বাংলা ভাষার বিপদ

বর্তমান শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তুরের পাশে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করছেন বাঁ থেকে শহীদ বর​কতের বোন, ভগ্নিপতি ও বৃদ্ধ মা; পেছনে কালো পতাকা, ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৬
বর্তমান শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তুরের পাশে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করছেন বাঁ থেকে শহীদ বর​কতের বোন, ভগ্নিপতি ও বৃদ্ধ মা; পেছনে কালো পতাকা, ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৬

বাংলা ভাষা বিপদগ্রস্ত—এ রকম একটা কথা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে খুব শোনা যাচ্ছে। বাংলার ক্ষেত্রে কথাটা অবশ্য নতুন নয়। পুরোনো উদাহরণ হিসেবে বলা যাক, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও বাংলার বিপদ নিয়ে উদ্বেগে ছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘বাঙালি ভদ্রলোক সন্তানরা পরস্পর কথা বলে ইংরেজিতে, চিঠিপত্র লেখে ইংরেজিতে, এবং হয়তো সেদিন বেশি দূরে নয়, যখন লোকে দুর্গাপূজার আমন্ত্রণপত্রও ইংরেজিতে লিখবে।’ ঔপনিবেশিক ভাষা হিসেবে ইংরেজি সে সমাজে প্রতাপশালী ছিল। দেশীয় অভিজাতরা সে প্রতাপ কার্যত মেনে নিয়েছিলেন। বাংলাদেশে ইংরেজির প্রভাব-প্রতিপত্তি আজকের দিনে বঙ্কিমের সময়ের চেয়ে সম্ভবত কম নয়। এখন ঔপনিবেশিক শাসন না থাকলেও উপনিবেশিত মন আছে। বাইরের টানের চেয়ে মনের টান সাধারণত শক্তিশালী হয়। তবে ভাষাপ্রশ্নে সে যুগের সঙ্গে আমাদের এ-কালের পার্থক্যও আছে। বঙ্কিমচন্দ্ররা বাংলায় বিচার-সালিস করতে পারতেন না, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারতেন না। কিন্তু তাঁরা মনে করতেন, বাংলায় এ কাজগুলো করা যায়, এবং করা দরকার। আজকাল বাংলাদেশের নীতিনির্ধারক মহলগুলো বিপরীত সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। তাঁরা মনে করছেন, বাংলায় এ কাজগুলো কোনোমতে করা হয়তো যায়, কিন্তু করাটা ভালোও নয়, লাভজনকও নয়। এই যে ধারণাটা মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে ওপরের শ্রেণিগুলোতে গভীরভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে, যাচ্ছে, তা-ই আসলে বাংলা ভাষার সবচেয়ে বড় বিপদ।

কিন্তু বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীদের যে বড় অংশটা বাংলা ভাষার সাম্প্রতিক অবস্থা সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করেন, তাঁরা এ কথাটা বলেন না। তাঁরা প্রধানত ভাষা-মিশ্রণের কথা বলেন, ‘উচ্চারণ-বিকৃতি’র কথা বলেন এবং বিশেষভাবে বলেন, ‘প্রমিত-বিচ্যুতি’র কথা। তাঁরা এসব ‘দুরবস্থা’কেই বাংলা ভাষার বিপদ বলে সাব্যস্ত করেছেন। ফরাসি ভাষার অধ্যাপক ও ভাষাতাত্ত্বিক শিশির ভট্টাচার্য্য সম্প্রতি বাংলা ভাষা: প্রকৃত সমস্যা ও পেশাদারি সমাধান বইয়ে ব্যাপারটার পর্যালোচনা করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, ভাষা-মিশ্রণ এবং ভাষার বিবর্তন যেকোনো ভাষার খুব স্বাভাবিক নিয়তি। যদি বিশেষ শ্রেণি-পেশার স্বেচ্ছাকৃত-আরোপিত বিকৃতি সমস্যার কারণ হয়ও, তা খুবই গৌণ, মুখ্য নয়। প্রশ্ন হলো, এ ধরনের একটা গৌণ ব্যাপারকে বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সমাজ বড় বিপদ হিসেবে দেখছে কেন? কোনো চটজলদি জবাব সম্ভব নয়। তবে কিছু ঐতিহাসিক-সাংস্কৃতিক-মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করা যেতে পারে।

মানুষ সাধারণত ভাষার বিবর্তন বরদাশত করতে চায় না। বিবর্তনকে সে বিকৃতি হিসেবে বিবেচনা করে। ভাষার নিয়তি এই যে, তা বদলে যাবেই। কিন্তু ভাষার বদল হয় খুবই ধীরগতিতে। তা অনুসরণ করা কার্যত অসম্ভব। কয়েক দশক পর হয়তো পরিবর্তনটা দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়ে ধরা দেয় নতুন প্রজন্মের লেখার ভাষায়, মুখের কথায়। পুরোনো প্রমিত রূপে অভ্যস্তদের পক্ষে তা মেনে নেওয়া কঠিন হয়। ব্যাপারটা আরেক দিক থেকেও দেখা যেতে পারে। একটা বিশেষ সময়ের প্রমিত রূপে অভ্যস্ত মানুষেরা সাধারণত ওই রূপটিকে ‘খাঁটি’ রূপ ভাবতে থাকে। ওই ভাষা-রূপে যখন অন্য ভাষার শব্দ ঢুকে পড়ে, তখন তার মনে হয় ভাষার কৌমার্য নষ্ট হচ্ছে। আসলে সে যে-ভাষারূপটিকে ‘খাঁটি’ ভাবছিল, ওই রূপটিও একটি মিশ্ররূপ। ‘খাঁটি’ ভাষা বলে কিছু হতেই পারে না, যেমন হতে পারে না খাঁটি জাতি বা সংস্কৃতি। ফলে ভাষা-মিশ্রণের ব্যাপারে লোকের উদ্বেগ পুরোপুরি না হলেও অনেকটাই কুসংস্কার। দুনিয়ার সব ভাষা সম্পর্কেই কথাগুলো সত্য। বাংলার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত দুটি আলাপ তুলে রাখা জরুরি।

বাংলা ভাষার ‘বিশুদ্ধতা’ আর ‘পবিত্রতা’র ধারণায় একটা বাড়াবাড়ি আছে। এটা এসেছে একটা পুরোনো চর্চার ইতিহাস থেকে। বাংলাকে উপনিবেশ আমলের শুরুর দিকে উনিশ শতকের গোড়ায় সংস্কৃতের আদলে ঢেলে সাজানো হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্যাপারটা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি ওই প্রক্রিয়াকে বাংলা ভাষার ‘আদিপাপ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ অবশ্য সংস্কৃতায়িত ‘শুদ্ধ’ বাংলাতেই তাঁর বেশির ভাগ লেখালেখি করেছেন। কিন্তু তিনি চাইতেন, এ অবস্থার পরিবর্তন হোক। কেননা, পরিবর্তনটাই স্বাভাবিক এবং ভাষাতত্ত্বসম্মত। কিন্তু তা হয়নি। বাংলা অভিধান আর ব্যাকরণ সংস্কৃতবাদী শুদ্ধতার জীবাণু বহন করেই আজ পর্যন্ত চর্চিত হচ্ছে। এই চর্চাকে গোঁজামিল দিয়ে বজায় রাখার স্বার্থেই বাংলা ব্যাকরণে আমদানি করা হয়েছে ‘বিদেশি শব্দ’ বলে এক হাস্যকর বর্গ। ‘বিদেশি শব্দ’ বর্গটা অর্থহীন; কারণ, কোনো ভাষায় আসলে কোনো বিদেশি শব্দ থাকতেই পারে না। কয়েক শ বছর ধরেই ভাষাবিজ্ঞানীরা জানেন, অন্য ভাষার শব্দ ধ্বনিতাত্ত্বিক-রূপতাত্ত্বিক গভীর পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই কেবল ঋণী ভাষায় গৃহীত হতে পারে। গৃহীত হওয়ার পর সে শব্দ আর বিদেশি থাকে না, ঋণী ভাষার শব্দ হয়ে যায়। বহু বছর আগে ১৮৭৭ সালে শ্যামাচরণ গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর অসামান্য প্রবন্ধ বেঙ্গলি স্পোকেন অ্যান্ড রিটেন-এ এই সমস্যার ভাষাবিজ্ঞানসম্মত সমাধান দিয়েছেন। তাঁর মতে, কোনো শব্দ বাংলা ভাষার শব্দ কি না, তা বোঝার একমাত্র উপায় জনগোষ্ঠীর কোনো অংশ স্বাভাবিক মুখের কথায় সে শব্দটা ব্যবহার করে কি না, তা খতিয়ে দেখা। মুখের ভাষায়, লেখার ভাষায় নয়। আমাদের ভাষাচর্চাকারীদের মনোভাব ঠিক উল্টো। এখানে সব লোক মুখের ভাষায় ব্যবহার করে এমন বহু শব্দকে ‘বিদেশি’ অভিধায় কলঙ্কিত করা হয়। আর লেখার ভাষায় ব্যক্তিবিশেষের ব্যবহার করা সংস্কৃত শব্দকে ভাবা হয় ‘খাঁটি’ বাংলা ভাষা। দেবেশ রায় পশ্চিম বাংলার চালু দুটি অভিধান নিয়ে পর্যালোচনা করে দেখিয়েছেন, এ মনোভঙ্গির খুব সামান্যই বদল ঘটেছে। যেমন তিনি লক্ষ করেছেন, দুটি অভিধানের কোনোটিতেই ‘ডিকশনারি’ শব্দটি নেই।

এই প্রেক্ষাপট মনে রাখলে বাংলায় চালু আরবি-ফারসি শব্দের—যেগুলোকে নিতান্তই সাম্প্রদায়িক কারণে ভাষার স্বভাবের তোয়াক্কা না করেই ‘মুসলমানি শব্দ’ নাম দিয়ে আলাদা করা হয়েছিল—ব্যবহারে বহু মানুষের অনীহা ও প্রতিক্রিয়ার কারণ বোঝা যায়। বাংলায় ব্যাপক হারে ইংরেজি শব্দ ঢুকে পড়ায় যাঁরা উদ্বিগ্ন, তাঁদের উদ্বেগের একটা কারণ এই পুরোনো ইতিহাস আর শুদ্ধতার কুসংস্কার। তবে এর অন্য দিকও আছে। পারস্পরিক মেলামেশা আর দৈনন্দিন ব্যবহারের মধ্য দিয়ে এক ভাষার শব্দ আরেক ভাষায় ঢুকে পড়া, আর জাতে ওঠার জন্য খিঁচুড়ি ভাষা ব্যবহার—এই দুইয়ের মধ্যে ফারাক আছে। এই দুইকে এক করে দেখলে চলবে না। ‘কম্পিউটার’ বা ‘টাইপ’ বাঙালি ব্যবহার করে দরকারে। ফলে এ দুটো বাংলা শব্দ। কিন্তু ‘লিসেনার’ বা ‘ভিয়্যুয়ার’ বাংলা নয়। এর সঙ্গে দেমাকের একটা সম্পর্ক আছে। মনে রাখা দরকার, শুদ্ধতা-অশুদ্ধতা দিয়ে এই বিচার চলবে না। এই রোগ এসেছে তথাকথিত ইংরেজি মিডিয়ামের আধিপত্য থেকে। ইংরেজির আধিপত্য থেকে। যে ছেলেমেয়েরা ইংরেজিই পড়ে, অন্য কিছু নয় বা যারা ছোটবেলা থেকে শুনে আসছে, ইংরেজি না শিখলে কোনো পড়াশোনাই কাজে লাগে না, তাদের এ রকম মিশ্রভাষী না হওয়াটাই বরং বিস্ময়কর। এ বাবদ কম বয়সী ছেলেমেয়েদের অভিযুক্ত করা খুব কাজের কথা নয়। তারা অবস্থার নির্মাতা নয়, ফল মাত্র।

এ পর্যন্ত এসে সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে, ভাষা-মিশ্রণ বা ‘প্রমিত’ রূপকে মান্য না করা বাংলা ভাষার বড়জোর গৌণ বিপদ। মূল ব্যাপার হলো, বাংলার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত না হওয়া। কলকাতা আর ঢাকায় মোট দুইবার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের কেন্দ্র হিসেবে বাংলার আপেক্ষিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তা নামতে নামতে আজ প্রায় শূন্যের কোঠায় এসে ঠেকেছে। ফেব্রুয়ারি মাসের মৌসুমি প্রচারণা দেখে বিভ্রান্ত না হলেই কেবল এ কথার তাৎপর্য বোঝা যাবে। ভাষার মর্যাদাজ্ঞাপক ব্যবহার হয় অফিসে-প্রশাসনে, আদালতে আর শিক্ষায়। এর মধ্যে সরকারি অফিসেই কেবল বাংলা ভাষার চলনসই গোছের ব্যবহার আছে। অন্যত্র—বেসরকারি অভিজাত অফিসগুলোতে, উচ্চ আদালতে আর শিক্ষায়—বাংলার অবস্থান ও অবস্থা বেশ শোচনীয়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশের শাসকশ্রেণি ব্যাপারটা মেনে নিয়েছে। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ, রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গটি সম্পূর্ণরূপে মুলতবি রেখে আমরা গ্রহণ করেছি মাতৃভাষা বর্গটি।

 ২১ ফেব্রুয়ারির একটা আস্ত রাষ্ট্রভাষা দিবস কোন মন্ত্রবলে মাতৃভাষা দিবসে পরিণত হলো, তার তত্ত্বতালাশ করলে বাংলাদেশের বাংলা ভাষা-সমস্যার কিছু ইশারা মিলবে। মাতৃভাষার অধিকার কথাটা কেবল তখনই তাৎপর্যপূর্ণ হতে পারে, যখন এর সাথে শিক্ষাসহ জীবনযাপনের আর দশ ব্যবহার যুক্ত হয়। এমনিতে শুধু মুখের ভাষা হিসেবে মাতৃভাষা ব্যবহারের বিরুদ্ধে সাধারণত কোনো ডিক্রি জারি হয় না। তৎকালীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের সঙ্গেও পূর্ব বাংলার জনগণের মাতৃভাষাজনিত কোনো সংকট ছিল না। দাবিটি ছিল রাষ্ট্রভাষার। এ দাবি ক্ষমতাসম্পর্কের মামলা। এ দাবি প্রয়োজনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। অন্যদিকে মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা বিশুদ্ধ আবেগের ব্যাপার। রাষ্ট্রভাষার বিপরীতে মাতৃভাষা হিসেবে বাংলাকে চিহ্নিত করা সেদিক থেকে উপযোগের বিপরীতে আবেগকে স্থাপন করারই নামান্তর। এ লড়াইয়ে আবেগের জয়ী হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই থাকে না। জয়ী হয়ওনি।

ক্ষমতাবান ইংরেজির উপযোগিতার বিপরীতে বাংলা ভাষাকে আবেগের সামগ্রী হিসেবে দেখার রেওয়াজ তৈরি হয়েছিল ইংরেজ আমলে। বাঙালি তখন রাষ্ট্র চালানোর ভাগীদার ছিল না। ফলে শিল্পসাহিত্যই ছিল ভরসা। হাতে গোনা দু-চারজন ব্যতিক্রম ছাড়া আমাদের গুরুত্বপূর্ণ চিন্তকদের অধিকাংশই সাহিত্যচর্চাকে বাংলা ভাষার প্রধান ব্যবহারক্ষেত্র মনে করতেন। বুদ্ধদেব বসুর আত্মজীবনী থেকে একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। তিনি লিখেছেন, তাঁদের পরিবারে পারিবারিক চিঠি থেকে রোজনামচা পর্যন্ত সবই চলেছে ইংরেজিতে। তখন বইয়ের ও স্কুল-কলেজের ভাষা ইংরেজি হলেও ‘জীবনের ভাষা’ ছিল বাংলা। প্রশ্ন তোলা সংগত হবে যে, পারিবারিক চিঠিপত্র, রোজনামচা, বই আর স্কুল-কলেজের ভাষা ইংরেজি হলে বাংলাকে কি আর ‘জীবনের ভাষা’ বলা যায়? হ্যাঁ, এক অর্থেই কেবল বলা যায়। যদি জীবন বলতে নিছক কথোপকথন আর সাহিত্যচর্চা বোঝানো হয়। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক বাংলা ভাষাচর্চার বৈশিষ্ট্যও অনেকটা একইরকম। ব্যবহারিক জগৎ থেকে, বিশেষত আভিজাত্যের এলাকা থেকে, দ্রুত অপসৃত হয়ে বাংলা ঠাঁই নিচ্ছে আমাদের অন্তরে-আবেগের এলাকায়। এভাবেও ভাষা বেঁচে থাকে। তবে তার ধার ক্ষয়ে যায়। সামর্থ্যের দিক থেকে ভাষা ক্রমশ কমজোর হয়ে ওঠে। দেবেশ রায় লক্ষ করেছেন, ‘আমাদের সংস্কৃতির ইতিহাসে গত প্রায় দুশো বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদের একটি হল এই বাংলা গদ্য।...[কিন্তু] কর্মের বৈচিত্র্যে ব্যবহৃত হলে ভাষায় যে বৈচিত্র্যের ধারা আসে, যাঁরা সে ভাষায় কথা বলেন, তাঁদের সকলের আত্মসম্মানের সঙ্গে জড়িত হলে ভাষার যে নিশ্চয়তাবোধ আসে, সকলের পক্ষে বিকল্পহীন হলে ভাষার যে বহুলতা আসে—বাংলা গদ্যভাষা তার সব-কিছু থেকেই বঞ্চিত।’ বাংলাদেশে বাংলা ভাষার উল্টোযাত্রা এই বঞ্চনাকে গভীরতর করছে, বিকাশের সম্ভাবনাগুলোকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে।

ভাষার বিপদ তো আসলে মানুষেরই বিপদ। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বঞ্চনা। দ্বিতীয় ভাষা রপ্ত করে কাজ চালানোর জন্য শ্রম দিতে হয়। বিপুল ব্যয় করতে হয়। যে শ্রেণির পক্ষে তা করা সম্ভব, তা তারা করছে। করার চেষ্টা করছে। কিন্তু বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের পক্ষে তো এ পরিমাণ সময় ও শ্রম বিনিয়োগ করা সম্ভব নয়। ফলে বাংলাদেশের ভাষানীতি বিদ্যমান শ্রেণিগত অসাম্যকে শুধু জায়মানই রাখছে না, তাকে রীতিমতো জোরালো করছে। এটা গণতন্ত্রবিরোধী এবং রাষ্ট্রের সুষম উন্নয়নের অন্তরায়। বাংলাদেশে বাংলা ভাষা প্রচলনের পক্ষে যাঁরা সাফাই গান এবং তৎপরতা চালান, তাঁরা রাষ্ট্র, গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও সামগ্রিক জীবনাচারের দিক থেকে ভাষাকে দেখেন না। সামগ্রিক সামাজিক ভাষা ও চৈতন্য থেকে এ ব্যাপারগুলো অপসৃত হয়ে কেবল জাতীয়তাবাদী আবেগের আংশিক অবলম্বন হয়ে বাংলা ভাষার পক্ষের প্রচারণাটা টিকে আছে। ফলে শুরু করার বিন্দুটাও আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অন্য বিপদের চেয়ে এ বিপদটাই ক্রমে বড় হয়ে উঠছে।

মোহাম্মদ আজম: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।