খোশগল্প

এ গল্পটা মনে রাখবেন। কাজে লাগবে। অন্তত চা-টা পাঁপরভাজাটা আসবে নিশ্চয়ই।
অ্যাসোসিয়েশন অব আইডিয়াজ, অর্থাৎ এক চিন্তার খেই ধরে অন্য চিন্তা, সেটা থেকে আবার অন্য চিন্তা, সেই রকম করে করে মোকামে পৌঁছে যাবেন। এখনো বুঝতে পারলেন না? তবে একটা গল্প দিয়েই বোঝাই।
সেই যে বাঁদর ছেলে কিছুতেই শটকে শিখবে না, এ ছেলে তেমনি পেটুক, যা কিছু শিখতে দেওয়া হয়, পৌঁছে যাবেই যাবে মিষ্টি-সন্দেশে। তাকে একং দশং শিখতে দেওয়া হয়েছে। বলছে, ‘একং, দশং, সহস্র, অযুত, লক্ষ্মী, সরস্বতী...’
(মন্তব্য: ‘লক্ষ’ না বলে বলে ফেলেছে ‘লক্ষ্মী’ এবং তিনি যখন দেবী তখন তাঁর অ্যাসোসিয়েশন অব আইডিয়াজ থেকে চলে গেছে আরেক দেবী সরস্বতীতে। তারপর বলছে...)
‘লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশ, কার্তিক, অগ্রহায়ণ...’
(মন্তব্য: ‘কার্তিক’ মাসও বটে, তাই অ্যাসোসিয়েশন অব আইডিয়াজে চলে গেল অগ্রহায়ণ, পৌষে)
অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ, ছেলে-পিলে...’
(মন্তব্য: ‘মাঘ’কে আমরা ‘মাগ’ই উচ্চারণ করে থাকি। তার থেকে ‘ছেলে-পিলে’)
‘পিলে, জ্বর, শর্দি, কাশী...’
(মন্তব্য: তার থেকে যাবতীয় তীর্থ!...)
‘কাশী, মধুরা, বৃন্দাবন, গয়া, পুরী...’
‘পুরী, সন্দেশ, রসগোল্লা, মিহিদানা, বোঁদে, খাজা, লেডিকিনি...’
ব্যস! পুরী তো খাদ্য, এবং ভালো খাদ্য। অতএব তার অ্যাসোসিয়েশনে বাদবাকি উত্তম উত্তম আহারাদি! পৌঁছে গেল মোকামে!
এই অ্যাসোসিয়েশন অব আইডিয়াজ থেকে গল্পের খেই ধরে নেওয়া যায়।
আমি দশ বছর ধরে একখানা সুইস পত্রিকার গ্রাহক। প্রতি সপ্তাহে পল্ডি নিয়ে একটি ব্যঙ্গচিত্র থাকে। চলেছে তো চলেছে। এখনো তার শেষ নেই। কখনো যে হবে মনে হয় না।
কিছুমাত্র না ভেবে গোটা কয়েক বলি—
বন্ধু: জানো পল্ডি, অক্সিজেন ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। ১৭৭০-এ ওটা আবিষ্কৃত হয়।
পল্ডি: তার আগে মানুষ বাঁচত কী করে?
কিংবা
পল্ডি: (আমেরিকান ট্যুরিস্টকে এক কাস্ল্ দেখিয়ে) ওই ওখানে আমার জন্ম হয়। আপনার জন্ম হয় কোনখানে?
ট্যুরিস্ট: হাসপাতালে।
পল্ডি: সর্বনাশ! কী হয়েছিল আপনার?
কিংবা
বাড়িউলী: সে কী মি. পল্ডি? দশ টাকার মনিঅর্ডার, আর আপনি দিলেন পাঁচ টাকা বকশিশ!
পল্ডি: হেঁ, হেঁ, ওই তো বোঝে না আর কিপ্টেমি করো। ঘন ঘন আসবে যে!
কিংবা
পল্ডি ঘোড়ার রেসে গিয়ে শুধোচ্ছেন: ঘোড়াগুলো এ রকম পাগল-পারা ছুটছে কেন?
বন্ধু: কী আশ্চর্য, পল্ডি তা-ও জানো না! যেটা ফার্স্ট হবে, সেটা প্রাইজ পাবে যে।
পল্ডি: তাহলে অন্যগুলো ছুটছে কেন?
এর থেকে আপনি রেসের গল্পের মাধ্যমে কুট্টি সাইক্লে অনায়াসে চলে যেতে পারেন। যেমন,
কুট্টি রেসে গিয়ে বেট করেছে এক অতি নিকৃষ্ট ঘোড়া। এসেছে সর্বশেষে। তার এক বন্ধু, আরেক কুট্টি, ঠাট্টা করে বললে, ‘কী ঘোড়া (উচ্চারণ অবশ্য ‘গোরা’, আমি বোঝার সুবিধের জন্য সেগুলো বাদ দিয়েই লিখছি) লাগাইলায় মিয়া! আইলো সক্কলের পিছনে?’
কুট্টি দমবার পাত্র নয়। বললে, ‘কন্ কী কত্তা! দ্যাখলেন না, যেন বাঘের বাচ্চা, বেবাকগুলিরে খ্যাদাইয়া লইয়া গেল!’
কুট্টি সম্প্রদায়ের সঙ্গে, পুব-পশ্চিম উভয় বাঙলার রসিকমণ্ডলীই একদা সুপরিচিত ছিলেন। নবীনদের জানাই, এরা ঢাকা শহরের খানদানি গাড়োয়ান-গোষ্ঠী। মোগল সৈন্যবাহিনীর শেষ ঘোড়সওয়ার বা ক্যাভালরি। রিকশার অভিসম্পাতে এরা অধুনা লুপ্তপ্রায়। বহু দেশ ভ্রমণ করার পর আমি নির্ভয়ে বলতে পারি, অশিক্ষিত জনের ভিতর এদের মতো Witty (হাজির-জবাব এবং সুরসিক বাক্চতুর) নাগরিক আমি হিল্লি-দিল্লি কলোন-বুলোন কোথাও দেখিনি।
এই নিন একটি ছোট ঘটনা। প্রথম পশ্চিম বাংলার ‘সংস্করণ’টি দিচ্ছি। এক পয়সার তেল কিনে ঘরে এনে বুড়ি দেখে তাতে একটা মরা মাছি। দোকানিকে গিয়ে অনুযোগ জানাতে সে বললে, ‘এক পয়সার তেলে কি তুমি মরা হাতি আশা করেছিলে!’ এর রাশান সংস্করণটি আরও একটু কাঁচা। এক কপেকের (প্রায় এক পয়সা) রুটি কিনে এনে এক বুড়ি ছিঁড়ে দেখে তাতে এক টুকরো ন্যাকড়া। দোকানিকে অনুযোগ করাতে সে বললে, ‘এক কপেকের রুটির ভিতর কি তুমি আস্ত একখানা হীরার টুকরো আশা করেছিলে?’ এর ইংরেজি ‘সংস্করণ’ আছে, এক ইংরেজ রমণী এক শিলিংয়ে একজোড়া মোজা কিনে বাড়িতে এনে দেখেন তাতে একটি ল্যাডার (অর্থাৎ মই, মোজার একটি টানা সুতো ছিঁড়ে গেলে পড়েনের সুতো একটার পর একটা যেন মইয়ের এক একটা ধাপ-কাঠির মতো দেখায় বলে ওর নাম ল্যাডার।) দোকানিকে অনুযোগ জানাতে সে বললে, ‘এক শিলিংয়ের মোজাতে কি আপনি, ম্যাডাম, একখানা রাজকীয় মার্বেল স্টেয়ারকেস আশা করেছিলেন!’
এবার সর্বশেষ শুনুন কুট্টি সংস্করণ। সে একখানা ঝুরঝুরে বাড়ি ভাড়া দিয়েছে পুলিশের এসআইকে। বর্ষাকালে কুট্টিকে ডেকে নিয়ে তিনি দেখাচ্ছেন, এখানে জল ঝরছে, ওখানে জল পড়ছে—জল জল, সর্বত্র জল পড়ছে। পুলিশের লোক বলে কুট্টি সাহস করে কোনো মন্তব্য বা টিপ্পনী কাটতে পারছে না, যদিও প্রতি মুহূর্তেই মাথায় খেলছে বিস্তর। শেষটায় না থাকতে পেরে বেরোবার সময় বললে, ‘ভাড়া তো দ্যান কুল্লে পাঁচটি টাকা। পানি পড়বে না তো কি শরবৎ পড়বে?’
(সংক্ষেপিত)

সৈয়দ মুজতবা আলী: বাঙালি লেখক। রম্যরচনা ও ভ্রমণকাহিনির জন্য বিখ্যাত। জন্ম ১৯০৪ সালে, অবিভক্ত ব্রিটিশ ভারতে আসামের অন্তর্ভুক্ত সিলেটের করিমগঞ্জে। মারা গেছেন ১৯৭৪ সালে।