ফুটবলে টাকা আছে অবকাঠামো নেই

প্রতিবছরই কাঁড়ি কাঁড়ি টাকায় ফুটবল দল গড়ছে ঢাকার শীর্ষ ক্লাবগুলো। ‘টাকা ভূতে জোগাবে’ প্রবাদটা মনে করিয়ে দিয়ে এই একটা জায়গায় ক্লাবগুলো প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মেতে আছে।
কিন্তু অবকাঠামো উন্নয়নের খবর নেই। সাত কোটি টাকায় দল গড়া যায়, সাত লাখ টাকায় একটা জিম হয় না। শেখ কামালের প্রতিষ্ঠিত আবাহনী ৪৪ বছরে একটি জিম পর্যন্ত করেনি! সাম্প্রতিক বছরে শেখ জামাল ফুটবলে দেদার টাকা ঢাললেও এই দলটিও চলছে জিম-সুবিধা ছাড়া। বাফুফে পথ দেখাতে পারত। কিন্তু তারাও ফিফা-এফসির কোটি কোটি টাকা অনুদান পেয়ে একটা জিম করার ‘দক্ষতা’ দেখাতে পারেনি!
সবাই ‘ফুটবল উন্নয়ন’, ‘ফুটবল উন্নয়ন’ বলে গলা ফাটান, এই দেশে একটা ফুটবল একাডেমি হয়নি আজও। অথচ নেপাল-ভুটানের মতো দেশ পাঁচ-ছয়টা একাডেমি গড়ে এগিয়ে চলেছে সামনে। বাংলাদেশের ফুটবল বলতে কিছু তৈরি খেলোয়াড়কে মোটা অঙ্কের টাকায় কিনে ক্লাবগুলোর কয়েক মাসের ক্যাম্প করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সমর্থকগোষ্ঠী গড়া বা বিপণন-ব্যবস্থা গড়ার দিকে নজর দেওয়ার সময় কই!
ঐতিহ্যবাহী মোহামেডানের সমস্যাটা তো আজও মৌলিক, নিজস্ব অনুশীলন মাঠই হলো না তাদের! অথচ ক্লাবটির ফুটবল দলের ম্যানেজার আমিরুল ইসলাম বাবু কাল প্রথম কথাটাই বললেন এভাবে, ‘আমরা তো প্রায় চার কোটি টাকা খেলোয়াড়দের পেমেন্ট করে দিয়েছি!’ কথাটা সত্যি হলে (!) সমর্থকেরা নিশ্চয়ই খুশি হতে পারেন। কিন্তু সত্যিটা হলো, মোহামেডানকে এবারও বুয়েট মাঠ, রমনা পার্ক বা অন্য কোথাও যাযাবরের মতো ঘুরতে হবে অনুশীলন করতে।
ঢাকা আবাহনী, শেখ জামাল, ব্রাদার্স নিজস্ব মাঠে অনুশীলন করে, এটা ব্যতিক্রম। শেখ রাসেল সম্প্রতি বসুন্ধরায় নিজস্ব মাঠ পেয়েছে। কিন্তু তিরানব্বইয়ে বড় দল গড়ে এগিয়ে চলা মুক্তিযোদ্ধাও আজ পর্যন্ত একটা অনুশীলন মাঠ বানাতে পারেনি। দলটির স্থায়ী আবাসন-ব্যবস্থাও নেই।
প্রিমিয়ারে এবার নবাগত সাইফ স্পোর্টিংয়ের ক্লাব টেন্ট না থাকা তাই অবাক করবে না কাউকে। দলটি অনুশীলন করতে ছুটে গেছে বিকেএসপিতে। এই অবস্থা অবশ্য বেশি দিন থাকবে না বলছেন সাইফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাসিরউদ্দিন চৌধুরী, ‘গাজীপুরে ৭০ বিঘা জমি কিনেছি আমরা। ওখানেই সাইফের ক্লাব টেন্ট, ছোট স্টেডিয়াম, একাডেমিসহ প্রয়োজনীয় সব হবে।’
হলে ভালোই। কিন্তু সেটা তিন-চার বছরের ব্যাপার। তত দিনে সাইফের ফুটবল নিয়ে আগ্রহ থাকবে কি না, বড় প্রশ্ন। তবে দলটি প্রথমবারেই বড় অঙ্কের দল গড়েছে। নাসিরউদ্দিনের ভাষ্যমতে, ‘আমাদের তিন-চার কোটি টাকার বেশি খরচ হবে দলের পেছনে।’ অন্য ক্লাব কর্মকর্তাদের মুখেও তাদের ফুটবল দল গঠনের খরচের অঙ্কটা প্রায় কাছাকাছিই। মোহামেডানের বাবু যেমন বলছেন, ‘আমাদের পাঁচ-ছয় কোটি টাকা খরচ হবে।’ শেখ রাসেলের অন্যতম শীর্ষ কর্মকর্তা সালেহ জামান সেলিমের কথায়, ‘আমাদের বাজেট তো সাত-আট কোটি টাকা থাকেই।’
ঢাকা আবাহনীর বাজেটও একই রকম। চট্টগ্রাম আবাহনী গতবার খরচ করেছিল পাঁচ-ছয় কোটি টাকা, এবার তাদের বাজেটটা একটু কমেছে। মোটের ওপর এবার শীর্ষ ক্লাবগুলোর বাজেট পাঁচ থেকে আট কোটি টাকার মধ্যে বলে জানা গেছে। তবে শেখ জামালের সাবেক সভাপতি ও বর্তমানে গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান মনজুর কাদেরের দাবি, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শেখ জামালের বাজেট ১০ কোটি টাকার বেশিই হয়েছে। তাহলে এত দিনে ক্লাবটির একটি জিম হয়নি কেন? কাদেরের দায়সারা উত্তর, ‘আমাদের বিরুদ্ধে অনেকে ষড়যন্ত্র করেছে। তাই চাইলেও অনেক কিছু করতে পারিনি।’
তবে অনুশীলন-সুবিধা নয়, ফুটবলে এখন আলোচনা ওই একটাই, কোনো ফুটবলার ৫০ লাখ টাকা পাচ্ছেন, কেউ ৪০ লাখ। পেশাদার ভিত্তি গড়ার উদ্যোগ নেই কারও। যা দেখে হতাশ কোচ মারুফুল হক, ‘গত নয় বছরে শীর্ষ পর্যায়ে কোচিং করিয়ে দেখেছি, অনুশীলন সরঞ্জাম হয়তো একটু ভালো হয়েছে। কিন্তু আর কোনো বদল নেই। একটা দল আট কোটি টাকার বাজেট থেকে এক কোটি সরিয়ে অনায়াসেই অনুশীলন-সুবিধা তৈরি করতে পারে। কিন্তু সেটা কেউ করে না।’
পেশাদার লিগ চালুর নয় বছরেও বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামই ‘হাতের পাঁচ’ ক্লাবগুলোর কাছে। গতবার লিগটা ঢাকার বাইরে ছড়িয়ে এবার আবার ঢাকায় বন্দী করে ফেলা হয়েছে। ক্লাব বলে, ঢাকার বাইরে খেলতে গেলে নাকি বেশি খরচ হয়। এই খরচ কে দেবে? অথচ ৩০ লাখ টাকার খেলোয়াড়কে ৫০ লাখ টাকা দিয়ে কিনতে কার্পণ্য নেই!
ক্লাব বা ফুটবলার কেউই আসল অঙ্কটা বলে না। তবে আবাহনী থেকে ডিফেন্ডার তপু বর্মনকে নাকি ৫০ লাখ টাকায় নিয়ে আসছে সাইফ। ক্লাব সূত্র অঙ্কটা অবশ্য ৪৫ লাখের একটু বেশি বলছে। জামাল ভূঁইয়াকে ৪০ লাখের কিছু বেশি দিচ্ছে দলটি। মনজুর কাদেরের দেওয়া তথ্য, ‘আমরা তো এবার ইয়াছিনকে ৫০ লাখ টাকায় চুক্তি করেছি।’
ফুটবলাররা টাকা পান ঠিক আছে। কিন্তু ক্লাবের শক্ত ভিত্তি তৈরির দিকে নজর না থাকা দেশের ফুটবলের যে সর্বনাশ করছে, সেটা নিয়ে কেউ কি ভাববেন না!