তিমিরবিনাশী সংগ্রাহক

আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ
আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ

বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির যথার্থ ইতিহাস রচনায় আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের (১৮৭১-১৯৫৩) উত্তরাধিকার আজ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকার করে দুই বাংলার সারস্বত সমাজ। তিনি মুসলমান সমাজের প্রথম প্রজন্মের ইংরেজি শিক্ষিত ম্যাট্রিকুলেট হলেও গ্রামের স্কুলে শিক্ষকতা আর চট্টগ্রাম শহরে সরকারি শিক্ষা দপ্তরে কেরানির চাকরি করে মূলত নিজ গ্রাম পটিয়ার সুচক্রদণ্ডিতে জীবন অতিবাহিত করেছিলেন। সুচক্রদণ্ডি থেকেই তাঁর নিয়মিত যোগাযোগ ছিল কলকাতা ও ঢাকার বুধমণ্ডলীর সঙ্গে। এই দরিদ্র গ্রাম্য–গৃহস্থ প্রবীণ সাধক তাঁদের সবার শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন।

রবীন্দ্র-পরিকরের বিশিষ্ট সংস্কৃত পণ্ডিত এবং মধ্যযুগের ভারতীয় সাধক ও তাঁদের সাধনা সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ ক্ষিতিমোহন সেনশাস্ত্রী একবার চট্টগ্রাম এসে সাহিত্যবিশারদের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। শাস্ত্রীর ব্যগ্রতা দেখে তাঁর স্থানীয় মেজবান এক আমলা নিজের কর্তৃত্বের অভ্যাসে তাঁকে ডেকে পাঠানোর আশ্বাস দিলে ‘ক্ষিতিমোহন গরম হয়ে গেলেন, অবাকও হয়েছিলেন। বললেন: কি বললে, তাঁকে ডেকে আনাবে! তিনি আমাদের অগ্রণী, আমাদের নমস্য, তাঁকে ডেকে আনাবে কি, আমরাই তাঁর কাছে যাব। ...দূর থেকে (তাঁকে) দেখে ক্ষিতিমোহন বললেন: উনি ব্যক্তিমাত্র নহেন, উনি একটা প্রতিষ্ঠান।’ (সাহিত্যিক মাহবুব উল আলম)

গ্রামের দরিদ্র গৃহস্থটি কীভাবে ব্যক্তিমাত্র থেকে রীতিমতো প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছিলেন, আজকের প্রেক্ষাপটে তা এক বিস্ময় বটে।

আবদুল করিম আজীবন নিরবচ্ছিন্নভাবে হাতে লেখা পুরোনো পুঁথি সংগ্রহ করে গেছেন। এসব নাড়াচাড়া করতে করতে তিনি পুঁথির পাঠোদ্ধারে দক্ষ হয়ে উঠলেন এবং ক্রমে এসবের সাহিত্যমূল্য সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠেছিলেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকেই মুদ্রণযন্ত্রের কল্যাণে ছাপা বইয়ের কাল এসে গেল। আর বেশির ভাগ হাতে লেখা পুঁথি ও পাণ্ডুলিপি বিগত কালের তামাদি জিনিস হিসেবে হিন্দু-মুসলিম–নির্বিশেষে অধিকাংশ বাড়িতে পূর্বপুরুষের স্মৃতি হিসেবে অযত্নে বস্তাবন্দী হলো।

ইংরেজের কল্যাণে নগরে যে নতুন বিদ্বৎসমাজের উদ্ভব হয়েছিল, তাঁরা গ্রামবাংলায় ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য কাহিনি, কেচ্ছা, গীত, গাথা, পালার মূল্য সাহিত্যের ইতিহাসের দিক থেকেও দেননি। বরং কিছুটা ইংরেজি শিক্ষার প্রভাবে ইউরোপের ইতিহাসের মতো বাংলারও একটি অন্ধকার মধ্যযুগের ভাবনা গুরুত্ব পেয়েছিল। অভিযোগ উঠেছিল, মুসলিম শাসনামলের এ সময়ে বাংলায় উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকৃতি ও সৃজনশীল কর্মের তেমন নজির মেলে না। সেদিক থেকে আবদুল করিমের সংগ্রহ, পাঠ এবং এ নিয়ে আলোচনা রীতিমতো যুগান্তকারী বিপ্লবী ঘটনা। তাঁর কাজের পরিচয় কলকাতায় বিদ্বৎসমাজে কী রকম আলোড়ন তুলেছিল, তা বোঝা যায় পুঁথিসাহিত্যের গবেষক ব্যোমকেশ মুস্তফীর মন্তব্যে ব্যবহৃত বিশেষণগুলো খেয়াল করলে—‘ইহার পরই (মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর সংগ্রহসমূহের পরে) চট্টগ্রামবাসী মুনশী আবদুল করিম কর্তৃক অজ্ঞাতপূর্ব, অশ্রুতনাম, কৌতূহলোদ্দীপক, বিস্ময়কর বহু প্রাচীন বাঙ্গালা পুথির বিবরণ নানা মাসিক পত্রে প্রকাশিত হইতে থাকে।’

তাঁর এই প্রয়াসের ফলে ‘প্রায় ৪০০ বছরের সাহিত্যিক নিদর্শন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে স্থান পেয়েছে। মধ্যযুগের দেড়শতাধিক কবিকে আবিষ্কারের কৃতিত্ব তাঁর’ (ড. মাহবুবুল হক)। তাঁর আবিষ্কৃত গুরুত্বপূর্ণ কবি হলেন: পনেরো শতকের শাহ মোহাম্মদ সগীর, ষোলো শতকের দৌলত উজির বাহরাম খান, সৈয়দ সুলতান, শেখ ফয়জুল্লাহ, সতেরো শতকের কাজী দৌলত, মাগন ঠাকুর, আলাওল, আঠারো শতকের আলী রজা প্রমুখ। এ ছাড়া ষোলো শতকের দ্বিজ শ্রীধর কবিরাজ, কবীন্দ্র পরমেশ্বর, শ্রীকর নন্দী, গোবিন্দ দাসসহ ত্রিশোর্ধ্ব হিন্দু কবিও রয়েছেন, যাঁদের পুঁথি ও পদের তিনিই প্রথম আবিষ্কর্তা।

তাঁর এ কাজের ফলে একদিকে মধ্যযুগের অন্ধকারের অবসান হয়ে তা আলোকোজ্জ্বল হয়ে উঠল আর অন্যদিকে বাংলা সাহিত্যে মুসলিম অবদান নগণ্য দোভাষী পুঁথির বাইরে সাহিত্যের মূলধারায় গুরুত্বের সঙ্গে স্বীকৃত হলো।

আবদুল করিমের প্রজ্ঞা ও দক্ষতার গুণেই দ্রুত এতকালের অপাঙ্‌ক্তেয় তামাদি সৃষ্টির পুনরুজ্জীবন ঘটল।তাঁর সম্পাদিত নরোত্তম ঠাকুরের রাধিকার মানভঙ্গ (১৩১২ ব.) বইয়ের মুখবন্ধে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এ কাজের মূল্যায়ন করে লিখেছেন, ‘তিনি এই দুর্লভ গ্রন্থের সম্পাদনকার্যে যেরূপ পরিশ্রম, যেরূপ কৌশল, যেরূপ সহৃদয়তা ও যেরূপ সূক্ষ্মদর্শিতা প্রদর্শন করিয়াছেন, তাহা সমস্ত বাংলায় কেন, সমস্ত ভারতেও বোধহয় সচরাচর মিলে না। এক-একবার মনে হয় যেন কোন জর্মান এডিটার এই গ্রন্থ সম্পাদন করিয়াছেন।’

জার্মান এডিটরের তুল্য কাজ তো সহজে সম্পন্ন হয়নি। গ্রামে নিজ বাড়ির নিম্নবিত্ত পরিমণ্ডলের মধ্যে বাস করেও এই সাধক মানুষটি তাঁর অবসরের সবটুকু সময় পুঁথির পাঠোদ্ধার ও গবেষণায় ব্যয় করেছেন। অনেক পুঁথির পাণ্ডুলিপি নিজেকেই লিখে তৈরি করতে হয়েছে। আবার একটি পুঁথির বিভিন্ন প্রতিলিপির তুলনামূলক পাঠ ও বিচার করে সেটির সংশোধিত চূড়ান্ত পাঠ রচনা করেছেন। সারা জীবনে তিনি ‘পাঁচ-ছয় শতাধিক পুঁথি পরিচায়ক ও গবেষণামূলক প্রবন্ধ ও ভূমিকা লিখেছেন, লিখেছেন ইতিহাসবিষয়ক প্রবন্ধ, গ্রন্থসমালোচনা, কিংবা পুস্তক পরিচিতি’ (আহমদ শরীফ)। যে ধৈর্য, শ্রম ও সময় দিয়ে আবদুল করিম এ কাজ করেছেন, তাকে আহমদ শরীফ তাঁর ‘সাধনা ও এবাদত’ আখ্যায়িত করে সঠিক ব্যঞ্জনাই দিয়েছেন। তাঁর নিজের জবানিতেও কথাটা একই—‘প্রাচীন পুথির সন্ধান ও আবিষ্কার আমার যেন ধ্যানের বস্তু হইয়া ওঠে। সারাজীবন আমি ধ্যাননিমগ্ন যোগীর ন্যায় সেই এক ধ্যানেই কাটাইয়াছি।’

বাংলার গ্রামীণ সমাজের চিরায়ত মানবিক চেতনা এই মানুষের মধ্যে সহজাতভাবেই অঙ্কুরিত হয়েছিল। তিনি বরাবর সবার সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক রেখে চলেছেন, হিন্দু-মুসলিম ভেদাভেদ করেননি। ‘পুঁথিও সংগ্রহ করেছেন হিন্দু-মুসলিম অভেদে, তাঁর আগে এমন অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে কেউ পুঁথি সংগ্রহ করেননি’ (আহমদ শরীফ)। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ পত্রিকায় তাঁর লিখিত ‘প্রাচীন পুঁথির বিবরণ’ স্বতন্ত্র পুস্তিকাকারে প্রকাশের সময় ভূমিকায় সম্পাদক স্বনামখ্যাত চিন্তাবিদ রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর লেখায়ও একই কথাই ব্যক্ত হয়েছে: ‘সংকলনকর্তার অধ্যবসায়, পরিশ্রম, বাঙ্গালা-সাহিত্য-অনুগত ধর্মমত সম্বন্ধে উদারতা প্রশংসা করিয়া শেষ করা যায় না।’

তাঁর এই ভেদজ্ঞানহীন মানবিক বোধের কারণেই আবদুল করিম বাংলার মুসলমানের মনে ও মননে বাঙালি হিসেবে আত্মপরিচয়ের উপলব্ধি তৈরির কাজে অগ্রদূতের ভূমিকা পালন করেছেন। মাদ্রাসা ও মোল্লাদের দৌরাত্ম্যে বহুকাল এ দেশের মুসলমানরা বাংলা ভাষা শিক্ষা ও চর্চা থেকে দূরে ছিলেন। নবযুগের শিক্ষিত মুসলমানের আবির্ভাব বিলম্বিত হওয়ার পাশাপাশি মাদ্রাসা-মক্তবের গণ্ডিতে আবদ্ধ মুসলিমসমাজ তার ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে সংশয়ে দিশেহারা ছিল। আবদুল করিম কিন্তু এ বিষয়ে আগাগোড়াই নিঃসংশয়।

তিনি সেই ১৩২০ বঙ্গাব্দে স্পষ্টভাবেই বলেছেন: ‘পুরুষানুক্রমে বাঙ্গালি মুসলমানেরা বাঙ্গালাভাষাই ব্যবহার করিয়া আসিতেছে। বাঙ্গালা ভাষা ভিন্ন অপর কোনও ভাষা বাঙ্গালী মুসলমানের মাতৃভাষা ও জাতীয় ভাষা হইতে পারে না। ইহা আমাদের পূর্বপুরুষগণ বুঝিতে পারিয়াছিলেন এবং তদনুসারে সেই কাজে ব্রতী হইয়াছিলেন।’

লক্ষ করার বিষয়, তিনি যুগপৎ মাতৃভাষা ও জাতীয় ভাষা হিসেবে বাংলার দাবিটি তুলে ধরেছেন। কারণ, মাতৃভাষাই যে জাতীয় ভাষা হতে পারে, এ সমীকরণ ধর্মভিত্তিক জাতীয়তায় আচ্ছন্ন মুসলমানদের মধ্যে অনেকের পক্ষেই বোঝা ও মানা কঠিন ছিল। আবার বাংলাদেশের উদ্ভবের পেছনে এই সমীকরণের সর্বজনীন স্বীকৃতি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। যে কাজ ১৯৭১-এ রাজনৈতিক অঙ্গনে সংগ্রাম ও যুদ্ধের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়েছিল, তার সূচনা ঘটে শতাব্দীর গোড়ার দিকে এই গ্রাম্য, দরিদ্র জ্ঞানবৃদ্ধের কঠিন সাধনালব্ধ দূরদর্শী উপলব্ধিতে। আবদুল করিম এ–ও বোঝেন যে জাতীয় সাহিত্যের পদবাচ্য হতে হলে তা শুদ্ধ ভাষাতেই রচিত হতে হবে। ভাষা সম্পর্কে এই স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর মধ্যে আগাগোড়াই ছিল। ১৯০৩ সালে নবনূর পত্রিকায় প্রকাশিত ‘বঙ্গভাষায় মুসলমানী সাহিত্য’ প্রবন্ধে লিখেছেন: ‘বাঙ্গালী হিন্দুদের সহিত আমরা সর্বতোভাবে এক দশাপন্ন।’ ১৯১৮–তে লিখেছেন: ‘আমাদের মধ্যে কয়েকজন লোক সুবুদ্ধি কি কুবুদ্ধির প্ররোচণায় বলিতে পারি না, বাংলাভাষাকে হিন্দুর ভাষা বোধে বাতিল করিয়া তৎস্থলে উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের উর্দুভাষাকে আপনাদের মাতৃভাষা ও জাতীয় ভাষার স্থলাভিষিক্ত করিবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করিতেছেন।’ আর ১৯৫১ সালে চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত সংস্কৃতি সম্মেলনে মূল সভাপতির ভাষণে তিনি মাতৃভাষা ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধবাদীদের সম্পর্কে বলেন: ‘আজ বোধহয় তাহারা দেশকে পাপে ডুবাইতে চাহেন, যাহারা প্রশ্ন তুলিয়াছেন বাংলাভাষা আমাদের সংস্কৃতির বাহন হইতে পারে না।’

ভাষা আন্দোলনের প্রামাণ্য ইতিহাস গ্রন্থের রচয়িতা বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী বদরুদ্দীন উমর ঠিকই বলেছেন, ‘১৬ই মার্চ ১৯৫১ সালের চট্টগ্রাম সংস্কৃতি সম্মেলনে প্রদত্ত সাহিত্যবিশারদ-এর সভাপতির অভিভাষণটিকে পরবর্তী বিশ বছর ধরে পূর্ব বাংলায় আন্দোলনের যে বিকাশ ঘটে, সেই আন্দোলনের ঘোষণা বললে বিন্দুমাত্র অত্যুক্তি হবে না।’

তাঁর জীবনসাধনা মূল্যায়ন করে বলতে হয়, গ্রামের এই সাধারণ মানুষটি ছিলেন বাংলাদেশের ভাবাদর্শ নির্মাণের এক পুরোধা ব্যক্তি।

[নিবন্ধে ব্যবহৃত সব উদ্ধৃতি আবুল আহসান চৌধুরী সম্পাদিত আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ: ঐতিহ্য-অন্বেষার প্রাজ্ঞ পুরুষ সংকলন গ্রন্থের বিভিন্ন প্রবন্ধ থেকে নেওয়া হয়েছে।]