লাইনফুল লাইফ

আজমল সাহেবের বাসার পানির লাইনে তিন ধরনের সমস্যা। কেয়ারটেকার এবং লাইনম্যানকে বললেও গা করেননি। সোজা বলে দিয়েছেন, ‘কোথায় জানি ওয়াসার লাইনে কাজ চলতাছে, কিসস্যু করার নাই।’
তাঁদের জবাব যে এই লাইনেই হবে, আজমল সাহেব জানতেন। নিজেদের লাইনে সমস্যা হলেও দোষ এঁরা ওয়াসার লাইনের ঘাড়েই চাপাবেন। তাঁর একবার ইচ্ছা হলো ওয়াসার হেল্পলাইনে ফোন করে জিজ্ঞেস করেন ঘটনা ঠিক কি না। পরে ভাবলেন, এসব সাইডলাইনের চেষ্টা বাদ দিয়ে স্ট্রেট লাইনে, অর্থাৎ সরাসরি বাড়িওয়ালার কাছে নালিশ জানানো উচিত। কিন্তু বাড়িওয়ালা এখানে থাকেন না, তাঁর বাসা সেই রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের কাছে।
মোবাইলে অনেক চেষ্টা করেও বাড়িওয়ালার নম্বরে লাইন পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক খুঁজেও পাওয়া যায়নি বাড়িওয়ালার দেওয়া ল্যান্ড লাইন নম্বর। সকালে ঘুম থেকে উঠেই তাই আজমল সাহেবকে গোসলের জন্য তাঁর তিন ছেলেমেয়ের সঙ্গে ছোটখাটো একটা লাইন মেইনটেন করতে হচ্ছে। সবার আগে ছোট মেয়ে তৃণা, অষ্টম শ্রেণিপড়ুয়া এই মেয়ে সারাক্ষণ ডিশের লাইনে হিন্দি-বাংলা সিরিয়ালে এমনই বুঁদ হয়ে থাকে যে কড়া আইলাইনার দিয়ে ভুরু-টুরু অদ্ভুত রকম করে সিরিয়ালের নায়িকাদের বেশ ধরে থাকে।
আজমল সাহেবের মডেলকন্যাকে পৌনে আটটার মধ্যেই স্কুলে অ্যাসেম্বলির লাইন ধরতে হয়। কাজেই লাইনে তার সিরিয়াল অঘোষিতভাবেই সবার আগে। তারপরের সিরিয়াল একটা প্রাইভেট কোম্পানির প্রোডাক্ট লাইন ইঞ্জিনিয়ার মেজ ছেলে রঞ্জু্র। একসময় এই ছেলের লাইনঘাট নিয়ে আজমল সাহেব বেশ চিন্তিত ছিলেন। এমনই বেলাইনে চলে গিয়েছিল সে! ছেলেকে বোঝানোর জন্য সোজা-বাঁকা কত লাইনেই না কথা বলেছেন তিনি। তাঁর সৌভাগ্য, শেষ পর্যন্ত ছেলে লাইনে এসেছে।
আজমল সাহেবের এখন সব চিন্তা অনলাইন ফ্রিক ছোটটাকে নিয়ে। দিন নাই, রাত নাই, সারাক্ষণই ইন্টারনেটের লাইনে পড়ে আছে। সবে নাইনে উঠেছে, অথচ এর মধ্যেই ‘লাইন মারা’ শুরু করে দিয়েছে। ইদানীং প্রেম-ভালোবাসার লাইনে কবিতা-টবিতাও লিখছে বেশ। এই তো সেদিন কী মনে করে ছেলের অঙ্ক খাতার পৃষ্ঠা ওলটাতে গিয়ে দেখেন, এক জায়গায় লাভ চিহ্নসহ চার লাইন প্রেমপদ্য লেখা—
‘তুমি কত সুন্দর, তুমি কত ফাইন!
তোমার জন্য ভাঙতে পারি দেশের সকল আইন
তোমার জন্য বাঁধতে পারি বুকের মধ্যে মাইন
তোমার জন্য লিখতে পারি এক লক্ষ লাইন!’
আজমল সাহেবের ইচ্ছা করেছিল ছেলেকে ডেকে বেশ কড়া লাইনে দু-একটা কথা বলেন। পরে ভাবলেন, এই বয়সে এক-আধটু প্রেম-ভালোবাসার লাইন লেখাই যায়। ছোট ছেলে সঞ্জুর গোসল শেষ হলেই সিরিয়ালের সব শেষে থাকা আজমল সাহেব বাথরুমে ঢোকেন এবং লাইনে পানির ঢিমেতালে আসা দেখে তাঁর মেজাজ বিগড়ে যায়। বিগড়ানো মেজাজ আরও তিরিক্ষি হয় যখন গোসল সেরে বের হওয়ার পর গিন্নি করুণ স্বরে বলেন, ‘লাইনে আজকেও গ্যাস আসে নাই। বাইরে থেকে নাশতা করে নিয়ো।’
প্রায় দিনই এই সময় লাইনে গ্যাস থাকে না। লাইনে গ্যাসের এমন ইচ্ছামাফিক যাওয়া-আসার খামখেয়ালিপনার চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে গজগজ করে বাসা থেকে অফিসের উদ্দেশে বের হন আজমল সাহেব। নয়টা পাঁচ-দশের দিকে তাঁকে দেখা যায় লেগুনার জন্য অপেক্ষারত শখানেক মানুষের বিশাল লাইনের শেষ মাথায়। এই লাইনের আকার কোনো দিন ইংরেজি ‘আই’, কোনো দিন ‘জে’ আবার কোনো দিন ‘ইউ’ অক্ষরের মতো। লেগুনার লাইনে দাঁড়ালে আজমল সাহেবের চিন্তাভাবনা ‘হাই’ লাইনে চলে যায়। তাঁর কেবলই মনে হয়, উন্নত দেশের মতো আমাদেরও যদি শহরজুড়ে রেললাইন আর ট্রামের লাইন থাকত, তাহলে পাবলিককেও লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো না। আর গাড়িগুলোকেও লাইন ধরে রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা লাগত না।
নানাবিধ লাইনবিষয়ক চিন্তায় আজমল সাহেবের হঠাৎ করেই মনে পড়ল তাঁর টাইমলাইনে বাড়তি একটা কাজ আছে আজ। অফিসের ফাঁকে তৃণার স্কুলের বেতনের জন্য ব্যাংকের লাইনে দাঁড়াতে হবে। আজ না দিলেই নয়, বেতনের ডেডলাইন পেরিয়ে গেলে অনেকগুলো টাকা ফাইন গুনতে হবে। ভাবতেই আজমল সাহেবের মেজাজ সহ্যের লাইন ক্রস করে ফেলল। লেগুনার লাইন এগোনোর নাম-গন্ধ নাই। আজমল সাহেবের মনে হলো তাঁর জীবনটাও হরেক রকম লাইনের মধ্যে আটকে আছে। লাইফ ইজ বিউটিফুল, ডিউটিফুল অ্যান্ড লাইনফুল!