ডাউলিংয়ের সঙ্গে এক সকাল

গ্রাহাম ডাউলিং l প্রথম আলো
গ্রাহাম ডাউলিং l প্রথম আলো

রিকার্টন রোডে এসে তিনি একটি কফি শপে বসে ফোন দেবেন। তারপর তাঁর সঙ্গে দেখা করে হাতে তুলে দেওয়া হবে কিছু উপহার। কফি পান করতে করতে কথা হবে তাঁর জীবন, ক্রিকেট-দর্শন এবং বাংলাদেশের স্মৃতি নিয়ে। গ্রাহাম ডাউলিংয়ের সঙ্গে এমনই কথা ছিল। কিন্তু ফোন না করে ভদ্রলোক যে সরাসরি হোটেলে চলে এসে দরজায় টোকা দিয়ে ঘুম ভাঙাবেন, সেটা কে জানত!

গ্রাহাম ডাউলিংয়ের অনেক পরিচয়। নিউজিল্যান্ডের সাবেক অধিনায়ক, সাবেক ওপেনার এবং দুর্দান্ত একজন ফিল্ডার। ১৯৬১ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯৭২ সালের মার্চ পর্যন্ত নিউজিল্যান্ডের হয়ে ৩৯টি টেস্ট খেলেছেন। ক্যারিয়ার ওই সময়ের বিবেচনায় মোটামুটি বর্ণাঢ্য। ১৯টি টেস্টে নিউজিল্যান্ডের অধিনায়ক, যার শুরু ভারতের বিপক্ষে দেশকে জয় এনে দিয়ে। তিনটি সেঞ্চুরির সবগুলোই ভারতের বিপক্ষে। এর মধ্যে নিজ শহর ক্রাইস্টচার্চে ২৩৯ রানের ইনিংসটি খেলতে উইকেটে কাটিয়েছেন ৯ ঘণ্টা সময়। ১৯৭০ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্টে আপত্কালীন কিপিং করতে গিয়ে ভেঙে ফেলেন বাঁ হাতের মধ্যমা। পরে কেটে ফেলে দিতে হয়েছে আঙুলটাই। নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ছিলেন এবং বাংলাদেশের ক্রিকেটের একজন সুহৃদও।

শেষের পরিচয়ের সূত্র ধরেই ক্রাইস্টচার্চে এসে গ্রাহাম ডাউলিংয়ের সঙ্গে যোগাযোগ। বাংলাদেশের টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার প্রত্যক্ষ সহযোগী আগামী ৪ মার্চ ৮০ বছরে পা দিতে যাওয়া এই প্রৌঢ়। আইসিসির ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির সদস্য হিসেবে দুই সহযোগী অ্যান্ড্রু পাইক্রফট ও নাসিমুল গণির সঙ্গে ২০০০ সালে বাংলাদেশে গিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য, টেস্ট মর্যাদার জন্য বাংলাদেশের সম্ভাব্যতা যাচাই। বিসিবির পরিচালক আহমেদ সাজ্জাদুল আলমের সঙ্গে ডাউলিংয়ের বন্ধুত্ব তখন থেকেই। পুরোনো বন্ধুর জন্য আহমেদ সাজ্জাদুল আলমের পাঠানো কিছু উপহার পৌঁছে দেওয়ার স্থান-কাল ঠিক করতেই ফোনে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। সেই ফোনালাপ থেকেই কাল সকালে এই প্রতিবেদকের দরজায় তাঁর হাতের খটখট শব্দ।

সকালের আড্ডাটা শেষ পর্যন্ত রিকার্টন রোডের এক কফি শপে বসেই হলো। ডাউলিং সাহেবের হাতে যত্ন করে রাখা তিনটি পেপার কাটিং। বাংলাদেশ নিয়ে কথা বলবেন বলে নিয়ে এসেছেন। তিনটিই ২০০০ সালের ঢাকা সফরের। একটি ওই সময়ের বিসিবি সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির মিটিংয়ের, একটিতে তিনি বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে দাঁড়িয়ে আছেন, আরেকটি গুলিস্তানের বিখ্যাত ট্রাফিক জ্যামের।

—তা এসব পেপার কাটিং কেন জমিয়ে রেখেছেন?

গ্রাহাম ডাউলিং: এটা আমার একটা শখ বলতে পারো। সেই ১৯৫৬ সাল থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত পেপার কাটিং জমাচ্ছি। খেলোয়াড়ি জীবনের ছবি, সংবাদ, বিভিন্ন সফরের ছবি, নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটে যখন ছিলাম তখনকার ছবি...এ রকম অনেক পেপার কাটিং আছে আমার কাছে।

—বাংলাদেশকে কেন টেস্ট মর্যাদা দেওয়া উচিত বলে মনে হয়েছিল তখন?

গ্রাহাম ডাউলিং: আমাদের মনে হয়েছিল বাংলাদেশে ক্রিকেট অনেক জনপ্রিয়। সেখানকার মানুষ ক্রিকেট ভালোবাসে। ঘরোয়া ক্রিকেট ভালো হয়। আমরা শুধু আমাদের প্রতিবেদনটাই জমা দিয়েছি, যেটার একটা কপি এখনো আমার কাছে আছে। তবে বাংলাদেশকে টেস্ট মর্যাদা দিতেই হবে, ও রকম জোর করিনি।

—বাংলাদেশের আর কী স্মৃতি মনে আছে আপনার?

গ্রাহাম ডাউলিং: বাংলাদেশে যাওয়া নিয়ে আমি খুব রোমাঞ্চিত ছিলাম। ক্রিকেটের সুযোগ-সুবিধা দেখতে বিভিন্ন জায়গায় যাওয়া-আসা নিয়ে অনেক ব্যস্ত সময় কাটিয়েছি সেখানে। চা-বাগানের যে এলাকা (সিলেট) সেখানে যাওয়ার আগে ববি (আহমেদ সাজ্জাদুল আলম) বলল, আমাদের যাওয়ার জন্য নাকি এয়ারফোর্সের একটা হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ওই প্রথম আমার হেলিকপ্টারে ওঠা। মনে আছে হেলিকপ্টার যখন একটু নিচে দিয়ে যাচ্ছিল, মানুষ আমাদের দেখে হাত নাড়ছিল। সবার মধ্যে কী রকম একটা উত্সাহ ছিল।

বাংলাদেশে ওটাই প্রথম সফর ছিল না ডাউলিংয়ের। পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট খেলতে ১৯৬৯ সালে প্রথম ঢাকায় যান নিউজিল্যান্ড দলের অধিনায়ক হয়ে। ডাউলিংয়ের স্মৃতিতে সেই ঢাকা টেস্টও এখনো বেশ তাজা, ‘সেবারের ঢাকা সফর কোনো দিন ভুলব না আমি। অনেক দর্শক ছিল গ্যালারিতে। পাকিস্তান আমাদের প্রায় হারিয়েই দিচ্ছিল। কিন্তু প্রথম ইনিংসে গ্লেন টার্নার ও দ্বিতীয় ইনিংসে মার্ক বার্জেসের সেঞ্চুরির সুবাদে আমরা টেস্টটা ড্র করে ফেলি। খুব ভালো দল ছিল পাকিস্তান।’

ক্রিকেট এখন শুধু ডাউলিংয়ের স্মৃতির পাতাতেই আছে। মাঠে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন অনেক আগেই। এমনকি নিজ শহর ক্রাইস্টচার্চের মাঠেও খেলা দেখতে যান না দীর্ঘদিন। খেলাটার সঙ্গে অন্য কোনো যোগাযোগও নেই। স্ত্রী, তিন সন্তান আর সাত নাতি-নাতনি নিয়ে কাটছে দীর্ঘ অবসরজীবন। ক্রিকেটের যা একটু খোঁজখবর রাখেন সেটা দূর থেকে। তাতেই তিনি জানেন, ১৭ বছর আগে যে দেশটাকে টেস্ট মর্যাদা দেওয়ার সুপারিশ করেছিলেন, সেই দলটা এখন ভালো খেলছে।

কিন্তু ক্রিকেট থেকে কেন এতটা দূরে সরে গেলেন গ্রাহাম ডাউলিং? হাসতে হাসতে বললেন, ‘আর কত! আমি দীর্ঘদিন মাঠে ছিলাম। এখন আর ভালো লাগে না। স্ত্রী, সন্তান আর নাতি-নাতনিদের নিয়েই ব্যস্ত থাকি। ভালো আছি। আর কিছুর দরকার নেই।’

কফি শপ থেকে বের হয়ে ক্রিকেট নিয়ে আরও টুকটাক কথা বলতে বলতে এগিয়ে গেলেন গাড়ির আছে। ওই কথোপকথনেরই একটা পর্যায়ে তাঁর মুখ দিয়ে বের হয়ে এল, ‘ক্রিকেট এখন অনেক বেশি বাণিজ্যিক। আমাদের সময় এ রকম ছিল না...।’

গ্রাহাম ডাউলিংদের সঙ্গে ক্রিকেটের দূরত্বটা বোধ হয় এভাবেই তৈরি হয়ে যায়।