মধ্যযুগের মধ্যাহ্ন ভাস্কর

শিল্পীর তুলিতে মধ্যযুগের আরাকান রাজ্য। এই রাজ্যের রাজসভাতেই রচিত হয়েছে আলাওলের অমর কীর্তিগাথা
শিল্পীর তুলিতে মধ্যযুগের আরাকান রাজ্য। এই রাজ্যের রাজসভাতেই রচিত হয়েছে আলাওলের অমর কীর্তিগাথা

মধ্যযুগের বাংলায় তুর্কি-পাঠান-মোগলদের শাসনভূমি থেকে অনেক দূরে বঙ্গোপসাগরের কোলবেষ্টিত চিলতে রাজ্য রোসাঙ্গে বঙ্গীয় সাহিত্য-সংস্কৃতির যে একটি সক্রিয় কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল, সে বৃত্তান্ত আমাদের জানা হলো আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের পুঁথিসংগ্রহের কল্যাণে। সাহিত্যবিশারদ সে সময়ের তরুণ গবেষক ও পণ্ডিত ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক সহযোগে আরকান রাজসভায় বাঙ্গালা সাহিত্য নামের অমূল্য গবেষণাগ্রন্থটি প্রকাশ করেন (১ মার্চ ১৯৩৫)। ‘আরকান’ নামটি পরে ‘আরাকান’ নামে সুস্থিত হয়। ‘রোসাঙ্গ’ ‘রাখাইন’ নাম তখন মিডিয়ার সূত্রে আরও সুপরিচিত।

ওই রকম একটি দূরবর্তী প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাংলা সাহিত্যচর্চার কেন্দ্র কেন হলো, তার ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক পটভূমি বর্ণিত হয়েছে গবেষণাগ্রন্থটিতে। স্বভাবতই, ওই বইয়ে আরাকান রাজসভার সব কবির পরিচিতি ও কৃতীর বৃত্তান্ত আছে। তাঁদের মধ্যে ‘আলাওল’ নামটিই বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিখ্যাত।

আলাওলের স্বরসংগতিমূলক বানান ‘আলাউল’ও দেখা যায় এবং ব্যাকরণমতে ‘আলাউল’ই যথাযথ। বানান যা-ই হোক, আলাওল যে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের শীর্ষ কবিদের একজন, সে কথাও সবার জানা। সাহিত্যবিশারদ ও এনামুল হক আলাওলকে আখ্যা দিয়েছেন মহাকবি। তাঁদের উক্তি—‘মধ্য-যুগীয় বঙ্গ সাহিত্যে তিনি মধ্যাহ্ন ভাস্করবৎ বিদ্যমান’।

এ প্রশংসা আলাওলের প্রাপ্য এবং তা অতিরঞ্জন নয়। আহমদ শরীফের কথায় সুর মিলিয়ে আমরাও বলব, মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ তিন কবি হলেন মুকুন্দরাম, আলাওল ও ভারতচন্দ্র। অবশ্য তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হবেন কয়েকজন অসামান্য বৈষ্ণব পদকার—বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, জ্ঞানদাস, গোবিন্দ দাস। চণ্ডীমঙ্গল রচয়িতা মুকুন্দরাম ও পদ্মাবতী রচয়িতা আলাওল সতেরো শতকের প্রথমার্ধের কবি, মুকুন্দরাম অন্তত ৫০ বছরের বড় হবেন আলাওলের, আর অন্নদামঙ্গল রচয়িতা ভারতচন্দ্র আঠারো শতকের প্রথমার্ধের কবি। মুকুন্দরাম ও ভারতচন্দ্র মৌলিক কবি এবং তাঁদের সৃষ্টি জ্বলজ্বলে। আলাওলকেও মৌলিক কবি বলা যাবে, যদি তাঁর অনুবাদভিত্তিক কাব্যগ্রন্থগুলোকে তাঁর স্বাধীন রচনা বলা যায়। সেটি আমরা সোৎসাহে বলতে পারি। আলাওলের নিজের মৌলিক রচনা অবশ্যই রয়েছে—পদাবলি আর গান। এগুলোর কথা লোকজন জানে না, যেগুলো জানে, সেগুলো সবই অনুবাদের ফসল। পদ্মাবতীসহ অন্য যেসব কাব্য তিনি লিখেছেন, যেমন সতীময়না ও লোর চন্দ্রাণীর শেষাংশ (প্রথমাংশ লিখেছেন দৌলত কাজী এবং তাঁর নামেই ওই মধ্যযুগীয় পুঁথিটি), সয়ফুলমুলক বদিউজ্জামাল, সপ্ত পয়কর, সিকান্দারনামা, তোহফা ইত্যাদির মূল উৎস হিন্দি-আওধি ভাষার প্রণয়কাব্য কিংবা ফারসি কাব্য। অন্য ভাষার রচনাকে বাংলা ভাষায় নিজ রচনা করার অপূর্ব কলাকৌশল আলাওলের আয়ত্তে ছিল। বাংলা ভাষার শব্দসম্ভার তাঁর সম্পদ।

সংস্কৃত ব্যাকরণ ও রসতত্ত্ব, অলংকারতত্ত্ব, তৎসম শব্দের পূর্ণ অধিকার এবং এর সঙ্গে যুক্ত আরবি-ফারসি ভাষার জ্ঞান, হিন্দি ও আওধি ভাষার রসতাত্ত্বিক শিক্ষণ, নানা রকম কলাবিদ্যা, সংগীতবিদ্যা—সব মিলিয়ে আলাওল অসাধারণ কাব্যস্রষ্টা—পদ্মাবতী যাঁর সেরা কীর্তি। এ কাব্যের উৎস ভারতের উত্তর প্রদেশে আমেথির হিন্দি কবি মালিক মুহম্মদ জায়সির কাব্যপদুমাবৎ, অর্থাৎ পদ্মাবতী উপাখ্যান। প্রণয়কাহিনির সঙ্গে ইতিহাসের ক্ষীণরেখা আছে, যদিও সেটি মিথ্যে বলে জানা গেছে। তুর্কিবংশীয় সম্রাট আলাউদ্দিন খিলজি রাজপুত রানি পদ্মিনীর রূপ-লাবণ্যে আকৃষ্ট হয়েছিলেন এবং রানিকে পাওয়ার জন্য অভিযান করলে রানি সহচরীদের নিয়ে জহরব্রত করেছিলেন। এই কল্পিত আখ্যানটি পদুমাবৎ কাব্যের মূল প্রসঙ্গ নয়, বরং রত্নসেন-পদ্মাবতীর প্রণয়কাহিনিই মুখ্য।জায়সির কাব্য আধ্যাত্মিক রূপক, সুফি-মরমি চেতনার উদ্বোধক। আলাওল এই কাহিনিকে মানবিক রসদৃষ্টিসম্পন্ন করেছেন। হিন্দি-আওধির আরও প্রণয়কাব্য আলাওলের সমকালীন কবিদের রচনা-উৎস হয়েছে। সেই ধারাতেই আলাওলের পদ্মাবতী কাব্যের সৃষ্টি। নায়িকার নামেই কাব্য, রোমান্স কাব্য, যেখানে আছে রূপবান অভিজাত নায়ক আর অনিন্দ্যসুন্দরী নায়িকা, যার রূপ বর্ণনায় আলাওল তাঁর বইয়ের বেশ কয়েক পৃষ্ঠাই খরচ করেছেন; তাতে উপমার ছড়াছড়ি বর্ণনাকে কত বর্ণাঢ্য করা যায়, তার তুলনাহীন কবিকৃতি। নায়িকার বর্ণনায় ভারতীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে চমৎকারভাবে ফারসি রীতিরও মিল ঘটাতে পেরেছেন স্বচ্ছন্দে। তীব্র প্রণয়ের সঙ্গে অভিযান, যুদ্ধবিগ্রহ, সংঘর্ষ, হিংসা-বিদ্বেষ, ষড়যন্ত্র সবই আছে, উপভোগ্যভাবেই আছে। এই কথা কেবলপদ্মাবতী নয়, রূপকথাশ্রয়ী অনুবাদ রচনা সয়ফুলমুলক বদিউজ্জামাল এবং বীরকাহিনি সিকান্দারনামা সম্বন্ধেও প্রযোজ্য। মধ্যযুগের বাঙালি কবি আলাওলের কাব্যসামগ্রী বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চিরায়ত সম্পদ।

সাহিত্যবিশারদ ও মুহম্মদ এনামুল হক তাঁদের গবেষণাগ্রন্থে আলাওলকে চট্টগ্রামের সন্তান মনে করেছিলেন। আলাওল আত্মকথা লেখেননি, কিন্তু গ্রন্থগুলোতে তাঁর নিজের সম্বন্ধে এখানে-ওখানে কিছু খবর দিয়েছেন, যাতে এখন গবেষকেরা সম্পূর্ণ নিশ্চিত যে আলাওল বাংলাদেশের ফরিদপুরে জন্মগ্রহণ করেছেন। পিতার সঙ্গে নৌকায় করে যাওয়ার সময় ডাকাতদের আক্রমণে নিজে ক্ষতবিক্ষত হলেও আত্মরক্ষা করেন, কিন্তু পিতাকে হারান। তারপর তিনি কীভাবে রোসাঙ্গ রাজ্যে গেলেন, সে বৃত্তান্ত জানা যায় না।তখন তাঁর কত বয়স, সেটাও জানা যায়নি। রোসাঙ্গে গিয়ে তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দিলেন।অনেকটা কাজী নজরুল ইসলামের মতো সৈনিক কবি।আশ্রয়দাতা মাগন ঠাকুর আলাওলের কবিত্ব ও সংগীতবিদ্যায় আকৃষ্ট হয়ে তাঁকে কাব্যসৃষ্টিতে কাজে লাগান। সেই থেকে আলাওল রোসাঙ্গের স্থায়ী বাসিন্দা, পিতৃভূমিতে তিনি আর ফিরে আসেননি।ওই রোসাঙ্গেই তাঁর ঘরসংসার, স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে সুখ-দুঃখের দিনগুলো।

আলাওল দীর্ঘজীবী ছিলেন বলে জানা যায়। ওই রোসাঙ্গেই রাজ অমাত্যদের পৃষ্ঠপোষকতায়, বদান্যতায়, শ্রদ্ধা ও সম্মান নিয়ে আলাওল বাংলা কাব্যের সাধনা করে গেছেন। সেই সাধনার পূর্ণ পরিচয় রয়েছে তাঁর লেখায়।

আলাওলের পদ্মাবতীর রচনাকাল ১৬৫১ খ্রিষ্টাব্দ। যদিও এটি তাঁর প্রথম রচনা। কিন্তু পরিণত কবিত্বকলার দৃষ্টান্ত এ অনুপম সৃষ্টি। জায়সির হিন্দি রচনার বাংলা ভাষ্য জায়সি থেকে অনেকটা দূরে। এতে রূপক, আধ্যাত্মিকতা কেউ খুঁজলে খুঁজতে পারেন; কিন্তু সেই মরমি বৈশিষ্ট্যের চেয়ে এ কাব্যে মানুষের কাহিনিই মুখ্য। জায়সির অনেক অংশই পরিত্যক্ত, আধ্যাত্মিক অংশগুলো তো বটেই। নিজের সংযোজনা আছে মাঝেমধ্যে। এতে বোঝা যায়, মূল কাব্যের সীমার মধ্যে নতুন কিছু করার প্রয়াস আলাওলের বরাবরই ছিল।আলাওলের অন্য কাব্যগুলো নিবিড়ভাবে পরীক্ষা করলেও এ সত্য ধরা পড়বে। মধ্যযুগের বাংলা রোমান্স-কাব্যের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আলাওলের রচনা।