ভালো লাগা আছে, ভেসে যাওয়া নেই

শততম টেস্টে জয়ের স্মারক স্টাম্প হাতে পি সারা ওভাল থেকে হোটেলে ফেরার বাসে অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম। গত পরশুর ছবি l ফেসবুক
শততম টেস্টে জয়ের স্মারক স্টাম্প হাতে পি সারা ওভাল থেকে হোটেলে ফেরার বাসে অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম। গত পরশুর ছবি l ফেসবুক

কল্পনার রং অনেকটা চড়িয়ে যদি ধরে নেওয়া যায়, শততম টেস্ট জয়ে কেউ একজন বাংলাদেশ দলকে এক শ গোলাপ উপহার দিয়ে গেল। আর সেই গোলাপের সৌরভ মেখে মুশফিকেরা জয়ের উদ্‌যাপন করলেন রাতভর!

এটি কল্পনা বলেই জানিয়ে দেওয়া যাক, কলম্বোর তাজ সমুদ্র হোটেলে ঐতিহাসিক জয়ের রাতেও বাংলাদেশ দল লাগাম পরিয়ে রেখেছিল আবেগের। একেকটা জয় যেভাবে ড্রেসিংরুমে উদ্‌যাপিত হয়ে আসছে প্রায় দশক ধরে, তার চেয়ে খুব বেশি কিছু হয়নি। গাওয়া হয়েছে দলীয় সংগীতে রূপ নেওয়া ‘আমরা করব জয়’ গানটি। একটু হইহুল্লোড়, চিৎকার-চেঁচামেচি হয়েছে। তারপর টিম বাসটা যখন এসে প্যাভিলিয়নের গেটে দাঁড়িয়েছে, সবাই সার বেঁধে উঠে বসেছেন। গন্তব্য হোটেল এবং নির্দিষ্ট করে বললে যাঁর যাঁর কক্ষ। সন্ধ্যায় শ্রীলঙ্কায় নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার একটি কেক নিয়ে এসেছিলেন। কয়েকজন মাত্র খেলোয়াড়ের উপস্থিতিতে সেটি কাটা হয়েছে, এই যা!

পরশু রাতে তাজে অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি করেও লবিতে কারও দেখা মিলল না। দ্বাররক্ষক রোহান গুনারত্নেকে জিজ্ঞেস করা হলো, জয়ের পর বাংলাদেশ দলকে লবিতে উল্লাস করতে দেখা যায়নি? রোহানের নীরস উত্তর, ‘কই না তো, কাউকেই তো দেখলাম না!’ রোহানই পরে আগ বাড়িয়ে বললেন, ‘যা-ই বলেন, এ এক বিশাল জয়। শ্রীলঙ্কায় এসে শ্রীলঙ্কাকে টেস্টে হারিয়ে দেওয়া, সোজা কথা নাকি!’ রোহানের সঙ্গেই মিলেন যাচ্ছেন রুকমাল, লাকমাল, সামপাথ, সিরিসেনা কিংবা সুরিয়াসেনা—কত শ্রীলঙ্কান! মানে ক্রিকেটাগ্রহী তামাম শ্রীলঙ্কা। অর্থাৎ পি সারা ওভালে গত রোববারের রোদেলা বিকেলটি একঝটকায় বাংলাদেশের ক্রিকেটকে তুলে দিয়েছে অনেকটা উচ্চতায়।

তবে অনেক উঁচুতে উঠেও বাংলাদেশ দল বাস্তবের মাটিতেই আছে। গতকাল বেলা ১১টায় গিয়েও তাজ সমুদ্রে ক্রিকেটারদের সাড়াশব্দ তেমন পাওয়া গেল না। যাঁরা টেস্ট খেলেছেন, সবাইকেই দিয়ে দেওয়া হয়েছিল ছুটি। কিন্তু ‘আজ আমাদের ছুটি, ও ভাই আজ আমাদের ছুটি’ এমন উদ্বেলিত মেজাজ কারও নেই। মুশফিকুর রহিম স্ত্রীকে নিয়ে কোথায় বেরিয়ে গেলেন, হয়তো সামান্য কিছু কেনাকাটা করতে। জানা গেল, সাকিব সস্ত্রীক ঘুরতে গেছেন গলের দিকে। আর সকালে বিমানে উঠে তামিম পাড়ি জমিয়েছেন মুম্বাইতে, সেখানে দুটি দিন পরিবারের সঙ্গে কাটিয়ে ফিরবেন।

হোটেল থেকে গল রোড ধরে একটু দক্ষিণে হেঁটে গেলেই ক্রিসক্যাট ফুডকোর্ট। সেখানে দেখা হয়ে গেল ইমরুল কায়েস ও শুভাশিস রায়ের সঙ্গে। ইমরুলের চোখে-মুখে এখনো যেন জয়ের সুবাস, ‘সত্যি, এটা অনেক বড় জয়। বিদেশের মাটিতে এমন জয়ের স্বপ্নই তো আমরা দেখে এসেছি। খুব অবদান হয়তো আমি রাখতে পারিনি, তবে আমিও এই জয়ের একজন অংশীদার, এটা অনেক গর্বের।’

আগের দিন লঙ্কাজয়ের পর প্রায় একই রকম অনুভূতির কথা জানিয়েছেন সাব্বির ও তাইজুল, ‘এ আনন্দ আসলে বলে বোঝাতে পারব না। শততম টেস্টে জয়ী দলে খেলেছি, এটা ভাবতেও ভারী ভালো লাগছে।’

তাইজুল কাল দেশে ফিরে গেছেন। সঙ্গী মুমিনুল ও মিরাজ। কামরুল হাসান রাব্বী স্ত্রীকে নিয়ে থেকে গেছেন কদিনের জন্য। বাংলাদেশের সীমিত ওভারের ক্রিকেট দলে ওঁরা নেই। ২৫ মার্চ থেকে ডাম্বুলায় শুরু তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ। এরপর দুই ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজ। দল যে গৌরবময় টেস্ট জয়ের আনন্দে আচ্ছন্ন হয়ে নেই, তা মনে হয় এই পাঁচটি ছোট ক্রিকেট ম্যাচের কথা ভেবেই। এটাই পরিণতিবোধের পরিচায়ক। সফর এখনো শেষ হয়ে যায়নি। মাঝপথেই সব আনন্দ ফুরিয়ে ফেলার কোনো মানে হয় না! আর প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামে কাল অনুশীলনের পর ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজাও বললেন, টেস্টের এই সাফল্য তাঁদের সামনের পাঁচটি ম্যাচেরও প্রেরণা।

বিসিবি সভাপতি একেবারে নগদ নগদ এক কোটি টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছেন দলের জন্য। দেশে ফিরে মুশফিকরা ক্রীড়াপ্রেমী প্রধানমন্ত্রীর কাছে নাকি ‘দোয়া’ চাইতে যাবেন। সেখানে আরও কিছু প্রাপ্তিযোগ হতেই পারে।

বাংলাদেশ যেখানে টেস্ট জয়ের আনন্দে ভেসেছে, শ্রীলঙ্কার ক্রিকেট-সমাজ যেন লজ্জায় একেবারে নীল। সংবাদমাধ্যমে রীতিমতো ঢি ঢি পড়ে গেছে। দেশের অন্যতম সেরা দৈনিক দ্য আইল্যান্ড তো অ্যাশেজের জন্মবৃত্তান্তের আদলে শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটের শোকগাথা লিখে ফেলেছে। প্রায় সব পত্রিকায় একটা কথা কমন—বাংলাদেশের কাছে পরাজয় শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটের সবচেয়ে কালো দিন!

পি সারায় বাংলাদেশের লঙ্কাজয়ের পর ঘনিয়ে আসা সন্ধ্যায় একজন মহা-উদ্বিগ্ন মানুষকে পারিষদসহ মাঠময় পায়চারি করতে দেখা গেছে। তিনি আর কেউ নন, শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটের সভাপতি থিলাঙ্গা সুমাথিপালা। শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটকে বড়সড় একটা ধাক্কাই দিয়েছে বাংলাদেশ!