ফরাসি লেখকের প্রতিবাদী কণ্ঠ

ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে অঁদ্রে মালরো (ডানে), নভেম্বর ১৯৭১। ছবি: সংগৃহীত
ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে অঁদ্রে মালরো (ডানে), নভেম্বর ১৯৭১। ছবি: সংগৃহীত

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অচিরেই এশিয়া ভূখণ্ডে একটি নতুন সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। সমস্যাটি হলো বাংলাদেশ। ভিয়েতনামের অনুরূপ রূপ নিয়ে দেখা দেবে এ সমস্যা। কিন্তু ভিয়েতনামের সঙ্গে ব্যতিক্রম আছে বাংলাদেশের। বাংলাদেশের জনসংখ্যা ৭ কোটি ৮০ লাখ। আর এই জনসংখ্যা মাওবাদে নয়, জাতীয়তাবাদে অনুপ্রাণিত। আমেরিকানদের বাংলাদেশ সম্পর্কে বর্তমান শান্ত অচঞ্চল ভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে।
—অঁদ্রে মালরো, টাইম, ২ আগস্ট ১৯৭১

ভারতীয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ স্বাধীনতাযুদ্ধের সমর্থনে ১৯৭১ সালের ১৮ থেকে ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দিল্লিতে একটি আন্তর্জাতিক সভার আয়োজন করেন। সভাটি বিশ্বজুড়ে ‘ওয়ার্ল্ড মিট অন বাংলাদেশ’ নামে পরিচিত হয়। সভায় অংশগ্রহণের জন্য জয়প্রকাশ সে সময়ের অনেক বিশ্বনেতাকে আমন্ত্রণ জানান। জুলাই মাসের শেষের দিকে জয়প্রকাশ ওই সভায় অংশগ্রহণের জন্য ফরাসি চিন্তাবিদ অঁদ্রে মালরোর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। প্রায় একই সময় ‘বাংলাদেশ বুদ্ধিজীবী মুক্তিসংগ্রাম পরিষদ’-এর পক্ষ থেকে চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানও মালরোকে চিঠি দেন। উত্তরে ৭ আগস্ট মালরো জানান, সভায় অংশগ্রহণের বিষয়ে তিনি জয়প্রকাশ নারায়ণ বা ভারতীয় দূতাবাসের মাধ্যমে জহির রায়হানকে জানাবেন। ৯ আগস্ট মালরো তাঁর বন্ধু আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ভারতীয় সাহিত্যিক রাজা রাওয়ের কাছে জানতে চান, বাংলাদেশের জন্য আত্মদান অর্থবহ হবে কি না? রাজা রাও তাঁকে জানান, বর্তমান বিশ্বে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি বাংলাদেশ সম্পর্কে কোনো আবেদন রাখলে পূর্ব ও পশ্চিমের সবাই তাতে গুরুত্ব দেবে।
অঁদ্রে মালরো সভার মাধ্যমে স্বাধীনতা পাওয়া যাবে বলে মনে করলেন না। তাই তিনি সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে জয়প্রকাশকে জানান, ‘সম্মেলনে আলাপ-আলোচনা হবে, প্রবন্ধের উপাদান জন্ম নেবে, কিন্তু পাকিস্তানি ট্যাংকগুলো ততক্ষণে আরও বহুদূর এগিয়ে যাবে। বাংলাদেশের পক্ষে সেই বুদ্ধিজীবীরাই কথা বলার অধিকার রাখেন, যাঁরা বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধ করতে প্রস্তুত। আমি মুক্তিবাহিনীর অধীন একটি দল পরিচালনার দায়িত্ব চাই।’
১৭ সেপ্টেম্বর সকালে ফরাসি রেডিও চ্যানেল ইউরোপ নম্বর ১-এর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে অঁদ্রে মালরো বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের জন্য তিনি একটি স্বেচ্ছাসেবী দল গঠন করে তার নেতৃত্ব দেবেন। পরদিন বিশ্বের প্রধান প্রধান সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় মালরোর বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশ নেওয়ার আকাঙ্ক্ষার কথাটি প্রকাশিত হয়। প্যারিস থেকে প্রকাশিত ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউন উল্লেখ করে, ‘ফরাসি লেখক ও সাবেক মন্ত্রী অঁদ্রে মালরো আজ বলেন যে, তিনি “বাঙালির নেতৃত্বে” যুদ্ধ করার জন্য পূর্ব পাকিস্তানে যেতে প্রস্তুত। এএফপি এই সংবাদ জানিয়েছে। ৬৯ বছর বয়সী মালরো বাংলাদেশের উদ্দেশে কবে রওনা হবেন এবং সেখানে কী ধরনের কর্মপন্থা গ্রহণ করবেন, সে সম্পর্কে শিগগিরই একটি বিবৃতি প্রকাশ করবেন।’

অঁদ্রে মালরো: ৩ নভেম্বর ১৯০১, ২৩ নভেম্বর ১৯৭৬
অঁদ্রে মালরো: ৩ নভেম্বর ১৯০১, ২৩ নভেম্বর ১৯৭৬

১৮ সেপ্টেম্বর দিল্লির সাপ্রু হাউসে ‘ওয়ার্ল্ড মিট অন বাংলাদেশ’ শুরু হয়। সভায় ২৪টি দেশের ১৫০ জনেরও বেশি প্রতিনিধি অংশ নেন। সভার শুরুতেই এতে অংশ নিতে না পারা প্রায় ৩৫ জন বিশ্বনেতার বক্তব্য পড়ে শোনানো হয়। সেখানে অঁদ্রে মালরোরও বক্তব্য ছিল। মালরো তাতে বলেছিলেন:
আবেদনবাদী মানুষেরা মনে করেন তাঁদের কাজকর্ম ফলপ্রসূ হয়। প্রথমে তাঁরা জাতিসংঘে ধরনা দেন। আমার মতো আপনারাও জানেন, এসব পণ্ডশ্রম। তাহলে কোন বিষয়টি উপেক্ষা করা যাবে না? বাংলাদেশের সামরিক সংগঠন। হয় এরা প্রথাগত যুদ্ধ করে পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবে, নয়তো গেরিলাযুদ্ধ সংঘটিত করে পাকিস্তানকে পর্যদুস্ত করবে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রও কিন্তু ভিয়েতনামকে অবনত করতে পারেনি।
কেন আপনার বন্ধুরা গণতন্ত্রের কথা বলছেন? বাংলা কোনো রাজনৈতিক আদর্শকে সমর্থন করছে না, সে তার অস্তিত্ব রক্ষা করছে। এদের ভিয়েতনামের মতো জবাব দিতে হবে: যদি আমাদের ধ্বংস হতেই হয়, তাহলে ধ্বংস হয়ে যাব; কিন্তু তোমাদেরও তাতে এতটাই ক্ষয়ক্ষতি হবে যে শেষ পর্যন্ত তোমাদেরও পালাতে হবে। সবকিছুর পরও বাংলা সব সময়ই নির্ভীক। আর এখনই সময় বিস্মৃতপ্রবণ মার্কিনদের কাছ থেকে মার্কিন শুভেচ্ছার বদলে তার নিজের সাহসকে কাজে লাগানো। এমন কোনো আদর্শ নিয়ে বাংলার উৎসাহী হওয়া উচিত হবে না, যা বাতিল। বরং এই কথায় তাদের গুরুত্ব দিতে হবে যে, হয়তো আমরা সবাই ধ্বংস হয়ে যাব, কিন্তু আশা আমরা মোটেই ছেড়ে দেব না।
অঁদ্রে মালরোর বাণীর সূত্র ধরে জয়প্রকাশ নারায়ণ সভার উদ্বোধনী ভাষণে বলেন, ‘এই সভায় পাঠানো উদ্দীপনামূলক বক্তব্যে অঁদ্রে মালরো বলেছেন, বাঙালিরা যুদ্ধ করছে জীবন বাঁচাতে, শুধুই গণতন্ত্রের জন্য নয়। ...স্পেনের গৃহযুদ্ধের মতো একটি সশস্ত্র আন্তর্জাতিক ব্রিগেড গঠনের কথাও এখন ভাবতে হবে। অঁদ্রে মালরো তো নিছক একজন বিখ্যাত লেখক নন। তিনি স্পেনের গৃহযুদ্ধের একজন গেরিলা যোদ্ধা এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ফ্রান্সের উচ্চপর্যায়ের নেতাও ছিলেন। বাঙালি গেরিলাদের সাহায্য করার যে প্রস্তাব তিনি দিয়েছেন, সে কারণে তাঁকে উষ্ণ অভিনন্দন জানানো দরকার এবং তাঁর প্রস্তাবের সম্ভাব্যতা যাচাই করা প্রয়োজন।’
সভা-সম্মেলন করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আসবে, তেমন বিশ্বাস মালরোর ছিল না। শক্তির বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগই তাঁর দৃষ্টিতে একমাত্র সমাধান ছিল। ২০ সেপ্টেম্বর গণমাধ্যমে প্রকাশিত একটি চিঠিতে অঁদ্রে মালরো এ ভাবনার কথা জানান। চিঠিতে তিনি লেখেন, ‘আমি প্রস্তাবিত সভার (ওয়ার্ল্ড মিট অন বাংলাদেশ) সঙ্গে সহমত নই। হয়তো এতে বুদ্ধিজীবীরা—যাঁরা লেখালেখি করে থাকেন—আত্মতুষ্টি পেতে পারেন। কিন্তু পাকিস্তানি সাঁজোয়া বাহিনী ততক্ষণে আরও এগিয়ে যাবে। বাংলাদেশের এখন অহিংস প্রতিরোধের ক্ষেত্র হওয়ার দরকার নেই। এটি এখন শুধু হতে পারে একটি সশস্ত্র প্রতিরোধের দেশ। আর তা-ই এর হওয়া উচিত। ৩০ বছর আগে এমন একটি সভার গুরুত্ব ছিল। এখন আর তা নেই। আমার কিছু সামরিক অভিজ্ঞতা আছে, লেখকের মধ্যে যা বেশ দুর্লভ। বাঙালিদের নেতৃত্বে গঠিত একটি ইউনিট পরিচালনার অধিকার আমি চাই। ...আমি বাংলাদেশের পক্ষে ভারতের সঙ্গে একত্র হয়ে জাতিসংঘে কথা বলতে চাই। ...এটি সহজ নয়, তবে অসাধ্যও নয়। অন্য যেকোনো পথই বৃথা।’
২৪ সেপ্টেম্বর কলকাতা থেকে প্রকাশিত আওয়ামী লীগের মুখপত্র সাপ্তাহিক জয় বাংলা পত্রিকায় মালরোর বিভিন্ন মন্তব্য নিয়ে একটি প্রতিবেদন বেরোয়। তাতে বলা হয়, ‘বর্ত্তমানে এই প্রবীণ ফরাসী [মালরো] সাহিত্যিক বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে কতগুলি মূল্যবান মন্তব্য করেছেন। মালরো বলেছেন: বাংলাদেশের ঘটনা বিশ্বের করুণতম ঘটনাবলীর অন্যতম। কিন্তু বাঙালীদের বুঝতে হবে, বর্তমান যুদ্ধ তাদের অস্তিত্বের লড়াই। হয় তারা জাতি হিসাবে জিতবে, নয়ত চিরতরে বিলীন হয়ে যাবে। আবেদন-নিবেদনে কোন ফল হবে বলে মনে হয় না। বাঙালিকে তার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে যুদ্ধ করেই। এখন বাঙালিরা কেবল নির্ভর করতে পারে আত্মসাহস ও রণশক্তির ওপর। অবশ্য মুক্ত রণাঙ্গনে, সম্মুখসমরে পাকবাহিনীর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া উচিত হবে না বাঙালিদের। বর্তমানে তা সম্ভব নয়। তাদের উচিৎ হবে গেরিলা যুদ্ধই ভালভাবে চালিয়ে যাওয়া। বিদেশের কাছে গণতন্ত্র ও মানবতার নামে দরখাস্ত দাখিলের চাইতে বাঙালীদের আজ বেশি প্রয়োজন সামরিক সংগঠন।’
২২ অক্টোবর সংবাদ সংস্থা এপিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মালরো বাংলাদেশের পক্ষে যুদ্ধ করার বিষয়ে আবারও তাঁর ইচ্ছার কথা জানান, ‘ফাঁকা বুলি আওড়ানোর অভ্যাস আমার নেই। তাই বাংলাদেশের পক্ষে যুদ্ধ করার প্রস্তাব আমি দিয়েছি। ট্যাংক যুদ্ধের অভিজ্ঞতা আছে আমার। বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর অধীনে একটি ট্যাংক ইউনিটে অংশগ্রহণে আমি অটল।’
নভেম্বর মাসে অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়ে প্যারিসে যান। উদ্দেশ্য সেখানে পাকিস্তানের সাহায্যদাতা দেশগুলোর কনসোর্টিয়ামের সভায় যোগ দেওয়া। সভায় তিনি পাকিস্তানকে সাহায্য প্রদানের বিরোধিতা করে বক্তব্য রাখেন। রেহমান সোবহান সভার আগে মালরোর সঙ্গে দেখা করেন। তিনি লিখেছেন, ‘ড্যানিয়েল [রেহমান সোবহানের পরিচিত] আমাকে প্যারিসের অদূরে মালরোর বাড়িতে নিয়ে গেলেন। ...মালরো অত্যন্ত ভালোবাসা দিয়ে আমাদের সম্পর্কে বললেন। ...তিনি মনে করেন, বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ন্যায়বিচার হওয়া দরকার। যেহেতু যথেষ্ট বয়স হয়েছে তাঁর এবং তাঁর স্বাস্থ্যও ভালো নয়, কাজেই তিনি প্রাক্তন প্রতিরোধযুদ্ধের সৈনিকদের বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করবার জন্য এবং এর সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্য আহ্বান জানাবেন। তিনি উল্লেখ করলেন, এরা গেরিলাযুদ্ধে এদের মূল্যবান দক্ষতা, বিশেষ করে গোলাবারুদ এবং যোগাযোগ ক্ষেত্রে এদের অভিজ্ঞতা দিয়ে মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করতে পারবে।’ (বাংলাদেশের অভ্যুদয়: একজন প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য, রেহমান সোবহান, ভোরের কাগজ প্রকাশনী)।
অঁদ্রে মালরো যুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য ভারত আসতে চাইলেন। ইন্দিরা গান্ধী তাঁকে জানালেন, শিগগিরই তিনি ফ্রান্সে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশ নিয়ে কথা বলবেন। নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে ইন্দিরা প্যারিসে গিয়ে মালরোর সঙ্গে দেখা করেন। মালরোকে তিনি তখনই ভারত না আসার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, শিগগিরই বাংলাদেশের কোনো প্রতিনিধি তাঁর কাছে আসবেন।

>সভা-সম্মেলন করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আসবে, তেমন বিশ্বাস মালরোর ছিল না। শক্তির বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগই তাঁর দৃষ্টিতে একমাত্র সমাধান ছিল। ২০ সেপ্টেম্বর গণমাধ্যমে প্রকাশিত একটি চিঠিতে অঁদ্রে মালরো এ ভাবনার কথা জানান

স্বাধীনতাযুদ্ধের শেষ মুহূর্তে বাংলাদেশের বিজয় তখন প্রায় আসন্ন। বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ বাহিনীর ওপর চাপ দেওয়া এবং যুদ্ধে প্রভাব বিস্তারের জন্য বঙ্গোপসাগরের দিকে যুক্তরাষ্ট্র সে সময় সপ্তম নৌবহরকে পাঠায়। যুক্তরাষ্ট্রের এই তৎপরতায় অঁদ্রে মালরো অতিশয় বিক্ষুব্ধ হন। নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে তিনি যে চিঠি পাঠান, ১৮ ডিসেম্বর সেটি ফ্রান্সের লা ফিগারো পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। মালরো সে চিঠিতে লেখেন, ‘আপনার বিমানবাহী রণতরি কলকাতাকে বিপন্ন করতে পারে, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ওখানকার মৃত্যুমুখী শরণার্থী মানবগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করতে পারে না। পৃথিবীর সবচেয়ে পরাক্রমশালী সেনাবাহিনী যদি নগ্নপদ ভিয়েতনামিদের গুঁড়িয়ে দিতে না পারে, আপনি কি বিশ্বাস করেন ইসলামাবাদের সেনাবাহিনী ১ হাজার ৮০০ কিলোমিটার দূর থেকে স্বাধীনতায় উদ্দীপ্ত একটি দেশকে আবার দখল করতে পারবে? পৃথিবীর ভাগ্য যখন ঝুঁকির মুখে, বঙ্গোপসাগরে বিমানবাহী রণতরি পাঠানো কোনো নীতি নয়, অতীতের ধ্বংসাবশেষ মাত্র।’

আন্তর্জাতিক সেনাদল গঠন করে অঁদ্রে মালরো শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতাযুদ্ধে যোগ দিতে পারেননি। সে যুদ্ধ তত দিনে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। যৌথ বাহিনী বাংলাদেশ পুনরুদ্ধারের সব প্রস্তুতি শেষ করে ফেলেছে।
পশ্চিমা বিশ্ব যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ নিয়ে হয় নীরবতা পালন করছে, নয় সরাসরি পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করছে; সে সময় অঁদ্রে মালরোর মতো ব্যক্তির বাংলাদেশের পক্ষসমর্থন সারা বিশ্বে অভূতপূর্ব আলোড়নের সৃষ্টি করে। বিশ্ব জনমতের ওপর এর ব্যাপক প্রভাব পড়ে। ফ্রান্সসহ বহু দেশ বাংলাদেশের ব্যাপারে তাদের আগের অবস্থান বদলাতে শুরু করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে আন্তর্জাতিক সমর্থন উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে।
স্বাধীনতার পর, ১৯৭৩ সালের এপ্রিল মাসে, অঁদ্রে মালরো বাংলাদেশ সফর করতে আসেন। ভ্রমণ করতে যান ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও কাপ্তাই। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় মালরোকে সাম্মানিক ডিলিট উপাধি দেয়। পরে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ‘মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’ ভূষিত করে। ২০১৫ সালে মালরোর স্মরণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘মালরো গার্ডেন’ উদ্বোধন করা হয়।


মৃত্যুভয়হীন একটি জাতি

চিরকাল আদর্শপ্রাণ মানুষ সীমাহীন দুঃখযাতনার মধ্যে মুক্তির লড়াইয়ের যে উজ্জ্বল ঐতিহ্য রচনা করেছেন, এ যুদ্ধ (বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ) তার আরেক উজ্জ্বল অধ্যায় হয়ে থাকল।
ফরাসি বিপ্লবের সময় এমনি করে লড়াইয়ে নেমেছিল সাধারণ মানুষ। সংগ্রাম করেছিল ইউরোপের বিপুল শক্তিমান বিভিন্ন রাজশক্তির সঙ্গে। এমনি করেই লড়াই করেছিল রুশ লাল ফৌজ, দীর্ঘ পদযাত্রার সময় এমনি করেই এগিয়েছিল মাওয়ের অকুতোভয় বাহিনী।...
আজ আমি শহীদদের প্রণাম জানাই, যাদের স্মৃতির অরণ্য আমাদের বেষ্টন করে আছে। যাঁরা প্রমাণ করেছেন, মৃত্যুভয়হীন একটি জাতির আত্মাকে পদদলিত করা যায় না। হৃদয়হীন স্বৈরাচারের বেদিমূলে কোনো অকুতোভয় জাতি মাথা নোয়ায় না।...
এ কথা সত্যি, জগতে দুই প্রকার জাতি আছে: অনেক জাতির ইতিহাস কেবল আপনাতে আপনি মহীয়ান। যেমন ড্রেকের গ্রেট ব্রিটেন। কিন্তু অন্য রকম জাতিও আছে এ জগতে, যারা বড়, কারণ তাদের সংগ্রাম শুধু তাদের নিজেদের জন্য নয়, অনেকের জন্য। ক্রুসেডের ফ্রান্স, ফরাসি বিপ্লবের ফ্রান্স এর দৃষ্টান্ত। আপনাদের যোদ্ধাদের সমাধি রচিত হয়েছে ন্যায় ও মুক্তির জন্য—যাদের স্মৃতিসৌধ সুবিচার ও স্বাধীনতার বিজয়-ঘোষণা।...
আপনাদের মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে ধ্বনিত হয়েছিল বাংলার চিরন্তন স্বাধীনতাপ্রেমী মানুষের কণ্ঠ, যেমন একদিন স্বাধীনতাপ্রেমী মানুষের কণ্ঠ ধ্বনিত হয়েছিল ফরাসি বিপ্লবের মধ্যে।

 রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দেওয়া অঁদ্রে মালরোর বক্তৃতা থেকে, ২২ এপ্রিল ১৯৭৩

মুহাম্মদ লুৎফুল হক: গবেষক ও লেখক