ক্রিকেটারদের দুঃসময়ের 'গুরু'

যখন রান কিংবা উইকেট আসে না, সেই দুঃসময়ে ক্রিকেটাররা ছুটে যান তাঁদের ‘গুরু’র কাছে। তেমনই একজন কোচ নাজমুল আবেদিন ফাহিমের সঙ্গে নাসির, সাকিব ও সোহ্‌রাওয়ার্দী শুভ। ছবি: শামসুল হক
যখন রান কিংবা উইকেট আসে না, সেই দুঃসময়ে ক্রিকেটাররা ছুটে যান তাঁদের ‘গুরু’র কাছে। তেমনই একজন কোচ নাজমুল আবেদিন ফাহিমের সঙ্গে নাসির, সাকিব ও সোহ্‌রাওয়ার্দী শুভ। ছবি: শামসুল হক
সব সময়ই ক্রিকেটারদের সুসময় থাকে না। মাঠের খেলায় ভালো-মন্দ সময় আসে। সেই দুঃসময়ে ‘গুরু’র কাছে ছুটে যান তাঁরা। কৈশোরের কোচের কাছ থেকে নেন নানা পরামর্শ। সব ক্রিকেটারেরই পছন্দের কোচ থাকেন, যাঁর কাছে তাঁরা সমস্যার কথা বলতে পারেন মন খুলে। দেশের এমন কয়েকজন তারকা ক্রিকেটার ও তাঁদের কোচদের কথা নিয়ে ছুটির দিনের এবারের প্রচ্ছদ প্রতিবেদন


ঘটনা-১:
২০১৪ সালের নভেম্বরে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে খুলনা টেস্টে সাকিব আল হাসান পেলেন ১০ উইকেট। এর পরের তিন টেস্টে তাঁর উইকেট মাত্র ৩টি। হঠাৎ কী হলো, উইকেট সোনার হরিণ হয়ে গেল সাকিবের কাছে! সমাধানের আশায় বাঁহাতি অলরাউন্ডার শরণ নিলেন তাঁর শুরুর দিকের কোচ, বর্তমান বিসিবির ন্যাশনাল গেম ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার নাজমুল আবেদিন ফাহিমের।

তাতে কাজ হলো। ২০১৫ সালের জুনে ভারতের বিপক্ষে ফতুল্লা টেস্টে নিজেকে ফিরে পেলেন সাকিব। কোহলিদের বিপক্ষে ৪ উইকেট নিলেন এই বাঁহাতি স্পিনার। সংবাদ সম্মেলনে নিজের বদলে যাওয়ার বোলিং নিয়ে বলতে গিয়ে নাজমুলের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানালেন সাকিব, ‘গত তিন-চার টেস্টে ভালো বোলিং করতে পারছিলাম না। গত রাতে আমার কোচের (নাজমুল) সঙ্গে কথা বলি। তাঁর পরামর্শ আমার অনেক কাজে লেগেছে।’

সাকিব আল হাসান পরামর্শ নেন মোহাম্মদ সালাহউদ্দীনের। ছবি: প্রথম আলো
সাকিব আল হাসান পরামর্শ নেন মোহাম্মদ সালাহউদ্দীনের। ছবি: প্রথম আলো

ঘটনা-২:
গত আইপিএলে ব্যাটিং-বোলিংয়ে ভালো করতে পারছিলেন না সাকিব। প্রথম যে ৫ ম্যাচ খেলার সুযোগ পেলেন, রান করলেন ২০, উইকেট মাত্র ২টি। নিজেকে ফিরে পেতে গোপনে ঢাকায় এসে তাঁর ‘গুরু’, বিসিবির সাবেক সহকারী কোচ মোহাম্মদ সালাহউদ্দীনের টিপস নিয়ে গেলেন। ভোজবাজির মতো বদলে গেল তাঁর পারফরম্যান্স। ঢাকা থেকে ফিরেই কলকাতা নাইট রাইডার্সের (কেকেআর) হয়ে গুজরাট লায়ন্সের বিপক্ষে করলেন অপরাজিত ৬৬ রান, আইপিএলে যেটি তাঁর সর্বোচ্চ।
ঢাকায় ঝটিকা সফরে কোচ সালাহউদ্দীনের সঙ্গে দুটি সেশনই কি তাহলে কাজে লাগল? প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সাকিব বলেন, ‘যদি রান না করতাম, মনে হতো এটা কাজে আসেনি। যেহেতু রান করেছি, বলতে হবে কাজে লেগেছে।’

‘গুরু’ সোহেল ইসলাম ও তাইজুল
‘গুরু’ সোহেল ইসলাম ও তাইজুল

বাংলাদেশ দলে চুক্তিবদ্ধ কোচ আছেন। ফ্র্যাঞ্চাইজি দল কেকেআরেও তা-ই। তবু সাকিব কেন নাজমুল কিংবা সালাহউদ্দীনের কাছে ছুটে আসেন? সরল এই জিজ্ঞাসার উত্তর পাওয়া যাবে পরে। তবে শুধু সাকিবই নন, তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম, ইমরুল কায়েস, সৌম্য সরকার, নাসির হোসেন, লিটন দাস, মোসাদ্দেক হোসেনরাও ছুটে যান তাঁদের গুরুদের কাছে।
মুমিনুল হক সুসময়ে-দুঃসময়ে নয়, যখনই সময় পান পরামর্শ নেন নাজমুল কিংবা সালাহউদ্দীনের কাছে। এই দুই বিজ্ঞ কোচের সংস্পর্শে এলে কীভাবে নিজেকে ফিরে পাওয়া যায়, সেটিই বলছিলেন ২২ টেস্ট, ২৬ ওয়ানডে, ৬টি-টোয়েন্টি খেলা বাংলাদেশ দলের এই বাঁহাতি টপঅর্ডার ব্যাটসম্যান, ‘ফাহিম স্যার-সালাহউদ্দীন স্যারের কাছে গেলে মানসিক ও টেকনিক্যালি অনেক উন্নতি হয়। দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠা তাই সহজ হয়।’

পেসারদের কাছে সরওয়ার ইমরান যেন বটবৃক্ষ
পেসারদের কাছে সরওয়ার ইমরান যেন বটবৃক্ষ

২০১৩ সাল থেকে জাতীয় দলের বাইরে আছেন শাহরিয়ার নাফীস। বাংলাদেশ জাতীয় দল থেকে বাদ পড়ার পর ব্যাটিং নিয়ে বাঁহাতি ওপেনারের নতুন করে যে উপলব্ধি হয়েছে, তাতে নাজমুলের অনেক অবদান। এই কোচের সঙ্গে চার-পাঁচ বছর ধরে কাজ করার অভিজ্ঞতা বলছিলেন শাহরিয়ার, ‘তাঁর চোখের সামনে বেড়ে উঠেছি। স্যার খুব ভালো করেই জানেন আমি কেমন ব্যাটসম্যান, আমার মানসিকতা বা খেলার ধরন কেমন।’
নাজমুল-সালাহউদ্দীনের কাছে পরামর্শ নেন সৌম্য সরকার কিংবা এনামুল হকও। তবে এই তারকাদ্বয়ের গুরু আখিনুর জামান রুশো। গত বছর সৌম্যর ব্যাট যখন হাসতে ভুলে গিয়েছিল, সমস্যার সমাধানে বাঁহাতি ওপেনার নিয়মিতই কথা বলেছেন বিকেএসপির এই সিনিয়র (ক্রিকেট) কোচের সঙ্গে।
পেস বোলারদের কাছে সরওয়ার ইমরান যেন বটবৃক্ষ। বাংলাদেশ দলের বেশির ভাগ পেসাররাই পরামর্শ নেন জাতীয় দলের সাবেক এই কোচের কাছ থেকে। ৫ টেস্ট খেলা কামরুল ইসলাম বলেন, ‘ইমরান স্যারের সঙ্গে কারিগরি বিষয় নিয়েই বেশি কথা হয়। তবে উজ্জীবিত হতে আমার এলাকার কোচ মঈনুজ্জামানের সঙ্গে কথা বলি।’
৬ টেস্ট, ১৪ ওয়ানডে ও ২৫ টি-টোয়েন্টি খেলা পেসার আল আমিনের কাছে ইমরান যেন বিশাল ছায়া, ‘আমার এই পর্যন্ত আসার পেছনে স্যারের অনেক অবদান। কোনো সমস্যা হলে তাঁর কাছে ছুটে যাই।’
মেহেদী হাসান মিরাজ, তাইজুল ইসলামের মতো স্পিনাররা খুঁটিনাটি সমস্যা নিয়ে কাজ করেন বিসিবির হাইপারফরম্যান্স (এইচপি) দলের কোচ সোহেল ইসলামের সঙ্গে। ‘বোলিং যখন ভালো করতে পারি না, তখন বেসিক ঠিক করতে সোহেল ভাইয়ের সঙ্গে কাজ করি। মানসিকভাবে চাঙা হতে সুজন ভাইয়ের সঙ্গেও (খালেদ মাহমুদ) কথা বলি’—বলছিলেন তাইজুল।
বোলিংয়ে মিরাজের নতুন সমস্যা, উইকেট পাচ্ছেন কিন্তু রান দিয়ে ফেলছেন একটু বেশি। ইংল্যান্ডে যাওয়ার আগে সমস্যাটা নিয়ে সোহেলের সঙ্গে কাজ করে গেছেন তিনি। তা গুরুর কাছ থেকে কী পরামর্শ পেলেন? ১৯ বছর বয়সী অলরাউন্ডার সাসেক্সে রওনা দেওয়ার আগে বললেন, ‘সোহেল স্যার আমার বোলিংয়ের আগাগোড়া সব জানেন। তিনি বলেছেন, “সব ঠিকই আছে। এটা ধরে রাখতে হবে আর অ্যাক্যুরিসি বাড়াতে হবে।”’

গুরুরা মূলত খেলোয়াড়দের উজ্জীবিত করেন। আখিনুর জামানের সঙ্গে সৌম্য সরকার। ছবি: সংগৃহীত
গুরুরা মূলত খেলোয়াড়দের উজ্জীবিত করেন। আখিনুর জামানের সঙ্গে সৌম্য সরকার। ছবি: সংগৃহীত

কী জাদু জানেন তাঁরা
খেলোয়াড়েরা কেন ছুটে যান তাঁদের কাছে কিংবা তাঁদের পরামর্শে কীভাবে দ্রুতই ছন্দ ফিরে পান একজন ক্রিকেটার—প্রশ্নটা করা হয়েছিল সবাইকে। উত্তর যা পাওয়া গেল সেটির সারমর্ম, যে ক্রিকেটাররা আসেন, তাঁদের বেশির ভাগই বেড়ে উঠেছেন এই কোচদের চোখের সামনে। খেলোয়াড়ের নাড়ি-নক্ষত্র তাই কোচদের চেনা। যদি রোগীকে হাতের তালুর মতো চেনা থাকে রোগ ধরাটাও সহজ হয়ে যায় চিকিৎসকের।
নাজমুল আবেদীন ছিলেন বিকেএসপির কোচ। এক যুগের বেশি সময় কাজ করছেন বিসিবির সঙ্গে। জাতীয় দলের সব ক্রিকেটারের কাছেই তিনি ভীষণ শ্রদ্ধাভাজন। নাজমুল বলেন, শুধু ছন্দ ফিরে পেতে নয়; ভালো খেললেও অনেকে আসেন। কারও অভ্যাসই তাঁর সঙ্গে নিয়মিত কথা বলা। তাঁর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করার একটা কারণ খুঁজে পেলেন নাজমুল, ‘খেলোয়াড়েরা তার কাছেই যাবে যেখানে সমস্যার সমাধানটা পাওয়া যাবে।’
দেশের শীর্ষ পর্যায়ে খেলা বেশির ভাগ খেলোয়াড়কে ভালোভাবেই চেনেন সালাহউদ্দীন। বেশির ভাগ তারকা ক্রিকেটারের কোচও তিনি। নিজে যেমন জানেন, খেলোয়াড়েরা তাঁকে চেনেন। সালাহউদ্দীন বললেন, এই দুইয়ের যোগেই সমস্যার সমাধান করা সহজ হয় তাঁর জন্য, ‘চোখের সামনেই বড় হয়েছে বলেই হয়তো আমার কাছে আসতে তারা স্বচ্ছন্দবোধ করে। ওদের মনের কথা বা সমস্যাটা ধরতে আমারও সুবিধা হয়।’
দেশের অভিজ্ঞ ও অন্যতম সফল কোচ সরওয়ার ইমরানের কাছে পেস বোলারদের আসাটা খুবই নিয়মিত ঘটনা। বোলাররা সাধারণত কী ধরনের সহায়তা চান তাঁর কাছে, সেটি বলছিলেন ইমরান, ‘অনেকে জানতে চায় নতুন বলে কীভাবে বোলিং করবে, কী ধরনের স্লোয়ার দেবে। আমি বলি, নিজের কাছে যে বৈচিত্র্য আছে, সেটা ভালো জানো, নিখুঁতভাবে কাজে লাগাও।’
শুধু পেসাররাই নন, ইমরানের কাছে ব্যাটসম্যানরাও আসেন। তবে সোহেলের কাছে সাধারণত স্পিনাররাই আসেন। এইচপি দলের সঙ্গে কাজ করায় বয়সভিত্তিক ক্রিকেটারের কাছ থেকে জানা-শোনার অবারিত সুযোগ তাঁর। সোহেল বলেন, ‘কথা বললে হয় কী, ওদের আত্মবিশ্বাস বাড়ে। একই কথা বিদেশি কোচেরা বললে এক রকম, আমরা বললে আরেক রকম।’
আখিনুর মনে করেন, টেকনিক-ট্যাকটিকস নিয়ে বিশদ কাজ করার সুযোগ কম, মনস্তাত্ত্বিকভাবে খেলোয়াড়দের উজ্জীবিত করাটাই তাঁর মূল কাজ, ‘আমার কথায় রাতারাতি সব ঠিক হয়ে যায়, তা নয়। ওদের উজ্জীবিত-অনুপ্রাণিত করি। বলি, হতাশ হওয়ার কিছু নেই। যে ম্যাচে খারাপ খেলছ, সেটা বারবার দেখ। কোথায় ভুল হচ্ছে বোঝার চেষ্টা করো, যাতে ভুলের পুনরাবৃত্তি না হয়।’
সাকিব-সৌম্যরা সেই চেষ্টাই করেন। প্রিয় কোচের দাওয়াই কাজে লাগিয়ে তাঁরা এগিয়ে চলেন, উদ্ভাসিত হন পরিপূর্ণ মহিমায়।