মাটির গানের মায়ায়

রাহুল আনন্দ ও মমতাজ। ছবি: কবির হোসেন
রাহুল আনন্দ ও মমতাজ। ছবি: কবির হোসেন

কবির বকুল: মমতাজ ও রাহুল আনন্দ, দুই প্রজন্মের শিল্পী আপনারা। আপনাদের ভেতর যেমন মিল আছে, তেমনি আছে বৈপরীত্যও। মমতাজ উঠে এসেছেন গ্রাম থেকে। গান করতে করতে জায়গা করে নিয়েছেন শহুরে মধ্যবিত্তের মনে। অন্যদিকে শহরে বড় হওয়া রাহুল শহুরে মধ্যবিত্তের জন্য গাইলেও গান খুঁজতে হাত বাড়িয়েছেন গ্রামে। খুঁজছেন লোকায়ত মাটির সুর। অবস্থানগত দিক থেকে আলাদা হলেও আপনাদের দুই শিল্পীর একজন শিকড় থেকে উঠে আসা, আরেকজন রয়েছেন শিকড়ের সন্ধানে। ছোট করে আপনাদের দুজনের শুরুটা জানতে চাই।

মমতাজ: আমার শিকড় হচ্ছে বাউল। বাবা মধু বয়াতি ছিলেন বাউলশিল্পী। বাবা বৈঠকি, মুর্শিদি গান গাইতেন। সেই গান শুনে ঝরঝর করে চোখের পানি পড়ত। দয়াল কে, মুর্শিদ কে, সৃষ্টিকর্তা কে, দীনবন্ধু কে—এসব তাঁর কাছ থেকে শেখা। প্রথমে আমি পালাগান গাইতাম। যুক্তিতর্ক দিয়ে সারা রাত হয় পালাগান। এ গান শুধু শিখলেই হয় না, গুরু ধরে তাঁর কাছ থেকে এর ভাব বিষয়গুলো জানতে-শিখতে হবে। তাই এই বলার ধরন শেখার জন্য ওস্তাদ মাতাল রাজ্জাক দেওয়ানের পেছনে আমি দু-তিন বছর শুধু ঘুরেছি। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গিয়ে তাঁর গান শুনেছি; কীভাবে কোন গানের কী ব্যাখ্যা তিনি দেন, জেনেছি সেসব।

গ্রামেগঞ্জে গিয়ে তখন আমি শুধু পালাগান গাই। তখনকার সময়ে—গান গাইলাম, মানুষ নাচল, আনন্দ করে চলে গেল—বিষয়টা এমন ছিল না। এই গান শুনে মানুষের জ্ঞান হবে, মানুষ জানবে—এটাই পালাগানের মর্ম। একসময় মনে হলো, গান তো ভালোই গাই। সুর ভালো, কথাও ভালো। কিন্তু এ দিয়ে তো হবে না। এর প্রচার দরকার। তো, অডিও অ্যালবামের লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। বললাম, টাকাপয়সার ব্যাপার না, আমার একটা অ্যালবাম করুন। পার হতে হলো অনেক চড়াই-উতরাই। এভাবে দু-তিন শত অ্যালবাম করার পর ইত্যাদি অনুষ্ঠানের হানিফ সংকেত ভাইয়ের কানে গেল আমার গান। তিনি খোঁজ করেন—এই মেয়েটা কে? তারপর ইত্যাদিতে গাইলাম ‘রিটার্ন টিকেট’। সেদিন থেকে ড্রয়িংরুমের দর্শক-শ্রোতারাও আমাকে চিনে ফেলল।

কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় বাউল গানের আসর। ছবি: প্রথম আলো
কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় বাউল গানের আসর। ছবি: প্রথম আলো

রাহুল আনন্দ: আমার গানবাজনার শুরুও পরিবার থেকে। বাড়িতে ঠাকুমা থেকে শুরু করে বাবা—সবাই গান করতেন। আমাদের বাড়িতে গান ছিল অনেকটা ভাত খাওয়ার মতো। সকাল-বিকেল চর্চা করতে হবে বা দুটো গান গাইতে হবে। কিন্তু এ বিদ্যা যে আলাদাভাবে শিখতে হয়, এটা বুঝতে পারি কলেজে ওঠার পর। আমি বাঁশি বাজাই, পাশাপাশি গান গাইতে পারি বলে দেখলাম আমার প্রতি সবাই একটু আলাদাভাবে নজর দিচ্ছে। চারুকলায় ভর্তি হওয়ার পর দেখি আমি ও আমার বন্ধু—যারা গানবাজনা করি, তাদের জন্য চায়ের কাপটা আগে আসে, মিষ্টির পেয়ালায় একটা মিষ্টি বেশি আসে। আলাদা একটু আদর। তো, চারুকলায় পড়ার কারণে দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আসে আমার। দেশকে চেনা, দেশকে জানা, প্রকৃতিকে জানা হলো একটু বেশি করে। পরিশ্রমী মানুষ গায়ের ঘাম মুছে পরিতৃপ্তির হাসি দেন, কৃষকের হাসি—সে তো অপূর্ব—এগুলো দেখতে দেখতে আমার বন্ধুদের সঙ্গে আমিও বুঝতে পারলাম, বাংলাদেশ মানে ঢাকা শহর নয়। তখন থেকেই ঢাকার বাইরে যাওয়া শুরু করি। ঢাকা শহর থেকে চল্লিশ পঞ্চাশ কিলোমিটার গেলে দেখি অন্য বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশের রূপগন্ধ আমাকে বেশি ভাবায়। কিন্তু আমি তো বড় হয়েছি এই ইট-কাঠ-সিমেন্টের পিচঢালা পথে। এই নগরে বেড়ে ওঠা একটি ছেলে যে কি না ভালোবাসে তার শিকড়, তার ঐতিহ্যকে। ঐতিহ্যের একটা টান চলে এল আমার গানের মধ্যে, আমার থিয়েটারের মধ্যে। বলা হয়, বাংলা নাটকের প্রাণ হলো গান। প্রাণভ্রমরার গানগুলো খুঁজতে গিয়েই আসলে ঐতিহ্যবাহী গানের সঙ্গে আমার সেতুবন্ধ তৈরি হয়। তখন মনে হলো, আমাদের ঐতিহ্যের সঙ্গে সমকালকে যদি জুড়ে দিতে পারি, তবেই এই সময়ের যে ছেলে বা মেয়েটি যে গান শুনছে, তার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারব তাই ‘জলের গান’-এর শুরু থেকেই ঐতিহ্যের সঙ্গে, লোকজীবনের সঙ্গে সমসাময়িক উপাদান মিশিয়ে গান তৈরি ও উপস্থাপন করার মাধ্যমে বর্তমানে থাকার চেষ্টা করছি আমরা।

বকুল: আপনাদের গানগুলো কারা লেখেন?

রাহুল: আমাদের পূর্বপুরুষেরা নিজের গান নিজেরাই লিখতেন, সুর করতেন। নিজের দোতারাটাও নিজেই বানাতেন। আমাদের গান আমরাই লিখছি। নিজেরাই নিজেদের বাদ্যযন্ত্র বানাচ্ছি। এটা বোঝানোর চেষ্টা করছি যে পাঁচ লাখ টাকার গিটার ছাড়াও গান হবে। তুমি তোমার নিজের বাদ্যযন্ত্র নিজেই বানিয়ে নিতে পারো।

বকুল: এই প্রশ্ন মমতাজের প্রতি: আপনি যখন মারফতি বা পালাগান করতেন, তখন নিজস্ব একটা ব্যাপার ছিল। কিন্তু অডিও বা সিনেমার গানে যখন চলে এলেন, তখন সেখানে ফরমায়েশি বিষয়টাও চলে এল। এখন এই ফরমায়েশি গান করতে করতে কখনো কি মনে হয়, একসময় যে গানগুলো করতেন, তার মতো এই গানেও আপনার নিজস্ব উপস্থাপনা থাকবে?

মমতাজ: আমার চাওয়া হলো, গানে নতুন কিছু হোক। আমার গান যেমন আমার দাদা, চাচা, বয়োজ্যেষ্ঠরা—আধ্যাত্মিক গান যাঁরা পছন্দ করেন—শোনেন, একইভাবে আমি চাই নতুন প্রজন্মও আমার গান শুনুক। গানের নিজস্বতাকে আমি কখনো অবহেলা করিনি। এভাবেই ‘লোকাল বাস’ পর্যন্ত এসেছি। কিন্তু আমাদের সময়ে যাঁরা গান লিখতেন বা সুর করতেন, তাঁরা বললেন, মমতাজ এটা ঠিক করল না। আমি যে একটা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে হাঁটছি, তবলা-বেহালা-বাঁশি রেখে গিটার-ড্রামস দিয়ে গান করছি, এটা অনেকেই নিতে পারেননি। তাঁরা বলাবলি শুরু করলেন, মমতাজ এত দিন উঠছে, এইবার নামবে। আমি কিন্তু হাল ছাড়িনি। এই গানেরও তো দর্শক আছে।

রাহুল: মমতাজ আপার কাছে আমার কয়েকটা প্রশ্ন আছে। আমাদের নিজস্ব যে গান, সেগুলোর কী এমন শক্তি আছে, যার মাধ্যমে আপনি আপনার সামনে বসে থাকা দর্শক-শ্রোতার সঙ্গে একাত্ম হতে পারেন?

মমতাজ: আমাদের গানে আবেগ আর মায়া অনেক বেশি। গানগুলো আমাদের জীবনের সঙ্গেও মিলে যায়। সুর আর কথাটা যখন হৃদয়ে লাগে, আপনাতেই চোখের পানি বেরিয়ে আসে।

রাহুল: আপনার গোটা জীবন, যতটুকু জানি, একটা সিনেমার মতন। ব্যক্তি মমতাজ কোথায় সুখ পান?

মমতাজ: দুই রকমভাবে বলব। একটি হলো নিজের একটা আত্মতৃপ্তি আছে। দুঃখের মধ্যেই সুখটা পাওয়া যায়। কোনো গান করতে করতে যখন আমার চোখে পানি চলে আসে, তখন সেটা আমার হৃদয়ের সুখ। আর একটা সুখ হলো অগণিত মানুষের ভালোবাসা। আমি নিজে মাঝেমধ্যে নিজের শরীরে চিমটি কেটে দেখি—এক জীবনে মানুষের এত কিছু হতে পারে, এত ভালোবাসা পেতে পারে! আল্লাহ যখন যা আমার ভাগ্যে রাখেন, আলহামদুলিল্লাহ। আমি খুবই সুখী মানুষ।

রাহুল: সুখী মানুষেরা অনেক সুন্দরভাবে ঘুমায়, অনেক সুন্দর স্বপ্ন দেখে। আপনি অনেক কিছু শুরুর আগেই শুরু করেছেন, যা অনেকে জনপ্রতিনিধি হওয়ার পরে শুরু করে। আপনার অনেক দূরের স্বপ্নটা কী?

মমতাজ: এখন মাঝেমধ্যে ভাবি, যা-ই করি, একদিন তো চলে যেতেই হবে। কিন্তু আমার কিছু কাজ এখনো অসমাপ্ত। এ জন্য আমার আরও একটু বাঁচতে ইচ্ছা করে।

রাহুল: তার মানে, সুখী মমতাজেরও অতৃপ্তি আছে?

মমতাজ: না, সেই অর্থে নয়। আসলে বাউল কমপ্লেক্সটা এখনো শেষ করতে পারিনি। এর মধ্যে কমপ্লেক্সের কাজ বন্ধ করে আবার হাসপাতালের কাজ শুরু করতে হয়েছে। ভাড়া বাড়িতে চলছে মানিকগঞ্জের হাসপাতাল। নিজস্ব ভবন না থাকলে আমি মরে গেলে এটা চালাবে কে? এই ভেবেই মানিকগঞ্জ শহরে একটা জায়গা কিনেছি—ছয়তলা ভবন করব। আপাতত চারতলা পর্যন্ত করা হয়েছে। আশা করছি, মে মাসের মধ্যেই হাসপাতাল আমরা চালু করতে পারব। যেহেতু নিজস্ব ভবন হলো, তাই আমি না থাকলেও হাসপাতাল হাসপাতালের মতোই চলবে। আর সিঙ্গাইরে যে হাসপাতাল, সেটা আমার নিজের জায়গাতেই করা। তাই এটা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই।

বকুল: ‘জলের গান’ বা রাহুল—ওঁদের গান, ওঁদের পরিবেশনা আপনার কেমন লাগে?

মমতাজ: ওদের একটা বিষয় আমার ভালো লাগে, ওরা নিজেদের গানটা নিজেদের মতো করেই করছে। ওদের বাদ্যযন্ত্র, কথা, সুর, পরিবেশনা—সবই ভালো লাগে। আর ওদের একটা গান তো আমার খুবই প্রিয় ‘বকুল ফুল বকুল ফুল সোনা দিয়া হাত কানও বান্ধাইলি’। কিন্তু একটা প্রশ্ন, ‘শালুক ফুলের লাজ নাই রাইতে শালুক ফোটে লো’—এ গানে ফুলের যদি লাজই না থাকবে, তবে সে রাতে ফুটবে কেন? হা হা হা।

রাহুল: ভাবার্থ যা-ই হোক, এটা একটা প্রতীকী উপমা।

বকুল: মমতাজের গাওয়া কোন গান ভালো লাগে রাহুলের?

রাহুল: আপার ‘মা’কে নিয়ে একটা গান আছে, ওটা। আচ্ছা আপা, ‘মা’ গানটি যখন করেন, তখন আপনার আশপাশে কি উজালা বেগম (মমতাজের মায়ের নাম) এসে দাঁড়ান?

মমতাজ: আমার পুরোটাজুড়েই উজালা বেগম থাকেন। কখনো কখনো কোনো অনুষ্ঠানে গান করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যায়। আমার বাসাভর্তি কত মানুষ। সবাই ঘুমায়। কিন্তু গাড়ি থেকে নামার আগেই দেখি, মা এসে গেট খুলে দাঁড়িয়ে আছেন।

বকুল: যাঁরা লালন সাঁইয়ের ভক্ত, তাঁর গান করেন, তাঁরা কিন্তু নিজস্ব এক রকম ঢঙে চলেন, লালনের সুরে আবিষ্ট হয়ে থাকেন। নিজের ধারা থেকে সরে বাণিজ্যিক ধারায় গান করছেন আপনি। কখনো কি এমন মনে হয়, ফরমায়েশি গান থেকে আবার বাউলগানের জগতে ফিরে যাবেন?

মমতাজ: ওই জগতে আমি আবার যাব। তখন আর ফরমায়েশি, বাণিজিক—এসবের মধ্যে থাকব না। যখন আর কোনো চাওয়া-পাওয়া থাকবে না, সেই সময় কেবল নিজের মনের শান্তির জন্য গান করব। বাউল কমপ্লেক্সে বসে যাব। রাহুলদের সঙ্গে নেব।

রাহুল: আমি তো আপনাকে বলেই রেখেছি, ওই কমপ্লেক্সে আমার যেন একটু জায়গা হয়। দারোয়ানের চাকরি হলেও দেবেন। আমি কিছু করতে চাই। আমি আসলে আপনার মধ্যে বাংলার রূপ দেখতে পাই। আচ্ছা আপা, আরেকটি প্রশ্ন করি, সংগীতশিল্পীর পাশাপাশি আপনি একজন জনপ্রতিনিধিও। দায়বদ্ধতার সেই জায়গা থেকে সংগীতাঙ্গনের মানুষের জন্য কোনো উদ্যোগ নিয়েছেন?

মমতাজ: সেই চেষ্টা শুরু থেকেই আমার আছে। আমাদের সব মন্ত্রণালয়ে সবকিছুতে বাজেট বেশি, শুধু সংস্কৃতি অঙ্গনের জন্য বাজেট সীমিত। কোনো শিল্পী অসুস্থ হলে দেখা যায় তেমন কোনো তহবিল নেই। আমিই প্রথম সংসদে প্রধানমন্ত্রীর সামনে বলেছি, কোনো শিল্পী অসুস্থ হলে তাঁর সহযোগিতার জন্য বাজেট বাড়ানো হোক। এ ছাড়া জেলা-উপজেলায় যেসব গুণী শিল্পী আছেন, তাঁদের যেন পৃষ্ঠপোষকতা করা হয়। বিভিন্ন অঞ্চলের গান, বাদ্যযন্ত্র—এগুলো সংগ্রহ করে আর্কাইভ করার জন্যও অনুরোধ করেছি।

বকুল: আড্ডা শেষ করি মমতাজকে প্রশ্ন করে: রাহুলদের ‘জলের গান’-এর কাছে কী চান আপনি?

মমতাজ: রাহুল আবেগী মানুষ। গানকে বড় ভালোবাসে। গানের প্রতি ওর, ওদের প্রেম আছে। আমি আবারও বলি, আমি যখন আবার বাউল জীবনে ফিরে যাব, তখন রাহুলদের পাশে চাই। রাহুলদের জন্যই বাউল কমপ্লেক্স। নতুন প্রজন্মের ভেতরে এই গানটা ওরা ছড়িয়ে দিক। যদি বেঁচে থাকি, তবে রাহুলদের পাশে বসিয়ে ওদের সঙ্গে আমি গান করতে চাই।