একাত্তরের সত্তা: যেভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ টাওয়ার হ্যামলেটকে তাড়িয়ে বেড়ায়

সারসংক্ষেপ

১৯৭১ সালের ব্রিটিশ বাঙালিরা বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সমর্থনে সর্বজনীনভাবে একত্র হয়েছিল। এই প্রবন্ধ সেই যুদ্ধের প্রকৃতি ও প্রভাব, এবং ব্রিটেনে, বিশেষ করে বেশির ভাগ বাঙালির বসবাসস্থল টাওয়ার হ্যামলেটে বাংলাদেশিদের অব্যাহত লিগ্যাসি তুলে আনবে। কীভাবে একাত্তরের চেতনা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের একত্র করেছে এবং নতুন অধ্যায়কে রাজনীতিকীকরণ করেছে, তার পটভূমি ও রাজনীতি এবং কীভাবে বিপ্লবী ‘স্টেজ থিওরি’ ও ‘পপুলার ফ্রন্টিজম’ বুদ্ধিজীবী নেতৃত্বের উগ্র সমাজতন্ত্রকে জাতীয়তাবাদের মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে যেতে সহায়তা করেছিল, তা দেখা হয়েছে এই প্রবন্ধে। কীভাবে বাঙালিদের সঙ্গে লেবার পার্টির সংযোগ এবং রাষ্ট্রীয় রাজনীতির উন্নয়নে ১৯৭১ সালের জনসংযোগ ভূমিকা রেখেছিল, তাও আলোচনা করা হবে।

এই ইতিহাস বাঙালিদের ব্যক্তিগত স্মৃতি থেকে সাক্ষাত্কার গ্রহণের মাধ্যমে রেকর্ড করা হয়েছে, যা কিনা নিজ গুণেই একটি শক্তিশালী গল্প। এই প্রবন্ধে মাতৃভূমিতে উপনিবেশবাদের অবসান ও জাতিগঠন এবং ব্রিটেনে বসতি স্থাপন ও সংহতিকরণের সময়ে প্রবাসীদের মধ্যে রাজনীতির আবির্ভাবের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক উন্নয়নের প্রভাবের বিস্তৃত উদাহরণ দেওয়া হয়েছে।

শব্দগুচ্ছ: বাঙালি, বাংলাদেশ, টাওয়ার হ্যামলেট, স্বাধীনতাযুদ্ধ, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, প্রগতিশীল বা বামপন্থী দলসমূহের মৈত্রী বা জোট।

প্রারম্ভিক আলোচনা

১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি লন্ডনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করে। যদিও তাঁর উপস্থিতি পাকিস্তান সরকার কর্তৃক নির্ধারিত, তবু এক্ষেত্রে মুক্তি সংগ্রামের সমর্থনে সর্বজনীনভাবে একত্র হওয়া প্রবাসী বাঙালিরা১ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে ২৪ বছরের অভিজ্ঞতা শেষে নতুন রাষ্ট্র হওয়ায় পূর্ব বাংলার জন্য এটা একটা বিশেষ মুহূর্ত ছিল; এটি ব্রিটিশ বাংলাদেশিদের জন্যও চরম মুহূর্ত ছিল। এই প্রবন্ধ সেই যুদ্ধের প্রকৃতি ও প্রভাব, এবং ব্রিটেনে, বিশেষ করে বেশির ভাগ বাঙালির বসবাসস্থল টাওয়ার হ্যামলেটে বাংলাদেশিদের অব্যাহত লিগ্যাসি তুলে আনবে। কীভাবে একাত্তরের চেতনা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের একত্র করেছে ও নতুন অধ্যায়কে রাজনীতিকীকরণ করেছে তার পটভূমি ও রাজনীতি এবং কীভাবে বিপ্লবী ‘স্টেজ থিওরি’ ও ‘পপুলার ফ্রন্টিজম’ বুদ্ধিজীবী নেতৃত্বের উগ্র সমাজতন্ত্রকে জাতীয়তাবাদের মধ্যে নিমজ্জিত হতে সহায়তা করেছিল, তা দেখা হয়েছে এই প্রবন্ধে। কীভাবে বাঙালিদের সঙ্গে লেবার পার্টির সংযোগ এবং রাষ্ট্রীয় রাজনীতির উন্নয়নে ১৯৭১ সালের জনসংযোগ ভূমিকা রেখেছিল তাও আলোচনা করা হবে।

এই ইতিহাস বাঙালিদের ব্যক্তিগত স্মৃতি থেকে সাক্ষাত্কার গ্রহণের মাধ্যমে রেকর্ড করা হয়েছে, যা নিজ গুণেই একটি শক্তিশালী গল্প। এই প্রবন্ধে মাতৃভূমিতে উপনিবেশবাদের অবসান ও জাতিগঠন এবং ব্রিটেনে বসতি স্থাপন ও সংহতিকরণের সময়ে প্রবাসীদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা তৈরিতে আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক উন্নয়নের কী প্রভাব, তার বিস্তৃত উদাহরণ প্রদান করা হয়েছে। যদিও অনেক ক্ষেত্রেই প্রবাসী সংগঠনগুলোতে কমিউনিস্ট ও সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের বিস্তারিত পাওয়া যায়, কিন্তু সেগুলো বিস্তর মতাদর্শিক প্রেক্ষাপট নিয়ে দেখা হয়নি। কালবির শুক্রা যদিও আদর্শগত উন্নয়ন সম্পর্কে বামপন্থীদের ভেতর থেকে সমালোচনা করেছেন, কিন্তু তিনি কনটেক্সচুয়াল বিশ্লেষণে এই সময়কে একই পর্যায়ে নিয়ে যাননি।২

রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট

এর কেন্দ্রে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকতাবাদীরা বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদের সঙ্গে একই প্ল্যাটফর্মে অবস্থান করে। আপাতদৃষ্টিতে এই অসম্ভাব্য সমন্বয় বারবার ঘটেছে, কিন্তু এর পেছনে গতিশীলতা (যেমনটি সোস্যালিস্ট শ্রমিক পার্টি এবং ব্রিটেনের মুসলিম অ্যাসোসিয়েশনের অসম্ভাব্য সমন্বয়ের পেছনে ছিল) শুধু সোভিয়েত কমিউনিজমের উন্নয়নের প্রেক্ষাপটেই বোঝা সম্ভব। সংশ্লিষ্ট সকলের মৌলিক সমস্যা ছিল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী প্রক্রিয়ার প্রকৃতি এবং এখান থেকেই এর সঠিক কৌশল গ্রহণ। বিতর্কের কোনো সংক্ষিপ্ত জরিপ এর ন্যায়বিচার করতে পারে না। যেকোনো বাস্তব অবস্থায় সফলতা ও ব্যর্থতার মধ্যে পার্থক্য একটি কৌশলগত কাল্পনিক রেখা পার করার ওপর নির্ভর করে, তাই সেই রেখার অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সারমর্মে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো রয়েছে যদিও সম্পূর্ণ বিতর্ককে পুনঃপরীক্ষা এর উদ্দেশ্য নয়। এ প্রবন্ধটি কিছু বাস্তবায়িত ধারণার গবেষণামূলক পরীক্ষার বিস্তারিত অবকাঠামো প্রদান করে, যে পরীক্ষাটি আবার বিস্তৃত বিষয়ে টেনে আনা যায়।

‘স্থায়ী বিপ্লব’ তত্ত্বে ট্রটস্কি বলেছেন সমাজতন্ত্র অর্জন করার ক্ষেত্রে শ্রমিক ক্ষমতা লাভ ও গণতান্ত্রিক সংশোধন করেই থেমে থাকতে পারবে না। প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিবিপ্লবী শক্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা পাওয়ার আগেই শ্রমিক সরকারকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের দিকে ধাবিত হতে হবে এবং এটাই ১৯১৭ সালে ঘটেছে। যাই হোক, সেই বিপ্লব আন্তর্জাতিকভাবে হওয়ার কথা ছিল। এটা যখন ব্যর্থ হয় তখন স্টালিনের দল “একটি দেশে সমাজতন্ত্রের” প্রচারণা চালায় এবং সুবিধামতো বিপ্লব তত্ত্বের পূর্ব ধারণাতে ফিরে যায়—যেখানে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব-পূর্ববর্তী রক্ষণশীল বিপ্লব থেকে আলাদা ছিল। ঔপনিবেশিক দেশগুলোতে যারা স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করছে তাদেরকে প্রথম পর্যায়ে মিত্র হিসেবে গণ্য করা হতো।

জাতীয় প্রশ্নকে এই দীর্ঘ বিতর্কের প্রধান কারণ হিসেবে দেখা হয়েছে। লেনিন যুক্তি দিয়েছেন যে একটি সংঘে একত্রিত জনগণের কমিউনিস্ট ধারণা বলতে বোঝায় জাতিগুলোর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের জন্য সংগ্রামে সমর্থন দেওয়া এবং সব ধরনের জাতীয় নিপীড়নের বিরোধিতা করা, কিন্তু সক্রিয়ভাবে জাতীয়তাবাদকে উত্সাহিত না করা। এটি বাস্তবে কী অর্থ বহন করে তা প্রকৃত পরিণতির আলোকে বিচার করে দেখতে হতো, কিন্তু লেনিন জোর দিয়েছেন যে জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম সব সময় সমাজতন্ত্রের বিপ্লবী সংগ্রামের অধস্তন থাকবে এবং সতর্ক করেছেন যে, ‘নিপীড়িত দেশের বুর্জোয়াগণ শ্রমিকদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করার জন্য ক্রমাগতভাবে জাতীয় মুক্তির স্লোগানকে কাজে লাগাচ্ছে।’৩

স্ট্যালিনের সময় এই সতর্কবাণী কাজে লাগেনি, যেহেতু কমিন্টার্ন নির্দেশ দিয়েছিল যেন কমিউনিস্টরা বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদীদের প্রোগ্রাম ও কৌশলের অধস্তন থাকে। যাই হোক, ক্যান্টন বিদ্রোহ ও ১৯২৭ সালের সাংহাই ক্যু-এর ভয়াবহ পরিণতির সময়, যখন চিয়াং কাই শেক চীনা কমিউনিস্টদের ওপর চড়াও হয় এবং তাদের মধ্যে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করে, তখন এসব নীতি সম্পূর্ণরূপে পাল্টে ফেলা হয়। ১৯২৭ সালে সাংহাই ক্যু ও ক্যান্টন বিদ্রোহের নীতির ক্ষতিকর ফলাফল দেখে সহযোগিতার এই কৌশল গৃহীত হয়। পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য নতুন নীতি ‘শ্রেণির বিরুদ্ধে শ্রেণি’র প্রভাবে কমিন্টার্ন অন্যান্য সমাজতন্ত্রবাদীদের সঙ্গে কাজ করতে অনাগ্রহ দেখায়।

১৯৩৩ সালে জার্মানিতে নািসদের বিজয়ের ফলে এই নতুন অবস্থানের বিপদ যখন উন্মোচিত হয়, তখন আরেকটা সম্পূর্ণ কৌশলী বৈপরীত্যের সমর্থনে এটা পরিত্যাগ করা হয়। মধ্যমপন্থা উপেক্ষা করে মতাদর্শগতভাবে অথবা সাংগঠনিকভাবে স্বাধীন হয়ে অন্যান্য নির্দিষ্ট ইস্যু নিয়ে কাজ করায় (যাকে ট্রটস্কি যুক্তফ্রন্ট বলেন) দলটি চীনে যেসব ধারণা ধ্বংসাত্মক ছিল সেগুলো প্রতিস্থাপন করে এবং শ্রমিক দল এবং বুর্জোয়াদের জোট আহবান করা হয়। যদিও এটা ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে তাত্ক্ষণিক জবাব প্রদর্শন করে, কিন্তু এটা যুদ্ধের পর অব্যাহতভাবে পপুলার ফ্রন্টিজম অনুসরণ করে এবং সোভিয়েত কমিউনিস্ট তত্ত্বে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছিল। যুদ্ধপরবর্তী সময়ে দ্বিতীয় পর্যায়ের ধারণা গ্রহণ করে—বুর্জোয়া গণতন্ত্র থেকে সমাজতন্ত্রে পরিবর্তন সংসদীয় মাধ্যমে, যা শান্তিপূর্ণভাবে বুর্জোয়া রাষ্ট্রের কাঠামো অব্যাহত রেখে অর্জন করা যায়। তবে এসব ধারণা যে শক্তিশালী রিভিসনিস্ট প্রতিক্রিয়ায় পড়তে পারে সে ধরনের ভিন্নমত বাতিল করে দেওয়া হতো, এবং তারা বিশ্বজুড়ে কমিউনিস্ট ও তাদের সহকর্মীদের মধ্যে নতুন অর্থোডক্সি হিসেবে আবির্ভূত হয়, যা পুরাতন উপনিবেশ দেশগুলোর চরমপন্থী ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনগুলোয়, যেমন পূর্ব পাকিস্তান বা আধুনিক বাংলাদেশে বিশেষভাবে প্রভাবশালী বলে প্রমাণিত হয়।

জনগণ

জনগণ ছিল বিস্তৃত রাজনৈতিক পটভূমি কিন্তু তারা কারা যারা রাজনীতিকে কাজে রূপান্তরিত করে? সে সময় ২২ হাজার পূর্ব পাকিস্তানি ব্রিটেনে বসবাস করত যাদের মধ্যে তিন হাজার লন্ডন নগরের পূর্বাঞ্চলে বাস করত।৪ তাদের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল কম এবং প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল উদ্ধত হয়ে জীবনে ভালো কিছু করা। তারা তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের উত্তর-পূর্ব কোণের সিলেট অঞ্চলের সাবেক নাবিক ছিলেন, যারা ব্রিটিশ বন্দর থেকে পালিয়েছে অথবা নাবিকদের পরিবার এবং গ্রামের মানুষ যারা কমনওয়েলথ অভিবাসন আইন-১৯৬২ দ্বারা অভিবাসন সীমিত করার সময় শ্রমিক ভাউচার প্রকল্পের অধীনে এই দেশে এসেছে। তারা অত্যাচারিত বাণিজ্যের মাধ্যমে জীবন ধারণ করছে যেমন অদক্ষ শ্রমিক বা ভারতীয় রেস্তোরাঁয় রান্নার লোক হিসেবে কাজ করত।৫ তারা সাধারণত এখানে কাজে এসেছিল এবং তাদের পরিবারের ভবিষ্যত্ নিশ্চিত করার জন্য উপার্জন করত এবং অধিকাংশ সময় তারা মাথা নত করে কঠোর পরিশ্রম করত। কমিউনিটির ফোকাস ছিল মসজিদের ওপর। পাকিস্তান কল্যাণ অ্যাসোসিয়েশন ১৯৫২ সালে স্বাবলম্বী গোষ্ঠী হিসেবে যাত্রা শুরু করে এবং অনেক বাঙালি ক্যাফে ও রেস্তোরাঁ মিটিংয়ের প্রতিষ্ঠিত জায়গায় পরিণত হয়। কিন্তু আরও কিছু উচ্চশিক্ষিত মানুষ ছিলেন যেমন তাসাদ্দুক আহমেদ। তিনি ১৯৫৩ সালে ব্রিটেনে এসেছেন কমিউনিস্ট রাজনীতির আরও উদার পরিবেশের আশায় এবং তার গঙ্গা রেস্তোরাঁ রাজনেতিক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতি-সচেতন জণগণ ছিল যাদের অনেকই তাসাদ্দুককে রাজনৈতিক গাইড হিসেবে পেয়েছিল এবং লন্ডনের পূর্বাচলে তাদের সামাজিক নীতির বাস্তবতা দেখেছিল। ব্রিটেনে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রত্যক্ষ প্রভাব ছিল বিভিন্ন পটভূমির বাঙালিদের একসঙ্গে করে নতুনভাবে রাজনীতিকীকরণ করা।

লন্ডনে পাকিস্তানি রাজনীতি

ত্রিশ ও চল্লিশ দশকের বাঙালি অভিবাসীদের লক্ষ্য ছিল ব্রিটেনের কাছ থেকে প্রভাবশালী রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করা। পাকিস্তানের স্বাধীনতাকে অনুসরণ করে ব্রিটিশ বাঙালি রাজনীতি পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনায় ফোকাস করেছিল—বিশেষ করে ইসলামাবাদের অধীনস্থ সরকারের সঙ্গে সম্পর্কে। বেশির ভাগ অভিবাসী গোষ্ঠীর জন্য তাদের প্রথম রাজনৈতিক ধারণা তাদের মাতৃভূমির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত এবং ব্রিটেনে অভিবাসনের সঙ্গে সম্পর্কিত। বাঙালিদের জন্য এ দুটো বিষয় ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল, বিশেষ করে যখন ইসলামাবাদ সরকার পূর্ব পাকিস্তানিদের প্রবাসের ওপর বাধা আরোপ করে।

পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে পূর্ব পাকিস্তানি রাজনীতি টেমস নদীর তীরে আলোড়ন তুলেছিল। দূরের ঘটনাসমূহ বাংলা পত্রিকা এবং যারা অংশগ্রহণ করে যেমন ছাত্রদের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে; অন্যান্য কার্যক্রম লন্ডনপ্রবাসীকে সরাসরি প্রভাবিত করে যেমন পাকিস্তান হাইকমিশন কর্তৃক দেখানো বঙালিদের বিরুদ্ধে কুসংস্কার। এবং কখনো তাদের এখানে ঘটে যাওয়া ঘটনাও প্রভাবিত করেছিল, যখন ভাসানী, ‘রেড মাওলানা’ ১৯৫৪ এবং ১৯৫৫ সময়কালে লন্ডনে রাজনৈতিক নির্বাসনে ছিলেন। ভাসানীকে আদর্শবাদ এবং বাঙালি বিদ্রোহের সংমিশ্রণ বলা যায়। কৃষক নেতা হিসেবে তিনি অপ্রতিরোধ্য কিন্তু অতাত্ত্বিক, শ্রেণিসচেনতা তৈরি করে যা ইসলামের সমমাত্রিক ব্যাখ্যার সঙ্গে অনুরণিত হয়েছে।৬ তার নির্বাচনের সময় তিনি আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট ছিলেন, যে দলটি বাঙালি রাজনৈতিক দল হিসেবে স্বাধীনতার কয়েক বছর পর্যন্ত শাসন করে কিন্তু ওই দশকের শেষে ক্ষমতার সংগ্রাম তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে এবং তিনি বামদের নিয়ে নতুন আরেকটি দল গঠন করে যার নাম ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি অথবা ন্যাপ।৭

লন্ডনে ভাসানী আবদুল মান্নানের সঙ্গে তাসাদ্দুকে যোগ দেন যিনি সাবেক নাবিক, অভিবাসনের জনক এবং ক্যাফের মালিক। তিনি কমিউনিটি সংগঠনে একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন। তাসাদ্দুক ক্যারোলাইন অ্যাডামসের কাছে স্মৃতিচারণা করে বলেন কেনসিংটনে আবদুল মান্নানের বাড়ি আলস কোর্টের গ্রিন মাস্ক রেস্টুরেন্ট পাকিস্তানের সব রাজনৈতিক নির্বাসিতদের সভার কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠে। পাকিস্তানের বিরোধী দলের কেন্দ্র ছিল ২৯ সেন্ট ম্যারি এবোট টেরেস।৮ বামদের সঙ্গে তার জোট থাকা সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তানে তার সঙ্গে কাজ করা তাসাদ্দুকের সেই ব্যক্তি ছাড়া ভাসানী লন্ডনে প্রতিষ্ঠিত বাম রাজনীতির কোনো উত্তরাধিকার রেখে যাননি। ‘রেড মাওলানা’ নিঃসন্দেহে দক্ষ নেতা হওয়া সত্ত্বেও কোনো স্পষ্ট মতাদর্শগত বার্তা দেননি।

ছাত্র, শ্রমিক ও ব্যবসায়ী

লন্ডনে বাঙালি রাজনীতি উন্নয়নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল ক্ষুদ্র বুদ্ধিজীবী এলিটদের ভূমিকা, যাদের অনেকেই ছাত্র ও পেশাদার তরুণ যারা রাজনীতি শিখেছে বাংলায় স্থানীয় জাতীয়তাবাদ আন্দোলন এবং নির্যাতিত বামদের কাছ থেকে। মার্ক্সবাদী ধারণা দ্বারা প্রভাবিত হওয়া সত্ত্বেও আমূল পরিবর্তনের ক্ষেত্রে তাদের প্রতিশ্রুতি গ্রামীণ জমিদার পরিবারের সদস্য হিসেবে প্রতিফলিত হয়, যা পিতৃতান্ত্রিক ঐতিহ্য অনুযায়ী চালিত হয়।

নুরুল ইসলাম ছিলেন এর মধ্যে একজন ছাত্র যিনি অভিবাসনের ইতিহাসে পঞ্চাশের শেষে ও ষাটের দশকে ব্রিটিশ বাংলা রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।৯ তিনি ১৯৫৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষে লন্ডনে এসেছিলেন। রেলওয়ে ক্লার্ক হিসেবে চাকরি নেন যখন লিনকন ইনে ব্যারিস্টার হিসেবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিলেন। তিনি স্মরণ করেন নর্থ লন্ডনে একটি বাড়িতে ১৫ জন ছাত্রের একটি মিটিংয়ের কথা যেখানে তাসাদ্দুক তাদের বলেছিলেন, ‘পুঁজিবাদী হওয়া ভালো কিছু নয় এবং ব্যারিস্টার ও আইনজীবী হয়ে লাভ কি যদি তুমি জনগণকে শোষণ করতে চাও? বরং নিজেকে শিক্ষিত কর, মার্ক্স, এঙ্গেলস, রুশো, ভলতেয়ার-মাঞ্জিনি পড়, টলস্টয় এবং শান্তি ও সংঘর্ষ দেখো....।’

ইংল্যান্ডে আসার পরপরই ১৯৫৩ সালে অফিস সম্পাদক হয়ে তাসাদ্দুক ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনকে একটি শক্তিশালী ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার গুরু ভাসানীর মতো তিনিও অনেক দ্বান্দ্বিক মানুষ: একজন জমিদারের ছেলে যিনি উত্সাহী কমিউনিস্ট, অভিজাত ভাবভঙ্গি রয়েছে, ছোট ব্যবসা-বাণিজ্য খুব ভালো করেছে এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সদস্য হিসেবে সম্মানিত হয়েছেন।১০ কল্যাণমূলক কাজ হলো অভিবাসী সংস্থার কাঁচামাল এবং তাসাদ্দুক তার কাজগুলোকে কল্যাণমূলক অ্যাসোসিয়েশনের জন্য দেখেছিলেন জনগণের রাজনৈতিক সচেতনতা হিসেবে। তিনি নিজস্ব বিশ্বাস নিজের এবং ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের মধ্যে রেখে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে অলাভজনক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবহার করে পপুলার ফ্রন্ট রাজনীতিতে ছিলেন এবং আছেন।১১ তিনি এবং অন্যরা কমিউনিটির বড় বিষয় নিয়ে বেশির ভাগ জনগণকে সচল করেছিল এবং রাজনৈতিক অংশগ্রহণ উত্সাহিত করেছিল, কিন্তু তাদের সমাজতন্ত্র খুব গভীরভাবে একটি দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব তৈরি করতে অন্যান্য কার্যক্রমে নিমজ্জিত থেকেছিল।

তাসাদ্দুকের আলোচনায় আরেকজন নিয়মিত অংশগ্রহণকারী ছিলেন শাহ লুত্ফর রহমান যিনি পঞ্চাশের দশকের শেষে ঢাকায় রাজনীতি করে আইনের ছাত্র হিসেবে এলএসইতে (লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস) আসেন।১২ ছাত্রদের কমনরুমে ‘দক্ষিণ এশিয়া কি’ শীর্ষক রাজনৈতিক আলোচনায় একজন আইরিশ মহিলা কর্তৃক কমিউনিটিতে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পর পূর্বাচলের বাঙালিদের সঙ্গে তাঁর আজীবন সম্পৃক্ততা শুরু করেন।১৩

শাহ ১৯৫৯ সালে কল্যাণ অ্যাসোসিয়েশনের অফিস সহকারীর দায়িত্ব নেন, যেখানে তিনি রোববার সকালে তার স্বদেশি অশিক্ষিতদের বাড়িতে চিঠি লেখার কাজে ও অফিসের ফরম পূরণ করা শেখাতে সাহায্য করত।

শেখ মান্নানও ব্রিটেনে ছাত্র হিসেবে ১৯৬৪ সালে আসে। তাঁর মনে আছে যে লন্ডনে পাকিস্তানি ছাত্ররাজনীতিতে বামপন্থীরা কর্তৃত্ব করত এবং ২০০ ছাত্র যাদের প্রায় সবাই বাঙালি তারা পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট গঠন করেছিল।১৪ ষাটের দশকের শেষে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বাম রাজনীতি দ্বারা ছেয়ে যায় কিন্তু পাকিস্তানি স্বাধীনতার পূর্বেই বাঙালি সংস্কারী মতবাদের নিজস্ব কঠিন লড়াইয়ের ইতিহাস রয়েছে।১৫ ভাগ হওয়ার আগের ঢাকায় শেখ মান্নান তরুণ কিশোর হিসেবে রাজনৈতিক সচেতনতা নিয়ে নেমে পড়েন, সেখানে তিনি দেখেন নতুন পশ্চিম পাকিস্তানি মুসলিমরা পূর্বের হিন্দু এলিটদের প্রতিস্থাপন করেছিল, মৌলিক কোনো পরিবর্তন হয়নি।

ষাটের দশকে বাঙালি বামপন্থীরা ভেঙে যায়, যেখানে আন্তর্জাতিক ঘটনার প্রতিফলন ছিল। ‘এক দেশে সমাজতন্ত্র’ ধারণাটি একটি নতুন জাতীয়তাবাদকে বৈধতা দিয়েছিল এবং বিভিন্ন স্ট্যালিনিস্ট দেশগুলোর আমলাতান্ত্রিক প্রতিযোগিতা ১৯৬৪ সালে চীন-সোভিয়েত দ্বন্দ্বের দিকে ধাবিত করেছিল। মাওবাদীদের নিজস্ব আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ছিল যারা নিজেরা কৌশলগতভাবে বিভক্ত ছিল। শেখ মান্নান বিভক্ত ন্যাপের মস্কোপন্থী সেকশনকে অনুসরণ করে। তিনি দাবি করেন বেশির ভাগ ছাত্র তার মস্কোপন্থী ভাবধারায় বিশ্বাসী।১৬ শাহ কমিউনিস্ট পার্টির পিকিংপন্থী দলকে অনুসরণ করে এবং নুরুল ইসলাম আওয়ামী লীগের আস্থাভাজন হয়ে ওঠে।

নূরুল ইসলাম দেখেছেন ১৯৫৮ সালে পাকিস্তান সামরিক শাসনের অধীনে এলে লন্ডনের ছাত্ররা নতুন রাজনৈতিক গুরুত্বের দিক দেখে:

“আমরা বলেছি আমরা মুক্ত। এখানে কেউ আমাদের কিছু করতে পারবে না। পাকিস্তানে কী হচ্ছে সে ব্যাপারে আমাদের চিত্কার করে বিশ্ববাসীকে জানানোর দায়িত্ব আছে, গণমতামত তৈরি, আন্তর্জাতিক মতামত তৈরির দায়িত্ব আছে; কারণ আইয়ুব খান ও সামরিক শাসন সকল সাংবাদিকদের অবহেলা করেছে।”১৭

আগে থেকে প্রতিষ্ঠিত অভিবাসীদের নূরুল ইসলাম ছাত্র পৃষ্ঠপোষক হিসেবে গণ্য করতেন যারা পূর্বের রাজনৈতিক ক্যাম্পেইনে অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছিল। যদিও কমিউনিটি কর্তৃক তৈরি রাজনৈতিক চাহিদার গ্রহণক্ষমতা ছিল, কিন্তু তাদের রাজনৈতিক জ্ঞান সাধারণত ছিল কম। বাঙালিদের ভিত্তি রাজনীতির উন্নয়নের জন্য পৃষ্ঠপোষকতার উপযোগী নয় এবং তাদের অনেকে কম শিক্ষিত এবং অশিক্ষিত। নুরুল ইসলাম মনে করেন চিত্তবিনোদনের অন্য উপায় না থাকা গণমিটিংয়ে লোকজন সমাগমের একটা কারণ এবং তিনি স্বীকার করেন যে ষাটের দশকের শেষে সাধারণ মানুষের মধ্যে কমিউনিস্ট বা সমাজতান্ত্রিক শিক্ষা বলতে ছিল না।’১৮ যদিও কিছু রেস্টুরেন্ট মালিক যেমন আবদুল মান্নান তাসাদ্দুকের আলোচনা গ্রুপে এসেছিল, কিন্তু শাহ বাঙালিদের অধিকাংশ সম্পর্কে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে দেয়নি, তিনি খুঁজে বের করেন তারা সকাল ৬টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত কাজ করে এবং তাদের জীবনের দিগন্ত অত্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল।১৯ অনেকের মতে ছাত্ররাজনীতি অনেকটাই চরমপন্থী ছিল। শাহ স্মরণ করেন যখন তারা তাঁদের বুলেটিন পূর্ব বাংলা বিক্রয় করেন, অনেক মানুষ এটা পছন্দ করেনি, তারা ভাবে আমরা পঞ্চম কলামিস্ট, কমিউনিস্ট। অনেক মানুষ আমাদের বিরোধিতা করে এই বলে যে আমরা পাকিস্তান ভাগ করতে চাই। ভারতের মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান ছিল খাঁটি এক আকাঙ্ক্ষা।২০

শাহ-এর মতে, অন্য বাঙালিদের মধ্যে সংহতি আনার জন্য রাজনৈতিকভাবে সচেতন ছাত্ররা ‘অনুঘটক’ হিসেবে কাজ করে । তিনি মন্তব্য করেন:

বাঙালিদের রাজনীতিকরণ সহজাতভাবে লন্ডনের পূর্বাচলে ঘটেনি। এটা ঘটেছে কারণ বাঙালি সম্প্রদায়ের কিছু ছাত্র ও বুদ্ধিজীবী যারা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন, লন্ডনের পূর্বাচলের বাঙালি সম্প্রদায় সম্পর্কে আগ্রহ প্রকাশ করতে শুরু করেন, বিশেষত পাকিস্তানের শোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন সম্পর্কে।২১

ছাত্ররা প্রশাসনিক, পেশাগত দক্ষতা ও বিস্তৃত রাজনৈতিক বিশ্লেষণ এনেছিল এবং কঠোর পরিশ্রমী অভিবাসীদের যে ধরনের সময় থাকত না তা তাদের ছিল।

এখানে দেখা যায় পূর্বের আন্দোলনের স্মৃতি কমিউনিটিকে রাজনৈতিক ধারণাগুলোর ব্যাপারে অপেক্ষাকৃত গ্রহণক্ষম করে তোলে, কিন্তু তারা তৃণমূল সংগঠনের তেমন উত্তরাধিকার রেখে যায়নি। যদিও এখন অন্য প্রজন্মের কর্মী এবং নতুন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বাঙালিকে কাছে টানছে। ছাত্র এবং বাঙালি ব্যবসায়ীদের মধ্যে রাজনৈতিক সম্পর্ক ১৯৬৪ সালে হাইবুরিতে পূর্ব পাকিস্তান হাউসের প্রতিষ্ঠা দ্বারা উদাহরণ দেওয়া হয়ে থাকে। প্রাথমিক উত্সাহ আসে ছাত্র এবং কর্মীদের থেকে কিন্তু বাড়িটি অর্থায়ন করেছিলেন রেস্টুরেন্ট মালিকরা। শাহ স্মরণ করেন যে যদিও তাঁরা উদার ছিলেন, কিন্তু তাঁরা প্রথমে সতর্ক ছিলেন।২২

১৯৬৯ সালে যখন শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদের জন্য ভারতের সঙ্গে পরিকল্পনাকারী হিসেবে অভিযুক্ত হয়, পূর্ব পাকিস্তান হাউসের কর্মী ও রেস্টুরেন্ট মালিকগণ রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি করে এবং বাঙালি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করে পাকিস্তানে পাঠানো হয় তাঁর প্রতিরক্ষার জন্য।

গণসমাবেশ

১৯৭১ সালের ঘটনা প্রবাসী বাঙালিদের আলোড়িত করেছিল এবং শুধু তাদের মাতৃভূমি একটি নতুন সম্পর্ক ত্যাগ করেনি, একটি নতুন রাজনৈতিক সচেতনতাও ত্যাগ করেছিল। ট্রিগার ছিল পাকিস্তানের নির্বাচন।

১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর বারো বছরের একনায়কতন্ত্রের পর পাকিস্তান নির্বাচনে যায় কিন্তু নির্বাচনের আগে পূর্ব পাকিস্তানে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস আঘাত হানে যার ফলে লাখ লাখ মানুষ মারা যায়। দুর্যোগ মোকাবিলায় পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের অবহেলা বাঙালিদের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানিদের বিভেদ সৃষ্টি করে। ব্রিটেনে জরুরি ত্রাণ সংগ্রহ করা হয়। ন্যাশনাল ফেডারেশন অব পাকিস্তানি অ্যাসোসিয়েশন এবং পূর্ব লন্ডন মসজিদ২৩ অর্থ সাহায্য বাড়ায়, ছাত্ররা সভার আয়োজন করে সবার কাছ থেকে টাকা, কাপড় ও অন্যান্য জিনিস সংগ্রহ করে স্বাধীনতা সংগ্রামকে ঘিরে গণসমাবেশের জন্য।

আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের লক্ষ্যে নির্বাচনের দিকে ধাবিত হয়। অন্যান্য বিরোধী দল নির্বাচন বয়কট করে, আর বাকিরা প্রান্তিক অবস্থানে চলে যায়২৪ এবং লীগ পূর্ব পাকিস্তানে ১৬২টি আসনের মধ্যে ১৬০টি পায়। আসনগুলো জনসংখ্যা হিসেবে বণ্টন করা হয় যেখানে পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে যায় এবং এটা জাতীয় সংসদে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভে সহায়ক হয়।২৫ কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি নেতাগণ আওয়ামী লীগ সরকারকে গ্রহণ করেনি। মূল নেতাদের সভায় কোনো অগ্রগতি হয়নি। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি পেছানোর ঘোষণা দেওয়া হয় এবং জনগণ ঢাকার রাস্তায় নেমে আসে। আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিব ৭ মার্চ জনগণের চাহিদার ওপর ভিত্তি করে লাখ লাখ মানুষকে বলে এই সংগ্রাম চূড়ান্ত মুক্তি ও স্বাধীনতার সংগ্রাম।

মার্চের প্রথমদিকে লন্ডনের প্রধান পাকিস্তানি হোস্টেল চেসাম প্লেস আলোচনায় উত্তেজিত ছিল। তখনকার বামপন্থী পাকিস্তান গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের প্রেসিডেন্ট শেখ মান্নান বোর্ডে কিছু পশ্চিম পাকিস্তানিকে রাখতে চেয়েছিল।২৬ ছাত্ররা শেখ মুজিবের রেডিওতে প্রচারিত ভাষণ শুনেছিল এবং সরাসরি পাকিস্তান হাইকমিশনের বাইরে অবস্থান করেছিল। ছাত্রদের জন্য সাধারণ জীবনযাপন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এবং প্রতিদিন রাত শুধু আলোচনায় কাটে এবং বাংলা থেকে পরবর্তী নির্দেশের অপেক্ষায় থাকে। বাঙালি ডাক্তার, মহিলা ও অন্যান্য গ্রুপের সভা হতে থাকে এবং আলোচনা করতে থাকে তারা কে কী করতে পারবে।২৭

ঢাকায় মূল দলের মধ্যে ২৪ মার্চ সমঝোতা আসে এবং সে রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে এবং সহিংসতা ব্যভিচারের মাধ্যমে হাজার হাজার নির্দোষ মানুষের ওপর অত্যাচার চালায়। ব্রিটেনে সব জায়গায় সভা হতে থাকে এবং অ্যাকশন কমিটি গঠিত হয়। তাদের পরিবার ও বন্ধুবান্ধব থেকে পাওয়া খবরের ওপর ভিত্তি করে কিছু একটা করার অপ্রতিরোধ্য ইচ্ছা ছিল তাদের মধ্যে। অবশ্যই কিছু ছিল যারা পাকিস্তানের প্রতি তাদের অতীতের আনুগত্য বজায় রাখে কিন্তু বেশির ভাগ মানুষের প্রতিক্রিয়া ছিল নবাব আলির মতো, যার বেপরোয়া কাজ ক্যারোলিন অ্যাডামসের মৌখিক ইতিহাসে রয়েছে:

আমি বাংলাদেশের সংগ্রামকে সমর্থন করি, (যেমন: ব্রিটেনের কাছ থেকে পাকিস্তানের স্বাধীনতা সংগ্রামকে করেছিলাম) তাত্ক্ষণিক করিনি কারণ আমরা পাকিস্তান তৈরির জন্য সংগ্রাম করেছিলাম, তাই আমরা এটা হারাতে চাই না, কিন্তু যখন আমরা সংবাদপত্র দেখি, বাঙালি নারীদের সঙ্গে তারা কী করেছে তার চিত্র দেখি, তখন সেটা সমর্থন না করে পারিনি। আমার পরিবারের আটজন সদস্য ছিল মুক্তিবাহিনীতে।২৮

ব্রিটিশ বাঙালিদের একটি গ্রুপে আনা অত সহজ ছিল না—অন্য সব সমস্যার সঙ্গে রাজনৈতিক সংগ্রাম তৈরি হয়। কমিউনিটি রাজনীতির প্রধানতম বৈশিষ্ট্য ছিল ব্যক্তিগত রেষারেষি এবং প্রথাগত বন্ধন২৯, কিন্তু অনেক নেতৃস্থানীয় কর্মীর মধ্যে কম আলোচিত কিন্তু মৌলিক আদর্শগত পার্থক্য ছিল। আওয়ামী লীগের মধ্যে রেষারেষি দুটি সংগঠনের জন্ম দিয়েছিল। দুটোই নিজেদের আওয়ামী লীগের বৈধ ব্রিটিশ অংশ বলে দাবি করে। যা হোক, বামপন্থীরা আওয়ামী লীগের পরিকল্পনার বাইরে এক ভিন্ন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিল। যদিও বেশির ভাগ বামপন্থী আওয়ামী লীগ ও জোট নিরপেক্ষ দলের সঙ্গে মিলে কাজ করেছে, তবুও অন্তর্নিহিত টেনশন ও অবিশ্বাস ছিল।

শেখ মান্নান উত্তাল সাংগঠনিক ইতিহাস স্মরণ করেন। সমবায় সমন্বয় পরিষদের প্রতিষ্ঠার প্রথম প্রচেষ্টার পরে কভেন্ট্রিতে কনভেনশনের জন্য বাঙালিদের মধ্যে সভা হয়। এটা ২৪ এপ্রিল হয়। ক্যারোলিন অ্যাডামসের কাছে লুলু বিলকিস বানু সভা সম্পর্কে তিনি বর্ণনা করেন:

সভার সভাপতি হিসেবে তারা অন্য কাউকে চেয়েছিল, তাই যখনই কারও নাম প্রস্তাবিত হয় অন্যরা চিত্কার করে, ‘না. না, সে চোর, সে প্রতারক, সে এটা সে ওটা।’ (তারপর কেউ মিসেস বানুকে বলেন আমাকে প্রস্তাব দেওয়ার জন্য) এবং আমি বলি ঠাট্টা করবেন না, এই নরকে আমি সভাপতিত্ব করব? তারা চেয়ার ভাঙছে, একে অন্যকে মারছে, শুধু ওখানে অনেক শত্রুতা ছিল (কিন্তু তাকে চেষ্টা করার জন্য রাজি করানো হয়েছিল) এবং তারা সকলে হাততালি দেয়। অনেক শান্ত ছিল সবাই, কেউ বিরোধিতা করেনি, কারণ আমি সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক, অদলীয় ছিলাম।৩০

কনভেনশনে পাঁচজনের জাতীয় কমিটি গঠিত হয়, শেখ মান্নানও ছিলেন যিনি আহ্বায়ক হিসেবে কাজ করেন। তিনি স্মরণ করেন তাঁরা কেউই আওয়ামী লীগের পরিশোধিত সদস্য ছিলেন না। এই কমিটি ক্যাম্পেইনটি সমন্বয় করে এবং একটি বড় কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের দায়িত্বও ছিল এই কমিটির ওপর। তা করতে ব্যর্থ হওয়ায় আওয়ামী লীগের একটি বড় দল কমিটি দখলের প্রয়াস চালায়, যারা গণহারে স্টিয়ারিং কমিটির অফিসে প্রবেশের জন্য সুবিধাজনক উপায় গ্রহণ করে।৩১ লন্ডন পর্যায়ে চৌদ্দটি ভিন্ন কমিটি এক নেতৃত্বের অধীনে আনার উদ্যোগ সফল হয়নি।

কমিটির বাইরে একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রুপ হলো বিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির পিকিংপন্থী, যারা কভেন্ট্রি কনভেনশনের পর সংগঠিত হয়। তারা পূর্ব বাংলায় তাদের নেতাদের কাছ থেকে নির্দেশনা নিয়ে ‘গণযুদ্ধ’ নামে তাদের নিজস্ব পত্রিকা বের করে, যা তারা বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠায়। পপুলার ফ্রন্টিজমকে বাতিল ঘোষণা করার পাশাপাশি তারা বলে যে মার্ক্সবাদ তত্ত্বীয় গণতান্ত্রিকভাবে সংগঠিত শ্রমিক আন্দোলনের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানে সমাজতন্ত্র কায়েম করা যাবে না। বরং এটা করতে হবে মাওবাদী ধারার কৃষক বিপ্লবের মাধ্যমে।

মস্কোপন্থী, ভাসানী ন্যাপ-এর পিকিংপন্থী এবং আওয়ামী লীগ সমর্থকসহ বেশির ভাগের জন্য সার্বিক নেতৃত্বের প্রশ্নের সমাধান হয় বাইরের হস্তক্ষেপে। যখন জেনেভাতে একটি আন্তর্জাতিক কনভেনশনে কোন্দল শুরু হয় তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং ঢাকা হাইকোর্টের বিচারক আবু সৈয়দ চৌধুরী অংশগ্রহণ করেন এবং তিনি বিভিন্ন দলের সমস্যাগুলো সমাধানের পক্ষে মত দেন। জাস্টিস চৌধুরীকে পরে কলকাতায় বাংলাদেশের নির্বাসিত সরকার পূর্ণ ক্ষমতাপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করে এবং কমিটিকে মধ্যপন্থী লাইনে রাখা নিশ্চিত করে। এটা একমত হয় বাংলাদেশ ফান্ডের জন্য ট্রাস্টি অবশ্যই জাস্টিস চৌধুরী এবং দুজন নিরপেক্ষ অবাঙালি ডোনাল্ড চেজওয়ার্থ এবং জন স্টোনহাউস হওয়া উচিত। স্টোনহাউসের পরবর্তী ইতিহাস নিয়ে (তার নিজের মিথ্যা আত্মহত্যার ঘটনার পর অর্থনৈতিক জালিয়াতির জন্য অপরাধী প্রমাণিত হওয়া) বাঙালি মতামত হলো, ১৯৭১ সালে স্টোনহাউসের ভূমিকা নিঃস্বার্থ ও সত্ ছিল।৩২ চেসওয়ার্থ ছিল ওয়ার অন ওয়ান্ট-এর চেয়ারম্যান এবং পূর্ব বাংলায় তার কাজের সুপরিচিত প্রমাণ ছিল।

অনেক ভগ্নাংশ সমস্যাগুলোর মূলে ছিল পূর্ব বাংলা কিন্তু বাঙালি গ্রামের সংযোগ ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারত যখন জনগণের বিক্ষোভের সময় উত্থান হয়েছিল। তারপর বিভিন্ন নেতার একটি প্রথাগত বন্ধনের ওপর ভিত্তি করে নিম্নলিখিত আশাগুলো করতে পারে৩৩ এবং সামগ্রিক সংখ্যার অনুমোদনের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক উপাদান পরিবেশিত হয়।

ব্রিটিশ কমিটির দুটি প্রধান কাজ ছিল: প্রজ্ঞাপন এবং অর্থায়ন। তারা পুরো বাঙালি সম্প্রদায়কে এক করতে চায় এবং শেখ মান্নান ‘প্রত্যেক বাড়ি ও ফ্ল্যাটের’ তদবিরের কথা স্মরণ করেন। তিনি রাজনৈতিক দিক অবজ্ঞা করেন এবং স্বাধীনতার কথা বলেন।৩৪ মতাদর্শ সাধারণত পত্রিকা ও জার্নালে ন্যস্ত থাকে। পূর্বে অন্য অভিবাসী ও নির্বাসিতদের মতো বাঙালি বিস্তৃত গণচাপের কেন্দ্র হিসেবে লন্ডনের কৌশলগত মূল্যকে উপলব্ধি করে।৩৫ এর শেষে তারা বিক্ষোভের আয়োজন করে। সংসদীয় সদস্যদের আহ্বান করে। দলের ও ট্রেড ইউনিয়নের সঙ্গে সম্মেলন করে এবং ব্রিটিশ সংবাদপত্রে চিঠি ও বিজ্ঞাপন পাঠায়। যারা বাংলার ধ্বংসযজ্ঞের সাক্ষী তারা ভাষার ব্যবহার করতে পারে। অক্টোবরে আজিজ চৌধুরী যখন লন্ডনে পৌঁছায় তখন তার রাজনৈতিক পরামর্শদাতা পীর হাবিবুর রহমান তাকে বলেন কী হচ্ছে তা সবাইকে জানানোর জন্য এবং একজন বাঙালি পাসপোর্ট অফিশিয়াল তাঁর জীবন কেড়ে নেন।৩৬ তিনি সমগ্র ইংল্যান্ডে বাঙালি সম্প্রদায়ের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন। যখন তাঁরা এমন কারও কথা শোনেন যিনি বাংলাদেশ থেকে এসেছেন সেটা সম্পূর্ণ ভিন্ন হয়। আমি দুবার বন্দুকের মুখে পড়েছি যাতে মানুষকে সাহস জোগাতে পারি দেশের জন্য অবদান রাখতে।৩৬ অর্থায়ন সম্প্রদায়কে আলোড়িত করে এবং সবার সাহায্যে অর্ধ মিলিয়ন পাউন্ড সংগৃহীত হয়।৩৮ আলী সৈয়দ গয়াস এখন টয়েনবি হল প্রিজনারস ক্লাবের সদস্য। তখন তাঁর বাবার সঙ্গে বার্মিংহামে বসবাস করতেন। গৃহস্থালি কাজ করে তাঁরা ৮ পাউন্ডে সপ্তাহ চালাতেন এবং একটি গাড়ির ফ্যাক্টরিতে রাতের শিফটে কাজ করে ২৫ পাউন্ড বাড়িতে পাঠাতেন। যখন যুদ্ধ শুরু হয় তখন তিনি পূর্ব পাকিস্তানে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে রেখে আসেন এবং অনেক মাস তাঁরা মা-ভাইয়ের কাছ থেকে কোনো খোঁজখবর পাননি। তিনি ৫২৮ পাউন্ড তাঁর ব্যাংকে জমা করেন এবং বাংলাদেশ ফান্ডে দান করেন।৩৯

গয়াস ১৯৬৯ সালে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। টয়েনবি ক্লাবের আরেক সদস্য আবদুর রাজ্জাক তখন ব্রাডফোর্ড উল মিলে রাতে কাজ করতেন। তিনি কখনো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না কিন্তু ১৯৭১ সালে শনিবার সকালে যখন তাঁর কাজ শেষ করেন তখন ব্রাডফোর্ডের বাঙালিদের সঙ্গে লন্ডনের বিক্ষোভে যোগ দেন এবং রাজ্জাক আওয়ামী লীগের একজন সদস্য হয়ে যান।৪০

এটা আলহাজ শামস উদ্দিনের রাজনৈতিক জাগরণের সময় ছিল, যিনি ১৯৬৩ সালে ব্রিটেনে আসেন এবং বর্তমানে জাতীয় পার্টির যুক্তরাজ্য শাখার সভাপতি। তিনি ব্যাখ্যা করেন: ‘সে সময় প্রায় সবাই রাজনৈতিকভাবে সচেতন হচ্ছিল কারণ পূর্বে কেউই রাজনীতিতে আগ্রহী ছিল না’।৪১

আন্দোলনের শ্রেণিভেদ্য প্রকৃতি সত্ত্বেও কিছু রেস্টুরেন্ট শ্রমিক তাদের চাকরি বিক্ষোভের ঝুঁকিতে ফেলেছে। তাদের বাঙালি কর্তাগণ যখন কাজ ছাড়তে এবং বিক্ষোভে যোগ দিতে নিষেধ করেছেন এবং তাদের অবৈধ অভিবাসী প্রমাণিত করার হুমকি দিয়েছেন, তখন বাণিজ্যিক স্বার্থই বিজয়ী হয়েছে।৪২

পূর্বাচলের বাঙালিদের৪৩ মধ্যে কিছু নারী ছিল যাদের যেকোনো ধরনের রাজনৈতিক কাজে বাধা ছিল। কিন্তু সংখ্যায় কম কিছু মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষিত নারী ছিলেন যাঁরা ট্রাফালগার স্কয়ারে অর্থায়নের কাজ করেছেন। শাহ লুত্ফর রহমানের স্ত্রী মুন্নি, শেখ মান্নানের স্ত্রী রোজি ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম।

মুক্তিবাহিনীর জন্য যুদ্ধাস্ত্র, পরিবহন খরচ প্রচারণার জন্য টাকা সংগ্রহ করা হয়। শেখ মান্নান বলেন, ‘উচ্চাকাঙ্ক্ষা বৃদ্ধি পায় এবং সবাই অস্ত্র কেনার জন্য টাকা ব্যয় করতে চায়। কিন্তু আমরা যখন ভারতীয় হাইকমিশনে যোগাযোগ করি আমরা প্রত্যাখ্যাত হই।’ আধুনিক যুদ্ধ পরিচালনায় সংগৃহীত অর্থ অনেক কম বলে অজুহাত দেওয়া হয়।

বৃদ্ধ লোকটি বসে হাসছিল। তিনি বলেন, ‘তোমাদের কত টাকা আছে?’ আমি বললাম, ‘আমরা যত অস্ত্র পাঠাব তত টাকা আসবে।’ তারপর তিনি বলেন, ‘তোমাদের পকেট কত বড়।’৪৪

অকুতোভয় শেখ মান্নান ও তাঁর কিছু সহকর্মী পাকিস্তানি নৌবাহিনীর একজনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, যিনি বলেছিলেন যে সে ব্যাক্তিগতভাবে কিছু ক্ষুদ্র অস্ত্র জোগান দিতে পারেন। কিন্তু যখন তাঁরা জাস্টিস চৌধুরীর মুখোমখি হন তখন তিনি হতভম্ব হয়ে যান।’

তিনি টেবিলে মাথা রেখে নুইয়ে পড়েন। তিনি বলেন, তোমরা আমাকে হতাশ, নিরাশ ও চূর্ণ করেছ। কীভাবে ব্রিটিশ সরকার এটার অনুমতি দেবে? যদি তারা কাল এটা জানতে পারে যে তোমরা এটা করেছ আমার অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে। দেশের বাইরের সকল আন্দোলন বন্ধ হয়ে যাবে। তোমরা কেন এটা করেছ?

জাস্টিস চৌধুরী কলকাতায় নির্বাসিত সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে জেনারেল ওসমানী ও অন্যদের অস্ত্রের জন্য ব্যক্তিগত অনুরোধ পাঠানো বন্ধ করতে বলেন।৪৫ যুদ্ধের পর বাংলাদেশের নতুন সরকারের কাছে টাকা দেওয়া হয় এবং রাষ্ট্রীয় ব্যাংক গঠনে ব্যবহূত হয়।৪৬

ব্রিটিশ বাঙালিরা তাদের প্রভাবের সীমা বুঝতে পারে। এটা লন্ডনের সংস্থাগুলোর বিশ্বাস যোগ্যতা ও শান্তি ধ্বংস করে দেয়। মান্নান পরে পর্যবেক্ষণ করেন টাকা আসার পরিমাণ উত্সাহজনক কিন্তু যখন তারা শুনতে পায় যে কোনো অস্ত্র পাঠানো হচ্ছে না তখন প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়।৪৭

পপুলার ফ্রন্টের লিগ্যাসি

১৯৭১ সালের সংহতির দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবের বিশ্লেষণে বাম গোষ্ঠীদের পপুলার ফ্রন্ট নীতির প্রভাব পরীক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্থানীয় কমিউনিস্ট পার্টির ১৯৭১ সাল পর্যন্ত টাওয়ার হ্যামলেট কাউন্সিলর ছিল। কিন্তু টাওয়ার হ্যামলেটে যেসব বাঙালি কাজে যুক্ত ছিল, তারা আন্তঃযুদ্ধ কর্মকাণ্ডে তাদের শিক্ষা কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়।

১৯৭১ সালে পপুলার ফ্রন্ট এবং স্টেজ তত্ত্ব অনুসারে পাকিস্তান ও ব্রিটেনের অধিকাংশ বাঙালি স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামে তাদের রাজনৈতিক ব্যবধান দূরে রেখেছে। শেখ মান্নান তাঁর অবস্থান সম্পর্কে বলেন:

জাতীয়তাবাদ একটি রোগ। কিন্তু আমরা ১০০০ বছর ধরে অনেক অত্যাচারিত হয়েছি; আমরা জাতীয়তাবাদের ট্যাগ চাই প্রথমে, অন্যথায় আমরা মানুষকে সন্তুষ্ট করতে পারব না। আমরা ভাবছিলাম আমাদের স্বাধীনতা অর্জন করতে দাও এবং স্বাধীনতার পরপর আমরা বিভক্ত হব এবং তখন তারা তাদের প্রোগ্রাম জনগণকে দেবে। যদি আমরা সফল হই সরকার আমাদের। এভাবে আমরা একসঙ্গে কাজ করেছিলাম। যদি আওয়ামী লীগ দেশে ও দেশের বাইরে স্বাধীনতা আন্দোলনের একমাত্র দল হতো তাহলে এটা ব্যর্থ হতো।৪৮

স্টিয়ারিং কমিটির একজন আহ্বায়ক হিসেবে তাঁকে ‘নিরপেক্ষ’ এবং ‘দল নয়, জাতীয়তাবাদী চেতনা’ ধারণ করতে হতো। যদি তিনি কখনো তাঁর রাজনৈতিক মতামত দিতে চান, জাস্টিস চৌধুরী তাঁকে বলবেন ‘স্বাধীনতা প্রথমে নাকি তোমার মতাদর্শ প্রথমে?’৪৯

নুরুল ইসলাম যিনি পূর্ব পাকিস্তানে বাস করতেন কিন্তু রাষ্ট্রদূত হিসেবে মুক্তি কমান্ড দ্বারা দুই মাসের জন্য ইউরোপে পাঠানো হয়, মনে-প্রাণে নিজেকে শেখ মুজিবের অনুসারী করেছিলেন ‘কারণ সময়ের প্রয়োজন ছিল জাতীয়তাবাদ’। তার মানে এটা নয় তিনি তাসাদ্দুক যুগের সব আদর্শ প্রত্যাহার করেছেন: তিনি সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী এবং আওয়ামী লীগের সমাজতান্ত্রিক শাস্ত্রে, কিন্তু অনুভব করেন যে এটা পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ছাড়া অসম্ভব।৫০

শেখ মুজিবের ক্ল্যারিজ হোটেলে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণায় তাসাদ্দুকের সম্পৃক্ততা পপুলার ফ্রন্টের রাজনীতিকে সংক্ষেপে তুলে ধরে।৫১ কিন্তু আওয়ামী লীগ তাদের বাম সমর্থনকারীদের কিছু ছাড় দিত এবং মুজিব হিথরোতে নামার আগে শেখ মান্নানকে এ ব্যাপারে খোলাসা করেছেন।৫২ বেশির ভাগ বাম নেতা স্বাধীনতার কারণ প্রচারে এত ব্যস্ত ছিলেন যে শেখ মান্নানকে এটা মানতে হয়েছিল।

জনগণ আওয়ামী লীগ ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির মধ্যে সূক্ষ্ম ব্যবধানের ব্যাপারে অজ্ঞ ছিল। আমি তাদের রাজনৈতিকভাবে অপরিপক্ব বলব না কিন্তু তারা জানত না কারণ কেউ মওলানা ভাসানী থেকে বার্তা নেয়নি, রেস্টুরেন্ট, ফ্যাক্টরি, গার্মেন্টসে গিয়েছিল যেখানে আমাদের জনগণ কাজ করে। যদি আমরা যেতাম তা হতো পূর্ব পাকিস্তানের জন্য।৫৩

ব্রিটিশ বাঙালি সম্প্রদায়ে বামপন্থীরা আলাদা পরিচিতি পায়নি। যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞের বাইরে অধিকাংশ বাঙালি স্বাধীনতার আনন্দ উপভোগ করে। যদিও লন্ডন তিন দশক ধরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রতিধ্বনি দেখছে, কিন্তু আর কোনো গণ আন্দোলন ছিল না এবং মতামত ও অগ্রাধিকার বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। ইতিমধ্যে কমিউনিটি তার দৈনন্দিন জীবনের সংগ্রামের দিকে মনোযোগ দেয়। ব্রিটিশ রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বাঙালিদের নতুন গণপরিচয় ও পরিচিতি হয়ে গেছে বাস্তবভিত্তিক রাজনীতি যেখানে লক্ষ্য হলো বিদ্যমান ব্যবস্থার সুষ্ঠু ভাগ নেওয়া, ব্যবস্থাকে বদলে দেওয়া না।

আমি এটা বলছি না যে স্বাধীনতাযুদ্ধ ছাড়া বাঙালি সম্প্রদায় একটি শক্তিশালী সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন করতে পারত। এই ইতিহাস একটি সমাজতান্ত্রিক উন্নয়নের প্রভাবের উদাহরণ, যা সর্বত্র অভিবাসী নীতিকে প্রভাবিত করেছে। নতুন মতাদর্শ যা পপুলার ফ্রন্টিজম থেকে আসে তা উন্নয়নকে প্রভাবিত করে। সত্তরের দশকের ‘কালো প্রগতিবাদ’ শেষ হয়ে গেছে, যা শুধু এটার রূপকের আমূল পরিবর্তনে নয়, বরং রাজনৈতিক মূলধারার বিভিন্ন আসনে প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রেও।৫৪ ব্রিটিশ বাঙালিদের রাজনীতি বৃহত্ প্যাটার্নের সঙ্গে মিশে গেছে৫৫ এবং মুুক্তিসংগ্রাম একটা আন্দোলন ছিল যার মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক ধারণা ক্রমান্বয়ে গ্রহণযোগ্যতা পেত যদি সমাজতন্ত্রের ধারকেরা নিজেদের বিদ্যমান বাম অর্থডক্সির সঙ্গে তাল মিলিয়ে সংকুচিত না করে ফেলত।

১৯৭১ এবং লেবার পার্টি

একই সময়ে পপুলার ফ্রন্ট রাজনীতির মূলধারার রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বাম নেতাদের কাজ করাকে গ্রহণক্ষম করে তোলে। বাংলাদেশি স্বাধীনতা সংগ্রামের মাধ্যমে রাজনীতিকীকরণ অনেক ব্রিটিশ বাঙালিকে ব্রিটিশ লেবার পার্টির সঙ্গে যুক্ত করে। লেবার রাজনীতির সঙ্গে ‘বাঙালি সম্প্রদায়ের দীর্ঘমেয়াদি অন্তরঙ্গ সম্পর্কের জন্য ১৯৭১ সালের ঘটনা ভূমিকা রেখেছে’।৫৬ বাঙালি অধ্যুষিত স্টেফানির সাবেক এমপি পিটার শোর বলেছেন, ‘মতাদর্শগতভাবে আওয়ামী লীগ এবং লেবার পার্টির মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গির মিল ছিল।’৫৭ বাস্তবিক অর্থে সংসদীয় দলটি বাঙালি মতামত প্রচারের জন্য চ্যানেল হিসেবে কাজ করে। শোর আমাকে বলেছেন:

আমি নিজেকে অনেক তাড়াতাড়ি গভীরভাবে সম্পৃক্ত হতে দেখেছি এবং আমি আন্তরিকভাবে সম্পৃক্ত ছিলাম। এটা ব্যাখ্যা করা কঠিন। (বাংলাদেশে) যা হয়েছে তাতে আমি ক্ষুব্ধ; আমি ব্রিটিশ রাজনীতির বেশির ভাগ মানুষের চেয়ে এ বিষয়ে ভালোভাবে জানতাম কারণ আমার অনেক সংগঠক আমাকে তাদের পরিবার ও আত্মীয়স্বজনদের দুর্দশার কথা বলেছে।৫৮

তাঁর অবদান বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত হয়েছে। পিটার শোরের প্রতি সমর্থন তার পুনর্নিবাচনের যুদ্ধ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, যখন মধ্য আশির দশকে জিল কোভ তাকে চ্যালেঞ্জ করে। অবশ্যই কিছু বাঙালি প্রগতিশীল ব্যক্তি সমর্থন দেয়, কিন্তু শোর দেখেছেন, ‘কমিউনিটি হিসেবে বাঙালিদের সমর্থনের ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন নেই।’৫৯

যুদ্ধের পর সম্পর্কটি অভিবাসনের নতুন অধ্যায় দ্বারা উত্সাহিত হয় এবং ভবিষ্যত্ আশা ব্রিটেনের দিকে ব্যক্ত করে। সত্তরের দশকের শুরুতে অনেক মহিলা ব্রিটেনে আসে। এটা একাত্তরের অভিবাসন নীতির নিয়ন্ত্রণের অধীনে ছিল, যা যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ এবং পরবর্তীতে বিশৃঙ্খলার ফলাফল ছিল। আশির দশকের শুরুতে নতুন জেনারেশন স্থানীয় লেবার পার্টিতে সরাসরি কাজ করার জন্য তৈরি হয়।৬০

লেবার পার্টিতে রাজনৈতিক জায়গা পাওয়ার জন্য বাঙালিরা স্ট্যান্ডার্ড অভিবাসী রুট অনুসরণ করে এবং যখন পার্টি স্থানীয় টাউন হল শাসন করত তখন লেবার পার্টির পছন্দ ছিল রাষ্ট্রীয় (বাঙালি লেবার কাউন্সিলরের সাক্ষাত্কার ২০০০)।৬১

লিগ্যাসি

লন্ডনের পূর্বাচলের একাত্তরের অনেক কর্মী তাদের আগের প্রজন্ম থেকে বেশি শিক্ষিত ছিল এবং তারা এই দেশের ভবিষ্যতের সঙ্গে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল। বর্তমান অভিবাসীদের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা অনেক কম। আনসার আহমেদ উল্লাহ, যিনি ১৯৭৫ সালে ১৫ বছর বয়সে ব্রিটেনে আসেন, লক্ষ করেন:

আমাদের মধ্যে অনেকে যুদ্ধ এবং যুদ্ধের আগে রাজনৈতিক আন্দোলন দেখেছে এবং এ সম্পর্কে সচেতন ছিল এবং এখানে এসে তারাও একইভাবে অনুভব করে। তারা মনে করে ইতিমধ্যে তারা এটা বুঝে ফেলেছে... আমরা আক্রান্ত হয়েছি, আমরা চাকরি পাব না, ঘর পাব না এবং সম্প্রদায় হিসেবে আমাদের নিচে থাকতে হবে।৬২

এসব মানুষ ব্রিটেনে তাদের জায়গার জন্য সংগ্রাম করতে রাজি এবং জাতিগত সচেতনতার মধ্যে জাতীয়তাবাদের সচেতনতা অন্তর্ভুক্ত।

শতাব্দীর শুরুতে টাওয়ার হ্যামলেটের বাঙালি সম্প্রদায় তাদের সুশীল সমাজ (২০০২ নির্বাচনের পর) ২৮টি পৌরসভাভিত্তিক নগরের ৫১ জন কাউন্সিলর (তাদের মধ্যে ২২ জন লেবার পার্টির সদস্য)। সম্প্রদায়ভিত্তিক সংস্থা নিয়ে তারা গর্ব করতে পারে। ৯/১১ পূর্বে ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদকে উগ্রবাদী মুসলিমরা চ্যালেঞ্জ করে।৬৩ যে প্রজন্ম একাত্তরের চেতনা দ্বারা প্রভাবিত তারা ধর্মপ্রাণ মুসলমান, কিন্তু বিশ্বাস করে ধর্ম হলো ব্যক্তিগত পছন্দ এবং একে রাজনীতি থেকে দূরে রাখা উচিত।

কিছু মানুষ নির্মূল কমিটি দ্বারা ধর্মনিরপেক্ষতা প্রচার করতে চেয়েছে। এই চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী সৃষ্টি হয়েছে যুদ্ধে ছেলে হারানো এক বাংলাদেশি মায়ের দ্বারা, যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং মুক্তি আন্দোলনের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে তুলে ধরার ক্যাম্পেইন চালিয়ে গেছে। এটা বলা হয় কিছু ইসলামি নেতা যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত এবং মসজিদকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে। জামাতে ইসলামী পার্টি পাকিস্তান বিভাগের বিরুদ্ধে ছিল। তাদের যুক্তি ছিল ইসলামে রাষ্ট্রের একাত্মতা জরুরি। সরকারপন্থী বাঙালিদের পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অস্ত্র দিয়ে সজ্জিত করে এবং তাদের মধ্যে কেউ কেউ যুদ্ধে স্থানীয় জানাশোনা থাকায় যুদ্ধের অনেক ভয়াবহ নৃশংসতা চালায় বা চালাতে সাহায্য করে।

নির্মূল কমিটি ব্রিটিশ বাঙালি হিসেবে বাঙালি তরুণদের ভালো পরিচয় তৈরিতে সাহায্য করতে চায়। আনসার আহমেদ উল্লাহ স্বীকার করেন ‘যেহেতু নির্মূল কমিটি রাজনৈতিক তাই এটি তরুণ প্রজন্মের কাছে মর্মস্পর্শী হয়ে ওঠেনি’৬৪ এবং তাঁর সহকর্মী সুনাহওয়ার আলী মন্তব্য করেন:

যদি তুমি বাঙালি সম্প্রদায়ের তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে কথা বল। যদি বল ‘একাত্তর কী, কী ঘটেছিল? বাংলাদেশ ও কার যুদ্ধ হয়েছিল?’ তারা বলবে, মনে হয় ব্রিটিশদের সঙ্গে বা অন্য কিছু। মানুষের কোনো সূত্র নেই।৬৫

নির্মূল কমিটির প্রতিক্রিয়া ছিল দু ধরনের। তারা তরুণ প্রজন্মকে একাত্তরের ঘটনা জানাতে চেষ্টা করেছিল এবং এটি তারা করতে চেয়েছিল বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি তরুণদের আকৃষ্ট করার মাধ্যমে। যা হোক, সাংস্কৃতিক রাজনীতি ইসলামের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারে না, যা তার অনুসারীদের মতাদর্শ অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা, বিরোচিত ইতিহাস, আন্তর্জাতিক শক্তি ও ভ্রাতৃত্ব এবং ভবিষ্যত্ উচ্চ সম্মানের ব্যাপারে ধর্মীয় প্রতিশ্রুতি দেয়। বিকল্প তৈরির শক্তি প্রয়োগের জন্য সত্যিকারের সমাজতন্ত্রের প্রয়োজন, যা সামাজিক বঞ্চনার জন্য নিজস্ব চরম আদর্শগত ও ব্যবহারিক এজেন্ডা উপস্থাপন করতে ভয় পায় না।

উপসংহার

গত ত্রিশ বছরে একাত্তরের উদ্দীপনা অনেক রূপ ধারণ করেছে। এতে করে বোঝা যায় যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে গণসমাবেশের প্রভাব কমিউনিটির মধ্যে এখনো রয়েছে এবং এটা এভাবে ব্যবসায়ী, শ্রমিক, শিক্ষিতদের একই রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির মধ্যে নিয়ে এসেছে। এখানে আন্দোলনের সময় রাজনৈতিক অস্থিরতার গুরুত্ব পরীক্ষা করা হয়েছে। কীভাবে স্ট্যালিনের স্টেজ থিওরি ও পপুলার ফ্রন্টিজম বৈপ্লবিক সমাজতন্ত্রে কাজ করে জাতীয়তাবাদের পক্ষে তা দেখানো হয়েছে। একটা বিস্তৃত গবেষণামূলক ইতিহাসের রাজনীতির ওপর আদর্শগত উন্নয়নের প্রভাব সম্পর্কে বলা হয়েছে, যা ব্রিটিশ অভিবাসী সম্প্রদায়ের সঙ্গে যুক্ত। সাম্প্রতিক ঘটনাবলি ব্রিটিশ বাঙালি রাজনীতিতে নতুন অধ্যায় খুলেছে কিন্তু যদি আগামী প্রজন্মের জন্য একাত্তরের উদ্দীপনা হালকা হয়ে যায়, সে ক্ষেত্রে সেই ইতিহাস এখনো গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা বহন করে। এবং এটা পূর্বাচলের বাঙালিদের জন্য সত্য, যেখানে অনেকে নিজেদের সমাজতান্ত্রিক মনে করে এবং সংরক্ষণশীল ইসলামিক গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে নিয়ে নতুন পপুলার ফ্রন্ট গঠন করতে চায়।

তথ্যসূত্র:

(নির্দিষ্ট নির্দেশিত কিছু ছাড়া সকল সাক্ষাত্কার লেখক কর্তৃক গৃহীত)

১.         বেশির ভাগ ব্রিটিশ বাঙালি নিজেদের বাঙালি বা বাংলাদেশি হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করে, যদিও কেউ কেউ প্রেসিডেন্ট জিয়ার ১৯৭৭ সালের ইসলামিক সংবিধানের পরিবর্তনের কারণে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু বাঙালি থেকে নিজেদের আলাদা করার জন্য বাংলাদেশি ব্যবহার করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্বে পূর্ব পাকিস্তানিদের কথা বলার সময় আমি বাঙালি ব্যবহার করেছি।

২.         Kalbir Shukra, The Changing Pattern of Black Politics in Britain.

(London, 1998).

3.       VI Lenin, Collected Works Vol.22 (Moscow, 1964) pp.143-156.

4.       ‘Estimating the growth of the Bangladeshi population of Great Britain’ New Community 16(4) (1990). এ চেরি পিচ পুরো চিত্র (ব্রিটেনে জন্মগ্রহণকারী ১,০০০ বাঙালিসহ) হিসাব করেছেন। ১৯৭১ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৩,৫৬০ জন যারা পাকিস্তানে জন্মগ্রহণ করেছে টাওয়ার হ্যামলেটে বাস করে কিন্তু অধিকাংশই পূর্ব পাকিস্তান থেকে এসেছে। ১৯৮১ সালের পরিসংখ্যানে দেখা যায় টাওয়ার হ্যামলেটের ৯,৮০৮ জন পূর্ব বাংলায় জন্মগ্রহণ করেছে এবং ৬৫৭ জন পাকিস্তানে জন্মগ্রহণ করেছে।

৫.         Yousuf Chowdhury, The Roots and Tales of the Bangladeshi Settlers (Birmingham, 1993), and Caroline Adams, Across Seven Seas and Thirteen Rivers (London, 1994, first published 1987).

6.       Talukder Maniruzzaman ‘Radical Politics and the Emergence of Bangladesh’ in Paul Brass and Marcus Franda (eds) Radical Politics in South Asia (Cambridge Mass, 1973) pp.230-231.

7.       Lawrence Zirling Bangladesh – From Mujib to Ershad: An Interpretative Study (Karachi, 1992) pp.32-34.

8.       Tasadduk Ahmed, interviewed by Caroline Adams, 1980s.

৯.         নূরুল ইসলামের ‘প্রবাসীর কথা’ (সিলেট, ১৯৮৯)। ১৯৬৬ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে পরিবারের কাছে ফেরত আসার আগে ব্রিটিশ পাকিস্তানি সংস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং পাকিস্তানি সরকার কর্তৃক সেখানে আটক হন। তিনি এখন সিলেটের বিদেশি কেন্দ্র চালাচ্ছেন। ২০০১ সালের ১২ জুন লন্ডনে নূরুল ইসলামের সাক্ষাত্কার নেওয়া হয়।

১০.       ব্রিটেনে তার পাকিস্তানি কল্যাণমূলক অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে কাজ ও ক্যাম্পেইন এবং অভিবাসী সম্প্রদায়ের জন্য জার্নাল তৈরি পাশাপাশি তাসাদ্দুক ১৯৬০-এ জাতীয় পাকিস্তানি খাদ্যদ্রব্য সরবরাহকারী অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি ছিল এবং ১৯৯৮ সালে স্ট্রোকের আগে ১৯৭৯ সালে স্পিটফিল্ডস স্মল বিজনেস অ্যাসোসিয়েশনের গোড়া থেকে চেয়ারম্যান ছিলেন। ১৯৮৯ সালে তাঁকে তাঁর কাজের জন্য এমবিই উপাধি দেওয়া হয়।

11.      Tasadduk Ahmed, interviewed by Caroline Adams, 1980s.

12.      Shah Lutfur Rahman, interviewed 22nd August 2001.

13.      Shah Lutfur Rahman, interviewed 18th August 2001.

14.      Sheikh Mannan, interviewed 30th March 2002.

15.      Khizar Humayun Ansari The Emergence of Socialist Thought among North Indian Muslims (1917-1947) (Lahore, 1990), and Anthony Cox ‘Paternal Despotism and Workers’ Resistance in the Bengal Jute Industry, 1920 – 1940,’ University of Cambridge PhD (1999).

16.      Sheikh Mannan, interviewed 30th March 2002.

17.      Nurul Islam, interviewed 12th June 2001.

18.      Nurul Islam, interviewed 12th June 2001.

19.      Shah Lutfur Rahman, interviewed 22nd August 2001.

20.      Shah Lutfur Rahman, interviewed 22nd August 2001.

21.      Shah Lutfur Rahman, interviewed 18th August 2000.

22.      Shah Lutfur Rahman, interviewed 22nd August 2001.

23.      East London Express 8th and 15th January 1971.

২৪.       ভাসানী ও তাঁর চীনপন্থী ন্যাপের বড় অংশ শেষ মুহূর্তে নির্বাচন বর্জন করে এই বলে যে মানুষ ঘূর্ণিঝড়ের পরে তখনো অনাহারে ছিল।

25.      300 seats were directly elected and a further 13 reserved for women, of which the Awami League had 7.

26.      Sheikh Mannan, interviewed by Caroline Adams 19th March 1998.

27.      Sheikh Mannan, interviewed by Caroline Adams 19th March 1998 and by the author 30th March 2002.

28.      Nawab Ali: transcript of interview by Caroline Adams, 1980s p.12.

29.      John Eade, The Politics of Community: The Bangladeshi Community in East London (Aldershot, 1989).

30.      Lulu Bilquis Banu, interviewed by Caroline Adams, 29th September 1990.

৩১.      ১৯৯৮ সালের ১ এপ্রিল তাসাদ্দুক আহমেদ ও ক্যারোলিন অ্যাডামস দ্বারা সাক্ষাত্কারের সময় শেখ মান্নান এই ঘটনা স্মরণ করেন। তিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন না কিন্তু যাঁরা উপস্থিত ছিলেন তাঁদের সঙ্গে কথা বলেন।

32.      See, for example, the tributes in the Awami League’s Silver Jubilee Commemorative Volume of Bangladesh Independence (London, 1997). All cheques had to be signed by Justice Chowdhury.

33.      For a discussion of patronage links associated with Bengali patrilineages, see Katy Gardner Global Migrants, Local Lives: Travel and Transformation in Rural Bangladesh (Oxford, 1995).

34.      Sheikh Mannan, interviewed 30th March 2002.

35.      Shah Lutfur Rahman, interviewed by the author 22nd August 2001, and Sheikh Mannan, interviewed by Caroline Adams 19th March 1998.

36.      Aziz Choudhury, interviewed 30th January 2001. Habibur Rahman was a NAP leader and a distant cousin of Choudhury’s.

37.      Aziz Choudhury, interviewed 20th February 2001.

38.      Sheikh Mannan, interviewed by Caroline Adams 19th March 1998. This sum would be worth over £4m today.

39.      Ali Syed Goyas, interviewed 14th May 2001 (translated by Abul Kalam Azad).

40.      Abdul Razzak, interviewed 14th May 2001 (translated by Abul Kalam Azad)

41.      Alhaj Shams Uddin, interviewed 6th March 2001.

42.      Sheikh Mannan, interviewed by Caroline Adams, 19th March 1998 and by the author, 30th March 2002.

৪৩.      ১৯৭১ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৩,৫৬০ জন পাকিস্তানে জন্মগ্রহণ করেন যারা টাওয়ার হ্যামলেটে বসবাস করে যাদের মধ্যে ৪৭০ জন মহিলা। এদের মধ্যে কমপক্ষে ৩.০০০ জন পাকিস্তানি পূর্ব বাংলার।

44.      Sheikh Mannan, interviewed by Caroline Adams 19th March 1998.

45.      Sheikh Mannan, interviewed by Caroline Adams 19th March 1998.

৪৬.      অনিবার্যভাবে অনেক বিপথে অর্থ যাওয়ার গল্প রয়েছে—ব্যাংকে গঠিত নয় এমন পৃথক চাঁদা এবং স্থানীয় সম্প্রদায় তাদের চূড়ান্ত হিসাবের সংগ্রহ জমা দেয়নি কিন্তু এগুলো আমাদের গল্পের সীমান্তবর্তী। স্টোনহাউসের বিরুদ্ধে অভিযোগ ফ্রড স্কোয়ারের মাধ্যমে তদন্ত হয় কিন্তু কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

47.      Sheikh Mannan, interviewed by Caroline Adams, 19th March 1998.

48.      Sheikh Mannan, interviewed 30th March 2002.

49.      Sheikh Mannan, interviewed by Tassaduk Ahmed and Caroline Adams, 1st April 1998.

50.      Nurul Islam, interviewed 12th June 2001.

৫১.       ১৯৮৯ সালে মহিউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ অবজারভারে প্রকাশিত চিঠিতে বলেন: “আমি তাসাদ্দুক ভাই ও শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠতার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলাম। ক্লেরিজ হোটেলে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি তাসাদ্দুক ভাই অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের (সানডে টাইমস-এর সাংবাদিক) সাথে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তার প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করে। স্পিটালফিল্ডের স্মল বিজনেস অ্যাসোসিয়েশনের পান্ডুলিপি থেকে নেওয়া।

52.      Sheikh Mannan, interviewed by Caroline Adams 19th March 1998.

53.      Sheikh Mannan, interviewed 30th March 2002.

54.      Shukra (1998).

55.      Sarah Glynn ‘East End Immigrants and the Battle for Housing: a comparative study of political mobilisation in the Jewish and Bengali communities’ Journal of Historical Geography, 13(3) (2005).

56.      John Eade ‘Nationalism and the quest for authenticity: the Bangladeshis in Tower Hamlets,’ New Community, 16(4) (1990) p.496.

57.      Peter Shore, interviewed 15th February 2001.

58.      See also Shore’s message in the Silver Jubilee Commemorative Volume of Bangladesh Independence (1997) p.37.

59.      The vote at the selection meeting, held 19th January 1986, was Peter Shore 46, Jill Cove 19, James McAllister 11 and Jan Alam 8.

60.      Eade (1989).

61.      Bengali Labour councillors, interviewed in 2000.

62.      Ansar Ahmed Ullah, interviewed 14th November 2000.

63.      John Eade, Isabelle Fremeaux and David Garbin ‘The political construction of Diasporic Communities in the Global City’ in P. Gilbert (ed) Imagined Londons (New York, 2002), and Sarah Glynn ‘Bengali Muslims: the new East End radicals?’ Ethnic and Racial Studies, 25(6) (2002) pp.969-988.

64.      Ansar Ahmed Ullah, interviewed 14th November 2000.

65.      Sunahwar Ali, interviewed 23rd January 2001.