অমৃতের পুত্র

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী
অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

কলেজ রোডের শেষ মাথায় ডাস্টবিনের পাশে যে পাগলটাকে বসে থাকতে দেখেন আপনারা, তাঁকে আমরা অনেক আগে থেকেই চিনি। মানুষ পাগল হয়ে যায় কেন জানি না, তবে পাগল হওয়ার আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো জানা গেলে হয়তো কিছুটা আন্দাজ করা যায়। আমরা সেগুলো কিছুটা জানি, সেই গল্পই বলছি আজকে।

এই পাগলটার নাম জাহিদ, বেশ সচ্ছল-শিক্ষিত পরিবারের ছেলে, একসময় আমাদের মহল্লাতেই একটা বেশ বড়সড় চোখে পড়ার মতো বাসায় ভাড়া থাকতেন। মা-বাবা আর তিন ভাইবোন মিলে বেশ সুখী পরিবার। দীর্ঘদিন ধরে এই মহল্লায় থাকার কারণে সবার সঙ্গে দারুণ হৃদ্যতাও গড়ে উঠেছিল তাঁদের। তখনো শহরে প্রতিবেশী বলে একটা ব্যাপার ছিল, এক ফ্ল্যাটের বাসিন্দা পাশের ফ্ল্যাটের লোকজনকে চেনে না এ রকম দুর্যোগ তখনো শুরু হয়নি, ফলে আমরা পরস্পরকে চিনতাম, জানতাম, একে অপরের বাসায় যাওয়া-আসার সম্পর্কও ছিল। জাহিদ ভাইয়ের বাবা বেশ বড় চাকরি করতেন। তাঁর মা, মানে আমাদের সবার প্রিয় খালাম্মা, ছিলেন গৃহিণী; তাঁর স্নেহ-মমতার ভাগ পায়নি, তাঁর হাতের সুস্বাদু খাবার খায়নি এমন কোনো ছেলেমেয়ে মহল্লাতে ছিল না। তিন ভাইবোনের মধ্যে বড়জন, মানে শাহেদ ভাই, পড়তেন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে, স্থাপত্যবিদ্যায়। জাহিদ ভাই পড়তেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে। আর সবার ছোট মুনমুন আপা পড়তেন হলি ক্রস কলেজে। বুঝতেই পারছেন, কী দারুণ একটা পরিবার! আমরা তখনো স্কুলে পড়ি; মানে, বেশ আগের ঘটনা এসব। জাহিদ ভাইয়ের প্রতি আমাদের, মানে ছোটদের, একটা বিশেষ আকর্ষণ ছিল। কারণ তিনি গান লিখতেন, সুর করতেন, গাইতেনও। অবশ্য বিখ্যাত কেউ ছিলেন না, ছোট পরিসরেই তাঁর পরিচিতি ছিল। শুধু যে গান নিয়েই থাকতেন তিনি—তা নয়, প্রচুর বইও পড়তেন। প্রায় সারাক্ষণই একটা না একটা বই হাতে থাকত তাঁর। এই ধরনের লোকের সঙ্গে আলাপ জমানো মুশকিল, এঁরা সব সময়ই ব্যস্ত থাকে, কথা বলার ব্যাপারটাকে মনে করে সময়ের অপচয়। তবু আমরা তাঁর কাছে যেতাম, গল্প জমাবার চেষ্টা করতাম। একবার জমে গেলে কত রকমের কথা যে তিনি বলতেন, তার কোনো হিসাব নেই। একজন মানুষ এত বিষয় সম্বন্ধে জানেন কীভাবে, এত কিছু নিয়ে ভাবেন কীভাবে—ভেবে আমরা দারুণ বিস্মিত হতাম।

আমরা যখন কলেজে পড়ি, তখন এই সাজানো-গোছানো পরিবারে একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল। সবাই মিলে গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছিলেন তাঁরা, সড়কপথে, একটা মাইক্রোবাস নিয়ে। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের কোনো এক জায়গায় একটা ট্রাক রং সাইড দিয়ে আসছিল দ্রুতবেগে। সংঘর্ষ এড়ানো যায়নি। সামনের সিটে বসেছিলেন জাহিদ ভাইয়ের বাবা। মাঝখানে খালাম্মা আর তাঁদের গৃহকর্মী। পেছনের সারিতে জাহিদ ভাইয়েরা তিন ভাইবোন। মুখোমুখি সংঘর্ষে মাইক্রোবাসের সামনের দিকটা দুমড়েমুচড়ে যায়। ড্রাইভার ও জাহিদ ভাইয়ের বাবা ঘটনাস্থলেই মারা যান, মা ও গৃহকর্মী গুরুতর আহত হন, তাঁরা মারা যান হাসপাতালে নেওয়ার দুদিনের মাথায়। শাহেদ ভাই, জাহিদ ভাই আর মুনমুন আপাও অল্পবিস্তর আহত হয়েছিলেন—তাঁরা বেঁচে যান বটে, তবে বেশ কিছুদিন হাসপাতালে থাকতে হয়। এত বড় দুর্ঘটনা ঘটে গেলে একটা পরিবারের কী অবস্থা হয়, তা বোধ হয় আর বিস্তারিতভাবে বলার প্রয়োজন নেই। জাহিদ ভাইদের পরিবারেও তাই হলো। হাসি-আনন্দ মুছে গেল, আর্থিক সংকট দেখা দিল, বাসা পাল্টে একই মহল্লায় ছোট একটা বাসায় উঠলেন তাঁরা, কিন্তু ঘরবাড়ি আর আগের মতো পরিপাটি করে গোছানো সম্ভব হলো না তাঁদের পক্ষে। তার চেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার, দুর্ঘটনা তাঁদের পিছু ছাড়ল না। একটা বড় দুর্ঘটনা যে পরিবারে ঘটে, সেই পরিবারে নাকি একের পর এক ঘটতেই থাকে। এটাই নাকি নিয়ম। হয়তো নিয়ম রক্ষার জন্যই এর পরের আঘাতটি এল আরও মর্মান্তিক রূপে।

ওই ঘটনার বছর দুয়েক পরের কথা। মুনমুন আপা তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, শাহেদ ভাই পাস করে বেরিয়ে একটা চাকরিতে ঢুকেছেন, জাহিদ ভাই শেষ বর্ষের পরীক্ষার জন্য অপেক্ষা করছেন। এই সময়ে জানা গেল, ক্ষমতাসীন দলের এক প্রভাবশালী নেতার ছেলে মুনমুন আপাকে নানাভাবে জ্বালাচ্ছে। ক্ষমতাসীন দলের পাতিনেতাদেরও অপরিসীম প্রভাব থাকে সমাজে, সে তো আপনারা জানেনই, আর এ তো বড় নেতার ছেলে! মুনমুন আপার ভাইদের সাধ্য কী ওই রংবাজ ছেলেকে থামায়? মুনমুন আপা যেহেতু ওই রংবাজ ছেলের ডাকে কিছুতেই সাড়া দিচ্ছিলেন না, অতএব অত্যন্ত বোধগম্য কারণেই একদিন তিনি নিখোঁজ হয়ে গেলেন। জাহিদ ভাইয়েরা সবই বুঝলেন, থানা-পুলিশ করলেন, আত্মীয়স্বজনের সাহায্য নিয়ে মন্ত্রীদের কাছেও ধরনা দিলেন, ফলাফলস্বরূপ বোনকে ফিরে পেলেন ঠিকই, তবে জীবিতাবস্থায় নয়। একদিন তাঁর মৃতদেহ আবিষ্কৃত হলো রেললাইনের পাশে। জানোয়ারগুলো মুনমুন আপাকে ক্ষতবিক্ষত করে অচেতন অবস্থায় ছুড়ে মেরেছিল চলন্ত ট্রেনের সামনে। ঘটনাটা ওখানেই থামতে পারত। থামল না। জাহিদ ভাই যতটা শান্ত-নির্বিরোধ মানুষ, শাহেদ ভাই ততটাই রাগী ও আপসহীন। বোনের হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করে বেড়াতে লাগলেন—একাই প্ল্যাকার্ড লিখে দাঁড়াতে লাগলেন প্রেসক্লাবের সামনে, হাইকোর্টের সামনে, অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে এবং এগুলো করতে করতেই সাংবাদিকদের চোখে পড়ে গেলেন তিনি। সংবাদপত্রে ছাপা হতে লাগল তাঁর দুঃখের কাহিনি, তাঁর অভিযোগনামা এবং বোনের হত্যার বিচারের দাবি। ব্যাপারটা চোখে পড়ল আরামপ্রিয় ফেসবুকজীবী আর টক শোজীবীদেরও, যাঁরা কিনা টেলিভিশনের পর্দায় আর ফেসবুকের পাতায় পাতায় নিয়মিতই বিপ্লব করে চলেছেন। দু-চার দিন কথা বলার মতো একটা গরম ইস্যু পেয়ে গেল এই বিপ্লবীদের দল। এবং বরাবর যেমনটি হয়, এই ইস্যুতেও একাধিক পক্ষ তৈরি হয়ে গেল। এক পক্ষ ধর্ষক-খুনির বিচার চাইল, সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের ধুয়ে দিল, সরকারের নিষ্ক্রিয়তার সমালোচনা করল; আরেক দল দাঁড়িয়ে গেল সরকারের পক্ষে; সরকারি দলের কেউ যে অপরাধ করতেই পারে না, শতকণ্ঠে তারা তা প্রচার করতে লাগল। ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চার মতো তৃতীয় আরেকটি পক্ষেরও দেখা পাওয়া গেল, যারা ঘটনার জন্য মেয়েটিকেই দায়ী করল, বলতে লাগল, মেয়েটির নিশ্চয়ই পোশাক-আশাকের ঠিক ছিল না, নইলে মাননীয় নেতার পুত্র কেন উত্তেজিত হবে? এই তিন নম্বরগুলো এমনিতে সব সময় সরকারের বিরোধিতা করার ছল করলেও ধর্ষণ প্রশ্নে তারা বরাবর সরকারি দলের সঙ্গে মিলেমিশে যায়। যাহোক, এতসব আলোচনা-সমালোচনা আর উত্তেজনা তৈরি করার ফল পেলেন শাহেদভাই, হাতেনাতেই। এক রাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে কে বা কারা যেন তাঁকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে গেল। জাহিদ ভাই সাধ্যমতো ছোটাছুটি করলেন ভাইয়ের খোঁজ পাওয়ার জন্য, পেলেন না। এভাবে ধরে নিয়ে গেলে যে আর খোঁজ পাওয়া যায় না, তা তো আপনারা জানেনই। একে যে ‘গুম’ বলা হয়, তা-ও জানেন। তবে নিজেদের নিরাপত্তার খাতিরে শব্দটি ব্যবহার করছি না আমরা! তো, অবাক হয়ে আমরা লক্ষ করলাম, এই রকম এক চরম বিপর্যয়কর সময়ে জাহিদ ভাইয়ের পাশ থেকে সবাই সরে যাচ্ছেন। যেন তিনি নিজেই এক মূর্তিমান বিপদ, যেন তাঁর পাশে কেউ থাকলে তাঁকেও বিপদে পড়তে হবে। আত্মীয়স্বজনের দরজা বন্ধ হয়ে যেতে লাগল তার মুখের ওপর, যেখানেই গেলেন সেখানে থেকেই তাঁকে সাহায্য করার ব্যাপারে অপারগতা প্রকাশ করা হলো, এমনকি প্রতিবেশীরাও এড়িয়ে চলতে লাগল তাঁকে। এরপর ঠিক কী হলো আমরা বলতে পারব না। এমন তো নয় যে আমরা সব সময় জাহিদ ভাইয়ের আশেপাশে ছিলাম, সব জানব কীভাবে?

অনেক দিন জাহিদ ভাইকে মহল্লায় দেখা গেল না, বাড়িওয়ালা ছাড়া এ নিয়ে কারও মধ্যে দুশ্চিন্তা দেখা গেল না। বাড়িওয়ালার ভাড়া বাকি পড়ছে, জাহিদ ভাই বাসায় তালা মেরে সেই যে গেছেন আর কোনো খবরই নেই, দুশ্চিন্তা না করে তাঁর উপায় কী? তারও অনেক দিন পর জাহিদ ভাইকে দেখা গেল কলেজ রোডের ওই ডাস্টবিনের পাশে। শতছিন্ন কাপড়চোপড়, গালভর্তি দাড়ি-গোঁফ, জট পাকানো চুল, আপনমনে বিড়বিড় করে চলেছেন। এই শহরে সব দৃশ্যই দুদিনের মধ্যে পুরোনো হয়ে যায়, জাহিদ ভাইয়ের এই দশাও সবার চোখ-সওয়া হয়ে গেল। কিন্তু আমাদের যে সহ্য হয় না! কী আকর্ষণীয় একজন মানুষ ছিলেন, আর এখন কী হয়েছেন! আমরা কতভাবে যে তাঁর মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করলাম, কতভাবে নিজেদের চেনানোর চেষ্টা করলাম, কোনো লাভই হয় না। তাঁর চোখে এখন নির্বাক-ধূসর শূন্যতা, স্মৃতির কোনো চিহ্ন সেখানে নেই, আমাদের চিনবেনই বা কীভাবে?

মানুষ পাগল হয়ে গেলে কি স্মৃতি হারিয়ে ফেলে? স্মৃতিমুক্ত হওয়া কি সম্ভব মানুষের পক্ষে? মনে হয় না। কিন্তু সম্ভব যদি না-ই হয় তাহলে কী করে সে তার সামাজিক অবস্থান ভুলে যায়? এই যে জাহিদ ভাই, ডাস্টবিনের পাশে বসে থাকেন, এটা তো তাঁর সুস্থ-সামাজিক জীবনের সঙ্গে যায়ই না। তিনি তা পারেন কীভাবে? তা ছাড়া একটু কান পাতলেই শোনা যায়, পাগলরা কেবল বর্তমান নিয়ে কথা বলে, যেন তাদের কোনো অতীত জীবন নেই! স্মৃতি হারিয়ে ফেলার সুবিধা অবশ্য অনেক। স্মৃতি মানেই দুঃখ, এমনকি সেটি যদি সুখের স্মৃতিও হয়। যা আর ফিরে পাওয়া যাবে না, তা সুখের হলেই বা কী? পাওয়া যে যাবে না সে কথাটিই তো মনে জেগে থাকে! এমন কি হতে পারে, পাগলরা এই বিশেষ সুবিধাটি পেয়ে থাকে? আর কী কী সুবিধা পায় তারা? আমাদের জানতে ইচ্ছে করে, কিন্তু পাগল না হলে তো আর পাগলদের জগৎকে চেনার উপায় নেই। অনেক দিন আগে জাহিদ ভাই একটা বই থেকে পড়ে শুনিয়েছিলেন কয়েকটি লাইন, ‘জীবিতের শোক মৃতরা গ্রহণ করে না। আমরা এদিক থেকে বড় পরাধীনভাবে বেঁচে আছি।’ হয়তো তেমন করেই বলা যায়, ‘সুস্থ’ মানুষের চাওয়া-পাওয়া ‘পাগল’রা গ্রহণ করে না। এই দিক থেকে আমরা, মানে ‘সুস্থ’ মানুষেরা বড় পরাধীনভাবে বেঁচে আছি।

আমাদের এই পরাধীনতা ভালো লাগে না। মনে হয়, জাহিদ ভাইয়ের কাছ থেকেই জানতে হবে, কী ভাবেন তিনি, তাঁর কোনো স্মৃতি আছে কি না! কিন্তু মানুষ দেখলেই ভয়ে কুঁকড়ে যান, টুপ করে ঢুকে পড়েন ডাস্টবিনের ময়লার স্তূপের মধ্যে, তখন আর তাঁকে বের করার উপায় থাকে না, কাছে যাওয়াও সম্ভব হয় না।

আমরা তখন তাঁর বিশ্বাস উৎপাদনের জন্য নানান উপায় বের করি। সকালবেলা একটা পত্রিকা আর কিছু খাবার রেখে আসি তার পাশে। আগেও খেয়াল করেছি, পাগলদের কেউ কিছু সাধলে নেয় না, কখনো নিজে থেকে চেয়ে নেয়, অথবা পথে পড়ে থাকা জিনিস কুড়িয়ে নেয়। জাহিদ ভাই কখনো কিছু চানও না। তবে আমরা কিছু রেখে এলে কিছুক্ষণ পর সেগুলো তুলে নেন। যে পত্রিকাটা রেখে আসি সেটি খুঁটিয়ে পড়েন, আগাগোড়া। আহা রে! লোকটা একসময় বই পড়তে কতই না পছন্দ করত! আমরা কি কোনো বই রেখে আসব তাঁর জন্য? কোন বই পছন্দ করবেন তিনি, তা-ও তো জানি না। তার চেয়ে পত্রিকাই ভালো। প্রতিদিন নতুন নতুন খবর, তরতাজা, উত্তেজনায় ভরা। আমরা দেখি, একটু একটু করে সহজ হচ্ছেন তিনি। আমাদের হাত থেকেই পত্রিকা আর খাবার নিতে শুরু করেছেন, পাশে রেখে আসার দরকার পড়ছে না। একদিন আমাদের একজন জাহিদ ভাইয়েরই লেখা আর সুর করা একটা গান গুনগুন করে গেয়ে উঠলে আমরা দেখতে পাই, তাঁর শূন্য চোখে যেন আলো জ্বলে ওঠে। অবাক গলায় আমাদের নাম ধরে বলেন, তোরা এখানে এলি কী করে? কত বড় হয়ে গেছিস!

তার মানে জাহিদ ভাই আমাদের চিনতে পেরেছেন! আগে অবশ্য তুই করে বলতেন না, সম্বোধনের এই পরিবর্তনেও আমরা দারুণ খুশি হয়ে উঠি। বলি, আমাদের চিনেছেন, জাহিদ ভাই?

হ্যাঁ চিনব না কেন? কত বড় হয়ে গেছিস! এখানে কী কাজ তোদের?

আপনি এখানে কী করেন? বাসায় যান না কেন?

আমি তো এখানেই থাকি।

তা তো জানি। বাসায় যান না কেন?

বাসা? কোন বাসার কথা বলছিস?

বুঝতে পারি, ওই পর্ব মুছে গেছে তাঁর মন থেকে। তা ছাড়া, বাসাটিও তো আর নেই। বাড়িওয়ালা তালা ভেঙে সমস্ত জিনিসপত্র চিলেকোঠার একটা রুমে স্তূপ করে রেখেছেন, বাসাটা ভাড়া দিয়েছেন অন্য লোকের কাছে। কোন বাসায়ই বা ফিরবেন জাহিদ ভাই? বাড়িওয়ালাকেও দোষ দেওয়া যায় না। কতকাল তিনি তালাবদ্ধ করে রাখবেন একটা ফ্ল্যাট? এখন ওখানে তাঁকে নিয়ে গেলে ভালোর চেয়ে খারাপই হবে, এটুকু বুঝি। এমনিতেই কোনো স্মৃতি নেই, ওই স্তূপকৃত জিনিসপত্র তাঁর স্মৃতিহীনতাই বাড়িয়ে দেবে। থাকুক এভাবে, দেখি বিকল্প কী করা যায়—এই রকম ভাবি আমরা।

কিন্তু জাহিদ ভাইয়ের অবস্থা দিন দিন আরও খারাপ হতে থাকে। আগে চুপচাপ বসে থাকতেন, বড়জোর একা একা বিড়বিড় করতেন। এখন জোরে জোরে কথা বলতে শুরু করেছেন। একদিন দেখি তিনি ডাস্টবিনের পাশের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে বক্তৃতার ভঙ্গিতে চিৎকার করছেন। কথা তো নয়, অকথ্য গালাগালি। আমরা অবাক হয়ে ভাবি, জাহিদ ভাই এত গালি শিখলেন কবে? কাউকে উদ্দেশ করে নয়, আপন মনেই বলে চলেছেন তিনি। প্রমিত ভাষা, ভরাট কণ্ঠ, উঁচু স্বর। দেশ নিয়ে বলছেন, রাজনীতি নিয়ে বলছেন, অর্থনীতি নিয়ে বলছেন। বাচ্চারা কৌতূহলভরে তাঁর কথা শুনছে। বড়রা একটু শুনে সভয়ে দূরে সরে দাঁড়াচ্ছে। জাহিদ ভাই বলে চলেছেন, ‘মানুষ মরে যাচ্ছে, খুন হয়ে যাচ্ছে, গুম হয়ে যাচ্ছে, মেয়েরা ধর্ষিত হচ্ছে, শিশুরাও রেহাই পাচ্ছে না। শিশুদেরও ধর্ষণ করা হচ্ছে, মেরে ফেলা হচ্ছে। কেউ কাউকে সহ্যই করতে পারছে না। অসহিষ্ণুতা, চারপাশে চরম অসহিষ্ণুতা। অরাজকতা, দেশজুড়ে অভাবনীয় অরাজকতা। মানুষ মরে যাচ্ছে, হাঁসফাঁস করছে, তবু প্রতিবাদ করতে পারছে না। তাদের ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে রাখা হচ্ছে। আর ওদিকে ওনারা উন্নয়নের গপ্প মারাচ্ছেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কেচ্ছা শোনাচ্ছেন! আরে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি দিয়ে কী হবে, যদি মানুষই না থাকে?’ এই রকম আরও কত কথা যে বলছেন! চারপাশের মানুষ চুপচাপ তাঁর কথা শুনছে, কোথাও সাড়াশব্দ নেই।

আমাদের মনে হতে থাকে জাহিদ ভাই যা যা বলছেন, সেগুলো আমাদেরও মনের কথা। আমরা বলতে পারছি না, তিনি অবলীলায় বলে চলেছেন! মনে হয়, তিনি যেন এক অমৃতের সন্তান, নইলে এই ভয়কাতর দুঃসময়ে কে-ইবা এত দুঃসাহসী হয়ে দ্বিধাহীনভাবে সত্য কথা বলতে পারে? আহা, এ রকম মানুষে যদি ভরে যেত পৃথিবী! যদি আমরাও এমন হতে পারতাম! কিন্তু এ-ও ভাবি, জাহিদ ভাই যেসব কথা বলছেন তা তাঁর জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে। এখন নিষেধাজ্ঞার সময়, সভয়ে সরে দাঁড়ানোর সময়, কথা বলার সময় তো এটা নয়! এসব বলা রীতিমতো অপরাধ, হয়তো শোনাও অপরাধ। আমরা তাঁকে জোর করে ফুটপাত থেকে সরিয়ে নিয়ে আসি। বলি, এসব বলছেন কেন, জাহিদ ভাই? বিপদ হতে পারে তো!

বিপদ? কিসের বিপদ?

কত রকমের বিপদ! আগে থেকে কিছু বলা যায় নাকি? এসব কথা বলতে হয় না।

কেন বলব না? আমি তোদের মতো ভিতু নাকি?

অত সাহস দেখাতে হবে না।

তোদের সমস্যা কি জানিস?

আমাদের আবার কী সমস্যা?

গুরুতর সমস্যা। তোরা তোদের অবচেতনের কাছে হেরে গেছিস।

সেটা কী রকম?

ফ্রয়েডকে চিনিস তো?

ইয়ে মানে, নাম শুনেছি।

তার চেয়ে আর বেশি কী-ই বা শুনবি, গরুর দল! তো, ফ্রয়েড কী বলেছেন, জানিস?

ইয়ে মানে...

বুঝেছি, জানিস না কিছু। ফ্রয়েড বললেন, মনের দুটো স্তর। চেতন-অবচেতন। যা আমরা চেতন মনে রাখতে পারি না তাকে অবচেতনে পাঠিয়ে দিই। তাহলে দোষ কার?

আমাদের একটু তর্ক করতে ইচ্ছে করে। বলি, কিন্তু মন বলে তো কিছু নাই, জাহিদ ভাই।

ওই হইল! মস্তিষ্কই। যাকে আমরা মন বলি সে-ও মস্তিষ্কই। মন বললে সমস্যা কী? আমরা তো বলি মন খারাপ, কখনো কি বলি যে আমাদের মস্তিষ্ক খারাপ? এসব তর্ক যারা করে তারা সব বেকুব। মানুষের হাজার বছরের ব্যবহৃত শব্দের কোনো অর্থই নাই, তা তো হয় না!

আমরা আর তর্কের ঝুঁকি নিই না। যদিও এখন বড় হয়েছি, আর জাহিদ ভাই পাগল হয়ে গেছেন, তার মানে তো এই নয় যে আমরা তাঁর সঙ্গে তর্কে পেরে উঠব! আমরা চুপ থাকলেও জাহিদ ভাই খেই হারান না। বলেন, বললি না, দোষ কার? চেতনের না অবচেতনের?

কোন দোষের কথা বলছেন, কার দোষের কথা বলছেন কিছুই তো বুঝতে পারছি না, উত্তর দেব কী করে? আমাদের কথা না বলতে দেখে আবার বললেন, পারলি না তো! ঠিক আছে বল, এ ব্যাপারে ইয়ুং কী বলেছেন?

ইয়ুং কী বলেছেন তা জানা তো দূরের কথা, এই নামই আমরা শুনিনি কোনো দিন। ফ্রয়েডের নাম তবু এদিকে-ওদিকে শুনেছি, ইয়ুংটা আবার কে? আমাদের চুপ করে থাকতে দেখে ধমকে উঠলেন জাহিদ ভাই, আরে ওই যে কার্ল গুস্তাভ ইয়ুং! কী বলেছেন উনি?

আমাদের জানার প্রশ্নই ওঠে না। ধমক শুনেও তাই চুপ করে রইলাম।

গর্দভের দল!—স্বগতোক্তি করলেন তিনি, ইয়ুং বললেন যৌথ অবচেতনের কথা। মানে, জনগণ যে জীবন-যাপন করে তার স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা জমা হয় প্রত্যেক ব্যক্তিমানুষের মনেও। তাহলে মনের স্তর দাঁড়াল তিনটা। সচেতন, অবচেতন আর যৌথ অবচেতন। সব মানুষের। শুধু পাগল ছাড়া। হাহাহা...শুধু পাগলের থাকে একটাই মন, তোদের আছে তিনটা। তাইলে কী দাঁড়াইল বাছাধনেরা?

আমরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করি।

দাঁড়াইল এই যে তোরা তিনটা মন নিয়া ঘুরস, সব ভণ্ডের দল। আর আমার একটাই। আমার কোনো সাব-কনশাস নাই, কালেকটিভ কনশাস নাই, আছে শুধু কনশাস মাইন্ড। যা ইচ্ছা হয় তাই বলি, যা ইচ্ছা তাই করি। তোদের মতো পুতুপুতু করি না, ইচ্ছা করলে আমি এই উন্নয়নের মুখে মুতেও দিতে পারি, তোরা পারবি না। হাহাহা...

আমরা আর কিছু বলি না। সত্যিই তো, আমাদের তিনটে মন। সচেতন মন যা বুঝতে পারে বা বলতে চায়, অবচেতন তাকে নিজের দিকে টেনে নিয়ে যায়, বলতে দেয় না। আর তৃতীয় মনটা যে কী করে আমরা তা বুঝতেই পারি না। সচেতন মন নিয়ে ঘুরে বেড়াই বলে আমরা তাই কোনো কথাই বলি না, চুপ করে থাকি, চুপ থাকতে থাকতে বোবা হতে থাকি, বোবা হয়ে যাই...