মুশফিকদের বিশ্বাস ছিল, ওরা পারবে

নিজেকে কিছু জায়গায় সৌভাগ্যবান বলে মনে করি আমি। আমি বাংলাদেশের প্রথম ওয়ানডেজয়ী দলে ছিলাম। দেশের হয়ে অভিষেক টেস্ট খেলেছি। বাংলাদেশের ক্রিকেটের ইতিহাসে এগুলোও গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। কিন্তু এবার কলম্বোয় আমাদের ছেলেরা যে ইতিহাস রচনা করল, সেটি ছিল একরকম ঘোষণা দিয়ে। দলের কাছাকাছি থাকার সুবাদে বুঝেছি, শততম টেস্টটা বাংলাদেশ দল জেতার জন্যই খেলতে নেমেছিল।

ক্রিকেটে টেকনিকের পাশাপাশি খেলোয়াড়দের মধ্যে ইতিবাচক মানসিকতা থাকাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। শততম টেস্টের আগে কলম্বো গিয়ে দেখলাম, ছেলেদের মধ্যে সেটা আছে। তারা বরাবরের মতোই সিরিয়াস। তবে যেটা বিশেষভাবে লক্ষ করলাম সেটা হলো, তারা এই টেস্টটা জিততে চায় এবং এই মন্ত্র তারা নিজেরাই নিজেদের কানে ছড়িয়ে দিয়েছে।

আবহাওয়া খুব গরম ছিল। অনুশীলন, ম্যাচ—সবকিছুতেই আমাদের খেলোয়াড়েরা অনেক কষ্ট করেছে। সঙ্গে ছিল শততম টেস্টের চাপ। এ রকম উপলক্ষে যা হয়, খেলার আগে অনেক আনুষ্ঠানিকতা, ছবি তোলা ইত্যাদি। টস হয়ে যাওয়ার পরও তাই খেলায় মনোযোগ দেওয়া কঠিন ছিল। তারপর আমরা টসে হারলাম। আমার তো তখন মনটাই খারাপ হয়ে গিয়েছিল।

কিন্তু খেলোয়াড়েরা প্রতিজ্ঞা থেকে সরেনি। তারা ইতিবাচক ছিল। প্রথম ইনিংসে শ্রীলঙ্কা ব্যাটসম্যানদের ভুলেই উইকেট দিয়ে এলেও আমাদের বোলিং ভালো হয়েছে, ফিল্ডিং ছিল আরও ভালো। সাম্প্রতিক অন্য টেস্টগুলোয় সুযোগ তৈরি করেও হারার অন্যতম কারণ ছিল বাজে ফিল্ডিং। এবার সেটা হয়নি। আমরা শ্রীলঙ্কার চেয়েও ভালো ফিল্ডিং করেছি।

প্রথম ইনিংসের ব্যাটিংয়ে আমাদের কিছু ভুল ছিল। তামিম ভালো খেলতে খেলতে হঠাৎই আউট হয়ে গেল। সাব্বিরও ভুল করল। এরপর সাকিব যখন ও রকম এলোমেলো খেলা শুরু করল, খুব হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। ধরেই নিয়েছিলাম, এই ম্যাচ আমরা আর জিতছি না।

সেদিন রাতের খাবারের পর আমি, বোর্ড সভাপতিসহ আরও কয়েকজন দলের সিনিয়র খেলোয়াড় সাকিব, মুশফিক, তামিম, ইমরুল, আর সাব্বিরের সঙ্গে বসলাম। কিছু ইতিবাচক কথা বললাম। বললাম, টেস্টটা আমাদের জেতার চেষ্টা করা উচিত। ওরাও সেটাই করতে চাচ্ছিল এবং তাদের বিশ্বাস ছিল, তারা পারবে। এরপর কী হলো, তা তো আপনারাও দেখেছেন।

সাকিব আমার দেখা তার অন্যতম সেরা ব্যাটিংটা করল। মোসাদ্দেক প্রমাণ করল, সে এই পর্যায়ের ক্রিকেটের জন্য প্রস্তুত। আর শেষ দিনে তামিম নিজেকে চেনাল নতুন করে। সেদিন ও শুধু রক্ষণাত্মক ব্যাটিং করে গেলে আমরা এই টেস্ট জিততাম না। দলের সবাই মিলে যে বার্তাটি দিল, তার অর্থ পরিষ্কার—বাংলাদেশের ক্রিকেট বদলে গেছে। এটা বোঝা যায় দলে নতুন যারা এসেছে, তাদের খেলা দেখেও।

টেস্ট শেষে বাংলাদেশের ড্রেসিংরুমে এসেছিলেন শ্রীলঙ্কান বোর্ডের সভাপতি থিলাঙ্গা সুমাথিপালা। মুশফিকদের অভিনন্দন জানিয়ে তিনি বললেন, ‘সিরিজ ড্র হয়েছে তো কি, ট্রফিটা তোমরাই নিয়ে যাও। এটা তোমাদের শততম টেস্ট, ট্রফিটা তোমাদেরই থাক।’

দলের মধ্যে নতুন একটা জিনিস দেখেছি এবার। কোচ ১৫-২০ মিনিটের একটা ব্রিফ করে। তারপর খেলোয়াড়েরা আবার নিজেদের মধ্যে মিটিং করে। শততম টেস্টের শুরু থেকে প্রতিদিন তারা এটা করেছে। যখনই মনে করেছে নিজেদের বসা দরকার, বসেছে। দ্বিতীয় ইনিংসে খেলাটা বদলে যাওয়ার এটাই কারণ। ফিল্ডিংয়ে এই ক্ষিপ্রতা, এই শরীরী ভাষা আমি আগে দেখিনি। সবাই যেন একটা লক্ষ্য স্থির করে খেলেছে। সবাই কিছু করতে চায়।

আমাদের খেলোয়াড়দের মধ্যে এখন এই বোধটা এসেছে যে, দলের এক-দুজন ভালো খেললে হবে না। টেস্ট জিততে হলে সবার ভালো খেলতে হবে। সে জন্য সবাই সবাইকে সাহায্য করছে, উৎসাহ দিচ্ছে, কেউ যেন পিছিয়ে না থাকে। মোস্তাফিজকে কেউ বল সাইন করে দিচ্ছে, কেউ হয়তো এসে পিঠ চাপড়ে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছে। একজন ভালো ফিল্ডিং করলে পাশের জন অভিনন্দন জানাচ্ছে। মোট কথা একটা দলের জেতার জন্য যা করা দরকার, সবই ওরা করেছে। বাংলাদেশ জেতার জন্যই খেলতে নেমেছিল এই টেস্ট এবং সেটা তারা জিতেছেও। টেস্ট জিততে ১১ জনকে ভালো খেলতে হয়। শততম টেস্টে সেটা আমরা করেছি। কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের অবদানও ভুলে গেলে চলবে না। তাঁর চিন্তাভাবনা খুব ভালো। কোচ এমন কিছু টেকনিক বলে দেন, যেটা কাজ করে।

আমরা যখন ক্রিকেটে আসি বড় কিছু ভেবে আসিনি। আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচ খেলাই ছিল সবচেয়ে বড় লক্ষ্য। জাতীয় দলে আসার পরও লক্ষ্য ছিল, ৫০ ওভার ব্যাটিং করা। অন্যরা খারাপ খেললে তবেই হয়তো আমাদের কপালে ভালো কিছু জুটবে, এটাই থাকত আশা। প্রথম টেস্টটাও খেলে ফেলেছিলাম কিছু বুঝে ওঠার আগেই।

কিন্তু এই প্রজন্মের খেলোয়াড়েরা দেশের ক্রিকেটকে কোথায় নিয়ে গেছে, তার প্রমাণ আমরা কলম্বোতেই পেয়েছি। আমার বিশ্বাস, এখন থেকে সেটা নিয়মিতই পেতে থাকব।