পদাবলি

অলংকরণ: অশোক কর্মকার
অলংকরণ: অশোক কর্মকার

আল মাহমুদ
হে অপ্সরী
চলতে চলতে পিছন ফেরার স্বভাব আমার
কথাও কিছু দেখলে দাঁড়াই অভাব আমার
বুদ্ধিসুদ্ধি যুক্তি-তর্ক মানতে তো চাই,
কিন্তু কোথায় থামতে হবে জানা না তো নাই
তবুও আমি আমার মতো হাঁটছি একা,
এমন সময় এক মানবীর সাথে দেখা
বলি আমি তার সম্মুখে বিনয় করে,
ইতিহাসের বাঁকে কখন রক্ত ঝরে?

আমার কথায় থমকে দাঁড়ায় সেই রমণী
অন্য কোনো নারী নয় সে, সোনার খনি
তার সমুখে ঘুরে দাঁড়াই সাহস নিয়ে
বলি কথা, ভুলে গেছো তোমার বিয়ে
হয়েছিল সেই অতীতে আমার সাথে
একটি কালো অন্ধকারে গভীর রাতে
বহুদিন তো পার হয়েছে স্মৃতি নিয়ে
এখন তো চাই বিস্মৃতি আর ভুলে যাওয়া
কালের পিঠে কাল সাঁতারে তোমায় পাওয়া
হলো না আর বলে কি লাভ হে সুন্দরী—
বাঁচতে হবে তোমায় তবে জড়িয়ে ধরি।

অলংকরণ: অশোক কর্মকার
অলংকরণ: অশোক কর্মকার

রফিক আজাদ
অজেয় সত্তা
বছরের দুটি মাসে শুধু কোনো দুঃস্বপ্ন দেখি না,
বাকি দশ মাস আমি ঘুমুতে যেতেই ভয় পাই
শুধু দুটি মাস বেশ সুখস্বপ্নে কাটে যে আমার,
এই দুটি মাস হলো—খ্রিষ্টীয় দ্বাদশ আর দুই;
বাকি দশ মাস কাটে অহর্নিশ দুঃস্বপ্নে কেবল—
কামাই-রোজগারহীন অসচ্ছল নিম্নবিত্ত লোক
কোনোমতে দিন যাপি সর্বদাই ভয়ে ও শঙ্কায়;
প্রাণভয়ে বালির ওপরে প্রাণপণে দৌড় দিই—
এগোতে পারি না, পায়ের নিচের বালি সরে যায়, 

মুখোশে শোভিত মুখ—শত্রুমিত্র চিনতে পারি না,
উন্মুক্ত খঞ্জর হাতে সীমারেরা ধরে ফেলতে চায়—
ভয়ে কাঠ হয়ে-যাওয়া গলা থেকে ‘টুঁ’ শব্দ বেরোয়?
ঘেমে নেয়ে ঘুম ভেঙে যায় মধ্যরাতে!—ফের ঘুম
আর তো আসে না!—দশ মাসব্যেপে এ রকমই ঘটে

বছরের দুটি মাস—ফেব্রুয়ারি আর ডিসেম্বরে
অজেয় বাঙালি-সত্তা স্পর্ধাভরে, সুখস্বপ্নে কাটে।


শামসেত তাবরেজী

স্যাল্যুট টু অল দোজ লিভিং ডেড পোয়েটস!
নিত্য দেখি বেটাগুলা নারীধর্মমতে
বিয়োবার কোশেশ করছে শিং-অলা পাখি,
তমিস্রা সঘন করছে ল্যাংটার মাজারে,
দশজনেও খুলতে নারে লাইলির আঁখি।
একজন লাফায়ে পড়ল ভাঙা পাটাতনে,
অন্যজন মুখ রাখল (নী)বি-দগ্ধ ক্ষতে,
তুরন্ত তিরের ফলা বিদ্ধ আড়ে-ঘাড়ে,
রচিল হত্যার গান (অ)সহমরণে—

সমলিঙ্গে শিশু নাই, নাম ঝরে খালি—
কবির সঙ্গেই চলছে কবির মিতালি!


মজনু শাহ

শব্দের অঙ্গার
কাঠের বাক্সে সে গুছিয়ে রাখছে কৃষ্ণচূড়া, বিড়বিড় করে বলছে,
আ হর্স আ হর্স! মাই কিংডম ফর আ হর্স...
গ্রহণ করো আমার এই রক্তবসন্ত, আর যত ট্র্যাজেডি,
তুমি হে কৌন ফরিস্তা, কৌন পরিন্দা দেখা দিচ্ছ হাওয়ায়,
রাজা সিমুর্গ তোমাকে চেনে? পাখিদের ভিড়ে তোমার
নৌটংকিবাজি মুছে যায়। ময়দানে, সারি সারি কবর,
ধরে নাও এরাই কোনো শিল্পের চূড়ান্তে পৌঁছেছে। তোমার মুখ থেকে
সরে যাচ্ছে ক্রমে হ্যালোজেন ফগ, জ্বলে উঠছে শব্দের অঙ্গার।
তবু কেন আজ কৃষ্ণচূড়ার মধ্যে ফিরে গেলে তুমি,
আজ কেন আমার কবিতার পাশে বসে থাকে জল্লাদ!


জাহিদ হায়দার

বিরলমৈত্রীর দেশ
চলে যাও বার্তাপ্রধান,
হেথা বিষ চক্রে সজীব;

শুনেছি কথা, দিয়েছ সংকেত;
পড়েছি অনেক ভাষা কঠিনাঅক্ষরে;

ওত পাতা না-দেখা বিচ্যুতি,
আনন্দে হিসাব লেখে কার কত ক্ষতি;

খাদের কিনার খুলেছে অন্ধ আদালত,
পথে পথে আগুনমুখা নদী;

দেখা যাচ্ছে পরাজিত দেশকাল,
দেখা যাচ্ছে তৈরি করা বাঁচা;

লোমশ রোদ্দুরে কী যাপন,
অবিরাম কোন সে ক্ষরণ?
অজানা তরাসবশে
আমি তুমি আতঙ্কের দাস;

দ্যাখ, হত, ক্ষত সন্তানসন্ততি
শুনছে বাধ্য হয়ে উজবুকের কোরাস;

হে বার্তাপ্রধান,
বিরলমৈত্রীর দেশ;
পুড়িয়ে শিশুর মুখ
আগুনকেও অপবিত্র করি;

ঘরে বাইরে উড়ছে লাল আঁধারের খাঁচা


আলতাফ হোসেন

সম্মোহন
ও দেখতে যথেষ্ট ভালো। ভালো ও খারাপ বলো নেই?
তারপরও সৌন্দর্য খরচ করে বলে যাচ্ছে কত মূক
ও বধির দু-পেয়েরা, জিভ দেখিয়ে-দেখিয়ে ভল্লুকদঙ্গল
হেলেদুলে লক্ষ মাইল পাড়ি দিচ্ছে, মরুসাগরের
পরোয়া না করে। আরও যা খুঁটিয়ে নিয়ে আনে তা বলছে।
যা আনতে সে পারে। একে তো খরচে হীরে। অন্যে অপব্যয়।
এর বেশি কথা পাখি খোঁজে যদি তবে তো হরিপ্রসাদ
লাগবে কিংবা আরও কারও মস্ত পুঁথি। সখী, ভাবনা কাহারে...
কিন্তু পায়ে পায়ে এতটা এগোবে
কেন কথা। সিলোজিজমের উই–ছিন্ন ভুলে যাওয়া
বই থেকে এতটা দোহাই কেন পাড়ো


টোকন ঠাকুর

শীত-বসন্ত
এবারের শীত অনেকটা ইন্ডিয়ান শীত, হিন্দি-ভাষী
তা ছাড়া শীতকে তো আমি সব সময়ই বলি, ‘ও গো, ভালোবাসি’

একবার, সাইবেরিয়ান শীতকেও বলেছিলাম, ‘সই
ভাষা ভুলে গিয়ে এসো আমরা গ্রীষ্মের কথা কই...’

মরুভূমির শীতকেও আমার মনে পড়ে, সেই বালু-বালু শীতে
একরাতে বলতে চাইলাম, ‘দাও, যা চেয়েছিলে দিতে’
কিন্তু শেষপর্যন্ত তা বলা হলো না, শীতের সঙ্গে চলা হলো না
শীতকে জাপ্টে ধরা হলো না, শীত-ইশকুলে পড়া হলো না
শীত-নৃত্য নাচা হলো না, পাখির মতো বাঁচা হলো না, আহা
পাশের বাড়িতেও যে শীত ছিল, কিন্তু ওই যে, বলি বলি ভেবেও
আমি বলতে না-পারার দলে, ফলে শীত আর আমারে কী দেবে?

একদিন দেখি, কোত্থাও কাঁপা-কাঁপা সেই শীত আর নেই,
‘বসন্ত এসে গেছে’
এই বলে গান গাচ্ছে এক বালিকা, স্টেজেই, ক্যামেরার সামনে,
হালকা নেচে-নেচে

শেষ লাইনটা হচ্ছে, ‘আবারও শীত আসবে’ ‘যা বলার, বলব’
তাই থাকলাম বেঁচে


শাহীন মোমতাজ

আবারও গানের সঙ্গে বোঝাপড়া
(গীত হতে হতে
যে গান ছড়িয়ে যাচ্ছে তার নাম
চির অচেনার দিকে তাকিয়ে থাকার অবসর,
তার নাম ভুলে যাওয়া বেদনার দিন!)

মঞ্চে উপবিষ্ট কবি, পঙ্ক্তি-ভোলা,
কিছুই বলার নাই—ভাব করে উদাস তাকিয়ে আছে, আর
শিল্পচেতনার কথা

কে এক পাঞ্জাবি-পরা, মোটামতো, ঘুরেফিরে বলে যাচ্ছে
আমাদের কানে,
তার নাম ভুলে যাওয়া সমীচীন হবে িক না ভাবি।

এই বক্তব্যপ্রধান মঞ্চে, শুষ্ক মরুবালুকার মধ্যে
জেগে থাকা বিবর্ণ ঘাসের মতো দেখা যাচ্ছে
তত্ত্ববিনাশিনী সেই গায়িকার মুখ, যাকে কোনো একদিন
কলেজের শিশুবাগানের পাশে বিদায় জানিয়ে
ঘূর্ণমান নানা পথ পাড়ি দিয়ে
এসেছি গানের সঙ্গে বোঝাপড়া করে নিতে,
এইখানে, জীবনের মতো।