যৌন নিপীড়নের অভিযোগ সাড়ে তিন শ ফুটবলারের

যৌন নির্যাতনের অভিযোগের ধাক্কায় কেপে উঠেছে ইংলিশ ফুটবল। প্রতীকী ছবি
যৌন নির্যাতনের অভিযোগের ধাক্কায় কেপে উঠেছে ইংলিশ ফুটবল। প্রতীকী ছবি

এ নিয়ে অনেক কানাঘুষা শোনা যেত। আড়ালে আবডালে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করতেন। অনেকেই তেমন কিছু নয় বলে উড়িয়ে দিত। কিন্তু ইংলিশ ফুটবলে যৌন নিপীড়ন যে আর হাসি ঠাট্টার বিষয় নয় সেটি বোঝা যাচ্ছে ধীরে ধীরে। এরই মাঝে ৩৫০ ফুটবলার পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছেন, কৈশোরে তাঁরা কোচিং স্টাফদের কাছে যৌন নিগ্রহের শিকার হয়ে​ছিলেন। 

সাড়ে তিন শ সংখ্যাটি এখনো প্রাথমিক। এটি আরও অনেক বাড়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিতে পারছেন না কেউ। যৌন নিগ্রহ এমনই এক বিষয়, যেখানে নির্যাতনে শিকার যে হন, অধিকাংশ সময়ই গোপন রেখে দেন। ফুটবলে এটি আরও বেশি করে ঘটে। আশপাশের মানুষের হাসি ঠাট্টার বস্তু হতে না চাওয়া, ফুটবল ক্যারিয়ার যেন শেষ না হয়ে যায়, উঠতি ফুটবলারের অসহায়ত্ব—সবকিছুই এসব ক্ষেত্রে যৌন নির্যাতনকারীর পক্ষে যায়।
ইংলিশ ফুটবলে কিশোরদের ওপর যৌন নির্যাতন নতুন কিছু নয়। আগেও বেশ কয়েকজন একাডেমি কোচকে এ অভিযোগে শাস্তি পেতে হয়েছে। কিন্তু বিষয়টি যে এমন ভয়ংকর মাত্রায় ছড়িয়ে আছে সেটি জানা গেছে অ্যান্ডি উডওয়ার্ডের দেওয়া সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে। ৪৩ বছর বয়সী সাবেক এই ফুটবলার নভেম্বরে প্রকাশ্যে অভিযোগ তোলেন ব্যারি বেনেলের বিরুদ্ধে। বেনেল ছিল ক্রুয়ে আলেক্সান্ডার কোচ। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের বড় বড় দলগুলোর সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকায় এবং কিশোর ফুটবলার গড়ায় বেনেলের সুনাম থাকায় উডওয়ার্ডকে পাঠানো হয় তার কাছে।
১১ বছর বয়সে উডওয়ার্ড ক্রুয়ে যোগ দেওয়ার পর থেকেই তাঁর ওপর যৌন নির্যাতন চালানো শুরু করে বেনেল। শারীরিক শাস্তি ও ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন—এ দুটিকেই অস্ত্র বানিয়ে বেনেল নির্যাতন চালিয়েছেন উডওয়ার্ডের ওপর। সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার, উডওয়ার্ডের বয়স যখন ১৮, তখন তাঁর বড় বোনকে বিয়ে করে বেনেল! এ পুরোটা সময় তাঁর ওপর নির্যাতন চালিয়েছে বেনেল। শুধু উডওয়ার্ড নন, ক্রুয়ের আরও বেশ কিছু কিশোরের ওপর চলে বেনেলের এ অত্যাচার। ১৯৯৮ সালে এ রকম নাম না প্রকাশ করার শর্তে এমন ছয়জন ফুটবলার বেনেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে ৯ বছরে জেল হয় এই কোচের। উডওয়ার্ড ছিলেন এই ছয়জনের একজন।
এত বছর পর নিজের নাম প্রকাশ করার পেছনে উডওয়ার্ড জানান, যেন তাঁকে দেখে অন্যরাও সাহস পান। তাঁর ধারণা, বেনেলের মতো এমন অনেক শিশু-নির্যাতক লুকিয়ে আছে ইংলিশ ফুটবলে, বিভিন্ন একাডেমিতে।
উডওয়ার্ডের এমন সাক্ষাৎকারের পর মৌচাকে যেন ঢিল পড়ে! স্টিভ ওয়াল্টার ও ডেভিড হোয়াইটের মতো সাবেক ফুটবলাররাও নীরবতা ভেঙে জানান বেনেলের কাছে নির্যাতনের শিকার হওয়ার কথা। এরপর মুখ খোলেন সাবেক নিউক্যাসল মিডফিল্ডার ডেরেক বেল। ৫২ বছর বয়সী এই ফুটবলার বিস্তারিত জানান, কীভাবে তাঁর অসহায়ত্ব ও তাঁরা বাবা-মার সরলতার সুযোগ নিয়ে দিনের পর দিন তাঁকে নির্যাতন করেছে নিউক্যাসল কোচ জর্জ অরমন্ড। বেলের অভিযোগ নিউক্যাসলের কাছে অভিযোগ করেও সহযোগিতা পাননি তিনি কিংবা তাঁর মতো অন্যরা। উল্টো ক্লাব সেটা ধামা চাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছে! ক্লাবটি একাডেমিতে কিশোর ফুটবলারদের সঙ্গে ২৪ বছরেরও বেশি সময় ধরে কাজ করা অরমন্ডের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন ডেভিড ইটকও।
এরপরই ঝড় ওঠে ইংলিশ ফুটবলে। কাল পর্যন্ত পুলিশের ১৭টি তদন্ত দল গঠন করা হয়েছে। একটি বিশেষ হেল্প লাইনও খোলা হয়েছে , যেন নির্যাতনের শিকার হওয়া ফুটবলাররা অভিযোগ জানাতে পারেন। প্রথম দুই ঘণ্টাতেই ৫০টি ফোন এসেছে সে হটলাইনে। ২৪ থেকে ৩০ নভেম্বর—এ কদিনেই সাড়ে তিন শ নির্যাতনের শিকার হওয়া ব্যক্তি অভিযোগ করেছেন শৈশব-কৈশোরের নির্যাতকদের বিরুদ্ধে। শুধু ম্যানচেস্টারেই ৩৫ জন অভিযোগকারীর কাছ থেকে ১০ জন সম্ভাব্য অপরাধীর নাম পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
অনেক বিশেষজ্ঞই ইংলিশ ফুটবলের সবচেয়ে কঠিন সময় বলে অভিহিত করছেন একে। অনেকে অভিযোগ তুলেছেন, ক্লাবগুলো ইচ্ছে করেই এত দিন চোখ বন্ধ করে রেখেছে এসব অভিযোগে। ফুটবলারদের মুখ বন্ধ রাখতে বাধ্য করেছে। সত্তরের দশকে চেলসিতে যোগ দিয়েছিলেন গ্যারি জনসন। তখনকার ১৩ বছর বয়সী জনসনকে প্রধান স্কাউট এডি হিথের যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন। এই সাবেক ফুটবলার অভিযোগ করেছেন, এ তথ্য লুকিয়ে রাখার জন্য তাঁকে ৫০ হাজার পাউন্ডও দিয়েছিল চেলসি!
এসব ফুটবলারের অধিকাংশই কৈশোরে এই ভয়াবহতা কাটিয়ে উঠতে পারেন না। অধিকাংশেরই শেষ পর্যন্ত পেশাদার ফুটবলে আসা হয় না। যে কয়েকজন আসতে পারেন তাঁরাও সফলভাবে শেষ করতে পারেন না। অ্যান্ডি উডওয়ার্ড ও ডেরেক বেল দুজনই বেশ কয়েকবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন, নিজেদের অসহায়ত্বের কথা বলতে না পেরে।
ইংল্যান্ড অধিনায়ক ওয়েইন রুনি প্রাক্তন ফুটবলারদের এমন ঘটনায় পাশে দাঁড়িয়েছেন, সবাইকে আহ্বান করেছেন সত্য প্রকাশের, ‘এটা ভয়ংকর যে, আমরা যে খেলাটা খেলি এবং ভালোবাসি, সেটা খেলার সময় এমন অত্যাচারের মধ্যে যেতে হয়েছে তাঁদের। অ্যান্ডি খুবই সাহসী, তিনি এগিয়ে এসেছেন, আমি অন্যদেরও এগিয়ে আসতে বলব যারা অত্যাচারের শিকার হয়েছে কিংবা হচ্ছে। মানুষের এসব জানা উচিত, এসব বলতে হবে। সবাই সাহায্য করতে প্রস্তুত, নীরবে এমন অত্যাচার সহ্য করবেন না।’