বাঙালির রাষ্ট্র, বাঙালির সংস্কৃতি

ষাটের দশকে রবীন্দ্রনাথের গান আর ছায়ানটের বর্ষবরণের অনুষ্ঠান বাঙালির আত্মপরিচয় নির্মাণে ভূমিকা রেখেছিল
ষাটের দশকে রবীন্দ্রনাথের গান আর ছায়ানটের বর্ষবরণের অনুষ্ঠান বাঙালির আত্মপরিচয় নির্মাণে ভূমিকা রেখেছিল

বাংলা, বাঙালি, বাংলাদেশ—এসব নিয়ে ভাবতে বসলে আমাদের যেতে হয় রবীন্দ্রনাথের কাছে। ১১২ বছর আগে দেশভাবনার যে আকুতি তিনি প্রকাশ করেছিলেন, তা অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করার জন্য পাকিস্তান নামক একটি মধ্যযুগীয় রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে আমাদের থাকতে হয়েছিল ২৩ বছর। বাংলা ১৩১২ সালের কার্তিক মাসে বিজয়া-সম্মিলনে তিনি বলেছিলেন:

বন্ধুগণ, এতদিন স্বদেশ আমাদের কাছে একটা শব্দমাত্র, একটা ভাবনামাত্র ছিল—আশা করি, আজ তাহা আমাদের কাছে বস্তুগত সত্যরূপে উজ্জ্বল হইয়া উঠিয়াছে।কারণ, যাহাকে আমরা সত্যরূপে না লাভ করি তাহার সহিত আমরা যথার্থ ব্যবহার স্থাপন করিতে পারি না, তাহার জন্য ত্যাগ করিতে পারি না, তাহার জন্য দুঃখ স্বীকার করা আমাদের পক্ষে দুঃসাধ্য হয়।তাহার সম্বন্ধে যতই কথা শুনি, যতই কথা কই, সমস্তই কেবল কুহেলিকা সৃষ্টি করিতে থাকে।এই-যে বাংলাদেশ ইহার মৃত্তিকা, ইহার জল, ইহার বায়ু, ইহার আকাশ, ইহার বন, ইহার শস্যক্ষেত্র লইয়া আমাদিগকে সর্বতোভাবে বেষ্টন করিয়া আছে—যাহা আমাদের পিতা-পিতামহগণকে বহুযুগ হইতে লালন করিয়া আসিয়াছে, যাহা আমাদের অনাগত সন্তানদিগকে বক্ষে ধারণ করিবার জন্য প্রস্তুত হইয়া আছে, যে কল্যাণী আমাদের পিতৃগণের অমর কীর্তি অমৃতবাণী আমাদের জন্য বহন করিয়া চলিয়াছে, আমরা তাহাকে যেন সত্য পদার্থের মতোই সর্বতোভাবে ভালোবাসিতে পারি—কেবলমাত্র ভাবসম্ভোগের মধ্যে আমাদের সমস্ত প্রীতিকে নিঃশেষ করিয়া না দিই। আমরা যেন ভালবাসিয়া তাহার মৃত্তিকাকে উর্বর করি, তাহার জলকে নির্মল করি, তাহার বায়ুকে নিরাময় করি, তাহার বনস্থলীকে ফলপুষ্পবতী করিয়া তুলি, তাহার নরনারীকে মনুষ্যত্বলাভে সাহায্য করি।...

রবীন্দ্রনাথ তাঁর কথা শেষ করেছিলেন একটি প্রার্থনা-সংগীত দিয়ে। তার শেষ পঙ্‌ক্তিগুলো ছিল:

বাঙালির প্রাণ, বাঙালির মন,

বাঙালির ঘরে যত ভাইবোন,

এক হউক এক হউক

এক হউক হে ভগবান।

রবীন্দ্রনাথ বাঙালিকে একটি অভিভাজ্য সত্তা হিসেবে দেখেছিলেন।সেই সত্তাটি দুই টুকরো হয়ে গিয়েছিলে ১৯৪০-এর দশকে রাজনীতিবিদদের হাতে।বাঙালি ভোট দিয়ে নিজেদের ভাগ করেছিল।পরিচিত প্রতিবেশীকে ছেড়ে হাজার মাইল দূরের অপরিচিতের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছিল। এই সমীকরণের পক্ষে দাঁড় করানো হয়েছিল নানান তাত্ত্বিক যুক্তি।কিন্তু মোহভঙ্গ হতে দেরি হয়নি। বাঙালির আত্মায় ঘা পড়েছিল।আর তখনই জন্ম হয়েছিল নতুন উপলব্ধির।ভাষার প্রশ্নে পাকিস্তানি বাঙালির মধ্যে নতুন বোধের স্ফুরণ ঘটল।

রাষ্ট্রভাষা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছিল পাকিস্তানের জন্ম হওয়ার আগেই।১৯৪৭ সালের ৩ জুন ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন যখন ভারতভাগের পরিকল্পনা ঘোষণা করেন, বাংলা ভাষাভাগের বিষয়টি তখনই ফয়সালা হয়ে গিয়েছিল।জুন মাসের প্রথম দিকেই সংবাদপত্রে খবর বেরোয় যে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করতে চাইছেন। কয়েকজন বাঙালি মুসলমান বুদ্ধিজীবী এর বিরোধিতা করে প্রবন্ধ লেখেন।তাঁদের মধ্যে ছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌, ড. কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল মনসুর আহমদ, ড. মুহম্মদ এনামুল হক, আবদুল হক, ফররুখ আহমদ, আবুল হাশিম প্রমুখ।উদু‌র্র বিরোধিতা করে এবং বাংলা ভাষার পক্ষে প্রথম প্রবন্ধ লিখেছিলেন আবদুল হক। ‘বাংলা ভাষাবিষয়ক প্রস্তাব’ শিরোনামে তাঁর লেখাটি দৈনিক ইত্তেহাদ-এর রবিবাসরীয় বিভাগে দুই কিস্তিতে ছাপা হয়েছিল ১৯৪৭ সালের ২২ ও ২৯ জুন।‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ নামে তাঁর দ্বিতীয় প্রবন্ধটি ৩০ জুন দৈনিক আজাদ-এ ছাপা হয়। আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে বিবৃতি দিলে জুলাইয়ের (১৯৪৭) শেষ দিকে এর বিরোধিতা করে ড. শহীদুল্লাহ্‌ দৈনিক আজাদ-এ একটি প্রবন্ধ লেখেন। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে ‘পাকিস্তান’ রাষ্ট্রটি জন্ম নেওয়ার আগেই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে এসব লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। সুতরাং বলা চলে, পরে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের যে সূচনা হয়েছিল, তার পটভূমি তৈরি করেছিলেন বুদ্ধিজীবীরা।

নতুন রাষ্ট্র ‘পাকিস্তান’ পেয়ে বাঙালি উঠতি মধ্যবিত্ত তখন আনন্দে দিশেহারা।দুই সপ্তাহ যেতে না–যেতেই ১ সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক ও ছাত্র ‘তমদ্দুন মজলিস’ নামে নতুন একটি সংগঠন তৈরি করেন।১৫ সেপ্টেম্বর তাঁরা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন। এতে লিখেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষক কাজী মোতাহার হোসেন এবং কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেহাদ-এর সম্পাদক আবুল মনসুর আহমদ। তমদ্দুন মজলিসের সম্পাদক আবুল কাশেম ভাষা বিষয়ে একটি প্রস্তাব লেখেন। প্রস্তাবে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তানে শিক্ষা, আদালত ও অফিসের ভাষা হবে বাংলা এবং পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের ভাষা হবে বাংলা ও উর্দু।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন নির্ধারণ করে দেয় বাঙালির রাজনৈতিক িনয়তি
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন নির্ধারণ করে দেয় বাঙালির রাজনৈতিক িনয়তি

পাকিস্তান নিয়ে আমজনতার ও তার প্রতিনিধিদের আবেগ থিতিয়ে আসার অনেক আগে এভাবেই বাঙালি জাতীয়তাবোধের নবযাত্রা শুরু হয়েছিল ভাষার প্রশ্নকে ঘিরে।বাঙালি মুসলমানের মনোজগতে পরিবর্তন শুরু হয় ধীরে ধীরে।ধর্মীয় জাতীয়তাবোধের দেয়াল ডিঙিয়ে সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবোধের বীজটি অঙ্কুরিত হতে থাকে, যার ভিত্তি ছিল ভাষা।এ অঞ্চলে সব ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষ যেহেতু একই ভাষায় কথা বলে, ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবোধ হিন্দু-মুসলিম টানাপোড়েনের ওপর নতুন এক সত্তার চাদর বিছিয়ে দিতে শুরু করে।বাঙালির সুপ্ত সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যবোধ জেগে ওঠে।ভাষাকে ঘিরে অসাম্প্রদায়িক চেতনার একটা ক্ষীণ জলধারা তৈরি হয় এবং ক্রমে তা আরও ব্যাপ্তি পায়। এর সরাসরি অভিঘাত দেখা যায় ১৯৪৮ আর ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের দুই পর্বে। ভাষা আন্দোলন ছিল এ দেশে সাংস্কৃতিক জাগরণের প্রতীক, যার চরিত্র ছিল অসাম্প্রদায়িক। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে চারাগাছটি রোপিত হয়েছিল, তা পরে ডালপালা মেলে হয়েছিল বিশাল এক মহিরুহ। এখান থেকে জোর পায় আঞ্চলিক সায়ত্তশাসনের দাবি এবং পরে বাঙালির জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা। তবে পথটি মসৃণ ছিল না।

পূর্ব পাকিস্তানে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির যে ধারাটি কমিউনিস্ট পার্টি, আওয়ামী লীগ ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বহমান রেখেছিল, তার সমান্তরাল একটি অসাম্প্রদায়িক, উদার ও প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনও যুগপৎ চালু ছিল। মূলত বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মী এবং দলীয় পরিচয়ের বাইরে মুক্তমনা কয়েকজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও বুদ্ধিজীবী এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তাঁদের লড়াই করতে হয়েছিল দুই ফ্রন্টে। একটি ফ্রন্ট হলো বাঙালি বুদ্ধিজীবী মানসে গেঁথে থাকা ধর্মাশ্রয়ী পাকিস্তানবাদী ধ্যান-ধারণার বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই, অন্যদিকে ছিল সাম্য ও প্রগতির ঝান্ডাটি এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রাগ্রসর চিন্তা। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ উদ্‌যাপন উপলক্ষে তাঁদের সম্মিলন ঘটে। এর তাৎপর্য ছিল সুদূরপ্রসারী।

১৯৬১ সালে ঢাকা হাইকোর্টের বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদকে সভাপতি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক খান সারওয়ার মুরশিদকে সাধারণ সম্পাদক করে রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ উদ্‌যাপন কমিটি গঠন করা হয়। এ উপলক্ষে ঢাকা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে সপ্তাহব্যাপী অনুষ্ঠানে দেশের প্রথম সারির অনেক লেখক, শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীর সমাবেশ ঘটেছিল। সামরিক শাসনে অবরুদ্ধ সমাজে এই উদ্যোগ ছিল স্পষ্টতই এক বিদ্রোহ। এই সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে ১৯৬৩ সালে ঢাকায় ‘ছায়ানট’ নামে তৈরি হয় একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন। এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন যথাক্রমে বেগম সুফিয়া কামাল ও ফরিদা হাসান। প্রধান সংগঠকদের মধ্যে ছিলেন মোখলেসুর রহমান (সিধু মিয়া), ওয়াহিদুল হক, সন্‌জীদা খাতুন, শামসুন্নাহার রহমান (রোজ), সাইদুল হাসান, আহমেদুর রহমান, মীজানুর রহমান (ছানা), সাইফুদ্দীন আহমেদ (মানিক) প্রমুখ। ১৯৬৭ সাল থেকে তাঁরা প্রতিবছর (১৯৭১ সাল বাদে) পয়লা বৈশাখে রমনার বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান করে আসছেন।

পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঞ্চলে পরস্পরবিরোধী দুটি ধারা ছিল। একটি হলো ধর্মীয় মোড়কে পাকিস্তানি রাষ্ট্রব্যবস্থার ধারা, যেখানে বাংলাদেশ (পূর্ব পাকিস্তান) হয়ে উঠেছিল পাকিস্তানের (পাঞ্জাবের) একটি ‘উপনিবেশ’।

অন্যদিকে একটি অসাম্প্রদায়িক ধারা বাঙালির স্বাধিকারের চেতনাকে সঞ্জীবনী মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করছিল ধীরে ধীরে। বাঙালির এ লড়াইয়ের এক মস্ত বড় অবলম্বন ছিল রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর সাহিত্য। তাই আঘাতটি এল রবীন্দ্রনাথের ওপর। ১৯৬৭ সালের ২৪ জুন পত্রিকায় একটি সংবাদ ছাপ হলো—রেডিও পাকিস্তান থেকে রবীন্দ্রসংগীত প্রচার করা হবে না। এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে ১৮ জন বুদ্ধিজীবী একটি বিবৃতি দেন। বিবৃতিতে তাঁরা বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য বাংলা ভাষাকে যে ঐশ্বর্য দান করেছে, তাঁর সংগীত আমাদের অনুভূতিকে যে গভীরতা ও তীক্ষ্ণতা দান করেছে, তা রবীন্দ্রনাথকে বাংলাভাষী পাকিস্তানিদের সাংস্কৃতিক সত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করেছে। সরকারি নীতিনির্ধারণের সময় এই সত্যের গুরুত্বকে মর্যাদা দান করা অপরিহার্য।’ বিবৃতিতে সই দেন মুহম্মদ কুদরাত-এ-খুদা, কাজী মোতাহার হোসেন, বেগম সুফিয়া কামাল, জয়নুল আবেদিন, এম এ বারি, মুহম্মদ আবদুল হাই, মুনীর চৌধুরী, খান সারওয়ার মুরশিদ, সিকান্দার আবু জাফর, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, আহমদ শরীফ, নীলিমা ইব্রাহীম, শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, ফজল শাহাবুদ্দীন, আনিসুজ্জামান, রফিকুল ইসলাম ও মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান। বিবৃতিটি দেখে শেষ সময়ে শহীদুল্লা কায়সারও সই দিয়েছিলেন।

সরকারি তথ্য বিভাগ, ব্যুরো অব ন্যাশনাল রিকনস্ট্রাকশন, পাকিস্তান কাউন্সিল ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অনেক বাঙালি বুদ্ধিজীবীকে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হতো। অনেকেই পাকিস্তানবাদের পক্ষে লিখতেন এবং এ জন্য টাকা পেতেন। তাঁদের এই মনোজাগতিক ধারার মূলে ছিল সুবিধাবাদ, ভারতভীতি ও হিন্দুবিদ্বেষ। যেহেতু পাকিস্তান রাষ্ট্রটি বাঙালিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করত, সে জন্য প্রাগ্রসর বাঙালির মনোজগতে পাকিস্তান রাষ্ট্রটি ক্ষয়িষ্ণু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একধরনের অসাম্প্রদায়িক ধারা তৈরি হলো। পাকিস্তান রাষ্ট্র ধর্মাশ্রয়ী ও নির্যাতনকারী না হলে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা অসাম্প্রদায়িক ধারায় যোগ দিতেন কি না, তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে।

১৯৬০-এর দশকটি ছিল এ দেশে সাংস্কৃতিক জাগরণের সময়। ওই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতি সংসদ, সৃজনী লেখকগোষ্ঠী, উদীচী—এই সংগঠনগুলোয় বামধারার প্রভাব ছিল লক্ষণীয়। এর পাশাপাশি ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যেও সংস্কৃতিচর্চার প্রবণতা বেগবান হয়। প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে সংকলন প্রকাশ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের ক্ষেত্রে এই সংগঠনগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ছায়ানট এবং পরে তাদের থেকে বেরিয়ে আসা ‘ক্রান্তি’। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী ধারার রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি অসাম্প্রদায়িক ও বামধারার এই সাংস্কৃতিক আন্দোলন এ দেশের মধ্যবিত্ত মানসকে প্রবলভাবে ঝাঁকুনি দিয়েছিল এবং স্বাধিকার আন্দোলনে যোগ করেছিল নতুন মাত্রা। অথচ পাকিস্তানি রাষ্ট্রব্যবস্থা বাঙালির এই মনোজাগতিক বিবর্তনকে দেখত ষড়যন্ত্র হিসেবে। ১২ আগস্ট ১৯৬৭ প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান তাঁর ডায়েরিতে লিখলেন:

পূর্ব পাকিস্তানের কথা মনে হলেই আমি ভাবি, এরা কেন পশ্চিম পাকিস্তানকে দূরে সরিয়ে হিন্দুদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে ধরে রাখতে চায়। আসলে তাদের নিজেদের কোনো ভাষা ও সংস্কৃতি নেই এবং উপমহাদেশের মুসলমানদের তমদ্দুন, যার ভিত্তি হলো উর্দু, তা থেকে তারা মুখ ফিরিয়ে রেখেছে। এটি করে তারা পাকিস্তানের ওপর দুটি রাষ্ট্রভাষা চাপিয়ে দিয়েছে। এটি তাদের জন্য এবং পাকিস্তানের জন্য দুঃখজনক একটি ঘটনা। ইসলামি দর্শনের ওপর তাদের কোনো ভালো সাহিত্য নেই। আমাকে বলা হয়েছে, ইকবালের সাহিত্য থেকে প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো অনুবাদ করে তাদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে। তবে এটি সফল হওয়ার সম্ভাবনা কম।কেননা, বাঙালিদের নিজেদের মধ্যে এ বিষয়ে কোনো আগ্রহ নেই।

আইয়ুব খান দেয়ালের লেখা পড়তে পেরেছিলেন।এর চার বছরের মাথায় ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তান দুই টুকরো হয়ে যায়। স্বাধীন বাংলাদেশে জাতীয় সংগীত হিসেবে গ্রহণ করা হয় রবীন্দ্রনাথের দেশবন্দনার পঙ্‌ক্তিমালা—আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি। একদিন রবীন্দ্রনাথ ‘বাঙালির ঘরে যত ভাইবোন এক হউক’ বলে যে প্রার্থনা করেছিলেন, এই পথ ধরে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অল্পসংখ্যক সুবিধাবাদী ও পশ্চাৎপদ চিন্তার লোক ছাড়া সবাই এককাট্টা হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। এর পেছনে একটাই প্রণোদনা ছিল—দেশপ্রেম। আর তার ভিত তৈরি করে দিয়েছিল বাঙালির সংস্কৃতি, তার স্বদেশচিন্তা।