নতুন বছরে ধর্মের প্রশ্ন

আমরা যখন ২০১৭ সালে প্রবেশ করছি, তখন সমাজে ধর্মের ভূমিকা সম্পর্কে অতি প্রাচীন একটা বিতর্ক সামনে চলে এসেছে। রাজনীতি, সমাজ ও ব্যক্তির ক্ষেত্রে ধর্মের ভূমিকা কী বা কোন মাত্রার হওয়া উচিত‍—এসবই হলো এই বিতর্কের কেন্দ্রীয় বিষয়।

মধ্যপ্রাচ্যে ধর্মের সামাজিক ভূমিকা একটা জলজ্যান্ত সমস্যা। কিন্তু এখন এই সমস্যা ইউরোপ-আমেরিকায়ও উত্তেজনা সৃষ্টির কারণ হচ্ছে। ইউরোপে উত্তেজনা সৃষ্টির কারণ হলো বিপুলসংখ্যক মুসলমান শরণার্থী ওই উপমহাদেশে আশ্রয় নিয়েছে, আর আমেরিকার কারণটা হলো, সে দেশের হবু প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণার মধ্য দিয়ে উগ্র ইসলামপন্থার ব্যাপারে ভীতি-আতঙ্ক উসকে দেওয়া হয়েছে।

এক দশক ধরে সন্ত্রাসবাদী ইসলামি রাজনীতির উত্থানের ফলে পশ্চিমা দুনিয়ায় এখন অনেক মানুষ জানতে চায়, ইসলাম ধর্মের ভেতরেই বহুত্ব বা বৈচিত্র্যের সঙ্গে দ্বন্দ্ব নিহিত আছে কি না; ইসলাম অনিবার্যভাবেই ‘অপরকে’ প্রত্যাখ্যান করে কি না এবং সে কারণে তার সেক্যুলার আধুনিকতার সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান অসম্ভব কি না।

বিশেষত ইউরোপীয় ও আমেরিকান মুসলমানদের জন্য এই বিতর্কের সুদূরপ্রসারী প্রভাব ও পরিণতি আছে। অধিকাংশ পশ্চিমা এবং বিশেষত ইউরোপীয় পর্যবেক্ষক মনে করেন, সমাজজীবনে ধর্মের ইতিবাচক ভূমিকা নিশ্চিত করতে হলে রাষ্ট্র থেকে চার্চ (কিংবা রাষ্ট্র থেকে মসজিদ) আলাদা করা অত্যন্ত জরুরি। এই দৃষ্টিকোণ থেকে ধর্ম হলো একটা দার্শনিক ও নৈতিক কাঠামো, যা থাকে সামষ্টিক জীবনের বাইরে; ধর্ম একটা ব্যক্তিগত বিষয়, তা ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল; রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থার ফসল নয়।

কিন্তু এই দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেছে পাশ্চাত্য জগতের কিছু নির্দিষ্ট অংশে, প্রাথমিকভাবে ইহুদি ধর্ম এবং বিশেষভাবে খ্রিষ্টধর্ম বিবর্তনের মধ্য দিয়ে। ইসলামি দুনিয়ায়, বিশেষত এশীয় সমাজগুলোতে এই দৃষ্টিভঙ্গির মূল্য তেমন নেই। ইসলামি দুনিয়া ও এশীয় সমাজগুলোতে জনজীবনে ধর্মের স্থান সম্পর্কে ধারণা ও বোঝাপড়া পাশ্চাত্য দুনিয়া থেকে ভীষণভাবে আলাদা রকমের।

যে সমাজে অধিকাংশ মানুষ একটা বিশেষ ধর্মবিশ্বাসের অনুসারী, সেই সমাজ প্রতিষ্ঠা পায় তার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যেসব নিয়মকানুন, বিধিবিধানকে ঐশ্বরিক বলে মনে করে সেসবের ভিত্তিতে এবং যথেষ্ট পরিমাণে সম্পদশালী সামাজিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানগুলোর দ্বারা, যেসব প্রতিষ্ঠানের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা থাকে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, পৃথিবীর প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অন্যতম, কায়রোর আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয় (অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কয়েক দশক আগে প্রতিষ্ঠিত) ৮০০ বছরের বেশি সময় ধরে ছিল সমগ্র সুন্নি মুসলিম দুনিয়ার জন্য জ্ঞানবিদ্যার প্রধান ক্ষেত্র।

এসব সমাজের ধার্মিক মানুষদের কাছে ধর্ম হচ্ছে তাদের পরিচয়ের মূল ভিত্তি; দুঃখ-কষ্ট, শঙ্কা-উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তার সময় ধর্মই তাদের স্বস্তি ও সান্ত্বনার উৎস। এভাবে, মধ্যপ্রাচ্যের মতো যেসব সমাজ বছরের পর বছর নানা রকমের বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, সেখানে ধর্ম বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

কিন্তু ইতিহাসে যেমনটি বারবার দেখা গেছে, ধর্ম যখন কোনো সমাজের খুব গভীরে শক্তভাবে প্রোথিত থাকে, তখন সেখানে রাজনৈতিক শক্তিগুলো নিজেদের স্বার্থে প্রতিপক্ষদের মুখ বন্ধ করে দিতে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবহার করতে পারে। গোটা ইসলামি দুনিয়াজুড়ে দীর্ঘ সময় ধরে এটা একটা বড় সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে; ধর্মীয় কর্তৃপক্ষগুলো সব সময় ন্যায্য আচরণ করে না, বরং রাষ্ট্রের একটা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যার সাহায্যে রাজনৈতিক এলিট শ্রেণি ক্ষমতা অর্জন করতে পারে।

ধর্মভিত্তিক সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোগুলোতে পরিবর্তন ও সৃজনশীলতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার প্রবণতা কম। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক অংশে এই নিয়ে একটা বিতর্ক আছে যে বিদ্যালয়গুলোতে বিবর্তনতত্ত্ব পড়ানোর পাশাপাশি ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত সৃষ্টিতত্ত্বেরও কোনো কোনো ভাষ্য পড়ানো উচিত কি না। এই বিতর্ক থেকে দেখা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের মতো অতি উন্নত সমাজেও ধর্মীয় ও ভাবাদর্শগত গোঁড়ামির মাত্রা কী ব্যাপক হতে পারে।

ধর্ম থেকে আবেগী সমর্থন মিলতে পারে, কিন্তু পরিচয়ের উৎস হিসেবে ধর্মের ভূমিকা সামাজিক জীবনে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে—এ ধরনের দৃষ্টান্তের অভাব নেই। একেশ্বরবাদী ও এশীয় ধর্মগুলোর ইতিহাসজুড়ে দেখা যায়, এসব ধর্মের অনুসারীরা সামাজিক সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীগুলোকে প্রায়ই সবকিছুর বাইরে রাখে, তাদের অপশক্তি হিসেবে তুলে ধরে। তারা নিজেদের সংকীর্ণ সংহতির স্বার্থে বহুত্ব পরিত্যাগ করে। সুনির্দিষ্টভাবে, মধ্যযুগীয় ও রেনেসাঁর সময়ের ইউরোপের ইতিহাসে এবং আজকের মুসলিম বিশ্বের কিছু অংশে দেখা যায়, ধর্ম উগ্রপন্থা ও সন্ত্রাসবাদ উসকে দিতে পারে; স্বাধীন ও মুক্তভাবে কথা বলা ও মতামত প্রকাশ করার ক্ষেত্রে বাধানিষেধ আরোপকে জায়েজ করতে ধর্মকে ব্যবহার করা যায়।

এই সমস্যাগুলো আরও প্রকট আকার ধারণ করে যখন এমন কিছু জনগোষ্ঠী একত্রে বসবাস করতে বাধ্য হয়, যাদের মধ্যে ঐতিহাসিকভাবেই সম্পর্ক ভালো নয়। এখন সেই পরিস্থিতিই দেখা যাচ্ছে সেই সব দেশে, যাদের মধ্যেকার সীমান্ত নির্ধারণ করে দিয়ে গেছে বিদেশি শক্তিগুলো। সমস্যাগুলো আরও খারাপ আকার ধারণ করে সেই সব দেশে, যেগুলোতে আধুনিকতার অভিজ্ঞতা জটিল; যেখানে আইন, রাজনীতি, জাতিগোষ্ঠীগত পরিচয় ইত্যাদি বিষয়ে বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠীর দৃষ্টিভঙ্গি বিভিন্ন রকমের; যেখানে কোন কোন বিষয়কে ঐশ্বরিক বা পবিত্র বলে মনে করতে হবে তা নিয়ে বিভিন্ন রকমের মত আছে। আর এ রকম কোনো সমাজের নবীন প্রজন্মই যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ হয় এবং তারা যদি এমন সব গুরুতর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার মুখোমুখি হয়, যেগুলো সৃষ্টির জন্য তারা নিজেরা দায়ী নয়, তাহলে সেই সমাজে উল্লিখিত মতবিরোধগুলো বিস্ফোরক পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে।

অবাক হওয়ার কিছু নেই যে মধ্যপ্রাচ্যে বর্তমানে চলমান যুদ্ধগুলোতে ক্রমেই প্রকট হয়ে ওঠা এই সমস্যাগুলো পাশাপাশিই আছে। অঞ্চলটিতে সাত দশক ধরে যেসব প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো রাজনৈতিক অংশগ্রহণের স্বরূপ নির্দিষ্ট করেছিল, সেগুলো ভেঙে পড়ার পর এই অঞ্চল আজ দৃশ্যত এক আবেগের বিস্ফোরণের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘ সময় ধরে চাপা দিয়ে রাখা সমাজে ধর্মের ভূমিকা কী হবে, এই ধরনের মৌলিক প্রশ্নগুলো নিয়ে বিরোধ দীর্ঘ সময় ধরে চাপা পড়ে থাকার পর এখন সামনে চলে আসছে এবং সেগুলোর বহিঃপ্রকাশ ঘটছে প্রায়ই সহিংসতার মধ্য দিয়ে।

২০১৭ সালে এবং তার পরেও যখন এই প্রক্রিয়া চলতে থাকবে তখন আরও অনেক অশুভ শক্তি বেরিয়ে আসতে পারে। তা যদি ঘটে তাহলে মুসলিম দুনিয়া আরও পেছনে পড়ে যাবে, কিন্তু বিশ্বের অন্য অনেক অংশ বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে আরও এগিয়ে যাবে। একেবারেই ভিন্নমুখী এই পথ মধ্যপ্রাচ্যে নবীনতর প্রজন্মের জন্য তাদের বিপর্যয়কর অতীত থেকে বেরিয়ে সামনের দিকে এগোনো আরও দুরূহ করে তুলবে।

কিন্তু শুধু এটাই সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ নয়। দুই শত বছর ধরে পৃথিবীর অন্যান্য সমাজ যেসব ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করেছে আর যেসব ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে, সেগুলো শিক্ষা নেওয়ার সুযোগ মধ্যপ্রাচ্যের নবীন প্রজন্মের আছে। সেক্যুলার আধুনিকতার সঙ্গে আরব ও মুসলিম দুনিয়ার প্রথম পরিচয়ের ইতিহাস তারা ঘেঁটে দেখতে পারে, সেগুলো নিয়ে চিন্তা করতে পারে। গত চার শ বছর ধরে পাশ্চাত্য দুনিয়া ধর্মের ব্যাপারে যে রাজনৈতিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছে, সেগুলো নিয়ে তারা চিন্তাভাবনা করতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যকে আরও প্রতিশ্রুতিময় ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে নবীন প্রজন্মের এ ধরনের চিন্তাভাবনাই সবচেয়ে বড় আশাব্যঞ্জক বিষয়। তা না হলে ধর্মীয় গোঁড়ামির জন্য চড়া মাশুল দেওয়া চলতেই থাকবে, ধর্মের কোনো সুফল পাওয়া যাবে না।

প্রজেক্ট সিন্ডিকেটের সৌজন্যে

ইংরেজি থেকে অনুবাদ: মশিউল আলম

তারেক ওসমান: ইসলামিজম: হোয়াট ইট মিনস ফর দ্য মিডল ইস্ট অ্যান্ড ইজিপ্ট অন দ্য ব্রিংক গ্রন্থের লেখক