা সুফিয়া কামালের সঙ্গে বেগম বিষয়ে আলোচনার সুযোগ পেয়ে ধন্য হয়েছি।

আমরা যেভাবে দেখেছি, এ সমাজে বেগম-এর প্রগতিবাদী পদচারণ, সে ক্ষেত্রে ভিন্নমতও আছে। কারও কারও৪৪ ধারণা যে বেগম পান খাওয়া, রান্না-ঘরকন্নায় ব্যস্ত ‘বিবি’ ‘পাত্র প্রভু’দের আকর্ষিত করার পন্থা হিসেবে রূপচর্চায় নিমগ্ন ‘বিবি’দের ধারণ করে বলেছে ‘নারী জাগরণের বিভ্রান্ত’পূর্ণ কথা। তাঁরা বলেন যে বেগম  নারীপ্রগতির ধারক নয়। ‘বিবি’ থেকে ‘বেগম’ বা ‘মিসেস’ বা ‘ওয়াইফ’ সবার অবস্থাই অভিন্ন বলে তাঁরা মনে করেন। বেগম-এর কর্ণধার; প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সব উদ্যোগের নেতৃত্ব দিয়েছেন যাঁরা, অর্থাত্ মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন, শামসুন্নাহার মাহমুদ, সুফিয়া কামাল, নূরজাহান বেগম প্রমুখ সংগ্রাম-আন্দোলন করে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিকূল অবস্থার বিরুদ্ধে নারীপ্রগতি ও জাগরণে যে অবদান রেখেছেন, সে বিষয়ে বিভ্রান্তিকর মন্তব্য ও পর্যালোচনা দুঃখজনক।

বেগম-এ লিখেছেন হাজার-লাখো নারী। শুরুতে দু-চারজন ভদ্রলোক লিখেছেন, স্ত্রীর নামে সেই লেখা প্রকাশ করতে বেগম-এ পাঠিয়েছেন। কিন্তু এসবই সামান্য ও বিচ্ছিন্ন ঘটনা। প্রথাগত দৃষ্টিতে বেগম আলোচিত হলে সুবিবেচনা হবে না। বেগম-এর মূল পাঠই আমাদের সাক্ষ্য দেবে, এ ধরনের মন্তব্য ঠিক নয়।

বেগম সংরক্ষণে আমাদের রাষ্ট্রীয়-জাতীয় অনাগ্রহ, অবহেলা; গ্রন্থাগারগুলোর অবহেলা অত্যন্ত দুঃখজনক। বেগম কার্যালয়ে এবং নূরজাহান বেগমের ব্যক্তিগত সংগ্রহেই শুধু বেগম-এর সংখ্যাগুলো সংরক্ষিত আছে। প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় সংগ্রহের ব্যবস্থা করা।

সূত্র

১. আনিসুজ্জামান, ভূমিকা, নির্বাচিত বেগম: অর্ধশতাব্দীর সমাজচিত্র ১৯৪৭-২০০০, [মালেকা বেগম সম্পাদিত ও সংকলিত], ঢাকা, পাঠক সমাবেশ, ২০০৬।

২. সায়মা খাতুন, ‘নারীবাদী ইতিহাস রচনার সংকট’, সমাজ নিরীক্ষণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা, ৭৪ বিশেষ সংখ্যা, বাংলাদেশের বহুকণ্ঠ, পৃ. ৭৩-৭৪, নভেম্বর ১৯৯৯।

৩. Joan Kelly, ‘The social Relation of the sexes : Methodological Implication of womens History’ সংকলিত হয়েছে History and Theory, The Essays of Joan kelly, Chicago and London, The university of Chicago Press, 1986.

৪. মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন, বাংলা সাহিত্যে সওগাত যুগ, ঢাকা, সওগাত প্রেস, ১৯৮৫, পৃ. ৩৩।

৫. ঐ, পৃ. ৪৭৬।

৬. রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, স্ত্রীজাতির অবনতি, রোকেয়া রচনাবলি, ঢাকা, বাংলা একাডেমী, ১৯৭৩, পৃ. ৩১।

৭.  বাংলা সাহিত্যে সওগাত যুগ, প্রাগুক্ত, পৃ ৪৮১।

৮. ঐ. পৃ ৫৭।

সওগাত

জাগো বঙ্গবাসী!

দেখ, কে দুয়ারে

অতি ধীরে ধীরে করে করাঘাত।

ঐ শুন শুন!

কেবা তোমাদের

সুমধুর স্বরে বলে, ‘সুপ্রভাত’!

অলস রজনী

এবে পোহাইল

আশার আলোকে হাসে দিননাথ।

শিশির সিক্ত

কুসুম তুলিয়ে

ডালা ভরে নিয়ে এসে ‘সওগাত’।

(মিসেস) আর এস হোসেন।

৯. মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন, বাংলা সাহিত্যে সওগাত যুগ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৮১

১০. আকিমুন রহমান, বিবি থেকে বেগম, ঢাকা, অঙ্কুর প্রকাশনী, ২০০৬, (প্রথম প্রকাশ র্যামন পাবলিশার্স, ১৯৯৬; দ্বিতীয় মুদ্রণ আগামী প্রকাশনী ১৯৯৯), পৃ. ৭৩-১১৫।

            এ প্রসঙ্গে মালেকা বেগমের মন্তব্য: মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের প্রগতিবাদী ভূমিকাকে এ বইয়ে ‘নতুন আদমের প্রতিনিধি’ বলে ব্যঙ্গ করা হয়েছে। তাঁকে বলা হয়েছে ‘ভুল নারী জাগরণ: ভুল প্রবক্তা’; বলা হয়েছে সওগাত ও বেগম-এ ‘নারীর কণ্ঠস্বর: পুরুষের ভাষা’ শোনা যায়। এ বইয়ে পিতৃতন্ত্র পুরুষতন্ত্রের ধারক-বাহকরূপে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, সুফিয়া কামালসহ সওগাত ও বেগম-এর লেখক কবি নারীদের বিষয়ে অপলাপ করা হয়েছে। উল্লেখ্য, এই লেখাটি ধারাবাহিকভাবে শৈলী পাক্ষিকে ছাপা হচ্ছিল। সে সময় এই অপলাপের বিরুদ্ধে ৫৬ জন বুদ্ধিজীবীর প্রতিবাদ সব সংবাদপত্রে প্রকাশের পর পাক্ষিক শৈলী পত্রিকার লেখাটির প্রকাশ স্থগিত হয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে অঙ্কুুর প্রকাশনী থেকে ২০০৬ সালে প্রকাশিত বইটির ভেতর ও শেষ প্রচ্ছদে মন্তব্য করা হয়েছে, ‘এই বইয়ের অভিনব ও নতুন ব্যাখ্যা সহ্য করতে পারেননি এ দেশের ৫৬ জন বুদ্ধিজীবী। বইটির প্রকাশ বন্ধ করে চিন্তার কণ্ঠস্বর রুদ্ধ করে দেন তারা।’ পাঠকই বিবেচনা করবেন, সত্যের বিকৃতি ও অপলাপের বিরুদ্ধে মানবতার জয়গানেরই বিজয় হয়।

১১. আনিসুজ্জামান, ভূমিকা, [মালেকা বেগম সম্পাদিত ও সংকলিত] নির্বাচিত বেগম: অর্ধশতাব্দীর সমাজচিত্র ১৯৪৭-২০০০; ঢাকা, পাঠক সমাবেশ, ২০০৬।

১২. মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, নিবেদন ইতি, অন্যপ্রকাশ, ঢাকা, ২০০৫, পৃ. ২৭০।

১৩. বাংলা সাহিত্যে সওগাত যুগ, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩১৮।

১৪. মালেকা বেগমকে দেওয়া সাক্ষাত্কার, ঢাকা, ১৭-২-২০০৫।

১৫. ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, সাময়িকপত্র সম্পাদনে বঙ্গনারী, বিশ্ববিদ্যা সংগ্রহ, কলিকাতা, ১৩৫৭, ফাল্গুন, পৃ. ১।

১৬. ঐ, পৃ. ১-১০।

১৭.  ঐ।

১৮. অন্যদিন, বৈশাখী সংখ্যা, ১৪১১; [অনুলিখন: মোমিন রহমান]।

১৯. বাংলা সাহিত্যে সওগাত যুগ, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩৩৯।

২০. ঐ, পৃ. ১৩৩৬।

২১. ঐ।

২২. ঐ।

২৩. তাহমিনা বানু প্রথিতযশা অভিনেতা মোহাম্মদ জাকারিয়ার (প্রয়াত) স্ত্রী। সূত্র: নূরজাহান বেগম, অন্যদিন বৈশাখী সংখ্যা, প্রাগুক্ত।

২৪. ঐ।

২৫. ঐ।

২৬. বাংলা সাহিত্যে সওগাত যুগ, প্রাগুক্ত, পৃ ১৩৪০।

২৭. ঐ, পৃ. ১৩৪১।

২৮. ঐ, পৃ. ১৩৪১-২।

২৯. মেয়েদের অর্থনৈতিক জীবন, সাপ্তাহিক বেগম, ৪র্থ বর্ষ ২৭ সংখ্যা, ৩রা জুন ১৯৫১, পৃ. ৩।

৩০. সৈয়দা মমতা আলম, পল্লী নারীর দুরবস্থায় শহুরে বোনদের কর্তব্য: ৬ষ্ঠ বর্ষ, ৪২ সংখ্যা, বেগম, ১৭ জানুয়ারি ১৯৫৪।

৩১. মালেকা বেগম সংকলিত ও সম্পাদিত, নির্বাচিত বেগম: অর্ধশতাব্দীর সমাজচিত্র ১৯৪৭-২০০০, ঢাকা, পাঠক সমাবেশ, ২০০৬।

৩২. ঐ।

৩৩. বেগম, ১ম বর্ষ, ৬ষ্ঠ সংখ্যা, ২৪ আগস্ট ১৯৪৭।

৩৪. বেগম, ১ম বর্ষ, ২৬ সংখ্যা, ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮।

৩৫. বেগম, ১ম বর্ষ, ৩৫ সংখ্যা, ১৮ এপ্রিল ১৯৪৮।

৩৬. বেগম, ১ম বর্ষ, ৩৭ সংখ্যা, ২ মে ১৯৪৮।

৩৭. বেগম, ৩য় বর্ষ, ২৪ সংখ্যা, ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৫০।

৩৮. বেগম, ৭ম বর্ষ ৫ম সংখ্যা, ৪ এপ্রিল ১৯৫৪,

৩৯. বেগম, ১২শ বর্ষ, ৪র্থ সংখ্যা, ৬ মার্চ ১৯৫৯।

৪০. বেগম, ৮ম বর্ষ, ১৯ সংখ্যা, ১৭ জুলাই ১৯৫৫।

৪১. ঐ।

৪২. মাজেদা খাতুন, বেগম, ৬ষ্ঠ বর্ষ ২২ সংখ্যা, ১৬ আগস্ট ১৯৫৩।

৪৩. বেগম, ৬ষ্ঠ বর্ষ, ৩৬ সংখ্যা, ৬ ডিসেম্বর ১৯৫৩।

৪৪. আকিমুন রহমান, বিবি থেকে বেগম, র্যামন পাবলিশার্স, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬, ভূমিকা, মুখবন্ধ, আমিমুন নাহার ও হুমায়ুন আজাদ, পৃ. ৯৯-১৪২।