তবু ফুটবলে এত বিদেশি কোচ

একটা সময় একজন বিদেশি কোচ আনতে পারাটাই বড় তৃপ্তি ছিল বাফুফের কাছে। কাজী সালাউদ্দিন যুগে সেই তৃপ্তি ছাপিয়ে গেছে। তাঁর নেতৃত্বাধীন বাফুফে এখন সহকারী কোচ, গোলরক্ষক কোচ, ফিটনেস ও কন্ডিশনিং কোচ এবং টেকনিক্যাল ও স্ট্র্যাটেজিক ডিরেক্টরও এনেছে।

জাতীয় দলে অস্ট্রেলিয়ান কোচ অ্যান্ড্রু ওর্ডের সংযোজন বাফুফের বিদেশি কোচ-পরিচালকের সংখ্যা নিয়ে গেছে পাঁচে। ১ জুন নতুন কোচের ঢাকায় আসার কথা।

গত বছর এপ্রিলে বাফুফে নির্বাচনের পরপরই আসেন টেকনিক্যাল ও স্ট্র্যাটেজিক ডিরেক্টর পল স্মলি। তাঁর মূল কাজ বাংলাদেশের ফুটবলের একটা পথরেখা তৈরি করা। তাঁর দেখানো পথে আগামী চার বছরের একটা বর্ষপঞ্জি ঘোষণাও করেছে বাফুফে। এরপর আসেন নিউজিল্যান্ডের গোলরক্ষক কোচ রায়ান সেন্ডফোর্ড এবং ফিটনেস ও কন্ডিশনিং কোচ জন হুইটাল। শেষেরটি বাংলাদেশের ফুটবলে নতুন পদ। নতুন যেমন স্মলির পদটিও। গঞ্জালো মোরেনোর পদও নতুন। এটির নাম বাফুফের হেড কোচ অব প্লেয়ার্স ডেভেলপমেন্ট।

তবে সবাইকে একপাশে রেখে বাফুফের ভবিষ্যৎ কর্মসূচির সবই এখন স্মলিকেন্দ্রিক। জুতা সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ—সবই তিনি করেন। মেয়েদের দলকেও অনুশীলন করান। নিজের কাজ নিয়ে এই ইংলিশ বলেন, ‘বাংলাদেশের ফুটবলকে ওপরের দিকে নেওয়াই আমার একমাত্র লক্ষ্য।’

সেন্ডফোর্ডও যুক্ত আছেন মেয়েদের দলের সঙ্গে। হুইটাল সম্প্রতি দেশে গেছেন। মোরেনো কাজ করছেন যুব দলের ভবিষ্যৎ টুর্নামেন্ট নিয়ে। এ বছরই জাতীয় দল, মেয়েদের খেলা, এএফসি অনূর্ধ্ব-১৯, অনূর্ধ্ব-২৩ দলের খেলা আছে। বাফুফে সভাপতি বলেছেন, এসব কর্মসূচির জন্যই এত বিদেশি কোচ আনা।

কিন্তু প্রশ্নটা কোচ আনা নিয়ে নয়। ‘গরিব ফেডারেশন’ কতটা ভার বইতে পারছে বিদেশি কোচদের, সেটাই প্রশ্ন। তা ছাড়া পল বাদে অন্যদের কোচিং অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন অনেকে। জানা গেছে, থাকা-খাওয়া বাদ দিলে বর্তমানে বাফুফেকে বিদেশি চার কোচের বেতন বাবদ মাসে প্রায় ২৫ হাজার ডলার খরচ করতে হয়। স্মলি ১০-১১, হুইটাল ৬, সেন্ডফোর্ড ৫ ও মোরেনোর জন্য আড়াই হাজার ডলার। নতুন কোচের বাড়তি ১০ হাজার ডলার ধরলে বাফুফেকে এখন মাসে ৩৫ হাজার ডলার গুনতে হবে বিদেশি কোচদের পেছনে।

বিদেশি কোচ আনার ব্যাপারে বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনের যুক্তি, ‘পল (স্মলি) তো কোচ নয়, ওকে আনায় আমরা ফিফার ভবিষ্যৎ কর্মসূচির অনুমোদন পেয়েছি। পৃথিবীতে মাত্র তিনটি দেশ এটা পেয়েছে। এটার জন্যই পলকে আনা।’ বাকিদের নিয়ে তাঁর কথা, ‘আমি পাঁচজন টিচার এনেছি, আমাকে তো চেষ্টা করতে হবে। টিচার আগে ছিল না, তাই ফুটবল এই জায়গায় এসেছে। এখন টিচার এনেছি, এখন ফল পাব।’

কিন্তু এত কোচের পরও বাংলাদেশের ফিফা র‍্যাঙ্কিং নিজেদের ইতিহাসে সবচেয়ে নিচে—১৯৩। বাংলাদেশ এখন ভুটানের কাছে হারে। সালাউদ্দিন এটাকে স্বাভাবিকই ধরে নেন, ‘কোচ এনে ফল তো কালকেই পাব না। কালকেই কেউ ফল দিতে পারবে না।’ সে ক্ষেত্রে গত নয় বছর তো কম সময় ছিল না। তাহলে ফুটবল পিছিয়ে পড়ছে কেন। এসব প্রশ্নে বাফুফে সভাপতি বলেন, ‘মেসিকে তো আর্জেন্টিনা তৈরি করেনি, করেছে বার্সেলোনা। দুনিয়ার কোনো ফেডারেশন ডেভেলপমেন্ট কাজ করে না, ওটা ক্লাবের দায়িত্ব। এত দিন তারা না করায় এখন আমি করছি।’

ফেডারেশনের নাকি টাকা নেই। কিন্তু এই বিদেশি কোচদের বেতনের সংস্থান হয় কী করে? ‘টাকার সংকট আছে। তবু আমি টাকা ম্যানেজ করে কোচ আনছি তো। এ জন্য আমাকে বাহবা দেওয়া উচিত’—বলেছেন সালাউদ্দিন।

ফুটবলের টানাটানির সংসারে অবশ্য নানা অভাব-অভিযোগের কথা শোনা যায়। তা ছাড়া কোচ আনলেও ছেলেদের প্রশিক্ষণ তো নেই। তাহলে কোচ এনে লাভ কী? হুইটাল বা মোরেনো মাঠে কাজ করার সুযোগে পাচ্ছেন না। এ ব্যাপারে বাফুফে সভাপতি বলেন, ‘দুই সপ্তাহের মধ্যে সব ট্রেনিং শুরু হবে। টাকা ম্যানেজ হচ্ছে। এখন আমি জোরেশোরে নামছি।’

বিদেশি কোচ নিয়ে দেশের অন্যতম ফুটবল কোচ মারুফুল হক বলেছেন, ‘দেখতে হবে তাঁরা কী মানের কোচ। ভালো মানের হলে দেশের ফুটবলের জন্যই ভালো। এত এত টাকা দিয়ে কোচ রাখা মানে আমাদের সক্ষমতা বেড়েছে বলতে হবে। তবে সেই অনুযায়ী তৃণমূলেও কাজ দেখতে চাই।’

কিন্তু তৃণমূলে সেভাবে যাওয়া হচ্ছে না বা ‘টাকার অভাবে’ কাজ খুব কমই হয়। তাই জাতীয় দল মেধাশূন্য। অনেক সাবেক ফুটবলার বলেন, নিচ থেকে সঠিক পরিচর্যা না করলে হোসে মরিনহোর মতো কোচ আনলেও এ দেশে ফুটবলের দৃশ্যমান উন্নয়ন হবে না, যত দিন না খেলোয়াড় তৈরি হবে।