হেলায় তাহারা করিবে জয়...

মাশরাফির নেতৃত্বে বাংলাদেশ বেশ কিছুদিন ধরে ওয়ানডেতে রঙিন সাফল্য পাচ্ছে। ছবি: প্রথম আলো
মাশরাফির নেতৃত্বে বাংলাদেশ বেশ কিছুদিন ধরে ওয়ানডেতে রঙিন সাফল্য পাচ্ছে। ছবি: প্রথম আলো
.
.

মুখে সেই চিরচেনা দুষ্টুমিমাখা হাসি, কিন্তু চোখে জল। রাশি রাশি কনফেত্তি বৃষ্টির মধ্যেও লুকোনো যাচ্ছে না, চিকচিক করছে অশ্রুবিন্দু। মাশরাফি কাঁদছেন!
মাশরাফি অবশ্য বেশিক্ষণ মঞ্চে থাকলেন না। ট্রফিটা একজনের হাতে দিয়ে নেমে পড়লেন। সেখানে হই-হুল্লোড় চলছে। একবার পেছন ফিরে তাকিয়ে হাসলেন, সে হাসিতে আশকারা। হুল্লোড়ের মাত্রা আরও বাড়ল। মাশরাফি আর তাতে যোগ দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলেন না। নেমে পড়লেন। দায়িত্ব যে শেষ হয়েছে!
সিঁড়ি বেয়ে মঞ্চ থেকে নামার সময় একটু নিজের বাঁ হাঁটুটা বুলিয়ে নিলেন। ডান হাঁটুও। সেই হাঁটু, সাতবারের অস্ত্রোপচারের ধকল সামলে ভার   বয়েছে ১৬ কোটি মানুষের প্রত্যাশার। স্বপ্নের। আশার। মাশরাফি আকাশের দিকে তাকালেন। চোখের জল শুধু  কষ্টের হয় না; আনন্দও নয়। তৃপ্তিরও তো হয়!
কল্পনা, শুধুই কল্পনা। কিন্তু কল্পনার চেয়ে বড় ‘সত্যি’ও তো নেই। এক মানুষ কল্পনায় আকাশে উড়তে চেয়েছিল বলেই তো একদিন সত্যি সত্যি বিমান উড়েছে আকাশে। কল্পনার পঙ্খিরাজ আকাশে উড়িয়ে আমরাও তো স্বপ্ন দেখতে পারি, ২০১৭ সালের ১৮ জুন, ওভালের ফাইনালে চ্যাম্পিয়নস ট্রফি চ্যাম্পিয়ন হবে বাংলাদেশ! সেই স্বপ্ন দেখার সাহস তো বাংলাদেশ দলই দিচ্ছে!
বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য গত দুটি বছর ছিল সোনায় মোড়ানো। ২০১৫ আর ২০১৬ তে স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে আমরা পৌঁছে গেছি কল্পলোকের দুয়ারে। নিজ সামর্থ্যের চাবি দিয়ে খুলে ফেলেছি তার দুয়ার। এবার বাংলাদেশের ক্রিকেটকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নেওয়া। আরও একটা চ্যালেঞ্জ জেতা। যে চ্যালেঞ্জ ইয়ান বোথামরাই জানিয়েছেন—এবার বাংলাদেশ বিদেশের মাটিতে জিতে দেখাক।
ঘরের মাটিতে টানা ছয়টি ওয়ানডে সিরিজ জিতেছে বাংলাদেশ। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজটিতেও জিততেই পারত। ছোটখাটো কিছু ভুলের বড় মাশুল গুনতে হয়েছে। ম্যাচের এক-দুটি মুহূর্ত বাঁক বদলে দিয়েছে। না হলে ওয়ানডে সিরিজটা জেতারই কথা ছিল বাংলাদেশের। শুধু ওয়ানডে? টেস্ট সিরিজটাও তো বাংলাদেশ জিততে পারত, সেটিও ২-০ ব্যবধানে। কিন্তু চট্টগ্রাম টেস্টটায় ২২ রানে হেরে যাওয়ার আক্ষেপ!

এবার বিদেশেও নিজেদের প্রমাণ করার পালা। সেই প্রমাণের বড় মঞ্চ হয়ে আসছে ‘২০১৭’। এ বছর বিদেশে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সফর আছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ দল নিউজিল্যান্ডে গিয়ে ওয়ানডে সিরিজ শেষ করেছে। সামনে ভারতে প্রথমবারের মতো টেস্ট খেলতে যাওয়া। এরপর জুনে চ্যাম্পিয়নস ট্রফি। আগস্টে পূর্ণ সফরে অস্ট্রেলিয়ায় যাওয়া। অক্টোবরে টেস্ট-ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি খেলতে বাংলাদেশ যাবে দক্ষিণ আফ্রিকায়।

ওয়েস্ট ইন্ডিজে সিরিজ জিতে    আসা হয়ে গেছে ২০০৯ সালে।     হোক না সে দুর্বল ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। এবার ক্রিকেটের আসল পরীক্ষার মঞ্চগুলোই বাংলাদেশের সামনে—নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা! ২০১৭-বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের নিজের সামর্থ্য জানান দেওয়ার বছর!

সব দেশই হোম অ্যাডভান্টেজ নেয়। বাংলাদেশ বরং এর আগে টেস্টে সেটা নেওয়ার সাহসই দেখায়নি। টেস্টেও মরা উইকেটে খেলতে চেয়েছে। এই প্রথম টেস্টে বাংলাদেশ নিজেদের সামর্থ্যের পক্ষে যায় এমন উইকেট বানিয়ে ইংল্যান্ডকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। তা ঘরের মাঠের সেই সুবিধা কে না নেয়। বিদেশে গিয়ে তো ইংল্যান্ডও কাঁপে! ভারত সফরেই তো নাকানিচুবানি খেল।

কিন্তু এ-ও সত্যি, বাংলাদেশের ক্রিকেটের প্রয়োজনেই, নতুন প্রজন্মকে এই আত্মবিশ্বাস ছড়িয়ে দেওয়ার তাগিদে এবার বাংলাদেশের জন্য একেবারে অচেনা কন্ডিশন বলে বিবেচিত দেশগুলোতে ভালো করার পালা। আর ২০১৭-র সূচি যেন তৈরিই করা হয়েছে সেভাবে! বাংলাদেশও প্রবল আত্মপ্রত্যয়ে এবার সমুদ্রে সপ্তডিঙা ভাসিয়ে দিতে পারে। এমনিতে বাঙালিদের মধ্যে ভিনদেশি রাজ্য জয়ে নাকি আগ্রহ নেই। চর্যাপদেও মিলবে না সে ইতিহাস। তবে বিজয় সিংহও তো হেলায় লঙ্কা জয় করেছেন। এবার ইউরোপ, আফ্রিকা, ওশেনিয়া জয়ের পালা! আর ২০১৫ ওয়ানডে বিশ্বকাপে বাংলাদেশ তো দাপট দেখিয়েই কোয়ার্টার ফাইনালে গিয়েছিল। সেটা তো ওশেনিয়াতেই!

নিউজিল্যান্ড সফরে ওয়ানডে সিরিজ শেষ হওয়ার পরপরই শুরু হবে তিন টি-টোয়েন্টির সিরিজ। এরপর আছে দুটি টেস্টও। জানুয়ারি মাসে সেই সফর শেষ করে ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ যাবে ভারতে। একমাত্র টেস্টটি হবে হায়দরাবাদে। যে টেস্টে ভালো করলে ‘বাণিজ্যলক্ষ্মী’র সন্ধানে মরিয়া ভারত বাংলাদেশকে আরও নিয়মিত আমন্ত্রণ জানাবে সন্দেহ নেই।

জুনে ইংল্যান্ডে চ্যাম্পিয়নস ট্রফি, যেটি ২০১৯ বিশ্বকাপের প্রস্তুতিও। পরের বিশ্বকাপ যে ইংল্যান্ডে। র‍্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষ আটটি দল খেলবে এই টুর্নামেন্টে। ‘এ’ গ্রু​েপ বাংলাদেশের সঙ্গে আছে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও ইংল্যান্ড।

 চ্যাম্পিয়নস ট্রফির প্রস্তুতি নিতে আয়ারল্যান্ডে একটি সংক্ষিপ্ত ত্রিদেশীয় সিরিজ খেলতে পারে বাংলাদেশ। আগস্টে দুই টেস্ট ও তিনটি ওয়ানডে খেলতে অস্ট্রেলিয়া সফরে যাবে দল। অক্টোবরে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে দুই টেস্ট ও তিনটি ওয়ানডের পাশাপাশি থাকছে দুটি টি-টোয়েন্টি।

ভিনদেশি এই কন্ডিশনগুলো বাংলাদেশের সামর্থ্যের নতুন পরীক্ষাই নেবে। বিশেষ করে এর আগে নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশে বাংলাদেশ সেভাবে লড়াই-ই করতে পারেনি।

২০১৬ সালে বাংলাদেশের ক্রিকেট সূচিতে দীর্ঘ বিরতি ছিল। প্রায় ১০ মাসের দীর্ঘ বিরতি ছিল আন্তর্জাতিক সূচিতে। তবে ২০১৭ কাটবে আন্তর্জাতিক ব্যস্ততায়। আইসিসির সফর সূচিতে (এফটিপিতে) একটি হোম সিরিজও আছে বাংলাদেশের। জুলাইয়ে পূর্ণাঙ্গ সফরে খেলতে আসবে পাকিস্তান, ২০১৫ সালের সফরটা যাদের ভালো কাটেনি। ওয়ানডেতে ধবলধোলাই হয়েছিল। টেস্টেও স্বাদ পেয়েছিল অন্য এক বাংলাদেশের।

তবে সব ছাপিয়ে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় লক্ষ্য হয়ে থাকবে চ্যাম্পিয়নস ট্রফি। ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি ছাড়া আইসিসির আর কোনো ট্রফি কখনো জেতা হয়নি। ঠিক ২০ বছর পূর্তিতে আরও একটা সুযোগ এসে দাঁড়াচ্ছে দুয়ারে। ১ জুন বাংলাদেশ-ইংল্যান্ড ম্যাচ দিয়েই শুরু হবে চ্যাম্পিয়নস ট্রফি। উদ্বোধনী ম্যাচ খেলার মধ্যে কৃতিত্ব নেই। যেটা আছে সমাপনী ম্যাচ খেলার মধ্যে। মাশরাফির জন্যও এটি দারুণ সুযোগ, নিজেদের রূপকথার নেতৃত্বে সোনালি এক অধ্যায় যোগ করার।

আশায় বুক বাঁধতে ক্ষতি কী!

রাজীব হাসান: সাংবাদিক