বাগান থেকে মহাকাশ

লেখক মীজানুর রহমান। ২০১৩ সালে কোস্টারিকায় তোলা ছবি
লেখক মীজানুর রহমান। ২০১৩ সালে কোস্টারিকায় তোলা ছবি

ছোটবেলা থেকেই দুটি ফলবৃক্ষের গল্প শুনে এসেছি। একটি আদম-হাওয়ার ‘নিষিদ্ধ’ ফলের গল্প, আরেকটি আইজ্যাক নিউটনের গাছ থেকে আপেল পড়ার গল্প। কিন্তু আসলেই কি নিউটনের মাথা বরাবর হতভাগা আপেলটি পড়েছিল?
মহৎ লোকদের নিয়ে চুটকি-চাটকি গল্প সবারই পছন্দ। আলবার্ট আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব আমরা কজন বুঝি, সেটা ভাবার বিষয়। কিন্তু তাঁর কাল্পনিক যানে করে মহাকাশ ভ্রমণের চিত্তাকর্ষক কাহিনি শুনতে কার না ভালো লাগবে, বলুন। এটা চমক লাগানোর মতো গল্প তো বটেই যে, বড় ভাই শূন্য ভ্রমণের পর থেকে ফিরে এসে দেখেন ছোট ভাইয়ের বয়স তাঁর চেয়ে বেশি! এর চেয়ে বড় বিস্ময় আর কী হতে পারে! আপেক্ষিক তত্ত্বের এটুকু রহস্যই আমাদের জন্য যথেষ্ট—আইনস্টাইন চিরকালের জন্য মনে গেঁথে রইলেন। সত্য-মিথ্যা কী আসে-যায়! গল্প মজার হলেই হলো।
প্রাচীন যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী হিসেবে পরিচিত ছিলেন গ্রিক পণ্ডিত আর্কিমেডিস (খ্রিষ্ট.পূ. ২৮৭-২১২)। একাধারে পদার্থবিদ, প্রকৌশলী, জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং সর্বোপরি সে সময়কার শ্রেষ্ঠ গণিতজ্ঞ। কিন্তু সাধারণ মানুষ তাঁকে মনে রেখেছে কীভাবে? একটি শব্দ দিয়ে: ‘ইউরেকা’, মানে ‘পেয়েছি’। আর মনে রেখেছে, শব্দটা উচ্চারণ করতে করতে তাঁর বিবস্ত্র হয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়া। কার কী গরজ পড়ে গেছে জানার যে তিনি ছিলেন প্রকৌশলীদের অবশ্যপাঠ্য বিষয় স্ট্যাটিক্স ও হাইড্রোস্ট্যাটিক্সের জনক, ছিলেন পদার্থের আপেক্ষিক গুরুত্ব তত্ত্বের (specific gravity) উদ্ভাবক এবং এই আপেক্ষিক গুরুত্বের আইডিয়াটিই তাঁকে উত্তেজনার চরম শিখরে পৌঁছে দিয়ে গোসলের জায়গা থেকে বের করে দিগম্বর অবস্থায় রাস্তায় নিয়ে গিয়েছিল। অনেকে হয়তো জানেও না যে রোমানদের বিরুদ্ধে গ্রিক পক্ষের যুদ্ধকালে এক মূর্খ রোমান সেনার অস্ত্রাঘাতে এই মহান ব্যক্তির প্রাণহানি হয়েছিল।

আইজ্যাক নিউটনের আপেল পতনের গল্পটি তেমন মজাদার না হলেও একটা চমকপ্রদ রোমান্টিকতা ছিল এতেও। আপেলের বাগান, তরুণ নিউটন ঘাসের ওপর শুয়ে শুয়ে ডুবে আছেন তাঁর কল্পনার জগতে। এমন সময় গাছ থেকে টুপ করে একটা পাকা আপেল পড়ে গেল ঠিক তাঁর কপাল বরাবর। আর অমনি দৈববাণীর মতো তাঁর মাথায় উদয় হলো এক অসাধারণ চিন্তা—তাই তো, এ তো মহাবিশ্বব্যাপী এক গূঢ় মহাশক্তির উপস্থিতিকে ঘোষণা করছে। অনেকটা যেন ধর্মগ্রন্থের অহি নাজিলের মতোই প্রেরণা জাগানো। আসলে নিউটন নিজেই নাকি ওই আপেলবৃক্ষটিকে আদিসৃষ্টির সেই বাইবেল-বর্ণিত ‘জ্ঞানবৃক্ষ’ বলে ধারণা করে বসেছিলেন। (গল্পটি বিশ্বাসযোগ্য না হলেও এটা সত্য যে মহামতি নিউটন অতিশয় ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি ছিলেন এবং প্রচলিত ভূতপ্রেতজাতীয় গল্পের প্রতি যথেষ্ট দুর্বলতাও ছিল)।
যা-ই হোক, এ নিবন্ধের প্রাথমিক আলোচ্য বিষয় হলো, গল্পগুলো কতখানি সত্য এবং কতটুকুই বা পুরোপুরি বানোয়াট। নিউটনের বাগানে কি সত্যি সত্যি আপেল পড়েছিল তাঁর মাথায়? নাকি আর্কিমিডিসের গল্পের মতোই সন্দেহসংকুল?
সম্ভবত আপেলের ঘটনাটি আসলেই ঘটেছিল নিউটনের গ্রামের বাড়িতে। তাঁর অন্তত দুটি ঐতিহাসিক প্রমাণ আছে। প্রথম সাক্ষ্য তাঁরই ভাইঝির স্বামী জন কনডুইট নামক এক যুবকের লিখিত বয়ান থেকে। কনডুইট পরবর্তীকালে স্যার আইজ্যাক নিউটনের সহযোগী ছিলেন ইংল্যান্ডের টাঁকশালায় পরিচালকের পদে নিযুক্ত থাকাকালে। তাঁর বর্ণনা অনুযায়ী, ১৬৬৬ সালে ব্রিটেনের ব্যাপক মহামারির সময় নিউটন কেমব্রিজ থেকে তাঁর গ্রামের বাড়ি লিঙ্কনশায়ারে মায়ের কাছে চলে গিয়েছিলেন। ছুটিছাটায় বরাবরই তা করতেন তিনি। একদিন ভাবাকুল অবস্থায় বাগানে হাঁটাহাঁটির সময় গাছ থেকে আপেলটি টুপ করে মাটিতে পড়ে তাঁর চোখের সামনে। আর অমনি মন ছুটে গেল অন্য জগতে। এই পড়াটা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ মনে হলো তাঁর কাছে। নিচে পড়ছে কেন? এবং ঠিক লম্বালম্বিভাবে, কোনাকুনি বা আঁকাবাঁকা হয়ে নয় কেন? এ থেকে তিনটি জিনিস প্রতীয়মান হয়ে উঠল তাঁর মনে। এক, আপেল নিচে পড়ে, ওপরে ওঠে না, কারণ নিচের দিকেই আকর্ষণধর্মী একটা শক্তি তাকে টেনে নেয়। দুই. কোনাকুনি বা বাঁকানো পথে পড়ে না তার কারণ আকর্ষণটি পৃথিবীর ঠিক কেন্দ্রের দিকে। অর্থাৎ মাধ্যাকর্ষণ একটি কেন্দ্রিক শক্তি (central force), যার একটা গভীর তাৎপর্য আছে। তিন. এই আকর্ষণ কেবল আপেলের বেলায় কাজ করে তা নয়, এটাই বিশ্বপ্রকৃতি—সব বস্তুর ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য। প্রতিটি ভরযুক্ত বস্তুই আসলে একে অন্যকে এভাবে আকর্ষণ করে। ছোট বস্তুর বেলায় এটা লক্ষণীয় নয়, বড় বস্তু, যেমন ভূমণ্ডল, সে ক্ষেত্রে অবশ্যই লক্ষণীয়।
দ্বিতীয় সাক্ষ্যে পাই নিউটনের ব্যক্তিগত বন্ধু উইলিয়াম স্টুকলি (১৬৮৭-১৭৬৫) ও বিশিষ্ট জীবনীকার ও ইতিহাসবিদ। বন্ধুর মুখ থেকেই এই গল্প ১৭২৬ খ্রিষ্টাব্দে শুনেছেন স্টুকলি। নিউটনের মৃত্যুর এক বছর আগে লন্ডনের কেনসিংটন পার্কে বসে দুজনে ঘনিষ্ঠ আলাপ করছিলেন। তাঁর বর্ণনার সঙ্গে জন কনডুইটের বর্ণনা প্রায় হুবহু মিলে যায়। তাতে মনে হয়, বিজ্ঞানের অন্তত এ গল্পটি হয়তো একেবারে মনগড়া নয়।

কিন্তু তার পরও প্রশ্ন থেকে যায়। বিজ্ঞানের তো ধারাই এটা। কোনো কিছুই চূড়ান্তভাবে মিটে যায় না। আপাতদৃষ্টিতে একটা প্রশ্নের সমাধান হয়ে গেলে নতুন প্রশ্ন সৃষ্টি, অনেক সময় সমাধান থেকেই প্রশ্নের উদ্রেক হয়। আপেলের ঘটনা সত্য হলেও প্রশ্ন ওঠে, সর্বজনীন মাধ্যাকর্ষণের ধারণাটা কি হঠাৎ করে দৈববাণীর মতো পেয়ে গিয়েছিলেন নিউটন, না আগেও একটা ইতিহাস ছিল বা ছিল কোনো বৈজ্ঞানিক আভাস-ইঙ্গিত। সাধারণত বিজ্ঞানের কোনো বড় আইডিয়া হঠাৎ করে আকাশ থেকে পড়ে না। প্রচণ্ড মেধাবী কোনো ব্যক্তি একদিন ঘুম থেকে উঠে ‘ইউরেকা’ ‘ইউরেকা’ বলে ঘরের বাইরে চলে যান না তাঁর সদ্যপ্রাপ্ত বৃহৎ আইডিয়া নিয়ে। বিজ্ঞানের রীতিটাই এমন যে সব সৃষ্টির পেছনেই একটা দীর্ঘ প্রস্তুতি লাগে, লাগে চিন্তাভাবনার ধারাবাহিকতা, সেটা মৌলিক হোক আর যৌক্তিক চিন্তাই হোক। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতত্ত্বের পেছনে ৩০০ বছর আগে ছিলেন গ্যালিলিও গ্যালিলি, যাঁর নিজেরও এক প্রকার আপেক্ষিকতত্ত্ব ছিল, যা আইনস্টাইনের চিন্তাজগতে যথেষ্ট খোরাক জুগিয়েছিল। তদুপরি ছিল নিউটনের মাধ্যাকর্ষণতত্ত্ব, যা না থাকলে চট করে এত সব যুগান্তকারী ভাবনা তাঁর মাথায় প্রবেশ করার সুযোগ পেত কি না, সন্দেহ। শুধু তা-ই নয়, তাত্ত্বিক বিজ্ঞানীদের সবচেয়ে বড় সহায় অন্য বিজ্ঞানীদের তত্ত্বকথা নয়, ফলিতবিজ্ঞানীদের পরীক্ষালব্ধ ল্যাবরেটরিজাত তথ্যসমূহ।

নিউটন কেবল মাধ্যাকর্ষণ শক্তির অস্তিত্বই উপলব্ধি করে ক্ষান্ত হননি, তাঁর প্রকৃতিও পূর্ণভাবে নিরূপণ করে গিয়েছিলেন। দুটি বস্তু পরস্পরকে আকর্ষণ করে ঠিকই, কিন্তু সেই আকর্ষণের মাত্রা কমতে শুরু করে বস্তুদ্বয়ের দূরত্বের সঙ্গে। ওটা প্রায় সাধারণ বুদ্ধিতেই বোঝার মতো, কিন্তু এই কমে যাওয়ার পরিমাণটা যে দূরত্বের বিপরীত বর্গের অনুপাতে, সেটা বুঝে ফেলা কিন্তু চাট্টিখানি কথা নয়। নিউটন সেটা বুঝতে পেরেছিলেন সহজেই। কিন্তু কীভাবে বুঝেছিলেন এবং তিনিই প্রথম ব্যক্তি কি না বিপরীত বর্গনীতি আবিষ্কারের, তারও একটা পশ্চাৎকাহিনি আছে। (ক্রমশ)