ছাত্রনং রাজনীতিং তপঃ

আঁকা: রোমেল বড়ুয়া
আঁকা: রোমেল বড়ুয়া

রাত। তার ওপর অন্ধকার।

আড়াই মাস ধরে এ রাস্তায় সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে। রাস্তা খোঁড়া। এদিকে-ওদিকে কৃষ্ণগহ্বর। আমি বিড়ালের মতো পা ফেলি। মোবাইল ফোনে কল। বাবার বজ্রকণ্ঠ, ‘কই তুই?’

: জি, রাস্তায়।

: আমি আর কতক্ষণ বসে থাকব?

: কোথায় বসে আছেন তার ওপর নির্ভর করছে। আইনস্টাইনের থিওরি অনুযায়ী আগুনের পাশে বসে থাকলে এক ঘণ্টাকে অনন্তকাল মনে হতে পারে। আবার সুন্দরী কোনো মেয়ের পাশে বসে থাকলে...

: চুপ থাক, গাধা! তোকে ফিজিকস পড়ানোই ভুল হয়েছে। পদার্থবিদ্যা পড়ে একটা অপদার্থ হয়েছিস।

আমি চট করে আশপাশে তাকিয়ে নিলাম। বকতে শুরু করলে বাবার কাণ্ডজ্ঞান থাকে না। ফোন লাউডে দেওয়া নেই তো কী হয়েছে? বাবার কণ্ঠ যাকে বলে বাজখাঁই। ফোন পেরিয়ে কান ছুঁয়ে বুকে শেল মারে।

: কী হলো, চুপ করে আছিস কেন? আমি আর কতক্ষণ বসে থাকব? কখন আসবি তুই?

: আমি? আমি তো এখন বাড়ি যাব না আব্বা। নতুন চাকরি, ছুটি নাই।

: তোকে বাড়ি যেতে হবে না। আমিই তোর ঘরে বসে আছি। তুই আসবি কখন? অফিস শেষে সোজা মেসে আসিস না?

আমার বুক-মুখ-কলিজা-ফ্যাপ্‌সা-সব শুকিয়ে গেল। বাবা আমার মেসে? আমার রুমে?

ঘটনা সাংঘাতিক। আমি চিঁ চিঁ করে বললাম, ‘আপনি ঢাকায়?’

: তোর ফিজিকস কী বলে? তোর মেসে বসে থাকার জন্য আমাকে কি হনুলুলুতে থাকতে হবে?

আমি কথা না বাড়িয়ে পা বাড়ালাম। আর বাড়াতে গিয়ে একটা গর্তে নিউটনের প্রথম সূত্র মেনে আমি এক ‘গতিশীল বস্তু সুষম গতিতে সরল পথে’ যেতে যেতে রাস্তার ময়লা পানিতে গোসল সেরে নিলাম।

২.

বাবা আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছেন। আমি বাথরুমে ৩০ মিনিট টানা নবধারা জলে শুদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করেছি। কাজ বোধ হয় হয়নি। ভ্রুর সঙ্গে সঙ্গে বাবা মাঝেমধ্যে নাকও কুঁচকাচ্ছেন। আমার ভেতরে ভরবেগের নিত্যতার সূত্র কাজ করছে। বললাম, ‘খারাপ কিছু ঘটেছে নাকি?’

: কী আর ঘটবে? ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর এই দুনিয়ায় আর আছেইটা কী খারাপ হওয়ার!

: জি।

: এখন যা ঘটবে সব ভালো ঘটবে।

: জি আচ্ছা।

: তোর জিনিসপত্র সব গুছিয়ে রেখেছি, ভোরের ট্রেনে বাড়ি যাচ্ছি আমরা।

: জি? কী বলেন! নতুন চাকরি।

: চাকরি গেলে চাকরি পাওয়া যাবে। কিন্তু তোর যে গাধার স্বভাব, তাতে বিয়ের সুযোগ গেলে আর পাওয়া যাবে না।

: বিয়ে?

: জীবনে প্রথমবার শুনলি মনে হয়! তোর বয়সী অন্য ছেলেরা বিয়ের জন্য এখন বাপ-মায়ের সামনে ‘আচ্ছা চালতা হু, দুয়ায়ো মে ইয়াদ রাখনা’ গায়। আর তুই এখনো নিউটনের বিগব্যাং নিয়ে পড়ে আছিস!

: বিগব্যাং থিওরি নিউটনের না...

: যারই হোক। আর তোর ওই আইনস্টাইন-হকিংয়েরাও বিয়ে করেছিল, তোকেও করতে হবে।

: মানে বিয়ে আসলে একটা খুবই অগুরুত্বপূর্ণ জিনিস...

: ওই অগুরুত্বপূর্ণ জিনিসটা তোর বাবা করেছিল বলেই তুই এখন সামনে বসে পটরপটর করতে পারছিস। যা আরেকবার গোসল দিয়ে আয়!

: জি?

: আরেকবার গোসল দিয়ে আয়। গোসলের পর শরীরে ভালো করে পারফিউম মাখবি। আর এরপর সুয়ারেজের লাইনের পাশে থাকলে আমার ফোন ধরার দরকার নেই। যা...

৩.

গভীর রাত।

বাবা আর আমি এক বিছানায় শুয়ে আছি। বাবা বললেন, ‘জেগে আছিস?’

: হুম।

: মন খারাপ? নাকি ভয় পাচ্ছিস?

: জি না, ভয় পাচ্ছি না।

: হুম। আচ্ছা শোন, তোর সিভি করা আছে না?

: জি।

: সিভিটা সঙ্গে করে নিয়ে যাস।

: আচ্ছা।

: কনেপক্ষ দেখতে চেয়েছে।

: জি আচ্ছা।

: আর শোন। সিভিতে একটা জিনিস যোগ করে রাখিস, লিখিস যে তুই ছাত্ররাজনীতি করতি।

: মানে? কেন? আমি তো কোনো দিন রাজনীতিটিতি করিনি।

: আরে আস্তে বল। দেয়ালে ভ্যান গঘের ছবি থাকলেই দেয়াল কালা হয় না! আজকাল ছাত্ররাজনীতি না করা পাত্রের ভ্যালু নাই। সবাই মনে করে যে পাত্রের কোনো ক্ষমতাই নাই। পাত্রের কোনো যোগাযোগ নাই। তাই ওরা যখন তোর সম্পর্কে জানতে চাইল, তখন বলেছি যে তুই রাজনীতির ঠেলায় ঠিকমতো পড়ালেখাই করতে পারিসনি। দুইটা মামলা আছে, এ-ও বলেছি।

: কী বলো বাবা!

: আরে তোকে এত কিছু ভাবতে হবে না! আমাদের আইনাল আছে না, আরে ওই যে, ক্লাস এইটের পর আর পড়ল না! একবার জেলেও গেল মাস্টার পিটিয়ে, ও তো এখন বিরাট ছাত্রনেতা। আইনাল বলেছে, সে সব সামলে নেবে। তুই গেলেই তোকে নিয়ে একবার পাত্রীদের বাড়ি থেকে ঘুরে আসবে। তোকে ‘বড় ভাই’ বলে একবার যদি আইনাল ডাকে, তাহলে দেখিস আর কোনো চিন্তা থাকবে না। আইনাল তো তোর চেয়ে বয়সে ছোটই। তুই রিকোয়েস্ট করলে ডাকবে নিশ্চয়, তাই না?

: হুম।

: যাক, তাহলে আর চিন্তা থাকল না। পাত্রী খুব ভালো। ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়িত। অনেক দিন হল পলিটিকসও করেছে। পাওয়ার আছে, বুঝলি! আচ্ছা, তুই সিভিটা ঠিক করে রাখিস কিন্তু।

বাবা এবার নিশ্চিন্তে ঘুমাতে লাগলেন। আমি পিসি খুলে সিভিটা এডিট করতে শুরু করলাম। আইনালের ওপর অবশ্য অনেক কিছু নির্ভর করছে। আইনস্টাইন না, সময় এখন আইনালদের!