'তবে মনে তো অবশ্যই ছিল'

মাশরাফি মুর্তজা জানতেন ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে লড়াই করে সেমিফাইনালে যাওয়াটা কঠিন। তবে অসম্ভব মনে করেননি কখনোই l প্রথম আলো
মাশরাফি মুর্তজা জানতেন ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে লড়াই করে সেমিফাইনালে যাওয়াটা কঠিন। তবে অসম্ভব মনে করেননি কখনোই l প্রথম আলো
চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেমিফাইনালে ওঠা নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার আধঘণ্টা পর গত পরশু কার্ডিফের টিম হোটেলে বাংলাদেশ অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজার মুখোমুখি উৎপল শুভ্র

প্রশ্ন: একটু আগে ফোনে সেমিফাইনালে ওঠার প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়ায় প্রথম যে শব্দটা আপনি বললেন, সেটা হলো ‘অবিশ্বাস্য’। যে মুহূর্তে জানলেন সেমিফাইনালে উঠে গেছেন, আপনার অনুভূতিটা আসলে কেমন ছিল? কোথায় ছিলেন তখন?

মাশরাফি বিন মুর্তজা: আমি হোটেলের দিকে হেঁটে আসছিলাম...একা একা। সকালে বাচ্চারা চলে গেল, মনটা একটু খারাপ ছিল। ‘অবিশ্বাস্য’ বলেছিলাম, কারণ আমরা যে গ্রুপটা পেয়েছিলাম, সেখান থেকে সেমিফাইনালে যাওয়াটা সহজ ছিল না। একে তো আমরা র‍্যাঙ্কিংয়ে নিচে, তার ওপর আবার এই কন্ডিশন। অন্য গ্রুপে যারা ছিল তাদের সবার জন্যই কন্ডিশন একই রকম ছিল-কঠিন। কিন্তু আমাদের গ্রুপের বাকি তিন দলের জন্য এটা অনেকটাই চেনা। আমাদের হয়তো ভাগ্যও একটু সাহায্য করেছে, তারপরও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটা তো আমাদের জিততেই হতো। আমার ধারণা, টুর্নামেন্টের শুরুতে ৯৯ শতাংশ মানুষ, এমনকি বাংলাদেশের মানুষের কথাও যদি বলেন, কেউ মন থেকে বিশ্বাস করেনি যে বাংলাদেশ সেমিফাইনালে খেলবে। সে জন্যই বলেছি, এটা আমাদের জন্য অবিশ্বাস্য একটা ব্যাপার।

প্রশ্ন: দেশে থাকতে চ্যাম্পিয়নস ট্রফি নিয়ে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘মনে বড় একটা চিন্তা আছে।’ আবার এটাও বলেছিলেন, ‘কোনো কিছুই অসম্ভব নয়।’ এই টুর্নামেন্ট নিয়ে আপনার ভাবনাটা আসলে কী ছিল?

মাশরাফি: দেখুন, অস্ট্রেলিয়ার মতো অনেক দল আছে, যারা ম্যাচের আগে অনেক কিছু বলে। আমাদের এই আছে, আমরা ওই করব। এটা ওদের ধরন। আমার কাছে মনে হয়, এগুলো স্রেফ বড় বড় কথা। মাঠে আমি কেমন খেলছি, এর ওপরই সবকিছু ঠিক হয়। আমার খেলোয়াড়ি জীবনেই আমি কখনো এ ধরনের কথা বলিনি, বলা আমার পছন্দও না। মনে যেটা আছে, সেটা তো আছেই। আমি বললাম, আমরা সেমিফাইনালে যাব, কিন্তু যেতে পারলাম না, জিনিসটা কেমন হলো? আমাদের সুযোগ আছে, আমরা ভালো খেলে যাব। এটা বলাই শ্রেয়। তবে মনে তো অবশ্যই ছিল। জানতাম, কঠিন, তবে এমন তো না যে অসম্ভব। ওই বিশ্বাসটা আমার মনে ছিল।

প্রশ্ন: অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বৃষ্টির কারণে পাওয়া ১ পয়েন্ট কাজে এসেছে। আবার এটাও তো সত্যি, শেষ ম্যাচে দুই দলেরই জয় দরকার ছিল। বাংলাদেশ পেরেছে, অস্ট্রেলিয়া পারেনি...

মাশরাফি: ঠিক, আমাদের জন্য যে রকম সমীকরণ ছিল, অস্ট্রেলিয়ার জন্যও তো সে রকমই ছিল। অস্ট্রেলিয়ার বরং সুবিধা ছিল, এই কন্ডিশন ওদের মুখস্থ, ওদের এমন কিছু খেলোয়াড় আছে, যারা সেকেন্ডের মধ্যে ম্যাচ ঘুরিয়ে দিতে পারে। আস্কিং রেট আটে থাকলেও। আমাদের হয়তো আস্কিং রেট ৮ হয়ে গেলে ম্যাচ ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো খেলোয়াড় নেই। আস্কিং রেট ৬ হয়ে গেলে হয়তো আমরা পারব। কিছুদিন আগেও আমরা বড়জোর ২৩০-২৪০ তাড়া করা সম্ভব মনে করতাম। এখন এই কন্ডিশনেও মনে করি, প্রতিপক্ষকে তিন শর মধ্যে রাখতে পারলে জেতা সম্ভব। মানসিকতার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গেই এগুলো আস্তে আস্তে হয়ে যাবে। আমরা সুযোগ নিতে পেরেছি, এটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

প্রশ্ন: ২০১৫ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল আর চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেমিফাইনাল-এই দুটির যদি তুলনা করতে বলি...

মাশরাফি: মঞ্চ যদি বলেন, বিশ্বকাপ সব সময়ই আলাদা। তবে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিও কোনো অংশে কম না। বিশ্বকাপে ‘কাম ব্যাক’ করার সুযোগ থাকে। কারণ অনেকগুলো ম্যাচ। সেটা বড় দলের বিপক্ষে হলেও। এখানে কোনো সুযোগই নেই। এক সপ্তাহের মধ্যে তিনটি ম্যাচ শেষ। ভাবারও সুযোগ নেই, দলও বেশি নেই। ওই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এটার গুরুত্ব একটু বেশি।

প্রশ্ন: সেমিফাইনালে ওঠার প্রতিক্রিয়ায় আপনি বললেন, অন্তত আগামী ১৫ তারিখ পর্যন্ত সবাই বাংলাদেশকে সম্মানের চোখে দেখবে। আপনি তো অসম্মানের দিনগুলোতেও ছিলেন। এটাকে কি সবচেয়ে বড় পাওয়া মনে হয়?

মাশরাফি: একজন ক্ষুদ্র মানুষও কিন্তু তার সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকতে চায়। একজন খেলোয়াড় হিসেবে আমিও চাই, আমার একটা সম্মান থাকুক। আমি ছোট খেলোয়াড় হয়েও আল্লাহর রহমতে অনেক বড় বড় জায়গায় খেলার সুযোগ পেয়েছি। আফ্রো-এশিয়া কাপে খেলেছি। ড্রেসিংরুমে আমার সঙ্গে কেউ কিন্তু এসে কথা বলেনি। হয়তো আমি গিয়ে বলেছি। দলের খোঁজও কেউ নেয়নি। সে জায়গা থেকে অবশ্যই গর্ববোধ হচ্ছে। সবাই আমাদের নিয়ে টুইট করছে, তাও আবার বড় দলের খেলোয়াড়েরা। হঠাৎ করে হওয়ায় এটাকে একটা ধাক্কাও বলতে পারেন। কী ব্যাপার, এখন টুইট করছে! এটাই দুনিয়ার নিয়ম। কিন্তু আমাদের জন্য কিছুটা অবিশ্বাস্য। মাত্র দুই-তিন বছরের মধ্যেই অনেক পরিবর্তন দেখছি তো, নিজের কাছেই ভালো লাগে।

প্রশ্ন: বাংলাদেশ সেমিফাইনালে উঠতে না পারলেও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটা বিশেষ কিছুই হয়ে থাকত। যে অবস্থা থেকে বাংলাদেশ জিতেছে, সেটি তো অবিশ্বাস্য। ওই ম্যাচটা থেকে সবচেয়ে বড় পাওয়া কী?

মাশরাফি: বিশ্বাস। এটা ছিল না বলব না, বিশ্বাস বাড়াল। সবাই বুঝল, কোন পরিস্থিতি থেকে আমরা জিততে পারি! এ রকম ম্যাচ জয়ের চেয়ে বড় শিক্ষা আর কিছু হতে পারে না। আপনি যখন একটা কিছু করে ফেলবেন, তার মানে এটা সম্ভব। পরের ধাপ কী, সেটাও হয়তো সম্ভব। যে পরিস্থিতি থেকে জিতেছি, একটা অসম্ভব জিনিস সম্ভব হয়েছে। ক্রিকেটে বাজে সময় আসে, আসবে-এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই যে বিশ্বাসটা এসেছে, তাতে খেলোয়াড়দের মনে থাকবে, কোনো পরিস্থিতিতেই হাল ছাড়া যাবে না।

প্রশ্ন: যে দুজন ম্যাচটা জেতালেন, সেই সাকিব-মাহমুদউল্লাহ তো তাঁদের নিয়ে সমালোচনার জবাবও দিলেন। বাংলাদেশে এই যে দুই-তিনটি ম্যাচ খারাপ খেললেই সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ে, ক্রিকেটারদের ওপর এর কতটা প্রভাব পড়ে?

মাশরাফি: এটা তো আপনি ঠেকাতে পারবেন না। সবচেয়ে ভালো, এসবে কান না দেওয়া। ফলো না করা। কারা কোথায় সমালোচনা করছে, এসব তো খেলোয়াড়দের কানে আসেও না। তবে দেখা যায়, সব মিলিয়ে একটা পরিস্থিতি তৈরি হলো, যেটি নির্বাচক-বোর্ডের কাছে যায়। তখন হয়তো খেলোয়াড় বুঝতে পারে কোনো চাপ তৈরি হয়েছে। আমি সবাইকে বলি, ফেসবুকে কে কী লিখছে, এ নিয়ে ভাবারই দরকার নেই। সোশ্যাল মিডিয়া কখনো কখনো খুব আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। একটা কিছু পেলেই হলো। আমাদের ধৈর্যটা কম। আবার এটাও সত্যি, আমরা অল্পতেই খুশি হয়ে যাই। ভালো-খারাপ দুই দিকই আছে। তবে খারাপ দিকই বেশি। সবকিছুর ভারসাম্য থাকা উচিত। একটা দল, একজন খেলোয়াড়কে দাঁড় করাতে দিনের পর দিন সময় লাগে। আমাদের মানুষের হাতে ওই সময়টা নেই। আমরা বুঝতে পারি না, বুঝতে চাই না। গড গিফটেড দু-একজনের কথা বাদ দিলে পৃথিবীতে কোনো খেলোয়াড় পরিশ্রম ছাড়া হয়নি। তবে কথা হবে; এটাই স্বাভাবিক। খেলোয়াড়দের তা মেনে নিতে হবে; এটাও স্বাভাবিক। দর্শকেরা ছিল বলেই বাংলাদেশের ক্রিকেট এই পর্যন্ত এসেছে। বাংলাদেশ দলের কম হার তারা দেখেনি। তারপরও সমর্থন করে গেছে দিনের পর দিন। আর একটা কথা-মানুষের কথার জবাব খেলোয়াড়দের কথা দিয়ে দেওয়া মানায় না। উচিতও না। আরেকটা কথা, টাকা দিয়ে অভিজ্ঞতা কেনা যায় না। অভিজ্ঞতা মানে অভিজ্ঞতা।

প্রশ্ন: বাংলাদেশ দল যখন ম্যাচের পর ম্যাচ শুধু হেরেই যেত, তখনো আপনি দলে ছিলেন। এখনো আছেন। মূল পরিবর্তনটা কোথায় হয়েছে?

মাশরাফি: মানসিকতার পরিবর্তন। বিশ্বাসটা আনা খুব জরুরি ছিল। ভয় না পাওয়াটা। নিজের প্রতি পূর্ণ আস্থা রেখে খেলা। খারাপ সময় আসবে, খুবই স্বাভাবিক। সেটাকে না নিয়ে ভালোর জন্য যেতে হবে। বাজে দিন যেতেই পারে বোলারের, পৃথিবীর কোন বোলারের না যাচ্ছে! ইংল্যান্ডের জ্যাক বল প্রথম ম্যাচে আমাদের সঙ্গে আট ওভারে ৮০ রান দিয়েছে। এটা বাংলাদেশের কোনো বোলার দিলে তার অবস্থা খারাপ হয়ে যেত। বেন স্টোকস ইংল্যান্ডকে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনাল হারিয়ে দিয়েছে। এটা বাংলাদেশে হলে আপনি একটু ভেবে দেখেন, ওর ক্যারিয়ার থাকত কি না। আমরা শুনেছি কীভাবে পুরো দল বেন স্টোকসের পাশে ছিল, ম্যানেজমেন্ট, ইংল্যান্ডের মানুষ ওকে সমর্থন করেছে। টি-টোয়েন্টিতে যুবরাজের কাছে ছয় বলে ছয় ছক্কা খাওয়ার পর এখন স্টুয়ার্ট ব্রডের টেস্টে প্রায় ৪০০ উইকেট। এদের কত ধৈর্য ভাবেন। তার মানে ওরা খেলাটা বোঝে। কাকে দিয়ে হবে, কাকে দিয়ে হবে না, সেটা বুঝে ওরা কাজ করে। আমাদের দলে এখন প্রচুর প্রতিভা। যদি আমরা ওদের ওপর অপ্রয়োজনীয় চাপ না দিই, এরাও দেখবেন, একদিন বড় বড় খেলোয়াড় হয়ে যাবে।

প্রশ্ন: সেমিফাইনালে তো উঠে গেলেন। দলের খেলোয়াড়দের প্রতি আপনার বার্তা কী হবে?

মাশরাফি: যেভাবে খেলছিলাম, ঠিক সেভাবে খেলা। চাপ না নিয়ে পরিবার ছাড়া বাকি সবকিছু থেকে দূরে থাকা। নিজের খেলার প্রতি মনোযোগ দিয়ে চাপমুক্ত হয়ে খেলা। আমাদের ফাইনালে ওঠার সুযোগ আছে, এই চিন্তা যেন মাথায়ই না আসে। এসব ভাবলেই আমরা খারাপ খেলব। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে যেভাবে খেলেছি, সেভাবে খেললে ভালো খেলার সুযোগ আছে। কোনো কিছু ভেবে মাঠে নামিনি। একটাই পরিকল্পনা ছিল-শেষ বল পর্যন্ত আমরা খেলা ছাড়ব না। মাঠে নামার আগেই আমরা এই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম।

প্রশ্ন: আপনি ফাইনালের কথা মাথায় না আনতে বললেন। কিন্তু দেশের মানুষ তো এখন চ্যাম্পিয়ন হওয়ার দাবি তুলবে। মিডিয়াতেও অনেক কিছু লেখা হবে। এই চাপ সামলানোর কোনো পথ কি ভেবে রেখেছেন?

মাশরাফি: মানুষ তো চাইবেই, মিডিয়াও মিডিয়ার কাজ করবে। এটা তো ঠেকাতে পারবেন না। আমি দলের সবাইকে বলব, এগুলোর জবাব দেওয়ার দরকার নেই, ফলো করার দরকার নেই। পরিবার ছাড়া সবকিছু থেকে বাইরে থাকতে হবে। পরের চারটা দিন খুব গুরুত্বপূর্ণ। শারীরিক, মানসিক ও দক্ষতা তিন ক্ষেত্রেই। চার দিন অনুশীলন করে তো আর কিছু বদলানো যায় না। তবে কারও যদি কোনো কিছু থাকে, সেগুলোতে তৈরি হওয়া। শারীরিক ও মানসিকভাবে তৈরি হওয়া।