সামনে সম্ভাবনার দিন

গিয়াসউদ্দিন সেলিম পরিচালিত স্বপ্নজাল ছবিতে ইয়াশ ও পরীমনি; ছবিটি মুক্তির অপেক্ষায়। ছবি: বেঙ্গল ক্রিয়েশন্সের সৌজন্যে
গিয়াসউদ্দিন সেলিম পরিচালিত স্বপ্নজাল ছবিতে ইয়াশ ও পরীমনি; ছবিটি মুক্তির অপেক্ষায়। ছবি: বেঙ্গল ক্রিয়েশন্সের সৌজন্যে

‘কালি’ কিংবা ‘লোকাল বাস’। দুটোই ছিল এ বছর বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে আলোচিত দুটো নাম। ‘কালি’ হলো ওয়েব সিরিজ। আর ‘লোকাল বাস’ মমতাজের গাওয়া গান। দুটোই দারুণ জনপ্রিয়তা পায়। কিন্তু দুটোই মূলত ভার্চু্যয়াল জগতের বিষয় ছিল। টিভিতে নয়, ‘কালি’ শুধু দেখা গেছে অনলাইন ভিডিও প্ল্যাটফর্মে। আর ‘লোকাল বাস’ সিডিতে বেরোয়নি। বেরিয়েছে মোবাইল প্ল্যাটফর্মে আর ভিডিও দেখা গেছে ইউটিউবে। তবে এদের নিয়ে আলোচনা অন আর অফলাইন—সবখানেই ছিল। সহজ কথায়, এ বছর অন্তর্জালের দুনিয়ার দর্শকদেরই জয়জয়কার ছিল। টিভির দর্শক কিংবা সিডির ক্রেতাদের চেয়ে ভার্চু্যয়াল দর্শক আর শ্রোতাদের আওয়াজটাই বছরজুড়ে সাড়া ফেলেছে।

গান আর ওয়েব সিরিজের পাশাপাশি শর্টফিল্মের কথাও বলতে হয় বিশেষ করে। অবিশ্বাস, দেয়াল, শোধ, মায়া, বখাটে—এমনই অনেক স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি বছরজুড়েই তৈরি করেছেন নির্মাতারা। আর দর্শকেরাও কোনো বিজ্ঞাপন বিরতির ভয়ে ভীত না হয়ে ইউটিউবসহ বিভিন্ন ভিডিও প্ল্যাটফর্মে দেখেছেন ছবিগুলো।

এবার গত বছরের আলাপ বাদ দিয়ে এই নতুন বছরটি নিয়ে কথা হোক। প্রতিবছরের শুরুটাই হয় অনেক অনেক সম্ভাবনা দিয়ে। পুরোনোকে পেছনে ফেলে এগিয়ে চলার প্রত্যয় নিয়ে নতুন বছরের শুভারম্ভ হয়। তবে ২০১৭টা হোক ভিন্নধর্মী। না, না, শিল্পীরা যেমন বলেন, গল্পটি ‘ভিন্নধর্মী’; বিষয়টি তেমন না। সত্যিকার অর্থেই ভিন্নধর্মী। এ বছর পুরোনো স্মৃতিকে পেছনে ফেলা কঠিন। অন্তত বাংলাদেশের চলচ্চিত্রজগৎ গত বছর যেই সম্ভাবনার ঝলকানি দেখিয়েছে দেশকে, তাতে তো পুরোনোকে কোনোভাবেই তুচ্ছ ভেবে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। বরং গত বছরের আয়নাবাজি, অজ্ঞাতনামার মতো ছবিগুলো যে আলো ছড়িয়েছে, তা এ বছরও ধরে রাখা এক চ্যালেঞ্জই বটে।

তবে ২০১৭-ও গত বছরের সেই চ্যালেঞ্জকে পাল্লা দিতে প্রস্তুত। মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ডুব, ফাখরুল আরেফিনের ভুবন মাঝি, দীপঙ্কর দীপনের ঢাকা অ্যাটাক, ওয়াহিদ তারেকের আলগা নোঙর, আবু শাহেদ ইমনের অপদার্থ আর গিয়াসউদ্দিন সেলিমের স্বপ্নজাল-এর মতো ছবিগুলো নতুন এ বছরকে করে তুলেছে কাঙ্ক্ষিত। নির্মাতারা সব শ্রেণির দর্শকের কথা মাথায় রেখেই প্রস্তুত হচ্ছেন প্রেক্ষাগৃহে ‘টেরাম টেরাম যুদ্ধে’ নামার জন্য। বোদ্ধামহলের প্রশংসা কিংবা আন্তর্জাতিক উৎসবগুলোয় পুরস্কার অর্জন নয়, এ বছরের ছবিগুলো নির্মাতারা প্রেক্ষাগৃহে দর্শক ফিরিয়ে আনার কথা মাথায় রেখেও তৈরি করছেন।

এবার টিভি নাটকের দিকে মোড় ঘুরিয়ে আনি। বিশ্বব্যাপীই টিভি দর্শকের সংখ্যা কমছে। স্মার্টফোন সবার হাতে হাতে পৌঁছে যাওয়ায় টিভির জায়গা দখল করে নিচ্ছে তারা। এরপর শিল্পী ও কলাকুশলীরা এখন আবার নাটকের চেয়ে বেশি আন্দোলন আর সাংগঠনিক বিষয়-আশয় নিয়ে বেশি ব্যস্ত। গত বছরের শেষটা তো আন্দোলন, সমাবেশ আর অবস্থান কর্মসূচির মধ্য দিয়ে শেষ করলেন টেলিভিশনের নাটক নির্মাণের সঙ্গে জড়িত শিল্পী ও কুশলীরা। যাঁরা আন্দোলনের বাইরে ছিলেন, তাঁদের মধ্যে আবার অনেকেই টিভির চেয়ে বেশি সময় দিচ্ছেন অনলাইনে প্রচারের জন্য নির্মিতব্য ওয়েব সিরিজ, শর্ট ফিল্ম আর মিউজিক ভিডিওর মডেলিংয়ের কাজে। আর অনলাইনভিত্তিক কাজে কেনই বা সময় দেবেন না শিল্পীরা। এ বছর ভার্চু্যয়াল জগতের যে দৌরাত্ম্য দেখেছে দেশের বিনোদন অঙ্গন, এরপরও সেদিকে মন না দিলে তা হবে বোকামি। অনলাইনে নাটক-সিনেমা-গান দেখার দর্শক যে দিন দিন বাড়ছে, তার প্রমাণ হলো ‘হিরো আলম’! বগুড়ার কোনো এক প্রত্যন্ত অঞ্চলের ‘হিরো আলম’ এই অনলাইন দর্শকদের কারণেই তো একটা সময় কেমন অহেতুক আলোচনায় উঠে এলেন। গুগলে খোঁজাখুঁজির ক্ষেত্রে ছাড়িয়ে গেলেন বলিউডের তারকা সালমান খানকেও!

টেলিভিশনে গত বছরের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল একটাই নাম—সুলতান সুলেমান। টিভি নাটকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিল্পী ও কুশলীদের আন্দোলনটা মূলত দানা বাঁধতে শুরু করে এই বাংলায় ডাবিং করা তুর্কির সিরিজের প্রচার শুরুর পর থেকে। সিরিজটি জনপ্রিয় হতে শুরু করলে তা নিয়ে নানা মহলে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। এরপর দীপ্ত টিভিতে প্রচারিত এই সিরিজের দেখাদেখি অন্য চ্যানেলগুলোও শুরু করে বিদেশি সিরিজের প্রচার। দর্শকও ভিন্নতার স্বাদ পেয়ে ঝুঁকে পড়ে সেই দিকে। তবে এ বছরও বিদেশি সিরিজ দর্শকদের টিভির সঙ্গে কতটা বেঁধে রাখতে পারবে, তা নিয়ে রয়েছে সংশয়। কারণ, চ্যানেলগুলো এক সিজন (মৌসুম) শেষে নতুন সিজন শুরু করতে যে সময় নেয়, তত দিনে দর্শক ভার্চু্যয়াল মাধ্যমেই তা দেখে নেয়। তা ছাড়া দেশি চ্যানেলে প্রচারিত হয় না, এমন সিরিজও টিভির দর্শকদের প্রচুর পরিমাণে অনলাইনে টেনে নিচ্ছে। আর এসবের বদৌলতে দেশের নাটকও অনলাইনে দেখার পরিমাণ বাড়ছে।

গানের জগতেও ২০১৭ যোগ করতে পারে নতুন এক বদলে যাওয়া অধ্যায়। শুধু ইউটিউব নয়, বিভিন্ন ভিডিও প্ল্যাটফর্মে ও মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে গানের প্রচার ও বাজারজাত যে হারে বাড়ছে, তাতে করে শ্রোতা এ বছর নতুন সুর ও সংগীতের চেয়ে বেশি নতুন প্রযুক্তির উৎকর্ষ আয়ত্তে আনতেই সময় বেশি ব্যয় করবে। মিউজিক ভিডিও ও ‘সিঙ্গেলস’-এর এই যুগে আট-নয়টি গান নিয়ে অ্যালবাম প্রকাশ হয়তো আরও সেকেলে রূপ নেবে এ বছর। নানা ঘরানার গানের উৎসব আর কনসার্টের সুবাদে এ শহর যে এ বছর পাবে ভিনদেশি সুরের স্বাদ, তা-ও অপরিবর্তিত থাকবে, তা গণক না হয়েও বলতে পারবে যে কেউ।

তবে গত বছরের যে বিষয়টি এ বছরের জন্য হতে পারে ক্ষতিকর, তা হলো ফাঁকা আওয়াজ। গণমাধ্যমের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় দিন দিন হাওয়ায় ভাসা গুজবই যেন ‘সদ্য সংবাদ’-এর তকমা পেয়ে যাচ্ছে সহজেই। এ বছরও যদি তেমনটিই ঘটে, তাহলে আড়ালে চলে যাওয়া অভিনেত্রী অপু বিশ্বাসকে নিয়ে এ বছরও তোলপাড় চলতেই থাকবে। পরীমনির অজ্ঞাত প্রেমিক নিয়ে রহস্য বারবারই খবরের শিরোনামে উঠে আসবে। স্পনসর দিয়ে ‘ভিউ’ আর ‘লাইক’ কিনে যে কেউই হয়ে যেতে পারবে ইউটিউব/ফেসবুকের সবচেয়ে ‘হিট’ গানের গায়ক/গায়িকা। উড়ো কথা যদি গত বছরের মতো এ বছরও হাওয়ায় ঘন ঘন উড়ে বেড়ায়, তাহলে নায়ক রাজ্জাকের স্বাস্থ্য নিয়ে ভুয়া খবর এ বছর ভাবাবে পাঠকদের। তাই বিনোদন-দুনিয়ার উত্তরোত্তর সাফল্যের পাশাপাশি, ভুয়া ‘ভিডিও’সহ খবর থেকে পাঠক-দর্শক-শ্রোতাদের যেন মুক্তি মেলে, নতুন বছরের জন্য সেই কামনাই করা যাক।

আদর রহমান: সাংবাদিক