দারিদ্র্য দূরীকরণে শিক্ষাই সর্বশ্রেষ্ঠ বিনিয়োগ

সারসংক্ষেপ

শিক্ষা ও দারিদ্র্যের মধ্যে দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক বিরাজমান। প্রজন্মের পর প্রজন্ম দরিদ্র জনগোষ্ঠী কি অশিক্ষিতই থাকবে? দারিদ্র্য দূর করার জন্য চাই শিক্ষা। এই প্রবন্ধে বলার চেষ্টা করা হয়েছে যে আর্থিক ও মানসিক দারিদ্র্য দূর করার জন্য আনুষ্ঠানিক বা অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রকৃত ফলপ্রসূ সম্মিলন প্রয়োজন। প্রাথমিক শিক্ষাপরবর্তী স্তরে মানসম্মত কারিগরি শিক্ষার প্রচলন ও সমন্বয় সম্ভব হলে দেশকে দারিদ্র্য থেকে মুক্ত করা সম্ভব। বিশ্বায়ন এই ক্ষেত্রে বিশাল সুবিধা হিসেবে কাজ করার কথা থাকলেও, নানা কাঠামোগত বাধার কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না। অন্যদিকে উপযুক্ত কাজ এবং উপযুক্ত শ্রমিক একে অপরের নাগাল না পাওয়ায় তৈরি হচ্ছে একধরনের প্যারাডক্স বা কূটাভাসের। এই সমস্যা সমাধানের পথগুলো এই প্রবন্ধে খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে এবং এ ক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয়েছে। অন্যদিকে, দেশীয় ধনিকদের হাতে প্রচুর সম্পদ থাকলেও তা উত্পাদনশীল খাতে বিনিয়োগ হচ্ছে না। দেশের উন্নয়নের স্বার্থে মানব উন্নয়নে জোর দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে পূর্ব এশিয়ার অভিজ্ঞতা আমাদের কাজে লাগাতে হবে। যেখান থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি, শিক্ষা খাতে বর্ধিত বিনিয়োগ দীর্ঘমেয়াদে কীভাবে রাষ্ট্রের সার্বিক উন্নয়নে সুফল বয়ে আনতে পারে।

মুখ্য শব্দগুচ্ছ: শিক্ষা, দারিদ্র্য, অর্থনীতি, বিপ্লব, বিশ্বায়ন, মধ্য আয়, সমাজতন্ত্র, বিনিয়োগ।

ভূমিকা

দারিদ্র্যের সঙ্গে শিক্ষার সম্পর্ক বিপরীতধর্মী ও দ্বান্দ্বিক। সাধারণভাবে চারদিকে তাকালেই এর সত্যতা চোখে পড়ে। আমরা দেখতে পাই, যে মানুষেরা দরিদ্র তারা অধিকাংশই হয় নিরক্ষর না হয় স্বল্পশিক্ষিত। শিক্ষা যত কম দারিদ্র্য তত বেশি। তবে ব্যতিক্রম হিসেবে আমরা স্বল্পশিক্ষিত কিছু ধনী লোককেও দেখতে পাব, যারা দরিদ্র নয়। কিন্তু তাদের এই প্রাচুর্যের পেছনেও তাদের কোনো না কোনো মানসিক শিক্ষা সক্রিয় ছিল। হাবাগোবা বা মানসিকভাবে দরিদ্র মানুষ উত্তরাধিকারী সূত্রে বা লটারির মাধ্যমে ধনী হতে পারে কিন্তু সেটা ব্যতিক্রম নিয়ম নয়। আবার এসব ব্যতিক্রমী অশিক্ষিত ধনী সমাজের জন্য সুফলের চেয়ে কুফলই বেশি বয়ে আনে। তাই শিক্ষা বলতে আমি এই প্রবন্ধে শুধু স্কুল-কলেজের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা বোঝাচ্ছি না। বোঝাচ্ছি প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠার জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের বিদ্যাশিক্ষা। এর জন্য আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কোনো আবশ্যকীয় শর্ত নয়, যথেষ্ট শর্তও নয়। একজন মুখস্থ করে এম এ পাস করলেন, কিন্তু ওই বিদ্যা কাজে লাগাতে তিনি অক্ষম, তাহলে তাঁর শিক্ষা বৃথা গেল। তিনি শিক্ষিত বেকার ও সমাজের জন্য বোঝা হয়েই থাকবেন। আরেকজন বিদ্যালয়ে কোনো দিন গেলেন না কিন্তু জীবনের অভিজ্ঞতার পাঠ নিয়ে সফলতার সঙ্গে সমাজে অবদান রাখছেন, তাঁকে আমি অশিক্ষিত বলব কি? সুতরাং আনুষ্ঠানিক শিক্ষাসহ বা ছাড়া দুইভাবেই মানুষ ‘শিক্ষিত’ হতে পারে, সমাজে অবদান রাখতে পারে। সাধারণভাবে এই প্রবন্ধে দাবি করা হচ্ছে যে আর্থিক দারিদ্র্য ও মানসিক দারিদ্র্য ঘোচানোর জন্য আমাদের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা বা কোনো না কোনো ধরনের প্রকৃত ফলপ্রসূ শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে।

শিক্ষা ও দারিদ্র্যের সম্পর্ক

প্রবন্ধের শিরোনামে প্রস্তাব করা হয়েছে ‘দারিদ্র্যকে দূর করার জন্য শিক্ষাই হোক প্রধান বিনিয়োগ’। এই প্রস্তাবের তাত্পর্য বিশ্লেষণের জন্য প্রথমে নজর দিচ্ছি অনুমাত্রিক স্তরে ব্যক্তির আর্থিক ও শিক্ষা বিকাশের প্রক্রিয়ার ওপর। আমরা সবাই একসময় শিশু ছিলাম। তখন আমাদের শারীরিক ক্ষমতা ও মানসিক ক্ষমতা ছিল সংকুচিত। পিতা-মাতা আমাদের যে পরিমাণ পুষ্টি ও শিক্ষা দিয়েছেন আমরা সে পরিমাণে আমাদের শরীর ও মস্তিষ্কের বিকাশ সাধন করতে সক্ষম হয়েছি। পিতা-মাতা যে মাত্রায় আমাদের আনুষ্ঠানিক ও অ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যবস্থা করেছেন সে মাত্রায় আমরা একেকজন শিক্ষিত মানুষ হয়ে গড়ে উঠেছি। কিন্তু এ ক্ষেত্রে প্রথম এবং প্রধান বাধা ছিল আমাদের অভিভাবকদেরই নিজস্ব দারিদ্র্য এবং শিক্ষার অভাব। অশিক্ষিত ও দরিদ্র বাবা-মায়ের রোজগার কম ও শিক্ষাও কম এবং নিজের সন্তানদের উপযুক্ত ভরণপোষণও তাঁদের পক্ষে তাই অসম্ভব। তাই মা-বাবার অশিক্ষা ও দারিদ্র্য থেকেই সন্তানের অশিক্ষা ও দারিদ্র্যের প্রাথমিক উদ্ভব ঘটে থাকে। আমরা দেখি দরিদ্রের সন্তান অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিক্ষাবঞ্চিত হন, তাদের আয়-উপার্জনও কম হয়, ফলে তাঁরা দরিদ্রই থেকে যান। আবার এ দরিদ্র ছেলে বা মেয়েরাও দরিদ্রই থেকে যায়। এই অর্থে অশিক্ষা ও দারিদ্র্য পরস্পর পরিপূরক এবং তা অশিক্ষা ও দারিদ্র্যের ফাঁদের মধ্যেই প্রজন্মের পর প্রজন্মকে আবদ্ধ করে রাখে। এটা আমরা পারিবারিক ব্যক্তি পর্যায়ের অসংখ্য অভিজ্ঞতার মধ্যেই প্রতিফলিত হতে দেখি। গুনার মিরডালের দারিদ্র্যের নিষ্ঠুর চক্র তত্ত্ব এ ধরনের বাস্তবতার ভিত্তিতেই নির্মিত হয়েছে। বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের অনুধাবন করতে হবে যে দারিদ্র্য ও অশিক্ষার এই মেলবন্ধন ভাঙতে না পারলে আমরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম দরিদ্র ও অশিক্ষিতই থেকে যাব। তাই এই বিষয়ে গভীর মনোযোগ দিতে হবে।

এই নিষ্ঠুর চক্র থেকে মুক্ত হওয়া কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। দুভাবেই হতে পারে। কখনো কখনো কেউ আগে দারিদ্র্যমুক্ত হয়ে পরবর্তী সময়ে শিক্ষা অর্জন করে শিক্ষিত হতে পারেন। আবার কেউ প্রথমে শিক্ষিত হয়ে উচ্চতর উপার্জনক্ষমতা অর্জন করে দারিদ্র্যমুক্ত হতে পারেন। দুই-ই যে সম্ভব তার উদাহরণ আমাদের সমাজে আছে।

বিশ্বায়িত অর্থনীতিতে দুটি অনুমাত্রিক দৃষ্টান্ত

আমি আমার নিজের জীবনের একটি অভিজ্ঞতা বলতে পারি। আমার বাসায় এক দরিদ্র বালক পাচক হিসেবে ঢুকেছিল। আমার মা প্রতি সন্ধ্যায় তাকে অক্ষরজ্ঞান দিতেন এবং ক্রমে ক্রমে সে নাম লিখতে, খবরের কাগজ পড়তে এবং চিঠি লিখতে শিখে গেল। এভাবে প্রাথমিক বিদ্যার্জন তার দরিদ্র অবস্থাতেই সম্ভব হলো। কিন্তু আরও বাড়তি লেখাপড়ায় তার কোনো আগ্রহ ছিল না। তবে সে প্রবল উত্সাহে আমার মায়ের কাছ থেকে বিশেষ এক বিদ্যা হিসেবে রান্না শিখতে শুরু করে। এভাবে একদিন সে পাকা বাবুর্চিতে পরিণত হলো। পরে যখন সে বিয়ে করল তখন সে একটি হোটেলে বাবুর্চির চাকরি নিয়ে চলে যায়। আরও বহুদিন পর মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমি একদিন

হঠাত্ তার ফোন পেলাম। সে সেখানে এখন একজন ধনাঢ্য বাবুর্চির পেশায় কাজ করছে। এটা কোনো অলীক গল্প নয়, এ অত্যন্ত বাস্তব সত্য ঘটনা। আমার এই অনুমাত্রিক উদাহরণ উপস্থাপনের উদ্দেশ্য হচ্ছে একটি বৃহত্ সত্যের প্রতিষ্ঠা, তা হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষার সঙ্গে বিশেষ পেশাগত শিক্ষার মিলন (এ ক্ষেত্রে বাবুর্চিবিদ্যা!) সম্ভব হলে একটি দেশের দরিদ্র জনগণকে দ্রুত দারিদ্র্যমুক্ত করা সম্ভব।

আধুনিক বিশ্বায়নের ফলে মানুষের অবাধ গতি বৃদ্ধি পেয়েছে, ফলে পুঁজি ও পণ্যের পাশাপাশি শ্রমেরও আদান-প্রদান বৃদ্ধি পেয়েছে। এটা যদি আরও অবাধ হতো, সত্য সত্যই যদি আমরা একটি ভিসামুক্ত পৃথিবী পেতাম তাহলে জনসংখ্যা কোথাও কোনো সমস্যা হিসেবে বিরাজ করত না। জনাকীর্ণ দেশ থেকে জনহীন দেশে সহজেই বহির্গমন সম্ভব হতো। পুঁজিঘন দেশ থেকে শ্রমঘন দেশে পুঁজি যেমন অবাধে চলে আসছে, তেমনি শ্রমঘন দেশ থেকে শ্রমও অবাধে পুঁজিঘন দেশে চলে যেত। ফলে উভয়েরই লাভ হতো—অব্যবহূত পুঁজি ও অলস শ্রম উভয়ই ফলপ্রসূভাবে ব্যবহারের সুযোগ মিলত। কিন্তু বিষয়টি এত সহজ নয়। বিশ্বায়নের ফলে এই স্বতঃস্ফূর্ত সমাধানের পথে অনেকগুলো কাঠামোগত বাধা বর্তমানে গড়ে উঠছে। যেমন:

১.         জাতীয় রাষ্ট্রের মধ্যে শ্রম-পণ্য-পুঁজির গতিবিধির অবাধ নিয়মগুলো সুষম নয়। পুঁজি ও পণ্য যত অবাধে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে আসতে পারে, শ্রম তত অবাধে উন্নত দেশগুলোতে প্রবেশ করতে পারে না।

২.         প্রযুক্তি, পুঁজি ও জ্ঞানের অসম বিকাশের কারণে সব পুঁজি বা সব মানুষ সব জায়গায় সমানভাবে খাপ খাওয়াতেও পারে না। যেমন অতীতে অটোমেটিক তাঁত ভারতবর্ষে যখন ইংল্যান্ড থেকে রপ্তানি শুরু করেছিল বা অটোমেটিক তাঁতটাই ভারতে আমদানি হয়েছিল তখন অসংখ্য ভারতীয় তাঁতি প্রতিযোগিতায় হেরে যান ও মৃত্যুবরণ করেন। মার্ক্সের ভাষায়, ‘ভারতীয় তাঁতির হাড়গোড়ের ওপর ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।’ আবার বর্তমানে উল্টোদিক থেকে আমাদের অশিক্ষিত লোকেরা যখন ইংল্যান্ড যাচ্ছেন তখনো সেখানে সবচেয়ে নিচু কাজগুলোই তাঁদের ভাগ্যে জুটছে! তাই অসম সম্পর্কের ফাঁদের কারণে বিশ্বায়নের প্রকৃত সুফল সুষমভাবে বণ্টিত হচ্ছে না।

তাহলে আমাদের উদ্বৃত্ত জনসংখ্যাকে দারিদ্র্য থেকে মুক্তি দেওয়ার উপায় কী? এ কথা সত্য যে আপেক্ষিকভাবে উদ্বৃত্ত জনসংখ্যা যত দিন বেকার থাকবে তত দিন তাদের দারিদ্র্য থেকে মুক্তি অসম্ভব। সুতরাং, তাদের জন্য উপযুক্ত কাজ সৃষ্টিই দারিদ্র্য থেকে মুক্তির প্রাথমিক পূর্বশর্ত। এটা দুভাবে হতে পারে। এক. যদি পুঁজি ও প্রযুক্তি তাদের নাগালে পৌঁছে দেওয়া যায় অথবা দুই. যদি পুঁজি ও প্রযুক্তির কাছে তাদের পৌঁছে দেওয়া যায়। কিন্তু আমি আগেই বলেছি, পুঁজি ও প্রযুক্তির বিকাশ যদি উঁচুতে থাকে তাহলে তার সঙ্গে নিচুতে থাকা শ্রমের মেলবন্ধন সম্ভব নয়। সে জন্য নিচুতে থাকা শ্রমকে উন্নত প্রযুক্তি ও উচ্চতর পুঁজি ব্যবহারে সক্ষম করে গড়ে তোলাটা জরুরি হয়ে উঠেছে। এ জন্য আবার শেষ বিচারে উপযুক্ত ধরনের শিক্ষাই হচ্ছে প্রধান হাতিয়ার। আমরা সবাই জানি শ্রম সরবরাহ ও শ্রম চাহিদার মিলন ছাড়া কর্মনিয়োজন সম্ভব নয় আর এই মিলনের বিষয়টা শুধু পরিমাণের দিক থেকে সমান হলে হবে না। গুণের দিক থেকেও হতে হবে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তাই শ্রমের গুণগত দিক ও শিক্ষাটাও কর্মসংস্থানের জন্য উপযুক্ত হতে হবে। তা না হলে আমরা একটি অদ্ভুত প্যারাডক্স বা কূটাভাসের সম্মুখীন হব। বিশেষ করে অপরিকল্পিত বাজার অর্থনীতিতে এটি প্রায়ই ঘটে থাকে।

এখন আমি দ্বিতীয় একটি সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত দিচ্ছি। আমাদের দেশে অসংখ্য পোশাকশিল্পের মালিক আছেন যাঁরা প্রায়ই অভিযোগ করে থাকেন যে ‘কাজ নিয়ে বসে আছি কিন্তু উপযুক্ত শ্রমিক পাচ্ছি না।’ তাঁরা দাবি করেন, ‘শ্রীলঙ্কা থেকে ম্যানেজার ভাড়া করছি, ভারত থেকে ফ্যাশন ডিজাইনার আনছি, চীন থেকে মাস্টার টেইলর আনছি। ওরা উচ্চ বেতন ও ডলার এ দেশ থেকে বিদেশে নিয়ে যাচ্ছে অথচ দেশের ভেতরে উপযুক্ত লোক পাচ্ছি না।’ অন্যদিকে আমাদের কাছে বহু শ্রমিক অভিযোগ করেন, ‘আমরা কাজই পাচ্ছি না অথবা পেলেও তার মজুরি এতই নিম্ন যে মানুষের মতো বাঁচা তা দিয়ে সম্ভব নয়।’ তাহলে এই ‘কাজ আছে কিন্তু কাজ নেই’ সমস্যার সমাধান কীভাবে হবে?

কর্মসংস্থান সমস্যার সমাধান—শিক্ষা একটি চাবিকাঠি

অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন দুভাবে এই উল্লেখিত কর্মসংস্থান-সংক্রান্ত ‘কূটাভাসের’ বাস্তব মীমাংসা সম্ভব। একটি হচ্ছে কর্ম নিয়োগকারীরা তাঁদের মুনাফা কমিয়ে যদি কিছু টাকা শিক্ষার জন্য ব্যবহার করেন। তার কাছে চাকরিপ্রার্থী বা চাকরিরতদের জন্য ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করেন, তাহলে শ্রমিকদের প্রয়োজনমতো ফলপ্রসূ শিক্ষা দিয়ে এ সমস্যা থেকে তিনি নিজ উদ্যোগেই মুক্ত হতে পারেন। তবে এখানে যৌথ স্বার্থ ও ব্যক্তিস্বার্থের একটি দ্বন্দ্ব থেকে যাবে। ধরা যাক কোনো ধনাঢ্য পুঁজিপতি আগ্রহী হয়ে একটি পোশাকশিল্পের ট্রেনিং ইনস্টিটিউট তৈরি করলেন। কিন্তু ব্যাপারটি এ রকম হতে পারে তাঁর প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের পাস করা ছাত্রকে অন্য কোনো মালিক বেশি বেতনের লোভ দেখিয়ে ভাগিয়ে নিতে পারেন। এই সমস্যাকে অর্থনীতির পরিভাষায় বলে বাহ্যিক সাশ্রয়। অর্থাত্ কাজ করলাম আমি কিন্তু ফল পাচ্ছে অন্যজন। ফলে এ অবস্থায় কাজটি কেউই করতে আগ্রহী হচ্ছে না। এই সমস্যা পরস্পরবিচ্ছিন্ন উদ্যোক্তানির্ভর বাজার অর্থনীতিতে অনিবার্য।

তাই এ ক্ষেত্রে দ্বিতীয় সমাধানের দিকে যাওয়া যেতে পারে। ধরা যাক বিজিএমইএ বা পোশাক মালিকদের যৌথ সংগঠন যৌথ স্বার্থে সবার কাছ থেকে চাঁদা তুলে একটি সাধারণ প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট গড়ে তুললেন। তাহলে সেখান থেকে প্রতিবছর উপযুক্ত সংখ্যক প্রশিক্ষিত কর্মী বের হয়ে প্রয়োজনমতো বিভিন্ন কারখানায় ছড়িয়ে যেতে পারেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও সমস্যা হচ্ছে, ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াবেন কে? উদ্যোক্তাদের মধ্যে কি এই আলোকিত যৌথ স্বার্থের বাহক পাওয়া যাবে? আসলে চূড়ান্ত বিচারে এ কাজটি শেষ পর্যন্ত সরকারকেই করতে হবে এবং এ জন্য প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ তাকে ধনীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করতে হবে।

এতক্ষণ পরে আমরা যে সমাধানে উপনীত হলাম তাকে ইংরেজিতে বলে ‘Public Goods’ এর ‘Public Supply’ অর্থাত্ ‘শিক্ষা যেহেতু একটি সর্বজনভোগ্য দ্রব্য’ সে জন্য তার সরবরাহের দায়িত্বও বর্তায় ‘সার্বজনীন কর্তৃত্বের’ কাঁধে অর্থাত্ সরকার বা রাষ্ট্রেরই দায়িত্ব হচ্ছে অর্থনীতির প্রয়োজনমতো একটি ফলপ্রসূ শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলে সবার জন্য শিক্ষা ও সেই অনুযায়ী কর্মসংস্থান সুনিশ্চিত করা ও দারিদ্র্য দূর করা। আর সমাজের দায়িত্ব হচ্ছে এ জন্য প্রয়োজনীয় ব্যয়ভার রাষ্ট্রকে যথাসময়ে যথাযথ মাত্রায় জোগান দেওয়া। অবশ্য এই ফাঁকে এ কথাটিও বলে রাখি যে পরিকল্পিত কর্মসংস্থান, পরিকল্পিত শিক্ষার মাধ্যমে অর্জিত হলেও যদি শিক্ষার গুণগত মান ও উত্পাদশীলতা যথেষ্ট না হয় তাহলে উপার্জিত আয় দ্বারা দারিদ্র্য দূরীভূত হবে না, আরও খারাপও হতে পারে। অর্থাত্ কম উত্পাদনশীল কম আয়ের ভারসাম্য ফাঁদেই আমরা দীর্ঘকাল আটকে থাকতে পারি। রাষ্ট্র চাকরি সৃষ্টি করে বেকারত্ব দূর করার নামে শূন্য উত্পাদনশীল অতিরিক্ত ছদ্মবেশী বেকারও তৈরি করতে পারে। সুতরাং শিক্ষাকে যদি সত্যিই দারিদ্র্য দূরীকরণের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে চাই তাহলে আমাদের একই সঙ্গে শিক্ষার পরিমাণগত মাত্রা, শিক্ষার বিশেষ ধরন এবং শিক্ষার গুণগত মান—এই তিনটি দিকেরই ভারসাম্যপূর্ণ উন্নয়ন অর্জন করতে হবে। প্রথমত, কয়েকটি মৌলিক শিক্ষাকে আপামর জনগণের নাগালের মধ্যে নিয়ে যেতে হবে। অর্থাত্ পড়তে পারা, লিখতে পারা ও গুনতে পারা—এই ক্ষমতাগুলোকে সবার জন্য বাধ্যতামূলক ও গ্রহণযোগ্য করতে হবে। এই সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান এমন হতে হবে যাতে যেটাকে বলা হয় Basic Competence বা মৌলিক দক্ষতা, সেটা অল্প বয়সেই নাগরিকেরা প্রত্যেকেই অর্জনে সক্ষম হন। তারপর যে পরবর্তী ধাপের শিক্ষা হবে সে শিক্ষার ধরনটি হবে কর্মমুখী এবং অর্থনীতির ও সমাজের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং তার মানটিও হতে হবে বিশ্বমানের বা গ্লোবাল স্ট্যান্ডার্ড। তাহলে দেশে-বিদেশে যুগপত্ কর্মসংস্থানে কোনো বাধা থাকবে না এবং আমরা সামগ্রিকভাবে একটি ন্যূনতম শিক্ষায় শিক্ষিত জনগোষ্ঠী উপহার পাব,

শিক্ষিত হয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকার দুঃসহ অভিশাপ থেকে রক্ষা পাব এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় সক্ষম একটি জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হব। মানবসম্পদকে কাজে লাগিয়ে উন্নয়ন ও দারিদ্র্য দূরীকরণের যে স্ট্র্যাটেজির কথা এখন অহরহ আমরা শুনতে পাই তা এই যৌক্তিক ভিত্তির ওপরই দাঁড়িয়ে আছে।

দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য শিক্ষা: সামষ্টিক কার্যকারণ চক্র

আমাদের আগের অধ্যায়ের আলোচনার সূত্র অনুসরণ করে আমরা দেখাতে পারি কীভাবে শিক্ষাহীনতা দারিদ্র্যকে দীর্ঘায়িত করে (দেখুন চিত্র-এক) এবং শিক্ষার অগ্রগতি কীভাবে দারিদ্র্য দূরীকরণে সহায়ক হয় (দেখুন চিত্র-দুই)।

Capture
Capture

এক নম্বর চিত্র থেকে আমরা দরিদ্র পরিবারের শিক্ষা ঘাটতির কারণগুলো সুনির্দিষ্টভাবে অনুধাবন করতে পারি। সেগুলো হচ্ছে:

ক.        শিশু বয়সেই বিদ্যালয়ে ভর্তি না হওয়ার সমস্যা। শুধু আর্থিক কারণে নয়, কাছাকাছি কোনো বিদ্যালয় না থাকাও এর কারণ হতে পারে। এর ফলে নিরক্ষর মানুষ তৈরি হচ্ছে।

খ.        দরিদ্রদের পরিবারের যারা অবশেষে ভর্তি হতে পারে তাদের মধ্যেও প্রাথমিক শিক্ষার জন্য যে পাঁচ বছর পর্যন্ত সময় ব্যয় করতে হয় সেটুকু সময় উপার্জনহীনভাবে ব্যয় করার বিলাসিতা সম্ভব নয়। ফলে সৃষ্টি হয় মাঝপথে ঝরে পড়া অসমাপ্ত শিক্ষার সমস্যা। এই স্বল্প বা অর্ধশিক্ষিত ব্যক্তিদের আর কখনোই পরবর্তী সময়ে শিক্ষালাভের সুযোগ তৈরি হয় না।

গ.         এই নিরক্ষর ও স্বল্পশিক্ষিতরা হয় বেকার অথবা অর্ধবেকার থাকে অথবা কাজ পেলেও তাদের কাজের উত্পাদনশীলতা ও মজুরি কম থাকে। ফলে দারিদ্র্য জমা হতে থাকে ও টিকে থাকে।

তবে সুখবর হচ্ছে যে বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা বোর্ডের আইন পাস করেছে। এটি কার্যকর হলে ঝরে পড়া লোকদেরও নতুন করে লেখাপড়ার সুযোগ তৈরি হবে।



মধ্য আয়ের দেশ প্রসঙ্গ ও শিক্ষার গুরুত্ব

বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়েছে যে ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্য আয়ের দেশে পরিণত করা হবে। এ সম্পর্কে দুধরনের আপত্তির কথা শোনা যায়। প্রথমত, কেউ কেউ বলেন, ‘সাত মণ তেলও পুড়বে না রাধাও নাচবে না।’ এই মতাবস্থানের অন্যতম কারণ হিসেবে তাঁরা বলেন যে অধুনা দুই প্রধান যে রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রক্ষমতায় পালাক্রমে আসীন হচ্ছে তাদের উন্নয়ন কৌশলে উত্পাদনশীল বুর্জোয়াদের তুলনায় লুটেরা বুর্জোয়াদের প্রাধান্যই বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। লুটেরা বুর্জোয়ারা প্রচুর সম্পদের মালিক হয়েছে বটে কিন্তু পূর্ব এশিয়ার বুর্জোয়াদের মতো তা উত্পাদনশীলভাবে ব্যবহার করে দেশে শিল্প বিপ্লব সংঘটিত করতে তাদের আগ্রহ কম। কিন্তু এই সুস্পষ্ট ও সরল বক্তব্যের সমস্যা হচ্ছে বক্তব্যটিকে আরেকটু গভীরে নিয়ে গিয়ে নতুন কিছু প্রশ্ন না করার সমস্যা। আসলে আমাদের যে মৌলিক প্রশ্নটি করতে হবে তা হচ্ছে বাংলাদেশে ধনাঢ্য ব্যক্তিদের সঞ্চয় কেন উত্পাদনশীলভাবে ব্যবহূত হচ্ছে না অথচ অন্যত্র কেন তা হয়েছিল? খুঁজে দেখতে হবে, এটা কি বাংলাদেশের বাঙালিদের চারিত্রিক ক্রটি, নাকি বর্তমান বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অধস্তন অবস্থানে থাকার জন্য দেশের ভেতরে উত্পাদনশীল বিনিয়োগ অসম্ভব হয়ে পড়েছে, নাকি এটা বুর্জোয়া শাসক রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতা, নাকি এটা রাষ্ট্রেরই এক সামগ্রিক ব্যর্থতা। আসলে এসব প্রশ্নই হয়তো আমাদের নিয়ে যাবে সমস্যার মূলে এবং তখনই হয়তো আমরা প্রকৃত সমাধানের চাবিকাঠিটি খুঁজে পাব।

বাংলাদেশের অধিকাংশ অর্থনীতিবিদ এখন মনে করেন যে বাংলাদেশে সঞ্চিত ধনের উত্পাদনশীল বিনিয়োগের অনুকূল বাস্তব পরিস্থিতি নেই। হয়তো সে জন্যই এ দেশের ধনী ব্যক্তিরা এবং উদ্বৃত্ত পুঁজির মালিক বিদেশি ধনী ব্যক্তিরাও এখানে সস্তা শ্রম পাওয়া সত্ত্বেও বিনিয়োগে ততটা আগ্রহী হচ্ছেন না। উত্পাদনশীল বিনিয়োগের পথে এ দেশে প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে সস্তা শ্রম কিন্তু তার বিপরীতে যে অন্য প্রতিবন্ধকতাগুলো এ যাবত্ চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে সেগুলোর শক্তিও কম নয়। এর তালিকাটি নিচে তুলে ধরা হলো।

১.         প্রয়োজনীয় ভৌত কাঠামোর অভাব অর্থাত্ সাশ্রয়ী দামে গ্যাস-বিদ্যুত্-পানি-বন্দর-যোগাযোগব্যবস্থা ইত্যাদির অভাব। এসব ছাড়া নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ার সাহস কেউ করবেন না।

২.         প্রয়োজনীয় আইনশৃঙ্খলার অভাব এবং সম্পত্তির নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কা। অদৃশ্য সেলামি বা চাঁদা/ঘুষ প্রদানের বোঝা। অর্থাত্ উত্পাদন খরচের ওপর এসব বাড়তি ঝামেলা ও খরচ থাকলে নতুন প্রতিষ্ঠানটি লাভজনক ও নিরাপদ নাও হতে পারে।

৩.        পরিবর্তনশীল পুঁজির অভাব এবং ব্যাংক থেকে সস্তায় বা কম সুদে অর্থ পাওয়া যাচ্ছে না। পুরো ‘ইকুয়িটি’ পুঁজি নিয়ে এখন কম লোকই মাঠে নামেন। তাই দক্ষ ব্যাংকিং সেবা ছাড়া মূল ‘ইকুয়িটি’ পুঁজি সক্রিয় নাও

হতে পারে।

৪.         বাজারের অভাব বা কোথায় উত্পাদিত পণ্য বিক্রি করা যাবে তা খুঁজে বের করে সেখানে তা দ্রুত সস্তায় প্রেরণ করার বাধাসমূহ। এটার সঙ্গে জড়িয়ে আছে পণ্যের দাম সস্তা কি না এবং মান ভালো কি না সেই প্রশ্ন। দাম

সস্তা ও মান ভালো না হলে বাজারজাতকরণের প্রতিযোগিতায় জয়ী হওয়া যাবে না।

৫.         কিন্তু সস্তা দাম ও উন্নত মান অর্জন করতে হলে উন্নত প্রযুক্তি, দক্ষ শ্রমিক, দক্ষ ব্যবস্থাপনা ইত্যাদির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। সুতরাং দক্ষ শ্রমের এবং তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ উন্নত প্রযুক্তির অভাব হলে ওপরের চার নম্বর শর্তটি পূরণ হবে না। আবার দক্ষ শ্রমিককে সন্তুষ্ট রাখতে হলে তাকে উপযুক্ত বেতন/মজুরি এবং অবিচ্ছিন্ন উত্পাদনকর্মের প্রণোদনাও দিতে হবে।

মনে রাখা দরকার উপরিউক্ত পাঁচটি উপাদান পরস্পরবিচ্ছিন্ন পৃথক পৃথক উপাদান নয়। এগুলোর একটি নিশ্চিত হলো, অপরটি নিশ্চিত হলো না, সে অবস্থায় কিন্তু অর্থনীতির চাকা মধ্য আয় অভিমুখে মসৃণ ও অব্যাহতভাবে চালু থাকবে না। যদি মোটামুটি মসৃণ ও অব্যাহতভাবে আমরা মধ্য আয়ের দিকে এগোতে চাই তাহলে এই বাধাগুলোকে চারদিক থেকে একসঙ্গে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং তার সম্মিলিত সমাধান করতে হবে বা অন্তত সেদিকে যে আমরা অগ্রসর হচ্ছি শাসকশ্রেণিকে তার বিশ্বাসযোগ্য সিগন্যাল সমাজকে দিতে হবে। এই সম্মিলিত সমাধানের জন্য অর্থনীতির ভাষায় Big Push বা ‘বড় ধাক্কার’ প্রয়োজন দেখা দেবে। বর্তমান রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ক্ষমতাসীন দল, বাইরে অবস্থিত ‘ব্যবসায়ী বুর্জোয়াদের’ অর্থনৈতিক ক্ষমতা এবং প্রশাসনের (সামরিক-বেসামরিক) নির্বাহী ক্ষমতা, এই ত্রয়ীর সম্মিলিত (Orchestrated) অঙ্গীকার ও প্রচেষ্টা ছাড়া এই Big Pushপ্রদান অসম্ভব। কিন্তু এই ত্রিভুজ ক্ষমতার তিনটি বাহুই যদি পুঁজির আদিম সঞ্চয়েই অধিকতর আগ্রহী ও ব্যস্ত থাকে তাহলে এই অতি প্রয়োজনীয় Big Pushকি সংগঠিত করা সম্ভব হবে? নিশ্চয়ই তখন তা সম্ভব হবে না। আমরা হয়তো তখন অন্যান্য অনুন্নত দেশের মতোই একটি অসম্পূর্ণ বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের ট্র্যাজেডির মধ্যেই আটকে পড়ে থাকব। প্রশ্ন হলো, এই ‘ত্রিভুজকে’ ভাঙার জন্য কোনো কার্যকর উদ্যোক্তা শক্তি সমাজে দৃশ্যমান হচ্ছে না কেন?

বামপন্থী বা সমাজতন্ত্রীরা বর্তমানে এই অসমাপ্ত বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের যন্ত্রণাগুলোর সমাধান করতে চাচ্ছে শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বে জনগণতান্ত্রিক একটি বিপ্লবের মাধ্যমে, যার বিষয়ীগত ও বিষয়গত শর্ত দুই-ই বর্তমানে অনুপস্থিত। মনে রাখা প্রয়োজন মার্ক্সের তত্ত্ব অনুসারে সমাজে সংখ্যাগরিষ্ঠ আধুনিক শ্রমিকশ্রেণি এবং বৃহদায়তন সামাজিক চরিত্রের শিল্পায়ন ছাড়া সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা অসম্ভব। তা ছাড়া বিশ্ব ইতিহাসের ধারায় অতীতে কোনো দুর্বল গ্রন্থিতে এককভাবে বিপ্লবের পর শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বে রাষ্ট্রের কেন্দ্রীভূত পরিকল্পনার অধীনে কোথাও কোথাও ভিন্নপথে শিল্পায়ন সম্ভব করা গেলেও তা শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রের অধীনে সুড়ঙ্গ করা যায়নি এবং ইদানীং চীন, ভিয়েতনাম ও কিউবাতে তা এখনো টিকলেও সেখানে তা টিকানোর জন্য ইতিমধ্যেই পুঁজিবাদী পথে নানা সংস্কারের আশ্রয় নেওয়া হচ্ছে। এসব অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা যায় যে উত্পাদনমুখী উদ্যোক্তাদের কিছুটা সহযোগিতা ছাড়া আমাদের দেশকেও আমরা শিল্পায়নের মাধ্যমে মধ্য বা উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত করতে পারব না।

উল্লিখিত বিষয়গুলোর সঙ্গে শিক্ষার সম্পর্ক কোথায়? কেউ বলতে পারেন যে আমি ‘ধান ভানতে শিবের গীত’ গাইছি। কিন্তু মধ্য আয়ের অন্য দেশগুলোর দিকে তাকালেই বোঝা যায় যে ন্যূনতম আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান-শিক্ষা ছাড়া কোনো দেশই আধুনিক শিল্পায়ন সম্পন্ন করতে পারেনি। মাত্র গুটি কতক ব্যতিক্রমী দেশ আছে কিন্তু তারা হচ্ছে প্রাকৃতিক সম্পদের আশীর্বাদধন্য অল্প কয়েকটি তেলসমৃদ্ধ দেশ। তাদের জন্য শিক্ষা ও আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োজন হয়নি। কিন্তু আমাদের মতো দেশে শিল্পায়নের পথে যে বহুমুখী বাধা রয়েছে তা দূর করার জন্য আসলে যে বহুমুখী উদ্যোগের প্রয়োজনীয়তার কথা ওপরের আলোচনায় তুলে ধরা হলো যাকে কেতাবি অর্থনীতিবিদেরা Big Push বলে অভিহিত করেছেন এবং চিরায়ত বিপ্লবীরা ‘বিপ্লব’ বলে অভিহিত করেছেন, জাতীয়তাবাদীরা যাকে ‘নবজাগৃতি’ বলে নামকরণ করেছেন এবং নাগরিক সমাজ যাকে সম্প্রতি ‘সুশাসন’ বলে চিহ্নিত করেছেন তার সূচনাবিন্দুটি কী হবে, সেটি আমাদের আজ প্রথমে খুঁজে বের করতে হবে। যদি আমরা ব্যাপকার্থে এবং সঠিক অর্থে এই সূচনাবিন্দুটিকে আজ চিহ্নিত করতে চাই তাহলে তাকে আমাদের নাম দিতে হবে ‘শিক্ষা’। উপযুক্ত ‘শিক্ষাই’ পারে নবচেতনার ভিত্তিতে একটি নবশক্তিকে তৈরি করতে, যারা হবে আমাদের ভবিষ্যত্ উন্নতির এজেন্ট। এই অর্থে শিক্ষাই আমাদের বর্তমান, শিক্ষাই আমাদের ভবিষ্যত্।

ধরুন আমাদের রাজনৈতিক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আছেন নেহেরু, মাহাথির, লেনিন বা মাওয়ের মতো সুশিক্ষিত নেতারা। বা ধরুন তাজউদ্দীনের মতো ধীশক্তিসম্পন্ন কোনো ব্যক্তি। বা ধরুন বঙ্গবন্ধুর মতো কোনো বিশাল হূদয়ের অধিকারী আবেগপ্রবণ ব্যক্তি, যাঁর জনগণের প্রতি অঙ্গীকারের পাশাপাশি রাষ্ট্রনীতি ও অর্থনীতি সম্পর্কে এক ধরনের Intuitive জ্ঞান আছে, আছে বিপুল বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং যিনি বাকি প্রয়োজনীয় টেকনিক্যাল জ্ঞানটুকু অন্য জ্ঞানী ব্যক্তিদের কাছ থেকে পরামর্শ হিসেবে গ্রহণ করার মতো বিনয়ের অধিকারী, তাহলে বাংলাদেশে কি আমরা একটি উত্পাদনশীল-সৃজনশীল শক্তিশালী রাজনৈতিক নেতৃত্বের সাক্ষাত্ পেতাম না? হয়তো পেতাম এবং সফল হতাম অথবা পেয়েও হয়তো সফল হতাম না (কারণ অন্য উপাদানগুলো থাকাটাও জরুরি)। উপযুক্ত রাজনৈতিক নেতৃত্বের পাশাপাশি অন্য উপাদানগুলো যথাযথ মাত্রায় না থাকলে আমাদের কী করুণ পরিণতির সম্মুখীন হতে হয় তার উদাহরণ তো আমাদের সামনেই আছে। ১৯৭৫-এর বিয়োগান্ত ঘটনাটি স্মরণ করুন। কীভাবে প্রগতির ধারাটি এত সহজে ১৮০ ডিগ্রি উল্টে গেল!

যদি সেই ‘উপযুক্ত রাজনৈতিক নেতৃত্ব’ খুঁজে পাওয়া যায়, তাহলে তাঁকেও খুবই সতর্কতার সঙ্গে এ দেশের ‘ধনাঢ্য বুর্জোয়া’ শ্রেণির মধ্যে উত্পাদনশীল বিনিয়োগের প্রবণতা সৃষ্টির ব্যবস্থাটি ধাপে ধাপে ক্রমশ নির্মাণ করতে হবে। কিন্তু সেটি করতে হলে শুধু বুর্জোয়াদের চাহিদাগুলো পূরণই যথেষ্ট নয়। পাশাপাশি তাঁদের কাউকে কাউকে কঠোর শাস্তি এবং বাকিদের মধ্যে একটি জাতীয়তাবাদী দেশপ্রেমিক সমাজমনস্ক মানসিক পরিবর্তনও সূচিত করতে হবে। যেমনটি আজকাল অমর্ত্য সেন, স্টিগলিত্জ থেকে শুরু করে সব সামাজিক গণতন্ত্রী তাত্ত্বিক বোঝানোর চেষ্টা করছেন এবং স্ক্যান্ডিনেভীয় দেশগুলোতে বা কল্যাণ পুঁজিবাদে যেটি অনেকখানি সফলতার সঙ্গে কার্যকরও হয়েছে। কিছুটা পরিমাণে সামাজিক ও আইনি বাধ্যতা ও কিছুটা সম্মতির ভিত্তিতে সেখানে গড়ে উঠেছে এক সুনিয়ন্ত্রিত পুঁজিপতি গোষ্ঠী, যারা নিজ প্রতিষ্ঠানের উদ্বৃত্ত মূল্যের বর্ধিত পুনরুত্পাদন অব্যাহত রাখার পাশাপাশি গড়ে প্রায় ৪০ শতাংশ উদ্বৃত্তমূল্য কর হিসেবে রাষ্ট্রের হাতে নিয়মিত তুলে দিচ্ছে। রাষ্ট্র আবার সেটি দিয়ে সব নাগরিকের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি সর্বজনভোগ্য দ্রব্য ও সেবা সরবরাহের নিশ্চয়তা প্রদান করছে। এ ধরনের একটা কিছু বাংলাদেশে কার্যকর করার জন্য দরকার হবে এ দেশের মধ্যবিত্ত ও বুর্জোয়াদের উত্পাদনশীল শাখাটির মধ্যে বিশাল এক মানসিক বিপ্লবের, একটি বাঙালি জাতীয়তাবাদী রেনেসাঁর, যাকে আমরা বর্তমানে নাম দিতে পারি আমাদের গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পুনরুজ্জীবন ও নবায়ন। এই চেতনার আলো শুধু ওই ‘ধনাঢ্য বুর্জোয়াদের’ অংশবিশেষকে স্পর্শ করলেই চলবে না, তাকে ছড়িয়ে পড়তে হবে পেটিবুর্জোয়া মধ্যবিত্তের মধ্যে, নিচের তলার দরিদ্র মানুষদের মধ্যে। ওপরের নেতৃত্বের সমানুপাতে শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে তাদের নিচে অবস্থিত অধস্তন শ্রেণিগুলোকেও। যাতে সর্বত্র প্রতিষ্ঠিত হয় এক আলোকিত স্বচ্ছতা ও পারস্পরিক জবাবদিহি।

সর্বশেষে আসুন আমাদের সামরিক-বেসামরিক নির্বাহী প্রশাসনের আমলাতান্ত্রিক ক্ষমতাকে সংশোধনের বিষয়টিতে। তাদের আত্মসেবার পরিবর্তে জনসেবায় নিয়োজিত করার জন্য কী করতে হবে এবং সেখানে শিক্ষার ভূমিকাটি কী হবে সেটিই আমাদের মূল প্রশ্ন। এখানেও ‘পূর্ব এশিয়ার’ আমলাদের উন্নয়ন অভিজ্ঞতা আমাদের শেখায় যে Meritocracy এবং Hard State ছাড়া রাষ্ট্রের আমলাতন্ত্রের সুষ্ঠু ভূমিকা নিশ্চিত করা যায় না। অর্থাত্ আমাদের আমলাদেরও হতে হবে নিজ নিজ ক্ষেত্রে জ্ঞানী, দক্ষ এবং আরও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তাদের নৈর্ব্যক্তিকভাবে দৃঢ়তার সঙ্গে গৃহীত আইন ও নীতিমালা কার্যকর করতে হবে। এই শেষের বিষয়টি আত্মীয়তাভিত্তিক বা ব্যক্তিগত সম্পর্কভিত্তিক ব্যবস্থার বদলে নীতি ও আইনভিত্তিক সমাজে উত্তরণের বিষয়। এ জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার অনিবার্য। তবে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার কার্যকর হয় না বা সীমিতভাবে ফলপ্রসূ হয় যদি আগের দুটি সংস্কার অর্থাত্ নেতৃত্ব ও চেতনার সংস্কার বাস্তবায়িত না হয়।

সুতরাং সামগ্রিকভাবে বলা যায় যে আমাদের অর্ধসমাপ্ত গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করার জন্য দেশের বিভিন্ন শ্রেণিকে নিজ নিজ ভূমিকা সম্পর্কে আত্মসচেতন ও সুশিক্ষিত করে না তুলতে পারলে আমরা সত্যিকার অর্থে মধ্য আয় এবং পরবর্তী সময়ে উন্নত আয়ের দেশে পরিণত হতে পারব না। আমি যে অর্থে এখানে চেতনা পরিবর্তনকে সংজ্ঞায়িত করেছি সে ধরনের চেতনা পরিবর্তনের জন্য বস্তুত দরকার হবে একটি ব্যাপক শিক্ষাবিপ্লবের। এটা না পারলে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা বিদ্যমান ছয় শতাংশ প্রবৃদ্ধির আশপাশেই মার্কটাইম করতে থাকবে, সামনে এগোতে পারবে না, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বনাম পশ্চাত্পদ মধ্যযুগীয় চেতনার দ্বন্দ্বেরও মীমাংসা হবে না, মধ্য আয়ের মাত্রাতেও আমরা যথাসময়ে পৌঁছাতে পারব না।

শিক্ষা বিনিয়োগের ম্যাজিক

আমরা যখন উন্নয়নের কথা বলি তখন প্রায়ই ভুলে যাই যে বস্তুগত উন্নয়নই একমাত্র উন্নয়ন নয়। বস্তুগত উন্নয়ন শেষ বিচারে মানবিক উন্নয়নে কতটুকু পরিণত হলো তা দিয়েই বস্তুগত উন্নয়নের সার্থকতা পরিমিত হয়। এ জন্যই বর্তমান বিশ্বে বিশ্বব্যাংকের নিম্ন আয়, মধ্যম আয়, উন্নত আয় ইত্যাদি অভিধার পাশাপাশি প্রতিযোগী আরেকটি ‘র্যাঙ্কিং’ ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে, যার ভিত্তি মানব উন্নয়ন সূচক। এই সূচকের একটি অপরিহার্য উপাদান হচ্ছে ‘শিক্ষা’। এ কথা সত্য যে বাংলাদেশ সম্প্রতি তার আপেক্ষিক নিম্ন মাথাপিছু আয় সত্ত্বেও কতিপয় মানব উন্নয়ন সূচকের ক্ষেত্রে বিস্ময়কর অগ্রগতি অর্জন করেছে। এগুলো হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা, নারী শিক্ষা, মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাস, শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস ইত্যাদি। এসব বাড়তি সাফল্যের ব্যাখ্যা কী?

অধ্যাপক ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদের মতে, বাংলাদেশের একটি বাড়তি সুবিধা হচ্ছে এর জনসংখ্যার ঘনত্ব। এখানে অল্প জায়গায় অনেক লোক জড়াজড়ি করে বাস করে। তার ফলে এখানে যেকোনো কথা, যেকোনো জ্ঞান দ্রুত বিদ্যুতের বেগে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এখানে প্রায় ১১ কোটি মোবাইল এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে বহু কম্পিউটার সেন্টার তৈরি হয়েছে। ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন কীভাবে বাংলাদেশে আইসিডিডিআর কর্তৃক আবিষ্কৃত ‘ওরাল স্যালাইন’ জ্ঞানটি এ দেশে শিশুমৃত্যুর হার অতি দ্রুত কমিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল! তাই বলা হয়ে থাকে যে বাংলাদেশের সামাজিক খাতে আপেক্ষিকভাবে অধিকতর অগ্রগতি অর্জন করার পেছনে বাংলাদেশের বিস্তৃত সামাজিক নেটওয়ার্ক বা ‘সামাজিক পুঁজির’ একটি বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।

এই বিস্তৃত সামাজিক নেটওয়ার্কে যদি আপনি বিভিন্ন ধরনের প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও মহত্ চিন্তার বীজ বপন করতে শুরু করেন তাহলে কল্পনা করুন তা কত দ্রুত এ দেশে নতুন নতুন সৃজনের অঙ্কুর সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে। স্বতঃস্ফূর্তভাবে এখনই জ্ঞান বিচ্ছুরণের যে প্রক্রিয়া চালু রয়েছে, যে প্রাণশক্তির বলে বাংলাদেশের কৃষিতে, পোশাকশিল্পে, নানা ধরনের বিচিত্র ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের মধ্যে এবং প্রবাসী শ্রমিকের শ্রমের মধ্যে উত্পাদন ও সৃজনের বিশাল একটি সক্রিয় প্রবাহ সৃষ্টি হয়েছে তা আরও কয়েক গুণ বৃদ্ধি পাবে, যদি রাষ্ট্র এই সমস্ত ক্ষেত্রে পরিকল্পিতভাবে আরও বেশি শিক্ষা ও সম্পদের প্রবাহ বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়। স্বতঃস্ফূর্ততা ও পরিকল্পনা পরস্পর পরিপূরক হলে কি অসাধ্য যে সাধন করা যায় তার উজ্জ্বল উদাহরণ হচ্ছে চীনের তথাকথিত ‘বাজার সমাজতন্ত্রের নীতি’। এর ফলে চীনে অবশ্য বৈষম্যের (আঞ্চলিক ও শ্রেণিগত) তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের দেশে এ ক্ষেত্রে সে জন্য একটু ভারসাম্যপূর্ণ এবং আঞ্চলিকভাবে অধিকতর সুষম নীতি গ্রহণ করতে হবে ।

আমরা জানি বিশেষ করে ‘শিক্ষা’ হচ্ছে এমন একটি সম্পদ যার মালিকানা, মালিকের শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। শিক্ষা এমন একটি সম্পদ যা ব্যবহার করলে তার দক্ষতা ও দীপ্তি আরও বৃদ্ধি পায়। জ্ঞান বা শিক্ষা অর্জনের খরচ ক্রমশ কমছে। ইন্টারনেটের কল্যাণে শিক্ষা এখন নখাগ্রে এসে উপস্থিত হয়েছে। অন্য সব সম্পদের উত্পাদনশীলতা তাদের ক্রমপুঞ্জীভবনের সঙ্গে সঙ্গে হ্রাস পায়। অথচ শিক্ষা যত ব্যবহার করা হবে তত তার দক্ষতা ও উত্পাদনশীলতা বৃদ্ধি পাবে। তাই অন্যান্য সম্পদের তুলনায় শিক্ষার নিম্নমুখী, মধ্যমুখী সম্প্রসারণ আমাদের জন্য বৈষম্য কমানোর বিষয়েও সহায়ক হতে পারে। যেহেতু দরিদ্রের জ্ঞানসম্পদকে ধনী ব্যবহার করতে পারে কিন্তু দখল বা লুট করে নিতে পারে না। বিশেষত ইস্ট এশিয়ার মডেলে শিক্ষা ও সম্পদপ্রবাহকে বাজার ও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের যুগপত্ ব্যবহারে দরিদ্র ও ধনী উত্পাদনশীল খাত অভিমুখে এমনভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হয়েছিল যে সেখানে একই সঙ্গে সমতা ও প্রবৃদ্ধি দুই-ই অর্জন করা সম্ভব হয়েছিল। তবে ‘শিক্ষার’ বৈষম্যহীন বিকাশকে থামানোর জন্য আমাদের দেশে শিক্ষাকে শাসককুল প্রথমে সুযোগে পরিণত করে ফেলেছে। তারপর আর্থিক বাধ্যবাধকতার দরুন বেশির ভাগ জনগণের জন্য নির্ধারিত করা হয়েছে এক বিশেষ ধরনের নিম্নমানের শিক্ষা বা/এবং ধর্মীয় শিক্ষা। শিক্ষার মধ্যে এই বিভাজন, সমাজের মধ্যেও বিভাজন, বৈষম্যকে ত্বরান্বিত করছে।

কিন্তু এরপরও সারা পৃথিবীতে আজ স্বীকৃত হয়েছে যে প্রত্যেক শিশুকে উন্নতমানের একটি ন্যূনতম সাধারণ শিক্ষা দিতে হবে, যাতে সে পড়তে পারে, নিজের ভাষায় লিখতে পারে এবং সব রকম সংখ্যাতাত্ত্বিক হিসাব—যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ সঠিকভাবে করতে ও বুঝতে পারে। যদি এটুকু ঠিকভাবে করা যায়, বাকিটুকু সে নিজেই করে নিতে পারবে। সর্বপ্রথম এ সুযোগটি ভবিষ্যত্ ও বর্তমান প্রজন্মের সবার জন্য রাষ্ট্রকেই নিশ্চিত করতে হবে। আর আর্থসামাজিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার চাহিদারও উন্নতি হবে এবং ধাপে ধাপে আমাদেরও মানসম্পন্ন প্রাথমিক শিক্ষা, মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা এবং স্নাতক ডিগ্রিকে সর্বজনীন অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। সে জন্য যদি রাষ্ট্র তার বাজেট থেকে যথাযথ তহবিল নিয়ে এগিয়ে আসে তাহলে বাংলাদেশেও আমরা শিক্ষার একটি বহুমুখী ম্যাজিক ফলাফল দেখতে পাব। এখন যে জিডিপির ২ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় হচ্ছে, তাকে ৮ শতাংশে উন্নীত করার কথা বর্তমান সরকারের শিক্ষা কমিশন রিপোর্টেই আছে। প্রতিবছর জিডিপির ১ শতাংশ করে রাষ্ট্রীয় শিক্ষা বিনিয়োগ বৃদ্ধি করার একটি প্রতিশ্রুতিও এখন ঘোষিত আছে। কিন্তু কবে থেকে তা সত্যে পরিণত হতে শুরু করবে, তা আমরা জানি না! কিন্তু এ কথা আমরা নিশ্চিতভাবে জানি শিক্ষা বিনিয়োগ বৃদ্ধিই হচ্ছে আমাদের সেই জাদুর কাঠি, যা আমাদের সমাজের মনোজগতের আঁধার দূর করে বস্তুজগতের আঁধারও ত্বরান্বিত হারে দূর করার শুভসূচনা ঘটাতে সক্ষম হবে।

এখনো যাদের এ বিষয়ে সন্দেহ রয়ে গেছে তাদের বলব ‘ইস্ট এশিয়ার’ উন্নয়ন মডেলের দিকে তাকাতে। বেশ আগে ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বনামধন্য গভর্নর ড. আতিউর রহমান সিঙ্গাপুরে ভিজিটিং ফেলো হিসেবে কাজ করার সময় একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন যার শিরোনাম ছিল, Education For Development: Lessons from East Asia for Bangladesh. ওই প্রবন্ধে ব্যবহূত একটি তালিকাকে কিছুটা পরিবর্তিত করে আমি পরিশিষ্ট দুইয়ে তুলে ধরেছি। যেকোনো পাঠক সেখানে দৃষ্টিপাত করলেই বুঝতে পারবেন যে ১৯৯৮ সালের Snapshot তথ্যানুসারে দেখা যাচ্ছে যে শিক্ষা সূচকের দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ার চারটি দেশের (নেপাল, বাংলাদেশ, ভুটান ও ভারত) তুলনায় পূর্ব এশিয়ার চারটি দেশ সেই বছরে গড়ে প্রায় দ্বিগুণ (১০৪ শতাংশ) বেশি এগিয়ে ছিল। একইভাবে তাদের শিক্ষা খাতে ব্যয়ের হার দক্ষিণ এশিয়ার তুলনায় গড়ে জিডিপির দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ অর্থাত্ প্রায় ১ শতাংশ বেশি ছিল। এই দুই অগ্রসর চলকের প্রভাবে পূর্ব এশিয়ার মানুষের গড় আয়ু দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের গড় আয়ুর তুলনায় তখনই ২৯ শতাংশ বেশি ছিল। এ ছাড়া গড়ে তাদের ক্যালরি গ্রহণমাত্রাও ছিল ২৬ শতাংশ বেশি। এতসব ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা সামনে থাকার পরও কি আমরা শিক্ষা সূচকের উন্নয়নের জন্য শিক্ষা বিনিয়োগ বৃদ্ধির অপরিহার্যতা অনুধাবন করব না?

পরিশিষ্ট-১

দৃঢ় এবং কোমল রাষ্ট্রের ওপর করা প্রামাণিক জরিপ (দক্ষিণ কোরিয়া)

প্রশ্ন: যখন বর্তমান সরকার (পার্ক) কোন সিদ্ধান্ত নেয়, যা ব্যবসাকে প্রভাবিত করে; তা মেনে চলা কতটা গুরুত্বপূর্ণ? রি সরকারের ক্ষেত্রে কি বলবেন?

উত্তরের ধরন    পার্ক সরকার     রি সরকার

সব সময়ই বাস্তবায়িত হয়, মেনে না চলা অসম্ভব            ৭৮.২    ৩.২

প্রায় সব সময়ই বাস্তবায়িত হয়, মাঝে মাঝে      ১৬.৬   ১৭.২

না মানলেও হয়

পরিবর্তিত আকারে বাস্তবায়িত হয়        ১.৭       ৫০.৫

খুব কম সময়ই পুরোদস্তুর বাস্তবায়িত হয়          ৩.৫      ২৯.৫

মোট     ১০০     ১০০

উত্স: Jones and Sokong, Govt., Business and Entrepreneurs in Economic Development: The Korean Case, Harvard University Press, Cambridge, 1980.

পরিশিষ্ট-২

১৯৯৫ সালে শিক্ষা সূচক, শিক্ষা ব্যয়ের হার এবং বিভিন্ন সামাজিক সূচক। দক্ষিণ এশিয়া ও পূর্ব এশিয়ার নির্বাচিত কতিপয় দেশের তুলনা।

দেশের নাম       শিক্ষা    শিক্ষা ব্যয়         আয়ু      মাথাপিছু ক্যালরি

            সূচক    (জিডিপির        আশা    গ্রহণমাত্রা

                        শতাংশ)

নেপাল .৩৭      ২.৯       ৫৫.৯    ২৩৬৭ 

বাংলাদেশ         .৩৮     ২.৩      ৫৬.৯   ২০০১ 

ভুটান   .৩৯      -           ৫২.০     - 

ভারত .৫৩      ৩.৫      ৬১.৬   ২৩৮২ 

গড়       .৪১       ২.৯       ৫৬.৬   ২২৫০

দক্ষিণ এশিয়া

চীন      .৭৬      ২.৩      ৬৯.২    ২৭০৮

শ্রীলঙ্কা .৮৩     ৩.১      ৭২.৫     ২৩০২

হংকং    .৮৪      ২.৮      ৭৯       ৩১৮৭

দক্ষিণ এশিয়া    .৯৩      ৩.৭      ৭১.৭    ৩১৫৯ 

গড়       .৮৪      ২.৯৭    ৭৩.১    ২৮৩৯

পূর্ব এশিয়া        (১০৪ শতাংশ    (.০৭ শতাংশ      (২৯%  (২৬%  

            বেশি)   বেশি)   বেশি)   বেশি)

উত্স: আতিউর রহমান (১৯৯৯)

তথ্যপুঞ্জি

১.         রুশিদান ইসলাম (২০১২), বাংলাদেশের অর্থনীতি ও উন্নয়ন স্বাধীনতার পর ৪০ বত্সর, সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা।

২.         সম্পাদনায় রুশিদান ইসলাম রহ্মান (২০০৭), আগামী  পাঁচ বছরে বাংলাদেশ: শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য এবং সবার জন্য মানসম্মত শিক্ষা, বিআইডিএস (বিশেষ প্রকাশনা-৯), আগারগাঁও, ঢাকা।

৩.        জোসেফ ই. স্টিগলিত্জ (১৯৯৬), সাম লেসনস ফ্রম দ্য ইস্ট এশিয়ন মিরাকল, দ্য ওয়ার্ল্ড ব্যাংক রিসার্চ অবজারভার, ভল্যুম-১১, নম্বর-২, (আগস্ট, ১৯৬৬), পৃ. ১৫১-১৭৭।

৪.         সমীর রঞ্জন নাথ (২০০৯), শিক্ষা-আশা-বাস্তবতা-নবআশা, একাডেমিক প্রেস, ঢাকা।

৫.         World Bank (2012), (East Asia and Pacific Regional Report), Putting Higher Education for Work: Skills and Research for Growth in East Asia, Washington, 2012.

৬.        Wahid Uddin Mahmud (2013), ‘Bangladesh’s Development Surprise: Will it Endure?’ A paper presented in the International Conference titled Development Ideas-Linking Research and Policies, organized by International Growth Center, held in Dhaka, December 27, 2013.

৭.         আতিউর রহমান (১৯৯৯), ‘এডুকেশন ফর ডেভেলপমেন্ট লেসনস ফ্রম ইস্ট এশিয়া ফর বাংলাদেশ, ইনস্টিটিউট অব সাউথইস্ট এশিয়ান স্টাডিজ, সিঙ্গাপুর।