কবিতা মানুষকে শান্ত করে

আল মাহমুদ ও টোকন ঠাকুর। ছবি: হাসান রাজা
আল মাহমুদ ও টোকন ঠাকুর। ছবি: হাসান রাজা
>


‘সোনালী কাবিন’-এর কবি আল মাহমুদ (৮২) আর নেই। শুক্রবার রাত ১১টার দিকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁর স্মরণে ২০১৭ সালে বাংলা নববর্ষ সংখ্যায় প্রকাশিত সাক্ষাৎকারটি পাঠকদের জন্য আবার প্রকাশ করা হলো।

আলতাফ শাহনেওয়াজ: বাংলা কবিতায় আল মাহমুদদেরপ্রজন্ম যখন শুরু করেছেন, তখন আমরা ছিলাম পরাধীন পাকিস্তানের বাসিন্দা। সেই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে বাংলা কবিতায় তাঁরা তৈরি করেছেন স্বতন্ত্র স্বর, বাংলাদেশের কবিতার ভূমণ্ডলের ভিত্তিও তাঁদের হাতে প্রস্তুতকৃত। অন্যদিকে টোকন ঠাকুর ও তাঁর প্রজন্মের কবিদের কবিতাচর্চার সূচনা স্বাধীন বাংলাদেশে। তাঁরা যখন লেখালেখি শুরু করেছেন, সেই সময় তাঁদের সামনে রয়েছে একটি তৈরি জমি। আল মাহমুদ, শামসুর রাহমান প্রমুখ কবি তখন তাঁদের সামনে ‘আদর্শ’। ফলে এই দুই প্রজন্মের কবির কবিতাযাপনের অভিজ্ঞতা ও বাস্তবতা ভিন্ন রকম। এই আড্ডায় দুই কবির কাছ থেকে আমরা শুনব তাঁদের অভিজ্ঞতার কথা। আল মাহমুদকে দিয়ে শুরু করি।

আল মাহমুদ: প্রথম কথা হচ্ছে কবিতা লেখা সহজ কাজ নয়। একজন কবি লেখেন, এ কারণে তাঁকে পরিশ্রম করতে হয়। আমার ক্ষেত্রে কী ঘটেছে বা ঘটে? আমি আগে দেখি, তারপর লিখি। সহিত্যে যাকে বলে কল্পনা, একজন কবি তাকে বহু বিস্তারিত করতে চান। ওই যে প্রথমেই বলেছি, আমি দেখি এবং লিখি। এই দেখা আর লেখার যে সংমিশ্রণ, সেটা অতুলনীয় এক ব্যাপার। এখানে বলে রাখি, বেশ আগে থেকেই চোখে ভালো দেখতে পাই না আমি। এখন এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে স্মৃতিহীনতা—অনেক কিছুই আজকাল মনে করতে পারি না। ফলে খুব গুছিয়ে কথা বলা এ সময়ে আমার জন্য বেশ কষ্টকর। কিন্তু নিজের কবিতাযাপনের কথা বলতে গিয়ে বলব যে, আমি খুব ধীরেসুস্থে, চিন্তাভাবনা করে লেখা শুরু করি। লেখাটা যখন শেষ হয়, আমার মনে তখন পুলক—একটা আনন্দ জাগে। এই হলো লেখার ব্যাপারে আমার অভিজ্ঞতা।

শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদ। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম
শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদ। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম

টোকন ঠাকুর: স্বাধীন বাংলাদেশের বয়স যখন বিশ বছর হয়ে গেছে, সেই সময় আমাদের তারুণ্যের সূচনাকাল। অর্থাৎ গত শতকের আশির দশকে যখন আমরা পড়াশোনা করছি—স্কুল পাড়ি দিয়ে কলেজের দিকে যাচ্ছি; সে সময় আমার ভেতরে প্রবলভাবে জেগেছে বই পড়ার নেশা। সে সময় থাকি মফস্বলে—ঝিনাইদহ শহরে। তখনই শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরীদের পড়ছি। পড়ছি আল মাহমুদের লোক লোকান্তর, সোনালি কাবিন বা যেভাবে বেড়ে উঠি। এসব বই পাবলিক লাইব্রেরি থেকে চুরি করে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে পড়তাম। আমাদের প্রজন্মের তৈরি হওয়ার ক্ষেত্রে এই পাঠ কাজে লেগেছে।

তো, আল মাহমুদকে প্রথম দেখি ১৯৮৭ সালে এক অনুষ্ঠানে। ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার মনোহরপুর গ্রামে কবি গোলাম মোস্তফা হাইস্কুল মাঠে, সম্ভবত গোলাম মোস্তফার জন্মবার্ষিকী বা মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠান ছিল। আমি তখন মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। পরের দিন আমার পরীক্ষা। বাড়ির কাউকে কিছু না বলে বাইসাইকেল নিয়ে গেলাম মনোহরপুর। দেখলাম কবি তালিম হোসেন, আল মাহমুদ ও শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার—তাঁরা সবাই বসে আছেন। এর কয়েক দিন পরই ইত্তেফাক-এ আল মাহমুদের একটা কবিতা ছাপা হলো, যেখানে শৈলকুপা, কুমার নদ—এসব প্রসঙ্গ ছিল। আদতে মাহমুদ ভাইয়ের কাছ থেকে আমাদের অনেক কিছু নেওয়ার আছে। স্বাধীন বাংলাদেশ এবং পরিবর্তিত নানা বাস্তবতার মধ্য দিয়ে দেশ আজ যেখানে এসে পৌঁছেছে, সেখান থেকে বলা যায়, মাহমুদ ভাই এখন সবকিছু অভিভাবকের মতো দেখতে পাচ্ছেন। আমি মনে করি, আমি একজন পাঠক; আপামর বাংলা কবিতার পাঠক। সেই হিসেবে মাহমুদ ভাইয়ের কবিতারও একজন ভক্ত আমি। শেখার জন্য তাই বারবার মাহমুদ ভাইয়ের কবিতার দ্বারস্থ হই।

আলতাফ: দুই ভিন্ন সময়ের কবি আপনারা। কিন্তু আপনাদের দুজনের মধ্যে একটি মিল আছে—দুজনই এসেছেন মফস্বল থেকে—আল মাহমুদ ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও টোকন ঠাকুর ঝিনাইদহ। কেবল কবিতাকে সম্বল করে মফস্বল থেকে রাজধানী ঢাকায় থিতু হওয়া—বিষয়টি সহজসাধ্য ছিল না নিশ্চয়।

মাহমুদ: কবিতা লেখা একটা শক্ত কাজ। প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়। ছন্দ-মিল জানতে হয়। আমি শুরু থেকে ছন্দের ব্যাপারে সচেতন ছিলাম। তো, ছন্দ যখন আয়ত্ত হলো, লোকে তখন আমাকে কবি বলতে শুরু করল। ছন্দ-মিল সম্পর্কে সচেতন ছিলাম বলেই অল্প বয়সে ‘কবি’ খেতাব পেয়ে যাই।এ জন্য আমাকে অনেক কসরত করতে হয়েছে। আমি লিখি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে। তবে প্রচুর পড়াশোনা করতাম। আর মফস্বল থেকে ঢাকায় স্থায়ী হওয়া নিয়ে যে কথাটি বললে, হ্যাঁ, কঠিন লড়াই করতে হয়েছে। সবকিছু আজ আর ঠিকঠাক মনেও নেই। তবে আমার আত্মস্মৃতিতে গুছিয়ে লিখেছি সব। সারা জীবনই আমার কেটেছে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে, লড়াই করতে হয়েছে বাঁচার জন্য। এখনো লড়াই করেই বেঁচে আছি। লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে একটা অভিজ্ঞতা অর্জন করে মানুষ, তা হলো—আমি অনেক দূর পর্যন্ত যাব। আমি নিশ্চিতই সেটা পেরেছি।

টোকন: মাহমুদ ভাই, এমন কি হয়নি, আপনাদের অনেক বন্ধু কিংবা আপনার প্রজন্মের কেউ কেউ হয়তো এই সংগ্রাম করতে গিয়ে টিকতে না পেরে পরাজিত হয়েছে?

মাহমুদ: পরাজিত হয়ে যাওয়ার ব্যাপার সাধারণত কবিদের ক্ষেত্রে ঘটে না। প্রকৃত কবি যাঁরা, তাঁরা লক্ষ্য স্থির রেখে চলতে থাকেন এবং একসময় সফল হন। এটা কবির অজান্তেই হয়ে যায়।

আলতাফ: এ ব্যাপারে টোকন ঠাকুর কী বলবেন?

টোকন: আমি মনে করি, কবিতা এমন একটা জিনিস যা লিখে টাকা আসে না। তরুণ কবি, সে যেখান থেকেই আসুক তাকে প্রচুর কষ্ট করতে হয়। আমি পঁচিশ বছর ধরে সেই কষ্ট করেই ঢাকায় অবস্থান করছি। যে তরুণ বা অনতি তরুণ এখন কবিতা লিখতে আসছেন, তাঁকেও এই কষ্টকর অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে আসতে হচ্ছে। বাস্তবতা একই। এ ছাড়া আরও নানা সংগ্রাম আছে। যেমন পরিবারের সমর্থন না পাওয়া। যাঁরা কবিতা লিখতে আসেন, এখনো পরিবার তাঁদের সাপোর্ট করে না বললেই চলে।

মাহমুদ: ভালো বলেছ। সাপোর্ট অবশ্যই দরকার। সমস্যা হলো, সব সময় তা পাওয়া যায় না। তবে কবি নিজের আত্মবিশ্বাস দিয়ে সে পরিস্থিতি উতরে যান।

আলতাফ: মাহমুদ ভাই, গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে, যখন আপনি লিখতে শুরু করেছেন, ঠিক সেই সময় থেকেই আপনার কবিতায় বেজেছে বঙ্গীয় সুর। আবহমান বাংলার লোকজীবনের নানা অনুষঙ্গ ও পুরাণ সফলভাবে এসেছে আপনার কবিতায়। এটি কি সচেতন প্রয়াস?

মাহমুদ: আমি কবি হব—এটা আমার রক্তের মধ্যে ছিল। ফলে সব সময় কবিতার কথাই চিন্তা করেছি। সারাক্ষণ কবিতার ছন্দ, অন্ত্যমিল, ভঙ্গি ইত্যাদি নিয়ে ভেবেছি। এভাবেই স্বতন্ত্র পঙ্‌ক্তি চলে এসছে।

আলতাফ: আল মাহমুদসহ তাঁর প্রজন্মের কবিরা বাংলা কবিতায় যে ভূমি ও পথ তৈরি করলেন, পরবর্তী সময়ে সেই পথ ধরে হেঁটেছেন আপনারা। তবে নিজস্ব পৃথিবীতে সৃষ্টিও করতে চেয়েছেন নতুন ভাষাভঙ্গি—প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের এই পরম্পরা নিয়ে কী বলবেন টোকন ঠাকুর?

টোকন: পরম্পরা স্বীকার করেই বলি, একজন তরুণ কবি তাঁর পূর্বজ কবির ভূমির ওপর দাঁড়িয়ে হাঁটতে শেখেন না। তাঁকে নানা সংগ্রামের ভেতর দিয়ে প্রতিদিন তিল তিল পরিশ্রম করেই নিজের দাঁড়ানোর ও হাঁটার জমিন তৈরি করে নিতে হয়। আমাদের দেশের পরিবারগুলো তাদের ছেলেমেয়েদের কবিতা লেখায় উৎসাহ দেয় না। কারণ, তারা জানে যে কবিতা লিখে ভাত খাওয়া যায় না। একজন তরুণ কবিও এসব জেনে-বুঝেই কবিতা লিখতে আসেন। ফলে তাঁর পায়ের নিচের মাটি আসলে তাঁকেই তৈরি করতে হয়। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পর যে কবি কবিতা লিখতে আসবেন, তাঁকেও এই লড়াই-সংগ্রাম করেই নিজের পায়ের নিচের মাটি তৈরি করতে হবে।

আলতাফ: প্রশ্নটি দুই কবির কাছেই: কবি ও কবিতা সংস্কৃতির ওপর কতটা প্রভাব ফেলতে পারে?

মাহমুদ: কবিতা মানেই হচ্ছে তা সংস্কৃতির ওপর প্রভাব ফেলবে। যাঁরা কবিতা লেখেন, একটি বিষয়ে তাঁরা সচেতন, সেটা হলো—মিলটা কোথায়। নানা বিষয়ে মিল খোঁজেন তাঁরা। এই মিলের প্রভাব সংস্কৃতির ওপর পড়বেই।

টোকন: কবিতা ব্যাপারটাই তো সংস্কৃতির সঙ্গে প্রবাহিত। কবিতা নেই কোথায়? একজন লোক যখন ঘর গোছায়, সুন্দর করে চিন্তা করে সেখানেও কবিতা আছে। কেউ যখন একটা সিনেমা দেখে সেখানেও কবিতা থাকে। ইরানি চলচ্চিত্রকার আব্বাস কিয়ারোস্তামির সিনেমায় তো কবিতা থইথই করে। সংস্কৃতির সবখানেই আছে কবিতা। যে মানুষ কবিতাকে প্রাধান্য দেয় না, তার জীবনেও কবিতা আছে।

এখন আমি মাহমুদ ভাইকে একটি প্রশ্ন করতে চাই: ষাট বছর ধরে বাঙালি পাঠক পড়ছে আপনার কবিতা। তো, কোনো পাঠক যখন আপনার কবিতা পড়ে, সেই মুহূর্ত আর আপনার কবিতা রচনার মুহূর্ত কি এক রকম? মানে বলতে চাইছি, পাঠের সময় পাঠক কি পৌঁছে যায় কবির ওই কবিতা লেখার মুহূর্তে?

মাহমুদ: পাঠক কবিতার ভেতরটা দেখতে পায় বলে মনে হয় আমার। অবশ্য এ জন্য কবিকে ভাষাটা উত্তমরূপে জানতে হয়। ভাষা না জানলে পাঠকের সামনে কবিতার ভেতরটা উন্মোচিত হবে কী করে? হবে না তো।

আলতাফ: কী এমন আছে কবিতার মধ্যে যে কারণে বারবার কবিতার কাছে ফেরে মানুষ?

মাহমুদ: শিক্ষণীয় বলে মানুষ কবিতার কাছে ফেরে, বারবার ফেরে। কবিতা ছন্দ দেয়, গন্ধ দেয়। সত্যি বলতে কী, কবিতা মানুষকে চলতে শেখায়। সব সময় কিছু না কিছু শিক্ষা দেয় কবিতা।

টোকন: আরেকটু যোগ করি। বলার বাইরেও মানুষের অনেক কথা থাকে। হয়তো দেখা যায়, যে কথা একজন বলতে চেয়েছিল কিন্তু কোনো কারণে বলতে পারেনি—সেই কথাই কোনো এক কবি বলেছেন তাঁর কবিতায়। এসব কারণেই বোধ হয় মানুষ কবিতার কাছে যায়। মানুষ সমুদ্রের কাছে যায়, পাহাড়ে যায়, জঙ্গলেও যায়। সরাসরি কি কিছু পায়? একইভাবে কবিতার কাছেও মানুষ যায় পরোক্ষভাবে কিছু পাওয়ার লোভে; ওই পাওয়াকেই মাহমুদ ভাই বলছেন ‘শিক্ষা’।

আলতাফ: আমাদের সমাজ এখন প্রবলভাবে অস্থির ও অসহিষ্ণু। হত্যা, খুন, হানাহানি—একধরনের উগ্র বাস্তবতা নিত্যদিনের বিষয়। এ রকম সমাজে একজন কবি কী করতে পারেন?

মাহমুদ: কী করতে পারেন সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা হচ্ছে, কবি কিছু করতে চান। সমাজ তিনি বদলাতে চান, সামগ্রিক পরিস্থিতি বদলাতে চান। অনেকে বলেন, কবিতা না হলেও সমাজ চলে। কথা হয়তো ঠিক। তবে কী জানো, কবিতা না হলে জীবনের যে একটা ছন্দ আছে সেটা অগ্রসর হয় না।

টোকন: কিছুদিন আগে কবি বিনয় মজুমদারকে নিয়ে একটা তথ্যচিত্র দেখছিলাম। সেখানে শেষের দিকে বিনয়কে এ রকম প্রশ্ন করা হয়েছিল। উত্তরে বিনয় বলেছিলেন, এ রকম হানাহানির মধ্যে দাঁড়িয়ে একজন কবি বিস্মিত হওয়া ছাড়া আর কিই-বা করতে পারে! আমার মনে হয়, কবিতা মানুষের কাছে গিয়ে এই বোধের জন্ম দেয় যে, এই হচ্ছে জীবন কিংবা এটা জীবন নয়। হয়তো অন্য আরেক কবি এসে আবার সেই বোধটা ভেঙে দেন। কবিরা মূলত মানুষের এই বোধের পরিবর্তনের কাজই করেন।

মাহমুদ: যেকোনো অস্থির সময়ে কবিতা মানুষকে শান্ত-স্নিগ্ধ হওয়ার আহ্বান জানায়, কবিতা মানুষকে কখনো উগ্র করে না।

টোকন: মাহমুদ ভাইয়ের সঙ্গে আমি একমত। কবিতা সংহতি দেয়, মনের স্থিতি দেয়। কোনো একটি ভালো কবিতা যদি কেউ মনোযোগ দিয়ে পড়ে, তবে কবিতা তাকে উগ্রতা থেকে মুক্তি দেয়—এ বিশ্বাস আমি করি।