মিয়ানমারের মানবাধিকার আইকনের কী হলো?

২০১০ সালে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা অং সান সু চিকে গৃহবন্দী দশা থেকে মুক্তি দেয়। সে সময়ে সু চি প্রায় দুই দশকব্যাপী পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত রাজনৈতিক বন্দীদের মধ্যে অন্যতম হিসেবে বিবেচিত হয়েছেন। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই সু চি আরেকজন সাবেক রাজনৈতিক বন্দীর কাছ থেকে অভিবাদনসূচক ফোন পেলেন। সেই সাবেক রাজনৈতিক বন্দী ভাক্লেভ হাভেল চেক প্রজাতন্ত্রের একজন ভিন্নমতাবলম্বী নাট্যকার, যিনি ১৯৮৯ সালে দেশটির প্রথম কমিউনিস্ট-উত্তর নেতা হয়েছিলেন। সেই ফোন কলটিই ছিল তাঁদের মধ্যে প্রথম প্রত্যক্ষ কথোপকথন, কিন্তু তাঁদের রাজনৈতিক সম্পর্ক সু চির বন্দিদশার পুরো সময়জুড়েই ছিল। চেকোস্লোভাকিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দুই বছর পার হওয়ার পর ১৯৯১ সালে হাভেল সু চিকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়ার জন্য নোবেল কমিটিতে সুপারিশ করেন। মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনের নেতৃত্বদানের স্বীকৃতি হিসেবে সু চিকে এই পুরস্কার দেওয়ার জন্য হাভেল চেষ্টা চালান। যখন সু চির একটি প্রবন্ধ বই প্রকাশিত হয়, সেখানে হাভেল ভূমিকায় বলেন, ‘আমরা যারা ন্যায়বিচার অনুসন্ধান করি, তাদের সবার পক্ষ হয়ে সু চি কথা বলেন।’

দুনিয়াজোড়া এমন অনেক ভিন্নমতাবলম্বীর মধ্যে হাভেল ও সু চিও রয়েছেন, যাঁরা গত শতকের আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝিতে মুক্তির প্রতিমূর্তি হিসেবে আবির্ভূত হন এবং অনেকে সফলভাবে তাঁদের ওপর নির্যাতন চালানো শাসকগোষ্ঠীকে উত্খাত করতেও সক্ষম হন। দক্ষিণ আফ্রিকায় নেলসন ম্যান্ডেলা প্রায় ৩০ বছর কারাভোগের পর বর্ণবাদ প্রথা বিলোপ করতে সক্ষম হন এবং সে দেশের প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত হন। ওয়ারশতে লিচ ওয়ালেসা নামে একজন জাহাজ নির্মাণের কারখানা শ্রমিক এবং সলিডারিটি নামে একটি আন্দোলন কমিউনিস্ট সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে। ফিলিপাইনেও ফার্দিনান্দ মার্কোসের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটে যখন নিহত স্বৈরাচারবিরোধী একজন সমালোচকের বিধবা স্ত্রী করাজোন অ্যাকুইনো তাঁর স্বামীর সংগ্রামকে এগিয়ে নেন। গণতান্ত্রিক আন্দোলন যে সব সময় জয়ী হয়েছে এমন নয়। তিয়েনআনমেন স্কয়ারে ছাত্র আন্দোলনে চীন সরকারের চালানো ব্যাপক হত্যাকাণ্ড তার সবচেয়ে নির্মম উদাহরণ। কিন্তু গত শতকের শেষ তিন দশকে পৃথিবীব্যাপী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সংখ্যা ৩১টি থেকে বেড়ে ৮১টি হয়েছে।

এসব সংস্কারকের একেকজনের জন্য একেক রকম পরিণতি অপেক্ষা করছিল। হাভেল ও ম্যান্ডেলা রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার পরও তাঁদের সুনাম অক্ষুণ্ন রেখেছেন, আবার পোল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ওয়ালেসা একজন খেয়ালি ও অনির্ভরযোগ্য নেতা হিসেবে পরিচিতি পান। কিন্তু তাঁদের কারোরই অং সান সু চির মতো এমন অপ্রত্যাশিত ও ভয়ানক রূপান্তর ঘটেনি। সু চির নৈতিক স্পষ্টতা ও ক্ষমাপূর্ণ সহনশীলতা তাঁকে দীর্ঘদিন ধরে মানবাধিকার ও অসহিংসতার একজন শক্তিশালী প্রতীকে পরিণত করেছে (২০১১ সালে তাঁর জীবনের ওপর ভিত্তি করে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়)। কিন্তু ২০১৬ সাল থেকে যখন তিনি মিয়ানমারের কার্যত নেতায় পরিণত হন, তখন থেকে তিনি একের পর এক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় নিরাসক্ত রয়েছেন। বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলের মুসলিম নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো বর্বর নির্যাতনের ঘটনায় এটা সবচেয়ে গুরুতরভাবে ধরা পড়েছে।

মিয়ানমার ১৩৫টি স্বীকৃত নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীর একটি জোড়াতালি দেওয়া দেশ। এদের মধ্যে দেশের মধ্যাঞ্চলের বামার জাতিগোষ্ঠী সবচেয়ে প্রভাবশালী। বামাররা মোট জনসংখ্যার ৬৮ শতাংশ। দেশটির ক্ষমতাসীন এলিটদের বেশির ভাগও বামার। অসংখ্য নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর সঙ্গে বামার নেতৃত্বাধীন সরকারের দশকের পর দশক ধরে চলা সশস্ত্র সংঘাত ধীরে ধীরে ফুটন্ত অবস্থায় পৌঁছেছে। সু চির বাবা অং সান একজন বামার জেনারেল ছিলেন। তাঁকে বার্মার আধুনিক জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অং সান ১৯৪৭ সালে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসন ধ্বংসের স্বার্থে কয়েকটি গোষ্ঠীকে নিজেদের মধ্যে পার্থক্য ভুলে একত্র হতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। জানুয়ারি ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতার কিছুকাল আগেই অং সান নিহত হন। স্বাধীনতার পরপরই নতুন জাতি গোত্রভিত্তিক সংঘাতে নিমজ্জিত হয়।

এসব গৃহযুদ্ধই ১৯৬২ সালে সামরিক বাহিনীকে ক্ষমতা দখলের অজুহাত তৈরি করে দিয়েছিল (সামরিক বাহিনী পরবর্তী সময়ে দেশটির নাম বার্মা থেকে মিয়ানমার করেছিল; পুরোনো রাজধানী ইয়াঙ্গুনের নাম বদলিয়ে রেঙ্গুন করেছিল এবং নেপিডোকে নতুন রাজধানী বানিয়েছিল)। গণতন্ত্রের জন্য ক্রমবর্ধমান চাপের মুখেই জান্তা অদক্ষতা ও নির্যাতনের মাধ্যমে পঞ্চাশ বছর দেশ শাসন করে। ২০১৫ সালে যখন বহুদিন পর উন্মুক্ত নির্বাচন দেওয়া হলো, সু চির জনপ্রিয়তার কারণে তাঁর দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। এনএলডি ও সেনাবাহিনী সচেতনভাবে একটি সমঝোতার মাধ্যমে ক্ষমতা ভাগাভাগি করে নেয়। ফলে ২০১৬ সালে এমন একটি সরকার গঠিত হয়, যা বেসামরিক নেতৃত্বাধীন হলেও এতে সামরিক বাহিনীর যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ থেকে যায়।

ক্ষমতায় গিয়ে সু চি তাঁর বাবার মতো আলোচনার মাধ্যমে নৃতাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব নিরসনের ঘোষণা দেন। তিনি ঘোষণা করেন, ‘আমাদের দেশ শান্তির জন্য উন্মুখ হয়ে আছে।’ কিন্তু কিছু সংঘাত আরও তীব্র আকার ধারণ করে এবং সেনাবাহিনী শান্তিচুক্তি ভঙ্গ করে। সরকারের সমালোচনামুখর সাংবাদিক ও আন্দোলনকর্মীদের জেলে ঢোকানো হয়। সবচেয়ে গুরুতর ঘটনা হলো রোহিঙ্গাদের দুর্দশা একটি মানবিক বিপর্যয়ে পরিণত হয়। গত বছরের অক্টোবর ও চলতি বছরের আগস্টে সেনাবাহিনী ও পুলিশের চৌকিতে রোহিঙ্গা উগ্রবাদীদের হামলার রেশ ধরে হিংস্র নির্যাতন শুরু হয়। গত মাস পর্যন্ত চার লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। সঙ্গে নিয়ে আসে নির্বিচার হত্যা ও গণধর্ষণের আলামত। ভূ-উপগ্রহ থেকে তোলা ছবিতে দেখা যায়, দুই শয়ের বেশি রোহিঙ্গা গ্রাম পুড়িয়ে ছাই করে ফেলা হয়েছে।

মিয়ানমারের ভেতরে অন্য প্রায় সব নৃগোষ্ঠীর মানুষই রোহিঙ্গাদের ঘৃণা করে। দেশের প্রায় নব্বই শতাংশ জনগোষ্ঠী বৌদ্ধ। বেশির ভাগই মুসলিম রোহিঙ্গাদের অবৈধ অভিবাসী মনে করে। মিয়ানমার সরকারের নৃগোষ্ঠীর তালিকায় রোহিঙ্গাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এই পক্ষপাতের বিরুদ্ধে সু চি কোনো ব্যবস্থাই নেননি। জাতিসংঘের একটি মানবাধিকার দল এই সংকটের অনুসন্ধানে আসতে চাইলে সু চির সরকার ভিসা দিতে অস্বীকার করে। আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোকেও সাহায্য দিতে বাধা দেওয়া হয়।

জাতিসংঘের মানবাধিকার-বিষয়ক হাইকমিশনার এই সামরিক অভিযানকে ‘জাতিগত নিধনের পাঠ্যবই উদাহরণ’ বলে আখ্যায়িত করেছে। সু চির মতো নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়া ডেসমন্ড টুটু ও মালালা ইউসুফজাই সহিংসতার নিন্দা জানাতে তাঁকে অনুরোধ করেন। কিন্তু এর পরিবর্তে তিনি রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের ‘সন্ত্রাসী’ বলে বর্ণনা করেন এবং বিশ্বব্যাপী চলমান নিন্দাকে খারিজ করে দেন। সু চি বলেন, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ‘ভুল তথ্যের এক বিরাট তুষারস্তূপ তৈরি করেছে’। তাঁর কার্যালয় থেকে অভিযোগ করা হয়, রোহিঙ্গারা একটা শোরগোল তোলার জন্য নিজেদের ঘরবাড়িতে নিজেরাই আগুন দিয়েছে। সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে সু চি এক ভাষণে সেনাবাহিনীর সমালোচনা করতে অস্বীকৃতি জানান এবং নৈতিক তুলনার একটি স্থায়ী অনুশীলন প্রস্তাব করেন। তিনি বলেন, ‘অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগ দুটোই আছে। আমাদের সবকিছুই শুনতে হবে।’

সম্প্রতি আমি মিয়ানমারে গিয়েছিলাম। সমস্যা কোথায় তা বের করতে কয়েক ডজন মানুষের সাক্ষাত্কার নিয়েছি। তাঁদের অনেকেই বলেছেন যে সু চির ক্ষমতা খুবই সীমিত। সেনাবাহিনীর ওপর তাঁর কোনো কর্তৃত্বই নেই। এখনো সরকারের মূল জায়গাগুলো সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণ করে। গণতান্ত্রিক সংস্কার উল্টে দেওয়ার ক্ষমতাও তাদের আছে। অনেকে মনে করেন, সু চি একটি ঘৃণিত ও ক্ষমতাহীন সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর জন্য দেশের ভেতরে নিজের জনপ্রিয়তা হারানোর ঝুঁকি না নেওয়ার রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ কষেছেন। আবার অন্যরা মনে করেন তাঁর রাজনৈতিক দক্ষতার অভাব রয়েছে। অনেকে মনে করেন তিনি সেনাবাহিনীর স্বৈরাচারী অভিব্যক্তি এবং সংখ্যাগুরু বৌদ্ধ বামার জাতিগোষ্ঠীর মতো মুসলিমবিরোধী কুসংস্কার ধারণ করেন। কিন্তু যাঁদের সঙ্গে কথা বলেছি তাঁদের প্রায় সবাই তাঁর রূপান্তরের গতি ও মাত্রা দেখে আশ্চর্যান্বিত। একজন সাবেক ছাত্র আন্দোলন কর্মী ও রাজনৈতিক বন্দী, যিনি সু চির দেহরক্ষী হিসেবেও কাজ করেছেন, তিনি আমাকে বলেন, ‘আমরা কখনো ভাবিনি যে অং সান সু চি আমাদের এতদূর নিয়ে আসবেন। কিন্তু একই সঙ্গে আমরা এটাও ভাবিনি যে ক্ষমতায় যাওয়ার পরে তিনি নিজেকে এতটা বদলে ফেলবেন।’

১৯৪৭ সালের ১৯ জুলাই বার্মার স্বাধীনতায় উত্তীর্ণের লক্ষ্যে আয়োজিত সমাবেশে সশস্ত্র ব্যক্তিরা যখন বিস্ফোরণ ঘটাল এবং অং সান সু চির বাবা ও আরও আটজনকে হত্যা করল, তখন সু চির বয়স মাত্র দুই বছর। তাঁর বাবার কিংবদন্তি ছায়ায় বড় হওয়া সু চি স্বাধীনতা-উত্তর সময়ের ডামাডোল থেকে বহুলাংশে রক্ষা পেয়েছিলেন। রেঙ্গুনে মেথডিস্ট ইংরেজি উচ্চবিদ্যালয়ে সু চি নৈতিকতা ও ভূগোল বিষয়ে পাঠ নেন। সু চির বাল্যবন্ধু ও বার্মার স্বাধীনতা-উত্তর প্রথম প্রেসিডেন্টের কন্যা সাও হায়মার থাইকে আমাকে বলেন যে সু চি ছিলেন একজন আন্তরিক, কেতাবি মেয়ে যাকে লালন-পালন করেছেন ‘খুব দৃঢ়, কোমল হূদয়ের মা’ খিন চি। ১৯৬০ সালে খিন চি ভারতে রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিযুক্ত হন। সু চিকেও তাঁর সঙ্গে নিয়ে যান। তার দুই বছর পর বার্মায় অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক সামরিক শাসকেরা ক্ষমতায় আসে।

পনেরো বছর বয়সে সু চি বার্মা ছেড়ে যান। প্রায় আটাশ বছর তিনি মাঝে মাঝে ঘুরে যেতেন, কিন্তু একেবারে ফিরে আসেননি। নয়াদিল্লিতে বিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিষয়ে পড়াশোনা করেন। তিনি একজন অসাধারণ শিক্ষার্থী ছিলেন। তারপরে তিনি অল্প সময়ের জন্য নিউইয়র্কে জাতিসংঘে কাজ করেন। ১৯৭২ সালে তিনি মাইকেল এরিসকে বিয়ে করেন। এরিস ছিলেন একজন তরুণ ব্রিটিশ পণ্ডিত। তিনি তিব্বতীয় বৌদ্ধধর্ম বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হন। এই দম্পতির দুটি পুত্রসন্তান ছিল। এই পরিবার তখন অক্সফোর্ডে স্থায়ী হয়। সেখানে সু চি গৃহস্থালির কাজকর্ম নিয়েই থাকতেন। বাজারসদাই করার পাশাপাশি ছেলেদের কাপড়ে সুতা দিয়ে নাম লিখে দিতেন। কিন্তু বাবার উত্তরাধিকার তাঁর মধ্যে ধীরে ধীরে একটা অদৃষ্টের উপলব্ধি প্রবেশ করে দেয়। তাঁর বাবার জীবনের ওপর গবেষণা করে একটি জীবনী লেখেন, যেখানে বাবার অর্জনগুলো উল্লেখ করেন। এরিসকে বিয়ে করার আগে তিনি একটি চিঠি লেখেন। সেখানে স্পষ্ট করে বলেন যে তাঁর দেশই তাঁর কাছে আগে। তিনি লেখেন, ‘আমি শুধু একটা জিনিস চাইব যে যদি আমাকে আমার জনগণের দরকার হয় তাহলে তাদের প্রতি আমার দায়িত্ব পালনে তুমি আমাকে সাহায্য করবে। তুমি কি খুব বেশি কিছু মনে করবে যদি এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়? এর কতটুকু সম্ভাবনা আছে আমি জানি না, কিন্তু সম্ভাবনা আছে।’

১৯৮৮ সালে সেই সম্ভাবনা হাজির হলো। মার্চ মাসে সু চির মা স্ট্রোক করেন। তখন তিনি তাড়াহুড়ো করে বার্মায় আসেন। সামরিক শাসনের সময়ে ব্যাপক ধ্বংস সাধন ঘটেছে। যে দেশে এককালে শক্তিশালী শিক্ষাব্যবস্থা ছিল এবং এশিয়ার মধ্যে অন্যতম উর্বর ধান উত্পন্ন হতো, তা পৃথিবীর অন্যতম গরিব দেশে পরিণত হয়। এর জন্য অর্থনীতিকে জাতীয়করণ করার সামরিক বাহিনীর ধ্বংসাত্মক পরিকল্পনা দায়ী। সু চি যখন বার্মা এলেন, তখন জান্তার বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলন জ্বলে উঠেছিল। জনতার ওপর সৈন্যরা গুলিবর্ষণ করে। এক মাসের মধ্যে শত শত মানুষ নিহত হয়। সেনা কর্মকর্তা, আইনজীবী, ছাত্র ও লেখকদের একটি দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি নামক একটি নতুন রাজনৈতিক দলের নেতা হতে সু চিকে আমন্ত্রণ জানায়।

সু চি প্রায় তিন দশক দেশের বাইরে ছিলেন। তাঁর কোনো রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাও নেই। কিন্তু এনএলডির প্রতিষ্ঠাতারা চাচ্ছিলেন অং সানের পরিবারের কোনো সদস্যের মাধ্যমে তাদের মিশনকে শুদ্ধ করতে। সু চিও সেই প্রস্তাব গ্রহণ করতে দ্বিধা করেননি। ২৬ আগস্ট সু চি তাঁর প্রথম ভাষণ দেন বার্মার সবচেয়ে পবিত্র বৌদ্ধ স্থান শেদাগোন প্যাগোডায়। স্পষ্ট, আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে তিনি তাঁর বাবার স্মৃতিচারণা করেন এবং সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনকে ‘জাতীয় স্বাধীনতার দ্বিতীয় সংগ্রাম’ বলে অভিহিত করেন।

সু চি সক্রিয় রাজনীতিতে নামেন। ১৯৮৯ সালের মে মাসে জনগণের চাপে জান্তা সরকার পরবর্তী বছরে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেয়। কিন্তু শিগগিরই কোনো বিচার ছাড়াই সু চিকে গৃহবন্দী করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল ‘রাষ্ট্রকে বিপন্ন করা’। সেই সঙ্গে এনএলডির বেশির ভাগ নেতাকেই বন্দী করা হয়। তা সত্ত্বেও তারা বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। তবে জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানায়। তারপরের একুশ বছরের পনেরো বছরই সু চি ইয়াঙ্গুনে তাঁর পরিবারের লোকের পাশে অবস্থিত বাড়িতে আবদ্ধ অবস্থায় কাটিয়েছেন। জান্তা তাঁকে দুবার মুক্ত করে আবার বন্দী করে। তাঁকে রাজনীতিবিদ হিসেবে নিরস্ত করতে গিয়ে জেনারেলরা অসাবধানতাবশত সু চিকে নিজেদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রতীকে পরিণত করেছে।

১৯৯৯ সালে সু চি এক নিদারুণ পীড়াদায়ক সিদ্ধান্তের মুখোমুখি হন। তাঁর স্বামীর টার্মিনাল ক্যানসার ধরা পড়ে। তিনি স্ত্রীকে দেখার জন্য মিয়ানমারে আসতে জান্তার অনুমতি চান। বারবার অনুরোধ করার পরও তা প্রত্যাখ্যাত হয়। কিন্তু জেনারেলরা সু চিকে মুক্তি দেওয়ার প্রস্তাব দেয়, যাতে তিনি অক্সফোর্ডে তাঁর স্বামীকে দেখতে যেতে পারেন। তিনি ও এরিস দুজনেই জানতেন যে যদি একবার তিনি দেশ ছেড়ে যান, তাঁকে আর দেশে ফিরতে দেওয়া হবে না। সু চি মিয়ানমারে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। ফলে তাঁর স্বামীকে আর কখনোই দেখতে পাননি।

২০১২ সালের জানুয়ারি মাসে অং সান সু চিকে চূড়ান্তভাবে গৃহবন্দী দশা থেকে মুক্তি দেওয়ার প্রায় এক বছরের কিছু বেশি সময় পরে ন্যায়বিচারের স্বার্থে আরেকজন নারী বন্দীকে মুক্তি দেওয়া হয়। তাঁর নাম হলো ওয়াই ওয়াই নু। তিনিও একটি রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য। তাঁর বাবা একজন সাবেক প্রধান শিক্ষক, যিনি ১৯৯০ সালের বাতিল হওয়া নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০০৫ সালে যখন ওয়াই ওয়াই নু আঠারো বছরের আইনের শিক্ষার্থী, তখন তাঁকে বিভিন্ন মিথ্যা মামলায় সতেরো বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। মামলা কিসের ছিল সে বিষয়ে বিচারকেরা কোনো নোট নেওয়ারও প্রয়োজন মনে করেননি। তাঁর বোন, ভাই, মা ও বাবার সঙ্গে নুকে ইয়াঙ্গুনের কুখ্যাত ইনসেইন কারাগারে বন্দী করে রাখা হয়। গোসল বা অন্যান্য পানির প্রয়োজনে তাঁকে তিন কাপ পানি দেওয়া হতো। পরবর্তী সময়ে ভালো ব্যবহারের জন্য তা পাঁচ কাপে উন্নীত করা হয়।

কিন্তু সু চি যেখানে একজন অভিজাত বামার, ওয়াই ওয়াই নু সেখানে একজন রোহিঙ্গা। তিন বছর আগে ইয়াঙ্গুনে নুয়ের প্রতিষ্ঠা করা উইমেন পিস নেটওয়ার্ক আরাকান নামে একটি এনজিওর কার্যালয়ে প্রথম তাঁর সঙ্গে আমার সাক্ষাত্ ঘটে (রাখাইন রাজ্যের পূর্ব নাম আরাকান। রোহিঙ্গাদের আবাসস্থল এই আরাকান মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলের একটি নিম্নভূমি উপকূলীয় এলাকা)। আমি জীর্ণ পাঁচটি সিঁড়ি ভেঙে ওপরে ওঠার সময় দেখলাম সিঁড়ির পাশে দেয়ালে লম্বা দড়ি দিয়ে একটি খালি ঝুড়ি ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। এক মিনিট পর তরকারি রান্নার জন্য ঝুড়িটি পেঁয়াজ, আদা ও অন্যান্য উপকরণ দিয়ে পূর্ণ করা হয়। এই শহরে এটা একটা উন্নত তাকওয়ালা বাক্স, যে শহরের উষ্ণপ্রধান গলদঘর্ম অবস্থায় সিঁড়ি ভেঙে ওঠাই শাস্তির সমতুল্য।

অফিসে ঢোকার মুখে দেখলাম বিক্ষিপ্ত স্যান্ডেল, কাচখচিত কীলক বা গোঁজ এবং ছেঁড়া খড়ের জুতা। কার্যালয়টি একধরনের নিষ্ঠার শক্তিতে বলীয়ান। সতর্ক টানা লেখায় একজন তরুণী একটি সাদা বোর্ডে প্রচলিত এনজিও ইংরেজির টুকিটাকি জিনিস লিখে রেখেছেন, ‘সক্ষমতা বৃদ্ধি’, ‘নারীর ক্ষমতায়ন’, ‘কারিগরি প্রশিক্ষণ’। ওয়াই ওয়াই নু ছিলেন তৃষ্ণার্ত, কিন্তু বুদ্বুদপূর্ণ হাসি ও সপ্রাণ চোখে আমাকে বললেন যে তিনি বড় হয়েছেন রাজনীতির মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে—‘ছোট্ট মেয়ে হয়ে বড়দের কথা শুনতে শুনতে’। তাঁর আগের রোল মডেল ছিলেন অং সান সু চি। তিনি বলেন, ‘আমার বাবার ডায়েরিতে সু চির ছবি লুকানো থাকত। সেখান থেকে আমাকে সু চির ছবি দেখাত।’ নব্বইয়ের দশকের মধ্যভাগেও ভাবা যেত যে মানবাধিকারের জন্য সু চির লড়াইয়ে রোহিঙ্গাদের অধিকারও অন্তর্ভুক্ত। কয়েক দশক ধরে রোহিঙ্গারা কল্পনা করেছে, কোনো জাতীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নির্যাতনের বদলে তাদের জন্য কিছু করবে।

রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের উপস্থিতির প্রমাণ—সেই অর্থে মুসলিমদের— অনেক শতাব্দী আগের। কিন্তু মিয়ানমারের অন্য গোষ্ঠীগুলো রোহিঙ্গাদের ঔপনিবেশিক সময়ের চিহ্ন হিসেবে দেখে, যখন বার্মাকে ব্রিটিশ ভারতের সঙ্গে যুক্ত করা হয় এবং ব্রিটিশরা উপনিবেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে অ-বৌদ্ধদের কাজ করাতে বার্মায় নিয়ে আসে। মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা নাম ব্যবহার নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। এর পরিবর্তে বেশির ভাগই রোহিঙ্গাদের বাঙালি বলে ডাকে। সাধারণত দেখতে দক্ষিণ এশীয়দের মতো হওয়ায় সহজেই অন্যান্য নৃগোষ্ঠীর সঙ্গে রোহিঙ্গাদের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। যদিও রাখাইনের বৌদ্ধদের বামার এলিটরা নির্যাতন করার পাশাপাশি প্রান্তিক করে রেখেছে, কিন্তু তাদের সঙ্গে আবার রোহিঙ্গাদের দীর্ঘদিনের সংঘাত চলমান রয়েছে।

১৯৪৮ সালে স্বাধীনতার সময়ে রোহিঙ্গারা বহুলাংশে অন্যান্য নৃগোষ্ঠীর মতো নতুন জাতিতে নিজেদের স্থান খুঁজে পেতে চেষ্টা করছিল। রোহিঙ্গারা সংসদে ছিল। ১৯৬১ সালের আদমশুমারিতে তারাও অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু সামরিক জান্তা একটা উগ্র জাতীয়তাবাদী, বামার আধিপত্যবাদী পন্থা অবলম্বন করেছে এবং পরবর্তী দশকগুলোয় রোহিঙ্গাদের পদ্ধতিগতভাবে দুশ্চারিত্রিক বানানো হয়েছে। তাদের অনেককেই মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। ১৯৮২ সালের নতুন নাগরিকত্ব আইনে তাদের বাঙালি বহিরাগত হিসেবে নতুন করে শ্রেণিবিভক্ত করা হয়। যদিও ওয়াই ওয়াই নুয়ের বাবার মতো রোহিঙ্গা রাজনীতিবিদেরা সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারত, কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্য আরও বেশি স্পষ্ট হয়ে যায়। রোহিঙ্গারা ভালো বিদ্যালয়ে পড়তে পারত না। যারা স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ দিতে পারত না, দেশের অন্যান্য জায়গায় যাওয়ার স্বাধীনতা তাদের জন্য সীমিত করে ফেলা হয়। কাজের জন্য মুখিয়ে থাকা ও রাষ্ট্রহীন অবস্থায় থাকা রোহিঙ্গারা দেশের বাইরে চলে যাওয়ার জন্য পাচারকারীদের প্রতি ঝুঁকে পড়ে। তারা সচরাচর থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া যাওয়ার জন্য সমুদ্রোপযোগী নৌকায় চড়ত না। সমুদ্রপথে শয়ে শয়ে রোহিঙ্গা মারা পড়ে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সরকার লক্ষাধিক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাকে বন্দিশিবিরে আটকে রাখে, যেখানে খাদ্য ও চিকিত্সার সুবিধা খুবই কম।

ওয়াই ওয়াই নু অন্য রোহিঙ্গাদের মতো নয়। তিনি উচ্চশিক্ষিত ও বিশ্বনাগরিক, পাতলা গড়নের এবং ঘোমটা পরেন না। আমাদের প্রথম সাক্ষাতের সময়েও সু চি ও তাঁর দল এনএলডি ক্ষমতায় এলে কী ঘটবে সে সম্পর্কে তিনি যথেষ্ট আশাবাদী ছিলেন। ‘রোহিঙ্গা’ শব্দ ব্যবহারে সু চির অস্বীকার এবং মুসলিমদের অবস্থা সম্পর্কে তাঁর পলায়নপরতাকে নু দেখেও না দেখে ছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন ক্রমবর্ধমান ধর্মীয় উত্তেজনা নিজের আয়ত্তে নিতে সু চি তাঁর নির্বাচনী কৌশলের জন্য এ রকম অবস্থান নিয়েছেন। ওয়াই ওয়াই নু আমাকে বলেন, ‘অবশ্যই আমরা হতাশ। কিন্তু আমি মনে করি সু চিকে সমর্থন করা ছাড়া আমাদের আর কোনো বিকল্প নেই। একবার গণতান্ত্রিক দল ক্ষমতায় এলে আমাদের সুযোগ ও আশা দুটোই বাড়বে।’

সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে আমি আবারও ওয়াই ওয়াই নুয়ের সঙ্গে দেখা করি, কিন্তু সেটা মিয়ানমারের বাইরে। এখন তিনি মনে করেন যে তাঁর জনগোষ্ঠীকে বিলুপ্ত করা হবে। তিনি আমাকে বলেন যে দেশ থেকে সমগ্র রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বিতাড়নের একটি পরিকল্পনার ব্যাপারে তিনি চিন্তিত। তিনি বার্মার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নজর রাখছিলেন। সেখানে যা পড়ছেন সে বিষয়ে তিনি আতঙ্কগ্রস্ত। বর্মি কর্মকর্তারা বলছিল যে গণধর্ষণ সম্ভব নয়, কারণ রোহিঙ্গা নারীরা খুবই নোংরা। ওয়াই ওয়াই নু বলেন, ‘যেহেতু বেসামরিক সরকার এসব কথা বলছে, তাই সাধারণ মানুষের মধ্যে আরও বেশি ঘৃণা বাড়ছে। আগে সামরিক স্বৈরশাসকেরা ক্ষমতায় ছিল। তাই তারা ঘৃণাপূর্ণ কথা বললে কেউ বিশ্বাস করত না। কিন্তু এখন অং সান সু চির বেসামরিক সরকারই এসব মূর্খ কথা বলছে। আর এর ফলে ঘৃণা আরও বেশি বৈধতা পাচ্ছে।’

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের নির্বাহী পরিচালক কেনেথ রথ মনে করেন, অং সান সু চির ব্যাপারে হতাশ হওয়াটা হাস্যকর। তিনি এ-ও উল্লেখ করেন যে যদিও তাঁর সংগঠন দশকের পর দশক সু চির লক্ষ্যকে সমর্থন করেছে, তবু ২০১২ সালের শুরু থেকেই সু চি তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত্ এড়িয়ে চলেন। তিনি বলেন, ‘আমরা রোহিঙ্গা ইস্যুতে এর মধ্যেই সু চির সমালোচনা করা শুরু করেছি। আমার ধারণা যারা সমালোচনা করে, তাদের সঙ্গ সু চি চান না।’ রোহিঙ্গাদের জাতিগত নিধনের বিরুদ্ধে কোনো কথা না বলাটাকে রথ সু চির রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ হিসেবে দেখেন। তিনি বলেন, ‘সু চি ভাবছে, এটা করার কোনো দরকার নেই। এই মানুষগুলো এতই জনপ্রিয়তাহীন যে তাদের সুরক্ষার চিন্তা করার কোনো মানেই হয় না।’

মিয়ানমারের উল্লেখযোগ্য অ-রোহিঙ্গা মুসলিম জনসংখ্যার জন্যও অভিযোগের পরিবেশ ক্ষতিকর। এই অ-রোহিঙ্গা মুসলিমদের অনেকেই সমৃদ্ধিশালী ব্যবসায়ী শ্রেণি। ২০১২ সাল থেকে কেন্দ্রীয় মিয়ানমারের বাণিজ্যিক শহরগুলোয় মুসলিমদের বিরুদ্ধে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে। ইসলামভীতি খুবই গভীরে প্রোথিত। সম্প্রতি উগ্রবাদী ভিক্ষুরা ইসলামভীতির পালে হাওয়া দিয়েছে। তারা মনে করে ইসলাম আফগানিস্তান ও ইন্দোনেশিয়ায় বৌদ্ধধর্মকে গ্রাস করে ফেলেছে। এর পরবর্তী নিশানা হলো মিয়ানমার। ভিক্ষুরা ব্যাপক সম্মানিত। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা বর্মিরাও সম্পূর্ণ গাম্ভীর্য নিয়ে আমাকে বলেছে যে কিছু মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে উচ্চ জন্মহারও একধরনের জিহাদ।

আমি সু চির একজন দীর্ঘদিনের আধ্যাত্মিক উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করেছিলাম। তাঁর নাম ধাম্মা পিয়া। তিনি ইয়াঙ্গুনের একটি মঠের মঠাধ্যক্ষ। সেখানেই তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়। তিনি বৌদ্ধ উগ্রবাদীদের প্রভাব সম্পর্কে বলতে গিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি খুব গর্বের সঙ্গে ঔপনিবেশিক সময় থেকে সব মুক্তি আন্দোলনে ভিক্ষুদের ভূমিকার কথা বলেন। তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘তরুণেরা মুসলিমদের ঘৃণা করা ছাড়া আর কিছুই বোঝে না।’ তবে তিনি আরও বলেন, ‘অনেক কালার (মুসলিমদের নিন্দাসূচক উপাধি) জানে না কীভাবে ভালো ব্যবহার করতে হয়। এর কারণ তারা কোনো ভালো শিক্ষা পায়নি। তাই আচরণ কিছুটা হিংস্র হতে পারে।’ যখন আমি জিজ্ঞেস করলাম কী ধরনের আচরণের কথা তিনি বলছিলেন, তখন মুসলিমরা যে প্রায়ই ট্রাফিক বন্ধ করে দেয় তার কথা তিনি উল্লেখ করেন।

বৌদ্ধ উগ্র জাতীয়তাবাদীরা বার্মার রাজনীতির কেন্দ্রভূমি ক্ষয় করে ফেলছে। ২০১৫ সালের নির্বাচনে এনএলডি উদ্বিগ্ন ছিল কীভাবে ‘মুসলিম দল’ হিসেবে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এড়িয়ে যাওয়া যায়। সে জন্য তারা একজনও মুসলিম প্রার্থীকে নিতে অস্বীকৃতি জানায়। স্বাধীনতার পর থেকে এই প্রথম কোনো মুসলিম বর্তমানে সংসদে নেই। সু চির সরকার এমন কোনো চেষ্টাও করেনি যা মুসলিমদের সন্তান গ্রহণের ওপর আরোপিত বাধা রদ করতে পারে এবং মুসলিম পুরুষ ও বৌদ্ধ নারীদের মধ্যে বিয়ে সংঘটনে যে বাধা ছিল তা বাতিল করতে পারে।

ইয়াঙ্গুনে এক বৃষ্টিস্নাত দিনে আমি তিন মিন্ট নামে একজন অবসরপ্রাপ্ত তেলবিষয়ক প্রকৌশলীর সঙ্গে সাক্ষাত্ করি। মিন্টের বাবা ছিলেন একজন মুসলিম, যিনি অং সানের মন্ত্রিসভায় ছিলেন এবং তাঁর সঙ্গেই নিহত হন। সময়টা ছিল রমজানের শুরু। তাই মিন্টের গৃহতত্ত্বাবধায়কের দেওয়া তালের রসের পিঠায় আমি খুব সচেতনভাবে কামড় দিলাম। কিন্তু তিন মিন্টও আমার সঙ্গে চায়ে চুমুক দিল। রোজার কঠোর নিয়ম পালনের চেয়ে অতিথিকে অস্বস্তি থেকে মুক্তি দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা থেকে তিনি চা পান করেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের ধর্মকে জাঁকালোভাবে প্রদর্শন করতে পারি না। আমাদের ভিন্ন ভিন্ন পোশাক ও খাবার রয়েছে। আমি সব সময় আমার ধর্মের লোকদের এ কথা বলি।’ তিনি রোহিঙ্গা মুসলিমদের জন্য কোনো বিশেষ উদ্বেগ প্রকাশ করলেন না। তিনি বলেন, ‘ইয়াঙ্গুনের মুসলিমদের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের সংযোগ খুবই কম।’

কো নি নামে একজন প্রখ্যাত মুসলিম আইনজীবী মিন্টের বন্ধু ছিলেন। জানুয়ারি মাসে তিনি নিহত হন। সে বিষয়েই আমরা কথা বলি। কো নি এনএলডি দলের আইন উপদেষ্টা ছিলেন। দলের অন্য মুসলিমদের মতোই সু চির ঘনিষ্ঠ ছিলেন। হত্যাকাণ্ডের জন্য দলত্যাগী সাবেক সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের দায়ী করা হয়। এই হত্যাকাণ্ড ইয়াঙ্গুনকে সন্ত্রস্ত করে ফেলে। তাঁর জানাজায় বিভিন্ন ধর্মের হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়। তবে সু চি জানাজায় যাননি। এমনকি তিনি ফুলও পাঠাননি বা কো নির পরিবারকে সান্ত্বনাও জানাননি এবং এক মাস তিনি কোনো মন্তব্য করা থেকেও বিরত থাকেন। কো নির মৃত্যুর পরের কয়েক মাসে আমি কয়েক ডজন বর্মি মুসলিমের কাছে সু চির নীরবতা বিষয়ে তাঁদের অনুভূতি জানতে চেয়েছি। তাঁরা সবাই সু চির সমালোচনা করতে ইতস্তত ছিলেন। তাঁদের প্রত্যেকেই তিন মিন্টের মতোই বলেছেন, ‘অবশ্যই সু চির বিশেষ কারণ রয়েছে।’

২০১৫ সালের নির্বাচনে সু চির দলকে ভোট দেওয়া লাখ লাখ ভোটারের মধ্যে পাণ্ডুবর্ণের, চশমা পরিহিত সাবেক জেনারেল খিন নিন্তও রয়েছেন। তাঁকে মিয়ানমারে সবচেয়ে বেশি ভয় পেত মানুষ। আশির দশকের মধ্যবর্তী সময়ে তিনি গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান নিযুক্ত হন। তিনি স্টাসির মতো গুপ্তচর নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন এবং হাজার হাজার মানুষের গ্রেপ্তার তত্ত্বাবধান করতেন। তিনি বলপূর্বক শ্রম প্রকল্পেরও দায়িত্বে ছিলেন, যেখানে বিভিন্ন নৃগোষ্ঠী এলাকা থেকে মানুষ ধরে এনে সেনাবাহিনীর অবকাঠামো প্রকল্পে কাজ করানো হতো, যাদের বেশির ভাগই ছিল শিশু। ২০০৩ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন এবং সংস্কার করার চেষ্টা করেন। তিনি নৃতাত্ত্বিক মিলিশিয়াদের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তির পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তিও সম্পন্ন করেন। দীর্ঘদিনের জান্তাপ্রধান থান শোয়ে সু চিকে এতটাই অপছন্দ করতেন যে তাঁর উপস্থিতিতে তিনি সু চির নাম উল্লেখ করা পর্যন্ত নিষিদ্ধ করেছিলেন। কিন্তু খিন নিন্ত সু চির সঙ্গে সংলাপ আয়োজন করেন।

মাত্র এক বছর পরেই শাসকদের বিরোধী উপদল তাঁকে উত্খাত করে এবং তিনি সাত বছরের বেশি সময় গৃহবন্দী অবস্থায় কাটান। তাঁকে যে বাসায় বন্দী করে রাখা হয়েছিল সেখানে আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করি। এই বাসার মেঝেতে তিনি একটি আর্ট গ্যালারি ও হস্তশিল্পের দোকান চালান। সেখানে পর্যটন স্থানের জাঁকালো ছবি, সংরক্ষিত বনের অংশ ও কম দামি জেড পাথরের ব্রেসলেট বিক্রি করা হয়। খদ্দেরের অভাবে একটি কফির দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। ঠাট্টার ছলে আশ্চর্যান্বিত হয়ে তিনি আমাকে বলেন, ‘মানুষ এখানে আসতে ভয় পায়। আমি জানি না কেন।’ আমার অনুবাদক (এক বন্ধু যিনি জর্জ অরওয়েলের কাজ বর্মি ভাষায় অনুবাদ করছেন) বুঝতে পেরেছিলেন কেন মানুষ ভয় পায়: রাখাইন রাজ্যে শৈশবে তিনি খিন নিন্তের সড়ক কর্মী হিসেবে কাজ করতে বাধ্য হন। পরে তিনি আমাকে বলেছিলেন যে খিন নিন্তের এত কাছে বসায় তিনি ভেতরে-ভেতরে ভয়ে কাঁপছিলেন।

নাদুসনুদুস মুষ্টিতে আমার হাত ধরে খিন নিন্ত বলেছিলেন, ‘আমি ভেবেছিলাম এনএলডির “পরিবর্তনের সময়” স্লোগান খুব ভালো ছিল। দাও অং সান সু চি শৃঙ্খলার গুরুত্ব বোঝেন, তাই এই দেশের ব্যাপারে আমার অনেক প্রত্যাশা।’

সু চির ক্ষমতায় আসাকে তিনি একটি ইতিবাচক অগ্রগতি হিসেবে দেখেছিলেন। তিনি বলেন, ‘আগে সু চি সামরিক বাহিনীর সঙ্গে লড়াই করেছেন। তাই ব্যাপারটা সামরিক শাসনের মতো ছিল না। কিন্তু এখন তিনি সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান মিন অং লাইংয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে চাইছেন। মনে হচ্ছে তিনি বুঝতে পেরেছেন যে তাঁকে দর-কষাকষি করতে হবে।’

নিন্ত ঠিকই বলেছেন। যাদের বিরুদ্ধে তিনি সংগ্রাম করেছেন তাদের সঙ্গে কাজ করা ছাড়া সু চির আর কোনো বিকল্প নেই। সু চির ক্ষমতায় আসীন হওয়ার রমরমা অবস্থার ফলে সেনাবাহিনীর হাতেও যে বিপুল ক্ষমতা রয়েছে, তা ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল। প্রতিরক্ষা, স্বরাষ্ট্র ও সীমান্তবিষয়ক মন্ত্রণালয়গুলো সেনাবাহিনীর হাতে। এ ছাড়া সংসদের এক-চতুর্থাংশ আসনও তাদের জন্য সংরক্ষিত। এমনকি যেসব মন্ত্রণালয় বেসামরিক হাতে, যেমন অর্থ মন্ত্রণালয়, সেগুলোও সামরিক শাসনের সময়কার ব্যক্তিদের নিয়ন্ত্রণে। দেশের বাজেটের বহুলাংশ সামরিক বাহিনীর জন্য সংরক্ষিত। ২০০৮ সালে সামরিক বাহিনী কর্তৃক লিখিত মিয়ানমারের সংবিধানও সমস্যা তৈরি করছে। সেখানে সেনাবাহিনীর জরুরি অবস্থা ডাকা ও ক্ষমতা দখল করার বিধান রয়েছে। সেখানে এমন আরেকটি ধারা রয়েছে যা সু চিকে দেশের প্রেসিডেন্ট হতে অযোগ্য করে রেখেছে (বর্তমানে কাজ চালানোর জন্য তাঁকে স্টেট কাউন্সেলর করে রাখা হয়েছে)। সু চি সংবিধান পরিবর্তন করে প্রেসিডেন্ট হতে চান, কিন্তু সে জন্য সেনাবাহিনীর সমর্থন প্রয়োজন। সংবিধানে তাঁকে যে দুর্বল অবস্থান দেওয়া হয়েছে, সেটাই সেনাবাহিনীর নির্যাতনের বিরুদ্ধে কিছু না বলার জন্য দায়ী বলে মনে করে তাঁর পক্ষের লোকজন। সেনাবাহিনীকে সাংবিধানিক সংস্কারে চাপ দেওয়ার পাশাপাশি তাঁকে অবশ্যই বিরুদ্ধাচরণ ও সামরিক শাসনে ফেরত আসা এড়িয়ে চলতে হবে।

কিন্তু সেনাবাহিনীকে তিরস্কার করতে তাঁর ব্যর্থতা শুধু বাস্তবতাবাদিতার কারণে নয়। তাঁর নেতৃত্বাধীন দলের সহপ্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সশস্ত্র বাহিনীর একজন সাবেক কমান্ডার-ইন-চিফ। সু চির বেশ কয়েকজন উপদেষ্টাও সামরিক বাহিনীর সাবেক সদস্য। এনএলডির পরিচালনার ক্ষেত্রেও সামরিক বাহিনীর প্রতি আনুগত্য এবং এর শ্রেণিবিভাজনের ওপর জোর দেওয়া হয়। দলের নেতা তো দূরের কথা, বহিষ্কার হওয়ার ভয়ে কোনো সদস্যই জনসমক্ষে সামরিক বাহিনীর সমালোচনা করতে ভয় পায়। একজন মন্ত্রিপরিষদ সদস্য গর্বের সঙ্গে আমাকে বলেছিলেন যে ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’ বশ্যতা স্বীকারের সংস্কৃতির মানে হলে সব সময় স্টেট কাউন্সেলরের দরজায় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ঝুলে আছে।

যদিও এনএলডি তরুণ মেধাবীদের দলে টেনেছে, কিন্তু দলের নেতারা তাদের বয়স এবং কারাবন্দিত্বের জন্য বিখ্যাত। সু চির বাল্যবন্ধু সাও হায়মার থাইকে আমাকে বলেন, ‘সু চির আশপাশে সব উচ্চপদস্থ থাকে, তৃণমূল থেকে কেউ নেই। তাঁর খুব বেশি ভালো উপদেষ্টাও নেই। তাঁর রয়েছে শুধু নিজের ভাবনা। অন্যরা তাঁকে তথ্য দিতেও ভয় পায়।’

জান্তার বিরুদ্ধে শত বিরোধিতার পরও সু চি একজন সামরিক বাহিনীর সদস্যের সন্তানই রয়ে গেছেন। বর্তমানের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা বর্মি স্বাধীনতা সেনাদের উত্তরাধিকার। আর সু চির বাবা ১৯৪১ সালে এর গোড়াপত্তন করেছিলেন ব্রিটিশদের কাছ থেকে দেশকে মুক্ত করার লক্ষ্যে। শোয়েদাগন প্যাগোডায় দেওয়া বক্তব্যে সু চি এই ইতিহাস শ্রোতাদের মনে করিয়ে দেন। তিনি বলেন, ‘আমি অসংকোচে বলতে পারি যে সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি আমার প্রবল অনুরাগ রয়েছে। শুধু যে এই বাহিনী আমার বাবা গঠন করেছিলেন তা-ই নয়, ছোট শিশু হিসেবে আমি সেনাদের কাছ থেকে স্নেহ পেয়েছি।’ তিনি সামরিক বাহিনীর অনেক মূল্যবোধ ধারণ করেন। তাই বারবার তিনি শৃঙ্খলা ও একতার ওপর জোর দেন। সংসদে একটি আসন জয়ের এক বছর পরে ২০১৩ সালে তিনি পর্যবেক্ষকদের অবাক করে দিয়ে জেনারেলদের সঙ্গে সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষে সামরিক প্যারেডে অংশ নেন।

২০০৩ সালে প্রথম নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী হিসেবে জডি উইলিয়ামসকে সু চির সঙ্গে দেখা করার অনুমতি দেওয়া হয় (উইলিয়ামস ১৯৯৭ সালে ভূমিমাইন নিষিদ্ধকরণে পরিচালিত আন্তর্জাতিক প্রচারণা প্রতিষ্ঠা করার জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কার পান)। আমি উইলিয়ামসের সঙ্গে কথা বলেছি। উইলিয়ামস লক্ষ করেছেন যে জেনারেলরা সু চির স্বাধীনতা খর্ব করলেও তাদের প্রতি সু চি একটা বাস্তবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতেন। উইলিয়ামস আমাকে বলেন, ‘সু চি বলেছেন যে “যদি সামরিক বাহিনী বিশাল ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মালিক হয়, তাহলেও আমার কোনো সমস্যা নেই।” এটা কোনো ভিন্ন চিন্তাপদ্ধতি নয়, কিন্তু শুনতে আশ্চর্য মনে হয়।’ যা বলা হয়নি সে বিষয়ে উইলিয়ামস আরও বেশি হতভম্ব হয়েছিলেন, ‘যে বিষয়টা সু চিকে বৈশ্বিক আইকনে পরিণত করেছে, সেই মানবাধিকার বিষয়ে তিনি একেবারেই কিছু বলছেন না।’

সু চি যখন ২০১২ সালে নিউইয়র্কে একটি এনজিওর সদস্যদের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন, তখন উইলিয়ামসের সন্দেহ আরও গাঢ় হয়। উইলিয়ামস সে এনজিওর একজন সহপ্রতিষ্ঠাতা। সু চি বৈঠক তছনছ করে দিয়ে চলে যাওয়ার পরে একজন তরুণ বর্মি কর্মী কত আতঙ্কিত হয়েছিল তা স্মরণ করে উইলিয়ামস আমাকে বলেন, ‘সু চি তাঁর দেশের মানবাধিকার বিষয়ে যেকোনো প্রশ্নের ব্যাপারে বিরূপ ছিলেন। সেই কর্মী তার নায়িকাকে দেখে খুবই উদ্দীপিত হয়েছিল। যখন সু চি এমন প্রতিকূল আচরণ করল, বেচারী তরুণ নারী কর্মীটি তখন একটানা বলতে থাকে, “আমি বিশ্বাস করতে পারছি না, আমি বিশ্বাস করতে পারছি না, তিনিই অং সান সু চি?”’

উইলিয়ামস ভেবেচিন্তে দেখেছেন যে সু চিকে মানবাধিকারের সেক্যুলার সাধু হিসেবে আগে যেভাবে ভক্তি করা হতো এবং এখন যেভাবে তাঁর রূপান্তরে বিস্ময় প্রকাশ করা হচ্ছে, দুটোই ভুল ব্যাখ্যার ওপর প্রতিষ্ঠিত। তিনি বলেন, ‘অন্যরা সু চিকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করেছেন এবং সু চি তা করতে দিয়েছেন।’ উইলিয়ামস সন্দেহ পোষণ করেন যে ১৯৮৮ সাল থেকে সু চির লক্ষ্য একই রকম সামঞ্জস্যপূর্ণ রয়েছে, যখন তিনি তাঁর নিজভূমে ফিরে এলেন, তাঁর বাবার আচ্ছাদন ধারণ করলেন, নেতৃত্বের দিকে তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন এবং বিজয় থেকে বঞ্চিত হলেন। উইলিয়ামস বলেন, ‘যখন তিনি ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন এবং তারপরে তারা নির্বাচনে জয়ী হলেও তাঁর কাছ থেকে সেই জয় ছিনিয়ে নেওয়া হলো, তখন থেকেই তাঁর মন লেজারের বিমের মতো ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য আঁকুপাঁকু করছিল। ক্ষমতায় যাওয়াই ছিল তাঁর একমাত্র প্রয়াস, বাকি সব গোল্লায় যাক।’

আমি একবার অং সান সু চিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে মানুষের মধ্যে কোন গুণটিকে তিনি সবচেয়ে মূল্যবান মনে করেন। তিনি উত্তরে বলেছিলেন, ‘আনুগত্য।’ অনেকেই এর সত্যতা নিশ্চিত করেছে। নেপিডোতে আমি এনএলডি সাংসদ কোয়ায় শোয়ের সঙ্গে দেখা করি। ২০০৩ সালে একবার যখন সু চি মুক্তি পেলেন, তখন শোয়ে তাঁর গাড়িচালক হিসেবে দেশ সফরের সঙ্গী ছিলেন। ৩০ মে সশস্ত্র ঘাতকেরা তাঁর বহরে হামলা চালায়। এই হামলাকে মনে করা হয়েছিল সামরিক বাহিনীর কঠোর কোনো অংশের নির্দেশে সু চিকে হত্যা করার একটা প্রচেষ্টা। প্রায় সত্তরজন মানুষ নিহত হয় এবং উড়ে আসা কাচে সু চির ঘাড় কেটে যায়। অসহিংসতার নীতিতে অটল থেকে তিনি তাঁর রক্ষীদের পাল্টা আক্রমণ না করার নির্দেশ দেন। কোয়ায় শোয়ে লিন যত দ্রুত সম্ভব গাড়ি চালিয়ে বেশ কটি পথরোধক অতিক্রম করে যান, কিন্তু তারপর আটকে যান।

এ ঘটনার পরে সু চিকে গৃহবন্দী করা হয়। কোয়ায় শোয়ে লিন এবং আরও সতেরোজনকে হাতকড়া অবস্থায় চোখ বেঁধে ভারতীয় সীমান্তের কাছে দূরবর্তী একটি স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁকে লাথি-ঘুষি মারা হয় এবং সিগারেট ও মোমবাতি দিয়ে তাঁর গায়ে ছ্যাঁকা দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। আমি তাঁর হাতের অগ্রভাগে দাগ দেখেছি। এসব নির্যাতন করার উদ্দেশ্য ছিল এটা স্বীকার করানো যে সহিংসতার জন্য এনএলডিই দায়ী। তিনি বলেন, ‘নির্যাতনের মুখে অন্যরা চিত্কার করছিল। আমি তা শুনতে পাচ্ছিলাম। কিন্তু আমি নীরব ছিলাম।’ তাঁকে এমনই জলাবদ্ধ ছোট একটি কক্ষে আটকে রাখা হয়েছিল যে তিনি শুতেও পারতেন না।

সু চি গৃহবন্দী দশা থেকে একেবারে মুক্তি পাওয়ার পর কোয়ায় শোয়ে লিন তাঁকে দেখতে যান। সু চি একটি ছোট প্লাস্টিকের লেফাফা হাতে ধরে ছিলেন। বেপরোয়া হত্যাকাণ্ডের দিন শোয়ে লিন যে জলখাবার সু চিকে দিয়েছিল, সেই প্যাকেটের অংশই ছিল এই প্লাস্টিকের প্যাকেট। শোয়ে লিন বলেন, ‘তিনি আমাকে বললেন যে তিনি এই জলখাবারের ব্যাগটা রেখে দিয়েছিলেন আমাকে মনে রাখার জন্য। প্রত্যেক দিন তিনি অল্প অল্প খেতেন এবং সরিয়ে রাখতেন।’ সবশেষে এই ব্যাগে আর কিছুই বাকি ছিল না, কিন্তু তিনি এটা আট বছর ধরে রেখে দিয়েছিলেন।

সু চি সারা জীবন তাঁর এমন এক পিতার স্মৃতির প্রতি বিশ্বস্ত থেকেছেন, যাঁকে তিনি ভালো করে চিনতেনই না এবং এমন এক দেশের প্রতি তিনি বিশ্বস্ত থেকেছেন যাকে পনেরো বছর বয়স থেকে পঁয়ষট্টি বছর বয়সের মধ্যে তিনি খুব কমই দেখেছেন। যে একগুঁয়েমি ও নিশ্চয়তার জন্য তাঁকে এখন স্বাধীনতার শত্রু হিসেবে স্মরণ করা হতে পারে, সেই গুণগুলোই বন্দিদশায় তাঁর উপকারে এসেছিল। বাড়িতে একাকী কাটানো বছরগুলোয় সক্রিয় রাজনীতি থেকে তাঁর দূরত্বের কারণে দেশবাসী তাঁকে নিখুঁত আশার তরি ও বিস্তৃত পৃথিবীর আদর্শবাদী প্রক্ষেপণে পরিণত করেছিল।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের কেনেথ রথ আমাকে বলেন, ‘পুরোটা না বলেই অং সান সু চি আইকন হওয়ার সুবিধা পেয়েছেন। হাভেল এ জায়গায় এসেছিল নৈতিক কণ্ঠস্বর হিসেবে অনেক কিছু বলার পরে। অং সান সু চি তেমন কিছুই বলেননি। তিনি ছিলেন একজন নৈতিক প্রতীক। আর আমরা সে প্রতীকে কিছু নির্দিষ্ট গুণাগুণ খুঁজেছি। তিনি যখন প্রকৃতপক্ষে বলা শুরু করলেন, তখন সেই গুণাগুণ ভুল প্রমাণিত হলো।’ সু চি হাভেলের মতো বুদ্ধিজীবী ছিলেন না, ম্যান্ডেলার মতো মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না অথবা ওয়ালেসার মতো সাংগঠনিক ছিলেন না। তাঁর বাবার মতো তিনি কিংবদন্তি রূপ কালিমালিপ্ত হওয়ার আগে মারাও যাননি।

২০১০ সালের নভেম্বরে সু চির মুক্তির পর তাঁর ছোট ছেলে প্রথমবারের মতো মিয়ানমার সফর করে। তাঁর ছেলে তাঁকে এক দশকে একবারও দেখেনি। ছেলে ইংল্যান্ডে ফিরে যাওয়ার আগে ইয়াঙ্গুনে একটি পোষা প্রাণীর দোকানে গিয়ে তার মায়ের জন্য বাদামি ও সাদা রঙের একটি কুকুরছানা কিনে এনে দেয়। সু চি এই কুকুরছানার প্রতি খুবই মনোযোগী। বিদেশি বিশিষ্টজনেরা দেখেছেন যে এই কুকুরছানার জন্য উপহার নিয়ে আসা মানে হলো বৈঠক ভালো হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তখন থেকেই এই কুকুরছানা একটি আগ্রাসী জন্তুতে পরিণত হয়েছে। যে কেউ তার মালিকের কাছে ঘেঁষলেই সে গর্জন করে ওঠে এবং হঠাত্ খট করে কামড়ে দিতে চায়। সু চি কুকুরের এসব গ্রাহ্য করেন না। তিনি কুকুরছানাকে সাজাতে পছন্দ করেন। বিমানবন্দরে তাঁকে বিদায় দেওয়ার সময়েও তিনি এই কুকুরছানাকে চুমু খেতে পছন্দ করেন। সু চির এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু আমাকে বলেছে, ‘আমি এই কুকুরটাকে ঘৃণা করি। কিন্তু সু চি কুকুরছানাটিকে নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসে, কারণ এই কুকুর তাঁর প্রতি বিশ্বস্ত।’

অনুবাদ: খলিলউল্লাহ্