আমাদেরও অবদান আছে

.
.

জাতীয় পোশাক সাদা ফতুয়া ও সারং (লুঙ্গি) পরে এলেন শ্রীলঙ্কার বন্দর ও জাহাজ চলাচল মন্ত্রী। চুল ও গোঁফ সাদা। এসেই বললেন, ‘আমি গত নির্বাচনে শ্রীলঙ্কার ক্রিকেট বোর্ডের সহসভাপতি পদে নির্বাচন করে হেরেছি। স্পোর্ট (খেলাধুলা) নিয়ে কাজ করার তো সুযোগ নেই, এখন কাজ করছি পোর্ট (বন্দর) নিয়ে।’ তাঁর মুখেও হাসি, সাংবাদিক গোষ্ঠীর মধ্যেও হাসির রোল।
এতক্ষণে মনে হয় চিনতে পেরেছেন ইনি কে? অর্জুনা রানাতুঙ্গা। শ্রীলঙ্কার বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক কাল নিজের মন্ত্রণালয়ে বাংলাদেশের সাংবাদিকদের ডেকে নিয়ে জানালেন তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী কীভাবে খেটে গেছে, ‘দুই-তিন বছর আগেই আমি বলেছিলাম, শিগগিরই বাংলাদেশের কাছে শ্রীলঙ্কা টেস্টে হেরে যাবে। অবশেষে সেটি ঘটল।’ বাংলাদেশের শততম টেস্টটা সামান্য দেখেছেন টেলিভিশনে এবং বাংলাদেশের বিজয় দেখে তিনি খুশি। আর এখানেই শ্রীলঙ্কান ক্রিকেট প্রশাসনের দুরবস্থা দেখছেন, ‘বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড এবং শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটের তুলনায় যদি আমি যাই, বাংলাদেশকেই খেলার দিকে বেশি মনোযোগী দেখি। শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট বেশ কিছু বছর ধরে নিয়ন্ত্রণ করছে মাফিয়ারা। আর বাংলাদেশ মনে হয় সঠিক পথেই এগোচ্ছে।’
বাংলাদেশ দল এবার কলম্বো টেস্টে জিতল কীভাবে? রানাতুঙ্গার সহজ উত্তর, ‘দলটির ক্রিকেটারদের মধ্যে আমি অসাধারণ দায়বদ্ধতা দেখেছি। খেলোয়াড়দের প্রতিভা আছে, টেকনিক দুর্দান্ত, ব্যাটসম্যানদের হাতে শট আছে। ওরা প্রথম টেস্টে আসলে খুবই বাজে খেলেছে। কিন্তু দ্বিতীয় টেস্টে ঘুরে দাঁড়িয়েছে দুর্দান্তভাবে। এটাই হলো দায়বদ্ধতা (কমিটমেন্ট)।’
এই জয়ের পেছনে কোচদেরও উজ্জ্বল ভূমিকা দেখেন শ্রীলঙ্কার সাবেক অধিনায়ক। তবে বর্তমান শ্রীলঙ্কান দুই কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে ও থিলান সামারাবীরাকেই শুধু সেই কৃতিত্ব দিতে তিনি রাজি নন, ‘শুধু বর্তমান এই শ্রীলঙ্কান কোচরাই নন, বাংলাদেশের উঠে আসার পেছনে অতীতের কোচদেরও অনেক অবদান আছে।’
বাংলাদেশ এক দিনের ক্রিকেটে এখন সমীহ জাগানো দল, টেস্ট ক্রিকেটেও তাদের জয়ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। এর পেছনে শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটারদেরও একটা ভূমিকা আছে বলে মনে করেন রানাতুঙ্গা, ‘একসময় বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে অনেক শীর্ষ সারির অনেক শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটার খেলত। আমি নিজেও সেখানে তিন বছর খেলেছি। এটা কিন্তু অনেক সাহায্য করেছে বাংলাদেশের ক্রিকেটকে।’
আগামী ২০২৩ বিশ্বকাপ আয়োজিত হবে উপমহাদেশে। বাংলাদেশ যেভাবে এগোচ্ছে তাতে কি বিশ্বকাপ জিততে পারে টেস্ট পরিবারের নবীন সদস্যদেশটি? রানাতুঙ্গার উত্তর, ‘কেন নয়? এখনো ছয় বছরেরও বেশি সময় আছে। এর মধ্যে বাংলাদেশকে একটি নতুন দল গড়ে তুলতে হবে। সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হবে। অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপে সেরা ফল দেখানো দল নিয়ে এগোলে ভালো হয়।’
২০১৯ ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে বাংলাদেশ ভালো করবে বলে বিশ্বাস সাবেক ক্যারিশমাটিক শ্রীলঙ্কান অধিনায়কের। সেই ‘ভালো’র স্বরূপটা অবশ্য বলেননি, ‘বাংলাদেশের দারুণ কিছু ফাস্ট বোলার আছে। একজন বাঁহাতি ফাস্ট বোলার (মোস্তাফিজ) তো দুর্দান্ত। ওদের অবশ্যই প্রতিশ্রুতি আছে। টপ অর্ডারে একজন বিধ্বংসী ব্যাটসম্যান লাগবে। তবে মিডল অর্ডার ব্যাটিংয়ের দিকে নজর দিতে হবে বেশি।’
নিজেকে ক্রিকেটের প্রাচীনপন্থী ‘সেবক’ বলে মনে করেন রানাতুঙ্গা। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট তাঁর দুই চোখের বিষ, ‘টি-টোয়েন্টি হলো জাঙ্ক ফুড। হোটেলে তৈরি নুডলস। আর টেস্ট ক্রিকেট মায়ের হাতে সযত্নে রাঁধা আদর্শ খাবার। টি-টোয়েন্টি খেলতে টেকনিক লাগে না। এটা হলো মেধার বিরুদ্ধে মেধাহীনতার প্রদর্শনী (ব্রেনস অ্যান্ড নো-ব্রেনস)। এটা ক্রিকেট নয়, বিনোদন।’
টি-টোয়েন্টির বিরুদ্ধে আপসহীন রানাতুঙ্গার ভয়, ‘এটা কিশোর ক্রিকেটারদের (অনূর্ধ্ব-১৩) টেকনিক শেখাবে না। ওরা ধুন্ধুমার ব্যাটিং শিখে আসবে, যা ক্রিকেটের জন্য অশনিসংকেত।’
বাংলাদেশকে খুব মনে পড়ে রানাতুঙ্গার। অনেক দিন যাওয়া হয় না। তবে শিগগিরই হয়তো যাবেন। এবং সেটি দেশের কাজে, যাতে উপকৃত হবে বাংলাদেশও, ‘আমি বাংলাদেশে গিয়ে চেষ্টা করব, যাতে সে দেশের জাহাজ বেশি করে শ্রীলঙ্কায় আসে। সিঙ্গাপুরে বন্দর ব্যবহার না করে বাংলাদেশ কলম্বোকে কাজে লাগাতে পারে। এটা সহজ, আর্থিকভাবে সাশ্রয়ী এবং দ্রুততর। বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান, আমার বড় ভাইকে (ধাম্মিকা রানাতুঙ্গা) আমি এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে বলব।’
কথা শেষ, উঠে যাওয়ার পথে রানাতুঙ্গা নিজেই জিজ্ঞেস করলেন, ‘অস্ট্রেলিয়া দল কবে যাচ্ছে বাংলাদেশে?’ হতে পারে সেপ্টেম্বরে-অক্টোবরে। শুনে যেন চকচক করে ওঠে শ্রীলঙ্কার বন্দর ও জাহাজ চলাচল মন্ত্রীর চোখ, ‘বাংলাদেশ অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়েও দিতে পারে। ওরা গত বছর যে হতশ্রী ক্রিকেট খেলে গেছে শ্রীলঙ্কায়!’
এমন আশাবাদের পর বাংলাদেশের মানুষ নিশ্চয়ই চাইবেন, রানাতুঙ্গার মুখে ফুলচন্দন পড়ুক!