ভলিবল বদলে দিয়েছে তাঁকে

আল-জাবীর
আল-জাবীর

কুড়িগ্রামের রৌমারিতে বিদ্যুৎ নেই। সৌরশক্তিতে চলে সবকিছু। সাঈদ আল-জাবীরের তাতে কোনো সমস্যা হয়নি। বরং নিজেই রীতিমতো ‘বিদ্যুতের আলো’ বিলিয়েছেন! গোটা ইউনিয়নে নাকি তাঁর সেই আলো ছড়িয়ে পড়েছিল মেঠো পথে।
স্থানীয় সাংসদ তাঁর ভাইয়ের নামে ভলিবল টুর্নামেন্ট করেছেন রৌমারিতে। বাংলাদেশ ভলিবল দলের অধিনায়ক ও তাঁর ছয় সতীর্থকে পেয়ে ওই টুর্নামেন্ট উত্তেজনায় কাঁপছিল গত কয়েকদিন! ফাইনাল হয়ে গেছে পরশু। এর আগের দিন নাকি ওখানে একটা বিয়ে ছিল। কিন্তু বিয়েতে দেখা গেল অতিথি সংকট। কিশোর, যুবক, প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ—সব গেছেন ভলিবল দেখতে। সেটিও নাকি ১০-১২ মাইল দূরে!
এসব বলতে বলতে ফোনে আল-জাবীরের হাসি থামেই না, ‘জানেন, গ্রামগঞ্জে ভলিবল মানে বিশাল আয়োজন। ওটা ঢাকায় বসে কেউ বুঝবে না।’ কথাটা ঠিকই। ভলিবলের আবেদন আসলে এমনই। ঢাকায় ক্রিকেট-ফুটবলের দিকেই হয়তো সবার চোখ থাকে। ভলিবলের খোঁজ কেউ রাখে না। কিন্তু ঢাকার বাইরে পুরো ভিন্ন ছবি। সেটা ভালোই বুঝতে পারছেন না আল-জাবীর, ‘আমার তো মনে হয় ফুটবল আর ভলিবলেই ঢাকার বাইরে সবচেয়ে বেশি খেলা হয়। তার ওপর এখন আবার শীত! ভলিবলের মহোৎসব চলছে এখন গ্রামে-ইউনিয়নে।’
ভলিবলের এই বিস্ফোরণ হঠাৎ নয়, গ্রামে এটি খুব জনপ্রিয় খেলা। তারওপর কদিন আগে ঢাকায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক ভলিবলে বাংলাদেশ দল চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় গ্রামে এটির আয়োজন আরও বেড়েছে। আগের চেয়েও ব্যস্ততা বেড়েছে জাতীয় দলের খেলোয়াড়দেরও। বঙ্গবন্ধু টুর্নামেন্টের তিন সপ্তাহও পার না হতেই জাতীয় দলের চনমনে অধিনায়ক আল-জাবীর খেলে ফেলেছেন অন্তত ১০টি ম্যাচ। ‘গত ১৫ দিনে গাজীপুর, নরসিংদী, সিরাজগঞ্জে খেলে কুড়িগ্রাম শেষ করলাম মাত্রই। কক্সবাজারে আমন্ত্রণ থাকলেও যাইনি। ঢাকার বাইরে প্রচুর ভলিবল টুর্নামেন্ট হচ্ছে। তাই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত টানা খেলা আছে হাতে।’ খেলা নিয়ে ব্যস্ততার কথা বলতে বলতে রোমাঞ্চিত আল-জাবীর।
খেলা মানেই হাতে টাকা আসে। ফুটবল-ক্রিকেটারদের মতো না হোক, অন্তত কিছু নগদ প্রাপ্তি তো হয়। সার্ভিসেস দলের চাকরি ছাড়া আর কোনো প্রাপ্তিই নেই ভলিবল খেলোয়াড়দের। কিন্তু ঢাকার বাইরে ভলিবলে ম্যাচপ্রতি কখনো কখনো নাকি ২০ হাজার টাকাও দাম ওঠে। গড়পড়তা ৮-১০ হাজার টাকা থাকেই। এই প্রাপ্তিটা আগেও ছিল, বঙ্গবন্ধু টুর্নামেন্টের পর বেড়েছে, সঙ্গে পরিচিতিও। যেটি নিয়ে তাঁদের অনেক দিনের আক্ষেপ। এখন যেখানেই যান, শুনতে হয়, ‘ভাই আপনি ভলিবলের জাবীর!’
তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে আরও বড় কিছু। ২৭ জানুয়ারি বড় সংবর্ধনা পাবেন জাতীয় দলের সুদর্শন এই অধিনায়ক। এটা দেবে সাতক্ষীরার কলারোয়ায় জাবীরের স্কুল। এলাকায় নাকি এ নিয়ে হুলুস্থুল চলছে। কিরগজিস্তানকে হারিয়ে এশিয়ার মধ্যাঞ্চলে গ্রুপসেরা বাংলাদেশ দলকে নেতৃত্ব দেওয়া আল-জাবীর কখনো এমন সংবর্ধনা কল্পনাও করেননি।
তাঁর উঠে আসাসহ সবকিছু নিয়ে তৈরি একটি প্রামাণ্যচিত্র ওই দিন প্রজেক্টরের মাধ্যমে স্কুলের ছেলেমেয়েদের দেখানোর কথা। স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর এই প্রথম আন্তর্জাতিক ট্রফি জয় গ্রামের মানুষ উদ্যাপন করতে চায় জাবীরকে নিয়ে। বিখ্যাত ভলিবল খেলোয়াড় ইয়াদ আলীরা যা পারেননি, আল-জাবীররা তাই করেছেন। স্বাভাবিকভাবেই শিহরিত জাবীর, ‘যা খবর পাচ্ছি এলাকা থেকে, সবাই নাকি খুব উচ্ছ্বসিত।’
ভলিবলে এসে এখন আর কোনো হতাশা নেই তাঁর। সেটি দূর করছে ঢাকার বাইরে প্রায় প্রতি ম্যাচেই আসা ৫-১০ হাজার দর্শকের উন্মাদনাও। তবে বিড়ম্বনাও অনেক। গ্রাম বনাম গ্রাম, উপজেলা বনাম উপজেলা, ভলিবল লড়াইয়ে বারুদ অনেক সময় ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেয় অন্যদিকে। ভলিবল কোর্টে অল্প জায়গায় দর্শক থাকে প্রায় ঘাড়ের ওপর। পান থেকে চুন খসলেই লাফিয়ে পড়ে সবাই কোর্টে। এমন সময় নিরাপত্তার খোঁজে দিতে হয় ভোঁ-দৌড়! যে অভিজ্ঞতা আছে জাবীরেরও।
এটা সুখের মধ্যে একটা অসুখই। পারিশ্রমিক নিয়ে আয়োজকেরা টালবাহানা করে কখনো কখনো। ‘একবার সিরাজগঞ্জে আয়োজকেরা অর্ধেক টাকা দেয় আগে। ম্যাচের পর বাকি অর্ধেক না দিয়ে ওরা হাওয়া! ওদের বাড়ি গিয়ে পরে কাপড়চোপড় নিয়ে আসি আমরা, হা হা।’ মজা করেন আল-জাবীর। ব্যতিক্রমী সংগঠকও আছে। জাবীর বলে যান, ‘গাজীপুরের কাপাসিয়ায় এক রাজনৈতিক নেতার আত্মীয় ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারে কাপাসিয়া যান ভলিবল ম্যাচ দেখতে। মায়ের নামে টুর্নামেন্টটা করেছেন তিনি। বুঝুন অবস্থা!’
সেই ভলিবলের সাম্রাজ্যে ইতালির খেলোয়াড় ইভানকে আদর্শ মানেন আল-জাবীর। দুজনই একই পজিশনে খেলেন। তবে কখনো দেখা হয়নি নিজের নায়কের সঙ্গে। যদিও ছোটবেলায় ক্রিকেটার হতে ঢাকায় এসে সচ্ছল পরিবারের ছেলেটি পাকেচক্রে হয়ে গেছেন ভলিবল খেলোয়াড়। তাঁর পাশের ইউনিয়নের মোস্তাফিজুর রহমান, সৌম্য সরকাররা অবশ্য ক্রিকেটার হতে পেরেছেন। এসব নিয়ে সব আক্ষেপও এখন দূর হয়ে গেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর জাবীরের মন থেকে। বদলে যাওয়া ভলিবল-জীবনটাই বরং উপভোগ করছেন।