পৃথিবী কোন দিকে যাচ্ছে?

গৃহযুদ্ধকবলিত সিরিয়ার শিশু। ছবি: আন্দালু এজেন্সির সৌজন্যে
গৃহযুদ্ধকবলিত সিরিয়ার শিশু। ছবি: আন্দালু এজেন্সির সৌজন্যে
.
.

বিদায়ী ২০১৬ সালকে যদি এককথায় বর্ণনা করতে হয়, তবে তা হবে ‘পরিবর্তনের বছর’। বৈশ্বিক রাজনীতির ঘটনাপ্রবাহ বিবেচনায় নিয়ে আমরা এই বছরটিকে বিস্ময়, বিভক্তি ও অনিশ্চয়তার বছর বলেও চিহ্নিত করতে পারি। রাজনীতি ও অর্থনীতিতে বিভক্তি ও বৈষম্য নতুন নয়, সব দেশে ও সমাজে সব সময়েই বিভক্তি থেকেছে। কিন্তু এতটা প্রকট রূপে এবং রাজনীতিতে নির্ধারকের ভূমিকায় তার উপস্থিতি আমরা আগে দেখতে পাইনি। বিস্ময় ও অনিশ্চয়তা ২০১৬ সালে সারা বছর ধরেই আমাদের সঙ্গী থেকেছে; কিন্তু তার আরও কতটা বাকি, তা আমরা জানি না।তাই অন্ততপক্ষে অনিশ্চয়তার বিষয়টি ২০১৭ সালের জন্য তুলেও রাখা যেতে পারে।
২০১৬ সালে যেসব ঘটনাপ্রবাহ দেখেছি, যেসব রাজনীতিবিদ প্রভাবশালী হয়ে উঠেছেন, যেসব প্রবণতা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে, সেগুলো আশু ভবিষ্যতে পৃথিবীজুড়ে এক অনিশ্চিত সময়েরই ইঙ্গিত দিচ্ছে। ২০১৭ সালের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আমরা বলতে পারি, অনিশ্চয়তাই এখন একমাত্র নিশ্চিত বিষয়। স্থিতাবস্থা সব সময়ই ইতিবাচক নয়, অনেক ক্ষেত্রেই স্থিতাবস্থার অবসানই কাঙ্ক্ষিত; তেমনি পরিবর্তন মানেই অগ্রগতি নয়, পরিবর্তনমাত্রই ইতিবাচক নয়, সেটাও আমাদের মনে রাখা দরকার। পশ্চাদ্‌গামী যাত্রাও পরিবর্তন, কিন্তু তা অপ্রত্যাশিত, অনাকাঙ্ক্ষিত।
বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনাগুলোর মধ্যে ব্রেক্সিট, যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয়, ফিলিপাইনে প্রেসিডেন্ট দুতার্তের উত্থান, কলম্বিয়ায় গণভোটে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে শান্তিচুক্তি প্রত্যাখ্যান, তুরস্কে ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান, কিউবার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কোন্নয়ন, সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে বাশার সরকারের উল্লেখযোগ্য সাফল্য, ব্রাজিলের রাষ্ট্রপ্রধান দিলমা রুসেফ ও দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট পার্ক গুন হির অভিশংসন, ভেনেজুয়েলার অব্যাহত রাজনৈতিক সংকট—এসবের মধ্যেই আছে পরিবর্তনের লক্ষণ এবং অধিকতর পরিবর্তনের ইঙ্গিত। বিশ্ব রাজনীতিতে রাশিয়া ও প্রেসিডেন্ট পুতিনের অবস্থা ও অবস্থান যে আগের চেয়ে অনেক বেশি প্রভাবশালী, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ক্রিমিয়া দখলের মধ্য দিয়ে পুতিন জানিয়েছিলেন যে সামরিক শক্তি ব্যবহারে তিনি অনীহ নন, সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের সরকারকে রক্ষায় প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হয়ে তিনি রাশিয়ার আগ্রাসী নতুন ভূমিকার জানান দিয়েছেন। রাশিয়া যে তার প্রভাব ও শক্তির প্রয়োগ কেবল মধ্যপ্রাচ্যেই সীমিত রাখবে না, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে প্রভাবিত করার চেষ্টায় তা-ই প্রমাণিত হয়।

রাশিয়ার এই চেষ্টার কারণে রুশ–মার্কিন ক্রমাবনতিশীল সম্পর্ক তিক্ততার পর্যায়ে নেমেছে, যা ডিসেম্বরে রাশিয়ার ওপর আরও অবরোধ এবং ৩৫ জন রুশ কূটনীতিককে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত ঘোষণার  মধ্যেই স্পষ্ট। বিশ্বরাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব যে হ্রাস পেয়েছে তাও ২০১৬ সালে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি সহজে অনুধাবন করা গেছে।

 এই বছরে আঞ্চলিক শক্তিগুলোর মধ্যে নতুন বিন্যাসও দেখেছি: মধ্যপ্রাচ্যে ইরান-সিরিয়া-রাশিয়ার ঘনিষ্ঠতা নতুন নয়, কিন্তু            তার সঙ্গে তুরস্কের সংযুক্তির যে আভাস বছরের শেষ নাগাদ পাওয়া যায়, তাতে ওই অঞ্চলে  নতুন মেরুকরণের এবং সহযোগিতা-কাঠামো গড়ে ওঠার সম্ভাবনা বা আশঙ্কার ইঙ্গিত আছে। এর বিপরীতে সৌদি আরবের যুদ্ধংদেহী  মনোভাব ও ইসরায়েলের আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি অবজ্ঞা বিবেচনায় নিলে আরও বেশি অস্থিতিশীল মধ্যপ্রাচ্যের ছবিই ভেসে ওঠে। এই অঞ্চলে পরিবর্তনের আরেক ইঙ্গিত হচ্ছে ইসরা​েয়লের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ী প্রশাসনের দৃষ্টিভঙ্গির বদল। কয়েক দশক ধরে অধিকৃত ফিলিস্তিনি এলাকায় ইসরায়েলের বসতি      স্থাপনের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ কোনো রকম নিন্দা প্রস্তাব পাস করতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্রের ভেটোর কারণে। কিন্তু ২৩ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র ভোটদানে বিরত থাকলে নিন্দা প্রস্তাব পাশ হয় এবং এই নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েল বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়ে। ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়ে দিয়েছেন যে তিনি ক্ষমতায় এলে ইসরায়েলের পক্ষেই তাঁর প্রশাসন অবস্থান নেবে। রিপাবলিকান নিয়ন্ত্রিত কংগ্রেসও ওবামা প্রশাসনের অবস্থানের বিরুদ্ধে। এই প্রস্তাবের আশু কার্যকারিতা না থাকলেও এর প্রভাব যে ভবিষ্যতে থাকবে, সেটা প্রায় নিশ্চিত।

পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীনের প্রভাব বিস্তার রোধে ওবামা প্রশাসন যে ‘এশিয়া পিভট’-এর উদ্যোগ নিয়েছিল, তার অন্যতম লক্ষ্য ছিল এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও বাণিজ্য ক্রমশ বাড়ানো। কিন্তু ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ চুক্তি বাস্তবায়িত হওয়ার আগেই তা থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষণার ফলে সেই প্রচেষ্টা এখন বাস্তবায়িত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এতে অনুমান করা যায় যে, অর্থনৈতিকভাবে চীনের প্রভাববলয় বিস্তৃতির পথ উন্মুক্ত হবে; চীন ও ফিলিপাইনের মধ্যে সম্পর্কের উন্নয়ন সেই দিকেই অঙ্গুলিসংকেত করে। এর একটি অনিবার্য পরিণতি হবে দক্ষিণ চীন সাগরে সামরিক উত্তেজনা বৃদ্ধি।

২০১৬ সালে আঞ্চলিক উত্তেজনা বৃদ্ধির ঘটনা ঘটেছে দক্ষিণ এশিয়ায়, যার প্রভাব ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে বলেই অনুমান করা যায়। সেপ্টেম্বরে কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণরেখা অতিক্রম করে পাকিস্তানের সেনাচৌকিতে ভারতের হামলা, যাকে ভারত ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ বলে দাবি করেছে, উত্তেজনা বৃদ্ধির সবচেয়ে বড় ঘটনা। তবে তার পটভূমি হচ্ছে জম্মু ও কাশ্মীরের উরিতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর চৌকিতে জঙ্গিদের আক্রমণ, যার জন্য ভারত পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোকে দায়ী করে। ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে অব্যাহত গণবিক্ষোভ এবং উরির ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সার্কের শীর্ষ সন্মেলন স্থগিত করার ঘটনা ভবিষ্যতে এই উত্তেজনা প্রশমনের বদলে আরও বেশি টানাপোড়েনের আশঙ্কাই তৈরি করেছে।

গত বছরের কয়েকটি প্রবণতা: পৃথিবীজুড়ে উগ্র জাতীয়তাবাদের উত্থান, লোকরঞ্জনবাদ বা পপুলিজমের বিকাশ, জেনোফোবিয়া বা বিদেশিদের বিরুদ্ধে অসহিষ্ণু মনোভাবের বিস্তার, রাজনীতির মূলধারায় ইসলামভীতি বা ইসলামোফোবিয়ার স্থান লাভ ও তার বিপরীতে ইসলামপন্থী উগ্র চরমপন্থার বিস্তার। এই প্রবণতাগুলোরই কিছু কিছু ব্রেক্সিট সম্ভব করেছে। ইউরোপে উগ্র দক্ষিণপন্থী দল যেমন অস্ট্রিয়ায় ফ্রিডম পার্টি, ব্রিটেনে ইনডিপেনডেন্স পার্টি, ফ্রান্সে ন্যাশনাল ফ্রন্ট, ডেনমার্কে ড্যানিশ পিপলস পার্টি, হাঙ্গেরিতে কেডিএনপির মতো দলকে মূলধারার রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয়ের পেছনেও একই প্রবণতার প্রভাব লক্ষণীয়। কিন্তু এটা শুধু ইউরোপ বা যুক্তরাষ্ট্রের বিষয় নয়, এশিয়া এবং আফ্রিকায়ও এর উপস্থিতি সুস্পষ্ট।

উল্লিখিত প্রবণতাগুলোর উপস্থিতি ও শক্তিশালী প্রভাব নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। কিন্তু এটি আরও বেশি উদ্বেগজনক এই কারণে, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কর্তৃত্বপরায়ণ নেতাদের উত্থান। উগ্র জাতীয়তাবাদ, লোকরঞ্জনবাদ ও জেনোফোবিয়া যে কর্তৃত্ববাদী রাজনীতির অনুকূল, তা ইতিহাসের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। ১৯৩০-এর দশক তার প্রমাণ। একসময় ভাবা হয়েছিল, ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে পৃথিবী সেই পথে আর এগোবে না, কিন্তু গত বছর যেসব রাজনীতিক সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছেন ও প্রভাব বিস্তার করেছেন—পুতিন, দুতার্তে, ট্রাম্প, ফারাগে, এরদোয়ান, মাদুরো, সু চি—তাঁদের আচরণ ও বক্তব্যই প্রমাণ করে যে নিরঙ্কুশ ক্ষমতাই তাঁদের লক্ষ্য। নিয়ন্ত্রণহীন বৈষম্যমূলক বিশ্বায়নের বিপরীতে সংরক্ষণবাদী অর্থনৈতিক নীতি ও জাতীয়তাবাদের নামে নিজস্ব জাতীয় স্বার্থের প্রাধান্য যে বিচ্ছিন্নতাবাদের জন্ম দেবে, তাতে বিশ্বের নিরাপত্তা বৃদ্ধি, দারিদ্র্য মোচন বা স্থিতিশীলতার সম্ভাবনা বাড়বে না। ২০১৬ সালের ঘটনাপ্রবাহ সেদিকেই ইঙ্গিত দেয়।

গত বছর সন্ত্রাসবাদের রূপ, প্রকৃতি ও ব্যাপ্তিতে পরিবর্তন এসেছে। বাংলাদেশের পাঠকদের জন্য তার উদাহরণ রয়েছে নিজ দেশেই। আইএস যতই ইরাক ও সিরিয়ার ঘাঁটি থেকে বিতা​িড়ত হচ্ছে, ততই তার অনুসারীরা ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বের আনাচকানাচে। ইউরোপে সন্ত্রাসী তৎপরতার বৃদ্ধি তার প্রমাণ। প্রমাণ তুরস্ক, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ—এমন অনেক দেশ। ২০১৪ ও ২০১৫ সালকে যদি আইএস-এর উত্থান ও শক্তি সঞ্চয়ের বছর বলে বিবেচনা করি, তবে ২০১৬ সালকে একাদিক্রমে তার পতনের সূচনা ও ভৌগোলিকভাবে তার আদর্শের বিস্তারের সময় বলেই ভাবতে হবে। মনে রাখা দরকার, আইএসই একমাত্র আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী নয়, আল-কায়েদার পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া গত বছরে বেশ জোরেশোরেই চলেছে। তদুপরি আছে বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরে জঙ্গিগোষ্ঠী, যারা নিজ নিজ দেশের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি। এর সঙ্গে আমরা গত বছরে দেখেছি স্বতঃপ্রণোদিত সন্ত্রাসীদের উত্থান, যারা সাংগঠনিকভাবে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীদের সঙ্গে যুক্ত না হলেও আদর্শিকভাবে প্রণোদিত হয়েছে। এই আদর্শিক প্রণোদনার সুনির্দিষ্ট কারণ ভিন্ন ভিন্ন, তার পটভূমিতেও পার্থক্য আছে। কিন্তু উগ্র জাতীয়তাবাদ, লোকরঞ্জনবাদ, জেনোফোবিয়া, অসহিষ্ণুতা ও কর্তৃত্ববাদী শাসন সন্ত্রাসবাদীদের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়ক হয়েছে।

যেকোনো বছরের সূচনায় আমরা জানি না সেই বছরে কী ঘটবে; সেই অনিশ্চয়তা স্বাভাবিক। কিন্তু ২০১৬ সালের বিস্ময়কর এবং অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের ফলে ভবিষ্যতের সেই অনিশ্চয়তা কেবল বৃদ্ধি পেয়েছে তা নয়, সেটাই সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়ে পরিণত হয়েছে।

আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।