'বাংলাদেশে জীবনের উৎসব চলছে'

>ক্যাথলিকদের প্রধান ধর্মগুরু ভ্যাটিকানের পোপ নির্বাচনের দায়িত্ব যে ১২০ জন কার্ডিনালের ওপর, সম্প্রতি তাঁদের একজন হয়েছেন বাংলাদেশের ক্যাথলিক খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের ধমর্যাজক ঢাকার আর্চবিশপ প্যাট্রিক ডি রোজারিও। তাঁর জন্ম বরিশালের বাকেরগঞ্জের পাদ্রি শিবপুর গ্রামে, ১৯৩৯ সালে। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে তাঁর মুখোমুখি হয়েছেন পার্থ শঙ্কর সাহা
আর্চবিশপ প্যাট্রিক ডি রোজারিও
আর্চবিশপ প্যাট্রিক ডি রোজারিও

প্রথম আলো: কার্ডিনাল নির্বাচিত হওয়ার খবর শোনার পর অনুভূতি কেমন হলো আপনার?
কার্ডিনাল প্যাট্রিক ডি রোজারিও : অভাবনীয়। অবিশ্বাস্য মনে হয়েছে। যে দেশে মাত্র তিন লাখ ক্যাথলিক বাস করে, সেখান থেকে যে পোপ কার্ডিনাল নির্বাচিত করবেন, তা আমি ভাবতে পারিনি। প্রায় চার কোটি খ্রিষ্টানের দেশ ভারত থেকে আছেন মাত্র তিনজন কার্ডিনাল। পশ্চিমবঙ্গেও আমাদের চেয়ে ক্যাথলিক বেশি।
প্র. আ.: এত কমসংখ্যক ক্যাথলিকের দেশ থেকে কার্ডিনাল নির্বাচন করার উদ্দেশ্য কী বলে মনে করেন আপনি?
কার্ডিনাল: এ সম্মান বিরাট। ব্যক্তি আমার জন্য নয়। এর মাধ্যমে সম্মানিত করা হয়েছে বাংলাদেশকে। শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে এ দেশের অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধকে। প্রান্তিক দেশগুলোর প্রতি নতুন পোপের এক বিশেষ দৃষ্টি রয়েছে। দরিদ্র মানুষ, পীড়িত মানুষের জন্য আছে তাঁর অশেষ ভালোবাসা ও সম্মান। আমি অবশ্য মনে করি, বাংলাদেশের মানুষ আর্থিকভাবে কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও আধ্যাত্মিকতা বা মনের দিক থেকে মোটেও দরিদ্র নয়। তাঁদের প্রজ্ঞা অভাবনীয়। এ দেশের মানুষের এই সম্পদ সম্পর্কে পোপের ধারণা রয়েছে। আমাকে কার্ডিনাল হিসেবে বেছে নেওয়ার কারণ সম্ভবত এ দেশের অপরাজেয় মানুষ। হাসি মুখে কষ্ট সহ্য করা জনগোষ্ঠী।
প্র. আ.: আপনার ছোটবেলা কেমন কেটেছে? যাজকের জীবনে কীভাবে এলেন?
কার্ডিনাল: ছোটবেলা কেটেছে গ্রামে। আমার চোখে দেখা শৈশবের গ্রাম ছিল অসম্ভব সাধারণ, নিটোল আর মায়াময়। সব ধর্মের মানুষের যে সদ্ভাব আমি দেখেছি, তা অভাবনীয়। আমার বাবা ছিলেন সাধু ধরনের মানুষ। আমার জন্মের ছয় মাসের মধ্যে তিনি আধ্যাত্মিক সাধনার জন্য চলে যান। ফিরে আসেন আমার পাঁচ বছর বয়সে। ছোটবেলায় মাকে দেখতাম, বাড়ির নতুন কোনো ফল বা তরকারি প্রথমেই ফাদারকে নিবেদন করতেন। আমিই তাঁকে নিয়ে যেতাম গির্জায়। সে সময় থেকেই এ জীবনের প্রতি আমি আকর্ষণ বোধ করতে শুরু করি। এর পর ধীরে ধীরে যাজকীয় জীবনে প্রবেশ করি।

প্র. আ.: আপনার শিক্ষাজীবন?
কার্ডিনাল: স্থানীয় স্কুলে লেখাপড়া শেষ করে ঢাকা থেকে স্নাতক সম্পন্ন করি। এরপর ধর্মীয় উচ্চশিক্ষার জন্য চলে যাই করাচিতে। সেই লেখাপড়া চলতে চলতেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। বছরের মাঝামাঝি সময়ে আমি দেশে ফিরে আসার সুযোগ পাই। এর পর আর যাইনি। যুদ্ধ শেষ হলো। সর্বত্র যুদ্ধের ভয়াবহতা। বরিশালের গৌরনদীতে আমি মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলাম। দেশ গড়ার কাজে কিছু সহযোগিতার চেষ্টা করেছি। আমি ছিলাম স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম যাজক।
প্র. আ.: অসাম্প্রদায়িকতা আপনার বক্তব্যে সব সময় ফিরে ফিরে আসে? কেন এর ওপর এত জোর দিতে চান?
কার্ডিনাল: আমি ফাদার হওয়ার পর আমাদের পরিবারের বন্ধু গণি হাওলাদার চাচা বলেছিলেন, তুমি শুধু খ্রিষ্টানদের ফাদার হয়ো না। সব ধর্মের মানুষের ফাদার হওয়ার চেষ্টা কোরো। জাতিধর্মের কোনো ভেদাভেদ আমার কাছে নেই। ১৯৯০ সালে আমি বিশপ হই। এলাকার মানুষ বিপুলভাবে আমার সংবর্ধনা দেয়। আমার সম্মানে তিনটি ফটক গড়া হয়। দুটো তৈরি করেছিল এলাকার হিন্দু ও মুসলমানেরা। অন্যটি স্থানীয় খ্রিষ্টানেরা। গ্রামে যাওয়ার রাস্তার দুই পাশে দাঁড়িয়ে থেকে সব ধর্মের মানুষ আমাকে সম্ভাষণ জানিয়েছে। এটাই তো বাংলাদেশ। এসব আমাকে অসম্ভব আপ্লুত করে।
প্র. আ.: যে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের কথা আপনি বলছেন, সেখানে তো ধর্মের কারণে অনেক সহিংসতা ঘটনা ঘটছে।
কার্ডিনাল: আমাদের দেশে ধর্মীয় সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ আমদানি করা হয়েছে। গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় বা দেশের অন্যত্র যা হয়েছে, সেসব এ দেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের একেবারে বিপরীত। আমাদের দেশে এগুলো উদ্ভাবিত হয়নি। কতিপয় মানুষ তাদের নিজেদের স্বার্থের জন্য এসব করছে। আপনি বাংলাদেশের দিকে তাকান, সেখানে তো জীবনের উৎসব চলছে। এখানকার মানুষ উন্নয়নমুখী। পরিবারের মায়া পেছনে ফেলে হাজার হাজার মাইল দূরে গিয়ে এ দেশের মানুষ আয়-রোজগার করছে। তাদের আয়ে পুষ্ট হচ্ছে বাংলাদেশ। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে লাখ লাখ নারী কাজ করছে গার্মেন্টস শিল্পে। তারা যা করছে, সবই তো মঙ্গলের জন্য। তারা তো ভেদাভেদ নিয়ে থাকছে না। তারা ভালো থাকতে চায়। এসব ঘটাচ্ছে নেতিবাচক রাজনীতি। বৃহত্তর সাধারণ মানুষের সঙ্গে এর কোনো যোগাযোগ নেই। তবে বাংলাদেশে ধর্মীয় বিভাজনের মাত্রা বেড়েছে। সবকিছুকে সাম্প্রদায়িক রূপ দেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। ধরুন কোনো গ্রামে ছেলেদের মধ্যে গণ্ডগোল হলো। হয়তো শাহীন বা সামাদ নামে কোনো ছেলে অন্য ধর্মের কাউকে মেরেছে। তখন বলা হয় মুসলমান ছেলেরা মেরেছে। এভাবে ধর্মের রং লেগে যায়।
প্র. আ.: এসব ঘটছে কেন?
কার্ডিনাল: আমার মনে হয় আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় বড় ধরনের ত্রুটি রয়ে গেছে। শিশুদের যা শেখাবেন, তারা তাই শিখে বড় হবে। আমাদের শিক্ষা চিন্তা করতে শেখাচ্ছে না। এর মাধ্যমে ডিগ্রি অর্জিত হচ্ছে, কিন্তু মানবিকতার শিক্ষা হচ্ছে না। মানবিকতার বোধহীন শিক্ষায় তো কোনো লাভ নেই। অনেক ক্ষেত্রেই লেখাপড়া শিখে জ্ঞানী ও বিবেকবান মানুষ তৈরি হচ্ছে না।
প্র. আ.: এর থেকে উত্তরণের উপায় কী?
কার্ডিনাল: শিক্ষার মানবিকীকরণ দরকার। কেবল বই মুখস্থ করে এ শিক্ষা দেওয়া সম্ভব নয়। জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণের পথ প্রশস্ত করতে হবে। আমাদের শিক্ষাকেন্দ্রগুলোতে এ চেষ্টা আমরা করে থাকি। মিশন পরিচালিত শিক্ষাকেন্দ্রে ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী অখ্রিষ্টান। সেখানে সব ধর্মের মধ্যে মিলনের শিক্ষা দেওয়া হয়। ভিন্ন ধর্ম ও মতকে শ্রদ্ধা করতে শেখানোর দায়িত্ব যেমন পরিবারের, তেমনই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেরও।
প্র. আ.: সাম্প্রদায়িকতা ও জাতিবিদ্বেষ তো এখন সারা বিশ্বের সমস্যা। কী এর কারণ বলে মনে করেন?
কার্ডিনাল: পশ্চিমের দেশগুলো খ্রিষ্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ। তবে সেখানে ধর্ম বা আধ্যাত্মিকতা সংকটে পড়েছে। কারণ ধর্ম দর্শনশূন্য হয়ে পড়েছে। আমার মনে হয় সব জায়গায় মানুষকে বিভাজিত করে ফেলা হচ্ছে। সর্বজনীনভাবে কাউকে আমরা দেখতে পারছি না। আইএসের জন্য ইসলামকে কিছুতেই দায়ী করা চলে না। ধর্মীয় উগ্রবাদের কারণ তো ধর্ম নিজে নয়। এর কারণ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক।
প্র. আ.: কার্ডিনাল হওয়ার পর আপনার অগ্রাধিকার কী হবে?
কার্ডিনাল: আমি ভ্যাটিকানে গিয়েছিলাম। সেখানে অন্য দেশের কার্ডিনালদের বাংলাদেশের বহুত্ববাদী সংস্কৃতি সম্পর্কে বলেছি। শুনে তাঁরা অভিভূত। আমার বর্তমান অবস্থান থেকে আমি বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক ও সহিষ্ণু সংস্কৃতিকে সারা বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে চাই।
প্র. আ.: অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে।
কার্ডিনাল: আপনাকেও ধন্যবাদ।