একজন কবির হাতে

একুশের প্রকাশনা : হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশের প্রথম সংকলন একুশে ফেব্রুয়ারী নিয়ে স্মৃতিচারণা

সৈয়দ শামসুল হক
সৈয়দ শামসুল হক

বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি: ভাষার জন্যে বুকের রক্তদান আর ইতিহাসে সোনালি অভ্যুত্থানের প্রথম সেই দিন আমাদের। ওই অভ্যুত্থানের সংকেতটি আর কারও কাছে নয়, একজন কবির কাছে পৌঁছেছিল, তাঁর নাম হাসান হাফিজুর রহমান। তখন তাঁর বয়স মাত্রই বিশ কি একুশ, বায়ান্নর একুশের মাত্রই আট-নয় মাস পরে তিনি সংকল্প করেন ওই একুশ তারিখটিকে এর পূর্ণ বিভায় ধরে রাখবার জন্যে তিনি একটি সংকলন প্রকাশ করবেন, যার ভেতরে একুশের ইতিহাস, ঘটনাপঞ্জি, একুশ নিয়ে লেখা গল্প, কবিতা ও রেখাচিত্র থাকবে। এ একটা দলিল হয়ে থাকবে, এই ছিল হাসানের অভিপ্রায়। এই সংকলন প্রকাশের প্রত্যক্ষ স্মৃতি বলবার মতো এখন আমরা হয়তো দু-একজনই মাত্র রয়ে গেছি—আনিসুজ্জামান আর আমি।
আজও আমার চোখে ভাসে নিউজপ্রিন্ট প্যাডের কাগজে নীল কালিতে লেখা আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর কবিতাটি, যার প্রথম কয়েকটি পঙ্ক্তি এখন আলতাফ মাহমুদের সুরে আমাদের একুশের গান। আজও আমি স্পষ্ট দেখতে পাই হাসানকে, টেবিলে ঝুঁকে পড়ে প্রুফ দেখছেন সংকলনের। সাইয়দ আতীকুল্লাহকে দেখতে পাই—ওই তিনি হাসানের পাশে টিনের চেয়ারটি টেনে সংকলন প্রকাশ নিয়ে ব্যস্ত উদ্ভ্রান্ত বন্ধুকে সাহায্য করছেন প্রুফ দেখতে কি লেখা বাছাই করতে। ওই তো টগবগে ঘোড়ার মতো মুর্তজা বশীর দাপিয়ে আসছেন তাঁর আঁকা গুলিবিদ্ধ শহীদের স্কেচ নিয়ে। আসছেন আমিনুল ইসলাম সংকলনের প্রচ্ছদ এঁকে। কী অসাধারণ প্রচ্ছদ—কাঁটাতার টানটান হয়ে আছে, তারই ওপরে—নিচে সংকলনের নাম আর হাসানের নাম।
আমি ভুলিনি যে হাসানের সম্পাদনায় একুশের সংকলন একুশে ফেব্রুয়ারী পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছিল—পরে পরে বছরের পর বছর একুশের কত সংকলনই বেরিয়েছে ওরই অনুসরণে। চটি একটি সংকলন, শতাধিক পৃষ্ঠার বেশি নয়, কিন্তু প্রভাবে ও প্রেরণায় কী বিশাল ছিল এই সংকলনটি। এবং এখনো আমাদের ফিরে যেতে হয় হাসানের এই সংকলনটির কাছেই, যদি জেনে নিতে হয় সদ্যই ঘটে যাওয়া একুশে ফেব্রুয়ারির প্রত্যক্ষ তাপতপ্ত ঘটনাপঞ্জি ও তার তাৎক্ষণিক মানসিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া আমাদের।
আর এটাও আমরা লক্ষ করি, সেদিন এই মাটিতে শিল্পে-সাহিত্যে ও মননে-মেধায় যে যুবকেরা ছিলেন অগ্র সারিতে, তাঁদের সবাইকে এই সংকলনের সঙ্গে যুক্ত করতে পেরেছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান। এটিও তাঁর দূরদৃষ্টির আরেকটি প্রমাণ যে ভবিষ্যতের বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ সৃজনশীলরূপে যাঁরা দেখা দেবেন তাঁদের প্রায় সবাইকেই তিনি তাঁদের সেই উষাকালেই শনাক্ত করতে পেরেছিলেন।

.
.

বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির এক বছর পূর্তি উপলক্ষে সংকলনটি বেরোয় তেপান্নর ঠিক একুশ ফেব্রুয়ারি তারিখেই নয়, মার্চের পঁচিশ কি ছাব্বিশ তারিখে—ইতিহাসের নাটকের দিক থেকে তারিখটা চোখে পড়বার মতো, আঠারো বছর পরে মার্চের ওই পঁচিশ-ছাব্বিশ মধ্যরাতেই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন! কী আশ্চর্য সূত্রেই না হাসানের সংকলন ও এর প্রকাশ-কালের সঙ্গে মিলে যায় বায়ান্ন আর একাত্তর, ভাষা আন্দোলন আর মুক্তিযুদ্ধ।
একুশের সংকলন একুশে ফেব্রুয়ারীর প্রকাশক ছিলেন মোহাম্মদ সুলতান, ছিলেন তিনি বামপন্থী রাজনীতির মানুষ, পুঁথিপত্র নামে একটা বইয়ের দোকান দিয়েছিলেন, দোকানটা ছিল ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের ঠিক পশ্চিম দিকে, রাস্তার ওপারে, একটা টিন ছাপরাঘরে, বই আলমারির পেছনে ছিল সরু এক চিলতে জায়গা, সেখানে সিঙ্গল একটা সস্তা চৌকি, সুলতান থাকতেন ওখানেই।
সংকলনটি বেরুতে মাস খানেকের দেরিটা হয়েছিল প্রেসে ছাপার টাকা পুরো শোধ করা যায়নি বলে, প্রকাশক হিসেবে মোহাম্মদ সুলতানের নাম ছাপা হলেও হাসানেরই পুরো টাকায় সংকলন, আর সে টাকার জন্যে হাসানকে তাঁর দেশের বাড়িতে গিয়ে পারিবারিক মাঠের উৎপন্ন পাট বিক্রি করতে হয়—পিতার আড়ালে কিন্তু মায়ের গোপন অনুমোদনে, আর দ্বিতীয়বার ওই রকম একটা প্রয়োজনীয় চৌর্যের জন্যে তাকে আবার যেতে হয় প্রেসের বিল শোধ করবার টাকার জোগাড়ে, সেবার পিতার অলক্ষ্যে পাট বিক্রিটা বোধ হয় তৎক্ষণাৎ করা যায়নি, সুযোগটা ঠিক হচ্ছিল না, দেরিটা সেই কারণেই।
জগন্নাথ কলেজের পেছনের গেট ওপারেই পাটুয়াটুলী—পোশাকি নাম লয়াল স্ট্রিট—গেট পেরুলেই সওগাত প্রেস, প্রেসের সমুখে একফালি খালি জায়গা, একটা ডালিমগাছ, তার পাশে নাসিরউদ্দীন সাহেবের গাড়ি, নিজেই তিনি দয়াগঞ্জ থেকে হালকা সবুজ ছোট্ট অস্টিন গাড়িটা চালিয়ে আসেন সকাল নয়টার মধ্যেই, সন্ধেরও অনেক পরে ফিরে যান, কলকাতা থেকে চলে আসবার পর বন্ধ হয়ে যাওয়া সওগাত আবার বের করছেন, মহিলাদের সাপ্তাহিক বেগম পত্রিকাটির প্রকাশও তিনি বন্ধ রাখেননি, আর এই বেগম-এর সম্পাদকীয় দায়িত্ব তিনি দিয়েছিলেন হাসানকে, সওগাত-ও হাসানের হাতেই তিনি দিয়েছেন।
হাসান বসতেন নাসিরউদ্দীন সাহেবের ঘরের পাশেই আর একটা বড় ঘরে, রিম রিম কাগজের স্তূপে ঘরটাকে গুদামঘরই বলা যায়, ওখানে ছিল একটা টেবিল আর কয়েকটা চেয়ার, ওই টেবিলে কাজ করেন হাসান, ঘরটা বেশ বড় ছিল বলে, ওই গুদামঘরেই পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের পাক্ষিক আসর বসত। ওই সংকলনটির সমস্ত কাজ—লেখা চাওয়া, লেখা আনা, পরে পরে লেখাগুলো সাজানো, প্রুফ দেখা, আমিনুল ইসলামকে দিয়ে প্রচ্ছদ করানো, মুর্তজা বশীরকে দিয়ে স্কেচ করানো, সবই হাসান করেছিলেন সওগাত-এর ওই ঘরটিতে বসে, সাপ্তাহিক বেগম-এর জন্যে সম্পাদকীয় সব দায়িত্ব, এমনকি নামী-বেনামীতে কিছু লেখা আর উল বোনার দুরূহ বর্ণনার প্রুফ পর্যন্ত দেখার ফাঁকে ফাঁকে।
একুশের ওই সংকলনে হাসান নিজে লিখছেন একুশের ওপর তাঁর সেই মৃত্যুহীন কবিতাটি, যার শেষদিকে তিনি উচ্চারণ করছেন—
‘এখানে আমরা ফেরাউনের আয়ুর শেষ কটি বছরের ঔদ্ধত্যের মুখোমুখি/ এখানে আমরা পৃথিবীর শেষ দ্বৈরথে দাঁড়িয়ে।’
কী সত্য এই উচ্চারণ! কবিই যে ভবিষ্যৎ-দ্রষ্টা, তারই সাক্ষ্য দেয় এই কথাটি। সত্যিই তো, ফেরাউনের পতন যে অচিরেই, আর মাত্র আঠারো বছর পরেই হবে, কবি ছাড়া, হাসান ছাড়া আর কে এমন দেখতে ও বলতে পারতেন? কিংবা বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর ছাড়া আর কে?—যখন তিনিও তাঁর কবিতায় ভাষাশহীদ বরকতকে নিয়ে বলেন—
‘বরকতের চোখে বুঝি ভবিষ্যত বুঁজে আছে।’

প্রচ্ছদ ১৯৫২ সালে অাঁকা মুর্তজা বশীরের লিনোকাট ও একুশে ফেব্রুয়ারী সংকলনে প্রকাশিত তিনটি রেখাচিত্র অবলম্বনে
প্রচ্ছদ ১৯৫২ সালে অাঁকা মুর্তজা বশীরের লিনোকাট ও একুশে ফেব্রুয়ারী সংকলনে প্রকাশিত তিনটি রেখাচিত্র অবলম্বনে

আর, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ্। তিনি থাকতেন লক্ষ্মীবাজারে, আমিও—কয়েকটা বাড়ি পরেই, প্রায়ই আমরা একসঙ্গে বেরুতাম সাহিত্যিক হানা দিতে শহরে। সংকলনের প্রস্তুতিকালে একদিন আমরা এলাম সওগাত-এ, হাসানের কাছে ওবায়দুল্লাহ্ একুশের ওপর একটা কবিতা দেবেন জানতাম, কিন্তু কী কবিতা তখনো জানি না। বেলা তখন দুপুর, নাসিরউদ্দীন সাহেব পাশের ঘরেই তাঁর আপিসে, তাঁর কাছে দরখাস্ত করে দুপুরের খাবারের জন্যে টাকা আনা হয়েছে। খাওয়া-দাওয়া শেষে জুৎ করে সিগারেট ধরিয়ে ওবায়দুল্লাহ্ পকেট থেকে তাঁর সদ্য লেখা কবিতাটা বের করে পড়ে শোনালেন। সেই কবিতা—‘কুমড়ো ফুলে ফুলে নুয়ে পড়েছে লতাটা।’
শুনে খুব অবাক হলাম, ওবায়দুল্লাহ্ এত দিন পর্যন্ত তাঁর সব কবিতাই ছড়ার আঙ্গিকে লিখেছেন, এতেই তাঁর প্রসিদ্ধি, কিন্তু এ কবিতা যে নিপাট গদ্যে লেখা! কবিতাটি শুনে গাঢ়স্বরে হাসান বলে উঠলেন, তুমি একটা নতুন প্রতীক দিলে আমাদের। তারপরেই বললেন, মায়ের প্রতীকটা পুরোনো, কিন্তু তুমি এতে নতুন একটা ব্যঞ্জনা এনেছ, এটা টিকে যাবে, এটাই থেকে যাবে।
হাসানের কথাটা যে কতদূর সত্য ছিল, আজ বুঝতে পারি—যুদ্ধ এবং মা! আন্দোলন এবং মা! কিন্তু ওবায়দুল্লাহ্ একা নন, ফজলে লোহানীও ওই সংকলনে যে-কবিতাটি লেখেন, ওতেও দেখি মায়েরই উল্লেখ—
‘মাগো, ভাবনা কিসের? আসছে ছুটিতে আবার
ফিরবো তোমার কোলেই।
শহীদ ছেলের শেষ কথাগুলো মনে পড়ে যায়
একলা রাতে।’
এই মায়েরই সাক্ষাৎ আমরা পাই হামিদুর রাহমান আর নভেরা আহমেদের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার কল্পনায়—যেন লোহানী আর ওবায়দুল্লাহ্ই সেই মা—মধ্যভাগে, সন্তানদের দুপাশে নিয়ে, শোকে অবনত।
এর মধ্যে ঝড়ের মতো ঘরে ঢুকলেন আনিসুজ্জামান, তিনি তাঁর শার্টের পকেট থেকে যে গল্পটি হাসানের হাতে তুলে দিলেন—শিরোনাম, দৃষ্টি—মুক্তোর মতো অক্ষর, কিন্তু মাপে আর তাঁর আগের গল্পের মতো তেমনটি ছোট নয়, বেশ বড়ই, একেবারে তাঁর অভ্যেসের বাইরেই—পেছনের দিকে তাকিয়ে এখন আমার মনে হয়, ভাষা আন্দোলনের ওপর কবিতা বা গল্প লিখতে গিয়ে ওবায়দুল্লাহ্ কি আনিস যে তাঁদের চিরাচরিত পথ থেকে সরে এসেছিলেন, এটা বিশেষভাবে লক্ষণীয় এবং গভীরে অনেক তাৎপর্যপূর্ণ।

হাসান হাফিজুর রহমান, ছবি: নাসির আলী মামুন, ফেটাজিয়াম
হাসান হাফিজুর রহমান, ছবি: নাসির আলী মামুন, ফেটাজিয়াম

শুধু কি ওঁদেরই ওই নতুনতর কলম হাতে নেওয়া?—আমার কথাটা বলি, হাসানের ওই সংকলন আমাকেও একটি নতুন কলম হাতে তুলে দেয়! হাসান তাঁর একুশে ফেব্রুয়ারী সংকলনটির জন্যে আমাকে একটি গল্প লিখতে আদেশ করেছিলেন, কিন্তু একেবারেই নবীন লেখক বলে তিনি আমার জন্যে বরাদ্দ রেখেছিলেন এক পৃষ্ঠা। মাত্রই এক পৃষ্ঠা! এক পৃষ্ঠার একটি গল্প! হয়? খুব হয়! কেন, আনিসুজ্জামান লিখছেন না এক পৃষ্ঠার গল্প? বনফুলের কথা কি ভুলে গেছি? অতএব, সওগাত আপিস থেকে বেরিয়ে, লক্ষ্মীবাজারের বাড়িতে এসে, বারান্দায় বেড়া ঘেরা আমার একফালি ঘরে চৌকির ওপর খাতা ফেলে এক পৃষ্ঠার মধ্যে বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে গল্প ফাঁদতে আমিও লেগে যাই।
দিন পরে দিন যায় গল্প আর হয়ে ওঠে না, এক পৃষ্ঠার মধ্যে তো নয়ই, ওদিকে প্রেসে কপি দেবার দিন যত ঘনিয়ে আসে হাসানের তাগিদও তত বাড়তে থাকে, রোজই তাঁকে কথা দিই—কালকেই! সেই আগামীকাল আর আসে না, আমাদের বাড়িতে তখন বিদ্যুতের ব্যবস্থা নেই, লণ্ঠনেরই আলো, সে আলোও তেলের তলানিতে এসে প্রচুর ধোঁয়া ছেড়ে মধ্যরাতে ফুস করে নিভে যায়, যেতে থাকে, রাতের পর রাত, গল্প আর হয় না, একদিন দুপুরে কাঁচুমাচু হয়ে হাসানের কাছে যাই।
কাঁচুমাচু কি আমি একাই—শামসুর রাহমানেরও ওই এক অবস্থা, একুশে নিয়ে কবিতা তাঁর কলমে আসছে না—ভাবা যায়!—সেই কবি যাঁর হাত দিয়ে একদিন বেরুবে দুঃখিনী বর্ণমালা নিয়ে অবিস্মরণীয় কবিতা!—নতুন কবিতা লিখতে না পেরে শামসুর রাহমান পার পেলেন কিছুদিন আগেই কাশ্মীরে রক্তপাত নিয়ে লেখা ও রেডিওতে পড়া তাঁর এক কবিতাকে ঈষৎ বদলে হাসানের সংকলনের জন্যে পেশ করে। সেটাই বোধ হয় শামসুর রাহমানের অভ্যেসের বাইরে গদ্যছন্দে লেখা তাঁর প্রথম কবিতা, আর ওই কবিতাটির জন্মান্তর ঘটিয়েছিলেন বলেই তিনি তাঁর কোনো বইতেই রচনাটিকে আর রাখেননি। কাশ্মীর থেকে একুশেতে জন্মান্তরের প্রত্নটি আজও ওই একুশের সংকলনে শনাক্ত করা যাবে তাঁর এমন পঙ্ক্তিতে—
‘...কোনো পেশওয়ারী ফলওয়ালা তার ধারালো ছুরির হিংস্রতায়/ ফালি ফালি করে কেটে ফেলে তাজা, লাল টকটকে একটি আপেল।’
আমাকে কাঁচুমাচু দেখেই হাসান জানতে চাইলেন, গল্প কই?—হয়নি।—হয়নি মানে?—এক পাতায় পারছি না!—পারছেন না, মানে? আমারও কাতরধ্বনি, এক পাতায় গল্প ধরানো, আমাকে দিয়ে হবে না! হাসান তখন নির্নিমেষ আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হুংকার দিয়ে উঠলেন, গল্প না হয়, কবিতা লিখে আনুন!—কবিতা!! হাসান ধমক দিয়ে উঠলেন, কেন হবে না? যান! কালকেই আমি কবিতা চাই! নইলে বাদ পড়ে যাবেন!
বলে কী! বাদ পড়ে যাব! হতেই পারে না! সে রাতেই আমি বসে যাই একটি কবিতা লিখতে, সওগাত থেকে অবসন্ন আমি স্যান্ডেল ঘষে ঘষে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফেরতা, আমার মাথার ভেতরে গুঞ্জন করে ওঠে একটি পঙ্ক্তি—সভ্যতার মণিবন্ধে সময়ের ঘড়ি! হ্যাঁ, আমারই তো এ পঙ্ক্তি। কবিতারই কি! বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির ভেতরে সভ্যতা ও কালের যাত্রা আমি অনুভব করে উঠি, প্রায় এক বসাতেই আমি লিখে উঠি আঠারো পঙ্ক্তির কবিতাটি। পরদিন হাসানের হাতে যখন তুলে দিই, ভেবেছিলাম হাত লাগিয়ে তিনি কাঁচা এই রচনাটিকে ক্ষতবিক্ষত করবেন, কিন্তু না! একটি শব্দও তিনি কাটলেন না! এমনকি, পয়ারে লিখতে গিয়ে কতই না পতন ঘটেছে ছন্দের, সেটিও তাঁর তখন গণনায় এল না।
আজ মনে হয়, হাসানের যে অভ্যেস ছিল গদ্যছন্দে লেখার, আমাদের মধ্যে তিনিই প্রথম গদ্যকেই যে কবিতার জন্যে ব্যবহার করেন, সেই তাঁর কাছে বোধ হয় মনে হয়েছিল—এটিও পয়ারে নয়, গদ্যেই আমি লিখেছি। এখন আমার কাছে আর আমার ওই কবিতায় পয়ারের ভুলটিকে ভুল আর মনে হয় না, কারণ, ইংরেজিতে যাকে ফ্রি ভার্স বলা হয়, মুক্তছন্দ বাংলায় যাকে বলতে পারি, ইংরেজি সেই ফ্রি ভার্সের শরীরটা গদ্যের, কিন্তু কোনো কোনো পঙ্ক্তিতে তার থাকে ও থাকবে প্রসিদ্ধ কোনো না কোনো ছন্দের স্পন্দন। অজান্তে আমার কলমেও সেদিন সেটি হয়েছিল।
আজও যে আমি কবিতা লিখছি, এ হাসানেরই জন্যে, সেই হাসান যিনি আমার কবি-কারক, আমার নিবিড়তম সুখদুঃখভাগী, কত নিবিড় অভিজ্ঞতার স্বাদসঙ্গী ও অকুণ্ঠতম মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী। এ সবই একদিন চলে যাবে ঘাসের তলায়, যেমন তিনি গেছেন, শুধু থেকে যাবে—কাজ! আমাদের কাজ, যদি তা আমাদের সময় ও মানুষের জন্যে কিছুমাত্র প্রাসঙ্গিক ও ব্যবহার্য হয়ে থাকে।
কাজ! হাসান হাফিজুর রহমান পঞ্চাশের দশকের আমাদের মধ্যে একমাত্র যিনি কাজটাকে বড় বলে মনে করতেন। রাজনীতি তাঁর শিরায় প্রবাহিত হতো, দলীয় রাজনীতি নয়, বাঙালির ভবিষ্যৎমুখী রাজনীতি—জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বের বিরোধী রাজনীতি, বাঙালির জাগরণের রাজনীতি। এরই প্রমাণ পাই যখন তিনি উনিশ শ পঞ্চাশে ঢাকায় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা হয়ে যাবার পরপরই প্রকাশ করেন দাঙ্গার পাঁচটি গল্প, নিজের টাকায়। এবং বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হলো তখন হাসান যে দায়িত্ব নিলেন মুক্তিযুদ্ধের দলিল সম্পাদনার, এর প্রতিটি কাজই তাঁকে মহত্তম এক বাঙালি করে তুলেছে আমাদের সময়ের।
একুশের সংকলন হাসান যখন করেছিলেন তখন তিনি ভাবতেও পারেননি এর অনুসরণে পরের বছর থেকেই কত সংকলন একুশকে কেন্দ্র করে বেরুতে থাকবে। কিন্তু আজ তাকিয়ে দেখি, একুশ আমাদের বইমেলা দিয়েছে, বই প্রকাশের মাস নির্ণয় করে দিয়েছে, কিন্তু কেড়ে নিয়েছে সংকলন করবার প্রেরণা। একুশ নিয়ে সংকলন করবার কথা আজ আর কেউ ভাবেনই না। এর কারণ কি এটাই যে আমরা গণহত্যা এবং মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে গেছি? আর, এরই কাছে ম্লান হয়ে গেছে একুশ? অথচ এই একুশ থেকেই তো শুরু, একুশে ফেব্রুয়ারি থেকে ছাব্বিশে মার্চ, বায়ান্ন থেকে একাত্তর।
হাসান বেঁচে থাকলে আজ তাঁর বয়স হতো তিরাশি। আজ বেঁচে থাকলে, আমি কল্পনা করি, তিনি একটি নতুন সংকলনের কথা ভাবতেন একুশকে নিয়ে। বাংলাকে আমরা কোথায় রেখেছি, কীভাবে রেখেছি, এ নিয়ে তীব্র কষাঘাত রূপেই হাসান সংকলনটি করতেন বলে আমি বিশ্বাস করি। তেপ্পান্নতে হাসানের একুশের সংকলন সম্পাদনার স্মৃতি বয়ানের চেয়েও আমি অধিক বোধ করছি আজকের দিনে একুশকে নিয়ে, আমাদের ভাষাকে নিয়ে, আমাদের ভাষা ব্যবহার ও জাতীয় জীবনে মাতৃভাষার অবস্থান নিয়ে নতুন সংকলনের পর সংকলন প্রকাশের তাগিদ আজকের হাসানদের জন্যে রেখে।