কলাপাতার ঘর

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

দাউদাউ পুড়তে থাকা ঘরটির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে দীনতা মুরমু। মা বলে, এই ঘরেই ওর জন্ম হয়েছিল পাখিডাকা ভোরে। দিনের আলো ফুটিফুটি করছিল তখন। ওর জন্মের সময় ওর মায়ের পাশে কেউ ছিল না। দিদিমাও না। মা নিজে নিজেই নাড়ি কেটেছিল।
মায়ের কাছ থেকে এমন গল্প শুনতে শুনতে ও বড় হয়েছে। এখন এই ঘর পুড়ে যাচ্ছে। ওর মনে হয় তাকিয়ে থাকতে থাকতে ওর চোখও আগুন হয়ে যাচ্ছে। ওখানে জল নেই। জল কী তা ও জানে না, কোনো দিন দেখেনি। দীনতা কাঁদতে শুরু করলে চোখের জল ওকে শীতল করে না। নিজের গালের ওপর জলের আগুন গড়ায়। চারদিকের পুড়ে যাওয়া ঘরের আগুনের তাপ ওর শরীরকে উষ্ণ করে দেয়। বুঝতে পারে এ উষ্ণতা অন্য রকম। শীতকালে ঘুঁটের আগুনে হাত সেঁকে উষ্ণতা পাওয়া এটা নয়।
ওর চারপাশে আরও তিন-চারজন মেয়ে এসে দাঁড়ায়। কেউ ওর হাত ধরে। সঙ্গে সঙ্গে ওর দিকে ফিরে তাকালে বোঝে, স্কুলে যাওয়ার সময় হয়েছে বুঝি। কিন্তু না, ও তো কবেই স্কুলে যাওয়া ছেড়েছে। ক্লাস ফাইভ পাস করার পরে আর পড়ালেখা হয়নি। সে জন্য ওর মনে কোনো দুঃখ নেই। ও মায়ের সঙ্গে খেতে কাজ করে। ধান কাটার সময় বাবার সঙ্গে কাজ করে। ধরিতা মাসির ঘরে গিয়ে মেশিনে জামা সেলাই করে। নিজের ঘরে বসে সুচের কাজ করে, কাঁথায় ফুল ফোটায়। সবাই বলে, দীনতা একটা কাজের মেয়ে হয়েছে। ও যেটা করতে চায়, সেটাই পারে। কাজ ওর কাছে কঠিন কিছু না।
শুধু কেউ ওকে বলেনি, দীনতা তোর হাসি ভালোবাসি। অনেক রাতে ঘরের চালে শিশির ঝরলে আচমকা ওর ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম ভাঙার কারণ কোনো বড় ধরনের শব্দ নয়, নিজের ভেতরের প্রবল অনুভব মাত্র। ভাবনায় আসে, কেউ বুঝি ফিসফিসিয়ে ডাকছে।
বলছে, দীনতা, চল ছাগল চরিয়ে আসি।
—না, আমি ছাগল চরাব না।

—তাহলে কি চরাবি, শূকর?

—না, শূকরও না। আমি বাঘ চরাব। বড় বাঘ। হালুম করে—

তারপর খিলখিলিয়ে হাসত ও। অনেক রাত এভাবে কেটেছে না ঘুমিয়ে। কেউ এসে হাত ধরবে এমন স্বপ্ন নিয়ে নিজেদের মাটির দেয়ালের ঘরের জানালার ফাঁক দিয়ে ভোরের আলো ফুটতে দেখেছে।

আজ এই ঘর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।

দীনতা কয়েক পা পেছনে সরে আসে। নিজের কষ্টের কান্না ওর বুকের ভেতরে স্তব্ধ হয়ে আছে, কিন্তু ওকে শুনতে হচ্ছে চারদিক থেকে ভেসে আসা প্রবল কান্নার শব্দ। আসলে কান্না নয়, চারদিক থেকে হাহাকারের তাণ্ডব। আগে কখনো মানুষকে এভাবে কাঁদতে দেখেনি দীনতা। আজ সবাই এভাবে কাঁদছে। পাশাপাশি চিৎকার করে ছোটাছুটি করছে। ও তো কত সময় কত মানুষকে কাঁদতে দেখেছে। মানুষ মরে গেলে কেঁদেছে সবাই। কিন্তু সে কান্না কখনো এ রকম হয় না। কেউ বিলাপ করে কাঁদে, কেউ গুনগুনিয়ে, কেউ মাথা চাপড়ে চিৎকার করে। কেউ শুধু চোখ মোছে। আজ সবার কান্না এক রকম। কান্নায় হাহাকার আছে, গালিগালাজ আছে, প্রতিশোধ নেওয়ার হুংকার আছে। এদের সঙ্গে এক হয়ে কাঁদছে দীনতার দিদিমা। ও দেখতে পায়, দিদিমা ছুটতে ছুটতে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। চিৎকার করে বলছে, নিল, নিল। ওরে আমার গরুটা নিল। গরুটার বিয়ানোর সময় হয়েছে। হায় হায় রে, আমার পোয়াতি গরু—

সুনিতার চিৎকার কেউ শোনে কেউ শোনে না। কেউ এগিয়ে আসে না। গরু নিয়ে নির্বিকার হেঁটে যায় কুদ্দুস বেপারি। ওর কাঁধে বড় পোঁটলাও আছে। ঘর লুটপাটের অন্য জিনিস। ওর পিছে পিছে দৌড়াচ্ছে শুধু দিদিমা সুনিতা। পাশে পড়ে থাকা ছোট একটা বাঁশের লাঠি নিয়ে দিদিমার সঙ্গে দৌড়াতে থাকে দীনতা। কুদ্দুসের পায়ের গতি বেড়েছে। ও অনেকটা দূরে চলে গেছে। ও দিদিমাকে ছাড়িয়ে এগিয়ে গেলে পথ আটকায় লক্ষণ টুডু। চোখ গরম করে বলে, আর যাবি না।

—ক্যান হে? ও চিৎকার করে ওঠে।

—জোয়ান মেয়ে। সে জন্য।

—জোয়ান মেয়ে! দীনতা দুচোখ বিস্ফারিত করে তাকায়। যেন এমন একটি শব্দ ও কোনো কালে শোনেনি। এর মানে কী তা-ও জানে না। আবারও চেঁচিয়ে বলে, ক্যান হে?

মধ্যবয়সী লক্ষণ টুডু একমাথা পাকা চুল ঝাঁকিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বলে, ওরা তোকেও লুট করবে।

—লুট! ততক্ষণে সুনিতা এসে ওর হাত ধরে। বাঁশের লাঠি কেড়ে নিয়ে বলে, থাক, আমার গরু লাগবে না। চল ঘরে যাই।

—ঘর! আবার চেঁচিয়ে ওঠে দীনতা। ওর মাথায় আগুন জ্বলে। তোর ঘর কোথায় দিদিমা?

সুনিতা ওকে জড়িয়ে ধরে। ও নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে চেঁচাতে থাকে, আমার ঘরে আগুন দেবে কেন ওরা? আমার জিনিস লুট করবে কেন? আমি কি লুটের মাল?

এ কথার সঙ্গে ওর চিৎকারে স্তব্ধ হয়ে যায় চরাচর। আখখেতের ওপর দিয়ে উড়ে যায় ওর কণ্ঠস্বর। সামনে তাকালে দীনতা দেখতে পায়, দ্রুত পায়ে চলে যাচ্ছে কুদ্দুস। একবার পেছন ফিরে তাকায়। যেন বলছে, আমার গোয়াল থেকে আমি গরু বের করেছি, তুই কোন শয়তানের হাড্ডি যে চিল্লাস? লোকটাকে আর দেখা যায় না। ও গাছের আড়ালে চলে গেছে। ততক্ষণে দিদিমা ওকে বুকে টেনে নিয়েছে। চারদিক থেকে ঘরপোড়া লোকেরা এসে এক জায়গায় জড়ো হয়েছে। মাথার ওপরে বড় গাছটি ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে আছে।

হঠাৎ দিদিমার হাত ছাড়িয়ে মাথা সোজা করে দীনতা। কান্নার শব্দ শুনে তাকালে দেখতে পায় তলখা টুডু কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে আসছে। দাঁড়িয়ে থাকা সবাই ওর দিকে মুখ ফেরায়। ও সবার কাছে দু-হাত ওপরে তুলে কাঁদতে কাঁদতে বলে, আমার শূকরছানা কেড়ে নিয়ে গেছে। তোমরা আমার ছানাটা এনে দাও। ওটাকে কোলে না নিলে আমি মরে যাব। আমি মরে যাব—

কিশোর বালক তলখা কাঁদতে কাঁদতে লাফায়। দীনতা ধমক দিয়ে বলে, তোর ছানাটি কে নিল?

—মোস্তফা চৌকিদার।

—মোস্তফা চৌকিদার? সে শূকরছানা দিয়ে কী করবে? ওরা কি শূকর খায়?

—আমি তো সেই কথা বলেছিলাম। সে আমাকে একটা চড় দিয়ে বলেছে, তুই নিজেও একটা শূকরের বাচ্চা। আমি এটা বেচব। তোরা খাবি। তোদের কাছেই বেচব।

—কোন দিকে গেছে চৌকিদার?

—ওই যে ওই দিকে। বাজারের রাস্তায়।

—চল, আমরা কেড়ে আনব। আয় আমার সঙ্গে। দীনতা পা বাড়িয়ে তলখার হাত ধরে। ওরা এগোতে গেলে বাধা দেয় বুড়ো নরেন হেমব্রম। দীনতা বুড়োর হাত সরিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে, দাদু থামান কেন?

—তোকেও লুট করবে। ওরা সাঁওতালপল্লিতে আগুন দিয়েছে। লুট করছে।

—আমাকে কেউ লুট করলে আমি তার গলা কাটব। ছাড়েন।

চারদিকে দাঁড়িয়ে থাকা সবাই ওকে ধমক দেয়। বলে, বাড়াবাড়ি করিস না দীনতা। চুপ করে বসে থাক। সুনিতা ওকে জড়িয়ে ধরে পিছে টেনে নিয়ে যায়। ধরিতা মুরমু মাটি চাপড়ে কাঁদছে। সেখানে গিয়ে দুজন বসে।

—আমার সেলাই মেশিন, কোথায় পাব আমার সেলাই মেশিন—ক্যান হে হামাকেরে জিনিস লুট হয়—ক্যান হে—

মাটিতে গড়াগড়ি করে ধরিতা। ধুলোবালুতে পুরো শরীর মাখামাখি। চেহারাও ঠিকমতো চেনা যাচ্ছে না। মাসির দিকে তাকিয়ে দীনতার বুক কুঁকড়ে যায়। পোড়া ঘরের মানুষ হয়ে মাসির চেহারা বদলে গেছে। মেশিনসহ ঘরের অন্য জিনিসও লুট হয়েছে। সব ঘরের জিনিস লুট করে তাহলে কি ওরা এবার জোয়ান মেয়েদের লুট করবে? দীনতার শরীর শিউরে ওঠে। ও হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে ধরিতার পাশে। ধরিতাকে টেনে জোর করে বসায়।

—মাসি, মাসি—হামাকেরে ঘর পোড়ে ক্যান হে?

ধরিতা বিমূঢ় দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে।

—মাসি, মাসি—হামাকেরে জিনিস লুট হয় ক্যান হে?

বিমূঢ় ধরিতা কাঁদতেও পারে না দীনতার প্রশ্নে। বোকার মতো ধুলোমাখা শরীর নিয়ে বসে থাকে। হাত-পা ঝেড়ে ধুলো সরায় না শরীর ও কাপড় থেকে। একটু আগে যখন মাটিতে গড়াগড়ি করছিল, তখন নিজের জন্য মায়া হচ্ছিল। কেঁদেকেটে বুকের কষ্ট উজাড় করে দিতে চেয়েছিল। এখন বুঝতে পারে, ওর চারপাশে বড় বড় পাথর পড়ে আছে। এই পাথর ঠেলে ও আর কোথাও যেতে পারবে না। ওর বেঁচে থাকার দিন শেষ হয়ে গেছে।

৭০ বছর ধরে দেখে আসা বাঙালি মানুষগুলো ওর সামনে ভিন্ন আকার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এদের মধ্যে অনেকে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে। যারা ধান্দাবাজি করছে, তাদের সংখ্যা কম। ওদের জমি থেকে উৎখাত করে চিনিকলের দখলে যাবে জমি। এ সবই তো শুনতে পাচ্ছে ওরা। এমনই তো হুংকার দিচ্ছে। তাহলে ওদের চৌদ্দপুরুষের ভিটা কোথায়? ভিটেমাটি ছাড়া কি মানুষ নিজের দেশের মানুষ হয়? তাহলে কি হামি এ দেশের মানুষ না? ধরিতা চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলে, হামার দ্যাশ কুণ্ঠে? ও হো—হো—হো—হামার দ্যাশ কুণ্ঠে?

দুই হাতে কপাল চাপড়ায় ধরিতা। চিৎকার করতে করতে গলা বসে যায় তার। ধরিতার প্রশ্ন আলোড়িত করে চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা আদিবাসী সাঁওতালদের। সবাই একসঙ্গে চেঁচিয়ে ওঠে, হামাকেরে দ্যাশ কুণ্ঠে? হামার জমিন হামাক দাও।

বাতাসে তোলপাড়।

বাতাস মানুষের কণ্ঠস্বর নিয়ে বইছে। তাই মানুষের ফুসফুসে পৌঁছাচ্ছে না। দম আটকে আসতে চায়। তবু মানুষ ফুঁসছে। গলা ফাটিয়ে চেঁচাচ্ছে—হামার জমিন হামাক দাও।

সবার সঙ্গে চেঁচিয়ে দীনতা দু-চোখ বিস্ফারিত করে ধরিতাকে দেখে। স্থির তাকিয়ে থাকলে ওর শরীরে কাঁপুনি ওঠে। ধরিতার ধূলিমাখা চেহারায় এবড়োখেবড়ো দাগ। কোথাও দাগ গোল, কোথাও টানা। যেন একটা মানচিত্রের মতো লাগছে। স্কুলে পড়ার সময় টিচার ওদের মানচিত্র দেখিয়ে ভূগোল পড়াত। বলত, এখানে বঙ্গোপসাগর, এখানে সুন্দরবন। এদিকে পাহাড়ি এলাকা—কী কী নাম যেন বলত, সেসব নাম দীনতার মনে নেই। টানা রেখাগুলো দেখিয়ে বলত, এগুলো নদী। একেকটি জেলার চারপাশে দাগ টানা ছিল। সেই বয়সে ম্যাপ দেখেই তো ও রংপুর জেলা চিনেছিল। জেনেছিল এটা ওর দেশ। এখানে ওদের চৌদ্দপুরুষ ছিল। আজ তাহলে কাঁদছে কেন সবাই? সিধো-কানহোর কথা কি ভুলে যাচ্ছে সবাই? তির-ধনুকের লড়াই কই? দীনতা চিৎকার করে বলে, মাসি, সিধো-কানহো তো আমাদের চৌদ্দপুরুষ। মাসি—

—তুই কোন মেশিনে সেলাই করবি রে দীনতা? আমার মেশিন গেল। ঘর গেল—ও হো—হো—হো—

পাশ থেকে কেউ একজন বলে, আমাদের সব গেল। আমাদের চৌদ্দপুরুষ গেল।

—চৌদ্দপুরুষ! ধরিতা চিৎকার করে ওঠে। তোরা কেউ সিধো-কানহো হবি না?

—ভিটেমাটি গেলে চৌদ্দপুরুষ থাকে?

ধরিতা মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে বলে, দেশের ধুলায় আমার শরীর বোঝাই। মাটি আমার সিধো-কানহো। দেশ আমার সিধো-কানহো।

দীনতা চিৎকার করে বলতে থাকে, আমরা সবাই সিধো-কানহো। মাসি রে—

ধরিতার কান্না থামে না। মাটিতে গড়াতে গড়াতে নিজেকে মাটিমাখা করে ফেলে। বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে অন্যরা। মাটির-কন্যা ধরিতা ওদের দেশ। মাটির-কন্যা ধরিতা ওদের সিধো-কানহো। তাহলে ধরিতা কাঁদবে কেন? ধরিতা কাঁদবে না—

মাটির সন্তানেরা কাঁদবে না।

তখন সবাই সামনে তাকালে দেখতে পায় পুলিশের গাড়ি আসছে।

কিংসু হেমব্রম চেঁচিয়ে বলে, আমার তির-ধনুক কই?

—ঘরে ছিল। পুড়ে ছাই।

কিংসুর বউ রমলা দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে উত্তর দেয়। মুহূর্তে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ধরিতা বলে, একটা পুড়লে কী হবে, আরও একটা বানাবি তোরা। পারবি না?

—পারব না ক্যান হে? পারব—পারব—

সমবেত কণ্ঠের চিৎকারে ভরে যায় পুড়ে যাওয়া বসতির এলাকা। প্রত্যেকের বুকের ভেতর ধ্বনিত হয় শব্দ। ওরা জানে, না পারলে শেষ হয়ে যাবে ওদের জনগোষ্ঠী। ওরা তো তেমন মানুষ নয়, যারা নিজেদের অস্তিত্বের বিলুপ্তি দেখে হাত গুটিয়ে বসে থাকবে।

ওদের স্লোগানের মধ্যে পুলিশের গাড়ি এসে থামে ওদের সামনে। দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে, চেঁচাচ্ছিস কেন? দমতে জানিস না?

—দমব কেন? আমাদের অপরাধ কী?

রমলা তির্যক ভঙ্গিতে রুখে দাঁড়ায়। কিংসু ওর পাশে দাঁড়িয়ে হাত ধরে।

—আবার মুখে মুখে কথা বলছিস?

—তুমি তো প্রশ্ন করেছ। উত্তর দিব না?

—চোপ। ফের কথা বললে কলজে ফুটো করে দেব।

—দিয়েছ তো, আর কতবার দেবে? দাও—দাও—

—দেখাচ্ছি মজা। তোদের আসামি করে মামলা দেব।

—কেউ কথা বলে না। সবার মধ্যে একটা উপেক্ষার ভাব। তোমাদের যা খুশি তা তো করছই। ঘর পুড়িয়েছ, মামলা করবে, তারপর মানুষ মারবে—বাকি থাকবে কী?

দুপুর গড়িয়েছে এখন।

সকালের দিকে ওরা এসেছিল গুলি করতে করতে। পেছনে ছিল অনেক মানুষ। মানুষের স্রোত ছিল। বন্দুক আর মানুষ মিলে যে শব্দ তৈরি হয়, তাকে তো সাঁওতালদের ছোট জনগোষ্ঠী মোকাবিলা করতে পারে না। ওরা একপাশে সরে গিয়েছিল। তাড়া খাওয়া জন্তুর মতো। আবার ঘুরে এসেছিল। আবার সরে গিয়েছিল। দু-চোখ ভরে দেখেছে লুটপাটের দৃশ্য। এখন আবার আর একটি দৃশ্য ওদের সামনে। মামলা করার জন্য পুলিশ বাদী হয়েছে।

নিশ্চুপ হয়ে আছে সবাই। তোমাদের যা খুশি তা তো করছই। লুটপাট হয়েছে ঘরের জিনিসপত্র-চাউল, আটা, ভুট্টা, গরু, ছাগল, শূকর, হাঁস, মুরগি, কবুতর, লাউ, কুমড়ো, শাকপাতা, হাঁড়িকুড়ি, বাসনকোসন, খুলছ টিনের চাল—আমাদের আর কী-ইবা আছে—এখন কি তোমরা লুট করবে আমাদের মেয়েদের? সমবেত কণ্ঠে ধ্বনিত হয়, না। ছোট্ট একটি শব্দ বিশাল হয়ে আকাশে ছড়ায়। সবাই একসঙ্গে না শব্দ উচ্চারণ করছে। মুষ্টিবদ্ধ দু-হাত ওপরে তুলেছে।

গফুর মিয়া ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে?

—কী আবার হবে? আমাদের শক্তির কথা জানাচ্ছি তোমাকে।

গফুর মিয়া ঠোঁট উল্টায়। ফুঃ! শব্দ করে বলে, তোমাদের আবার শক্তি! ভাগাড়ের লোকেরা—

—খবরদার! চেঁচিয়ে ওঠে কিংসু আর রমলা। ঠিক করে কথা বলবি।

গফুর মিয়া কিছু বলার আগে পুলিশ বন্দুক তাক করে বলে, সরে যাও এখান থেকে।

—আমরা কোথায় থাকব?

—আজ রাতে আকাশের নিচে, কাল দেখব। যাও। সরো।

ওরা দলবেঁধে গির্জার সামনের বড় গাছগুলোর নিচে গিয়ে বসে। একটু পরে তলখা দৌড়াতে দৌড়াতে এসে দীনতাকে একটা দা দিয়ে বলে, এটা রেখে দে দিদি। ছাইয়ের মধ্যে খুঁজে পেয়েছি। আমাদের দরকার হবে। ঘর বানানোর সময় কাজে লাগবে।

—ঠিক বলেছিস। অনেক কাজে লাগবে।

দীনতা চোখের সামনে ধরে দাটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে। বলে, লোহাকে আগুন পুড়িয়ে ছাই করতে পারে না। এখন থেকে এই দা আমার সঙ্গী।

তলখা মৃদু হেসে বলে, দিদি, তুই দা পেয়ে খুব খুশি হয়েছিস দেখছি।

—হ্যাঁ রে, খুব খুশি হয়েছি।

—পন্না দাদাকে বলব যে তোকে আমি একটি দা দিয়েছি।

—কেন? পন্না দাদাকে বলতে হবে কেন?

—তোর কথা বললে পন্না দাদা খুশি হয়। আমাকে দাদা বলেছে, তোকে একটা নতুন দা উপহার দেবে।

—নতুন দা দিয়ে আমি কী করব?

—বলেছে, তুই দা নিয়ে খেতে যাবি দাদার সঙ্গে। দুজনে একসঙ্গে কাজ করবি।

—তাই বলেছে বুঝি?

—হ্যাঁ রে দিদি, হ্যাঁ।

তলখার মুখ হাসিতে উচ্ছ্বল হয়ে ওঠে। দীনতা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবে, শূকরছানা হারানোর পরেও তলখার মুখে হাসি থাকে। পন্নাও পোড়া দা ওর হাতে তুলে দিয়ে ভাবছে একসঙ্গে কাজ করবে।

যে প্রেমের কথা আগে বলেনি, তা এখন বলছে। ছাইয়ের গাদা থেকে কুড়িয়ে আনা দা তার সাক্ষী।

দীনতার বুক ভরে যায়। পন্নাকে ওর নিজেরও ভালো লাগে। দীনতার ভাবনায় নিজের হাসিকে পোড়া ছাইয়ের ওপরে ভেসে ওঠা সূর্যের আলো মনে হয়। ও গুনগুনিয়ে গান গায়। ধরিতা মাসির দিকে তাকায়। ধরিতা ওর গুনগুন শব্দ শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। দূরে বসে আছে বলে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারে না।

পরদিন ওদের জন্য কলাপাতার ঘর ওঠানো হয়। ঝুপড়িঘর। সার বাঁধা ঘরে যে যার পরিবার নিয়ে ঢুকেছে। দীনতা ওর দিদিমাকে জড়িয়ে ধরে বলে, এটা আমাদের জন্য ভিন্ন রকম ঘর। দরজা নাই।

—এই ঘরে আমি তোকে নিয়ে ঘুমোতে পারব না।

—দরজা নেই বলে?

—হ্যাঁ। দিদিমার বয়সী চেহারায় নতুন ভাঁজ পড়ে।

—আমি দা নিয়ে দরজায় বসে থাকব। তুই ভাবিস না। কেউ ঢুকতে পারবে না।

সুনিতা কথা বলে না। কলাপাতার ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে অনেক দূরে তাকিয়ে থাকে। যারা লুট করেছে, তাদের বাইরেও মানুষ আছে। তাদের সংখ্যা অনেক বেশি। তারা ওদেরকে খিচুড়ি-ডিম খাইয়েছে। ওরা ওদের পাশে দাঁড়িয়েছে। সুনিতার মনে হয়, না-খাওয়া পেটে খিচুড়ি-ডিমের ডুগডুগি বাজে। ওরা ওদেরকে ত্রাণ দিয়েছে।

সুনিতা দেখতে পায়, সন্ধ্যা নামছে। ঘরে আলো নেই। হয় বসে থাকতে হবে, নয়তো শুয়ে পড়তে হবে। ও দীনতার গাঁ-ঘেষে দাঁড়ায়।

—কিছু বলবি দিদিমা?

—তুই কী করবি এখন?

—বসে থাকব। সময় গুনব।

—সময় গুনবি? কোন সময়?

—আজ আমার কাছে অন্য রকম সময় এসেছে। আমার জীবনে ভালোবাসার মানুষ এসেছে দিদিমা।

—হ্যাঁ রে, কী বলছিস?

—সত্যি বলছি। প্রেমের বাতাস গায়ে লেগেছে।

ওহ হো—হো—হো—

সুনিতার উচ্ছ্বাসের শব্দ শুনে দীনতার বুক ভরে যায়। ভাবে, পোড়া ঘরের ওপর দিয়ে উড়ে আসছে স্নিগ্ধ বাতাস। প্রতীক্ষিত ভালোবাসার দারুণ সময় ওর চারপাশে।

কলাপাতার ঘরের দরজায় বসে থাকে দীনতা। ভাবে, যদি পন্না আসে তাহলে ওকে বলবে, থাকো আমার পাশে। চৌদ্দপুরুষের সিধো-কানহো একজনকে তো আমার জন্ম দিতে হবে। আর ওকে যদি কেউ লুট করতে আসে, তাহলে পোড়া দা উঁচিয়ে বলবে, কল্লা ফেলে দেব। এক পা-ও আগাবি না।

কত রাত হয়েছে ও জানে না। অন্ধকারকে ওর সঙ্গী মনে হচ্ছে। বাতাসের শোঁ-শোঁ শব্দ ওর কলাপাতার ঘরে এসে ঢোকে। দীনতা পোড়া দাটা কোলের ওপর রেখেছে। একসময় ওটা হাতে নিয়ে বিড়বিড় করে বলে, তুই আমার প্রেম। যত যুদ্ধ আসুক তোকে নিয়ে লড়ব।

অসীম আকাশের নিচে কলাপাতা দিয়ে ঘেরা একটি ঘরের সামনে বসে নিজের আগামী দিন মুঠোয় ধরে বুকভরা নিশ্বাস বাতাসে ছেড়ে দিয়ে কলাপাতায় মাথা ঠেকায় দীনতা।

সেলিনা হোসেন: কথাসাহিত্যিক।