জেনোসাইড বাংলাদেশ: আপেক্ষিক বনাম তথাগত দৃষ্টিভঙ্গি

কল্যাণ চৌধুরী বিরচিত জেনোসাইড ইন বাংলাদেশ (১৯৭২)-এর আলোকে একটি পর্যালোচনা

শিরোনামকেন্দ্রিক বিষয়ভিত্তিক আলোচনায় প্রবেশ করার আগে গ্রন্থের মান ও গ্রহণযোগ্যতা-সম্পর্কিত মূল্যায়ন প্রয়োজন। সাধারণ পর্যালোচক হিসেবে অভিমত, গ্রন্থ কখনো ভালো বা খারাপ, সম্পূর্ণ বা অপূর্ণ হওয়া সম্ভবপর নয়। গ্রন্থ যেকোনো বিষয়ে কিছু কথা বা তথ্য বা সংখ্যা উপস্থাপনের মাধ্যমে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কিছু পাঠককুলের মধ্যে ভাববাচ্যের অবতারণা ঘটায়। নিরপেক্ষ বা সর্বজনীন গ্রন্থ বলতে আদৌ কোনো গ্রন্থ আছে কি না তা গবেষণার বিষয়। আলোচ্য গ্রন্থটির সীমাবদ্ধতা আড়ালের জন্য যুক্তির অবতারণা নয়, বরং সব সংবেদনশীল পাঠককে ব্যক্তিমানসিক আতশি কাচ দিয়ে যেকোনো গ্রন্থ পাঠ করার সবিনয় অনুরোধমাত্র।

কল্যাণ চৌধুরী বিরচিত জেনোসাইড ইন বাংলাদেশ (১৯৭২) গ্রন্থে একই তথ্যের পুনরাবৃত্তি রয়েছে, তবে নিতান্ত প্রেক্ষাপট ও কার্যকারণ ব্যাখ্যা করতে এই দ্বিরুক্তি। তিনি গ্রন্থের ভূমিকা অধ্যায়ে ১৯৭১ কে বাংলাদেশের পক্ষে এবং বাংলাদেশীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছেন। গ্রন্থটি মূলত বাংলাদেশে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর নৃশংসতা ও জেনোসাইডের বিবরণ। এ জন্য হয়তো তিনি পক্ষপাতিত্বের দোষে দুষ্ট (পৃ. ১)। গ্রন্থটি ১৯৭২ সালে রচিত এবং গ্রন্থটির পর্যালোচনার বর্তমান প্রয়াসটির সময় ২০১৬। গ্রন্থটি এবং গ্রন্থটির পর্যালোচনা দুই-ই হয়তো সংগঠিত নয় বলে প্রতীয়মান হতে পারে। গ্রন্থটি যে সময়ে রচিত মুক্তিযুদ্ধের বিজয়, ত্যাগ সব তখনো সতেজ। অনেক প্রশ্নের উত্তর হয়তো অজানা বা জানা হলেও তখনকার পরিস্থিতিতে সরল কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে গরল। কল্যাণ চৌধুরী বিরচিত জেনোসাইড ইন বাংলাদেশ (১৯৭২) গ্রন্থটি যে বিষয়সংশ্লিষ্ট অন্যান্য গ্রন্থের সঙ্গে একই কক্ষপথে বক্ররেখায় সংযুক্ত বোঝানোর জন্য অন্যান্য গ্রন্থের তথ্য ও তথ্যসূত্র আলোচ্য পর্যালোচনায় ব্যবহার করা হয়েছে।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আত্মপরিচয় ও অস্তিত্ব মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১-এর মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক ও পরিপূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৭১ সালে উত্তর-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম অসাধারণ ঘটনা ছিল।১ কোনো দেশের সশস্ত্র স্বাধীনতাসংগ্রামে হতাহতের ঘটনা কোনো বিস্ময়কর বা আকস্মিক ঘটনা নয়। তবে স্বাধীনতার জন্য জেনোসাইডের মতো নৃশংস ও বীভত্স মানবতাবিরোধী অপরাধের বলি হওয়া সর্বজনীনভাবে অনাকাঙ্ক্ষিত ও ঘৃণিত। বাংলাদেশের জনগণকে দমনে সংঘটিত জেনোসাইডের মাধ্যমে ৩ মিলিয়ন বা ৩০ লাখ মানুষ হত্যা, ১/৪ মিলিয়ন বা ২ লাখ কিশোরী ও নারীর সম্ভ্রমহানি এবং ১০ মিলিয়ন বা ১ কোটি মানুষকে বাস্তুহারা ও দেশত্যাগে বাধ্য করার বদৌলতে বাংলাদেশের স্বাধিকারের জন্য মুক্তিযুদ্ধ বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিল।২ তবে অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে বিশ্বসমাজে সর্বজনীন মনোভাবের অনুপস্থিতি ও সংকীর্ণ স্বার্থবাদী অপসামাজিক-রাজনৈতিক সংস্কৃতির কারণে জেনোসাইড বিশ্ব ইতিহাসে বারবার পুনরাবৃত্তি হয়ে আসছে। জেনোসাইডের সঙ্গে অস্বীকৃতির সংস্কৃতি নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। অস্বীকৃতির সংস্কৃতির ধারক ও অভিভাবক শুধু জেনোসাইড অপরাধের অপরাধী নয়, বরং সংঘটিত অপরাধের গুরুত্ব অপেক্ষা লঘুতার প্রতি নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তি ও সমাজ সমভাবে দায়বদ্ধ। অবশ্য দায়বদ্ধতার প্রশ্ন তখনই উত্থাপন করা যায় যখন ব্যক্তি ও সমাজ বিশ্বমানবতার প্রতি নিঃশর্তভাবে শ্রদ্ধাশীল থাকে। নচেত্ সর্বজনীনতা, বিশ্বমানবতা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ প্রতিরোধ ও বিচারের চেতনা বিশ্ববাসীর দায়বদ্ধতার আলোচনা উলুবনে মুক্তা ছড়ানো বই আর কিছু নয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, অভিযুক্ত অপরাধীদের অস্বীকৃতি নয় বরং তত্কালীন বিশ্বসমাজের নেতৃস্থানীয় ও তাদের প্রতিক্রিয়াশীল উত্তরসূরিদের অস্বীকৃতির জন্য বাংলাদেশে সংঘটিত জেনোসাইড আন্তর্জাতিকভাবে অস্বীকৃত ও অগ্রন্থিত রয়ে গেছে। বাংলাদেশ জেনোসাইডে ক্ষতিগ্রস্ত কেউ যদি বৈশ্বিক অস্বীকৃতিকারীদের অকাট্য যুক্তিকে (যুক্তি না মানবতা প্রণিধানযোগ্য?) আবেগতাড়িত হয়ে উন্মাদের প্রলাপ আখ্যা দেয় তা দোষণীয় কি না ভাববার বিষয়। বাংলাদেশ জেনোসাইডের অস্বীকৃতির প্রধান যুক্তিদ্বয় ছিল—১৯৭১ সালের যুদ্ধ ছিল পাকিস্তানের গৃহযুদ্ধ এবং ৩০ লাখ মানুষ হত্যা ও ২ লাখ নারীর সম্ভ্রমহানির সংখ্যাতত্ত্ব আবেগী বাঙালির অতিরঞ্জন। এই যুক্তিগুলো ১৯৭২ সালে গ্রন্থিত কল্যাণ চৌধুরী তাঁর জেনোসাইড ইন বাংলাদেশ গ্রন্থে হয়তো পরোক্ষভাবে খণ্ডন করেছেন।

১৯৭১ সালজুড়ে বিশ্বের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক জান্তার নেতৃত্বে সামরিক বাহিনী জেনোসাইড সংঘটিত করছে বলে খণ্ড সংবাদ ও সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশ ও প্রচার করা হয়েছে। সাটারডে রিভিউ সাময়িকীতে ‘পূর্ব পাকিস্তানে জেনোসাইড’ শিরোনামে ২২ মে, ১৯৭১ একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। সম্ভবত প্রথম এই নিবন্ধে পূর্ব পাকিস্তানে চলমান পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহযোগী বেসামরিক সশস্ত্র দলগুলোর গণহারে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ ও নির্যাতনকে প্রথম জেনোসাইড হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়।৩ এই নিবন্ধ প্রকাশের এক মাসের মধ্যে অ্যান্থনি মাসকারেনহাস তাঁর ‘জেনোসাইড’ শীর্ষক নিবন্ধটি দ্য সানডে টাইমস পত্রিকায় প্রকাশ করেন।৪ অবশ্য ‘দ্য ভিক্টিমস’ শিরোনামে ২৮ মার্চ, ১৯৭১ সানডে টেলিগ্রাফ সম্পাদকীয় পরোক্ষভাবে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী পরিকল্পিত জেনোসাইড অপরাধকে নির্দেশ করেছে।৫ সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন ব্যতিরেকে কল্যাণ চৌধুরী বিরচিত জেনোসাইড ইন বাংলাদেশ (১৯৭২) গ্রন্থটি বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সংঘটিত ‘জেনোসাইড’ শীর্ষক প্রথম রচিত গ্রন্থ বলা যেতে পারে। তাঁর গ্রন্থটি ১৯৭২ সালে আর এন দাস কর্তৃক মেসার্স ওরিয়েন্ট লংম্যান লি. থেকে প্রকাশিত হয়েছিল।

আন্তর্জাতিক আইন ও বিশ্ব মানবাধিকার জগতে ‘জেনোসাইড’ অপরাধের সঙ্গে ‘অপরাধের অস্বীকৃতি’ ও ‘হতাহতের সংখ্যাতত্ত্ব বিতর্ক’ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আর জে রামেল তাঁর বিরচিত স্ট্যাটিকস অব ডেমোসাইড: জেনোসাইড অ্যান্ড ম্যাস মার্ডার সিন্স ১৯০০ (১৯৯৭) গ্রন্থে জেনোসাইড সংঘটনের সময়ে তাত্ক্ষণিক হতাহত ও তার পরবর্তী সময়ে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার প্রভাবে হতাহতের সংখ্যাতত্ত্ব নিরপেক্ষণের প্রক্রিয়া-পদ্ধতি প্রস্তুতি ও ব্যবহারের প্রয়াস পেয়েছেন। আর জে রামেল তাঁর ডেথ বাই গভর্নমেন্ট গ্রন্থে ডেমোসাইডের সংজ্ঞায়নে বলেছেন, ‘কোনো সরকার কর্তৃক সংঘটিত জেনোসাইড, পলিটিসাইড এবং গণহত্যাসহ যেকোনো ব্যক্তি হত্যা বা গণহত্যা কাণ্ড।’৬ তিনি বাংলাদেশ জেনোসাইডকে একটি বৃহত্তর ডেমোসাইড হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বিভিন্ন মাধ্যমিক উপাত্ত সংকলন ও পরিবিন্যাসের মাধ্যমে বাংলাদেশে জেনোসাইডে হতাহতের একটি উপাত্তভিত্তিক নিবন্ধ সংকলনের চেষ্টা করেছেন। তাঁর প্রদত্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, নিশ্চিতভাবে প্রমাণ সাপেক্ষে পাকিস্তান ডেমোসাইডে ১৫ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে।৭ তবে বিভিন্ন কার্যকারণ ও পরিস্থিতি বিচারে বলা যায়, চূড়ান্ত নিহতের সংখ্যা ৩০ লাখের বেশি হতে পারে।৮

জেনোসাইড ইন বাংলাদেশ গ্রন্থটি বাংলাদেশে সংঘটিত জেনোসাইডের নিকটতম সময়ে রচিত। তথ্যসূত্রগুলো ক্রমিক ও কাঠামোবদ্ধ না হলেও মৌলিক ও সমসাময়িক বাস্তবতাকে উপস্থাপন করেছে, যার গুরুত্ব স্বীকার করা অনিবার্য। কল্যাণ চৌধুরী জেনোসাইড ইন বাংলাদেশ (১৯৭২) গ্রন্থটির প্রথম অধ্যায়ে বাংলাদেশে সংঘটিত জেনোসাইডের একটি সংক্ষিপ্তসার উপস্থাপন করেছেন। দ্বিতীয় অধ্যায়ে জেনোসাইড সংঘটনের কার্যকারণ অনুধাবনে দ্বিজাতিতত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতার পর পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও শাসনতন্ত্রের কলুষতা, বৈষম্য, শঠতা, অগণতান্ত্রিক আচরণ ও পাকিস্তানের পূর্বাংশের জনপদের (পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে পরিচিত) জনগণকে দমন ও শোষণের অপচেষ্টাহেতু প্রতিবাদ ও সংঘাতের পরিক্রমার একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বিবৃত করার অবকাশ পেয়েছেন। তৃতীয় অধ্যায়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের সংবাদসূত্র এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পরপর গঠিত সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন তদন্ত দলের তথ্যসূত্র ব্যবহার করে বাংলাদেশ জেনোসাইডের প্রথম ভাগ গ্রন্থিত করেছেন। চতুর্থ অধ্যায়ে গ্রন্থকার পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর বর্বরোচিত নিধনযজ্ঞের ভয়ে উদ্বাস্তু শরণার্থীদের দেশান্তর ও অমানবীয় জীবনযাপন উপস্থাপন করেছেন। পঞ্চম অধ্যায়ে দেশব্যাপী চলমান জেনোসাইডের দ্বিতীয় ভাগ (সংগঠিত হত্যাযজ্ঞ) উপস্থাপন করেছেন। ষষ্ঠ অধ্যায়ে বাংলাদেশ জেনোসাইডে অপরাধের বিভিন্ন ধারাসম্পর্কিত ঘটনাবলি উপস্থাপন করা হয়েছে। সপ্তম অধ্যায়ে গ্রন্থকার জেনোসাইডের সংজ্ঞায়নের আপেক্ষিক বনাম তথাগত দৃষ্টিভঙ্গির বিতর্কের অবতারণা করেছেন।

কল্যাণ চৌধুরী দেশি-বিদেশি প্রত্যক্ষদর্শীদের জবানবন্দি উদ্ধৃত করে বিভিন্ন গ্রামীণ ও শহুরে অঞ্চলে পাকিস্তানি বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ, হত্যাযজ্ঞ ও পাশবিকতার কথ্যচিত্র তুলে ধরতে চেষ্টা করেছেন। বর্ণনায় সমসাময়িক পরিস্থিতিতে বেঁচে যাওয়া এই প্রত্যক্ষদর্শীদের বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতাপ্রসূত তথ্য-উপাত্ত গাণিতিকভাবে আংশিক ভ্রান্ত হলেও চিরন্তন সত্য। কল্যাণ চৌধুরী গ্রন্থনের সূচনায় তাঁর তথ্যসূত্র সম্পর্কে লিখেছেন, মূলত সামরিক অভিযানের শুরুতে বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশিরা, ইউরোপীয় পাদরিগণ এবং সামরিক প্রশাসনের অনুমতি সাপেক্ষে আগত সাংবাদিক, স্বেচ্ছাকর্মী ও ত্রাণকর্মীরা। তিনি অবশ্য সচেতন গ্রন্থকারের মতো গ্রন্থের শুরুতে সচেতনভাবে তাঁর গ্রন্থের উপস্থাপনায় পক্ষপাতদুষ্টতা এবং বিষয়বস্তুর আড়ম্ভরতা থাকতে পারে বলে স্বীকার করে নিয়েছেন।

কল্যাণ চৌধুরীর মতে, পাকিস্তানের অসংহতি ও ভাঙন কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়, বরং ঐতিহাসিক পটপরিক্রমার ফল। পূর্ব পাকিস্তানের বিদ্রোহীদের ভারতের সামরিক সহায়তা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন মুক্তিযুদ্ধের ফলাফলকে ত্বরান্বিত করেছে মাত্র। বাংলাদেশ জেনোসাইডের জন্য পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর আগ্রাসন বা পক্ষান্তরে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের রাষ্ট্রদ্রোহী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সম্প্রীতির পাকিস্তান ভাঙনের প্রচেষ্টার জন্য দায়ী করা হলেও, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের সময় থেকেই পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে কোনো মনস্তাত্ত্বিক মতৈক্য ছিল না। কল্যাণ চৌধুরীর মতে, এই অনৈক্যের কারণ ছিল পশ্চিমের পাঞ্জাবি ও আগের বাঙালি সমাজের সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক পার্থক্য এবং ১২০০ মাইল ভৌগোলিক দূরত্ব (পৃ. ৩)। মোহাম্মদ আইয়ুব এবং কে. সুবরিমানিয়্যামও দ্য লিবারেশন ওয়ার (১৯৭২) গ্রন্থে নিপীড়ন বৃত্তান্ত অধ্যায়ে পাকিস্তানের রাজনৈতিক কাঠামো এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা কখনোই পূর্ব বাংলার জন্য সবান্ধব ছিল না বলে উল্লেখ করেছেন।৯ গ্রন্থকার বাংলাদেশ জেনোসাইডের কার্যকারণ অনুসন্ধানে ২৫ মার্চ, ১৯৭১ পর্যন্ত পাকিস্তানের রাজনৈতিক ঘটনাপঞ্জির একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণী পেশ করেছেন। তাঁর মতে, ১৯৪০ সালে সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ কর্তৃক গৃহীত লাহোর প্রস্তাব অনুসারে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলো নিয়ে একাধিক রাষ্ট্রগঠনের কথা থাকলেও ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ফসল হিসেবে পাকিস্তান এবং ভারতের স্বাধীনতা অর্জন। একক মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাকে আওয়ামী লীগ লাহোর প্রস্তাবের লঙ্ঘন দাবি করে। পাকিস্তানের শাসকশ্রেণির সদিচ্ছার অভাবে পাকিস্তান একটি এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়। বাঙালি জনগোষ্ঠী ছিল পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ। ৭৫ মিলিয়ন বা ৭ কোটি ৫০ লাখ জনগণের মধ্যে ১২ মিলিয়ন বা ১ কোটি ২০ লাখ ছিল হিন্দু (সনাতন ধর্মাবলম্বী) যাদের বহিরাগত হিসেবে বিবেচনা করা হতো। পাকিস্তান সৃষ্টির শুরু থেকে গণপরিষদ থেকে সরকারি প্রশাসন কোথাও পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে সমতা লক্ষ করা যায়নি। উল্লেখ্য, ১৯৪৭ সালের ৮৩ জন মুসলিম আইসিএস কর্মকর্তাদের মধ্যে মাত্র একজন বা দুজন ছিলেন পূর্ব বাংলার।১০ পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার বৈষম্য ও বিরোধের উত্সগুলো যেমনি গুণগত তেমনি পরিমাণগত। রফিকুল ইসলাম তাঁর বিরচিত দ্য মিলিয়নস গ্রন্থে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যের অসমতার একটি তুলনামূলক ছক উপস্থাপন করেছেন।১১

কল্যাণ চৌধুরী বলেছেন, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যত্ কী হবে তা নিয়ে চিন্তা করার অবকাশ রয়েছে। তবে তাঁর গ্রন্থে ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর যে বৃহত্ জনযুদ্ধ ও জেনোসাইড সংঘটিত সেটি আলোচ্য বিষয়। অবশ্য এই বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা প্রস্তুত খুব একটা সহজসাধ্য নয়, কারণ যখন মিলিয়ন মিলিয়ন (১ মিলিয়ন = ১০ লাখ) মানুষকে হত্যা করা হয় তখন মৃতদেহের শুমারি করা অসম্ভব বলে তিনি অভিমত দিয়েছেন। ১৯ মার্চ ১৯৭২ জেনারেল টিক্কা খান এক বিবৃতিতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার দোষে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ৩০ হাজার বাঙালিকে হত্যা করেছে এবং ৪ জন নারী ধর্ষণ করেছে বলে জানান। অবশ্য সপ্তাহ খানেক পরই ২৬ মার্চ, ১৯৭২ জুলফিকার আলী ভুট্টো একজন ভারতীয় সাংবাদিককে দেওয়া সাক্ষাত্কারে নিহতের সংখ্যা ৫০ হাজার বলে জানান। অন্যদিকে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের মুহূর্তে শেখ মুজিবুর রহমান ৩ মিলিয়ন বা ৩০ লাখ শহীদ হয়েছেন এবং দু্ই লাখ নারীর সম্ভ্রমহানি করা হয়েছে মর্মে ঘোষণা দেন (পৃ. ৫)। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তব্যের সমর্থনে অবশ্য ইয়াহিয়া খানের উদ্ধৃতি: Kill 3 million of them and the rest will eat out of our hands উল্লেখ করা যায়।১২ পরবর্তী সময়ে জনসংখ্যাতাত্ত্বিক সূত্র ব্যবহার করে আর জে রামেল দেখিয়েছেন মোট নিহতের সংখ্যা ৩০ লাখ বা অধিক হতে পারে।১৩

মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর ২২ ডিসেম্বর, ১৯৭১ প্রকাশিত দৈনিক পূর্বদেশ-এর ‘ইয়াহিয়ার ফাঁসি চাই’ শিরোনামে প্রকাশিত নিবন্ধ এবং ৫ জানুয়ারি, ১৯৭২ দ্য মর্নিং নিউজ প্রকাশিত সংবাদে মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা ৩০ লাখ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।১৪ পরিকল্পিত শুমারির মাধ্যমে কেবল প্রকৃত হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতির সংখ্যা নিরূপণ সম্ভব বলে কল্যাণ চৌধুরী উল্লেখ করেছেন। তবে তিনি শঙ্কা প্রকাশ করেন যে নভেম্বর ১৯৭০ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে ব্যাপক মানুষ, ১ মিলিয়ন বা ১০ লাখের বেশি প্রাণহানি এবং স্বল্প সময়ের ব্যবধানে ২৫ মার্চ, ১৯৭১ পাকিস্তান বাহিনীর পূর্ব পাকিস্তানব্যাপী আগ্রাসী সামরিক আক্রমণের কারণে মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষ ও মহামারিতে উপকূলীয় ও প্রান্তিক অঞ্চলের বহু মানুষের প্রাণহানির ঘটনা বস্তুনিষ্ঠ শুমারি প্রণয়ন দুষ্কর করে তুলবে।

আর জে রামেল বাংলাদেশ জেনোসাইডের জন্য প্রধানত ১৯৭০ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে পাঁচ লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু এবং ঘূর্ণিঝড়-পরবর্তী আন্তর্জাতিক ত্রাণসহয়তা বরাদ্দ সত্ত্বেও পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসন কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলে ধীরগতিতে অপর্যাপ্ত ত্রাণ সরবরাহের কারণে দুর্ভিক্ষে অনেক মানুষের মৃত্যু পূর্বাঞ্চলীয় জনগণের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ক্ষোভের সঞ্চার করে, যার প্রতিফলন লক্ষ করা যায় ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে এবং সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় সত্ত্বেও তাদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে সামরিক শাসকের অস্বীকৃতি পূর্ব পাকিস্তানে স্বায়ত্তশাসনের দাবি এবং সামরিক সরকারের প্রতি সম্পূর্ণ অনাস্থা জ্ঞাপন প্রতিক্রিয়াশীল সামরিক সরকারের শাসনাধীন রাষ্ট্রে জনমত ও গণশক্তি দমনে জেনোসাইড সংঘটন অনিবার্য করে তোলে।১৫ ঢাকায় ১৮-২০ মার্চ, ১৯৭১ অপারেশন সার্চলাইট প্রণয়ন করা হয়। সংশোধিত চূড়ান্ত পরিকল্পনাটি ২৪ মার্চ সেনা কর্মকর্তাদের অবহিত করা হয়। মেজর জেনারেল খাদিম হাসান রাজা ও মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী খান অপারেশনের মূল পরিকল্পনার খসড়া প্রণয়নের জন্য ১৮ মার্চ ঢাকা সেনানিবাসে বৈঠকে বসেন।১৬ টিক্কা খানের দাবি ছিল তাঁকে পর্যাপ্ত সেনাবাহিনী দিলে তিনি ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে বাঙালিদের নিশ্চিহ্ন করে ফেলবেন।১৭ জেনারেল টিক্কা খানের কাছে ছয় ডিভিশন সেনা প্রস্তুত ছিল বাঙালি জাতিকে চিরকালের মতো দমন করার জন্য।১৮

সামরিক সরকারপ্রধান ইয়াহিয়া খান এবং শেখ মুজিবুর রহমানের আট দিনব্যাপী চলমান রাজনৈতিক সমাধানের জন্য বৈঠক ভেঙে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হত্যাযজ্ঞ পরিক্রমা শুরু হয়। ২৫ মার্চ ১৯৭১ শুরুতে হত্যাযজ্ঞ নির্দিষ্ট কিছু স্থানে সীমিবদ্ধ থাকলেও পরবর্তী সময়ে দ্রুততার সঙ্গে অন্যান্য স্থানেও শুরু হয়। ঢাকার উত্তরাংশে অবস্থিত হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আটকে পড়া বিদেশি সাংবাদিকেরা রাতভর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের ব্যারাকসহ অন্যান্য এলাকায় জ্বলন্ত অগ্নিশিখার ধোঁয়া ও স্ফুলিঙ্গ দেখেছেন। পরের দিন বহিষ্কৃত ৩৫ জন বিদেশি সাংবাদিক ঢাকা ত্যাগের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অগ্নিশিখা ও গোলাগুলির আওয়াজ শুনেছেন বলে পরবর্তী সময়ে তাঁদের সাক্ষাত্কার ও প্রতিবেদনে জানিয়েছেন। তাঁরা এয়ারপোর্ট রোডের দুই পাশে প্রায় ৫০০ বস্তিঘর ও দোকানপাট আগুনে ভস্মীভূত অবস্থায় দেখতে পেয়েছিলেন (পৃ. ২৩)। ৩৫ জন বিদেশি সাংবাদিক বহিষ্কারের বিষয়টি ২৮ মার্চ, ১৯৭১ নিউইয়র্ক টাইমস-এ গ্রেস লিকটেনস্টেইনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস ও রয়টার্সের দুজন সাংবাদিক এই সময় হোটেলে উপস্থিত ছিলেন না। প্রতিবেদনে দ্য টাইমস-এর স্যুয়েনবার্গের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, যখন তিনি ওই এলাকার ভারপ্রাপ্ত লে. কর্নেলকে তাঁদের ঢাকা ত্যাগের নির্দেশ প্রদানের কারণ জানতে চাইলে অফিসারের মন্তব্য ছিল, ‘আমরা তোমাদের নিরাপত্তাঝুঁকির জন্য তোমাদের চলে যেতে বলছি। এখানে অনেক রক্তারক্তি হবে।’ দ্য টাইমস-এর পক্ষ থেকে পাকিস্তান সরকারের কাছে পাঠানো একটি টেলিগ্রামে স্যুয়েনবার্গ এবং অন্য সাংবাদিকদের সঙ্গে পাকিস্তান সামরিক প্রশাসনের অশোভন আচরণের তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়।১৯ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা ও স্বাধীনচেতা ছাত্রদের দমনে ১৮ ও ৩২ নম্বর পাঞ্জাব রেজিমেন্ট এবং ২২ নম্বর বেলুচ রেজিমেন্টের ইউনিটসমূহকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। রাতেই এই ইউনিটগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল ও জগন্নাথ হল আক্রমণ করে। ১৯৭১ সালের ২৫-২৬ মার্চ এবং ডিসেম্বরের মধ্যবর্তী সময়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং তাদের অবাঙালি ও প্রতিক্রিয়াশীল বাঙালি দোসররা এক হাজারের অধিক শিক্ষককে হত্যা করেছে (পৃ. ২১০)। তাঁরা মার্কিন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহূত এম-২৪ ট্যাংক ও ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে অন্যতম প্রধান লক্ষ্যবস্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করেছিল এবং ব্রিটিশ কাউন্সিল দখল করে সেখান থেকে ছাত্রদের আবাসস্থলগুলোর ওপর আক্রমণ পরিচালনা করে। ব্রিটিশ কাউন্সিলে দায়িত্বরত আটজন বাঙালি পুলিশকে পাকিস্তানি সেনারা হত্যা করে ও গ্রন্থাগারের বইপত্র পুড়িয়ে দেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল ছিল পাকিস্তান সরকারবিরোধী ছাত্রসংগঠনগুলোর প্রধান কেন্দ্রস্থল। ৩০ মার্চ, ১৯৭১ দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ-এ প্রকাশিত সায়মন ড্রিংয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০ ছাত্র নিহত হয়েছে এবং সেনাবাহিনী ৩০টি মৃতদেহ ব্যতীত অন্যান্য মৃতদেহ সরিয়ে ফেলেছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সাতজন শিক্ষক এবং তাঁদের ১২ জন পারিবারিক সদস্য তাঁদের নিবাসে নিহত হয়েছেন। ১৯৭৪ সালে আবুল হাসনাত তাঁর বিরচিত গ্রন্থেও দুই শ ছাত্রকে হত্যা করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন।২০ রবার্ট পেইন তাঁর গ্রন্থে ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিহত ছাত্রসংখ্যা ১০৯ জন উল্লেখ করেছেন।২১ অবশ্য পাকিস্তানের ৩২তম পাঞ্জাব রেজিমেন্ট যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আক্রমণের পুরোধা ছিল, তাঁর একজন সামরিক কর্মকর্তা ইকবাল হলে বারো জন মারা যায় তাঁর মধ্যে সন্দেহভাজন দুজন নারী ছিল। হলের একজন ছাত্র ও একজন নৈশপ্রহরী বাদে বাকি বাইরের দশজন মারা গিয়েছে বলে ধারণা করা হয়।২২ যদিও আর জে রামেলের ডেথ বাই গভর্নমেন্ট গ্রন্থে উদ্ধৃত ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ধারণকৃত বেতার কথোপকথন থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিহতের সংখ্যা তিন শ জানা যায়।২৩ ঢাকা মেডিকেল কলেজে চিকিত্সারত একজন আহত শিক্ষার্থীর কাছ থেকে জানা যায়, পাকিস্তানি বাহিনী ১০৩ জন শিক্ষার্থীকে হত্যা করেছে। জগন্নাথ হলের হত্যাকাণ্ডে বেঁচে যাওয়া একজন শিক্ষার্থীর বর্ণনায়, সে ম্যানহোলে লুকানো অবস্থায় ৬ জন শিক্ষার্থী ও হলের পেছনে আবাসিক নিবাসে ১২ জন নারী ও শিশুকে হত্যা করা হয়েছে প্রত্যক্ষ করেছে। আওয়ামী লীগের মুখপাত্র হিসেবে পরিচিত ইত্তেফাক পত্রিকা কার্যালয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি ইউনিট অতর্কিত হামলা চালায়। হামলায় প্রায় ৪০০ মানুষ প্রাণ হারান।২৪ সর্বাপেক্ষা নির্মম হত্যাযজ্ঞ পরিচালিত হয়েছে ২৬ মার্চ পুরান ঢাকা এলাকায়। নয়া বাজার, ইংলিশ রোড, ফ্রেঞ্চ রোড, সদরঘাট ও বুড়িগঙ্গার তীরবর্তী এলাকায় সামরিক অভিযানে অগণিত মানুষ হতাহত হন। এই এলাকার অধিকাংশ অধিবাসী শেখ মুজিবুর রহমানের সমর্থক ছিলেন বলে পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রোশের মাত্রা সবচেয়ে বেশি ছিল। ২৫ মার্চ রাত থেকে পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টায় পূর্ব পাকিস্তানের স্বনামধন্য শিক্ষাবিদ, ব্যবসায়ী ও প্রায় ৫০০ ছাত্রকে হত্যা করা হয়। ইপিআর দপ্তরে পাকিস্তান বাহিনীর অভিযানে ১০০০ জন ইপিআর সদস্যের ৬০০ জনই নিহত হন এবং বাকিদের মধ্যে যাঁরা বন্দী হয়েছিলেন পরবর্তী সময়ে তাঁদের কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। আর জে রামেলের ডেথ বাই গভর্নমেন্ট গ্রন্থ অনুসারে, ২৫-২৬ মার্চ চার থেকে দশ হাজার পুলিশ সদস্যকে হত্যা করা হয়েছে।২৫ ২৬ মার্চ সারা দিন পাকিস্তান বাহিনী সুপরিকল্পিতভাবে হিন্দু অধ্যুষিত শাঁখারীবাজার ও টানবাজারে বসবাসরত হিন্দুদের ওপর আক্রমণ পরিচালনা করে। আর জে রামেলের তথ্যানুসারে, শুধু ঢাকায় ২৫ মার্চ দশ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়।২৬ স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশ সরকারের পরিসংখ্যান বিভাগের খসড়া প্রতিবেদন অনুযায়ী, পাকিস্তান বাহিনী শাঁখারীবাজারে ঘরে ঘরে ঢুকে প্রায় ৮০০০ পুরুষ, নারী ও শিশুকে হত্যা করেছে। ২৫-৩১ মার্চ পর্যন্ত ঢাকাজুড়ে পরিচালিত হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী মার্কিন নাগরিকদের একটি ঘটনা বিবরণী ১৪ জুলাই, ১৯৭১ মার্কিন সিনেটে উপস্থাপন করা হয়েছিল। প্রত্যক্ষদর্শী একজন বাঙালি ছাত্রের কাছ থেকে জানা যায়, ২৬ মার্চ সদরঘাটে অপেক্ষারত সব যাত্রীকে হত্যা করা হয়েছিল। ২৯ মার্চ সদরঘাটের প্ল্যাটফর্ম ও বাথরুম রক্তে রঞ্জিত ছিল। একজন মার্কিন মিশনারি শাঁখারীবাজারে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর ভয়াবহ গোলাগুলির পর ২৯ মার্চ রমনা কালিবাড়িতে বসবাসরত ২০০ জন হিন্দু অধিবাসীর মধ্যে ৭০-১০০ জনের মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল। একইভাবে নয়া বাজার রায়ের বাজার ও মহাখালী হাসপাতালের নিকটবর্তী বস্তিসহ অসংখ্য বস্তি পুড়িয়ে ভস্ম করে দেওয়া হয় এবং বস্তিগুলোর ওপর নির্বিচারে গুলি চালানো হয়। (পৃ. ২৭-২৯)। বাংলাদেশ সরকারের হিসাব অনুযায়ী, ২৫ থেকে ২৬ মার্চ শুধু ঢাকা শহরে বিভিন্ন পেশার ১৫ হাজার জনকে হত্যা করা হয়েছে। চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, যশোর, রাজশাহী, ময়মনসিংহ, সিলেটসহ অন্যান্য জেলা থেকে প্রাপ্ত হিসাব অনুসারে ২৫-২৭ মার্চ ১ কোটি আশি লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে বলে জানা গেছে। পাকিস্তানি সেনারা ২ এপ্রিল বারিধারাতে আটককৃত ৬০০ জনকে দিনভর জিজ্ঞাসাবাদের পর ৪৮ জন শিক্ষক, ছাত্র রাজনীতিবিদ ও হিন্দু ব্যক্তিকে গুম করেছিল। বাংলাদেশ সরকারের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুসারে, বুড়িগঙ্গার তীরবর্তী জিঞ্জিরায় ১০ হাজার জনকে হত্যা করা হয়, যাদের অধিকাংশ জীবন বাঁচাতে নদীপথে ঢাকা ত্যাগ করছিল। (পৃ. ৩১-৩২) পাকিস্তান অবজারভার-এ কর্মরত এম হাসান তাঁর এক সাক্ষাত্কারে ৬-১০ মে বুড়িগঙ্গাতে অসংখ্য মৃতদেহ ভাসমান দেখেছেন, যাদের মধ্যে অনেকের মৃতদেহ একসাথে বাঁধা ছিল। সদরঘাটে বসবাসরত অনেকে তাকে বলেছিলেন সাত্তার দেয়াশলাই কারখানার শ্রমিকদের অবাঙালি বিহারিরা পাকিস্তানি বাহিনীর নির্দেশে নির্বিচারে হত্যা করেছিল। তিনি আরও জানান, দৈনিক পূর্বদেশ-এর এম হাসান উল্লাহ চৌধুরীর মতো মিরপুরের অবাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় বসবাসরত অনেক বাঙালিকে অবাঙালিরা নির্মমভাবে হত্যা করেছে। এম হাসানসহ বহু যুবককে পাকিস্তানি বাহিনী ও সশস্ত্র অবাঙালিরা ধরে ট্রাকে করে নিয়ে গুম করেছে, তাদের আর কোনো হদিস পাওয়া যায়নি (পৃ. ৩৪)।

৬ এপ্রিল পাকিস্তানের সামরিক সরকার পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে দাবি করলেও বিমানবন্দরের কাছাকাছি অবস্থানরত অনেকেই বিমানবন্দরে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নিয়মিত সেনাদলের আগমন প্রত্যক্ষ করেছেন। পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক জনবল বৃদ্ধির জন্য সামরিক সরকার দুটি বোয়িং ৭০৭ একটি বেসরকারি আইরিশ কোম্পানির কাছ থেকে এক বছরের জন্য বন্দোবস্ত নেয়। বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুসারে, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ৮০-১০০ হাজার সামরিক সদস্য এবং হতাহতদের বিপরীতে নিয়মিত সামরিক সদস্য নিয়ে আসা হয়েছে। পাকিস্তান বাহিনীর নবম ডিভিশন কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে সদর দপ্তর স্থাপন করে পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্ত বন্ধ করে দেয় এবং নিয়মিত টহলের ব্যবস্থা করে। অন্যদিকে ১৬তম ডিভিশন যশোর ক্যান্টনমেন্টকে সদর দপ্তর হিসেবে ব্যবহার করে পশ্চিমাঞ্চলের সীমান্ত নিরাপত্তা জোরদার করে।

অন্যদিকে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের সমগ্র প্রশাসন নিজেদের হস্তগত করে। পশ্চিম পাকিস্তানি অথবা উর্দুভাষী অবাঙালিদের বাঙালি কর্মকর্তাদের অপসারণ করে দায়িত্ব দেওয়া হয়। বাংলাদেশ সরকারের একজন মুখপাত্র জানান, সামরিক অভিযানের ছয় মাসের মধ্যে এক হাজার বাঙালি কর্মকর্তাকে অপসারণ করে পশ্চিম পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেওয়া হয় (পৃ. ৩৫)। বাঙালি স্বাধীন হলেও যেন জাতি হিসেবে মেরুদণ্ড সোজা না করতে পারে সে লক্ষ্যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কর্মদক্ষ বা অদক্ষ এক-তৃতীয়াংশ শিল্পকারখানার শ্রমিককে হত্যা করা হয়।২৭

পাকিস্তান বাহিনীর সামরিক আগ্রাসনের পাশাপাশি বাঙালি সংস্কৃতি ও পরিচয় পরিবর্তনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। ঢাকাসহ অন্যান্য শহরের সড়কসমূহের হিন্দু ও বাঙালি জাতীয়তাবাদী নাম পরিবর্তন করে পাকিস্তানি নামকরণ করা হয়। রাতারাতি শাঁখারীপট্টি সড়কের নাম হয়ে যায় টিক্কা খান রোড। পূর্ব পাকিস্তানের সব এলাকায় পাকিস্তানি সামরিক প্রশাসন বাংলার পরিবর্তে উর্দু চালু করে। সেনাবাহিনী সরাসরি ঘোষণা দেয় পূর্ব পাকিস্তানিদের উর্দু শিখতে হবে কারণ তাদের ‘মাতৃভাষা সভ্য নয়’। ব্যবসায়ীরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে তাদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করে ইংরেজিতে রাখেন, কারণ তাঁরা উর্দু জানতেন না।

পূর্ব পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীকে বিতাড়িত করার জন্য পাকিস্তানি বাহিনী সুসংগঠিত হত্যাযজ্ঞ ও লুণ্ঠন চালিয়েছে সে সম্পর্কে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। এপ্রিলের শুরু থেকে মূলত বাঙালি শরণার্থীদের ভারতের পথে যাত্রা শুরু হয়। শরণার্থীদের লক্ষ্য ছিল সীমান্তবর্তী নিরাপদ স্থান অথবা সীমান্তের ওপারে ভারতে আশ্রয়। প্রায় আট মাস শরণার্থীদের এই স্রোত বহমান থাকে। আন্দ্রে মালরাক্স শরণার্থীদের বাস্তুহারা যাত্রাকে ‘জেনোসাইডের অভিন্ন অংশ’ আখ্যায়িত করেছেন। বাংলাদেশ সরকারও ১০ এপ্রিল ভারতের আগরতলার নিকটবর্তী কুষ্টিয়ার মুজিবনগরে গঠিত হয়। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর আগ্রাসনের শিকার ১০ মিলিয়ন হিন্দুসহ খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ এবং ‘সাচ্চা মুসলিম’ (উর্দু-আরবি শব্দ যুগল) ব্যতীত সব মুসলিম বাঙালি। পাকিস্তানি সেনারা আটক করলে কলেমা ও কোরআন পাঠ করে মুসলিম পরিচয় প্রমাণ করতে পারলে বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকত। জুন মাস পর্যন্ত আগত শরণার্থীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত সংকলিত তথ্যানুসারে, পাঁচ লাখ মানুষ পূর্ব পাকিস্তানে নিহত হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের চরের মুসলিম কৃষক ও হিন্দু জেলে অধ্যুষিত গ্রামগুলো পর্যন্ত পাকিস্তানি নৃশংসতা থেকে রেহাই পায়নি (পৃ. ৬৮-৬৯)। ২৮ জুলাই, ১৯৭১ আইআরসিতে প্রেরিত জরুরি মিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রায় ৬ মিলিয়ন বা ৬০ লাখ মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী বাঙালি শরণার্থী তাদের পূর্ব পাকিস্তানের আবাসস্থল ত্যাগ করে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয়ের সীমান্তে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। প্রতিদিন হাজার হাজার নতুন শরণার্থীর আগমন ঘটছে। ভারতের আইআরসি মিশন পরিচালিত সাক্ষাত্কার থেকে জানা যায়, পশ্চিম পাকিস্তানের পাশবিক ও নির্মম শাসন থেকে জীবন রক্ষার্থে তাঁরা দেশ ত্যাগ করেছেন (পৃ. ৩৫)। শরণার্থী বিষয়ে কল্যাণ চৌধুরী আরও উল্লেখ করেছেন, সামরিক আক্রমণের পর প্রায় ১০ মিলিয়ন বা ১ কোটি লোক ভারতে আশ্রয় নেয় (পৃ. ৫)। তাঁর প্রদত্ত পেশাভিত্তিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ভারতে আগত শরণার্থীদের মধ্যে ৫.৭ মিলিয়ন বা ৫০.৭ লাখ কৃষক, ২.৫ মিলিয়ন বা ২০.৫ লাখ দিনমজুর, ০.৪ মিলিয়ন বা ৪ লাখ তাঁতি এবং ১.৫ মিলিয়ন বা ১০.৫ লাখ শ্রমজীবী ও নগরবাসী। তাঁর মত অনুসারে আগত শরণার্থীদের ৬০ শতাংশ হিন্দু (সনাতন ধর্মাবলম্বী) ছিল। জাতিসংঘের হিসাব অনুসারে, পাকিস্তান সামরিক বাহিনী ৭০ শতাংশ গ্রাম সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করেছিল (পৃ. ৫-৬)। ভারতীয় সরকারের সূত্রমতে মে, ১৯৭১ ভারত আগত শরণার্থীর সংখ্যা ছিল ৪ লাখ।২৮ পরবর্তী সময়ে ভারত সরকারের আগস্ট মাসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ভারতে আশ্রিত পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদের মধ্যে ৬৯.৭১ লাখ হিন্দু (সনাতন ধর্মাবলম্বী), ৫.৪১ লাখ মুসলিম এবং ০.৪৪ লাখ অন্যান্য।২৯ ইয়াহিয়া খানও নিউজউইককে দেওয়া তাঁর সাক্ষাত্কারে ভারতে পাকিস্তানের ২ মিলিয়ন বা ২০ লাখ শরণার্থী আশ্রিত আছে বলে স্বীকার করেন।৩০ কল্যাণ চৌধুরীর বক্তব্য অনুযায়ী, ১০ মিলিয়ন বা ১ কোটি মানুষ পরবাসী শরণার্থী হলেও ৬০ মিলিয়ন বা ৬ কোটি মানুষ দেশের অভ্যন্তরে অনিশ্চয়তার মধ্যে বসবাস করছিল (পৃ. ৬)।

বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার এক মিলিয়ন বা ১০ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে বলে দ্য টাইমস, দ্য গার্ডিয়ান এবং লা মন্ড-এর মতো বিভিন্ন বৈদেশিক পত্রপত্রিকায় উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও জানুয়ারি ১৯৭২ প্রাক্তন সোভিয়েত রাশিয়ার নন্দিত পত্রিকা প্রাভদায় প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধের সময়ে নিহতের সংখ্যা ৩০ লাখ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের প্রাক্কালে মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ বাঙালি শহীদ হয়েছেন এবং ২ লাখ নারী তাঁদের সম্ভ্রম হারিয়েছেন বলে ঘোষণা করেন। বাংলাদেশ সরকারের সংগৃহীত তথ্যানুযায়ী ৩০ লাখ মানুষ নিহত হয়েছে এবং প্রায় ৪০ লাখ আহত হয়েছেন। স্বাধীনতার পরপরই বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে সরকারি ও বেসরকারি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি বাড়ি-বাড়ি গিয়ে শুমারির মাধ্যমে হতাহতের সংখ্যা লিপিবদ্ধ করার কার্যক্রম শুরু করে। ১২ সদস্যবিশিষ্ট সরকারি তদন্ত কমিটির সভাপতি আবদের রহমান মার্চ, ১৯৭২ অদ্যাবধি সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে নিহতের সংখ্যা তিন লাখে পৌঁছেছে বলে জানান, ‘সংখ্যা এত দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে যে বাংলাদেশ সরকারের ৩০ লাখ নারী, পুরুষ, বৃদ্ধ ও শিশু হত্যার খসড়া ও প্রাথমিক হিসাব ভিত্তিহীন মনে হচ্ছে না।’ বাংলাদেশি সংবাদপত্রগুলোর নিজস্ব গ্রামীণ শুমারি থেকে প্রাপ্ত তথ্য ও প্রথম প্রতিবেদন অনুসারে, নিহতের সংখ্যা প্রায় ৩ মিলিয়ন বা ৩০ লাখের কাছাকাছি। অবশ্য প্রতিবেদনগুলোতে দাবি করা হয়, মূলত রাজাকাররা বাঙালি মুসলিম ও হিন্দুদের হত্যা করেছে। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ভয়ভীতি প্রয়োগ করে অথবা লুণ্ঠনে প্রলুব্ধ করে রাজাকার বাহিনীতে সাম্প্রদায়িক বাঙালি ও অবাঙালিদের অন্তর্ভুক্ত করত, যারা মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তাকারী সন্দেহে মানুষজনকে হত্যা করত। মার্চ থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সামরিক বাহিনী ১ লাখের বেশি এবং মে থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত রাজাকার, আলবদর ও সাম্প্রদায়িক দলগুলোর সদস্যরা প্রায় ১ মিলিয়ন বা ১০ লাখের বেশি বাঙালিকে হত্যা করেছে বলে ধারণা করা হয় (পৃ. ২২-২৩)। পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী তাদের সহযোগী রাজাকার—যাদের ৯০ শতাংশ উর্দুভাষী অবাঙালি—সহযোগে সুসংগঠিত হত্যাকাণ্ড পরিচালনা করেছিল। উর্দুভাষী অবাঙালিদের অধিকাংশ পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতি অনুগতশীল ছিল। বাঙালিদের বিভিন্ন সময়ের আন্দোলন দমনে এদের পাকিস্তানের সামরিক সরকার চতুরতার সঙ্গে ব্যবহার করত। পাকিস্তান সরকারের এক পরিসংখ্যান অনুসারে, পূর্ব পাকিস্তানের অসহযোগ আন্দোলনে প্রায় ২০ হাজার উর্দুভাষী অবাঙালি নিহত হয়েছিল (পৃ. ৬৯)।

আক্রান্ত গ্রামবাসী ও মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের জবানবন্দি এবং আন্তর্জাতিক সংবাদ ও নিবন্ধের প্রামাণ্য সাক্ষ্য প্রমাণ করে পাকিস্তানি বাহিনীর ‘খুনি-চরিত প্লেগ মহামারির’ মতো সমগ্র বাংলাদেশকে মৃত্যুপুরীতে পরিণত করেছিল। হত্যাযজ্ঞের পাশাপাশি লুটতরাজ ছিল খুবই তুচ্ছ ও নৈমিত্তিক ঘটনা। পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহযোগী রাজাকারদের শান্তি কমিটি গ্রামে গ্রামে জনগণের কাছ থেকে ৫-৬ হাজার টাকা অথবা গৃহস্থালি সামগ্রী ‘জীবনের কর’ হিসাবে আদায় করত। কল্যাণ চৌধুরী সিলেটের দাদাপাড়া, নোয়াখালীর বাঞ্চুনগর, কুমিল্লার আশ্বিনপুরের উদাহরণ দিয়েছেন যে স্থানগুলোতে রাজাকার ও পাকিস্তানি সৈন্যরা ৫-৮ হাজার টাকা গ্রামবাসীদের কাছ থেকে ‘জীবনের কর’ হিসাবে আদায় করেছিল। কল্যাণ চৌধুরী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর লুটতরাজের মাত্রা বোঝানোর জন্য বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখিত পাকিস্তানি মেজর জাহানজেব খানের নিকট আত্মীয়ের কাছে ১০ দিনে ৬৫ হাজার টাকা ঝালকাঠি ডাকঘর থেকে মানি অর্ডার, সুবেদার হামিদ খানের গৌরনদী ডাকঘর থেকে ২০ হাজার টাকা মানি অর্ডার এবং বরিশাল জেলার উপডাকঘর থেকে আগস্টের এক সপ্তাহে ২৩৩,৮২০ টাকা মানি অর্ডার করার উদাহরণ দেন। এ এ জে নিয়াজি ও রাও ফরমান আলীর বিরুদ্ধেও লুটের অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। যার প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ্য, ৩১ জানুয়ারি, ১৯৭২ পশ্চিম পাঞ্জাবের সাবেক গভর্নর জেনারেল আতিক রহমানের লাহোরের জমিদারে রাও ফরমান আলীর সম্পত্তির পরিমাণ ৩০ মিলিয়ন, জেনারেল নিয়াজির সম্পত্তি ৮.৭ মিলিয়ন এবং জেনারেল টিক্কা খানের সম্পত্তি ৫.৬ মিলিয়ন বলে দাবি করেন। জেনারেল রহমান আরও অভিযোগ করেন, ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তান থেকে সংগৃহীত ১০০ মিলিয়ন চীন, জেনেভা ও সুইজারল্যান্ডে ব্যক্তিগত ব্যাংকে পাচার করেছে (পৃ. ১৫৪-১৫৫)।

বাংলাদেশের তদন্ত কমিটি পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত বাসভবনে যে পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করে তাতে সহজেই প্রতীয়মান হয় যে তাঁরা পাশবিক ও নৃশংস মানসিকতার চূড়ান্ত শিখরে অবস্থান করছিল। তদন্ত কমিটি পাকিস্তানি সেনাদের শিশু, কিশোরী ও নারীদের শ্লীলতাহানির প্রমাণ নিবন্ধিত করে। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে উদ্ধারকৃত নির্যাতিতাদের বয়স প্রধানত ১৪ থেকে ৩০ বছর। উদ্ধারকৃতদের অধিকাংশ অবিবাহিত এবং সন্তানসম্ভবা ছিলেন। তাঁদের বেশির ভাগের শারীরিক ও মানসিক অবস্থা খুবই শোচনীয় ছিল। ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে চার হাজারের বেশি বাঙালি নারীকে উদ্ধার করা হয়। ১৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২ বাংলদেশি পত্রিকা সংবাদ-এ স্থানীয় রাজাকার আলী আজমের সহযোগিতায় পাকিস্তানি সেনাদের দ্বারা ১৬ বছর বয়সী এক কিশোরীর পরিবারের ছয়জনকে হত্যা এবং তার ও তার চার ভাবির শ্লীলতাহানির ঘটনা প্রকাশ করা হয়। কল্যাণ চৌধুরী বাংলাদেশে সংঘটিত অসংখ্য নারীর সম্ভ্রমহানির ঘটনার কিছু সংখ্যক ঘটনা গ্রন্থিত করেছেন। তিনি ৭ অক্টোবর, ১৯৭১ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলে মেজর আসলামের নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনারা জোরপূর্বক প্রবেশ করে অবস্থানরত ৪০ ছাত্রীর সম্ভ্রমহানি করে। ঘটনাটির নৃশংসতার তীব্রতার জন্য পাকিস্তানের ইংরেজি দৈনিক ডন সংবাদটি সামরিক বিধি লঙ্ঘন করে প্রকাশ করেছে। মুক্তিযুদ্ধের পর ঢাকার বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি শিবির থেকে ৩০০ জন নারীকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। বিভিন্ন বয়সের মেয়েদের বিভিন্ন স্থান থেকে জোরপূর্বক ধরে বিবস্ত্র অবস্থায় রাখা হতো, যাতে তারা পালাতে অথবা আত্মহত্যা করতে না পারে এবং সেনাদের পাশবিক শারীরিক নির্যাতনে অনেক মেয়ে নিহত হয়েছে বলে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে উদ্ধারকৃতদের কাছ থেকে জানা যায়। অনুরূপ রায়েরবাজার থেকে অচেতন অবস্থায় ৩০ জন মেয়েকে উদ্ধার করা হয়, যাঁরা পরবর্তী সময়ে নির্যাতনকারী সেনাদের পরিচয় দিতে পেরেছিলেন। অনেক নির্যাতিতা নারী ও তাঁদের পরিবার সামাজিক লাঞ্ছনার ভয়ে ঘটনা ও পরিচয় গোপনে সচেষ্ট ছিলেন। অনেক নারী লজ্জা ও অপমানে আত্মহত্যার পথ গ্রহণ করেছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমান ২ লাখ নারীর সম্ভ্রমহানির দাবি করেছেন। তবে বাস্তবতার কারণে সম্ভ্রমহানির শিকার নারীদের সংখ্যা সুনির্দিষ্টভাবে নিরূপণ করা সহজসাধ্য নয়। ডা. পটস ১ মার্চ দেওয়া এক সাক্ষাত্কারে বলেন, ‘পাকিস্তানি সেনাদের দ্বারা দশ হাজার নারী তাদের সম্ভ্রম হারিয়েছে এবং তাদের অনেককে পরিশেষে হত্যা করা হয়েছে।’ আন্তর্জাতিক রোমান ক্যাথলিক ত্রাণ সংস্থা কারিতাসের মাদার তেরেসাসহ ১০ জন পাদরি ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত চার হাজার নির্যাতিতা নারীকে উদ্ধার করে তাদের চিকিত্সা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন (পৃ. ১৫৯-১৬২)।

জানুয়ারিতে দেশে ফিরে শেখ মুজিবুর রহমান দেশের বিভিন্ন প্রান্তর সফর করে পাকিস্তানিদের ধ্বংসলীলা প্রত্যক্ষ করে দুই শ দেশি-বিদেশি সাংবাদিককে বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানিরা সমগ্র বাংলাদেশের প্রত্যেকটি গ্রামকে জালিয়ানওয়ালাবাগে পরিণত করেছে।’

মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পর ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে স্থানীয় আওয়ামী লীগ স্থানীয়দের তাদের পরিবারের নিখোঁজ সদস্যদের খোঁজে সহায়তার জন্য শিবির স্থাপন করে। এই শিবিরে শুধু জানুয়ারি মাসেই লিপিবদ্ধ নিখোঁজ ব্যক্তির সংখ্যা ৪০ হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছে।

আন্তর্জাতিক রেড ক্রস ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে অনুসন্ধান কেন্দ্র স্থাপন করে। তাদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গড়ে প্রতিদিন কেন্দ্রগুলোতে তিন হাজারের মতো মানুষ তাদের নিখোঁজ স্বজনদের সন্ধানে সারিবদ্ধ হয়ে অপেক্ষা করে। বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদসূত্র এবং সংশ্লিষ্ট তদন্ত কমিটির ৩১ মার্চ, ১৯৭২ পর্যন্ত প্রাপ্ত বাংলাদেশের ১৮টি জেলার ক্ষয়ক্ষতি ও হতাহতের একটি অসম্পূর্ণ পরিসংখ্যান গ্রন্থে সংযুক্ত করা হয়েছে। প্রদত্ত পরিসংখ্যান অনুসারে, মোট নিহতের সংখ্যা ১২ লাখ ৪৭ হাজার জন এবং সম্ভ্রমহারা নারীর সংখ্যা ৫৫ হাজার ৬০০ জন ছাড়িয়েছে (পৃ. ১৯৯-২০২)।

কল্যাণ চৌধুরী বাংলাদেশ জেনোসাইড পরিকল্পিত হলো সে প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছেন। তাঁর মতানুসারে, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় ইয়াহিয়া খানের পরিকল্পিতভাবে নৃশংস হত্যাকারীর ভূমিকা এবং পাকিস্তানের ভাঙনের কারণ। জেনারেল ইয়াহিয়া ভারতের হস্তক্ষেপের বিষয়ে খুব একটা শঙ্কিত ছিলেন না এবং তিনি নিশ্চিত ছিলেন বিশ্ব সম্প্রদায় ইন্দোনেশিয়া ও সিলনের (বর্তমান শ্রীলঙ্কা) মতো পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না। যদিও জেনারেল তাঁর এবং তাঁর অধীন সামরিক সদস্যদের অপরাধ ধামাচাপা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। সামরিক আক্রমণের ধরন বিশ্লেষণ করলে সহজে অনুধাবন করা যায়, ইয়াহিয়া খানের পরিকল্পনা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের সংখ্যালঘুতে পরিণত করে তাদের ইচ্ছানুযায়ী শাসন-শোষণ করা। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অবাঙালি উর্দুভাষী জনগোষ্ঠী এবং সাম্প্রদায়িক দলগুলোর সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত আলবদর, আলশামস বাহিনী ধর্মনিরপেক্ষ, বির্নিমাণপন্থী শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবী এবং হিন্দু বাঙালিদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়। মূলত তিনি এই কৌশল গ্রহণ করেছিলেন, কারণ তিনি বাঙালি জাতিনিধনের পাঁয়তারা করছেন—এই অভিযোগ সুনির্দিষ্টভাবে কেউ করতে না পারে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে এবং পরবর্তী সময়ে জেনারেল রক্তপিপাসু মানবদৈত্য হিসেবে পরিচিতি পান। তিনি রাজাকার ও আলবদরের মতো আধাসামরিক মিলিশিয়া বাহিনী গঠন করেছিলেন কিন্তু এই বাহিনীর কর্মকাণ্ডের ওপর তাঁর কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। ফলে এই মিলিশিয়া বাহিনীর সদস্যরা যথেচ্ছ হত্যা, লুট, সম্ভ্রমহানির মতো অপরাধ বিনা বাধায় সম্পাদন করেছে (পৃ. ৭)।

অভিযুক্ত পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তা ও তাদের দোসরদের যুদ্ধাপরাধ ও জেনোসাইডের জন্য বিচারের জন্য জেনোসাইড অপরাধ বলতে কী বোঝানো হচ্ছে সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজন। গ্রন্থকারের মতে, জেনোসাইড প্রত্যয়টি আন্তর্জাতিক আইনে সাম্প্রতিক হলেও মানব ইতিহাসে জেনোসাইডের ইতিহাস প্রাচীন। দুই বিশ্বযুদ্ধের অন্তর্বর্তী সময়ে আইনজ্ঞ রাফায়েল ল্যামকিন প্রথম এই প্রত্যয় ব্যবহার করেন। ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ আয়োজিত জেনোসাইড-বিষয়ক সম্মেলনে তত্কালীন বিদগ্ধ আইনজ্ঞরা জেনোসাইডের একটি সর্বজনীন সংজ্ঞা প্রদান করেন—এই সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, জেনোসাইড বলতে কোনো জাতিগত, নৃতাত্ত্বিক, বর্ণগত অথবা ধর্মীয় গোষ্ঠীকে আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করার প্রবৃত্তি হতে সম্পাদিত নিম্নে বর্ণিত যেকোনো কর্মকাণ্ডকে নির্দেশ করা হবে—

ক.        জাতি বা গোষ্ঠীর সদস্যদের হত্যা করা।

খ.        জাতি বা গোষ্ঠীর সদস্যদের মারাত্মক শারীরিক বা মানসিক ক্ষতিসাধন।

গ.         উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কোনো গোষ্ঠীকে সমূলে বা আংশিকভাবে নিধনের জন্য সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনাপ্রসূত আরোপিত ব্যবস্থাপনা।

ঘ.         জাতি বা গোষ্ঠীর বংশগতি রোধে আরোপিত ব্যবস্থাপনা।

ঙ.        জোরপূর্বক কোনো জাতি বা গোষ্ঠীর শিশুদের অন্য জাতি বা গোষ্ঠীতে স্থানান্তর।

এই সম্মেলনের গৃহীত ঘোষণার প্রথম অনুচ্ছেদ অনুসারে, যুদ্ধাবস্থায় বা শান্তিকালীন যেকোনো সময়ে সংঘটিত জেনোসাইড শাস্তিযোগ্য অপরাধ এবং চতুর্থ অনুচ্ছেদ দ্বারা শাসনতান্ত্রিক প্রধান, সরকারি ও বেসরকারি কর্মকর্তাদের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা হয়েছে। জেনোসাইড সম্বন্ধীয় দুটি বিষয় আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। প্রথমত, জেনোসাইড সংঘটনে রাষ্ট্রীয় প্রধানের প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ জরুরি নয় যদি তাঁর অধীনদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়। অধীনদের দ্বারা যদি জেনোসাইড অপরাধ সংঘটিত হয় তবে তাদের নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা ও অপরাধের জন্য সরকারপ্রধানও সমভাবে দায়ী। ন্যুরেমবার্গ ট্রায়াল ও ভিয়েতনামের মে লাই গণহত্যার ক্ষেত্রে মার্কিন ও ব্রিটিশ আইনজ্ঞরা সন্দেহাতীতভাবে এ অবস্থান গ্রহণ করেছেন। অথচ আশ্চর্যজনকভাবে বাংলাদেশ জেনোসাইডের ক্ষেত্রে তাঁরা সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থান গ্রহণ করেছেন। ব্রিটিশদের যুক্তি ছিল, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়তো পরিস্থিতি আরও নাজুক করে তুলতে পারে, যদিও সেই সম্ভাবনা ন্যুরেমবার্গ ট্রায়াল ও পরবর্তী সময়ে আইকম্যানের বিচারের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য (পৃ. ২০৩-২০৪)।

আন্তর্জাতিক আইনে জেনোসাইডের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো কোনো জাতি বা গোষ্ঠীকে অসার ও দুর্বল করার জন্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং সংগঠিত রাজনৈতিক, ধর্মীয় বা বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্বকে নিশ্চিহ্ন করার অপচেষ্টা। বাংলাদেশ জেনোসাইডে এই বৈশিষ্ট্য প্রামাণ্য সাক্ষ্যসহ সুস্পষ্ট। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সংগঠিত জেনোসাইডের পরিকল্পনায় সুস্পষ্টভাবে বাঙালি সমাজের শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবীদের বৃহত্তর অংশকে হত্যা ও গুমের মাধ্যমে বাঙালি জাতিকে অর্ধশিক্ষিত প্রতিবন্ধীতে পরিণত করার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হীন প্রচেষ্টা ছিল (পৃ. ২০৩-২০৪)। বাঙালিদের মুক্তিযুদ্ধের অন্তিমলগ্নে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগী আলবদর ও আলশামস পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়কে সমূলে নিশ্চিহ্ন করতে গোপন হত্যাযজ্ঞ ও গুম পরিচালনা করে (পৃ. ২০৮)।

জাতিসংঘের জেনোসাইড-সম্পর্কিত ঘোষণায় ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ প্রত্যয়ের মাধ্যমে যুদ্ধে সাধারণ হতাহতের সঙ্গে জেনোসাইডের পার্থক্য সুস্পষ্ট করা হয়েছে। ১৯৪৮ সালের জাতিসংঘ ঘোষণার অনুচ্ছেদ দুইয়ে জেনোসাইডকে ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ প্রত্যয়যোগে সংজ্ঞায়ন করা হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে হিটলারের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদি নিধনের ঘটনা উল্লেখ করা যায়। হিটলার ইহুদিদের তাদের কোনো প্রমাণিত অপরাধ নয় বরং তারা ‘ইহুদি’ বিধায় তাদের হত্যা করেছিলেন। জাঁ পল সার্ত্রে হিটলারের ইহুদি নিধনের উদাহরণটি ডেনমার্কে আন্তর্জাতিক আদালতে মার্কিন যু্ক্তরাষ্ট্রের ভিয়েতনাম জেনোসাইড মামলায় প্রামাণ্য উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন (পৃ. ২০৫)। পাকিস্তান সামরিক সরকার কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধকরণ জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষণার পঞ্চম অনুচ্ছেদের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী, নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পাকিস্তান বাহিনীর আগ্রাসী আক্রমণ ও নৃশংসতা ১৯৪৮ সালের জেনোসাইড-বিষয়ক ঘোষণার অনুচ্ছেদ ২-এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন (পৃ. ২১০)।

পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ পাকিস্তানের সামরিক সরকার ও পশ্চিম পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করতে পারে। প্রথমত, বেসামরিক বাঙালিদের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানিদের (পাঞ্জাবি, বেলুচ, পাঠান) অমানবিক আচরণ; পাকিস্তান বিমানবাহিনীর পলায়নরত সাধারণ মানুষের ওপর নির্বিচার আক্রমণ; তালিকানুসারে রাজনৈতিক নেতা, প্রশাসক, শিক্ষক, বাঙালি সামরিক ও পুলিশ সদস্য, বিশেষজ্ঞ ও বুদ্ধিজীবীদের হত্যা; অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে দেওয়ার জন্য অবকাঠামো ধ্বংস; নারী ও শিশুদের সঙ্গে পাশবিক আচরণ; সংখ্যালঘুদের নিধন-নিপীড়নে প্রতিক্রিয়াশীল ও অপরাধীদের ব্যবহার এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি (পৃ. ২০৫-২০৬)।

কল্যাণ চৌধুরী তাঁর গ্রন্থের শেষাংশে অভিযোগগুলোর নমুনা প্রমাণের জন্য দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, গ্লোব অব রিও ডি জেনিরো, দ্য সান, দ্য সানডে অস্ট্রেলিয়ান, ওয়াশিংটন ডেইলি নিউজ, মর্নিং স্টার, টাইমস, ফরাসি পত্রিকা লা মন্ড, দ্য শিকাগো সান টাইমস এবং ফার ইস্টার্ন রিভিউ-এ প্রকাশিত বাংলাদেশ জেনোসাইডের অংশবিশেষ উপস্থাপন করেছেন (পৃ. ২০৬-২০৭)। যেকোনো জেনোসাইড ও গণহত্যায় প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য গুরুত্বপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য প্রমাণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালে প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য ব্যাপৃতভাবে গ্রহণ ও ব্যবহার করা হয়েছে। সুতরাং বাঙালিদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ও তাঁদের প্রতিক্রিয়াশীল সহযোগীদের বিরুদ্ধেও প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য ও বর্ণনা গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হিসেবে ব্যবহারের দাবিদার (পৃ. ২০৯)। অবশ্য পরবর্তী সময়ে রচিত ১৯৭১ শীর্ষক বিভিন্ন গ্রন্থে কল্যাণ চৌধুরীর যৌক্তিক প্রত্যাশার অস্বীকৃতি লক্ষণীয়ভাবে প্রত্যক্ষ করা যায়। বিশেষত উল্লেখ্য, শর্মিলা বসুর ডেড রেকর্নিং: মেমোরিস অব দ্য ১৯৭১ বাংলাদেশ লিবারেশন ওয়্যার। অন্যদিকে স্থানীয় জনশ্রুতিও সাক্ষ্য হিসেবে বিবেচনার যোগ্যতা রাখে। বিশেষত, কল্যাণ চৌধুরী বিমান হামলার দায় ও হতাহতের বিতর্কের যে উদাহরণ দিয়েছেন (পৃ. ২০৯) সে ক্ষেত্রে জনশ্রুতি সাক্ষ্য বাস্তবসম্মত প্রামাণ্য সাক্ষ্য বলে বিবেচিত হতে পারে।

সীমান্তবর্তী অঞ্চলের উদ্দেশে সড়ক ও নৌপথে পলায়নরত শরণার্থীদের ওপর হামলা, গ্রামের পর গ্রামে অগ্নিসংযোগ, বেসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে ট্যাংকের যথেচ্ছ ব্যবহার এবং সারিবদ্ধ করে হত্যা করার দৃশ্য সাধারণ মানুষসহ অনেক বিদেশি সাংবাদিক ও ত্রাণকর্মীও প্রত্যক্ষ করেছেন (পৃ. ২০৯)। পাকিস্তান বাহিনীর আগ্রাসনের মতো সামরিক আক্রমণে সব হত্যা জনসম্মুখেই হবে অথবা প্রত্যক্ষদর্শীর উপস্থিতি ছাড়া হত্যা, ধর্ষণ, লুট ও অগ্নিসংযোগ করা হবে না এবং দায়িত্বশীলতার সঙ্গে আগ্রাসী সেনারা মৃতদেহগুলো যথাযথভাবে সত্কার এবং আহত ব্যক্তিদের সুচিকিত্সার ব্যবস্থা করবে—এ ধরনের যুক্তির অবতারণা বাংলাদেশ জেনোসাইডের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অস্বীকৃতি প্রমাণের জন্য ব্যবহার করতে দেখা যায়। এই ধরনের যুক্তিকে বরং অতিরঞ্জনের সর্বোচ্চ ব্যবহার আখ্যায়িত করা যেতে পারে।

কল্যাণ চৌধুরী পরিশেষে বলেছেন, জাতিসংঘ নীরব (বাংলাদেশ জেনোসাইড ইস্যুতে) তবে জাতিসংঘের উচিত হবে না যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে বাধা প্রদান। জাতিসংঘের জেনোসাইড-সংক্রান্ত ঘোষণার অনুচ্ছেদ ছয় অনুসারে কোনো রাষ্ট্র স্বভূখণ্ডে নিজস্ব আদালত অথবা আন্তর্জাতিক আদালতে জেনোসাইডের জন্য কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের বিচারের অধিকার রাখে (পৃ. ২১৬)। বাংলাদেশ এই এখতিয়ার ও সাংবিধানিক আইনের ভিত্তিতে পাকিস্তানের বাংলাদেশীয় সেসব সহযোগীর বিচার কার্যক্রম শুরু করেছে, যারা ১৯৭১ সালে যুদ্ধাপরাধ ও জেনোসাইড সংঘটনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল। হয়তো বাংলাদেশ অদূর ভবিষ্যতে পাকিস্তানি অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচারের প্রশ্নে আন্তর্জাতিক আইনানুসারে এবং জাতিসংঘ প্রদত্ত এখতিয়ারবলে উদ্যোগ গ্রহণ করবে। তবে তথাগত দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণকারীদের জন্য এই বিচারপ্রক্রিয়া যত দ্রুত হওয়া কাম্য, কারণ সময়ের পরিক্রমায় প্রত্যক্ষদর্শীদের অনেকেই অজানার উদ্দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের গ্রন্থিত বিবরণী ও জনশ্রুতি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য সাক্ষ্য হয়ে উঠবে। ফলে অভিযুক্ত অপরাধীর আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ সংকুচিত হবে। আইনের বহুল প্রচলিত বেদবাক্যগুলোর একটি ‘বিচারে বিলম্ব বিচারের বস্তুনিষ্ঠতা ম্লান করে’। এই প্রবাদে নিশ্চয়ই তথাগত দৃষ্টিভঙ্গির অনুসারীরা বিশ্বাস করেন। তাঁরা নিশ্চয়ই চাইবেন না তথাগত দৃষ্টিভঙ্গিতে আপেক্ষিক প্রামাণ্য সাক্ষ্য মুখ্য নিয়ামক হয়ে উঠুক। পর্যালোচনার পরিসমাপ্তিতে কিছু প্রশ্নের অবতারণা করা প্রয়োজন: যে যুদ্ধে ট্যাংক, যুদ্ধবিমান, স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ব্যবহার করা হয় সে যুদ্ধে হতাহতের সংখ্যা নিম্নগামী হওয়া কীভাবে সম্ভব? বিশ্ব ইতিহাসে এমন নজির বিরল যেখানে শরণার্থীদের রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদায় আশ্রিত ও সেবা প্রদান করা হয়েছে। বিশাল শরণার্থীদের স্রোত দুটি বিষয় নিশ্চিত করে—যে কার্যকারণে তারা শরণার্থী তাতে অনেকের মৃত্যু হয়েছে এবং তাদের অগস্ত্যযাত্রায় অনেকেই প্রাণ হারিয়েছেন এবং মানবিক বিপর্যয়ের কারণে প্রাণ হারাবেন। শরণার্থীদের অনিশ্চয়তার যাত্রায় এবং আশ্রয়কেন্দ্রে মানবিক সাহায্যের অপর্যাপ্ততা হেতু মৃত্যুগুলো কি জেনোসাইডভুক্ত হত্যাকাণ্ড নয়, যেখানে জেনোসাইডের সংজ্ঞায়নে উল্লেখ করা হয়েছে কোনো জাতি বা গোষ্ঠীকে সমূলে নিশ্চিহ্ন করার ব্যবস্থাপনাও অন্তর্ভুক্ত। জীবনের মায়ায় কোনো নারী যদি তাঁর সম্ভ্রমহানির চেষ্টাকে প্রতিরোধ না করেন তবে কি তাঁর সম্ভ্রমহানি স্বীকৃত হবে না? ১৯৭১ থেকে ২০১৬ অনেক সময়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর পাকিস্তানি বাহিনীর বদৌলতে অর্ধশিক্ষিত বাঙালি জাতিতে পরিণত হওয়া দেশটির শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বর্তমানে উল্লেখযোগ্য। ১৯৭১ সালের অর্ধশিক্ষিত প্রত্যক্ষদর্শীরা স্বভাবতই সংখ্যাতত্ত্ব বা আইনের যুক্তি অপেক্ষা লোমহর্ষক স্মৃতির আবেগী রোমন্থন করবেন এবং হয়তো তাঁর অভিজ্ঞতার নাটকীয় বর্ণনা দেবেন। তাঁদের এই বর্ণনা আবেগাশ্রিত হলেও অস্বীকার করার অবকাশ যৌক্তিক বিচারে আছে বলে মনে হয় না।

তথ্যসূত্র:

১.         দেখুন, Jahan, Rounaq. "Genocide in Bangladesh." In “Century of Genocide”, by Samuel Totten and William S.Parsons, New York And London: Routledge, 2009. P. 245.

২.         দেখুন, প্রাগুক্ত।

৩.        দেখুনCousins, Norman. "Genocide in East Pakistan." Saturday Review, May 22, 1971: 20-21.

৪.         দেখুন, Mascarenhas, Anthony. "Genocide." The Sunday Times, June 13, 1971: 01.

৫.         দেখুন, Editorial. "The Victims." The Sunday Telegraph, March 28, 1971: 20.

৬.        দেখুন, Rummel, R J. “Death by Government”. New Brunswick and London: Transaction Publishers, 1994.

৭.         দেখুন, Rummel, R J. প্রাগুক্ত। P. 315.

৮.        দেখুন, Rummel, R J. “Statistics of Democide: Genocide and Mass Murder since 1900”. Charlottesville: Transaction Publishers, 1997.

৯.         দেখুন, K. Subrahmanyam and Mohammed Ayoob. “The Liberation War”, New Delhi: S. Chand & Co. (Pvt.) Ltd., 1972. P. 31.

১০.       দেখুন, Khalid B. Sayeed, “The Political System of Pakistan”, Boston: 1967, P. 156.

১১.       দেখুন, Islam, Rafiqul. “A Tale of Millions: Bangladesh Liberation War-1971”, Dhaka: ABCO Press Ltd., 1971. Pp. 9-10.

১২.       দেখুন, Payne, Robert. “Massacre: The Tragedy of Bangladesh and the Phenomenon of Mass Slaughter Throughout History”. New York: The Macmillan Company, 1973. P. 50.    

১৩.      দেখুন, Rummel, R J. প্রাগুক্ত। P. 331.

১৪.       দেখুন, সম্পাদকীয়, “ইয়াহিয়ার ফাঁসি চাই”, দৈনিক পূর্বদেশ, ২২ ডিসেম্বর ১৯৭১ এবং “Over 30 Lakh Killed by Pak Force”, The Morning News, January 5, 1972.

১৫.       দেখুন, Rummel, R J. প্রাগুক্ত। P. 316.

১৬.      দেখুন, Salik, Siddique. “Witness to Surrender”. Dhaka: UPL, 1997.

১৭.       দেখুন, Rummel, R J. প্রাগুক্ত। P. 319.

১৮.      দেখুন, Rummel, R J. প্রাগুক্ত। P. 320.

১৯.      দেখুন, Lickttenstein, Grace. “Armey Expels 35 Foreign Newsmen from Pakistan”, The New York Times, March 28, 1971.

২০.       দেখুন, Hazelhurst, Peter. “Cholera Outbreak Reported:India Puts Pakistani Refugees at 4 Million”. International Herald Tribune, May 31, 1971.

২১.       দেখুন, Hasanat, Abul. “The Ugliest Genocide in History”, Dhaka: Muktodhara, 1974. Pp. 26-34.

২২.       দেখুন, Payne, Robert. প্রাগুক্ত। P. 18.

২৩.      দেখুন, Rummel, R J. প্রাগুক্ত। P. 321.

২৪.       দেখুন, Rummel, R J. প্রাগুক্ত। P. 322.

২৫.       দেখুন, Rummel, R J. প্রাগুক্ত। P. 320.

২৬.      দেখুন, Rummel, R J. প্রাগুক্ত। P. 322.

২৭.       দেখুন, Rummel, R J. প্রাগুক্ত। P. 323.

২৮.      দেখুন, Government of India, Minisitry of External Affairs, Bangla Desh Documents, P. 446. August 16, 1971.

২৯.       দেখুন, Yahya’s interview to Arnaud de Borchgrave of The News Week in International Herald Tribune, November 1, 1971. Yahya’s broadcast of June 28,1971, reproduced in Institute for Defence Studies & Analysis- News Review on Pak.6/71

৩০.      দেখুন, K. Subrahmanyam and Mohammed Ayoob.  প্রাগুক্ত। P. 166.