সম্পাদকীয়

প্রতিচিন্তার বিগত সংখ্যা পাঠকেরা ভালোভাবে গ্রহণ করেছেন, যা আমাদের বিশেষভাবে উত্সাহিত করেছে। সেই সঙ্গে আমরা দৃঢ়ভাবে পাঠকদের উদ্দেশে প্রতিশ্রুতি দিতে চাই, প্রতিচিন্তা সময়মতো প্রকাশে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। প্রতিবারের মতো প্রতিচিন্তার এবারের সংখ্যাটিও সাজানো হয়েছে সমাজ ও রাষ্ট্রসংক্রান্ত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অধ্যায়ে জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গটি বারবার সামনে আসছে। এই সমসাময়িক গুরুত্বের দিকটি বিবেচনায় নিয়ে এবারের সংখ্যায় বদরুল আলম খানের ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ: চার দশক পর’ প্রবন্ধটি বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্বরূপ বিশ্লেষণে আমাদের সহায়তা করবে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের দুই বিপরীতমুখী উপাদান—ধর্ম ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার মধ্যকার দ্বন্দ্বের একটি সাবলীল ব্যাখ্যা তিনি দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছেন। আজকের এই সংঘাতময় রাজনীতির পেছনে আত্মপরিচয়ের সংকটটি প্রকট হয়ে ধরা পড়ার কারণ এখানে পাওয়া যায় এবং এ সংঘাত থেকে বেরিয়ে আসার সম্ভাব্য পথের প্রাথমিক এক ইঙ্গিত তিনি দিয়েছেন।

দ্বিতীয় প্রবন্ধ সিরাজুল ইসলামের ‘ইয়াংকি বণিকদের বঙ্গবাণিজ্য ও প্রাচ্যচর্চা’তে মার্কিন শিল্পবিপ্লবে বাংলা অঞ্চলের পুঁজির ভূমিকা এবং ইয়াংকি বণিকদের প্রাচ্যবাদ চর্চার বিশ্লেষণ রয়েছে। মার্কিনরা কীভাবে পুঁজির পাশাপাশি সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলেও এই অঞ্চল থেকে লাভবান হয়েছে এবং প্রাচ্যবাদ চর্চায় অবদান রেখেছে, তারই একটি উপস্থাপনা এই প্রবন্ধ।

বার্ট সুইকেন্স ও আইনুল ইসলাম তাদের প্রবন্ধে হরতাল কীভাবে স্থানীয় ক্ষমতা কাঠামোতে স্থানীয় নেতা-কর্মী-সংগঠকদের অবস্থান বজায় রাখতে এবং তা সুদৃঢ় করতে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হয় তা আলোচনা করেছেন। হরতালের সহিংসতা এবং বাংলাদেশের বর্তমান হরতালের আত্মঘাতী ধরণ বন্ধ করা কেন কঠিন তার বিশ্লেষণ রয়েছে প্রবন্ধটিতে। এ প্রবন্ধেরই ধারাবাহিকতায় আগামীতে আমাদের পাঠকের জন্য লেখকদের কাছ থেকে বাংলাদেশের বর্তমান সহিংসতার উপর একটি নির্মোহ গবেষণা ভিত্তিক বিশ্লেষণ পাব তেমনটি আশা করি।  

ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিকে সামনে রেখে মিজানুর রহমান খানের ‘উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা: প্রয়োজনীয়তা ও সীমাবদ্ধতা’ প্রবন্ধটি ছাপতে উত্সাহী হলাম। এই প্রবন্ধে লেখক দেখিয়েছেন, সংবিধানে রাষ্ট্রভাষা বাংলা থাকার পরও তা রাষ্ট্রের ওপর কোনো সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করতে পারেনি। আর সে কারণেই উচ্চ আদালতে এখনো বাংলা ভাষা চালু করা সম্ভব হয়নি। ভাষা মানুষের মৌলিক অধিকার হওয়ায় এটি যে সরাসরি মানবাধিকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তা-ও লেখক বিশ্বের অন্যান্য দেশের উদাহরণ দিয়ে তুলে ধরেছেন চমত্কারভাবে।

গত ৬ ডিসেম্বর ছিল প্রয়াত চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদের জন্মদিন। তাঁর স্মৃতির উদ্দেশে সাজেদুল আওয়াল ‘তারেক মাসুদের চলচ্চিত্রে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উপস্থাপনা’ প্রবন্ধে বাঙালি জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে তারেক মাসুদের ধ্যানধারণা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। তারেকের চলচ্চিত্রকর্মের মাধ্যমে কীভাবে আমাদের লোকসংস্কৃতির ভেতরের অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও মানবিক এবং কিছুটা পারস্যের সুফিবাদী দর্শনের মানবসম্পর্কিত ধারণা ফুটে উঠেছে, সেটিই লেখক আলোচনা করেছেন বর্তমান প্রবন্ধে।

বই আলোচনা অংশে সোহরাব হাসান কূলদীপ নায়ারের বিয়ন্ড দ্য লাইনস এবং মোশারফ হোসেন তপন রায় চৌধুরীর বাঙালনামা  গ্রন্থ দুটি যথাক্রমে আলোচনা করেছেন। প্রথমটিতে উপমহাদেশের খ্যাতনামা সাংবাদিক কূলদীপ নায়ারের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে দেশভাগ, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও বর্তমান সময়ের হালনাগাদ স্থান পেয়েছে। আর দ্বিতীয় গ্রন্থটি ইতিহাসবিদ তপন রায় চৌধুরী ইতিহাসের দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্রিটিশ শাসনামল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত সমাজ-রাজনীতিকে কীভাবে প্রত্যক্ষ করেছেন তার আলোচনা রয়েছে।

আমরা প্রতিচিন্তায় প্রকাশিত কোনো লেখা সম্পর্কে পাঠকের দ্বিমত ও প্রতিক্রিয়া ছাপাতে আগ্রহী। পাঠকদের তথ্যসমৃদ্ধ প্রতিক্রিয়া ও মূল্যায়ন আমাদের উত্সাহিত করবে।

পরিশেষে আশা করি, আপনাদের সার্বিক সমর্থন পাব।