সেই কৃষ্ণারা এখন অনেক 'স্মার্ট'

কৃষ্ণারা মেয়েদের ফুটবলকে নিয়ে যাচ্ছে আরেক উচ্চতায়। ফাইল ছবি
কৃষ্ণারা মেয়েদের ফুটবলকে নিয়ে যাচ্ছে আরেক উচ্চতায়। ফাইল ছবি

কিছুদিন ধরে প্রচারমাধ্যমে ভালোই গুরুত্ব পেয়ে আসছে কিছু নাম। কৃষ্ণা রানী সরকার, সানজিদা খাতুন, তহুরা খাতুন ইত্যাদি। অজপাড়াগাঁয়ের এই মেয়েদের কে চিনত! কিন্তু বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৬ নারী দলে খেলার সুবাদে এখন তাদের পরিচিতি এসেছে। জীবনের বদলে যাওয়া মোড়ে দাঁড়িয়ে এই মেয়েরা আজ চীন তো কাল জাপান যাচ্ছে। হঠাৎ সবকিছু যেন রঙিন হয়ে উঠেছে এই মেয়েদের কাছে। কোথায় ছিল আর কোথায় এসেছে!

আসলে ফুটবল তাদের জীবনটাকে সাজিয়ে তুলেছে নতুনভাবে। পেছনের জীবনটা এখন তাদের কাছে অতীত। গ্রামের মাঠে দাপাদাপি নয়, গ্রামের পুকুরে দিনভর সাঁতার কাটার ফুরসত আজ আর মেলে না। এই মেয়েরা এখন বিমানে চড়ে নিয়মিত। কখনো সাংহাই, কখনো সিঙ্গাপুর, কখনো ওসাকা।

আগামী সেপ্টেম্বরে থাইল্যান্ডে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ ফুটবলের চূড়ান্ত পর্বে এশিয়ার সেরা আটের অভিজাত প্রতিযোগিতায় খেলবে বাংলাদেশ। ওই টুর্নামেন্টে খেলার যোগ্যতা পেয়েছে ঢাকায় এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ নারী ফুটবলে বাছাইপর্বে অপ্রতিরোধ্য থেকে চ্যাম্পিয়ন হওয়ায়।

থাইল্যান্ডে চূড়ান্ত পর্বে জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও বর্তমান চ্যাম্পিয়ন উত্তর কোরিয়ার মতো দলের সঙ্গে গ্রুপ পর্বে খেলা পড়েছে বাংলাদেশের। লড়াইটা খুব কঠিন। এই দলগুলো বাংলাদেশের ধরাছোঁয়ার অনেক বাইরে। তবু নিজেদের তৈরি করে নিতেই বিদেশে অনুশীলন ম্যাচ খেলার ব্যবস্থা করছে বাফুফে।

এর আগে চীন, জাপানে পাঠানো হয়েছিল মেয়েদের প্রস্তুতি ম্যাচ খেলতে। সিঙ্গাপুরেও যাওয়ার সুযোগ হয় একটা টুর্নামেন্টে খেলার। সেই ধারাবাহিকতায় আজ রাতে বাংলাদেশ দল দ্বিতীয়বারের মতো জাপান যাবে তিনটি অনুশীলন ম্যাচ খেলতে। এরপর কোরিয়া ও ভিয়েতনাম যাওয়ার পরিকল্পনা আছে একই উদ্দেশ্য। এভাবে বিদেশ গিয়ে ম্যাচ খেলার স্বপ্ন দেখার সাহস কখনো ছিল না মেয়েদের।

কিন্তু নিয়তি চাইলে সবই সম্ভব। কৃষ্ণাদের জীবন এখন বদলে গেছে। এ যেন সিনেমার মতন! তাদের চালচলন, পোশাক, সবকিছুতেই আধুনিকতার ছোঁয়া। চলনে-বলনে এখন তারা অনেক সাবলীল, চৌকস। জীবনের রং বদলে এখন তা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।

মেয়েদের জীবনের এই বাঁকবদল কাছ থেকে দেখছেন গোলাম রাব্বানী ছোটন। বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৬ দলের কোচের সঙ্গে কথা হচ্ছিল এ নিয়ে। গোলাম রাব্বানী হেসে বলেন, ‘আগে তো ওদের মধ্যে অনেক জড়তা ছিল। বিমানবন্দরে নেমে বা পৌঁছে কোন দিকে যাবে বুঝতে পারত না। এখন ওরা নিজেরাই বোঝে কোন দিকে যাওয়া লাগবে, ট্রানজিটে কী করতে হবে। মেয়েরা এখন বুঝতে পারে বিদেশে গিয়ে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় থাকলে খাওয়ার পর প্লেটটা ধুয়ে রাখতে হবে। কারণ, ওখানে ধুয়ে রাখার লোক নেই।’

এ তো বাইরের পরিবর্তন। আসল খেলা মাঠে। ছোটন তাতেও মুগ্ধ। বাইরের আত্মবিশ্বাসের ছাপ ভেতরেও তো পড়ে। ছোটন বলেন, ‌‌‘আগে ভিনদেশি দলগুলোকে দেখে ওরা কিছুটা হলেও শঙ্কায় থাকত, কীভাবে খেলবে? এখন আর সেটা নেই। এখন আত্মবিশ্বাস নিয়ে খেলে মেয়েরা।’

এই মেয়েরা তুর্কমিনিস্তান অনূর্ধ্ব-১৪ আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নশিপ খেলে চ্যাম্পিয়ন হয়ে এসেছে। দেশের নারী ফুটবল পতাকাকে ওরা তুলে ধরেছে ওপরে। ওরা নেপাল গিয়েছে, সফল হয়েছে। এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ আঞ্চলিক পর্বে চ্যাম্পিয়ন হয়ে নিজেদের সামর্থ্যের বার্তা জানান দিয়েছে আগেই। নেপালে ফাইনালের আগে ভূমিকম্প হয়েছিল। ভয়ে মেয়েরা জড়সড় হয়ে গিয়েছিল। সেই সব অধ্যায় পেরিয়ে আজ ওদের সামনে পৃথিবীটা খোলা বইয়ের মতো।

ছেলেরা পারেনি। সাফের মতো আসরে টানা তিনবার গ্রুপ থেকেই লজ্জাজনক বিদায়। ভুটানের কাছে হেরে ফিফা র‌্যাঙ্কিং এখন ১৯৩। পুরুষ ফুটবলের শরীরটা হাড়জিরজিরে কঙ্কাল হয়ে গিয়েছে। আর আশা দেখার মতো লোক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এই দুঃসময়ে মেয়েরা সাফে রানার্সআপ হয়ে এসেছে এ বছরই গোড়ায়। এখন অনূর্ধ্ব-১৬ দল এশিয়ার সেরা আটের লড়াইয়ের নামার আগে অনুশীলন ম্যাচ খেলছে এশিয়ার উন্নত দেশগুলোতে গিয়ে।

তবু ছেলেদের ফল খুব খারাপ হওয়ায় ফুটবলে চলছে হাহাকার। সব হতাশা দূর করে কবে যে আমাদের প্রাণের খেলা ফুটবলে আবার ফিরে আসবে ‘সুখপাখি’!