দুর্নীতি, দুর্নীতির নিয়ন্ত্রণ এবং পরিবর্তনের চালকেরা: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

সারসংক্ষেপ

বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর রাষ্ট্রীয় খাতে দুর্নীতি একটি বহুল আলোচিত বিষয়। এই দুর্নীতির উত্সমুখগুলো চিহ্নিত করার তাগিদ থেকেই প্রতিনিয়ত দুর্নীতি নিরূপণ এবং নিবারণের কৌশল খুঁজতে নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। সেই প্রচেষ্টারই ধারাবাহিকতায় এই গবেষণাভিত্তিক প্রবন্ধটি প্রাথমিকভাবে নীতিপত্র হিসেবে জাতীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএস কর্তৃক ইংরেজিতে ছাপা হয়েছিল, যার অনুবাদ ছাপা হলো। এই প্রবন্ধে প্রবৃদ্ধি ও দুর্নীতির সামষ্টিক সম্পর্কের আর্থগাণিতিক বর্ণনার পরিবর্তে বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতি এবং সুনির্দিষ্ট খাতের পারফরম্যান্সের ওপর এসব দুর্নীতির প্রভাব বিশ্লেষণের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এটিকে দুর্নীতির প্রভাব বিশ্লেষণের এবং দুর্নীতিবিরোধী পদক্ষেপ গ্রহণের ফলপ্রসূ উপায় হিসেবে দেখা হয়েছে। সে জন্য দুর্নীতির ধারণা সূচকের মতো সমন্বিত দুর্নীতি নিরূপণ সূচকের পাশাপাশি প্রয়োজন পড়েছে অর্থনীতির সুনির্দিষ্ট খাতে দুর্নীতির ব্যাপকতা বোঝার জন্য সম্পূরক বিশ্লেষণের। এটি করা হয়েছে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মতামতভিত্তিক জরিপের ভিত্তিতে। দুর্নীতির সামগ্রিক বিষয়গুলো বোঝার জন্য প্রবৃদ্ধি ও দুর্নীতির সম্পর্ক, ঘুষের লেনদেন, উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতি, নির্বাচনে দুর্নীতি, সেবা খাতে দুর্নীতি এবং তৃণমূলে মধ্যবিত্ত শ্রেণির দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের মতো বিষয়গুলোর ওপর বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া হয়েছে। 

মুখ্য শব্দগুচ্ছ

দুর্নীতি, সেবা খাত, ঘুষ, দুর্নীতির সূচক, বাংলাদেশ, স্বচ্ছতা, নির্বাচন, মধ্যবিত্ত শ্রেণি, দুদক।

ভূমিকা: দুর্নীতি, প্রবৃদ্ধি এবং ন্যায্যতা

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রবৃদ্ধি এবং দারিদ্র্যের ওপর সরকারি অফিস ব্যবহার ও ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হওয়ার মাধ্যমে সৃষ্ট দুর্নীতির প্রভাব সম্পর্কে বেশ আলোচনা চলছে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন সংখ্যাবাচক সূচক ব্যবহারের মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে দুর্নীতির প্রভাব বিশ্লেষণে কিছু গবেষণা পরিচালিত হয়েছে। প্রবৃদ্ধির ওপর দুর্নীতির প্রভাব পরিমাপে পরিচালিত ১০০টি আর্থগাণিতিক গবেষণা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে: প্রথমত: সেগুলোর ৬২ শতাংশই পরিসংখ্যানগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ নয়; দ্বিতীয়ত: ৩২ শতাংশ গুরুত্বপূর্ণ ও নেতিবাচক এবং ৩.৬ শতাংশ গুরুত্বপূর্ণ ও ইতিবাচক।১ এসব গবেষণায় ঘুষ কিংবা তহবিল তছরুপের মতো দুর্নীতির ব্যক্তিগত উপাদানগুলো বারবার ব্যবহূত হলেও স্বজনপ্রীতি, পক্ষপাতিত্ব এবং ব্যক্তিগত স্বার্থে রাষ্ট্রীয় সম্পদ দখলের মতো বিষয়গুলো সংখ্যাবাচক সূচকের অভাবে প্রায় বাদ পড়ে গেছে। কিছু গবেষণা দেখিয়েছে, দুর্নীতি ও প্রবৃদ্ধি নেতিবাচকভাবে সংযুক্ত। তবে এ দুটি বিষয়ের মাঝে যে সম্পর্ক সেটি কিন্তু অবধারিতভাবে বোঝাচ্ছে না একটির কারণে অপরটি ঘটছে। অধিকন্তু কোনটির কারণে কোনটি ঘটছে তা-ও নিশ্চিত না। উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দুর্নীতির মাত্রা কমাতে পারে। মানুষের আয়ের প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে, জনগণের দিক থেকে দুর্নীতি দমনের জোর দাবি ছিল এবং একই সঙ্গে সরকারের কাছে যথেষ্ট সম্পদ ছিল দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং দুর্নীতি দমনের বিভিন্ন পদক্ষেপ প্রয়োগে নানা উদ্যোগ নেওয়ার। ব্যাপক দুর্নীতি সত্ত্বেও দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে, এমন দেশের উদাহরণ ইতিহাসে রয়েছে। সঞ্চয় ও বিনিয়োগের উঁচু হারের সঙ্গে মিলে উন্নয়নধর্মী সামষ্টিক ও খাতওয়ারি নীতিমালা উঁচু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রেখেছে।২ প্রবৃদ্ধির ওপর দুর্নীতির নেতিবাচক প্রভাব যা-ই হোক না কেন, সাধারণভাবে তা মানুষের মাঝে দেখার মতো সে রকম কোনো উদ্বেগ তৈরি করেনি। এসব ক্ষেত্রে দুর্নীতির নেতিবাচক প্রভাব অনেকটাই প্রশমিত হয়েছে বিনিয়োগের উঁচু হার এবং প্রবৃদ্ধিবান্ধব নীতিমালার মাধ্যমে। কিন্তু প্রতিষ্ঠিত তথ্যের বিরুদ্ধে তোলা এসব ‘দাবি’ পরীক্ষা করা সম্ভব হয়নি।

প্রবৃদ্ধি ও দুর্নীতির সামষ্টিক সম্পর্কের আর্থগাণিতিক গবেষণার পরিবর্তে অব্যাহতভাবে বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতি এবং সুনির্দিষ্ট খাতের পারফরম্যান্সের ওপর এসব দুর্নীতির প্রভাব বোঝার জন্য বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়েছে। এটিকে দুর্নীতির প্রভাব বিশ্লেষণের এবং দুর্নীতিবিরোধী পদক্ষেপ গ্রহণে ফলপ্রসূ পদ্ধতি হিসেবে দেখা হয়েছে। সে জন্য দুর্নীতির ধারণা সূচকের মতো সমন্বিত দুর্নীতি সূচকের পাশাপাশি দরকার পড়েছে অর্থনীতির কোনো সুনির্দিষ্ট খাতে দুর্নীতির ব্যাপকতা বোঝার জন্য সম্পূরক বিশ্লেষণের, যেটি করা হয়েছে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মতামতের জরিপের ভিত্তিতে। দুর্নীতির ঘটনা (মাঝেমধ্যে বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতি বিভাজন) ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মতামত জরিপের মাধ্যমে নির্ণয় করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ সেবা খাতের দুর্নীতির ব্যাপকতা বিশ্লেষণের জন্য সংশ্লিষ্ট খাতের সেবা গ্রহণকারীর মতামতের ভিত্তিতে জরিপ করা হয়েছে। উত্পাদন খাতের ক্ষেত্রে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের মতামতের ভিত্তিতে জরিপ করা হয়েছে। এ খাতের ক্ষেত্রে যেসব আইনবিধি সরকারি কর্মকর্তাদের ক্ষমতার অপব্যবহারে উত্সাহিত করে এবং যেসব বিধি বেসরকারি বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করে, তা চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হয়েছে।

একটু ভেঙে বললে বলা যায়, খাতওয়ারি দুর্নীতির একটি নমুনা হলো কর ফাঁকি, যা সরকারের সম্পদ কমায়। হারানো কর-আয় হয়তো কোনো উত্পাদনশীল প্রকল্পে বিনিয়োগ হচ্ছে। তবে, কর ফাঁকি প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত করে। কেননা অপর্যাপ্ত করের কারণে সরকার জনকল্যাণে সরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে পারে না, যা কখনোই বেসরকারি খাত করে না। অধিকন্তু অবকাঠামো খাতে অপর্যাপ্ত সরকারি বিনিয়োগ উত্পাদনশীল খাতে বেসরকারি বিনিয়োগ নিরুত্সাহিত করে।

একইভাবে প্রবৃদ্ধির ওপর ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তারকারী দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট কর্মকাণ্ডগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো খনিজ সম্পদ যেমন: তেল, গ্যাস ও কয়লা উত্তোলনের ও বণ্টনের নীতিমালা নিয়ে দুর্নীতি। প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলন ও বণ্টনের এই অনুমতি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ একচেটিয়া রেন্ট এবং মাত্রাতিরিক্ত মুনাফা সৃষ্টি করতে পারে। দুর্নীতির কারণে সংশ্লিষ্ট ওই খাতের ওই একচেটিয়া রেন্ট বিনিয়োগের জন্য সরকারি খাতের সম্পদকে বঞ্চিত করে অনুমতি প্রদানকারী এবং অনুমতি গ্রহণকারীর মধ্যে বণ্টিত হয়। সরকারি ভূমির কেনাবেচার ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তারা যেসব নীতি তৈরি করেন, সেখানেও এ ধরনের ঘটনা ঘটে। কোনো ভূমি কেনা বা বেচার ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য প্রযোজ্য বিধিতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ দুর্নীতির সুযোগ রয়েছে। বর্ধিত জনসংখ্যার উন্নয়নশীল দেশে ভূমির মতো স্থিত সম্পদের বেশ চাহিদা থাকার কারণে ভূমির দাম বেশ চড়া এবং এ কারণে ভূমি কেনাবেচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার সুযোগ রয়েছে। এর ফলে এখানে ব্যক্তিগত লাভের জন্য সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহারের সম্ভাবনা রয়েছে এবং একই সঙ্গে বিকল্প ব্যবহারের পরিবর্তে সম্পদের ভুল বণ্টন হতে পারে। ভূমি অধিকার, মালিকের নিরাপত্তা, ভূমি অধিগ্রহণ এবং এর ক্ষতিপূরণের সঙ্গে যে অনিশ্চয়তা জড়িত তা শিল্প, ব্যবসা এবং অবকাঠামোর বিনিয়োগে প্রতিকূল প্রভাব ফেলে।

সরকারি ক্রয়ে দুর্নীতির কারণে অবকাঠামো এবং সেবায় নিম্ন মান লক্ষ করা যায়। এটা সরকারি ব্যয়ের ক্ষেত্রে জনকল্যাণ নিশ্চিত না করে ঘুষের সুযোগ সৃষ্টি করে। বৃহত্ প্রকল্প যেখানে সঠিক নজরদারি কঠিন, সেখানে দুর্নীতির সুযোগ তৈরি হয়। টেক্সট বই প্রকাশনা বা শিক্ষকদের বেতনের মতো ছোট সরকারি প্রকল্পের চেয়ে প্রযুক্তি প্রতিরক্ষা পদ্ধতি বা অবকাঠামোগত প্রকল্পের মতো বড় প্রকল্পে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ঘুষ গ্রহণ তুলনামূলকভাবে সহজ। এভাবে বড় বড় প্রকল্পে বড় ধরনের বা ‘পাইকারি’ দুর্নীতি হয়, আর ছোট প্রকল্প যার বিনিয়োগ অনেক খাতে ছড়ানো থাকে, সেখানে হয় ছোট ছোট ‘খুচরো’ দুর্নীতি। ব্যবসা এবং বেসরকারি খাতের আচরণ নির্ণয়কারী অনুপুঙ্খ জরিপ নিশ্চিত করে, পুরো ব্যাপারটায় জড়িত গোপনীয়তা এবং ঘুষ গ্রহণকারী তার কথা রাখবে তা নিয়ে যে অনিশ্চয়তা রয়েছে সেটিকে বিবেচনায় নিয়ে বলা যায়, দুর্নীতি ব্যবসার ওপর একধরনের করের মতো, যা প্রকারান্তরে বিনিয়োগের প্রণোদনা কমায়। ঘুষ প্রদানকারীর অর্থাত্ ঘুষ যিনি প্রদান করছেন তাঁর তরফ থেকে চুক্তি বা সরকারি ক্রয়ের ক্ষেত্রে কয়েক ধরনের অনিশ্চয়তা রয়েছে। একটি অনিশ্চয়তা হলো, কাকে ঘুষ দিতে হবে অর্থাত্ সরকারের কোন যথাযথ ব্যক্তিকে ঘুষ দিতে হবে। দ্বিতীয় অনিশ্চয়তা হলো, একটি চুক্তি বা অনুমোদন পেতে কী পরিমাণ ঘুষ দিতে হবে। যদি ঘুষ প্রদানকারী যথাযথ ব্যক্তিকে চিহ্নিত করতে না পারে কিংবা ঘুষের টাকার সঠিক অঙ্ক না জানে, তখন ঠিকাদারি চুক্তি সম্পন্ন করতে তাঁকে বেশ কয়েকজন ব্যক্তিকে বিভিন্ন পরিমাণ অর্থ দিতে হয়। এটা কোনো একটি চুক্তি বা অনুমোদনের প্রদত্ত মূল্যের জন্য দুর্নীতির খরচ বাড়ায়। এর ফলে দুর্নীতির খরচ তুলতে গিয়ে প্রকৃত প্রকল্প ব্যয় বাড়ে যদি প্রকল্পের গুণগত মান ঠিক রাখতে হয় অথবা প্রকল্পের গুণগত মানে ঘটে বড় ধরনের পরিবর্তন, যদি প্রকল্পটিকে নির্ধারিত ব্যয়ের মধ্যে সম্পন্ন করতে হয়। সুতরাং অন্যান্য ক্ষেত্রের তুলনায় এসব ক্ষেত্রে সরকারি বিনিয়োগের প্রতিযোগিতামূলক চাহিদা থেকে সরকারি সম্পদ ভিন্ন খাতে যাওয়ার সুযোগ বেশি। অধিকন্তু ঘুষগ্রহীতার দিক থেকে ঘুষ প্রদানকারী চুক্তি মোতাবেক প্রকল্প বাস্তবায়ন করবেন কি না এ ধরনের অনিশ্চয়তা থাকে। এই তিন ধরনের অনিশ্চয়তা কেন্দ্রায়িত স্বেচ্ছাচারী ব্যবস্থায় তুলনামূলকভাবে কম, এই ব্যবস্থা কোন ব্যক্তিকে কী পরিমাণ ঘুষ দিতে হয় সে-সংক্রান্ত দুর্নীতির চ্যানেল নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ করে। ঘুষ গ্রহণকারী এবং প্রকৃত সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী সঠিকভাবে চিহ্নিত হওয়ার ফলে টাকা প্রদানের মাধ্যমে চুক্তি নিশ্চিতভাবেই সম্পন্ন হয়। একই সঙ্গে এ রকম ব্যবস্থায় ঘুষ প্রদানকারী যদি প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যর্থ হন, তবে তাঁকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে শাস্তি প্রদান করা হয়। উঁচু প্রবৃদ্ধির দুর্নীতিগ্রস্ত দেশে, দক্ষিণ কোরিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ায়, এ ধরনের উদাহরণ রয়েছে। এসব দেশে বড় আকারের সরকারি ক্রয় বা প্রকল্পের ভাগ্য সরকার/রাষ্ট্রপ্রধানের হাতেই থাকে। তাদের পক্ষে কাজ করার জন্য রয়েছে সুপরিচিত এজেন্ট। দক্ষিণ কোরিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় ঘুষ সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে দেওয়া হতো এবং চুক্তি সরকারের একবারে উপরের মহলে সম্পাদন করা হতো, তাই প্রকল্প বাস্তবায়নে বেসরকারি ঠিকাদার বা ঘুষ প্রদানকারীর কোনো ধরনের শৈথিল্য বা বরখেলাপের ফলে তাকে ভোগ করতে হতো মারাত্মক পরিণতি: তাকে দেউলিয়া ঘোষণা থেকে কারান্তরীণ করা হতো। গণতন্ত্র এমনকি অর্ধগণতন্ত্রেও সিদ্ধান্ত গ্রহণ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের হাতে থাকে। একই সঙ্গে প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের আলাদা আলাদা কাজ থাকে। মন্ত্রীদের সমাজের বিভিন্ন অংশকে সন্তুষ্ট করতে হয়; সমাজের এই বিভিন্ন অংশ জাতিসত্তা, বর্ণ, ধর্ম, ভাষা এবং আঞ্চলিক আনুগত্যের ভিত্তিতে প্যাট্রন-ক্লায়েন্ট সম্পর্ক দ্বারা সংজ্ঞায়িত হয়। ফলে বহু প্রধান সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী থাকে এবং প্রতি প্রধান সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীর আবার বহুসংখ্যক এজেন্ট থাকে।৩ এ কারণে ঘুষ প্রদানকারীর দিক থেকে কাকে কী পরিমাণ ঘুষ দিতে হবে এবং ঘুষ গ্রহণকারী কথা অনুযায়ী কতটুকু কাজ করতে পারবেন, সে সংক্রান্ত অনিশ্চয়তা থাকে। আর এ কারণে ঘুষ প্রদানকারী বহু এজেন্টকে বিভিন্ন পরিমাণ ঘুষ প্রদান করে থাকেন। সম্ভবত বড় বিনিয়োগ প্রজেক্ট/চুক্তির ক্ষেত্রে এসব দেশে সরকারপ্রধানের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা থাকে; কিন্তু তা নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সহযোগিতার ভিত্তিতে। এমনকি তারপরও সেখানে একটি চরম অনিশ্চয়তা থাকে যে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা শেষ পর্যন্ত চুক্তিটি সম্পন্ন করতে পারবেন কি না।৪ তবে বিভিন্ন গণতান্ত্রিক সমাজের মধ্যে ক. প্রজেক্টের সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং খ. ঘুষ গ্রহণ করার ব্যাপারে কর্তৃত্বের মাত্রার তফাত আছে। কর্তৃত্ব যত বেশি বিকেন্দ্রায়িত থাকে, ঘুষ প্রদানকারীকে তত বেশি অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হতে হয় আর বেশি পরিমাণে দুর্নীতির ব্যয় বহন করতে হয়।

এসব ক্ষেত্রে দুর্নীতির ব্যয় কমাতে অতিরিক্ত শর্ত হলো উন্নয়ন প্রকল্প যেসব চুক্তির সুনির্দিষ্ট শর্ত মেনে দক্ষতার সঙ্গে বাস্তবায়িত হয়। এটি বিকেন্দ্রিক গণতন্ত্র বা আধা গণতান্ত্রিক দেশ, যেখানে ঘন ঘন নির্বাচন হয়, সেখানে নাও ঘটতে পারে; ফলে এসব দেশে উত্তরসূরি সরকার অনেক সময় ওই অদক্ষভাবে সম্পাদিত প্রকল্পের ফল ভোগ করে। আর এ ব্যাপারটিকে তুলনা করা হয়েছে ভবঘুরে ঠগের স্বল্পস্থায়ী দস্যুতার সঙ্গে পাড়ার মাস্তানের দীর্ঘস্থায়ী গুন্ডামির সঙ্গে।

এ প্রসঙ্গে প্রজেক্ট পর্যায়ে দুর্নীতির ক্ষুদ্র প্রভাব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করাটা বেশ কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার হতে পারে। আগেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে, দুর্নীতির ব্যয় উঠিয়ে আনার জন্য ঘুষ প্রদানকারীকে প্রকল্প ব্যয়ের সঙ্গে ঘুষের অর্থ যোগ করতে হয়। একটি অবস্থায় দেখা যায়, চুক্তির শর্তানুযায়ী প্রজেক্ট বাস্তবায়িত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সম্পদের হস্তান্তর সরকারি বাজেট থেকে ঘুষ গ্রহণকারী যিনি প্রকল্পের দায়িত্বে আছেন, হয়তোবা নির্বাচিত, তাঁর কাছে। ঘুষের মাধ্যমে এভাবে পাওয়া সম্পদ তিনি রিয়েল এস্টেট অথবা অন্য কোনো উত্পাদনমুখী উদ্যোগে বিনিয়োগ কিংবা সরকারি/বেসরকারি সিকিউরিটিজ/বন্ডে খাটান। অন্য কথায়, যে সম্পদ সরকারি বিনিয়োগ প্রকল্পে ব্যবহূত হতে পারত তা বেসরকারি বিনিয়োগে ব্যবহূত হচ্ছে। যদি এই বেসরকারি বিনিয়োগের প্রতিদান বেসরকারি বিনিয়োগের চেয়ে কম না হয় তবে মোট সম্পদ ব্যবহারের দক্ষতায় কোনো ক্ষতি নেই, সেই সঙ্গে মোট জাতীয় আয়েও কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। তবে অনেক সময় দেখা যায় ঘুষ গ্রহণকারী তাঁর ব্যক্তিগত ভোগ ব্যয় বাড়িয়ে দেন।৫ এখন সরকারি সম্পদ বেসরকারি খাতে সরিয়ে নেওয়ায় সরকারি বিনিয়োগ কমে যাওয়ার কারণে এবং সেই সঙ্গে তুলনামূলকভাবে বেসরকারি বিনিয়োগ না বাড়ার কারণে যদি মোট বিনিয়োগ কমে যায় (মানব উন্নয়ন খাতে বিনিয়োগ বাদে) আর দুর্নীতি বেড়ে যায়, তবে তা প্রবৃদ্ধির ওপর নেতিবাচক প্রভাব রাখে।

তবে, এসব ক্ষেত্রেই এটি দেখা যায় যে উন্নয়নের ওপর দুর্নীতির প্রভাবের কোনো অনুমিত উপসংহার নেই। এটি পুরোপুরি নির্ভর করছে ঘুষ গ্রহণকারী কীভাবে আত্মসাত্কৃত সম্পদ ব্যবহার করছেন সেসব পারিপার্শ্বিক অবস্থার ওপর। তবে দুর্নীতির ব্যাপকতার কিছু স্পষ্ট ক্ষতিকর দিক রয়েছে। এর একটি হলো, যদি ঘুষ গ্রহণকারী ঘুষের মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে বা সম্ভাব্য কর ফাঁকির উদ্দেশ্যে বাইরে পাচার করেন। তবে রেমিট্যান্সের মাধ্যমে এই সম্পদ দেশে ফিরে না এলে পুঁজির এ রকম স্থানান্তর প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তবে এর চেয়েও ক্ষতিকর দিক হচ্ছে যখন প্রকল্প অনুমোদন/ক্রয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণে নিযুক্ত ঘুষ গ্রহণকারী শর্ত জুড়ে দিয়ে বলেন যে ঠিকাদার কোনোভাবেই নির্ধারিত প্রকল্প ব্যয় বাড়াতে পারবেন না এবং ঘুষের ব্যয় তাঁর নিজের পকেট থেকেই মেটাতে হবে; এ ক্ষেত্রে ব্যয় বাড়লেও তা ঘুষের মোট পরিমাণ থেকে কম হবে। দুটি ক্ষেত্রেই ঘুষের ব্যয় ঠিকাদার বা বেসরকারি বিনিয়োগকারীকে অংশিক বা পুরোপুরি বহন করতে হয়। তবে পরের ক্ষেত্রে প্রকল্প ব্যয় ঠিক রাখতে গিয়ে নিচুমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহারের কারণে প্রকল্পের গুণগত মান বেশ কমে যায়। এর ফলে বিনিয়োগের প্রতিদান কমে যায় আর প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তৃতীয় দিকটি হচ্ছে যখন ঘুষ গ্রহণকারী সরকারি কর্মকর্তা স্বজনপ্রীতি এবং পক্ষপাতের বশবর্তী হয়ে প্রকল্পে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী ঠিকাদার/বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের মধ্য থেকে ব্যবসায়িক ও ব্যবস্থাপনা সামর্থ্যের বিবেচনায় তুলনামূলকভাবে কম যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থীকে নির্বাচন করেন। এর ফলে বিনিয়োগের প্রতিদান কমে যায়। প্রকৃতপক্ষে, স্বজনপ্রীতি এবং পক্ষপাতিত্ব দুর্নীতির এমন ধরন, যা সরকারি কর্মকর্তাদের দক্ষতা ও সততার বিরুদ্ধে কাজ করে।৬ দুর্নীতির নেতিবাচক প্রভাব কম রাখার জন্য খেয়াল রাখতে হবে সরকারি সম্পদ থেকে স্থানাস্তরিত অর্থ যেন ব্যক্তির ভোগে বেশি ব্যয় না করা হয় বা বিদেশে পাচার না হয় অথবা সার্বিক প্রকল্পের গুণগত মানে যেন আপস করা না হয়। কাজেই, দুর্নীতি থাকা সত্ত্বেও যেসব দেশ এগিয়েছে তারা দুটি বিপরীতধর্মী লক্ষ্যের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে তা করতে পেরেছিল: ঘুষের সর্বোচ্চ পরিমাণ নির্ধারণ এবং বিনিয়োগের সংখ্যা ও মানে দুর্নীতির প্রভাব কম রাখা। উন্নয়নের প্রতি দায়বদ্ধতা কম এমন দেশে দুর্নীতি সহাবস্থান করে ‘বিনিয়োগে অদক্ষতা’ আর ‘বাইরে সম্পদ পাচারে’র সঙ্গে।

সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ সেবাগুলো প্রদান করে, যার ওপর দরিদ্র জনগোষ্ঠী নির্ভরশীল। দুর্নীতি এসব সেবাকে বাধাগ্রস্ত করে এবং এসব সেবার মান ও পরিধি কমিয়ে দেয়। এটা শিক্ষার পরিমাণ ও মান হ্রাস করে। এটা পশ্চাত্মুখী কর হিসেবে কাজ করে, যা দরিদ্র জনগোষ্ঠী ও ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানের জন্য খাঁড়ার ঘা হিসেবে নেমে আসে। সবচেয়ে দুর্বল জনগোষ্ঠীর জন্য দুর্নীতি এসব সেবার সুযোগ সংকুচিত করে। সমাজের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী সরকারি সেবা যেমন: শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্যানিটেশন, ক্ষমতা, পরিবহন ও সরকারি নানা বিধি ও আইনের সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভোগে। যদি ঘুষ এসব সরকারি সেবা ও আইন বাস্তবায়নের সুবিধা পাওয়ার নির্ধারক হয়ে থাকে, তবে এসব জনগোষ্ঠী অসুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে, কারণ তাদের ঘুষ দেওয়ার সামর্থ্য সীমিত। অসাধুতার কারণে সরকারি সেবা হ্রাস পেলে, নিজেদের সম্পদ দিয়ে আত্মসাত্ হয়ে যাওয়া সরকারি সম্পদের ঘাটতি মেটানোর দায় গরিবদের নয়। সরকারি স্বাস্থ্য-শিক্ষাব্যবস্থার বাইরে গরিবদের এসব সেবা পাওয়ার সুযোগ বেশ কম আর এ কারণে দুর্নীতির কারণে এসব সেবার সুযোগ ও মান কমে গেলে তার জন্য সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় গরিবেরা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের বিনা অনুমতিতে অনুপস্থিতি বা ডাক্তার কিংবা ওষুধ ছাড়া স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ক্ষেত্রে গরিব নন এমন পরিবার গরিব পরিবারের তুলনায় গৃহশিক্ষকের পেছনে ব্যয় ও বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় মেটানোর সামর্থ্য রাখেন। বাংলাদেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, সচ্ছল পরিবারের শিক্ষার্থীরা গরিব শিক্ষার্থীদের তুলনায় ২ থেকে ৪ গুণ বেশি খরচ করতে রাজি। সমাজে গরিবদের অবস্থান দুর্বল হওয়ার কারণে তারা সেবা খাতের দুর্নীতির উন্মোচন আর প্রতিরোধে তেমন সক্রিয় হতে পারছে না। আর তাই সরকারি সেবা পেতে তাদের অপ্রাতিষ্ঠানিক খরচের মুখোমুখি হতে হয়।

যে সমাজে দুর্নীতি ব্যাপক, সেখানে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে টিকে থাকার জন্য সরকারি সেবার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তার তৈরি করা দুর্নীতি প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে হয়। সুবিধাবঞ্চিত লোকজন ঘুষ দিয়ে বা মর্যাদা কিছুটা বিসর্জন দিয়ে হলেও তাদের জীবিকার ব্যবস্থা নিশ্চিত করে। দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি কর্মকর্তা সব সময় দুর্নীতির একক উপকারভোগী হয় না। তাদের দ্বারা চুরি করা সরকারি তহবিল মাঝেমধ্যে কিছু দরিদ্র মানুষের আয়ের উত্স হিসেবে কাজ করে। নির্বাচনী রাজনীতির কারণে রাজনীতিবিদদেরও তাঁদের অবৈধ সম্পদের ভাগ গরিবদের দিতে হয়।৭

২. বাংলাদেশে দুর্নীতি

বার্লিনভিত্তিক ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের করাপশন পারসেপশন ইনডেক্স এবং বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ উভয় সূচকেই বাংলাদেশকে বিশ্বের অন্যতম দুর্নীতিপ্রবণ দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল।৮ এসব ধারণা সূচকের নিরপেক্ষতা, মান এবং এদের পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। কারণ এসব সূচকের বেশির ভাগই নির্বাচিত কিছু জাতীয়/আন্তর্জাতিক ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানের ধারণার ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছিল। তবে, দুর্নীতির ক্ষেত্রে আমরা ধারণাকে বিবেচনায় না নিয়ে পারি না, কারণ দুর্নীতি কাগজে প্রমাণ রেখে করা হয় না। কিন্তু কিছু দুর্নীতি আমরা আবার পুরোপুরি পরিমাপ করতে পারি। যেমন মানুষ ঘুষের জন্য কত টাকা দেয় তা ধারণার বদলে পুরোপুরি পরিমাপ করা যায়। বিভিন্ন সরকারি খাতের নিরীক্ষা প্রতিবেদন এবং সরকারি ব্যয় কীভাবে করা হয়েছে, তার ওপর জরিপের ফলাফলের ভিত্তিতে আমরা আর্থিক অনিয়মগুলো যথাযথভাবে চিহ্নিত করতে পারি। তবে এসব জরিপ প্রতিবেদন সহজেই আর্থিক অনিয়ম ধরতে পারলেও এর বড় সীমাবদ্ধতা হলো এসব অনিয়ম আদৌ দুর্নীতির ফল নাকি দুর্বল তদারকি ব্যবস্থার কার্যকরণের ফলে তৈরি তা নির্ণয় সম্ভব নয়।৯ আন্তর্জাতিক সংস্থা কর্তৃক তৈরি করা দুর্নীতির এসব ধারণা পরিমাপক সূচককে অন্যান্য গবেষণার মাধ্যমেও শক্তিশালী করা যায়। এদের মধ্যে রয়েছে সুশীল সমাজের সংস্থা, যেমন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ ও অন্যান্য থিংক ট্যাংক দ্বারা তৈরি করা জাতীয় জনমত জরিপসমূহ।

ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের ভাষ্যে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ পরিচালিত অনুপুঙ্খ জরিপে যে উপাত্ত উঠে এসেছে তা অর্থনীতির বিভিন্ন খাতের ব্যাপকতা নির্দেশ করে, আর এই জরিপটি করা হয়েছে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির মতামতের ভিত্তিতে। ২০১০ সালের এ ধরনের জরিপের ফলাফল পরিশিষ্ট-১-এ দেখানো হয়েছে। জরিপে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয় বিচার বিভাগে। জরিপ করা পরিবারগুলোর মধ্যে ৮৮ শতাংশ মানুষ, যারা বিচার বিভাগের সেবা গ্রহণ করেছে, তারা প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতির শিকার। দুর্নীতির মাত্রা অনুযায়ী তারপরের অবস্থানে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী (৭৯ দশমিক ৬ শতাংশ) আর তারপর রয়েছে ভূমি প্রশাসন সেবা (৭২ দশমিক ২ শতাংশ)। একই সঙ্গে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে দুর্নীতির শিকার মানুষের হার যথাক্রমে ১৫ দশমিক ৩ শতাংশ এবং ৩৫ দশমিক ২ শতাংশ।

ঘুষ দেওয়ার ব্যাপকতা বিবেচনায় নিলে ৭১ দশমিক ৯ শতাংশ পরিবার সব ধরনের সেবা খাতে সেবা পেতে ঘুষ প্রদান করে থাকে। পর্যবেক্ষণে এটাও উঠে এসেছে যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সেবা পেতে সর্বোচ্চ হারে ঘুষ প্রদানে বাধ্য হয়েছে ৬৮ দশমিক ১ শতাংশ পরিবার। ঘুষের পরিমাণের দিক থেকে ভূমি ও বিচার বিভাগ যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। এই দুই সেবা খাতে যথাক্রমে ৬৭ এবং ৫৯ দশমিক ৬ শতাংশ পরিবার ঘুষ বা অবৈধ অর্থ প্রদানে বাধ্য হয়।

সরকারের বিভিন্ন খাত আর সেবা খাত নিয়ে পরিবারগুলোর মতামতের ভিত্তিতে চালানো জরিপের বাইরেও গত কয়েক বছরে বেশ কিছু মূল্যায়ন হয়েছে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, যেমন সরকারি খাদ্য বণ্টন কর্মসূচির ওপর। এসব কর্মসূচির সুবিধা মানুষের কাছে পৌঁছাতে নয়ছয় হওয়া সম্পদের হিসাব, যা ভোগ করছে অনাকাঙ্ক্ষিত গোষ্ঠী, মোটামুটিভাবে দুর্নীতির হিসেবের সমান। উদাহরণ হিসেবে টানা যায় ১৯৮০-এর দশকের কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির কথা। ওই মূল্যায়নে এই খাদ্য কর্মসূচিতে সম্পদ নয়ছয়ের হিসাব ছিল ৩২-৫৫ শতাংশ। আর ১৯৯০-এর দশকে গ্রামীণ রেশনিং ও বিধিবদ্ধ রেশনিং ব্যবস্থায় চুরির হিসাব ৭১ থেকে ৯৮ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করেছিল। অবশ্য ওই দশকে গ্রামীণ গরিব গৃহস্থদের ভিজিডিপি কর্মসূচিতে অনিয়ম ছিল মাত্র ১৪ শতাংশ। আবার ২০০৫ সালে ভিজিএফ, ত্রাণ এবং অন্যান্য কর্মসূচি, দুর্নীতির হার ৩৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছিল।১০

এর বাইরে কিছু নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে মাথায় রেখে করা নগদ সহায়তা ও খাদ্য বিতরণ কর্মসূচিতেও চুরির হিসাব ছিল। ২০১০ সালে ৪৯ শতাংশ পরিবারকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির কোনো কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য ঘুষ দিতে হয়েছিল। ৭৮ দশমিক ১ শতাংশ পরিবারকে তাদের প্রাপ্ত সহায়তার কিছু অংশ ঘুষ হিসেবে দিতে হয়েছিল; ১২ দশমিক ৩ শতাংশ পরিবার স্বজনপ্রীতির শিকার এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে ২০ দশমিক ২ শতাংশ পরিবারের এ ধরনের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের সুযোগ সংকুচিত হয়েছিল।১১

সরকারি খাতের উন্নয়ন প্রকল্পে ঘুষের পরিমাণ বা সরকারি কর্মকর্তা কর্তৃক তহবিল তছরুপের প্রত্যক্ষ সংখ্যাগত প্রমাণ অবশ্য নেই। তবে ২০০৫-এর মার্চ থেকে আগস্ট পর্যন্ত প্রকাশিত সংবাদ প্রতিবেদনের ভিত্তিতে চালানো জরিপে (উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে বাজেট-পূর্ব ও বাজেট-পরবর্তী বিতর্কের সময়) দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, ভুল নিরীক্ষা, তহবিল পরিশোধ, যানবাহনের অপব্যবহারসহ নানা অনিয়মের ২১৯টি ঘটনা উঠে এসেছে।১২

২০০০-২০০৩ সালের কৃষি ও গ্রামীণ উন্নয়ন প্রকল্পে চুরির হার ছিল মোট প্রকল্প ব্যয়ের ৩০ শতাংশ। ছোট প্রকল্পে বেশি হারে চুরি হয়েছিল ৩০-৪০ শতাংশ। আর বড় প্রকল্পের চুরির হার ছিল ১৫-২০ শতাংশ। গড় খরচ কম বলে সব ছোট প্রকল্পে চুরির হার বেশি ছিল, কেননা প্রকল্পের আকার যা-ই হোক না কেন কমপক্ষে একটি নির্দিষ্ট অংশ ঘুষ হিসেবে দিতে হতো। এ ছাড়া, ছোট প্রকল্পগুলোর অধিকাংশই দূরবর্তী এলাকায় ছড়িয়ে থাকায় সেখানে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা মুশকিল ছিল। এর ফলে ব্যাপক মাত্রায় সম্পদের অপব্যবহার হতো। বেসরকারি খাত এবং নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ও পরিদর্শন সংস্থার মধ্যে অবৈধ লেনদেনের খুব কমই হিসাব করা আছে।১৩

তবে তথ্য ও পদ্ধতিগত ভুলের কারণে এসব জরিপ একেবারে ত্রুটি ও অসংগতিমুক্ত নয়। তারপরও দুর্নীতির যে হিসাবগুলো পাওয়া যায় তাতে চোখ বোলালে দুর্নীতির ব্যাপকতা সেবা খাত ছাড়িয়ে বাণিজ্য ও শিল্পসংক্রান্ত নিয়মনীতি প্রয়োগে এবং সরকারি খাতের প্রকল্পগুলোতেও দৃশ্যমান হয়। এসব ফলাফল সাধারণত দেশের ভেতরে দুর্নীতি নিয়ে প্রচলিত ধারণাকেই সমর্থন করে।

বাংলাদেশে ব্যাপক দুর্নীতির ব্যাপারে দেশে-বিদেশে প্রচলিত ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, এ দেশের দুর্নীতিতে তেমন কোনো স্বতন্ত্রতা নেই। পৃথিবীর অনেক উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে কিছু ক্ষেত্রে ব্যাপক মাত্রার দুর্নীতি রয়েছে। তবে উন্নত ও গরিব দেশের দুর্নীতির মাঝে কিছু পার্থক্য রয়েছে। প্রথমত, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার দ্বারা তৈরি করা বিভিন্ন দুর্নীতি সূচকে বাংলাদেশের মতো অনুন্নত দেশগুলোর অবস্থান ক্রমসোপানে উপরের দিকে আর উন্নত দেশগুলোর অবস্থান নিচের দিকে। দ্বিতীয়ত, উন্নত দেশগুলোতে যে ধরনের দুর্নীতি দেখা যায় তা নিত্যপ্রয়োজনীয় দরকারি খাতে নয়, বরং আর্থিক খাত কিংবা বড় আকারের সরকারি ক্রয়চুক্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উচ্চপর্যায়ের দুর্নীতি।১৪ তারপরও, দুর্নীতির ব্যাপকতা বাংলাদেশের তুলনায় অনেক কম। সব ধরনের অর্থনৈতিক লেনদেনের বিচারে দুর্নীতির মাত্রা উন্নত দেশে কম। তৃতীয়ত, অধিকাংশ উচ্চ আয়ের দেশে আইনের শাসন আছে। একবার দুর্নীতি ধরা পড়লে বিচারের চেষ্টা চলতেই থাকে আর আইনের গতি শ্লথ হলেও তার খড়্গ অপরাধীর ঘাড়ে নামবেই। ধরা পড়ার ও একবার ধরা পড়লে শাস্তি হওয়ার সম্ভাবনা থাকায় আইনের শাসন দুর্নীতি প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে। উন্নত দেশে দুর্নীতির কারণে ব্যবসা, রাজনীতি ও শিল্পজগতের অনেক উচ্চপর্যায়ের নক্ষত্রের পতন ঘটেছে এবং শাস্তি ভোগ করতে হয়েছে।

এমনকি প্রতিবেশী দেশ ভারতেও রাজনীতিবিদ এবং প্রশাসকদের দুর্নীতির দায়ে কারাবাসসহ কঠোর শাস্তি দেওয়া হয়েছে, সম্ভবত তাদের যা প্রাপ্য তার চেয়ে অনেক কম সাজা তাদের ভোগ করতে হয়েছে। অনেক মন্ত্রীকে এ কারণে পদত্যাগ করতে হয়েছে এবং জনরোষে পড়তে হয়েছে। এটা অবশ্য সত্য যে ভারতে সংসদের নিম্নকক্ষের এক-তৃতীয়াংশ সদস্যই কোনো না কোনো ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত।১৫ কিন্তু তাঁরা তাঁদের অপরাধ স্বীকার করেননি এবং কোনো ধরনের শাস্তি পাননি এবং যতক্ষণ তাঁরা দণ্ডিত না হচ্ছেন ততক্ষণ তাঁরা সংসদীয় দায়িত্ব চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে, তাঁরা জনগণের আস্থার সংকটে ভুগছেন। এমনকি চীনের মতো কর্তৃত্ববাদী দেশও সেখানে বড় আকারের দুর্নীতি থাকার কথা স্বীকার করেছে। সাম্প্রতিক নেতৃত্ব (২০১৩) দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধকে তাদের প্রধান লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করেছে। চীনে ইতিমধ্যে কিছু উচ্চপর্যায়ের দুর্নীতির ক্ষেত্রে অপরাধীদের শাস্তি দেওয়া হয়েছে। তথাপি দেশটির অগণতান্ত্রিক প্রকৃতি ও পার্টির উঁচুতলার সঙ্গে সরকারনিয়ন্ত্রিত এমনকি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের যোগ থাকায়, দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা পার্টির উঁচুতলা পর্যন্ত পৌঁছায়নি। তবে স্থানীয় সরকার পর্যায়ে দুর্নীতি সাম্প্রতিক সময়ে গভীর নজরদারির মধ্যে রয়েছে এবং অনেক ক্ষেত্রে দোষীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে।

এটা উল্লেখযোগ্য যে বাংলাদেশে সরকার বা ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে খুব কম সংখ্যক হর্তাকর্তাকে দুর্নীতির অভিযোগে বিচার ও শাস্তি দেওয়া হয়েছে। ২০০৭-২০০৮ সালের সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাববায়ক সরকারের আমলে কিছু উচ্চপর্যায়ের রাজনীতিবিদ এবং আমলার দুর্নীতি চিহ্নিত হয়েছিল এবং তাঁদের বিচার শুরু হয়েছিল। কিছু বিচার নিষ্পত্তি হয়ে দোষীরা শাস্তিও পেয়েছিল।১৬ তবে, মনে রাখতে হবে প্রতিরক্ষা ক্রয় যা কিনা ব্যাপক দুর্নীতির ক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত, সামরিক এবং বেসামরিক কোনো সরকারের আমলেই সেভাবে নজরদারিতে আসেনি।১৭ অবশ্য বাংলাদেশে কয়েকটি নির্বাচিত সরকারের সময়ে উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা বা রাজনৈতিক নেতার এ খাতে দুর্নীতির জন্য বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছিল। তবে তাঁদের অধিকাংশই ছিলেন বিরোধী দলের এবং ক্ষমতাহীন দলের সংসদ সদস্য। যখন তাঁদের দল আবার ক্ষমতায় ফিরে আসে তখন তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছিল আর যাঁদের বিচার ও শাস্তি হয়েছিল তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হযেছিল। তবে এটি বলা যাবে না বিরোধী দলের লোকজন অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের গুরুত্বপূর্ণ বা উচ্চপর্যায়ের নেতারা ব্যাপক মাত্রায় দুর্নীতি করলে দল ক্ষমতায় থাকলেও তাঁদের বিচার ও শাস্তি হয়নি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনায় বিরোধী দলের সদস্যদের শাস্তি দেওয়া হয়েছে, এমনকি সত্যিকারের দুর্নীতি হলেও। ফলে জনগণের মাঝে এ ধারণা জন্মেছে এগুলো মূলত করা হয়েছে রাজনৈতিক হয়রানির উদ্দেশ্যে, দুর্নীতির বিচারের জন্য নয়। এমনকি যেসব ব্যবসায়ী রাজনৈতিক দলগুলোকে চাঁদা দিয়ে থাকেন, সেসব দল ক্ষমতায় থাকাকালে এসব ব্যবসায়ীকে আইন অমান্য করার জন্য কখনো বিচারের মুখোমুখি হতে হয়নি।

খুব কম ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংযুক্ত ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত হওয়ার কারণে তদন্ত হয়েছে এবং যদি কখনো তদন্ত হয়ও তবে কিছুদিন পর তাঁদের নির্দোষ পাওয়া যায়। কিছু ক্ষেত্রে বিচারে তাঁদের শাস্তি দেওয়া হলেও অল্প সাজা খেটে তাঁরা বেরিয়ে আসেন। সুতরাং এখানে ব্যাপক জন-উপলব্ধি আছে যে প্রতিটি দলই তার সদস্য বা সমর্থকদের বাঁচাতে চায়। যেহেতু কোনো রাজনৈতিক দলই পরপর দুই মেয়াদের জন্য বাংলাদেশে নির্বাচিত হয়নি, সেহেতু দুই রাজনৈতিক দলেরই মিউজিক্যাল চেয়ারের এই খেলায় একে অপরের সমর্থকদের অভিযুক্ত করার নজির রয়েছে। ফলে, রাজনৈতিক সংস্রব যা-ই হোক না কেন দীর্ঘমেয়াদে বড় আকারের দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত কাউকেই শাস্তি পেতে হয়নি। যদি উপরের বিশ্লেষণটি সঠিক না হয় বা পক্ষপাতমূলক হয় তবে অন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশকে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে বিবেচনা করা উচিত, যেখানে অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় রাজনীতিবিদেরা কম দুর্নীতিপ্রবণ। এটা এমন একটি বিষয়, যা অধিকতর অভিজ্ঞতালব্ধ বিশ্লেষণ দাবি করে। তবে দেশে সাধারণ মানুষের মাঝে ব্যাপকভাবে যে ধারণা প্রচলিত তা অন্য রকম। রাজনীতি ও জনসংযোগে মানুষের ধারণা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যদি তা ব্যাপক ও সংগতিপূর্ণ হয়। মাঝেমধ্যে এটা বাস্তবতার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্য রাজনীতিবিদদের অসাধারণ কিছু পদক্ষেপ নিয়ে এসব ধারণা ভাঙাতে হয়। কেউ হয়তো বলতে পারেন যেসব রাজনীতিক মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ত জীবন আর রাজনৈতিক ক্ষমতা পেতে চান, এ জোয়ালের ভার তাঁদের কাঁধে নিতেই হবে। আর আমরা জানি একজন ‘সতী সাবিত্রীকে অবশ্যই সব ধরনের সন্দেহের ঊর্ধ্বে থাকা উচিত’।

বাংলাদেশে পোশাকশিল্প সরকারি কর্মকর্তা এবং ব্যক্তি শিল্পপতির মধ্যে আঁতাতের দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখা হয়। এখানে আমলাতান্ত্রিক এবং রাজনৈতিক উভয় ধরনের দুর্নীতির উপাদান আছে।১৮ পোশাকশিল্পের বিরুদ্ধে বিভিন্ন আর্থিক/কর সুবিধা পেতে ও সরকারি নানা বিধি পালন এড়াতে পোশাকশিল্পের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে প্রভাবিত করার অভিযোগ রয়েছে।১৯ ২০০৬ সালের পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তাদের মাঝে চালানো এক জরিপ বলছে, ৭৫ জনের মাঝে ৫০ জন শিল্পপতি বিভিন্ন সময়ে সংসদ সদস্য ছিলেন এবং তাঁদের অনেকেই মন্ত্রীও ছিলেন। অনেক অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা এবং জ্যেষ্ঠ সেনাকর্মকর্তা অনেক পোশাক কারখানার মালিক ছিলেন বা আছেন। এটা প্রায়ই বলা হয়ে থাকে যে যেকোনো ব্যক্তি যে কি না বাংলাদেশে ‘কিছু একটা’ ছিল কোনো না কোনোভাবে রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্পের সঙ্গে জড়িত। অধিকন্তু, পোশাকশিল্পের মালিকেরাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ব্যাংকের অংশীদার। দেশের অর্থনৈতিক পরিবেশে এ শিল্পের গুরুত্বের কারণে খরচের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিধি পালন করা থেকে পোশাকশিল্পের মালিকেরা ঘুষ দিয়ে অব্যাহতি পাচ্ছেন।২০ দেশে পোশাকশিল্পে উচ্চ মুনাফা এসেছে মূলত ক. এর নিম্ন শ্রমব্যয়, আর খ. মজুরি ও কাজের পরিবেশ, কারখানা ভবনের নিরাপত্তা মান নিয়ে নজরদারির অভাবের কারণে।২১ ক ও খ-এর কারণে উত্পাদন খরচ থেকে বাঁচানো অর্থের কিছুটা আবার গেছে এসব নিয়মনীতির বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকা সরকারি কর্মকর্তাদের পকেটে বিভিন্ন ধরনের ঘুষ হিসেবে। অন্যান্য শিল্পের মতো পোশাকশিল্পকেও ভুগতে হয়েছে অপর্যাপ্ত ও অদক্ষ অবকাঠামো আর বিভিন্ন ধরনের বিধির জন্য, যা লাইসেন্স ও অনুমতি পাওয়ার ফি-ই শুধু বাড়িয়েছে। আর এসবই ব্যবসার খরচ বাড়াতে ভূমিকা রেখেছে। রাজনৈতিক প্রভাব ও ঘুষের মাধ্যমে তাঁরা এসব প্রতিবন্ধক জটিল বিধিবিধান এড়াতে পেরেছেন। আর সীমিত অবকাঠামো সুবিধা থাকা সত্ত্বেও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে জ্বালানি সরবরাহ পেয়েছেন।

গার্মেন্টস মালিক ও আইন প্রয়োগকারীদের মধ্যে আঁতাতের সুযোগ ও প্রণোদনার ব্যাপারটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে ক. কাজের পরিবেশ ও খ. ভবনের কাঠামো নিরাপত্তা নিশ্চিতের নজরদারির অভাবের মধ্য দিয়ে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ ধরনের নিয়মনীতি না মানার ফলে একের পর এক অগ্নিদুর্ঘটনা আর ভবনধসের ঘটনা, ২০১৩ সালের আলোচিত রানা প্লাজা ধস, বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।২২ বিশেষ করে, বিদেশে আমদানিকারকদের এবং নানা শ্রম অধিকার রক্ষাকারী সংগঠনের, যারা দেশের ভেতর তুলনামূলকভাবে দুর্বল কিন্তু বাইরের দেশগুলোতে শক্তিশালী।

৩. দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ

দুর্নীতি দমনের জন্য দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ এবং দুর্নীতি ঘটে থাকলে শাস্তি প্রয়োগ শাসনব্যবস্থার সামগ্রিক উন্নতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত শাসনের একটি সুনির্দিষ্ট অংশের মধ্যে রয়েছে প্রতিবাদ ও জবাবদিহি, আইনের শাসন এবং সরকারের কার্যকারিতা।২৩ প্রতিবাদ ও জবাবদিহি উপাদানের ভেতর রয়েছে জনগণের অংশগ্রহণে সরকার নির্বাচন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠান, বাক, সংবাদমাধ্যম ও সংগঠনের স্বাধীনতা, বহুদলীয় রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে রাজনৈতিক বহুত্ববাদ ইত্যাদি। আইনের শাসনের ভেতর রয়েছে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, আদালতের মান, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মান ও ন্যায়নিষ্ঠতা, গরিব ও ক্ষমতাহীন মানুষদের বিচার পাওয়ার সুযোগ এবং আইনের চোখে সবার সমান অধিকারের বিষয়টি। বাজার অর্থনীতিতে বিনিয়োগ নির্ভর করে চুক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তিক অধিকার প্রয়োগের ওপর। এসব উপাদানই নাগরিকদের আত্মবিশ্বাস ও সমাজের বিধিবিধানের প্রতি তাদের অনুগত থাকতে কাজ করে। সরকারের কার্যকারিতা প্রতিফলিত হয় সরকারি সেবার মান, সরকার রাজনৈতিক চাপ থেকে কতটুকু মুক্ত এবং সেবার সামর্থ্যের মাধ্যমে। এর মধ্যে রয়েছে সরকারের নীতির বিশ্বাসযোগ্যতা ও নীতির প্রতি সরকারের দায়বদ্ধতার বিষয়টি।

উন্নত স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি

সুশাসনে সুবিস্তৃত কাঠামোর মাঝে, যার মধ্যে রয়েছে দুর্নীতি দমনের মতো অপরিহার্য উপাদান, কিছু সুনির্দিষ্ট পরিমাপ রয়েছে যাদের দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। যেমন: স্বচ্ছতা, যাতে আছে তথ্যের অধিকার, বাক্ ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং বিধিবিধান সহজীকরণ, এর মাঝে রয়েছে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার—নিয়ন্ত্রিত ও নিয়ন্ত্রণকারীর মাঝে সরাসরি সংযোগ এড়ানোর জন্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ব্রান্ডেই একবার বলেছিলেন ‘সূর্যালোক হচ্ছে সর্বোত্তম ছোঁয়াচরোধক’। স্বচ্ছতা দুর্নীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিমাপক। সরকারি কর্মকর্তা, মন্ত্রী, বিচারক, সংসদ সদস্য এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীরা তাঁদের যে সম্পদের বিবরণ প্রকাশ করেন তা দুর্নীতি প্রতিবন্ধক হিসেবে বিবেচনা করা যায়। যতক্ষণ পর্যন্ত তাঁরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও দেওয়ার মতো অবস্থানে থাকেন ততক্ষণ পর্যন্ত এ ধরনের ঘোষণা দেওয়া উচিত। এ ধরনের ঘোষণায় সম্পদের পরিমাণ কম করে দেখানো হতে পারে কিন্তু ঘোষণাগুলো প্রকাশিত হচ্ছে জনগণের সামনে। তবে সময়ের ব্যবধানে জনগণের চাপে সম্পদের ভুল বিবরণী প্রকাশ করার প্রবণতা কমে যাবে বলে আশা করা হয়।২৪ আর গণতন্ত্রে যাঁরা রাজনীতিতে আসবেন, যাঁদের সিদ্ধান্তের কারণে নির্ধারিত হবে জনগণের সম্পদ কীভাবে ব্যবহূত হবে, তাঁদের মেনে নিতে হবে যে তাঁদের আইনের হিসাব জনগণের অনুসন্ধানের জন্য উন্মুক্ত—এমন সিদ্ধান্তের ওপর এ প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। কেউ যখন একবার রাজনীতিতে প্রবেশ করেন তাঁর ব্যক্তিস্বাধীনতা, বিশেষ করে আয়-ব্যয় গোপন রাখার ব্যাপারে, হ্রাস পায়।২৫ এ ধরনের বিবরণী কার্যকর প্রতিরোধক হওয়ার জন্য। এসব বিবরণী খতিয়ে দেখার জন্য একটি কার্যকর ব্যবস্থা থাকা উচিত। একটি স্বাধীন তদারকি কমিশন গঠন করা যেতে পারে এ ধরনের বিবরণী পরীক্ষা ও এর সত্যতা যাচাই করার জন্য। যদিও শুরুতে এ ধরনের তদারকি ও যাচাইকরণ খুব একটা কার্যকর হয় না, তবে সব তথ্য জনগণের নাগালে রাখার চর্চা দুর্নীতি প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করবে।

একইভাবে সরকারি নীতি, কাজ, আয়-ব্যয়ের ব্যাপারে তথ্য পাওয়ার অধিকারের জন্য দুর্নীতিবিরোধী কৌশলের ভূমিকা রয়েছে। বাংলাদেশে ২০০৯ সালে তথ্য অধিকার আইন করা হয়েছে।২৬ কিন্তু তথ্য পাওয়ার এই অধিকার প্রতিষ্ঠা খুব একটা সহজ ছিল না। কারণ সব সরকারই নিরাপত্তার অজুহাত তুলে তথ্য পেতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করত। জনগণের সঙ্গে তথ্য ভাগাভাগি করতে সব সরকারই অনিচ্ছুক। কারণ তথ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ সরকারের ক্ষমতা প্রদর্শনেরই একটি অংশ, আর তথ্যের জন্য জনগণের অবাধ প্রবেশাধিকার সরকারের এই ক্ষমতাকে খর্ব করবে। বাংলাদেশে এ সংক্রান্ত আইনে ২০ ধরনের তথ্য প্রকাশের ব্যাপারে বিধিনিষেধ রয়েছে। তথ্য দিতে অস্বীকার করলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আদালতে নিয়ে বিচারের প্রক্রিয়াটি বেশ সময়সাপেক্ষ। গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা সংস্থাগুলোকে এ ব্যাপারে আইনি বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। শুধু মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্র ছাড়া, এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট আইনের ভাষাটিও পরিষ্কার নয়। এ দেশে এর মধ্যে তিনটি আইন হয়েছে: রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা আইন ১৯২৩, বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪ এবং রুলস অব বিজনেস ১৯৯৯। এই আইনগুলো তথ্য আইনের কিছু ধারাকে নিষ্ক্রিয় করে থাকতে পারে। আর এ আইনটি স্থানীয় সরকারের উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত কার্যকর, এর নিচে ইউনিয়ন পর্যায়ে কার্যকর নয়।২৭ তবে এ আইন এনজিওগুলোর দ্বারা গরিব মানুষদের পক্ষে ব্যবহার করা হয়েছে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মধ্যে তাদের দাবিদাওয়া ও অধিকার খুঁজে বের করা ও তা প্রতিষ্ঠা করার জন্য।২৮ এ ব্যাপারে সিভিল সোসাইটি সাধারণ মানুষকে শিক্ষিত ও সচেতন করার জন্য ভূমিকা রাখতে পারে, যেন তারা সঠিক বিষয় নির্বাচন করে এবং তথ্যের বিভিন্ন ধরন বাছাই করে যথাযথ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাতে তথ্য পেতে পারে। তারা জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত সব বিষয়ে ওয়াচডগের ভূমিকা রাখতে পারে। সরকারের বিভিন্ন সংস্থার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতে এবং এ বিষয়গুলো বাক ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতাচর্চার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে নিয়ে আসার মাধ্যমে তাঁরা ভূমিকা পালন করতে পারেন। তথ্য অধিকার আইন মিডিয়ার কার্যকর ভূমিকায় একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, যা স্বচ্ছতায় বেশ গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সময় মিডিয়া তার স্বাধীনতার অপব্যবহার করে থাকে। দুটি উপায়ে এই অপব্যবহার রোধ করা যায়: প্রথমত অপপ্রচার ও ভুল তথ্য পরিবেশনের জন্য সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা; দ্বিতীয়ত, সিভিল সোসাইটি, নিরপেক্ষ ব্যক্তি ও গণমাধ্যমকে সম্পৃক্ত করে প্রেস কাউন্সিল গঠনের মাধ্যমে গণমাধ্যমে আত্মনিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা চালু করা। এ ছাড়া মুক্ত গণমাধ্যম ও অসংখ্য গণমাধ্যমের প্রতিযোগিতার মধ্যে যেকোনো ধরনের অপপ্রচার প্রতিদ্বন্দ্বীদের মাধ্যমে যাচাই করার সুযোগ রয়েছে। মিডিয়ার স্বাধীনতা সংকুচিত হলে জনকল্যাণ হুমকিতে পড়ার ঝুঁকি, ভুল তথ্য প্রচারের ফলে যে ক্ষতি হয় তার চেয়ে অনেক বেশি। কারণ দিন শেষে জয় হয় সত্যেরই।২৯

সরকারি সম্পদ ব্যবহারে দুর্নীতিবিরোধী পদক্ষেপের জন্য একটি ব্যাপার ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ব্যক্তিগত সুবিধার জন্য সরকারি সম্পদ ব্যবহারে নজরদারি এবং এ ধরনের ব্যক্তিগত ফায়দা লোটার প্রবণতা রোধ করার জন্য সরকারের আর্থিক কার্যক্রমের, যেমন: রাজস্ব আয় ও ব্যয়, স্বচ্ছতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সরকারি ব্যয়সংক্রান্ত যত তথ্য জনগণের সামনে উন্মুক্ত থাকবে, তহবিল তছরুপের ঘটনা চিহ্নিত করার সুযোগ তত বাড়বে। এগুলো সরকারের ওপর চাপ তৈরি করবে দুর্নীতিবিরোধী ব্যবস্থা নিতে।

ইন্টারন্যাশনাল বাজেট পার্টনারশিপের তৈরি করা ওপেন বাজেট ইনডেক্স বাজেট কতটুকু স্বচ্ছ তা মূল্যায়ন করে। এর মধ্যে রয়েছে বাজেট তৈরিতে জনগণের অংশগ্রহণ এবং আইন বিভাগ ও সর্বোচ্চ নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানে তদারককারী প্রতিষ্ঠানের ভূমিকার বিষয়টি।৩০ বাজেটের স্বচ্ছতার বিষয়টি বিচার করা হয় জনগণের সামনে বাজেট দলিল প্রকাশের মাধ্যমে। এর মধ্যে রয়েছে তিনটির প্রাক্-বাজেট দলিল, চারটি বাজেট নির্বাহী দলিল এবং নিরীক্ষা প্রতিবেদন। বাজেট-প্রক্রিয়ায় আইনসভার তদারকির মধ্যে রয়েছে নির্বাহী বিভাগে বাজেট প্রস্তাব জমা দেওয়ার আগে বাজেট-প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হওয়া, গবেষণা ও বিশ্লেষণ সামর্থ্যে আইনসভার প্রবেশাধিকার, বাজেট প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার জন্য যথেষ্ট সময়, বাজেট সংশোধনের পর্যাপ্ত ক্ষমতা এবং বাজেট বাস্তবায়নের সময় তহবিল হস্তান্তর। সর্বোচ্চ নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্ষমতা বিচার করা হয় ১. প্রতিষ্ঠান-প্রধানকে বাদ দেওয়ার ক্ষমতা, ২. সরকারি অর্থায়ন নিরীক্ষা করার আইনি ক্ষমতা ৩. স্বতঃপ্রণোদিত কোনো নিরীক্ষা করার উদ্যোগ, ৪. নিজের বাজেট নির্ধারণে আর্থিক সম্পদের পর্যাপ্ততা ও কর্তৃত্ব এবং ৫. দক্ষ লোকের প্রাপ্যতার ওপর। ওপেন বাজেট ইনডেক্সে ২০১২ সালে বাংলাদেশের স্কোর ছিল ৫৮, স্কোরের সীমা ০ থেকে ১০০-এর মধ্যে ছিল, এর মধ্যে ১০০ নির্দেশ করে সবচেয়ে উন্মুক্ত বাজেটকে আর শূন্য স্কোর বোঝায় বাজেটটি কত কম স্বচ্ছ।৩১ দেশগুলোর ৫টি শ্রেণির মধ্যে ৪১ থেকে ৬০ স্কোর অর্জনকারী দেশগুলোর শ্রেণি বোঝায় এসব দেশ বাজেট সম্পর্কে কিছু তথ্য জনগণের সামনে উপস্থাপন করে। যা তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। বাংলাদেশসহ এ দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও ফিলিপাইনস। ১০০ দেশের মধ্যে অধিকাংশ দেশই এই শ্রেণিভুক্ত, তবে ভারত ও ইন্দোনেশিয়া তুলনামূলকভাবে একটু ওপরের শ্রেণিতে আছে, যাদের স্কোর ৬১ থেকে ৮০-এর মধ্যে।

উন্মুক্ত বাজেটের জরিপের উপাদান

ছক-১- বাজেট দলিলাদির প্রাপ্যতা (২০১২)

ঢ= জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত; ঢঢ= অভ্যন্তরীণ ব্যবহারকারীদের জন্য উন্মুক্ত; ঢঢঢ= জমা দেওয়া হয়নি।

ছক-২- জনগণের সম্পৃক্ততা ও তদারকি প্রতিষ্ঠানের শক্তি (স্কোর: ১০০-০)

এ ক্ষেত্রে দক্ষ, স্বাধীন ও প্রয়োজনীয় জিনিসে সজ্জিত অডিটর জেনারেলের অফিস এবং তার মাধ্যমে প্রকাশিত সময়োপযোগী ও বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অডিটর জেনারেলের অফিসের শক্তির বিচারে বাংলাদেশ ভারত, নেপাল, পাকিস্তান ও ফিলিপাইনসের অনেক নিচে অবস্থান করছে। বাংলাদেশে সরকারি ব্যয়ের যাবতীয় তদারকি অডিটর জেনারেলের হাতে থাকলেও, বিদেশি সহায়তায় পরিচালিত প্রকল্পসমূহের পর্যবেক্ষণ এর আওতায় নেই। প্রেসিডেন্ট অডিটর জেনারেলের নিয়োগ দিয়ে থাকেন, যিনি কিনা এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করে থাকেন। অডিটর জেনারেলের অফিসে কর্মরত কর্মচারীদের অধিকাংশেরই হিসাবরক্ষণ বা নিরীক্ষা বিষয়ে কোনো অভিজ্ঞতা বা শিক্ষা নেই, আর এটি তাদের নিয়োগের রাজনৈতিক বিবেচনার বিষয়টি নিয়ে জনমনে সন্দেহের উদ্রেক করে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উঠে আসা পর্যবেক্ষণের ওপর ভিত্তি করে মাঠপর্যায়ে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।৩২ সরকারি ক্রয় ও লাইসেন্স প্রদানের সঙ্গে মন্ত্রীদের জড়িত থাকার বিষয় নিরীক্ষা প্রতিবেদনে প্রকাশিত হওয়ায় সম্প্রতি ভারতে বেশ কয়েকজন মন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন।

বিধি সহজীকরণ, পেশাদার আমলাতন্ত্র ও বিকেন্দ্রীকরণ

সরকারের আইন ও বিধিবিধান সুযোগ তৈরি করে ক্ষমতা অপব্যবহারের এবং সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে নানা দুর্নীতির। সরকারি কর্মকর্তারা বাণিজ্য সুযোগের প্রবেশাধিকার, বিভিন্ন পণ্য ও সেবায় সহায়তা এবং সীমান্তের এপার-ওপার পুঁজির চলাচল নিয়ন্ত্রণ করায় এসব বিষয়ে তাদের দুর্নীতি করার নানা সুযোগ তৈরি হয়। ঘুষের মাধ্যমে সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকা খনিজ সম্পদের প্রবেশাধিকার সহজেই পাওয়া যায়। যখনই মনোপলির সুযোগ থাকে, সরকার এসব মনোপলির সুযোগ থাকা সম্পদের প্রবেশাধিকার দেওয়ার মাধ্যমে অবৈধভাবে দুপয়সা কামিয়ে নিতে পারে। একটি ব্যবসা শুরু ও তার পরিচালনা নিয়ে সরকারের নিয়ন্ত্রণ বেশ ব্যাপক। এর মধ্যে রয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য অনুমতি বা লাইসেন্স গ্রহণ; এ ছাড়া কোনো ব্যক্তি কোনো সেবা গ্রহণ করতে চাইলে তাকেও নিয়ম মেনে চলতে হবে। সরকারের নিয়ম-নীতি যত কম বেসরকারি খাতে প্রভাব বিস্তার করবে, সরকারি অপব্যবহার তত কম হবে, আর ব্যক্তিস্বার্থে ক্ষমতার অপব্যবহারও কমে যাবে। একই সঙ্গে নিয়ম-নীতি যত জটিল হবে, নিয়ন্ত্রকের ক্ষমতা অপব্যবহারের সুযোগ তত বাড়বে এবং ব্যক্তিগত লাভের জন্য ক্ষমতার অপব্যবহারও বাড়বে। তবে সব নিয়ম-নীতিই যে অপ্রয়োজনীয় নয়, তার ওপরও জোর দিতে হবে। অনেক নিয়ম আছে যেগুলো দক্ষতা ও ইকুইটি বাড়ানোর জন্য দরকারি। যেমন: সামাজিক নিরাপত্তা, দূষণ, আর্থিক বাজার; যা তথ্যের অসমতার কারণে জর্জরিত; প্রাকৃতিক সম্পদের সংরক্ষণ, মনোপলি, স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশন, পরিবেশ বিপর্যয়—এসব ক্ষেত্রে নিয়ম ও নিয়ন্ত্রণের দরকার আছে। তবে নিয়ম-নীতিগুলো যেন সহজে বাস্তবায়ন ও বোধগম্য হয় তা নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ।৩৩ দ্বিতীয়ত নিয়ম-নীতিগুলোর ব্যাপক পরিচিতি থাকা উচিত এবং এমনভাবে প্রচার করা উচিত যেন অর্থনীতিতে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেকে এর প্রভাব সম্পর্কে জানে ও বোঝে। এটি গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে বর্তমানে জটিল ও পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল অর্থনৈতিক কাঠামো ও প্রতিষ্ঠানের এই যুগে নিয়মগুলো একটি জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে জন্ম নেয় ও পরিবর্তিত হয়। আর তাই নিয়ন্ত্রক সংস্থা বা কর্তৃপক্ষের জন্য এগুলোকে অধিকতর সহজ করা এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। একই সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মাঝে এসব নিয়মে ব্যাপক প্রচার বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তবে একটি জায়গায় বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য উন্নতি করতে পারে এবং করা উচিত। মেয়াদোত্তীর্ণ, জটিল, পুনরাবৃত্তি হচ্ছে এমন ও অদরকারি নিয়ম-নীতি বাদ দেওয়া এবং দরকারিগুলো যাদের রাখতেই হবে তাদের আরও সহজ করার উদ্দেশ্যে এসব নিয়ম-নীতির ব্যাপক পর্যালোচনা করা। এ ধরনের পর্যালোচনায় সব সুবিধাভোগীর অংশগ্রহণ থাকা উচিত। যেমন: নির্বাহী বিভাগ, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, অন্যান্য প্রতিষ্ঠান, যারা এসব নিয়মের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং সাধারণ জনগণ। অতীতে এ ধরনের পর্যালোচনা করা হলেও সেসব পর্যালোচনার সুপারিশ ও পরামর্শ সেভাবে বিবেচনা করা হয়নি। সরকারি নির্বাহী বিভাগ নিয়ন্ত্রণ ও নিয়ম বাদ দিতে অনিচ্ছুক, কেননা এর ফলে ক্ষমতা ব্যাপকভাবে খর্ব হতে পারে বলে তাদের আশঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রগতির কারণে অনেক নিয়ম-নীতি বাস্তবায়ন করা যেতে পারে নিয়ম বাস্তবায়নকারী কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ ছাড়াই। এ জায়গাগুলোতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মনোযোগ দিতে হবে। এ জন্য সরকারি কর্মকর্তার একাত্মতা ও দক্ষতা বেশ গুরুত্বের দাবি রাখে। এসব কর্মকর্তার পক্ষপাতহীন ও নিরপেক্ষ থাকা দরকার। এটি আবার নির্ভর করছে জনপ্রশাসনের প্রাতিষ্ঠানিক ও তদারকি কাঠামো এবং কর্মকর্তাদের দক্ষতা ও একাত্মতাকে প্রভাবিত করে এমন প্রণোদনাব্যবস্থার ওপর। দুর্নীতির ব্যাপকতা কমানোর জন্য আমলা/নিয়ন্ত্রকদের বেতন বাড়ানোর সুপারিশ প্রায়ই করা হয়ে থাকে। তবে এটি বাস্তবতার নিরিখে তেমন স্পষ্ট নয়। যদি ঘুষের মাত্রা নির্ধারিত না থাকে আর কোনো তৃতীয় পক্ষ বিরাজ না করে, তবে যেমনটা বলা হচ্ছে তেমনটা ঘটবে কি না তা বেশ অস্পষ্ট। কারণ সরকারি কর্মচারী ও ঘুষ প্রদানকারী দর-কষাকষি করবে ঘুষের পরিমাণ নিয়ে, মোটা বেতন কর্মকর্তাদের দর-কষাকষির ক্ষমতা বাড়াবে। এর ফলে ধরা পড়ে যাওয়ার মাশুল যেমন বেড়ে যাবে, তেমনি ঘুষের পরিমাণও বাড়বে।৩৪ বাংলাদেশের মতো রাজনীতিয়ায়িত সমাজে এটি গুরুত্বপূর্ণ যে আমলাতন্ত্রে যেন কোনোভাবেই ‘রাজনৈতিকীকরণ’ না ঘটে এবং সে যেন তার নিরপেক্ষতা বজায় রাখে। সুপ্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্রে সাধারণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সরকারের উঁচু পর্যায়ে রাজনৈতিক রদবদল। বাংলাদেশের মতো সংঘাতপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশে, যেখানে বড় দুটি দল দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, বড় বড় পদে বিরোধী দলের নিয়োগকৃত আমলাদের ব্যাপারে ক্ষমতাসীন দলের আপত্তির যুক্তিসংগত কারণ রয়েছে। তারা চাইলে উত্তরসূরি সরকারের অগ্রাধিকারমূলক প্রকল্পের বাস্তবায়নে দেরি করাতে পারে বা ঝুলিয়ে দিতে পারে। তবে একেবারে উঁচু পদ ছাড়া রাজনৈতিক বিবেচনায় এসব নিয়োগের কোনো যুক্তিই থাকতে পারে না। প্রশাসনে রাজনীতিকীকরণের ফলে উঁচু থেকে নিচু সব পর্যায়ে অযোগ্য অদক্ষ লোকের নিয়োগ ও পদোন্নতি ঘটেছে। পদোন্নতির জন্য পক্ষপাতমূলক ও অস্পষ্ট আইন এবং বাইরের প্রভাব থেকে আমলাদের রক্ষা করার জন্য আইনের অভাব এ ধরনের চর্চার বিকাশে ভূমিকা রেখেছে। এর ফলে সরকারি সেবার মান পড়ে গেছে এবং এখানে নির্লিপ্ততা বেড়েছে। দৈনন্দিন নির্বাহী সিদ্ধান্ত গ্রহণে রাজনৈতিক বিবেচনার প্রভাব বাড়ার কারণে দুর্নীতিতে অসত্ রাজনীতিবিদ ও আমলাদের যোগসাজশ বাড়ছে, কারণ আমলা ও তার রাজনৈতিক প্রভুদের ভাগ্য একই সুতোয় বাঁধা। আমলাতন্ত্রে তাই রাজনৈতিকীকরণের মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো শুধু দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের জন্যই আবশ্যক নয়, বরং তা উন্নয়নের জন্য একটি কার্যকর ও দক্ষ সরকারের জন্য অপরিহার্য।

সেবা খাতে বিশেষ করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামো নির্মাণ ও স্থানীয় পর্যায়ে উন্নয়ন প্রকল্পে যেসব দুর্নীতি রয়েছে তার অনেকটাই প্রশমিত করা যায় এসব সেবার দায়িত্ব বিকেন্দ্রায়িত করে স্থানীয় সরকার, বিশেষ করে এর নিচু পর্যায়ে এর দায়িত্ব দেওয়া হলে। স্থানীয় সরকারের সঙ্গে স্থানীয় জনগণ, যাদের এসব সেবায় প্রবেশাধিকার দরকার এবং যারা এসব সেবার জন্য মূল্য দিয়ে থাকে, এর এক ধরনের নৈকট্য রয়েছে। তবে দক্ষতা বাড়াতে, দুর্নীতি কমানো বা ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে এই বিকেন্দ্রীকরণ কার্যকরী হতে হলে দরকার জবাবদিহি ও প্রতিনিধিত্ব; যেমন নির্বাচিত স্থানীয় সরকার। স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিত্বশীল হওয়া উচিত, স্থানীয় জনগণ দ্বারা নির্বাচিত এবং তাঁর আর্থিক সম্পদ থাকা দরকার যা নিজস্ব উত্স থেকে আহরিত এবং সরকারের কাছ থেকে বরাদ্দ বা অনুদান পাওয়া। উন্নয়ন প্রকল্প অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নির্ধারণে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মাধ্যমে আয় হস্তান্তর কর্মসূচিতে অগ্রাধিকার দেওয়ার ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকারের স্বাধীনতা থাকা উচিত। এ ছাড়া এর নিজস্ব কর্মচারী এবং কেন্দ্রীয় সরকারের প্রভাবমুক্ত থাকা উচিত। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বা সংস্থার কর্মচারী যাঁরা স্থানীয় পর্যায়ে কাজ করছেন তাঁদের স্থানীয় সরকারের আওতায় থাকা উচিত।

এখানে কোনো অনুমিত কারণ নেই যে ভাবার, কেন স্থানীয় সরকারের কর্মচারীরা কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারীদের তুলনায় কম দুর্নীতিগ্রস্ত হবেন। প্রতিনিধিত্বশীল স্থানীয় সরকারের পাশাপাশি সেবা গ্রহণকারী, স্বেচ্ছাসেবক সংগঠন ও সুশীল সমাজের সংস্থার অংশগ্রহণ থাকা দরকার স্থানীয় পর্যায়ে মানুষ সঠিক সেবা যথাযথভাবে পাচ্ছে কি না তার তদারকিতে। স্থানীয় সরকারের কর্মচারীদের সঙ্গে নিয়ে এসব সংস্থা অনেক কার্যকরভাবে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে পারবে। আবার প্রমাণ সংগ্রহ এবং তথ্যের প্রবেশাধিকার পাওয়াও তুলনামূলকভাবে সহজ হবে। ছোট গ্রাম্য সমাজে দুর্নীতির ঘটনাসমূহ আড়াল করা তেমন সহজ নয়। নাগরিকেরা যেন স্থানীয় সরকার পর্যায়ে সম্পদের ব্যাপারে তথ্য পেতে পারে এবং কোনো নির্দিষ্ট প্রকল্প যেগুলো তারা ব্যবহার করছে ও যার জন্য তারা সরকারি কর্মকর্তাদের জবাবদিহি করতে পারবে সে জন্য তথ্য অধিকার আইন একেবারে স্থানীয় সরকার পর্যায়ে প্রয়োগ করা উচিত।৩৫

তবে বিকেন্দ্রীকরণ দুভাবে হতে পারে। নিচের দিক থেকে চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে, যেমন নাগরিকদের চাপ। আবার ওপরের দিকে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে তাদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব/নিয়ন্ত্রকের ক্ষমতা কিছুটা বিসর্জনের মাধ্যমেও এটা হতে পারে। স্থানীয় সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে রাজনৈতিক নেতৃত্ব বেশ লম্বা সময় ধরে অনিচ্ছুক ছিল।৩৬ যদি কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ক্ষমতা ছাড় দিতে রাজি হয়, তবে এটি স্থানীয় সরকারের কাছে তার মাধ্যমে বরাদ্দকৃত সম্পদ দিয়ে দুর্নীতিমুক্ত ক্রয় সেবা ও উন্নয়ন প্রকল্প নিশ্চিত করতে পারে।

নির্বাচনী প্রচারাভিযানের অর্থায়নে সংস্কার

নির্বাচনী গণতন্ত্র বা অর্ধগণতন্ত্রে, যে প্রধান কারণে রাজনীতিবিদদের সম্পদে প্রবেশাধিকার দরকার—সম্পদ বাড়ানো ও নিজের বৈধ প্রয়োজন মেটানোর বাইরে বা বৈধভাবে অর্জন করা সম্পদের বাইরে—তা হলো নির্বাচনী ব্যয় মেটানোর জন্য। দুধরনের ব্যয় রয়েছে। একটি হচ্ছে বছরজুড়ে রাজনৈতিক দলগুলোর অর্থায়ন, যার মধ্যে রয়েছে অফিসের ব্যয় নির্বাহ ও কর্মীদের বেতন-ভাতা প্রদান, ভ্রমণ খরচ, প্রচারণা খরচ, সভার খরচ ইত্যাদি মেটানো; দ্বিতীয়টি, নির্বাচনী প্রচারাভিযানের জন্য ব্যয়, যাতে রয়েছে ভোটারদের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তর, এতে আবার রয়েছে নির্বাচনী প্রার্থীদের ভ্রমণ ও সভার খরচ। এ ছাড়া নির্বাচনী ব্যয়ের কিছু অদৃশ্য কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ব্যয় রয়েছে, যেমন কেন্দ্রীয় তহবিলে চাঁদা নির্বাচনী মনোনয়ন নিশ্চিতের জন্য।

একটি হিসাব থেকে দেখা গেছে, ২০৩০ সালের শুরুতে একজন প্রার্থীকে গড়ে খরচ করতে হতো প্রায় ৫০ মিলিয়ন টাকার মতো।৩৭ যদি না প্রার্থী বেশ বড় রকমের ধনী হয়ে থাকে তবে নির্বাচনী ব্যয়ের এই বড় অংশ তার ব্যক্তিগত সম্পদ থেকে মেটানো কঠিন হয়ে পড়ে। যদি সে কোনো শুভাকাঙ্ক্ষীর কাছ থেকে অর্থ নিয়ে থাকে তবে নির্বাচিত হলে সে সরকারি সম্পদ থেকে তার দায় মেটানোর চেষ্টা করে। যদি সংসদের অধিকাংশ সদস্যই বণিক ও শিল্পপতিদের প্রতিনিধি হয়ে থাকে, তবে তারা সরকারি সম্পদের প্রবেশাধিকার পেতে সরকারি চুক্তি সম্পাদনে পরোক্ষভাবে অংশ নিতে পারে। আর অন্যরা তাদের শুভাকাঙ্ক্ষীদের সরকারি চুক্তি ও ক্রয়াদেশে প্রবেশাধিকার পাইয়ে দেওয়ার মাধ্যমে তাদের ব্যয় উঠিয়ে নিতে পারে। সরকারি খাত থেকে স্থানান্তরিত অর্থ, যা নির্বাচনের কাজে ব্যয় হয় তা মূলত বেসরকারি কাজে ব্যয় হয় না। কারণ নির্বাচনী ব্যয় ও দলের জন্য ব্যয় প্রধানত বিভিন্ন পণ্য ও সেবার জন্য চলতি হিসাবের মধ্যে পড়ে। যেহেতু কোনো নির্দিষ্ট খাতে ব্যয় না হয়ে এই ব্যয়গুলো হয় অসংখ্য খাতে, তাই জনগোষ্ঠীর বিপুল অংশ এই ব্যয়ের কারণে উপকৃত হয়ে থাকে।

এটি খতিয়ে দেখার দরকার যে সরকারি অফিস/ক্ষমতা অপব্যবহারের মাধ্যমে আত্মসাত্কৃত অর্থ সরাসরি এবং দক্ষভাবে নির্বাচনী ব্যয়ে খরচ করা সম্ভব হতো কি না। দক্ষভাবে সরকারি অর্থ খরচ করে নির্বাচনী ব্যয় মেটাতে হলে একমাত্র দুটি বিষয় বিবেচনা করতে হবে। একটি নির্বাচনী প্রচারাভিযানের সঙ্গে সম্পর্কিত। এ ধরনের ব্যয় কমানোর জন্য কী কী সুযোগ রয়েছে? বর্তমানে নির্বাচন কমিশন প্রার্থীদের ক. ব্যয় বিবরণী দাখিল করতে বাধ্য করেছে এবং খ. ব্যয়ের সীমা বেঁধে দিয়েছে। তবে ব্যয়ের এই বাধ্যবাধকতা প্রয়োগ করা যায় না, কারণ প্রার্থীরা অতিরিক্ত ব্যয় করে থাকে এবং ব্যয় অনেক কম দেখিয়ে বিবরণী দাখিল করে। এ কারণে ব্যয়ের সর্বোচ্চ সীমা অপ্রয়োজনীয় এবং বাদ দেওয়া উচিত। তবে প্রার্থীদের অবশ্যই ব্যয়ের বিস্তারিত বিবরণ দাখিল ও মিডিয়ায় তা প্রকাশ করা উচিত। নির্বাচন কমিশন বরং যতটা সম্ভব যেসব জায়গায় এসব ব্যয় করা যাবে না তা নির্দিষ্ট করে দিতে পারে। এটি প্রার্থীকে গ্রহণযোগ্য ব্যয়ের সীমা নির্ধারণে স্বাধীনতা দেবে। যা দেখে মানুষ নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেবে প্রার্থী ঠিক কী পরিমাণ ব্যয় কম দেখাচ্ছেন। ভোটারদের প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় একটি প্রাথমিক ধারণা রয়েছে প্রার্থীদের নির্বাচনী ব্যয়ের ব্যাপারে। যদিও তাঁদের ধারণার পরিমাণটি সঠিক না-ও হতে পারে, তারপরও যেসব জায়গায় ব্যয় কম দেখানোর সুযোগ রয়েছে সেসব জায়গার ব্যাপারে তাঁরা ধারণা দিতে পারেন। মিডিয়াও এসব ব্যয়ের ব্যাপারে আলোচনা ও তাদের মতামত দিতে পারে। অনুসন্ধানী সাংবাদিক ও সিভিল সমাজের প্রতিনিধিরা বিভিন্ন উত্স থেকে তথ্য সংগ্রহ করে নির্বাচনী ব্যয়ের ব্যাপারে জরিপ পরিচালনা করতে পারেন ও তা প্রকাশ করতে পারেন। নির্বাচনী প্রার্থীর সব আর্থিক তথ্যের আলোকে তার ব্যয় বিবরণীর সত্যতা যাচাইয়ের জন্য একটি স্বাধীন বোর্ড থাকতে পারে। এসব ব্যয়ের সমন্বিত প্রভাব এসব ব্যয়ের ওপর প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করতে পারে।

নির্বাচনী প্রচারাভিযানে অর্থায়নের দ্বিতীয় ব্যাপারটি নির্বাচনী প্রচারাভিযানে সরকারি অর্থায়নের বিভিন্ন পন্থার বাছাইয়ের সঙ্গে জড়িত। সরকার এ ধরনের সাম্প্রতিক ব্যয় যাচাই করে প্রত্যেক প্রার্থীর জন্য একটি গড় ব্যয় ধার্য করে দিতে পারে। অথবা প্রার্থীর নির্বাচনী দলের কাছে টাকা দিতে পারে, যেন দল মনোনীত প্রার্থীদের নির্বাচন করার জন্য টাকা দিতে পারে এই শর্তে যে প্রার্থী কত টাকা অনুদান পেলেন তা তিনি প্রকাশ করবেন। অর্থায়নের এই অনুদান নির্ভর করতে পারে সর্বশেষ সংসদে দলটির প্রতিনিধিত্ব কেমন ছিল তার ওপর।৩৮ এ ধরনের অর্থায়নের জন্য সরকার আংশিকভাবে সম্পদ সংগ্রহ করতে পারে বাজেটের সম্পদ থেকে এবং আংশিকভাবে নির্ভর করতে পারে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অবদানের ওপর। এ জন্য এসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে কর সুবিধা দেওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া এসব ব্যক্তি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন দলের নির্বাচনী তহবিলে কোনো প্রার্থী ও ব্যক্তিগত নির্বাচনে অর্থায়নের জন্য অনুমতি দেওয়া যেতে পারে এই শর্তে যে এই ধরনের অনুদান বা অবদান নির্বাচন কমিশনকে জানাতে হবে এবং কমিশন তা জনসমক্ষে প্রকাশ করবে।

তবে এই নির্বাচনী ব্যয় অর্থায়নের জন্য অন্য কোনো উপায়ও বের করতে পারে। এটি কোনো রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজস্ব ভিত্তি ও বিনিয়োগ তহবিল গড়তে, যেমন সামরিক বাহিনী সংস্থা, সুযোগ করে দেবে যা বিভিন্ন ধরনের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মালিক হওয়ার জন্য তাদের পথ সুগম করে দেবে। লাভজনক প্রতিষ্ঠান শুরু করার/কেনার জন্য রাষ্ট্র এসব দল বা বিনিয়োগ তহবিলে প্রাথমিক পুঁজির জোগান দিতে পারে। এটি খুবই সম্ভব যে পার্টি ফাউন্ডেশন এ ধরনের ব্যাংক, জীবন বিমা কোম্পানির মালিক হতে পারে। এসব লাভজনক সম্পদের মালিক পার্টি ফাউন্ডেশন/বিনিয়োগ তহবিল তাদের আয়/লাভ থেকে সরকারি সম্পদে অবদান রাখতে পারে, যা নির্বাচনী অর্থায়নে খরচ হবে। তবে আরও বিশ্লেষণ ও বিভিন্ন পর্যায়ে পরীক্ষার মাধ্যমে কার্যকর ও যথাযথ সমন্বিত-নির্বাচনী-অর্থায়ন ব্যবস্থা নির্ধারণ করা সম্ভব। তবে এটি অপরিহার্য যে, যে পন্থাই বাছাই করা হোক না কেন তা যেন স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করে। তবে মূল লক্ষ্য হচ্ছে, যতটা সম্ভব নিশ্চিত করা নির্বাচনী প্রচারণার এই ব্যবস্থায় প্রার্থী যেন কোনোভাবেই সরকারি ক্ষমতা অপব্যবহারের মাধ্যমে সম্পদ জোগাড় না করে এবং দুর্নীতির ব্যাপকতা যেন কমে। তবে এ ধরনের ব্যবস্থা সিদ্ধান্ত গ্রহণের সঙ্গে যাঁরা জড়িত অথবা ক্ষমতায় যাঁরা বসে আছেন তাঁদের আখের গোছানোর লোভ কমাবে না। বরং এটি নির্বাচনী গণতন্ত্রে বহুল পরিচিত দুর্নীতির একটি কারণ এড়ানোর দিকে একটি পদক্ষেপ।

একটি কার্যকর দুর্নীতি দমন কমিশন

২০০৪ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন সাম্প্রতিক সময়ে সরকারের দুর্নীতি দমনবিরোধী কার্যক্রমের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বিস্তারিত পরিশিষ্ট (গ)-তে দেওয়া আছে। তবে চ্যালেঞ্জটি হচ্ছে শুধু আইনের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে এটিকে কার্যকর করা। এর জন্য দরকার ক. এটিকে নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত রাখা, খ. আর্থিক সম্পদ ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর দিক থেকে এটিকে স্বাধীন রাখা, গ. কর্মচারী নিয়োগের বেলায় এটিকে স্বাধীন রাখা, ঘ. এটির পরিচালনা ও তদন্তের কাজে যথেষ্ট স্বাধীনতা বজায় রাখা। জনগণের সামনে এই কমিশনকে মুক্ত ও এর একাত্মতা তুলে ধরতে হলে এর স্বাধীনতা বজায় রাখতে হবে।৩৯

একেবারে শুরু থেকে দুর্নীতি দমন কমিশন রাজনৈতিক ও কৌশলগত সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে। অস্পষ্ট দায়িত্ব, দুর্বল নেতৃত্ব, দুর্বল তদন্তের সামর্থ্যে ভুগেছে, যা প্রকারান্তরে এর স্বাধীনতা ও আইন অনুযায়ী চলার সামর্থ্যকে ব্যাহত করেছে।৪০ এটির কর্মচারী অপর্যাপ্ত। তার ওপর অধুনা বিলুপ্ত দুর্নীতি দমন ব্যুরোর কর্মচারীদের নতুন কমিশনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে যাচাই-বাছাই ছাড়াই। যদিও এই ব্যুরোর অদক্ষতা ও একাত্মতার অভাবের কারণে বেশ দুর্নাম ছিল। নিজস্ব বাজেট তৈরির ব্যাপারে এই কমিশনের কোনো স্বাধীনতা নেই। নির্বাহী বিভাগ শুধুই বাজেট নির্ধারণ করে দেয় না, আরও ঠিক করে দেয় কোন কোন খাতে বাজেটের অর্থ ব্যয় করতে হবে। উচ্চ আদালতে এর সিদ্ধান্তগুলোকে বেশ কয়েকবার প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। দুর্নীতি চিহ্নিত করা ও এর তদন্ত কখনোই দুর্নীতির জন্য শাস্তির ঝুঁকি বাড়াবে না, যদি জটিল আইনি লড়াই চালিয়ে নেওয়ার জন্য যথাযথ কোনো প্রক্রিয়া না থাকে, সীমিত সামর্থ্য ও তুখোড় আইনি জ্ঞানের অভাব থাকে।৪১

ওপরে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের যেসব উপায় তুলে ধরা হয়েছে তা করা হয়েছে মূলত ক. জননীতি এবং উন্নয়ন কার্যক্রমে স্বচ্ছতা এবং একই সাথে খ. ক্ষমতা প্রয়োগে ও সরকারি সম্পদ ব্যবহারে সরকারি কর্মকর্তাদের জবাবদিহি নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে। চূড়ান্ত বিশ্লেষণে দুর্নীতি দমন পন্থাগুলোর কার্যকারিতা নির্ভর করছে সার্বিক শাসনের গুরুত্বের ওপর। এটি নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ যে অর্জনের চেষ্টা যেন কখনোই ভালোর শত্রু হয়ে না দাঁড়ায়। দুর্নীতির নিয়ন্ত্রণ একটি শ্লথ প্রক্রিয়া এবং এতে নিরলস ও টেকসই প্রয়াসের দরকার। জাগ্রত মানুষের সদা নজরদারি দুর্নীতি কমাতে গিয়ে যে উন্নতি ঘটছে তারই মূল্য।

৪. পরিবর্তনের চালকেরা

অভ্যন্তরীণ চাপ ‘নিচ থেকে ওপরে’ অথবা ‘ওপর থেকে নিচে’

এসব পারিপার্শ্বিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেই দুর্নীতিবিরোধী বিভিন্ন পন্থা বাংলাদেশে বাস্তবায়িত হবে। এ ধরনের অনেক পন্থাই অতীতে আলোচনা করা হয়েছে। এ ধরনের জ্ঞানের প্রয়োগ পর্যাপ্ত না। দরকারি প্রশ্নটি হচ্ছে, পরিবর্তনের চালকেরা কারা। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, পরিবর্তনের চালকেরা উঠে আসতে পারে ‘নিচ থেকে ওপর’ বা ‘ওপর থেকে নিচ’ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। বাইরের অবস্থা এই পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে পারে। কিছু সুনির্দিষ্ট অবস্থায় ভেতরের ও বাইরের পারিপার্শ্বিকতা পরস্পরের অবদানকে জোরালো করে এই অবদানে ভূমিকা রাখতে পারে।৪২ জনগণের মাঝে ব্যাপক সচেতনতা থাকতে পারে। সচেতন জনগোষ্ঠীর সাধারণ জনগণ ছাড়াও বিভিন্ন নাগরিক গোষ্ঠী রয়েছে, যারা দুর্নীতির ব্যাপকতার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এ সমস্যার চিহ্নিতকরণ ও সংজ্ঞায়ন যেকোনো দুর্নীতিবিরোধী ব্যবস্থার প্রথম পদক্ষেপ। বাংলাদেশে যথেষ্ট পরিমাণে মিডিয়া রিপোর্টের কারণে এবং দুর্নীতির মাত্রার ওপর গভীর জরিপের কারণে, যা করা হয়েছিল সিভিল সমাজ, থিংক ট্যাংক ও আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে, দুর্নীতির সমস্যা নিয়ে ব্যাপক সচেতনতা রয়েছে। এ অবস্থায় দুর্নীতির ওপর কার্যকর আক্রমণে দরকার ক. দুর্নীতি দমন প্রচেষ্টার প্রতি দায়বদ্ধ একদল রাজনৈতিক নেতা এবং খ. সমাজের এক উল্লেখযোগ্য অংশ যেমন: সিভিল সমাজ, ব্যবসায়ী সংগঠন, জনগণ যারা দুর্নীতিবিরোধী প্রচারাভিযান চালাতে তৈরি।৪৩ যদি সামনের দিকের রাজনৈতিক নেতারা দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে ঐক্যবদ্ধ না হন অথবা নিজেরাই দুর্নীতিগ্রস্ত হন, তবে নিচের সারির নেতারা দুর্নীতির দিকে ঝুঁকে পড়েন। যখন নেতারা/নির্বাচিত রাজনৈতিক নেতৃত্ব দুর্নীতির প্রতি নির্লিপ্ত থাকেন অথবা নিজেরা দুর্নীতিতে অংশ নেন, তখন আমলাতন্ত্রে দুর্নীতি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কম হয়।৪৪

শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণি—দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন

তবে পরিবর্তনের এই চাপ ‘নিচ থেকে ওপর’—এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েও উদ্ভূত হতে পারে। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের চাপ বা শুরুটা ‘নিচ থেকে ওপর’ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে উঠে আসা দরকার। বড় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির দরকার যারা অধিকাংশ সমাজে এবং সময়ে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের ইঞ্জিন হিসেবে কাজ করেছে।৪৫

তারা সিভিল সমাজ, থিংক ট্যাংক ও নানা ধরনের উদ্বিগ্ন নাগরিক গোষ্ঠীর মাধ্যমে ভূমিকা পালন করে। বারবার দেখা গেছে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব উঠে এসেছে এই শ্রেণি থেকে আর মধ্যবিত্ত শ্রেণির সমর্থন তার ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে। রাজনৈতিক প্রতিবাদ/আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে গরিবদের দ্বারা নয়, বরং তাদের দ্বারাই যাদের গড় আয় ও শিক্ষা তুলনামূলকভাবে গরিবদের থেকে বেশি। গরিবেরা যখন তাদের দৈনন্দিন বাঁচার সংগ্রামে লিপ্ত, মধ্যবিত্তরা তখন রাজনৈতিক আন্দোলনে ব্যস্ত নিজেদের পথ বের করার জন্য।

বর্ধিষ্ণু শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির তরুণ প্রজন্ম থেকেই পরিবর্তনের গতির সূচনা হয়। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে যাদের জন্মহার বেশ বেশি, একটি সময় পর সেসব দেশে মোট জনসংখ্যায় কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যার (১৫-৪৫ বছর) অনুপাত অনেক বেশি হয়ে যায়। এই তরুণ জনগোষ্ঠীর, যাদের চিহ্নিত করা হয় ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড হিসেবে, অর্থনৈতিক প্রভাব ছাড়াও রয়েছে রাজনৈতিক প্রভাব। মধ্যপ্রাচ্য ও ব্রাজিলে ঘটে যাওয়া পরিবর্তনের আন্দোলনে নেতৃত্বে ছিল মূলত এই তরুণেরাই, বিশেষ করে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও বেকার তরুণেরা। বয়স্ক জনগোষ্ঠীর তুলনায় তুলনামূলকভাবে তাদের মধ্যে ঝুঁকি এড়ানোর প্রবণতা কম; আবার প্রত্যাশা বেশি থাকায় এবং কাজের ও রোজগারের সুযোগ বেশি থাকায় তারা বারবার হতাশ হয়ে পড়ে। নতুন ধরনের তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক বিস্তারের ফলে এখনকার তরুণেরা অন্য দেশের উন্নয়নের অংশ। তার ওপর তথ্যপ্রযুক্তির নানা মাধ্যম যেমন স্মার্টফোন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদেরও সহজ প্রবেশাধিকার থাকায় তারা খুব সহজেই বড় আকারের আন্দোলন করার ক্ষমতা রাখে। এ ছাড়া তারা ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির ব্যাপারে সচেতন, দুর্নীতির ব্যাপারেও তাদের রয়েছে সর্বনিম্ন মাত্রার সহ্যক্ষমতা তাদের চেয়ে বয়স্ক লোকের তুলনায়, আচরণে যারা রক্ষণশীল এবং দুর্নীতির সুবিধাভোগী হওয়ায় যাদের এর সঙ্গে আপস করার দৃষ্টান্তও রয়েছে।

এ ধরনের পরিবর্তনের গতির দরকারি পূর্বশর্ত হচ্ছে প্রথমত একটি বৃহত্ মধ্যবিত্ত শ্রেণি থাকতে হবে; দ্বিতীয়ত এই শ্রেণির অবস্থান শহরে হতে হবে; তৃতীয়ত, এ শ্রেণিকে শিক্ষিত হতে হবে যতক্ষণ পর্যন্ত না শহুরে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেণি মোট জনসংখ্যার বৃহত্ অংশে পরিণত হচ্ছে। ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের দুর্নীতিগ্রস্ত অবস্থায় অংশ নিতে প্রণোদনা দেওয়া যায়। দুর্নীতিগ্রস্ত এই ব্যবস্থায় তারা স্বজনপ্রীতি, পক্ষপাত ও ঘুষের মাধ্যমে ছোট-বড় নানা ব্যবসায়িক সুবিধা পায় এবং এর ফলে সরকারি ও বেসরকারি খাতের সম্পদ ভোগ করার সুযোগ তৈরি হয়। আর এই ব্যবস্থায় শক্তিশালী নেতৃত্ব থাকায় তারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোনো সম্মিলিত পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়। এ অবস্থায় দেশজুড়ে কোনো শক্তিশালী আন্দোলন হওয়ার সম্ভাবনা কম। তবে পুরো ব্যবস্থাটি একটি পড়ন্ত অবস্থায় গিয়ে পৌঁছায় যখন রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যথেষ্ট সম্পদ ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা থাকে না উদীয়মান শ্রেণির বাড়ন্ত প্রত্যাশা মেটানোর। ফলে, আন্দোলন শহুরে মধ্যবিত্ত তরুণ থেকে অসন্তুষ্ট শহুরে বস্তিবাসীর মাঝে ছড়িয়ে পড়ার কারণে সমাজের সব অংশে পরিবর্তনের গতির সঞ্চার হয়।

এই আর্থসামাজিক পরিবর্তনের জন্য আন্দোলনের জায়গাটি বেশ কিছু বিষয়ের জন্য বাংলাদেশে অনুপস্থিত। প্রথমত বর্তমানে যে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি রয়েছে তারা মোট জনসংখ্যায় এমন শহুরে জনগোষ্ঠীর বিচারে সেভাবে বেড়ে ওঠেনি। আর তা ছাড়া শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণির আকারই শুধু নয়, এই শ্রেণির শিক্ষার অবস্থানও তেমন উঁচু অবস্থানে নেই যে এটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আর গত দুই-তিন দশকে বাংলাদেশ শুধু মাথাপিছু আয় বাড়াতেই সক্ষম হয়নি বরং ধারাবাহিকভাবে তার দারিদ্র্য, শহুরে ও গ্রামীণ, উভয়ই কমাতে সক্ষম হয়েছে। যদিও আয়ের অসমতা ক্রমেই বাড়ছে, তবে খালি চোখে তার ধরা পড়ার দৃশ্য আর প্রকোপ শহরে এমনকি দেশের সার্বিক বিচারে সমাজে গ্রহণযোগ্য মাত্রা ছাড়িয়ে যায়নি। ২০০০-২০১০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে মাথাপিছু গড় ভোগ্য ব্যয় প্রতিবছর গড়ে ২ শতাংশ হারে বেড়েছে। একই সময়ে দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা মানুষের সংখ্যা ২০০০ সালে ৪৮.৯ শতাংশ থেকে কমে ২০১০ সালে ৩১.৫ শতাংশ হয়েছে। ২০০০ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে আয়ের অসমতা বেড়েছে ০.৩০৭ শতাংশ থেকে ০.৩১০ শতাংশে । ২০০৫ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে তা ০.৩১০ শতাংশ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ০.২৯৯ শতাংশে।৪৬ এটি নির্দেশ করে বিভিন্ন আয় গোষ্ঠীর মধ্যে ভোগ ব্যয় কমবেশি বেড়েছে। এটিও বেশ আগ্রহোদ্দীপক পর্যবেক্ষণ যে ২০০০ থেকে ২০১০ সালের মাঝে বিভিন্ন আয় গোষ্ঠীর মধ্যে মাথাপিছু ভোগ্য ব্যয়ের পার্থক্য কমবেশি এক। ওপরের দিককার ১০ শতাংশ মানুষের আয় নিচের দিককার ১০ শতাংশ মানুষের গড় ভোগ ব্যয়ের পার্থক্য ২০০০ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে কমে গিয়েছিল আবার ২০০৫ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে তা বেড়ে গিয়েছিল। ওপরের দিককার ৫০% আর নিচের দিকের ১০% মানুষের ভোগ ব্যয় তুলনা করে একই ট্রেন্ড পর্যবেক্ষণ করা গিয়েছিল। অন্যান্য ব্যয় গোষ্ঠীর জন্য মাথাপিছু ভোগ ব্যয় একই রকম রয়ে গেছে।৪৭ এ কারণে মধ্য আয়ের গোষ্ঠী ও ধনীদের মাঝে পার্থক্য তেমন বাড়েনি। আর তাই শহুরে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি মোট শহুরে জনগোষ্ঠীর তুলনায় সেভাবে বাড়েনি আর তার অর্থনৈতিক অবস্থাও স্থাবর হয়ে পড়েনি অথবা ধনীদের তুলনায় তার অবস্থান খারাপের দিকে যায়নি। এ কারণে মধ্যবিত্ত শ্রেণি বর্তমান হারের আয়-প্রবৃদ্ধি ও আয় বণ্টন থেকে যে সুবিধা পাচ্ছে তা এখন পর্যন্ত তাদের কাছে অগ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়নি।

এ ছাড়া সবার আয় যখন বেড়ে গেছে আর ঘুষ, স্বজনপ্রীতি ও পক্ষপাতের মাধ্যমে যখন দুর্নীতির ফল শহুরে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেণির সঙ্গে ব্যাপকভাবে ভাগ করে নেওয়া যাচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত বর্তমান অবস্থার প্রতি এ শ্রেণির যেকোনো পরিবর্তনের দাবিকে ঠেকিয়ে রাখা যাচ্ছে। ১৯৯১ সাল থেকে পর্যায়ক্রমিক নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারের পালাবদল আর মধ্যবিত্ত গোষ্ঠীর বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর সম্পৃক্ত হওয়ার কারণে প্রবৃদ্ধি ও দুর্নীতির ভাগ ব্যাপকভাবে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মাঝে বণ্টন হচ্ছে।৪৮ রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রয়োগ আর অর্থনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ও সম্পদের প্রবেশাধিকার চালকসমূহের নিয়ন্ত্রণকারী মধ্যবিত্ত শ্রেণির গঠনে পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তন দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থার ফল ব্যাপকভাবে বণ্টনে ভূমিকা রাখছে। এমনকি তরুণ ছাত্র, যাদের মাঝে রয়েছে বেকারেরাও, কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত। স্বাধীনতার আগে ও পরে বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক বিবর্তনে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের ব্যবহার করেছে গণজমায়েত আয়োজনে।৪৯ সরকারি খাতের চাকরিতে নিয়োগ-প্রক্রিয়া আর সরকারি ক্রয়, চুক্তি ও ব্যবসায়িক টেন্ডারে রাজনৈতিক বিবেচনা ও বরাদ্দ, দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থা ও অপশাসন বদলে দেওয়ার জন্য তরুণদের আকাঙ্ক্ষাকে দুর্বল করে দিয়েছে। তরুণদের ভেতর উগ্র গোষ্ঠীগুলো এই সুযোগগুলো থেকে সুবিধা আদায় করছে চাঁদাবাজির মাধ্যমে আর ব্যবসায়ী ও ঠিকাদারদের কাছ থেকে ‘সুরক্ষা অর্থ’ আদায় করে।

ক্ষমতার পালাবদলের অন্যথা ঘটলে, যদি ক্ষমতাহীন শ্রেণির পালাবদল না ঘটে এবং একটি রাজনৈতিক দল দীর্ঘ সময়ের জন্য ক্ষমতায় থাকে, তবে উদ্ভূত পরিস্থিতি বেশ অস্থিতিশীল হয়ে পড়তে পারে। সাধারণভাবে, বিভিন্ন জায়গার অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, যদি অর্থনৈতিক অচলাবস্থা বা বড় আয় অসমতার কারণে অর্থনৈতিক অবস্থা পড়ে যাওয়ার ফলে মধ্যবিত্তের পিঠ দেয়ালে ঠেকে না যায়, তবে প্রতিটি সমাজে মধ্যবিত্তের মাঝে বড় ধরনের পরিবর্তনের জন্য সোচ্চার হওয়া থেকে বিরত থাকার প্রবণতা রয়েছে। কারণ এ ধরনের কোনো নিশ্চয়তা নেই যে বিদ্যমান অবস্থার সুবিধাভোগীদের জন্য পরিবর্তনের আন্দোলন পরিবর্তনের প্রতিরোধকে পরাজিত করতে সক্ষম হবে। তার ওপর এ ধরনের পরিবর্তনের ফল কী হবে তা আগে থেকে অনুমান করা যায় না। এর সঙ্গে অনেক অপ্রত্যাশিত ফলাফলও জড়িত। আর যদি পরিবর্তনের চাপ সফল হয়ও, পরিবর্তনের ফলে মধ্যবিত্ত যে সুফল পাচ্ছে তা হয়তো বিদ্যমান অবস্থায় তারা যে সুফল পাচ্ছে তার বেশি না-ও হতে পারে। কাজেই এ ধরনের হঠাত্ অথবা বড় ধরনের পরিবর্তন অথবা রাজনৈতিক শক্তির ক্ষমতার পালাবদলের সুবিধা যখন অনিশ্চিত, তখন স্বল্প মেয়াদে এ ধরনের পরিবর্তনের কারণে কী কী মূল্য দিতে হতে পারে তাই জরুরি হয়ে ওঠে। এর ফলে ক্ষমতায় যারা আছে তারা কর্তৃত্বপরায়ণ হলেও এ শ্রেণি তাদের সঙ্গে আপস করে; এটি তাদের কাছে নিজেদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিশ্চিতে সর্বোত্তম ব্যবস্থা বলে প্রতীয়মান হয়, আর একই সঙ্গে তারা ব্যক্তিগতভাবে অথবা ছোট ছোট দলে এমন একটি ব্যবস্থার কাছে নিজেদের বিক্রি করে, যা তাদেরই পুরস্কৃত করে যারা জানে ভেতরের খবর রেখে কীভাবে এখানে খেলতে হয়। তারা পণ্যমূল্য কম দেখিয়ে লাভ বিদেশে পাচার করে। অনেক ক্ষেত্রে তাদের পরিবারের সদস্যরাই আমদানিকারক হিসেবে কাজ করে এবং এ কারণে তারা নিজেদের কাছেই রপ্তানি করে আমদানিকারকের লাভটাও পায়। এ ক্ষেত্রে তাদের মুনাফা দেশে পুনরায় বিনিয়োগ না হয়ে বিদেশের আবাসন খাতে বা বাণিজ্য উদ্যোগে বিনিয়োগ করা হয়।

এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, কেন বাংলাদেশে লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর মতো স্বল্পস্থায়ী ও বিচ্ছিন্ন দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন লক্ষ করা যাচ্ছে না। ২০১৩ সালের শুরুতে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার শাহবাগে অনুষ্ঠিত হওয়া শাহবাগ আন্দোলন ছিল বাংলাদেশের প্রথম সংগঠিত যুব আন্দোলন, যা স্বল্পস্থায়ী ও সংক্ষিপ্ত ছিল এবং এটি মূলত ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের

ফাঁসির দাবিতেই সীমাবদ্ধ ছিল। অপশাসন বা দুর্নীতি দাবিদাওয়ার মধ্যে ছিল না। আর তাই দুর্নীতির ব্যাপারে সচেতনতা থাকা সত্ত্বেও শিক্ষিত, শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণি ও ছাত্রদের মধ্য থেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোনো সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।

ছোট, শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রতিবাদ ও রাস্তার সমাবেশের দ্বারা গড়ে ওঠা এই আন্দোলনের সাফল্যের বিরুদ্ধে আরেকটি কারণ কাজ করছিল। দরকারি প্রশ্নটি হলো দেশজুড়ে গণ-আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য এ ধরনের জমায়েত যথেষ্ট ব্যাপক ছিল কি না। একা একা এ ধরনের আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ কোনো সংস্কারসাধনে খুব কমই সফল হয়, যদি শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণি জনগণের বড় অংশের সঙ্গে অথবা বাকি অংশের সঙ্গে জোট না গড়ে তোলে। একটি বৃহত্ জোট গড়ে তোলার জন্য কৃষক ও মজুর শ্রেণির কাছে পৌঁছানোর দক্ষতা অনেক সময়ই তাদের থাকে না। তারা প্রায়ই বিভক্ত থাকে এবং তাদের কোনো নেতা থাকে না যে বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠীকে এক ছাদের তলায় এনে নতুন রাজনৈতিক দল তৈরি করে নির্বাচনে লড়ার নেতৃত্ব দেবে। এ ধরনের আন্দোলনের সফলতা নির্ভর করে এমন একজন নেতার ওপর যিনি একটি জোট তৈরি করতে পারেন, যা যথেষ্ট বড় হবে পরিবর্তনের দিকে আন্দোলনকে ধাবিত করার জন্য।৫০

প্রতিবার ক্ষুদ্র পদক্ষেপ—তৃণমূল পর্যায়ের কার্যক্রম

বড় পরিবেশে দুর্নীতির এই নিরুত্সাহী অবস্থানের পরও কিছু চিন্তাবিদ ও সমাজ পরিবর্তনকারী মানুষ আছেন যাঁরা পরিবর্তনের জন্য সব আশা ছেড়ে দিতে নারাজ। তাঁরা নিম্ন পর্যায়ে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সুপারিশ করেন। তাঁরা বিশ্বাস করেন দুর্নীতি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে সিভিল সমাজের সংস্থা, যার মধ্যে বেসরকারি সংগঠন ছাড়াও রয়েছে কমিউনিটিভিত্তিক গোষ্ঠী ও সংস্থা—স্বনির্ভর গোষ্ঠী, ব্যবসায়ী ও পেশাজীবী সংগঠন, স্বাধীন নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং বিশ্বাসভিত্তিক গোষ্ঠী, গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে এবং তাদের তা করা উচিতও। এরই প্রতিফলন ঘটেছে একটি আন্তর্জাতিক উদ্যোগে যা ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে নাগরিকবৃন্দ: স্বচ্ছতার জন্য অংশীদারি’ নামে পরিচিত।৫১ এই আন্দোলন বিশ্বাস করে দুর্নীতিবিরোধী প্রচারাভিযানে সিভিল সমাজের সংস্থাগুলো দুটি প্রধান ভূমিকা পালন করতে পারে। একটি কাজ হচ্ছে দুর্নীতিবিরোধী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের, যাদের দায়িত্ব সরকারের বিভিন্ন নির্বাহী বিভাগের কাজ তদারক করা, কার্যক্রম পর্যালোচনা ও পর্যবেক্ষণ করা। এর মধ্যে রয়েছে জাতীয় দুর্নীতি দমন কমিশন, সর্বোচ্চ জাতীয় মহানিরীক্ষক, তথ্য অধিকার আইন, ন্যায়পাল ইত্যাদি। জাতীয় পর্যায়ে তারা সরকারের নীতি ও কাজের পর্যালোচনা করতে পারে; যেমন সরকারের বাজেট ব্যয়ের দিকটি জনগণের জন্য কতটা উন্মুক্ত। এসব সংস্থার জন্য দুর্নীতিবিরোধী প্রচেষ্টার দ্বিতীয় দিকটি হচ্ছে তৃণমূল পর্যায়ে দুর্নীতি প্রতিরোধে জোরালো দাবি তৈরির জন্য কাজ করা। এখানে মূল ধারণাটি হচ্ছে, পরিবর্তনের বিভিন্ন চালককে উত্সাহিত করা ক্রমশ বড় হতে থাকবে এমন একটি পরিবর্তনের সূচনা করার জন্য এবং তা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও এর সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য। স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে বিশেষ করে তৃণমূল পর্যায়ে সরকারি সংস্থাগুলো যে সেবা দিয়ে থাকে, সেখান থেকেই এই পরিবর্তন ভালোভাবে শুরু করা যায়। স্থানীয় পর্যায় সরকারি সংস্থাগুলোর সেবা কার্যক্রমে যে দুর্নীতি হয়ে থাকে তার প্রভাব সরাসরি গরিব মানুষের ওপর পড়ে। এই কাজ দুটির ফলে জনগণের সচেতনতা বাড়ানোর সুযোগ যেমন থাকছে, তেমনি তাদের একত্র করে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি তোলার সুযোগও রয়েছে। ফলে দোষী সরকারি কর্মকর্তাদের মুখোশ উন্মোচনের পাশাপাশি তাদের জবাবদিহি করার অধিকারের ব্যাপারেও জনগণকে সচেতন করা যাচ্ছে।

সিভিল সমাজের সংস্থাগুলোর জন্য এ ধরনের পদক্ষেপের প্রধান উপাদানগুলো হচ্ছে ১. স্থানীয় পর্যায়ে জনসেবায় যে দুর্নীতি হয়ে থাকে তা ভিত্তি জরিপের মাধ্যমে খুঁজে বের করা ও তার অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করা, ২. দুর্নীতির ব্যাপকতা প্রচারের জন্য স্থানীয় গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে প্ররোচিত করা; ৩. দুর্নীতির পর্যবেক্ষণ, উন্মোচন ও এর থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এবং স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন স্তরে নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার জন্য বিভিন্ন নাগরিক গোষ্ঠী যেমন: স্বেচ্ছাসেবকদের গোষ্ঠী, স্বনির্ভর দল ইত্যাদি গড়ে তোলা; ৪. স্থানীয় সেবা খাতের বিভিন্ন সুবিধা ও দুর্বলতা নিয়ে নাগরিক গোষ্ঠীর সঙ্গে সমাজকর্মী, কমিউনিটিভিত্তিক সংগঠন, স্বেচ্ছাসেবক গোষ্ঠী, যুব সংগঠন, স্থানীয় পর্যায়ের সেবাদানকারী ও স্থানীয় সরকারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনায় সহায়তা প্রদান; ৫. গ্রাম পর্যায়ে সভা ও গণশুনানির আয়োজন করা, যেখানে সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের উচ্চ কর্মকর্তা, প্রশাসক ও সরকারি কর্মকর্তাদের আমন্ত্রণ জানানো হবে; সভা ও শোভাযাত্রা করা এবং জরিপ ও গ্রুপ মিটিংয়ে প্রাপ্ত দুর্নীতির বিস্তারিত বর্ণনা জানিয়ে উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কাছে ও মিডিয়ার কাছে চিঠি দেওয়া এবং ৬. উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা সিভিল সমাজের সংস্থার শক্তি সম্পর্কে আশ্বস্ত হয়ে চিঠির উত্তর দিলে, উচ্চ পর্যায়ের তদারককারীদের ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে সভার আয়োজন করা এবং নাগরিক গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সংলাপে বসা এবং প্রতিকার ব্যবস্থার করণীয় নির্ধারণ করা।

স্থানীয় পর্যায়ের জনগোষ্ঠীকে দ্রুত কাজে লাগানোর জন্য তাদের গণজমায়েত সফলভাবে সংগঠিত করতে চাইলে সিভিল সমাজের সংস্থাগুলোর একটি জিনিস দরকার। আর তা হলো একদল উত্সর্গীকৃত ও বিশ্বস্ত সমাজকর্মী যাদের প্রমাণ সংগ্রহ ও পর্যবেক্ষণের উদ্দেশ্যে সেবা গ্রহণকারী গোষ্ঠীর সঙ্গে কাজ করার একই সঙ্গে নাগরিকদের পাহারাদার হিসেবে নিজেদের নিয়োজিত রাখার জন্য স্বেচ্ছাশ্রমের ইচ্ছা রয়েছে। এ ছাড়া সরকারি কর্মকর্তা ও সেবা প্রদানকারীর তদারককারীদের— স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের—সহায়তা পাওয়ার এসব প্রচেষ্টার জন্য কিছু সরকারি কর্মকর্তা বা তদারককারীদের, যারা সেবা প্রদানে আগ্রহী ও উত্সাহী এবং যাদের একাত্মতা রয়েছে, চিহ্নিত করা দরকার যারা সমাজের বিভিন্ন অংশের সঙ্গে আলোচনায় বসবে এবং সেবা প্রদানের উন্নয়নের উদ্দেশ্যে ও ফিডব্যাক দেওয়ার জন্য সুবিধাভোগীদের দরকারি তথ্য প্রকাশ করবে। এই কৌশলের প্রবক্তারা জোর দিয়ে থাকে যে স্থানীয় পর্যায়ে কিছু কর্মকর্তা বা রাজনীতিবিদ রয়েছে, যারা দুর্নীতিবিরোধী ছোট পদক্ষেপের ব্যাপারে আগ্রহী।

আশা করা হয়ে থাকে যে ছোট ছোট পরীক্ষা-নিরীক্ষার সাফল্যের একটি ‘স্নো বল’ (নুড়ি আকারের ছোট ছোট বরফখণ্ড ঢালু পাহাড় বেয়ে গড়িয়ে পড়তে পড়তে বিশালাকার ধারণ করে) ইফেক্ট রয়েছে এবং তা ধীরে ধীরে অন্যান্য ক্ষেত্রেও ছড়িয়ে পড়বে। এটি বিশ্বাস করা হয় ‘নিযুত কর্মকাণ্ডের যোগফল আমাদের মোড়-ঘুরিয়ে-দেওয়া অবস্থানের দিকে নিয়ে যায়।’ একই সময়ে ছোট ছোট পদক্ষেপের এই পন্থা বড় পরিসরের প্রচেষ্টাকে সাহায্য করে, তবে এগুলো এসব প্রচেষ্টার কোনো অংশ নয়। বিরাজমান অর্থসামাজিক অবস্থা যখন প্রতিষ্ঠানগুলোতে এবং নীতিতে কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে, তখন তারা (এসব পদক্ষেপ) কোনো ধরনের কর্মকাণ্ডহীনতার চেয়ে অনেক শ্রেয়। ৫৩টি দেশে ২০০ প্রকল্প এই প্রক্রিয়ায় সফলভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে, যা স্থানীয় ও আংশিকভাবে জাতীয় পর্যায়ে দুর্নীতি প্রতিরোধে সফল হয়েছে। সময়ই বলে দেবে এ ধরনের বাড়তে থাকা সংস্কার, তৃণমূল পর্যায়ে ছোট প্রকল্পের মধ্য দিয়ে, অর্থনীতিতে ‘দুনিয়া-ওল্টানো’ পরিবর্তনের দিকে নিয়ে যাবে কি না।

ওপরের আলোচনা থেকে এটি স্পষ্ট যে বড় আকারের পরিবর্তন ঘটাতে চাইলে এবং তৃণমূল পর্যায়ে এসব বাড়তে থাকা সংস্কার-প্রক্রিয়া সফল হতে হলে একগুচ্ছ কঠোর শর্ত দরকার: যেমন যথেষ্ট যোগ্যতা ও একাত্মতা আছে এমন এনজিও নেতার প্রাপ্যতা, সেবার প্রতি উত্সর্গীকৃত এবং একাত্মতা রয়েছে এমন সরকারি কর্মকর্তার প্রাপ্যতা, একটি ইচ্ছুক ও সহযোগী সরকার যারা এনজিওগুলোর যথেষ্ট কাজের স্বাধীনতা দেবে এবং অর্থায়নের স্বাধীন উত্স নিশ্চিত করবে, যাদের মধ্যে রয়েছে বৈদেশিক সহায়তাও, যা আন্তর্জাতিক সিভিল সমাজের বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে দেওয়া হবে এবং যা দাতাদের নীতির সঙ্গে সম্পর্কহীন। বাংলাদেশে যখন বেশ কিছুসংখ্যক এনজিও রয়েছে যারা সেবা ও উত্পাদন খাতে সেবা প্রদানে নিয়োজিত, যাদের কারও কারও আন্তর্জাতিক সুনাম রয়েছে, তাদের অধিকাংশই সেবা প্রদানকারী অথবা ঠিকাদার হিসেবে সরকারি তহবিল অথবা দাতাদের সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। তাই তাদের দুর্নীতি দমন প্রচেষ্টার নেতৃত্ব দিতে প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। সরকারি সংস্থার সেবা প্রদানের অনুপুঙ্খ জরিপ, পরিবেশ, নারীর অধিকার, মানবাধিকার ইত্যাদির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু ছোট এনজিও পর্যবেক্ষক ও পাহারাদারের ভূমিকা পালন করে থাকে। তবে তাদের সম্পদ বেশ কম এবং তারা বেশি করে দাতাদের সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। তবে উপরোল্লিখিত প্রক্রিয়া অনুসরণ করে নাগরিকদের সংগঠিত করে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার করার মতো কাজ তাদের পরিধির মধ্যে নিয়ে আসা কিছুসংখ্যক এনজিওর পক্ষে সম্ভব। অর্থায়নের উেসর জন্য তাদের দরকার তাদের কার্যক্রমে পরিচিত ও আর্থিকভাবে সম্পদশালী আন্তর্জাতিক সিভিল সমাজের সংস্থাগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত হওয়া।

বাইরের চাপ

একটি গুরুত্বপূর্ণ ও যথোপযুক্ত প্রশ্ন হচ্ছে বাইরের ফ্যাক্টরগুলো ‘পরিবর্তনের চালক’ হিসেবে বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন প্রচেষ্টায় কোনো ভূমিকা পালন করতে পারে কি না। সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মাঝে দুর্নীতির ব্যাপারে সচেতনতা ও মনোযোগ অনেক বেড়েছে। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে পদক্ষেপ নিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ইচ্ছা ও সচেতনতার প্রতিফলন হচ্ছে আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত জাতিসংঘের দুর্নীতিবিরোধী কনভেনশন।৫২ এটি অংশত এ কারণে যে একটি দেশের দুর্নীতি আরেকটি দেশে প্রভাব ফেলে, কারণ এটি অন্য দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করে। অন্য ভাষায় বলতে গেলে, দুর্নীতি কোনোভাবেই সীমান্ত অতিক্রমকারী প্রভাবহীন কোনো অভ্যন্তরীণ ব্যাপার নয়। সবচেয়ে বড় উদাহরণ হচ্ছে একটি দেশের সম্পদ চুরি করে অন্য দেশে পাচার করে দেওয়া। টাকা পাচার দুর্নীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক ফল।

জাতিসংঘ কনভেনশন, যাতে বাংলাদেশ একটি স্বাক্ষরকারী দেশ, কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা নয় বরং একটি স্বেচ্ছাচুক্তি যেখানে দেশগুলোকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য জোর দেওয়া হয়েছে। দুর্নীতির সব অলিগলি নিয়েই এখানে আলোচনা করা হয়েছে এবং তাদের ব্যাপারে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থার সুপারিশও করা হয়েছে এবং একগুচ্ছ সমন্বিত মানদণ্ড, ব্যবস্থা ও নিয়ম উপস্থাপন করা হয়েছে ‘যেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আইনি ও নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা শক্তিশালী করার জন্য সব দেশ এগুলো প্রয়োগ করতে পারে’। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধারাটি দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাগুলোকে নিয়ে। এ ধারায় বলা হয়েছে, এসব সংস্থার সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের জন্য ‘ক. দরকারি সম্পদ, খ. বিশেষায়িত জনবল এবং গ. প্রশিক্ষণ তাদের প্রদান করতে হবে।’ কনভেনশন এ ধরনের প্রচেষ্টার প্রসারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সহায়তার আহ্বান জানিয়েছে। অনেক দরকারি ব্যবস্থার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু নিচে তুলে ধরা হলো:

ষ          দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি পদে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে জনবল নিয়োগ ও তাদের প্রশিক্ষণ প্রদান এবং যথাসময়ে যেখানে দরকার এসব কর্মকর্তাকে অন্যত্র বদলি করা।

ষ          নির্বাচিত সরকারি অফিসের জন্য প্রার্থীদের অর্থায়ন এবং রাজনৈতিক দলগুলোর অর্থায়নে স্বচ্ছতা আনা।

ষ          জনপ্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে স্বার্থের সংঘাত হতে পারে এমন সব উপহার বা সুবিধা, সম্পদ, বিনিয়োগ, চাকরি, বাইরের কার্যক্রম সম্পর্কে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে সরকারি কর্মকর্তাদের বিবরণী প্রদান।৫৩

ষ          যথাযথ ক্রয়-প্রক্রিয়াব্যবস্থা গ্রহণ যা স্বচ্ছতা ও প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে তৈরি এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে নির্মোহ মানদণ্ড অনুসরণ করা, যা দুর্নীতি প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।

ষ          ক্রয়-প্রক্রিয়া ও চুক্তির সঙ্গে সম্পর্কিত তথ্য জনগণের সামনে প্রকাশ করা, যার মধ্যে রয়েছে টেন্ডার আহ্বানের ও চুক্তির দরকারি ও যথোপযুক্ত তথ্য। এর ফলে টেন্ডার জমাদানকারীরা যথেষ্ট সময় পাবেন টেন্ডার তৈরি ও জমা দেওয়ার জন্য।

ষ          যথাযথ নিয়ম মেনে আবেদন করা হয়েছে কি না তা যাচাই করার লক্ষ্যে, কার্যকর অভ্যন্তরীণ পর্যালোচনার ব্যবস্থা যাতে আছে আপিল করার কার্যকর ব্যবস্থা এবং যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করা না হলে আইনি সহায়তা ও প্রতিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকারি ক্রয়-প্রক্রিয়ার সিদ্ধান্তের জন্য নির্মোহ ও পূর্বনির্ধারিত মানদণ্ড ব্যবহার করা।

ষ          ক্রয়-প্রক্রিয়ার দায়িত্বে থাকা লোকবলের বিষয়াদি যেমন কোনো সরকারি ক্রয়-প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণে আগ্রহ প্রকাশ, যাচাই-প্রক্রিয়া এবং প্রশিক্ষণ চাহিদা নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা গ্রহণ।

ষ          ক. জনপ্রশাসনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায়, কার্যক্রমে ও সংগঠনে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা। আর তা করতে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও তথ্যের সুরক্ষা বিবেচনায় নিতে হবে। খ. জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট আইনি কর্মকাণ্ডে এবং সিদ্ধান্তে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা; এবং

ষ          দক্ষ সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী কর্তৃপক্ষের কাছে জনগণ যেন তাড়াতাড়ি পৌঁছাতে পারে সে জন্য যেখানে প্রয়োজন প্রশাসনিক প্রক্রিয়া সহজ করা এবং জনপ্রশাসনে দুর্নীতির ঝুঁকির ওপর পর্যায়ক্রমিক প্রতিবেদনের মতো তথ্য প্রকাশ করা।

বর্তমান ও ভবিষ্যতের সরকারগুলো যে এই কনভেনশন বাস্তবায়নে দায়বদ্ধ তা মনে করিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে সিভিল সমাজ, থিংক ট্যাংক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কনভেনশনের ধারাগুলো ব্যাপকভাবে প্রচার করতে হবে।৫৪ নৈরাশ্যবাদীরা বলতে পারে এই ধরনের প্রচারণায় বাংলাদেশের সরকারগুলোর টনক নড়ে না। তবে জনমতকে চাঙা রাখার জন্য চাপ অব্যাহত রাখলে তাতে কোনো ক্ষতি নেই। এটি জানা নেই কখন ও কীভাবে এই মনে করিয়ে দেওয়া ও চাপ প্রয়োগ কাজে আসতে পারে। আসলে যতবারই বড় ধরনের দুর্নীতি সংঘটিত হয় মিডিয়া ও সিভিল সমাজের দরকার সরকার ও জনগণকে কনভেনশনে এসব দুর্নীতির সংশ্লিষ্ট ধারার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাদের করণীয় মনে করিয়ে দেওয়া। সরকারের ভেতরে ও বাইরে কনভেনশনের ধারা নিয়ে আলোচনা সংস্কারবাদীদের জন্য কাজ করার সুযোগ করে দেবে। দুর্নীতিবিরোধী ব্যবস্থার অগ্রগতির পর্যায়ক্রমিক পর্যালোচনা, সংস্কারপ্রক্রিয়ার পর্যায়ক্রমিক ঝুঁকি ও সমস্যা চিহ্নিত করবে।৫৫ বর্তমানে বাইরের দুটি ফ্যাক্টর বাংলাদেশকে পরিবর্তনের দিকে ধাবিত করছে: ১. বৈদেশিক সাহায্য সংস্থা এবং ২. আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক অংশীদার। উন্নত দেশগুলো বাংলাদেশে বাণিজ্য/বৈদেশিক সাহায্যে ও নানা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত এবং বৈদেশিক বিনিয়োগ কনভেনশনকে সরকারের দুর্নীতি দমনবিরোধী এজেন্ডার প্রতি দায়বদ্ধতা মূল্যায়নের মাপকাঠি হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। তারা এটিকে সরকারগুলোর সঙ্গে আলোচনার দরকারি উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।

উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের অর্থায়নে যেন কোনো ধরনের দুর্নীতি না হয় সে ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বনে উন্নত দেশের সরকারগুলো তাদের আইনপ্রণেতা ও জনমতের কাছ থেকে বেশ চাপের মুখে থাকে। এই প্রবণতা উন্নত দেশগুলোতে তুলনামূলকভাবে বেশ নতুন। দুই দশক ধরে এই প্রবণতা বাড়ছে। সাহায্য ব্যবহারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য সাহায্য সংস্থাগুলোর মাঝে উচ্চ সচেতনতা দেখা যাচ্ছে মূলত আংশিকভাবে বহু দেশের চাহিদার মুখে সাহায্য তহবিলে ঘাটতি দেখা দেওয়ার কারণে এবং আংশিকভাবে কোনো ধরনের সাহায্য চাইব এই ধরনের উদ্দেশ্য বেড়ে যাওয়ার কারণে।৫৭

ব্যাপকভাবে দেখা যাচ্ছে, দাতাদেশ/সংস্থাগুলো ক. তাদের সহায়তা কর্মসূচিতে দুর্নীতি কমাতে এবং এসব সুরক্ষা দিতে, খ. সরকারের সংস্থার উন্নয়নে সাহায্য ও উপদেশ দিতে এবং অর্থনীতিজুড়ে দুর্নীতির ব্যাপকতা কমাতে ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে। এই দুটি কারণ পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। দেশে যদি ব্যাপক দুর্নীতি থাকে তবে সাহায্যপুষ্ট প্রকল্পসমূহকে দুর্নীতির প্রভাব থেকে মুক্ত রাখা বেশ কঠিন। বাজেট সহায়তা অথবা ব্যালান্স অব পেমেন্ট সহায়তায় যেসব সম্পদ ব্যবহার করা হয় তাদের আলাদা করা যায় না। এখানে অভ্যন্তরীণ সম্পদ ও বৈদেশিক সাহায্যের ব্যবহার আলাদা করা যায় না। বাজেট সম্পদের সার্বিক ব্যবহারে, যাতে রয়েছে আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও সরকারি ব্যয়ের নিরীক্ষা, দুর্নীতির ব্যাপকতা কমাতে নজর দিতে হবে।

দ্বিতীয়ত সাহায্যপুষ্ট প্রকল্পগুলোকে দুর্নীতির প্রকোপ থেকে রক্ষা করা গেলেও, সরকারি খাতে সমন্বিত সম্পদ ব্যবহারে, যার মধ্যে রয়েছে অভ্যন্তরীণ সম্পদ, দুর্নীতি প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। সমন্বিত সম্পদ অপব্যবহার বা ভুল ব্যবহারের কারণে সাহায্যপুষ্ট প্রকল্পের উপকারী দিকগুলো কমে যায়। এ কারণে দাতা সংস্থাগুলো প্রধান প্রধান প্রতিষ্ঠান, যাতে রয়েছে বিচার, আইন রক্ষাকারী বাহিনী, জনপ্রশাসন সিভিল সমাজ, সরকারের কার্যকারিতা—যারা সার্বিক অর্থনীতির শাসনকে প্রভাবিত করে, শক্তিশালী করার জন্য সহায়তা প্রদান করে। সাহায্যগ্রহীতা দেশের উন্নয়নে দাতাদের অংশগ্রহণ যত বাড়বে, শাসনব্যবস্থার উন্নয়নে সমন্বিত সম্পদ যথাযথভাবে ব্যবহূত হচ্ছে কি না তা নিশ্চিতে তাদের উত্সাহও তত বাড়বে। একদিকে যখন ঋণদানকারী সংস্থাগুলো উদ্বিগ্ন দুর্নীতির ব্যাপারে এবং ঋণ বাতিল করে দেয় দুর্নীতি ধরা পড়লে, অন্যদিকে এসব সংস্থার মাঝে তাড়না আছে সাহায্য করার বাংলাদেশের মতো গরিব দেশগুলোকে, যাদের কারণেই তাদের তৈরি করা হয়েছে। তাই এই দুটো সাংঘর্ষিক বিবেচনার মাঝে একধরনের ভারসাম্য বজায় রাখা দরকার। আর এই সিদ্ধান্তটি ঋণদানকারী সংস্থাগুলোকে অবশ্যই নিতে হবে একটির পর আরেকটি বিষয়ের ক্ষেত্রে।৫৮ দাতা সংস্থাগুলো যেমন বিশ্বব্যাংকের বিশেষায়িত বিভাগ ‘ইন্টেগ্রিটি অফিস’ স্থাপন করেছে তাদের প্রকল্পে যেন দুর্নীতি না হয় সেটি দেখভাল করার জন্য এবং দুর্নীতি হলে তদন্ত করার জন্য। অনেক দেশে যার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশও, দুর্নীতি ধরা পড়লে বিশ্বব্যাংক ও অন্য দাতা সংস্থা প্রকল্প বাস্তবায়নের মাঝপর্যায়ে সহায়তা ছাড়ের অর্থ বন্ধ করে দিয়েছে। পৃথিবীজুড়েই বড় আকারের অবকাঠামো প্রকল্প যেমন সেতু, মহাসড়ক, রেলপথ, বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর ইত্যাদি নির্মাণ চুক্তি ও ক্রয়-প্রক্রিয়ায় সম্পদ অপব্যবহারের ও দুর্নীতির বড় ধরনের সুযোগ রয়েছে। এ কারণে সব জায়গায় বড় ব্যয় ও অবকাঠামো প্রকল্পের সম্ভাব্য দুর্নীতি দাতাদের মাঝে বড় ধরনের উদ্বেগ তৈরি করে।৫৯ এই প্রকল্পগুলো চোখে পড়ার মতো বড় এবং উন্নত দেশের ঠিকাদার ও পরামর্শক যারা ক্রয়, বাস্তবায়ন ও তদারকি চুক্তি পাওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা করে থাকে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। দেশ পর্যায়ে দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রমের কাঠামো ও দিকনির্দেশনা হিসেবে কাজ করার জন্য আন্তর্জাতিক উন্নয়ন অর্থায়ন প্রতিষ্ঠানগুলোর, যেমন বিশ্বব্যাংক ও অন্য দাতাদের, নিজস্ব শাসন ও দুর্নীতিবিরোধী কৌশল রয়েছে।৬০ যেমন ২০০৬-২০০৯ সময়কালে বাংলাদেশের জন্য বিশ্বব্যাংকের সহায়তা কৌশল নিচের বিষয়গুলোর প্রতি জোর দিয়েছিল: ১. পূর্ণ কর্মক্ষম দুর্নীতি দমন কমিশন; ২. আইন ও বিচার বিভাগের সংস্কার-প্রক্রিয়ার ভিত্তি স্থাপন; ৩. মানুষের দাবির ক্ষমতায়ন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তার অংশগ্রহণকে শক্তিশালী করা। পরবর্তী সময়ে ২০১০ সালে ব্যাংকের বাংলাদেশ অংশীদারি কৌশলের মনোযোগ স্থানান্তরিত হয় ভিন্ন সব বিষয়ের প্রতি: ক. সরকারি আর্থিক ব্যবস্থাপনা, খ. ক্রয়, গ. স্থানীয় সরকার, ঘ. সেবা প্রদান এবং ঙ. সিভিল সমাজ (সুশাসনের দাবি)।৬১

বাংলাদেশে অন্য দাতাগোষ্ঠী (যেমন নরডিক দেশগুলো ও ডিএফআইডি) উন্নয়নে অংশ নিতে ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেছিল এবং তা তেমন সুনির্দিষ্ট ছিল না।৬২ তারা তাদের সহায়তা কর্মসূচিতে শাসনের এজেন্ডা ঢুকিয়েছিল, যা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ক. উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশের জাতীয় কৌশল ও দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলপত্রে এবং খ. জাতিসংঘের দুর্নীতিবিরোধী কনভেনশনের (ইউএনসিএসি) বিধিমালায়। এই দুই দিকনির্দেশনা মেনে তাদের সুনির্দিষ্ট সহায়তা কর্মসূচিগুলো আমলাতন্ত্রের সংস্কার, বিচার বিভাগ ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার শক্তিশালীকরণ, সরকারি আর্থিক ব্যবস্থাপনা, নির্বাচন কমিশন ও তার বিধিমালা এবং তার ক্রয়-প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। তারা বাংলাদেশ দুর্নীতি দমন কমিশনকে সহায়তা প্রদান করেছে এবং একই সঙ্গে তথ্য আইনের স্বাধীনতা তৈরিতে সাহায্য করেছে। এসব দাতার কাছ থেকে সাহায্য পাওয়া বেশ কিছু সংখ্যক সিভিল সমাজের সংস্থাগুলোর মাঝে রয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ, মানবাধিকার রক্ষাকারী সংগঠন যার মধ্যে রয়েছে নারী অধিকার নিয়ে কাজ করা সংস্থা, শ্রমিকদের সংগঠন, আইনি সেবাদানকারী সংগঠন, পরিবেশবাদী গোষ্ঠী এবং থিংক ট্যাংক। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য চাপ বা জনমত তৈরির মাধ্যমে এবং দুর্নীতির ব্যাপারে ব্যাপক সচেতনতা বাড়ানোর মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে তাদের দেখেছে দাতারা (পরিশিষ্ট খ.১ এবং পরিশিষ্ট খ.২)।

দাতাদের দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় দেওয়া বিভিন্ন ধরনের সহায়তার মধ্যে ছিল দুর্নীতিবিরোধী কর্মকাণ্ড ও সুশাসন নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাংগঠনিক কার্যক্রমের উন্নয়ন এবং তাদের পেশাগত ও কারিগরি সামর্থ্য বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে প্রণয়ন করা কারিগরি সহায়তা। ক. বিভিন্ন সংস্থার কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ, খ. ওয়ার্কশপ, সেমিনার এবং কনফারেন্সের মধ্য দিয়ে অভিজ্ঞতা বিনিময় ও আইডিয়ার প্রচার এবং গ. উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন ও প্রশাসনের কাজ যুগোপযোগী করার জন্য নানা উপকরণ সরবরাহের এই সহায়তা দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশে দাতাদের নিজস্ব দুর্নীতিবিরোধী কৌশল অনুসরণ করতে গিয়ে, যা তাদের মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বিশ্লেষণ করা হয়েছে, দাতাদের অভিজ্ঞতা কি ছিল? ২০১১ সালে বাংলাদেশ নিয়ে বিশ্বব্যাংকের মূল্যায়ন প্রতিবেদন বলছে: দুর্নীতি দমন কমিশনের কাজ এবং একাত্মতা পরিবেশ যে ধারায় কাজ করছে তা বেশ আশাপ্রদ নয়, কারণ দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে এটি বাছাই করা কিছু দুর্নীতির তদন্তকাজ করে থাকে; তদন্তগুলো প্রায়ই পুরো প্রক্রিয়ার অন্যান্য অংশ (যেমন মামলা তৈরি ও পরিচালনা, বিচার ও শাস্তি প্রদান) থেকে তেমন সহায়তা পায় না। ব্যাংকের ‘বিশ্বাসযোগ্য পুঁজি ব্যবস্থাপনার’ কারণে ব্যাংক নিজেকে জাতীয় মহাসড়কের প্রকল্প থেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে এবং এক দশকেরও বেশি সময় ধরে এটি ব্যাংকের অর্থায়নে বড় ধরনের কোনো বিদ্যুত্ উত্পাদন প্রকল্পের দরপত্র আহ্বান করতে পারেনি। আমলাতন্ত্রের সংস্কারের অগ্রগতি গতি খুব ধীর; সরকারি মন্ত্রীরা নির্দেশনা দিয়ে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন এবং স্বচ্ছতা ও অংশগ্রহণ বাড়াতে যে অতিরিক্ত চেষ্টা, সময় এবং ঝুঁকির দরকার তা দিতে নারাজ।৬৩

বেশ কিছু কারণে বিশ্বব্যাংক দেখেছে সিভিল সমাজের সংস্থাগুলোকে চাঙা করে সুশাসনের দাবি জোরদার করা ‘বেশ জটিল’; সিভিল সমাজের সংস্থাগুলো বেশি মনোযোগ দিয়ে থাকে সেবাদানের দিকে অ্যাডভোকেসির বদলে, কারণ আগেরটি রোজগার জোগায় আর পরেরটি ‘জীবন ও জীবিকা হুমকির মুখে ঠেলে দেয়’;

সরকারের কাছ থেকে তহবিল নিয়ে সেবা প্রদানে নিয়োজিত এনজিওগুলোর তোলা দাবি বাধাগ্রস্ত হয় ক. তাদের দুর্বল সামর্থ্যের কারণে খ. রাজনৈতিকীকরণ যা অনেক ক্ষেত্রে স্বাধীন পর্যবেক্ষণের জন্য বিশ্বাসযোগ্যতা হারানোর কারণে, এবং গ. সাবকন্ট্রাক্টিং এনজিওর কাজে সরকারের অনধিকারচর্চার কারণে। একই সময়ে দাতাদের সাহায্য পাওয়া এনজিওগুলো অনেক সময়ে দাতাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করে বলে অভিযুক্ত করা হয়।

বাংলাদেশে শাসনের রাজনৈতিক অর্থনীতি নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সার্বিক পর্যালোচনা ছিল নিম্নরূপ, ‘শাসক দল জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠান গড়ার বদলে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর খুব কমই আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থা রয়েছে, যা বিরোধী দল ব্যবহার করে সরকারকে জবাবদিহি করতে পারে। সংসদ ও বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগের উল্লেখযোগ্য তদারকি করে না।’

অন্য দাতাদের দুর্নীতিবিরোধী প্রচেষ্টার যৌথ মূল্যায়ন, যা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, উপসংহার টেনেছে যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণ, প্রশাসন, নিরীক্ষা এবং হিসাবরক্ষণ ব্যবস্থায় যে সহায়তা দেওয়া হয়েছে তা তাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য পূরণ করতে পারেনি। ক. প্রশিক্ষণ ও খ. অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষাব্যবস্থায় সাহায্যের মাধ্যমে প্রধান সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ যেমন আইন রক্ষাকারী সংস্থা ও আমলাতন্ত্রে একাত্মতা প্রসারে তাদের চেষ্টা খুব কমই সফল হয়েছে। শক্তিশালী নৈতিকতা, স্বচ্ছতা এবং সরকারি অভিযোগ-প্রক্রিয়া উত্সারিত করতে, তারা মিডিয়া ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করেছে। তবে মিডিয়ার সঙ্গে তাদের কাজ বেশ সীমাবদ্ধ ছিল।৬৪

তারা বাংলাদেশে দুর্নীতির ব্যাপকতা ও প্রক্রিয়াগত দিকটির ওপর জোর দিয়েছে, যা দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে; এনজিও, সরকারি কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ, বেসরকারি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের জন্য এটি হচ্ছে ‘কাজ আদায় করে নেবার একটি বৈশিষ্ট্য’। তার ওপর এটি ছড়িয়ে পড়েছে পুলিশ ও বিচার বিভাগে যাদের ভূমিকা ছিল দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়ার। তাই সরকারি সংস্থাগুলো খুব কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না, যদি না অন্য বিবেচনা যেমন বড় ধরনের দাবি, প্রতিযোগিতাকে সহযোগিতা করা এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়া উন্নত করা হিসেবের মধ্যে নেওয়া হতো। উঠতি ও দরকারি পরিবর্তনের নিয়ামকের যেমন: বেসরকারি খাত, পেশাদার ও সিভিল সমাজের সংগঠন এবং মিডিয়ার মধ্যে শেষের দুটি গতিশীল ও শক্তিশালী। কিন্তু তারা সব সময়ই স্বাধীন নয় এবং তারা নিজেরাই দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারে।

দাতাদের সার্বিক পর্যালোচনায় মনে হয় যে তারা জোর দিচ্ছে অভ্যন্তরীণ ফ্যাক্টরগুলোর ওপর, যা দাতারা কাটিয়ে উঠতে পারবে না। এদের মধ্যে রয়েছে রাজনৈতিক ব্যবস্থার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ঘাটতি, সংসদ ও বিচার বিভাগের অপর্যাপ্ত ও অদক্ষ তদারকি ভূমিকা, রাজনৈতিক নেতৃত্বের দায়বদ্ধতার ঘাটতি এবং দুর্নীতিবিরোধী প্রচেষ্টায় জনগণের চাপ তৈরিতে সিভিল সমাজের সংস্থাগুলোর সীমাবদ্ধতা।

তবে দাতারা শুধু দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অভ্যন্তরীণ দায়বদ্ধতায় সাহায্য অথবা সহযোগিতা দিতে পারে আর্থিক ও কারিগরি সাহায্যের মাধ্যমে এবং বাংলাদেশের মতো অন্যান্য দেশে দুর্নীতি দমনবিরোধী প্রচেষ্টার শিক্ষা বাংলাদেশে নিয়ে আসতে পারে অনুসরণের জন্য।

দাতারা দুই ধরনের ডিলেমার মুখোমুখি হয়ে: একটি ডিলেমা হচ্ছে ‘ব্যয় করার চাপ’ যা তাদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতির বিরুদ্ধে যায়। দ্বিতীয় ডিলেমাটি হচ্ছে, ১৬ কোটি মানুষের গরিব দেশ বাংলাদেশকে, যার সাহায্যের দরকার, ঠিক কী পরিমাণ সহায়তা দিতে হবে তা নির্ধারণ, অন্যদিকে উত্পাদনশীল, দুর্নীতিমুক্ত সাহায্যের ব্যবহার নিশ্চিত করা।৬৫

সাহায্য ছাড়াও বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কও কোনো কোনো সময় দুর্নীতির ব্যাপকতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ভূমিকা রাখতে পারে। বাংলাদেশে এর প্রতিফলন দেখা গিয়েছিল রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানা রয়েছে এমন একটি ভবন ধসে পড়ার পর আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া দেখে। অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা এবং মুহূর্তের মধ্যে সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার এই সময়ে যেকোনো রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কৌশলগত ঘটনার খবর পৃথিবীর সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। দুর্ঘটনা ও বিপর্যয়সংক্রান্ত ঘটনার ক্ষেত্রে এটি বিশেষভাবে সত্যি।৬৬

সস্তা পোশাকের রপ্তানিকারক হিসেবে তৈরি পোশাকের আন্তর্জাতিক পদচারণা বেশ চোখে পড়ে। বাংলাদেশ চীনের পর তৈরি পোশাকশিল্পের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যা ২০০৭ থেকে ২০১২ এই পাঁচ বছরে দ্রুত বেড়েছে, ২০০৭ সালে ১৬ মিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ২০১২ সালে ইইউ ও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২০ বিলিয়ন ডলারে। বাংলাদেশের ‘ব্র্যান্ড’ সুনাম বিশ্বে হুমকির মুখে পড়তে পারে বলে একধরনের উদ্বেগ ছিল, কারণ বাংলাদেশ বিক্রি বাড়ানোর চেষ্টা করছিল অন্যান্য সস্তা পণ্য রপ্তানিকারক উন্নয়নশীল দেশের রপ্তানিকারকদের সঙ্গে যেমন: কম্বোডিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম, মিয়ানমার ইত্যাদি।

ভবন নির্মাণে মানদণ্ড নিশ্চিতে এবং একই সঙ্গে শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে বাংলাদেশের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছিল। আর এই চাপের উত্সগুলো হচ্ছে ক. আমদানিকারক দেশের আন্তর্জাতিক ট্রেড ইউনিয়ন, শ্রম আন্দোলনকর্মী, মানবাধিকারকর্মী এবং ভোক্তা গোষ্ঠী আর একই সঙ্গে খ. আমদানিকারক দেশগুলোর সরকার যারা বাংলাদেশে রপ্তানির জন্য বিশেষ বাণিজ্য সুবিধা প্রদান করে থাকে (জিএসপি, শুল্ক ও কোটামুক্ত বাজার সুবিধা)। এদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ইইউ যা বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের এক গুরুত্বপূর্ণ আমদানিকারক দেশ। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র তৈরি পোশাক রপ্তানি ছাড়া বাংলাদেশের রপ্তানির জন্য বিশেষ কিছু বাণিজ্য-সুবিধা দিয়ে থাকে। শ্রম আন্দোলনকর্মী এবং মানবাধিকারকর্মীদের চাপের মুখে যুক্তরাষ্ট্র সরকার ২০১৩ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশের রপ্তানির ওপর বাণিজ্য-সুবিধা স্থগিত করে, যদিও ইইউ তাদের জিএসপি প্রত্যাহার করেনি। তবে তারা বাংলাদেশে নিচু নিরাপত্তা মান নিয়ে তীব্র উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, সঙ্গে ছিল প্রচ্ছন্ন হুমকি, যদি বাংলাদেশ তার নিরাপত্তা মানের উন্নয়ন না ঘটায় তবে এর বিরুদ্ধে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা ইইউ নিতে পারে।৬৭

এ ছাড়া আমদানিকারক ও বিদেশে বাংলাদেশি পোশাকের খুচরা বিক্রেতারা সেখানকার মানবাধিকারকর্মী, শ্রম আন্দোলনকর্মী ও ভোক্তাদের কাছ থেকে চাপের মুখে পড়েন, যেন তাঁরা আমদানিকারক দেশে কারখানার নিরাপত্তা মান অনুসরণ করতে পরিদর্শনকাজ জোরদার করার জন্য চাপ দেন। বাংলাদেশের ওপর, সরকার ও রপ্তানিকারকদের ওপর চাপ তাই বহু উত্স থেকে উত্সারিত।

কারখানাগুলোতে কাজের পরিবেশের তদারকব্যবস্থার উন্নতিতে বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বেশি ও ক্রমাগত চাপের মুখে বেশ কিছু ব্যবস্থা নিয়েছে। দেশের কারখানাগুলোতে বিধিমালা প্রয়োগে শ্রম মন্ত্রণালয়ের সামর্থ্যের ঘাটতি বড় ধরনের প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করছে।৬৮ বাংলাদেশে তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ শ্রমিকদের নিরাপত্তার মান, যার মধ্যে রয়েছে ভবন নির্মাণের বিষয়টিও, সদস্য কারখানাগুলোর ওপর একটি জরিপ পরিচালনা করেছিল। বাংলাদেশ সরকার একটি শ্রম আইন তৈরি করেছিল দুর্ঘটনার পরপর।৬৯

এর বাইরে এই শিল্প ও আইএলওর সঙ্গে মিলে একটি অ্যাকশন প্ল্যান নিতে সম্মত হয়েছে। কারখানা মালিক, আইএলও এ শিল্পের সঙ্গে মিলে কাজ করবে সংস্কার সুপারিশের জন্য, যার মধ্যে রয়েছে ইউনিয়ন গড়ার অধিকার, সম্মিলিত দর-কষাকষির ব্যবস্থা এবং কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এ বছরের শেষ নাগাদ সরকার এ শিল্পের সঙ্গে মিলে সব পোশাক কারখানার একটি সমন্বিত নিরাপত্তা পর্যালোচনা করতে যাচ্ছে, যার মধ্যে রয়েছে স্ট্রাকচারাল ইন্টেগ্রিটির একটি বিশ্লেষণ এবং অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থা, সঙ্গে আছে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা যাতে অন্তর্ভুক্ত আছে নিরাপত্তাঝুঁকিতে থাকা ভবন থেকে কারখানার স্থানান্তর।৭০

আলোচিত ঘটনা এটিই নির্দেশ করে কীভাবে শ্রমিকদের নিরাপত্তার দিকটি উপেক্ষা করে কেবল উচ্চ মুনাফার লোভে পড়ে দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি তদারকি সংস্থা, আমদানিকারক ও রপ্তানিকারকেরা মিলে একটি আঁতাত গড়ে তুলেছিল। এটি আরও দেখায় যে যখন অপশাসন আর দুর্নীতি বড় ধরনের দুর্যোগ ঘটায় তখন অর্থনৈতিক খাত যেগুলো আন্তর্জাতিক অর্থনীতি ও বাণিজ্যিক সম্পর্কের সঙ্গে যুক্ত এবং যাদের রয়েছে ব্যাপক আন্তর্জাতিক পদচারণা তাদের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন গোষ্ঠী যেমন: শ্রম সংগঠন, বিদেশি ভোক্তা এবং আমদানিকারক দেশগুলোর সরকারের জন্য উদ্বেগের বড় কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আর বাণিজ্যিক অংশীদারদের এই উদ্বেগ ও প্রতিক্রিয়া সরকারকে বাধ্য করে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে। তবে বহির্বাণিজ্যের এই সম্পর্ক, যা অর্থনীতির একটি নির্দিষ্ট খাতের শাসনব্যবস্থার উন্নতি ঘটাচ্ছে, তার নজির খুব কম ও বিরল।

তবে শেষ পর্যন্ত সাহায্য ও বৈদেশিক বাণিজ্যের কারণে তৈরি হওয়া বাইরের এই চাপ দেশে দুর্নীতির ব্যাপকতা কমাতে তেমন কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখছে না। এটি দাতারাও স্বীকার করেছে; তাদের চরম অস্ত্র হচ্ছে, যখন সাহায্যপুষ্ট কোনো প্রকল্পে দুর্নীতি ধরা পড়ে, সাহায্য প্রত্যাহার করে নেওয়া। আর তাই দুর্নীতির পরিবেশের উন্নতি ঘটাতে তাদের অবদান খুব সামান্যই। এ ক্ষেত্রে দাতারা একটি ডিলেমার মুখোমুখি হয়: দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে চাপ প্রয়োগের জন্য গরিব দেশ থেকে সাহায্য প্রত্যাহারের নেতিবাচক দিক রয়েছে গরিবদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির নানা সুবিধার ওপর ও আয় এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরিতে। তা ছাড়া গরিবদের জন্য সাহায্য প্রত্যাহারের ত্বরিত প্রভাব হচ্ছে দুর্নীতি কমানোর দীর্ঘস্থায়ী সুফলকে ত্যাগ করার মতো চরম মূল্য দেওয়া। তবে তারা তাদের নির্দিষ্ট সাহায্য প্রকল্পগুলোতে দুর্নীতি থেকে বাঁচতে ‘বেড়া দেবার’ চেষ্টা করেছে যতটা সম্ভব। যেমন উপকরণ সংগ্রহ ও ক্রয়, বাস্তবায়ন ও তদারকির জন্য তারা অনেক কঠোর নিরাপত্তা নিয়মকানুন চালু করেছে। তবে এসব শর্ত ও নিরাপত্তাব্যবস্থা পুরোপুরি কাজে লাগাতে গিয়ে অনেক সময় প্রকল্প বাস্তবায়নে দেরি হয় এবং প্রকল্পের ব্যয় অনেক বেড়ে যায়।

সাধারণভাবে বলতে গেলে, কিছু দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠান স্থাপনে—যেমন দুর্নীতি দমন কমিশন এবং তথ্য অধিকার আইন—দাতারা বেশ সহযোগিতা ও প্রেরণা দিয়েছে। এখন এগুলোকে কার্যকর করাই বড় চ্যালেঞ্জ। এ ছাড়া তাদের সহায়তা কর্মসূচিতে তারা জাতিসংঘের দুর্নীতিবিরোধী কনভেনশনের দিকনির্দেশনা অনুসরণ করেছে এবং ধারাগুলোর প্রতি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে বাস্তবায়নের জন্য। জরিপ ও গবেষণার মাধ্যমে দুর্নীতির প্রমাণ বের করার জন্য তারা বিভিন্ন থিংক ট্যাংক ও সিভিল সমাজের সংস্থাকে সহায়তা কর্মসূচির মাধ্যমে সাহায্য দিয়েছে এবং এভাবে দুর্নীতির ব্যাপারে সার্বিক জনসচেতনতা বাড়াতে ও দুর্নীতির প্রতিরোধে চাপ প্রয়োগে ভূমিকা রেখেছে।

৫. উপসংহার

শেষ বিশ্লেষণে বাংলাদেশে দুর্নীতির নিয়ন্ত্রণ একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া, যার শুরু ও স্থায়িত্ব নির্ভর করছে অভ্যন্তরীণ পরিবর্তনের ও সংস্কারের ওপর যেটি আবার ‘নিচ থেকে ওপরে’ উত্সারিত চাপ এবং ‘ওপর থেকে নিচে’ উত্সর্গীকৃত নেতৃত্বে যুগপত্ ক্রিয়ার ফল। শহুরে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভূমিকা, যেহেতু এই শ্রেণি আকারে বড় হচ্ছে এবং যেহেতু এর বাড়তে থাকা আকাঙ্ক্ষা আয় প্রবৃদ্ধির সুফল দিয়ে মেটানো যাচ্ছে না, দুর্নীতি কমানোর দাবির চাপ তৈরিতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এ কাজে মধ্যবিত্ত শ্রেণির সফলতা নির্ভর করছে তারা জনগোষ্ঠীর বাকি অংশকে কতদূর অনুপ্রাণিত ও এতে শরিক করতে পারছে তার ওপর। সিভিল সমাজের সংস্থাগুলো এবং মিডিয়া দুর্নীতির ঘটনাগুলো ব্যাপকভাবে প্রচার করতে পারে এর বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার জন্য। একই সঙ্গে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বাড়ানোর জন্য তারা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নজর রাখতে পারে। যখনই সম্ভব তারা তৃণমূল পর্যায়ে ক্ষুদ্র প্রকল্প হাতে নিতে পারে স্থানীয় সরকারপর্যায়ে দুর্নীতি কমানোর জন্য। ‘নিচ থেকে ওপরে’ চাপ তৈরির জন্য।

দুর্নীতি থেকে মুক্তির মূল্য হচ্ছে সদা সতর্কতা। চূড়ান্ত বিশ্লেষণে, বৃহত্ জনগোষ্ঠীর মাঝে দুর্নীতি সহ্য করার মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে হবে। আর এর মধ্যেই সংশোধনমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার তাড়নার চাবিটি লুকিয়ে আছে। যাদের রূপকল্প অথবা উচ্চাকাঙ্ক্ষা আছে ‘পেছনে একটি কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে যাওয়ার’ এবং গণমানুষের জন্য, যার নেতৃত্বে মধ্যবিত্ত শ্রেণি, ‘নিচ থেকে ওপর’ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে চাপ তৈরি করবে, সেসব নেতার মাঝে আকাঙ্ক্ষা অথবা প্রণোদনা নির্ধারণ করবে এই মাত্রা। নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও সামাজিক ঐতিহ্যের প্রতি, অন্যদিকে, দুর্নীতি সহ্য করার মাত্রা ব্যাপকভাবে নির্ভর করে। নৈতিক মানদণ্ড শুধু জনগণের জন্যই প্রযোজ্য নয়, একই সঙ্গে তা প্রযোজ্য যারা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে তাদের জন্যও। বেসরকারি উদ্যোক্তা যারা আইন ভেঙে এবং রাষ্ট্রক্ষমতা প্রভাবিত করে নিজেদের সুবিধাজনক আইন ও বিধি তৈরি করে তাদের নৈতিক মানদণ্ডও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তবে দীর্ঘ মেয়াদে মুনাফা বাড়ানোর জন্য দুর্নীতির চর্চার মাধ্যমে নিয়মকানুন ভাঙা ও এর ইচ্ছামাফিক ব্যবহার করপোরেট খাতে/বাজার অর্থনীতির একাত্মতায় ধস নামাতে পারে।৭২

আচরণ ও মূল্যবোধের পরিবর্তন লম্বা সময় ধরে ঘটে। তবে শেষ পর্যন্ত কেন, কখন এবং কীভাবে দুর্নীতি দমনের প্রভাব, গতি ও সাফল্য পেতে পারে তার উত্তর জানা নেই। এটি একটি চলমান কাজ।

পরিশিষ্ট

পরিশিষ্ট-ক: সেবা খাতে দুর্নীতির প্রকোপ সম্পর্কে জরিপ

ছক-১: সেবা খাতে বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতি এবং অনিয়মের শিকার হওয়া পরিবার:

ক্ষেত্র     ২০১০ সালের পরিবার (%)

বিচার বিভাগ   ৮৮.০

আইন প্রয়োগকারী সংস্থা           ৭৯.৭

ভূমি প্রশাসন     ৭১.২

কর ও শুল্ক        ৫১.৩

বিদ্যুত্  ৪৫.৯

কৃষি     ৪৫.৩

স্থানীয় সরকার ৪৩.৯

স্বাস্থ্য     ৩৩.২

বিমা    ১৯.২

ব্যাংকিং            ১৭.৫

শিক্ষা    ১৫.৩

এনজিও            ১০.১

অন্যান্য            ৩৪.১

সামগ্রিক           ৮৪.২

১.         ঞত্ধহংঢ়ধত্বহপু ওহঃবত্হধঃরড়হধষ, ইধহমষধফবংয, ঈড়ত্ত্ঁঢ়ঃরড়হ রহ ঃযব ঝবত্ারপব ঝবপঃড়ত্ং: ঘধঃরড়হধষ ঐড়ঁংবযড়ষফ ঝঁত্াবু ২০১০, উযধশধ, উবপবসনবত্ ২০১০.

            দুর্নীতি শুধু ঘুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, দায়িত্বে অবহেলা, স্বজনপ্রীতি, আত্মসাত্, ছলচাতুরী ইত্যাদিও দুর্নীতি হিসেবে বিবেচিত। জরিপ করা পরিবারের মধ্যে ৮৪.২ শতাংশ পরিবার জরিপে এই দৃশ্য দেখা যায়।

            জরিপে দেখা যায় যে বিচার বিভাগে দুর্নীতির পরিমাণ সর্বোচ্চ।

            ৮৮ শতাংশ পরিবার যারা বিচার বিভাগের সেবা পেয়েছে তারা দুর্নীতির শিকার হয়েছে।

ছক ২—২০১০ সালে বিভিন্ন খাতে বিভিন্ন পরিবার দ্বারা প্রদত্ত ঘুষ ও অননুমোদিত টাকার পরিমাণ:

ক্ষেত্র     ঘুষ ও অননুমোদিত      গড় ঘুষ ও অননুমোদিত

            খরচ (%)          টাকার পরিমাণ (টাকা)

আইন প্রণয়নকারী সংস্থা            ৬৮.১   ৩,৩৫২/-

ভূমি প্রশাসন     ৬৭.০    ৬,১১৬/-

বিচার বিভাগ   ৫৯.৬   ৭,৯১৮/-

কর ও শুল্ক        ৪৩.৯    ৬,৭৩৪/-

কৃষি     ৩৮.১   ৩১০/-

স্থানীয় সরকার ৩৬.৭   ৯১৩/-

বিদ্যুত্  ২৭.৬    ১,৮৩৪/-

শিক্ষা    ১৫.০    ১৬৮/-

বিমা    ১৫.০    ৩,৯৪৯/-

ব্যাংকিং            ১২.৭     ১,৯২৮/-

স্বাস্থ্য     ১৩.২    ৪৬৩/-

এনজিও            ৭.২       ৫৪৯/-

অন্যান্য            ৩৫.৫    ৬,৮০৪/-

সামগ্রিক           ৭১.৯    ৫,৩৬৫/-

২.         প্রত্যেক পরিবারের শিক্ষা খাতে অনৈতিক টাকার পরিমাণ গড়ে ১৬৮ টাকা ছাত্র ভর্তি, বৃত্তি ও বিনা মূল্যে বই পাওয়ার ক্ষেত্রে পরিবারগুলো দুর্নীতির শিকার হয়। স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে তাদের দিতে হয় গড়ে ৪৬৩ টাকা। ২০১০ সালে ৯৭.১ শতাংশ পরিবার সরকারি ও বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা পেয়েছে। এর বাইরে ২০ শতাংশ সরকারি স্বাস্থ্যসেবা পায় এবং ৮০ শতাংশ বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা পায়। সরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে ৩৫.২ শতাংশ জেনারেল হাসপাতাল, ৩৩.৬ শতাংশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও ৩৮.৪ শতাংশ উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ঘুষ নেওয়া হয়। জরুরি বিভাগ থেকে সেবা নেওয়ার সময় ৩৭.৭ শতাংশ গড়ে ১৪৩ টাকা দেয়। বিভিন্ন সেবার জন্য তারা গড়ে ৫,৩৬৫ টাকা ব্যয় করে। ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে পরিবারগুলো মোট ৩০.১২ মিলিয়ন টাকা ব্যয় করে। ২০০৯ সালের জুন থেকে ২০১০ সালের মে পর্যন্ত বিভিন্ন খাতে ৯৫. ৯১৬ লাখ বা ১০০ কোটি টাকা ব্যয় করে।

পরিশিষ্ট খ.১—জাতিসংঘ কনভেনশন

নোরাড ও অন্য দাতাদের ইউএন কনভেনশনে নীতিসমূহ নিচে দেওয়া হলো:

পরিশিষ্ট-খ-২-বাংলাদেশের কৌশল

NSAPR*-I ও NSAPR-II তে প্রতিফলিত এবং নোরাড ও অন্য দাতাদের দ্বারা অনুসরণকৃত বাংলাদেশের কৌশলগুলো নিম্নে দেওয়া হলো:

NSAPR-I I NSAPR-II সুশাসন ও দুর্নীতি দমনের অগ্রাধিকার

সূত্র:        NSAPR-I and NSAPR-II । দারিদ্র্য নিরসন ত্বরান্বিত করতে উপরিউক্ত কৌশলগুলো দাতারা তাদের জাতীয় কৌশলে প্রয়োগ করেছে। National Strategy to Accelerate Poverty Reduction: I (2005-08), II (2009-11).

পরিশিষ্ট-গ-দুদক

২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত দুদকের প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ নিম্নরূপ:৭৩

ষ          নিজস্ব গতি বা সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির আবেদন বা কোনো ব্যক্তি তার পক্ষ থেকে অনুসন্ধান বা তদন্ত ও আচরণের ভিত্তিতে মামলা দায়ের করার ওপর দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত করা।

ষ          অনুসন্ধান, তদন্ত ও মামলা দায়ের করার পদ্ধতি নির্ধারণ।

ষ          দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য স্বীকৃত বিধান পর্যালোচনা ও তাদের বাস্তবায়নের জন্য সুপারিশ করা।

ষ          দুর্নীতির কারণসমূহ চিহ্নিত করা ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সুপারিশ করা।

ষ          গবেষণা করা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম কর্মশালার ব্যবস্থা করা ও দুর্নীতি প্রতিরোধে পরিকল্পনা তৈরি এবং সুপারিশ প্রণয়ন করা।

ষ সচেতনতা বৃদ্ধি ও মানুষের মধ্যে সততার অনুভূতি তৈরি।

কমিশন দুর্নীতির কিছু ধরন সংজ্ঞায়িত করেছে।

ঘুষ: এটা হলো টাকা, সেবা বা মূল্যবান কোনো কিছুর বিনিময়ে কাউকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়া। সমার্থক শব্দ: বকশিশ, উেকাচ ইত্যাদি।

অর্থ আত্মসাত্: অর্থ, সম্পত্তি ও অন্যান্য মূল্যবান জিনিস ভোগ করা, যা অন্যের আমানত।

চাঁদাবাজি: পথরোধের মাধ্যমে টাকা, সম্পদ ও অন্যান্য জিনিস দাবি করা।

ক্ষমতার অপব্যবহার: চাঁদাবাজি বা বাইরের প্রভাব ছাড়া ব্যক্তিগত লাভের জন্য অফিসের ক্ষমতার অপব্যবহার করা। বিশেষ করে আমলাতন্ত্রে এটি দেখা যায়, যেখানে ব্যক্তি বেশ ক্ষমতাবান হয়ে ওঠে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা অর্জনের ফলে আর নজরদারির সুযোগের অভাবে। এ ছাড়া সুযোগ থাকলেও তা এতই জটিল যে এর কার্যকারিতা তেমন থাকে না।

অন্যায় রাজনৈতিক অবদান: একটি রাজনৈতিক দল ও তাদের সদস্যদের সঙ্গে লেনদেন করে অযাচিতভাবে তাদের বর্তমান ও ভবিষ্যত্ কার্যক্রম প্রভাবিত করার চেষ্টা করা।

এর স্বাধীনতা শুধু আর্থিক স্বাধীনতার ঘাটতির কারণেই খর্ব হয়নি, এর বাজেটও নির্ধারণ করে সরকার। শুধু রাষ্ট্রপতির অনুমোদন সাপেক্ষে এটি তার অভ্যন্তরীণ সংগঠন ও কার্যক্রমের জন্য নীতিমালা প্রণয়ন করতে পারে। দুর্নীতি দমন আইনে কমিশনের দায়িত্বসংক্রান্ত বিধিমালা নিয়ে অস্পষ্টতার কারণে কোনো জটিলতা দেখা দিলে সরকার এতে নাক গলাতে পারে। দুর্নীতি দমন কমিশনে স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। দুদকের স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। কীভাবে এটি দুর্নীতির ঘটনাগুলোর লক্ষ্য নির্ধারণ করে, কীভাবে বিশেষ ঘটনাগুলো বাছাই করে এবং কীভাবে এটি বেশ বড় সংখ্যক অভিযোগের বিরুদ্ধে তদন্ত করে তা পরিষ্কার নয়।

এর ক্ষমতার অপব্যবহার প্রতিরোধের কোনো জবাবদিহি নেই, শুধু প্রেসিডেন্টকে বার্ষিক প্রতিবেদন জমা দেওয়া ছাড়া যা তিনি সংসদে পাঠিয়ে দেন। দুদকের স্বাধীনতা যত বাড়বে, একে জবাবদিহি করার দাবিও তত জোরালো হবে। তাই তার পদ্ধতি ও কার্যাবলি সম্পর্কে পরিষ্কার ও সমন্বিত নীতিমালা কমিশনের প্রকাশ করা উচিত। দুদকের ওপর একটি সংসদীয় কমিটি থাকবে এর কার্যক্রম পর্যালোচনার জন্য, যা রাজনৈতিক দলগুলোর প্রভাব কমাবে।৭৪

এই প্রসঙ্গে ইন্দোনেশিয়ার দুর্নীতি দমন কমিশনের অভিজ্ঞতা প্রাসঙ্গিক।৭৫ এই কমিশনের দুর্নীতি প্রতিরোধ ও দুর্নীতিবিরোধী ব্যবস্থা বাস্তবায়নের জন্য অনেক দায়িত্ব ছিল। এটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের শাসনব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ ও দুর্নীতিবিরোধী ব্যবস্থার পক্ষে জনমত আদায়ে ভূমিকা পালন করতে পারত। এটি যেকোনো সরকারি কর্মচারীর ওপর যেমন: সংসদ সদস্য, বিচারক, সামরিক কর্মকর্তা সবার দুর্নীতি তদন্ত করতে পারত। এটি ইন্দোনেশিয়ার সুপ্রিম অডিট বোর্ড দ্বারা নিরীক্ষিত হতো।

এটি দুর্নীতি দমনের কাজে ব্যবহূত সব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংগঠনের তদারকি ও সমন্বয়ের দায়িত্বে ছিল। এটি তার কাজের সমন্বয় করেছে; ক. স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ রাষ্ট্রীয় সব অভ্যন্তরীণ পর্যবেক্ষণ ইউনিটের সঙ্গে। খ. রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে, যারা বর্তমান ও আগের সরকারি কর্মকর্তাদের অননুমোদিত নিয়ন্ত্রণে থাকা সরকারি সম্পদের তদন্ত করে এবং গ. অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস ও পুলিশের সদর দপ্তরের সঙ্গে দুর্নীতির বিচার-প্রক্রিয়া ও তদন্তকাজে সহযোগিতা, সমন্বয় ও তত্ত্বাবধান-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার জন্য। এটি সংস্থাপন মন্ত্রণালয় ও আমলাতন্ত্রের সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করেছে আমলাতন্ত্রের সংস্কারে ও সরকারি কর্মচারীদের বিধি অনুযায়ী সম্পদ বিবরণী দাখিল নিশ্চিত করার জন্য এবং যেভাবে এই বিবরণীগুলো পরীক্ষা ও নিশ্চিত করা হতো তা মূল্যায়ন করেছে।৭৬

সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক ও ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করা, সুপারিশ করা এবং সুপারিশের বাস্তবায়ন করা এর দায়িত্ব ছিল। ২০১০ সাল পর্যন্ত এটি ভূমি প্রশাসন সংস্থা, আমদানি নিয়ন্ত্রণ সংস্থা, রাষ্ট্রীয় বাজেট, কর, রাষ্ট্রীয় কোষাগার, ইমিগ্রেশন, রাজনৈতিক দলগুলোর অর্থায়ন ইত্যাদির মতো কাজ পর্যবেক্ষণ করছিল। দুর্নীতি নির্মূল বা কমানোর জন্য এটি গবেষণা ও জরিপের কাজ হাতে নিয়েছিল, যার মধ্যে ছিল কমিশনের ওপর জনমতের জরিপ, সরকারি ক্রয়-প্রক্রিয়ার পর্যালোচনা, কিছু নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানে সমন্বিত সরকারি সেবার ওপর জরিপ, স্থানীয় সরকারগুলোর শাসন, করপোরেট শাসনের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা।

 ২০০৪-২০০৯ সালে এটি যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতিবিরোধী ঘটনার তদন্ত, বিচার-প্রক্রিয়া ও অভিযোগ প্রমাণ করে তাদের মধ্যে ছিল ৪৫ জন সংসদ সদস্য, ৮ জন মন্ত্রী, ৮ জন প্রাদেশিক গভর্নর, ১ জন গভর্নর, ৩ জন বিচারক, ৪ জন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর, ২৭ জন মেয়র, অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসের ৩ জন প্রসিকিউটর, ৩ জন দূত, ৪ জন কাউন্সেল জেনারেল এবং ১ জন পুলিশ প্রধান।৭৭

তথ্যসূত্র:

১.         গাণিতিক অর্থনীতি সাফল্যের সঙ্গে নিম্নোক্ত সমস্যা সমাধান করতে পারে না: ক. চলকগুলোর মধ্যে কোনটির কারণে কোনটি ঘটছে তা ঠিক করতে না পারা, খ. আদর্শিক পক্ষপাতদুষ্ট মতামত অথবা দুর্নীতির সাধারণ ধারণারই ভিত্তিতে তৈরি দুর্নীতি পরিমাপের সীমাবদ্ধতা। এ ছাড়া বহু গবেষণায় নিম্নমানের তথ্য-উপাত্ত দৃশ্যমান। ঘ. Campos, জ. Dimova, and অ. Saleh, “Whither Corruption? A Quantitative Survey of the Literature on Corruption and Growth,” Institute for the Study of Labor (IZA), Bonn, Germany, November 2010, Discussion Paper Series No. 5334|

২.         প্রবৃদ্ধির ওপর দুর্নীতির প্রভাব পর্যালোচনায় কিছু দরকারি প্রশ্ন যা সম্পর্কিত: ক. কোন প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি হয় এবং খ. দুর্নীতির কোন ধরনটি সবচেয়ে আধিপত্য বিস্তার করছে এবং তা স্বাভাবিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পথে কত তীব্রভাবে বাধা সৃষ্টি করছে। পূর্বে উল্লেখ করা কিছু আন্তদেশীয় আর্থগাণিতিক গবেষণায় দেখা গেছে ক. বাণিজ্য উন্মুক্ততা খ. প্রতিষ্ঠান ও গ. স্থায়ী প্রভাব যা দেশগুলোকে আলাদা করছে প্রবৃদ্ধির ওপর দুর্নীতির নেতিবাচক প্রভাব প্রশমনে ভূমিকা রাখছে। পূর্ব এশীয় গবেষণা দেখিয়েছে, প্রতিষ্ঠানের মধ্যবর্তী প্রভাব সত্ত্বেও প্রবৃদ্ধিতে দুর্নীতির কোনো নেতিবাচক আন্তসম্পর্ক নেই (পূর্বোক্ত)।

৩.        এটা বলা হয়ে থাকে যে দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রেসিডেন্ট পার্ক নিজে ব্যক্তিগতভাবে বড় বড় কোম্পানির হর্তাকর্তাদের সঙ্গে বসতেন, তাঁদের বিভিন্ন ব্যাপারে প্রশ্ন করতেন এবং তাঁরা তাঁর অফিস ত্যাগ করার আগে রাষ্ট্রপতির সহকারীর কাছে প্রয়োজনীয় ঘুষের অর্থ রেখে যেতেন। ইন্দোনেশিয়ার সুহার্তোর সময়ে তাঁর স্ত্রী ঘুষ গ্রহণের কাজটি করতেন। তাঁকে বলা হতো ‘মিসেস ১০ পার্সেন্ট সুহার্তো’। পরবর্তী সময়ে সুহার্তোর ছেলে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠিত হলে মায়ের পাশাপাশি তিনিও ঘুষ গ্রহণ করতেন।

৪.         বাংলাদেশে এরশাদের সময়ে বড় বড় প্রকল্প অথবা ক্রয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তাঁর হাতেই ছিল এবং এটা সাধারণের মাঝে ধারণা ছিল তাঁকে ঘুষ দিলে এসব প্রকল্পের কাজ বাগিয়ে নেওয়া যেত। গুজব ছিল যে তিনি ইন্দোনেশিয়ার ঘুষের পদ্ধতি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে তা বাংলাদেশে প্রবর্তন করেন। যখন এই পদ্ধতি প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছিল, তখনই তাঁকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করা হলো।

৫.         এর মধ্যে থাকতে পারে তার সন্তানের শিক্ষায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি, যা মানবসম্পদ গঠন ও উন্নয়নে অবদান রাখে।

৬.        মনে করা হয়, চুক্তিবদ্ধ বিনিয়োগের প্রভাব প্রবৃদ্ধির ওপর যেমন কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে জন্য প্রকল্পের গুণগত মানের সঙ্গে যেন কোনোভাবেই আপস করা না হয় এবং চুক্তি অনুযায়ী যেন এটির বাস্তবায়ন নিশ্চিতের জন্য দক্ষিণ কোরিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় সরকারের কঠোর নজরদারি থাকে।

৭.         Katherine Boo, Behind the Beautiful Forevers. Life, death, and hope in Mumbai Uncercity, 2012, Radon House. “One Cheer for Corruption in India: For the indigent and unemployed, bribery is a way to share in resources long plundered by the better-off” by Pankaj Mishra in Wall Street Journal.

            ট্রেনের একজন টিকিট পরিদর্শক যিনি ঘুষের, যেটি প্রকৃত টিকিটের মূল্যের চেয়ে কম, বিনিময়ে টিকিটবিহীন যাত্রীদের রেলভ্রমণের সুযোগ করে দেন, আসলে চাকরি পেতে তাকে যে ঘুষ দিতে হয়েছিল তার অংশবিশেষ ওঠানোর চেষ্টা করছেন। আর এটি করতে গিয়ে তিনি দুর্নীতির সুফল ভোগ করছেন।

৮.        ২০১২ সালে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের তৈরি দুর্নীতির ধারণা সূচক ১৭৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৪৪তম।

৯.         যদিও দুর্নীতি কোনো দলিল/সাক্ষ্য রেখে হয় না, তারপরও উন্নত নিরীক্ষা-প্রক্রিয়া যেটি পারফরম্যান্সের ওপর নজর দেয়, একটি দরকারি ভূমিকা পালন করতে পারে এ ক্ষেত্রে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধের অগ্রগতি পরিমাপ করা যায় দুর্নীতি তদন্তের রেকর্ড সংরক্ষণ মামলার হিসাব এবং সরকার কর্তৃক পরিচালিত অডিট পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে।

১০.       M. S. Mudahar and R. Ahmed, “Government and Rural Transformation: Role of Public Spending and Policies in Bangladesh.” UPL, Dhaka, 2010, pp. 194–204.

১১.       Transparency International Bangladesh, “Corruption in Service Sector: National Household Survey 2010,” Dhaka, 2012.

১২.       Mudahar and Ahmed, et al. pp. 202–204.

১৩.      নব্বইয়ের দশকে ফ্যাক্টরি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ঘুষ লাইসেন্সের প্রয়োজনীয় বৈধ ব্যয়ের চেয়ে ১ দশমিক ২৮ গুণ বেশি ছিল, লাইন্সেস নবায়ন ও অনুমোদন ছিল প্রয়োজনীয় বৈধ ব্যয়ের চেয়ে ৩০ গুণ বেশি। ১৯৯২ সালে একটি ফ্যাক্টরির অনুমোদনের প্রাথমিক খরচ ছিল ৭০ হাজার এবং ঘুষের পরিমাণ ছিল প্রায় ৯৫ হাজার টাকা সে সময়কার হিসেবে। নবায়নের বার্ষিক খরচ ছিল প্রায় ১৫ হাজার, অথবা এ-সংক্রান্ত ঘুষ ছিল ৪৫ হাজার টাকা, ১৯৯২ সালের হিসাবে। World Bank, “The Manufacturing Sector of Bangladesh,” selected issues 1992.

১৪.       অধিকন্তু উন্নত দেশে সুনির্দিষ্ট খাত বা শিল্প বা কাজের সুবিধার্থে সরকারের আইন/নির্বাহী বিভাগকে প্রভাবিত করে আইন পাস করিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে দুর্নীতি সংঘটিত হয়। উদাহরণস্বরূপ যুক্তরাষ্ট্রে পরিবেশ, অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ, জ্বালানি, বিদ্যুত্, স্বাস্থ্য প্রভৃতি খাতের আইন নিজেদের মতো করে প্রণয়নে প্রভাব বিস্তারে বিশেষ স্বার্থ গোষ্ঠীর তদবিরের চর্চা সবার জানা। তবে এ ধরনের তদবিরের প্রচেষ্টার ও ব্যয়ের নিয়ন্ত্রণে আইন রয়েছে। তদবিরের প্রচেষ্টার সীমা নির্দিষ্ট করে দেওয়া আছে, এই সীমা অতিক্রম করলে আইনি ও বিচার-প্রক্রিয়ার মুখোমুখি হতে হবে। এ ছাড়া বিভিন্ন তদবিরকারী গোষ্ঠীর প্রচেষ্টা আর ব্যয় জনগণের জন্য উন্মুক্ত ও স্বচ্ছ।

১৫.       ভারতীয় পার্লামেন্টের ৩০ শতাংশ সদস্যের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ আছে।

১৬.      সামরিক সরকারের শেষে পরবর্তী নির্বাচিত সরকার এসে নিজ দলের নেতা-কর্মীদের—যাদের অভিযুক্ত, বিচারের মুখোমুখি অথবা দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল—অধিকাংশকেই মুক্ত করে দেয় এবং তাঁদের বিরুদ্ধে করা সেনা-সমর্থিত সরকারের অধিকাংশ মামলাই প্রত্যাহার করে, যদিও বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বেলায় তা ঘটেনি।

১৭.       ২০০৭-২০০৮ সালের সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে এ ধরনের অভিযোগ উঠেছিল যে ‘দায়মুক্তির সুবিধা নিয়ে কিছু সংখ্যক সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য ক্ষমতার অপব্যবহার ও আর্থিক দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন, যা মানবাধিকার পরিস্থিতি ও আইনের শাসনকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল’। যেমন আর্মিদের তৈরি করা দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের তালিকা থেকে নাম বাদ দেওয়া, জামিন করা, দুর্নীতি দমন কমিশনের করা দুর্নীতি মামলার সাজা কমাতে বিচারকদের প্রভাবিত করা ইত্যাদির জন্য অবৈধ লেনদেন হয়েছিল। ভূমি মালিকদের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে, এমন মানুষদের কাছে জোর করে জমি বিক্রি করতে বাধ্য করা হয়েছিল, আর অনিচ্ছুক মালিকদের আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে অত্যাচার করা হয়েছিল। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অবৈধ লেনদেন হয়েছে এবং আমদানি কর ফাঁকি দেওয়া হয়েছে, এমন অভিযোগ তুলে কখনো কখনো ব্যবসায়ীদের সরকারকে বড় অঙ্কের টাকা দিতে বাধ্য করা হয়, যার একটি অংশ সেনাবাহিনী আত্মসাত্ করে।

            Transparency International Bangladesh: Role of a Section of the Bangladesh Armed Forces During the Caretaker Government of 2007-08—A Review/ Executive Summary, February 2013.

১৮.      দুর্নীতির দুটি দিক আছে। একটি দিক হলো, গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রির সম্মতি, অনুমোদন ও লাইসেন্স পেতে ঘুষ প্রদানের জন্য বেশ বড় ধরনের অর্থ খরচ করা, যা অনুমোদিত সরকারি খরচের চেয়ে বহুগুণ বেশি। দ্বিতীয় দিক হলো, পরিবেশ রক্ষায় বা প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ, ভবনকাঠামো নিরাপত্তা ও শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ-সংক্রান্ত আইন ও বিধিমালা পালন ও বাস্তবায়ন এড়াতে সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ প্রদান।

১৯.      ১৯৯৪ সালের একটি গবেষণায় দেখা যায়, শিল্পের অর্জিত মুনাফার ৩ শতাংশ ঘুষ প্রদানে ব্যয় হয়। তৈরি পোশাকশিল্প অত্যন্ত লাভজনক এবং এ কারণে তারা গার্মেন্টস স্থাপন ও এ শিল্প পরিচালনা করার জন্য অনুমতি/লাইসেন্স পেতে বেশি ঘুষ দিতেও রাজি হয় দুর্নীতিগ্রস্ত আমলাদের—যাঁরা কাজ করছেন কাস্টমস, কেন্দ্রীয় ব্যাংক, আমদানি-রপ্তানি ব্যুরোসহ বিভিন্ন সংস্থায়—চাহিদা পূরণ করার জন্য। বিশ্বব্যাংক, পূর্বোক্ত।

২০.       “Bad governance and good services. The ready-made garment industry in Bangladesh,” in N. Islam and M. Asaduzzaman, “A Ship Adrift: Governance and Development in Bangladesh,” BIDS 2008, Dhaka. বাংলাদেশের রপ্তানির ৭৫ শতাংশ পোশাক খাতের এবং জিডিপিতে এ খাতের অবদান ১৩ শতাংশ।

২১.       প্রতিযোগী দেশের তুলনায় মজুরি কম রাখা হয়েছে এবং তা দেশের অন্যান্য শিল্পের তুলনায়ও কম। এই মজুরি বস্ত্র ও অন্যান্য শিল্প খাতের কারখানা শ্রমিকদের মজুরির তুলনায় ১ দশমিক ৪ থেকে ২ গুণ কম। বিভিন্ন কারখানা আইন ও বিধিমালা মোতাবেক প্রাপ্য সব সুবিধা থেকে তাদের বঞ্চিত করা হয়। তাদের অনেক সময়ই অনিয়মিত শ্রমিকদের মতো আচরণ করা হয়, যারা স্বাভাবিক মজুরির চেয়েও কম মজুরি পেয়ে থাকেন; তাদের এত ঘন ঘন ছাঁটাই করা হয় যে, বিশেষ করে মহিলাদের, তারা ছাঁটাই ভাতাও পান না। আইন মোতাবেক নিয়োগপত্র পান না বলে তাঁরা চিকিত্সা, বিমা, মাতৃত্বকালীন ছুটি ও পরিবহনের মতো সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন। পূর্বোক্ত/মোদাহার এবং আহমেদ।

২২.       গত দশকে তৈরি পোশাক কারখানায় আগুন লেগে ৭০০ জনের বেশি মৃত্যু হয়েছে। ২০০৫ সালে ভবনধসে মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। কাঠামোগত ত্রুটির কারণে সোয়েটার কারখানায় ১৬৪ জন মারা গেছে এবং ৮০ জন আহত হয়েছে। (The Wall Street Journal, 25 April 2013, p.10)। কাউকেই অপরাধী করা হয়নি। ২০১২ সালে আরেকটি কারখানায় আগুন লেগে ১০০ জন মারা যায় (The Wall Street Journal, 27 April 2013)। ভবনধসের কারণ হলো ত্রুটিপূর্ণ নির্মাণশৈলী, পুরোনো কাঁচামাল, অল্প সংখ্যক পরিদর্শন যা মালিক খরচ কমানোর জন্য অনুসরণ করেছেন। ভবন নির্মাণে বিল্ডিং কোড অনুসরণ করা হয়নি আর অপ্রতুল নিরাপত্তাব্যবস্থার কারণে আগুন লাগা সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসবের জন্য এখন পর্যন্ত কাউকেই দায়ী অথবা দোষী সাব্যস্ত করা হয়নি। ২০১৩ সালের বিল্ডিং ধসে ১১০০ জনের মৃত্যু ঘটেছে এবং শত লোক আহত হয়েছে।

            এটা অভিযোগ করা হয়ে থাকে যে এ শিল্প রাজনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত। ২০১৩ সালে কমপক্ষে ২৫ জন সাংসদ তৈরি পোশাক খাতে বিনিয়োগ করেছিলেন। ২০১২ সালের নভেম্বরের আগুনের পর বিজিএমইএ তার কিছু সদস্যের কারখানায় পরিদর্শন দল পাঠায়। চারটি ভবনে কাঠামোগত ত্রুটি ছিল অথবা নির্মাণ বা শ্রম আইন লঙ্ঘন করেছিল। মালিক কারা ছিল? গার্মেন্টস মালিকদের জোটের সভাপতি আতিকুল ইসলাম, তার পূর্বসূরি এবং সমিতির সাবেক উপসভাপতি কাউকেই দোষী সাব্যস্ত করা হয়নি (ঞযব ঊপড়হড়সরংঃ, ৪ গধু, ২০১৩)।

২৩.      N. Islam, “Reflection on Governance and Development,” Journal of Bangladesh Studies, vol. 12, no. 2, 2010.

২৪.       বাংলাদেশের প্রত্যেক সরকারি চাকরিজীবীকে প্রতিবছর চাকরির বিধিমালা অনুযায়ী তাঁর সম্পত্তির একটি তালিকা সরকারকে দিতে হয় কিন্তু বাস্তবে এ ধরনের বিবরণী দাখিলের নজির খুব কম। বরং নজির রয়েছে যে দুর্নীতিচর্চার মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ, যেমন সম্পদ জমানো আয়ের চেয়ে বেশি সাংসারিক ব্যয়, জ্ঞাত আয়ের চেয়ে বহুগুণ বেশি। এসব প্রমাণ দুর্নীতিগ্রস্ত। যদি সরকারি চাকরিজীবী (আচরণ) আইন ১৯৭৯ কঠোরভাবে অনুসরণ করা হয় তাহলে প্রায় ৭৫ শতাংশ দুর্নীতি কমানো সম্ভব। (M. Shamsul Haque, Advocate, Supreme Court, Bangladesh http://www.humanrights.asia/resources/journals-magazines/article2/0901/08anti-corruption-mechanisms-in-Bangladesh)।

২৫.       অনেক উন্নত গণতান্ত্রিক দেশে ব্যক্তিগত অর্থের সরকারি তদন্ত বাধ্যতামূলক, এমন অনেকে আছেন যাঁরা খুব ভালো সরকারি কর্মকর্তা অথবা জনপ্রতিনিধি হতে পারতেন, নির্বাচিত অথবা অন্য কোনোভাবে, সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে তাঁরা এ ধরনের দায়িত্ব নেবেন না, কারণ তাঁদের সম্পত্তির তদন্ত করা হবে।

২৬.      Government of Bangladesh, “The Right to Information Act 2009,” Act No. XX. 2009, Dhaka, Bangladesh.

২৭.       Committee on Human Rights Initiative. Bangladesh—The Right to Information Act, New York 2009. Right to Information Law—Major Challenges to Implementation Dream B4 Dies web blog: Tomorrow Never Dies, May 2010.

২৮.      World Bank, WBI. ANSA Region—The Power of Using the Right to Information Act in Bangladesh. Experiences from the Ground, 2012.

২৯.       দিল্লিতে বাসে ধর্ষণের ঘটনার পর বাক্ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ভূমিকা এবং সিভিল সমাজের আন্দোলনের কারণে নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে আইন, বিধি ও প্রতিষ্ঠানে পরিবর্তন এসেছে।

৩০.      IBP (International Budgetary Partnership), Open Budget Survey 2012: Open Budgets Transform Lives, 2012.

৩১.      ব্যাপক তথ্য (৮১-১০০) গুরুত্বপূর্ণ তথ্য (৬১-৮০), কিছু তথ্য (৪১-৬০) সর্বনিম্ন তথ্য (২১-৪০), শূন্য তথ্য (০-২০)।

৩২.      Sofia Wickberg, Anti-Corruption Resource Centre, Transparency International Bangladesh and Chr. Michelsen Institute, November 2012, Norway. U4 Expert Answer: Overview of Corruption and Anti-Corruption in Bangladesh.

৩৩.      এটি বলা হয়ে থাকে যে ঘুষের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণের কঠোর বিধিমালা এড়িয়ে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা ও প্রবৃদ্ধি বাড়াতে দুর্নীতির একটি তৈলাক্ত প্রভাব আছে। তবে এটি কেবল তখনই সত্য যখন বিধিমালাগুলো অদরকারি, জটিল ও কঠোর এবং যে উদ্দেশ্যে তাদের করা হয়েছে তা পূরণে কোনো কাজে আসে না। এগুলো কেবল প্রবৃদ্ধি হোঁচটকারী বিধিমালা।

৩৪.      সিঙ্গাপুর সরকারি কর্মকর্তাদের উচ্চ বেতন প্রদানের মাধ্যমে দুর্নীতি কমিয়ে এনেছে। এ ব্যবস্থার দুটি ফ্যাক্টর আছে: একটি দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন গড়তে সর্বোচ্চ রাজনৈতিক নেতৃত্বের দায়বদ্ধতা, দ্বিতীয়ত দুর্নীতিগ্রস্ত আমলার বিরুদ্ধে তদন্ত ও শাস্তি প্রদান একটি শক্তিশালী তদারকি প্রক্রিয়া ব্যবস্থা। বিভিন্ন খাতে উচ্চ মজুরি ও দুর্নীতির সম্পর্কের ওপর চালানো আন্তদেশীয় আর্থগাণিতিক গবেষণায় কোনো উল্লেখযোগ্য ফল পাওয়া যায়নি। এটি ঘটেছে মূলত বহফড়মবহবরঃু ঢ়ত্ড়নষবসং-এর কারণে। অর্থাত্ কম দুর্নীতির কারণে উচ্চ মজুরি ও আয় হচ্ছে আবার উচ্চ মজুরি ও আয় দুর্নীতি কমার সাথেও সম্পৃক্ত । [কোনটির কারণে কোনটি ঘটছে সেটি স্পষ্ট নয়।] (J. Stevenson, “Eight Questions About Corruption, ”Journal of Economic Perspectives, Summer 2005.)

 ৩৫.     World Bank Institute, ANSA, CIDA. 2012. “The Power of Using the Right to Information Act in Bangladesh: Experience from the Ground.”|

৩৬.     বাংলাদেশে কার্যকর স্থানীয় সরকারব্যবস্থার বাধা এবং তার প্রতিকার সম্পর্কে বলা হয়েছে এখানে Nurul Islam, Role of Experts in Policy Advice: Lessons of Experience, BIDS, Dhaka, 2010|

৩৭.      অতীত অভিজ্ঞতা অনুযায়ী একটি হিসাবে দেখা যায়, ২০০০ সালের শুরুর দিকে দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলের প্রার্থীদের স্বাধীন প্রার্থীসহ মোট অর্থের দরকার জিডিপির ১.৫ থেকে ২.৫ শতাংশ| M. Mudaharand R. Ahmed, Government and Rural Transformation, op cit.|

৩৮.     প্রত্যেক স্বতন্ত্র প্রার্থীকে অন্য রাজনৈতিক দলের প্রার্থীদের মতোই সমান হারে সরকারি তহবিল থেকে নির্বাচনী অর্থায়ন করতে হবে।

৩৯.      দুর্নীতির কিছু রূপ যেমন মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে ঘুষ নেওয়া, নাগরিকদের ঘুষ দেওয়ার জন্য হয়রানি করা, বিদেশি সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ এর আওতার বাইরে রয়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে শাস্তি তেমন কঠোর নয়, মাত্র ৩-১০ বছরের জেল। অন্যদিকে মালয়েশিয়ায় এ জন্য ২০ বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে। ইন্দোনেশিয়াতে কিছু কিছু দুর্নীতির জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। কাগজে-কলমে বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশনের ব্যাপক ক্ষমতা আছে অনুসন্ধান, তদন্ত এবং গ্রেপ্তার করার ক্ষেত্রে। (S. Naushin Parnini, “Governance Reforms and Anti-Corruption Commission in Bangladesh,” Romanian Journal of Political Science, vol. 11, No. 1, 2011.)।

৪০.       ২০০৬--২০০৭ সালে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আমলা, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযোগ ও বিচার-প্রক্রিয়া আরম্ভে এটি কার্যকর ভূমিকা পালন করলেও আর্মিকে তাদের কাজের আওতায় আনেনি। যেহেতু এটি একটি বিতর্কিত স্বল্পমেয়াদি সামরিক সরকারের সঙ্গে জড়িত ছিল তাই ক্ষমতার পালাবদলে পরবর্তী বছরগুলোতে এটির কাজে ভাটা দেখা যায়।

৪১.       পরিশিষ্টে (পরিশিষ্ট-গ দেখুন) ইন্দোনেশিয়ার, যার সুহার্তোর শাসনামলে ব্যাপক দুর্নীতির ইতিহাস ছিল, মতো দেশে দুর্নীতি দমন কমিশনের পরিধি ও কার্যকর ক্ষমতা উদাহরণ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।

৪২.       সংস্কারের রাজনৈতিক অর্থনীতির বিষয়টি এখনো শৈশব পর্যায়ে রয়ে গেছে। এর জন্য দরকার সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক উপাদান; যা পরিবর্তনে সহায়ক অথবা প্রতিবন্ধক, পরিবর্তনকে সাহায্য করার জন্য সমাজের বিভিন্ন খাতে প্রণোদনা এবং তাদের ক্ষমতা পরিবর্তনের বিপক্ষ শক্তির তুলনায় সরকারে তাদের প্রভাব।

৪৩.      একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর একজন নেতা সমমনা সমর্থক বা সহকর্মীদের নিয়ে সাহসে বলীয়ান হয়ে রাজনৈতিক দৃশ্যপটে আবির্ভূত হবেন এবং পরিবর্তনের দাবি তুলবেন। দুর্নীতির নিয়ন্ত্রণ এবং একটি উন্নত শাসনব্যবস্থার জন্য পারিপার্শ্বিক অবস্থাই নেতা তৈরি করতে পারে অথবা নিজের রূপকল্প বাস্তবায়নে নেতারা দৃশ্যপটে হাজির হয়ে পারিপার্শ্বিকতা তৈরি করতে পারেন। বাজেট দুর্নীতির নিয়ন্ত্রণ অথবা শাসনব্যবস্থার সংস্কারের প্রক্রিয়া হতে পারে কোনো অপ্রত্যাশিত, অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা অথবা দৈবক্রমে ঘটে যাওয়া অসংখ্য দুর্ঘটনার সমন্বিত রূপ।

৪৪.       ভারতের গুজরাট রাজ্যের দুর্নীতির নিয়ন্ত্রণের অভিজ্ঞতা এ ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। A. Panageria, Why Gujrat Miracle Matters. The Times of India, June 29, 2013 | T. Shah, A. Gulati, Hemant P. G. Shreedhar, and P. C. Jan. Secret of Gujrat’s Miracle After 2000, Economic and Political Weekly, December 26, 2009।

৪৫.       N. Loaza, J. Rigolini, R. Pigotlini, and G. Llorente, “Do Middle Classes Bring Institutional Reforms?” Discussion Paper, March 2012, Institute for the Study of Labor, Bonn. ২০১২ সালে ভারতে আন্না হাজারের দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনে মধ্যবিত্ত শ্রেণি সমর্থন জুগিয়েছিল ও এর অগ্রভাগে ছিল। তবে সামনের সারির রাজনৈতিক নেতৃত্বের, যাঁদের দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনে যথেষ্ট দায়বদ্ধতা ছিল না, ওপর যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি করার আগেই তা বাতাসে মিলিয়ে যায়। তারপরও দুর্নীতিবিরোধী ব্যবস্থা যেমন ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠা এবং তার ক্ষমতা ও দায়িত্ব বাড়ানোয় এর প্রভাব ছিল।

৪৬.      World Bank, “Bangladesh Poverty Assessment 2010: Assessing a Decade of Progress in Reducing Poverty.” World Bank, Washington, DC, 2013। যদিও গরিব মানুষেরা আনুপাতিক হারে তেমন সুবিধা পায়নি, তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির, যা জিডিপির ২.৫ শতাংশ, ব্যাপকতা বাড়াতে তারা বেশ সুবিধা পেয়েছে, যদিও তা পুরোপুরি জিডিপির ২.৫ থেকে ৩ শতাংশ নয়।

৪৭.       পূর্বোক্ত

৪৮.      এমনকি ১৯৯১ সালের আগে যখন মধ্যবিত্ত শ্রেণি বর্তমানের মতো এত বড় ছিল না, তখন বিদ্যমান ব্যবস্থায় পরিবর্তনের যেকোনো চাপ মোকাবিলা করা সম্ভব ছিল একটি গোষ্ঠীকে অপর গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে খেলানোর মাধ্যমে ১৯৭৫-১৯৮১ সময়কালে ক্ষমতায় থাকা কর্তৃত্ববাদী শাসনগোষ্ঠীর দ্বারা। এ ক্ষেত্রে তারা আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা আর রাজনৈতিক নিপীড়ন দুটোকে মিলিয়েই ব্যবহার করত।

৪৯.      বিস্তারিতভাবে বলতে গেলে এই দৃশ্যপট কেবল বাংলাদেশেই বিরাজ করছে না, বরং অনেক উন্নয়নশীল দেশেই বিরাজ করছে বিশেষ করে দক্ষিণ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোতে। আলোচিত দৃশ্যপট বিরাজ করে শুধু সেই সমাজে যেখানে সরকার পরিবর্তিত হয় নির্বাচনের দ্বারা, যদিও সরকারগুলো দৃশ্যত মনে হয় ‘অনুদার গণতন্ত্রের’ প্রতিনিধি। মধ্য ও উচ্চ আয়ের অগণতান্ত্রিক দেশে যেমন খনিজ/তেল সম্পদে সমৃদ্ধ দেশগুলোতে, সামাজিক শ্রেণিগুলোর মধ্যে একটি অদৃশ্য দর-কষাকষি রয়েছে। যেমন অভিজাত শ্রেণি ও সমাজের বাকি অংশের মধ্যে। কর্তৃত্ববাদী সরকার দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনসহ যখনই কোনো সামাজিক বা রাজনৈতিক পরিবর্তনের আন্দোলনের মুখে পড়ে তখনই তারা নিপীড়ন ও সম্পদ হস্তান্তর কর্মসূচি, যাতে রয়েছে নগদ সহায়তা ও বিভিন্ন ধরনের দয়া, বাড়ানোর মিলিত প্রয়াসের মাধ্যমে এর মোকাবিলা করার চেষ্টা করেন। তবে অচল ও গরিব দেশগুলোতে অপশাসন এবং দুর্নীতি প্রলম্বিত করা যায় শক্তি প্রয়োগের দ্বারা, যদি সেখানে থাকে একটি কর্তৃত্ববাদী সরকার, যাকে নিয়ন্ত্রণ করছে সেনাবাহিনী অথবা সমাজের অভিজাত শ্রেণি সেনা সমর্থন নিয়ে। এটি একটি অস্থিতিশীল অবস্থা এবং এখানে পরিবর্তনের সম্ভাবনা বেশ বেশি, তবে তা অনিশ্চিত। Francis Fukuyama, “The Middle Class Revolution—Mid, Middling, and Mobilized” Wall Street Journal Review, January 24-30, 2013. Fareed Zakaria, The Rise of Illiberal Democracy, Foreign Affairs, November/December1997.

৫০.       পূর্বোক্ত

৫১.       Pierre Landell-Mills, “Citizens Against Corruption: Partnership for Transparency,” Final, UK, 2013. Citizens Against Corruption: What Work? Findings from 200 projects in 53 countries. http://blogs.worldbank.org/publicsphere/. এই বইয়ে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে কীভাবে বিভিন্ন দেশে সিভিল সমাজের সংস্থাগুলো বিভিন্ন প্রকল্পে নাগরিক গোষ্ঠীগুলোকে সংগঠিত, সহায়তা ও অনুপ্রাণিত করছে, স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে, সফলতার সঙ্গে সরকারি কেনাবেচা প্রক্রিয়া নজরদারি এবং একই সঙ্গে বিভিন্ন কার্যক্রমে দুর্নীতিবিরোধী কাঠামো শক্তিশালী করার জন্য। এটি গুরুত্বপূর্ণ যে দুর্নীতিবিরোধী প্রচারাভিযানে গঠনমূলক ভূমিকা পালন করতে হলে সিভিল সমাজের সংগঠনগুলোর অবশ্যই একাত্মতার ভাবমূর্তি থাকতে হবে এবং তাদের সুবিধাভোগী ও পৃষ্ঠপোষকদের পাশাপাশি তাদের প্রচেষ্টাগুলোর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির আলোকে পরিচালিত করতে হবে। সরকারের উচিত দায়িত্ব পালনে তাদের যথেষ্ট স্বাধীনতা দেওয়া। সিভিল সমাজ ও সরকারের সংঘাতমূলক অবস্থান দুজনের উপকারী দিকটিকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে। তাদের সরকারি চুক্তি ও সম্পদের ওপর নির্ভরশীল হলে চলবে না। এতে তাদের স্বাধীনতাই সংকুচিত হবে। তাদের নিজস্ব সম্পদ আহরণের উত্স থাকতে হবে, যেমন সদস্যদের চাঁদা অথবা বেসরকারি দাতব্য প্রতিষ্ঠানের অনুদান। অবধারিতভাবেই, অদূর ভবিষ্যতে এ ধরনের দায়িত্ব পালনকালে তাদের প্রধান অর্থায়নের উত্স হবে বাইরের সাহায্য। আন্তর্জাতিক সুনাম আছে এমন এনজিও এবং সিভিল সমাজের সংস্থা থেকে সাহায্য নেওয়া ভালো, এ ধরনের সাহায্যকে দাতা-গ্রহীতার সম্পর্কের রাজনীতি থেকে মুক্ত রাখার জন্য। এসব এনজিও ও থিংক ট্যাংক উন্নত দেশগুলোর সরকার থেকে নিজেদের স্বাধীন রাখার ব্যাপারে বেশ পরিচিত।

৫২.       United Nations Office of Drugs and Crimes (UNODC), “United Nations Convention Against Corruption” (Vienna, Austria: UNODC, 2004), pp.10–13. ttp://en.wilipedia.org/wiki/United_Nations_Convention_against_Corruption.

৫৩.      এই কনভেনশনে দুর্নীতির জন্য দায়ী আমলা, রাজনীতিক, বিচারক নির্বাচিত অথবা নির্বাচিত নন এমন সরকারি কর্মকর্তাদের একটি বিস্তৃত সংজ্ঞা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।

৫৪.       দুর্নীতিবিরোধী পদক্ষেপে জনমত গড়তে সরকার, সুশীল সমাজের সংস্থা ও মিডিয়া এই কনভেনশনকে উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। পর্যালোচনা প্রক্রিয়ায় সিভিল সমাজের অন্তর্ভুক্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির জন্য এবং একইভাবে পর্যালোচনা প্রক্রিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা ও কার্যকারিতার জন্য। Transparency International Bangladesh and UNCAC Coalition.UN Convention Against Corruption: Civil Society Review, Bangladesh, 2011. যতই পরিশীলিত আইনি কাঠামো প্রয়োগ করা হোক না দেশের ভেতর আধিপত্যকামী গোষ্ঠী নৈরাজ্যের মাধ্যমে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে উপায় খুঁজে বের করতে পারে। তাই রাষ্ট্রকে সাড়া দেওয়ার জোর দাবি জনগণের পক্ষ থেকে ওঠা দরকার।

            (H. Hechter, G. F. Zinkernagel, Koeschem, D. Morns, “Can UNCAC Address Grand Corruption?,” Chr. Michelsen Institute, U4 Anti-Corruption Resource Centre, U4 Report, October 2011.)

৫৫.       UNCAC তে রাষ্ট্রীয় দলগুলোর (States Parties) একটি সম্মেলন করা (Conference of the States Parties) হয় যা সচিবালয় হিসেবে কাজ করে রাষ্ট্রীয় দলগুলোর মধ্যে সহযোগিতা ও সামর্থ্য বৃদ্ধিতে যেন তারা টঘঈঅঈ লক্ষ্যসমূহ পূরণ করতে এবং এদের বাস্তবায়নের প্রসার ঘটাতে ও পর্যালোচনা করতে পারে। বিভিন্ন সেশনের অন্তর্বর্তী পর্যায়ে বাস্তবায়ন পর্যালোচনা গোষ্ঠী, যেটি তদারকি পর্যালোচনা ব্যবস্থা ও কারিগরি সাহায্যের ওপর মনোযোগ দেয়, সম্পদ পুনরুদ্ধারের ওপর ওয়ার্কিং গ্রুপ, প্রতিরোধের ওপর ওয়ার্কিং গ্রুপ, আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ওপর বিশেষজ্ঞদের নিয়ে বৈঠকসহ নিজেদের মাঝে নিয়মিত বৈঠকে মিলিত হয়। এটি দাতা ও গ্রহীতা দেশগুলোর বাস্তবায়নের জন্য সমন্বয় জোরদার ও কারিগরি সাহায্য বাড়ানোর অনুরোধ করে এবং আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ দেওয়া নিয়ে কাজ করে। ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত প্রথম সম্মেলনে সবাই একমত হন যে ‘কনভেনশন বাস্তবায়নে কার্যকর ও দক্ষ পর্যালোচনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি।’ এটি নীতিগতভাবে একটি মতৈক্যকে প্রতিনিধিত্ব করছে। তবে জি ৭৭ দেশগুলোর প্রভাবশালী সদস্যদের উদ্বেগের কারণে তারা এ ব্যাপারে ২০০৮ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় সম্মেলনে খুব কমই অগ্রগতি অর্জন করে। (“UN Convention against Corruption: Recommendations for a Review Mechanism,” Heimann and Dell, April 2009)। ৪০টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও এনজিওর প্রধান নির্বাহী জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনকে লেখা এক খোলা চিঠিতে UNCAC এর প্রতি তাদের সমর্থন ব্যক্ত করেন। তবে এর বাস্তবায়নে শ্লথগতি নিয়ে তাঁরা উদ্বেগ প্রকাশ করেন। ৬টি দেশের কেস স্টাডির ওপর এক প্রতিবেদন বলছে: আত্মপর্যালোচনা কোনো ফল বয়ে আনেনি এবং সংসদ, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে অগ্রগতির বাইরের পর্যালোচনার পরিকল্পনাই করা হয়নি। (Anti-corruption Policy making in Practice: What Can Be Learned for Implementing Article 5 of UNCAC?” Report by U4 Anti-Corruption Resource Center, 2007; UN Global Compact. Link given: http://www.unglobalcompact.org/issues/transparency_anticorruption/CEO_Letter.html).

৫৬.      পূর্বোক্ত

৫৭.       নিম্ন আয়ের উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য বিশ্বব্যাংকের/ওউঅ সাহায্য বণ্টনের ক্ষেত্রে দুর্নীতির নিয়ন্ত্রণ/শাসন একটি গুরুত্বপূর্ণ সাহায্য নির্ধারণী সূচক হিসেবে কাজ করে। এটি গুরুত্বপূর্ণ যে গ্রহীতা দেশে ব্যাপক দুর্নীতি হয়, এমন ধারণা থাকলে কেবল বৈদেশিক সাহায্যই নয়, বৈদেশিক বিনিয়োগও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এটি বিশেষ করে সত্য সেসব দেশের জন্য যেখানে কঠোর আইন রয়েছে কোম্পানিগুলোকে শাস্তি দেওয়ার জন্য, যারা বিদেশে বিনিয়োগ করতে গিয়ে দুর্নীতির আশ্রয় নেয়। বিদেশি রাষ্ট্রে সরকারি কর্মচারী ও আমলাদের ঘুষ দেওয়ার সঙ্গে জড়িত বেসরকারি করপোরেশনদের বিচার ও শাস্তি দেওয়ার জন্য বহু ঙঊঈউ দেশেই দুর্নীতিবিরোধী আইন রয়েছে।

৫৮.      এই সম্পর্কে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টের সাম্প্রতিক বিবৃতি যথাযথ। তিনি বলেছেন যে, আমাদের এমন সব জায়গায় কাজ করতে হয় যারা সুশাসনের বৈশ্বিক সূচকে উপরের দিকে অবস্থানে নেই। আমাদের এমন সব জায়গায় দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়তে হবে যেখানে অসদাচরণ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়ার আইনি কাঠামো ত্রুটিপূর্ণ এবং জবাবদিহির প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিকভাবে কাজ করে না অথবা অনুপস্থিত। জটিল পরিস্থিতিতে আমাদের কাজ করার আকাঙ্ক্ষা এবং কিছুটা ঝুঁকি নেওয়ার তাড়নাকে কোনোভাবেই ব্যাংকের প্রকল্প বা কার্যক্রমে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়ার ইচ্ছার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা ঠিক হবে না। ক্রয়-প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির সম্ভাবনা চিহ্নিত হওয়ায় একটি বড় প্রকল্প সহায়তা প্রত্যাহার করা হয়েছে এমন উদাহরণ দিতে গিয়ে ২০১২-১৩ সালে পদ্মা সেতু থেকে বিশব্যাংকের সরে যাওয়াকে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘আমাদের কি বড় ঝুঁকির প্রকল্প থেকে বিরত থাকা এবং গরিবদের বড় ধরনের সুফল নিয়ে আসে এমন প্রকল্প উপেক্ষা করা উচিত, নাকি যথাযথ নিরাপদ ব্যবস্থা তৈরি করে একটু হিসাব করে ঝুঁকি নিয়ে সামনে এগোনো উচিত? আমার উত্তর হচ্ছে উন্নয়নের ফল পেতে হলে আমাদের ঝুঁকি নিতেই হবে। তবে একই সঙ্গে আমাদের চোখ-কান খোলা রাখা উচিত এবং যতটা সম্ভব ঝুঁকি কমানোর চেষ্টা করা উচিত।’ The Bank President’s address at the Centre for Strategic and International Studies, Washington, DC, 2013. http://www.worldbank.org/en/news/speech/2013/01/30/world-bank-group-president-jim-yong-kim-speech-anti-corruption-center-for-strategic-and-international-studies.

৫৯.      দুর্নীতিবিরোধী মহলের আরেকটি উদ্বেগ হলো সামরিক সরঞ্জামাদিতে ব্যয়। গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে দুর্নীতি ভাগাভাগি করে নেওয়া হয় রাজনৈতিক নেতার ও সেনাবাহিনীর মাঝে। বেসামরিক ক্রয়-প্রক্রিয়ার তুলনায় প্রতিরক্ষা ক্রয়-প্রক্রিয়া বেশ অস্পষ্ট এবং অধিকাংশ দেশে প্রতিরক্ষা ক্রয়ের বিস্তারিত রহস্যাবৃত থেকে যায়। তবে বেশির ভাগ উন্নয়ন সাহায্য সংস্থা, বিশেষ করে বহুপক্ষীয় ও আঞ্চলিক সংস্থাগুলো, এ ধরনের সামরিক সহায়তার সঙ্গে যুক্ত নয়।

৬০.      উদাহরণস্বরূপ, বিশ্বব্যাংক নিম্নোক্ত কৌশলের মাধ্যমে তার কৌশল বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ নিয়েছে: ক. দুর্নীতিবিরোধী প্রক্রিয়ায় বিশ্বব্যাংকের জড়িত হওয়ার সুযোগ চিহ্নিত করা এবং একই সঙ্গে শাসনের সমস্যা বিশ্লেষণে এবং কৌশল ও প্রকল্প নির্ধারণে এসবের সমাধান খোঁজার জন্য দেশ শাসন ও দুর্নীতিবিরোধী প্রক্রিয়ার, যাতে আছে যৌথ ওয়ার্কশপ এবং সমসাময়িকদের কাছ থেকে শেখা, সাথে যুক্ত হওয়া; খ. শাসন ও বিভিন্ন খাতে ও প্রকল্পে দুর্নীতিবিরোধী প্রচেষ্টার সঙ্গে যুক্ত হওয়া ১. প্রকল্প তৈরি ও খাতভিত্তিক সংলাপ হিসাবরক্ষণ ব্যবস্থা ও প্রণোদনা শক্তিশালী করার জন্য এবং ২. চাহিদাভিত্তিক উপায়, জবাবদিহিমূলক শাসন সূচক এবং রাজনৈতিক অর্থনীতির বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিভিন্ন খাত ও প্রকল্পে নিয়মতান্ত্রিক ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ও পর্যালোচনা শক্তিশালী করা। IEG, World Bank, “Bangladesh: World Bank Engagement in Governance and Anti-Corruption,” 2011.

৬১.      পূর্বোক্ত

৬২.      NORAD, Joint Evaluation of Support to Anti-Corruption Efforts: Bangladesh Country Report, January 2011. DFID, SIDA, NORAD, ADB, DANIDA. পরিশিষ্ট-গ. দ্রষ্টব্য।

৬৩.     বিশ্বব্যাংক। op cit., p.6, pp. 29–31.

৬৪.      NORAD, পূর্বোক্ত। ২০০৮ সালে এক পর্যালোচনা প্রতিবেদনে বলা হয় যে বাংলাদেশ সরকার তখনই পরিবর্তনের চাহিদার প্রতি সাড়া দেয় যতক্ষণ না এটি পৃষ্ঠপোষক ব্যবস্থার প্রতি কোনো ধরনের হুমকি তৈরি করছে, অন্য জায়গায় খুব কমই সত্যিকারের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এটি ব্যাখ্যা করে কেন সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা সাফল্য পেয়েছে কিন্তু দুর্নীতি দমন এবং আমলাতন্ত্রের সংস্কারে ব্যর্থ হয়েছে। প্রশাসনের রাজনীতিকীকরণ ও পৃষ্ঠপোষক-ব্যবস্থা পরিত্যাগ করার রাজনৈতিক সদিচ্ছার ঘাটতির কারণে সরকারি সেবার যেকোনো উল্লেখযোগ্য সংস্কার বাধাগ্রস্ত হয়েছে। S. Foot and A.K. Mubin. 2007. Political Economy Assessment for Review of Financial Management Reform Programme. DFID, Bangladesh

            এটি একটি চলমান সমস্যা, যার মোকাবিলা করা বেশ কঠিন বলে দাতাদের কাছে মনে হয়েছে। তবে সরকারি সংস্থা যেমন: আমলাতন্ত্র, বিচার বিভাগ, পুলিশ এবং সেনাবাহিনীতে কোনো সংস্কার নেই, এমনটি বলা যাবে না। তবে সমস্যা হচ্ছে পরিবর্তনের আওয়াজ তোলার সম্ভাবনা আছে এমন অনেক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান প্রায়ই বিভক্ত, বিচ্ছিন্ন ও এ ধরনের পরিবর্তন আনতে যথেষ্ট প্রভাবশালী নয়। M. Moore, 2003, Politics and the Drivers of Pro-Poor Change in Bangladesh.

৬৫.      NORAD পূর্বোক্ত।

৬৬.     আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, ভবন নিরাপত্তা ও শ্রমিকদের কর্মপরিবেশের সঙ্গে সম্পৃক্ত আইন ও বিধিমালা পালনের ব্যর্থতা সম্পর্কযুক্ত ক. আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পরিদর্শনকারী এবং এ শিল্পের আঁতাতের, যা ঘুষের মাধ্যমে তৈরি, সঙ্গে এবং খ. শিল্প মালিকদের পরিদর্শনকারী সংস্থাগুলোকে দুর্বল ও অদক্ষ রাখার মধ্যে। আন্তর্জাতিক ধারণা যা বিদেশে প্রতিক্রিয়া তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে তা বিদেশি মিডিয়ায় এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে (The Economist, May 4, 2013): ‘বিজিএমইএর ৪০০০ সদস্য রয়েছে, যারা রাজনৈতিকভাবে বেশ শক্তিশালী। এ শিল্প দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত এবং কমপক্ষে ২৫ জন এমপির এ শিল্পে বিনিয়োগ রয়েছে।’ ২০১২ সালে একটি বড় কারখানায় অগ্নিদুর্ঘটনার পর তার কিছু সদস্য কারখানায় পরিদর্শক পাঠায়। চারটি ভবনে কাঠামোগত ত্রুটি ছিল। এ ছাড়া নির্মাণ বা শ্রম আইন লঙ্ঘন করা হয়েছিল। মালিক কারা ছিল? তারা বিজিএমইএর সভাপতি, তার পূর্বসূরি এবং একজন সাবেক সহসভাপতি। কাউকেই বিচারের মুখোমুখি হতে হয়নি। সবাই দেখছে কী হয় কোর্ট বিজিএমইএর ১৫ তলা ভবন অবৈধ ঘোষণা করার পর। ১৬ জুনের মধ্যে এটি ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেন কোর্ট। তবে কেউই মনে করছে না বিজিএমইএ আদেশ মানবে। তবে তারা যদি তাদের নিজেদের অনিয়মই শোধরাতে না পারে তাহলে অন্যরা তা করবে কেন। বাংলাদেশের একটি বড় শিল্প গ্রুপ নসু গ্রুপের পদচারণা আছে ব্যাংকিং, নির্মাণ ও কৃষি খাতে। এর চেয়ারম্যান বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টেরও চেয়ারম্যান। এর তিনটি কারখানা জরিপে দেখা যায় যে তাদের প্রয়োজনীয় নিয়ম মেনে তৈরি করা হয়নি এবং তারা যেকোনো সময় ধসে পড়তে পারে। Wall Street Journal, March 30, 2013.

৬৭.      এখন আমরা দেখি যে এই লোকগুলোকে কম বেতন দেওয়া হতো; তাদের সে রকমভাবে কোনো অর্থই দেওয়া হতো না এবং সবচেয়ে বড় কথা হলো তাদের কাজ করতে হতো অনিরাপদ ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে, যা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। এটি এক ধরনের আধুনিক ‘দাসত্ব’, আরও বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ যদি শ্রমমান উন্নয়নে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয় তিনি ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা স্থগিত করবেন।’ EU Trade Commission’s statement quoted in Wall Street Journal, Monday, May 6, 2013, p.A8.

৬৮.     পরিদর্শকের সংখ্যা ১৮ জন থেকে কয়েক শতে উন্নীত করতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

৬৯.      যেমন বাংলাদেশি শ্রমিকদের সংগঠন করার ও মালিকদের সঙ্গে দর-কষাকষি করার আইনি অধিকার দেওয়া হয়েছে। বাস্তবে দেখা যায়, পোশাক শ্রমিকদের সংগঠিত করার চেষ্টা অতীতে দমন করা হয়েছে এবং আন্দোলনকারী শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্র থেকে খুঁজে বের করে হয়রানি করা হয়েছে সরকারি সমর্থন নিয়ে। The Washington Post, May 4–5, 2013। এটি হয়তো অতিরঞ্জিত, তবে এটি বিদেশে প্রচলিত ধারণা। এটি এখনো চলছে, যদিও কিছু শ্রম আইন ছিল অতীতে, তাদের কখনোই বাস্তবে প্রয়োগ করা হয়নি।

৭০.       Financial Times, May 6, 2013.

৭১.       নৈতিক আচরণ গুণগত আস্থা তৈরি করে। প্রাথমিক পর্যায়ে নৈতিকতা হচ্ছে অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ও বাইরের চাপের জন্য স্বল্প খরচের প্রতিস্থাপক। শাসনব্যবস্থায় দেখা যায় নৈতিক আচরণ ছাড়া, একটি নির্দিষ্ট সময় পর নিয়ন্ত্রণ বেশ ব্যয়বহুল ও এদের বাস্তবায়ন বেশ দুরূহ। আইন-প্রয়োগকারী ব্যবস্থা একেবারে দুর্বল হয়ে পড়ে, যদি মানুষের আচরণে ন্যূনতম নৈতিক ভিত্তি না থাকে। মূল্যবোধের একটি কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার পরিচালনাকে বেশ সহজ করেছে। সমাজের সব পর্যায়ে, বিশেষ করে সমাজের উঁচু পর্যায়ে এবং অভিজাতদের মাঝে দুর্নীতি সহ্য করার মাত্রা বিগত কয়েক বছরে বেশ বেড়েছে। এ রকম পরিবেশে মানুষ রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার বৈধতার ওপর আস্থা হারায়। আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধা সার্বিকভাবে কমে গেছে।

 ৭২.      বেসরকারি পুঁজিবাদী ব্যবস্থার জনক অ্যাডাম স্মিথ সম্পদের পাশাপাশি মূল্যবোধের ওপরও জোর দিয়েছিলেন। তিনি উচ্চ মুনাফা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। এটি ব্যবসায়ীদের মাঝে স্বাভাবিকভাবে বিদ্যমান মিতব্যয়িতাকে নষ্ট করে দেয়। যখন মুনাফা বেশি হয়, তখন অপ্রয়োজনীয় ও মোটামুটি মানের মূল্যবোধের বাহুল্য দেখা দেয় এবং তার অবস্থার জন্য যতটুকু দরকার তার চেয়েও বেশি বিলাসিতা তার মধ্যে দেখা যায়। N. Islam, “Making of a Nation,” p. 405

৭৩.      http://en.wikipedia.org/wiki/Anti_Corruption_Commission_Bangladesh|

৭৪.       Naushin Pasnini, Governance Reforms and Anti-Corruption Commission in Bangladesh. Romanian Journal of Political Science2 (1), 2011.

৭৫.       M. Jason, Commissioner Vice Chairman, Corruption Eradication Commission, Indonesian Corruption Eradication Commission, 2010, Jakarta, Indonesia.

 ৭৬.     ২০১২ সাল পর্যন্ত এটি অর্থ মন্ত্রণালয় এবং কাস্টমস ও শুল্ক বিভাগের সংস্কার এবং একই সঙ্গে ইন্দোনেশিয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে স্বার্থের সংঘাত এড়াতে অভ্যন্তরীণ নিয়ম শক্তিশালী করতে ভূমিকা রেখেছে।

 ৭৭.     অন্যদের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়া এবং নিজের সামর্থ্য তৈরির জন্য, ইন্দোনেশিয়ার দুর্নীতি নির্মূল কমিশন, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ব্রুনাই, হংকং ও সিঙ্গাপুরের এ রকম কমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছে ও তাদের সহযোগিতা পাচ্ছে।