মরিনহোর জন্যও চাকরিটা কঠিন

বাংলাদেশ ফুটবল দলের নতুন কোচ l শামসুল হক
বাংলাদেশ ফুটবল দলের নতুন কোচ l শামসুল হক

কত কোচ এল, গেল। কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। জাতীয় দল খারাপ করছে টানা। সর্বশেষ ভুটানের কাছে গত অক্টোবরে হার। ফিফা র‍্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশ নেমেছে নিজেদের ইতিহাসের সর্বনিম্ন ১৯৩তম স্থানে। এই নাজুক পরিস্থিতিতে বাফুফে অ্যান্ড্রু ওর্ড নামের আরেকজন নতুন বিদেশি কোচ এনেছে। বয়সে নবীন এই কোচ জাতীয় দল নিয়ে কাজ করতে চান নতুন করে।

তাঁর কোচিং অভিজ্ঞতা খুব সমৃদ্ধ নয়। পেশাদার ফুটবলও খেলেননি। এমন একজনের হাতে জাতীয় দলের গুরুদায়িত্ব তুলে দিয়েছে বাফুফে। অস্ট্রেলীয় এই কোচকে নিয়ে আছে অনেক কৌতূহল। এই কৌতূহল কিছুটা মেটানোর লক্ষ্য নিয়েই ঈদুল ফিতরের এক দিন আগে বিকেএসপিতে অনূর্ধ্ব-২৩ দলের অনুশীলনের ফাঁকে প্রথম আলো মুখোমুখি হলো নতুন কোচের—

প্রশ্ন: আপনি অস্ট্রেলিয়া জাতীয় দলের স্কাউট ছিলেন। তো কেমন ছিল কাজটা?

অ্যান্ড্রু ওর্ড: অস্ট্রেলিয়ার প্রতিপক্ষ দলগুলো সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেছি তিন বছর। বিশ্বকাপ বাছাই বা অন্য কোনো উপলক্ষে মধ্যপ্রাচ্যে ইরান, সৌদি আরব, আরব আমিরাত গিয়েছি দলগুলো সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে। জাপান, থাইল্যান্ডও সফর করেছি একই কারণে। এই দলগুলোর ম্যাচ দেখে প্রতিবেদন দিতাম অস্ট্রেলিয়ার ফেডারেশনকে।

প্রশ্ন: বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে গত বছর বাংলাদেশের সঙ্গে খেলা ছিল অস্ট্রেলিয়ার। দুই দল মুখোমুখি হওয়ার আগে বাংলাদেশের খেলা দেখেছিলেন?

ওর্ড: বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া প্রথম মুখোমুখি হয়েছিল পার্থে, তখনই মাঠে বসে প্রথম দেখি বাংলাদেশের খেলা। পার্থ মাঠটা অস্ট্রেলিয়ার প্রিমিয়ার লিগে আমার দল পার্থ গ্লোরির হোম ভেন্যু। এর আগে বাংলাদেশ-তাজিকিস্তান ম্যাচের ভিডিও দেখেছিলাম। ওটা ছিল ঢাকায়, ১-১।

প্রশ্ন: স্কাউটিংয়ের কাজটা আসলে কীভাবে করতেন?

ওর্ড: অস্ট্রেলিয়ার ফেডারেশন আমার ক্লাব পার্থ গ্লোরিকে অনুরোধ করে বলত, আমাকে যেন তারা ৩-৪ দিনের জন্য ছাড়ে। ক্লাব ছেড়েছে এবং সংশ্লিষ্ট দেশে গিয়ে খেলা দেখেছি। এই কাজের জন্য আমি আমার ক্লাবের বড় ম্যাচও মিস করেছি। এমনও হয়েছে, দেশে অস্ট্রেলিয়া খেলছে, আর আমি হয়তো একই দিনে জাপান টিমের খেলা দেখতে টোকিওতে। এভাবে অস্ট্রেলিয়ার ম্যাচ আমার দেখা হতো না। বাইরে বাইরেই থাকতাম।

প্রশ্ন: নিশ্চয়ই ভিন্ন অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে?

ওর্ড: অনেক অভিজ্ঞতা। এশিয়া এত বড় যে প্রতিটি দেশের খেলার ধরন আলাদা। স্পেন-পর্তুগালের সীমান্ত যেমন লাগোয়া, কিন্তু খেলার ধরন ভিন্ন। ইংল্যান্ড-জার্মানির উদাহরণও দিতে পারি। এসবই আমি আসলে অনুসরণ করে এসেছি।

প্রশ্ন: শোনা যায়, আপনাকে বাংলাদেশে এনেছেন বাফুফের টেকনিক্যাল ও স্ট্র্যাটেজিক ডিরেক্টর পল স্মলি। তিনিও অস্ট্রেলিয়ান। পলের হাত ধরে আরও কয়েকজন বিদেশি কোচ বাফুফের চাকরি নিয়েছেন। পলের সঙ্গে আপনার যোগাযোগ হলো কীভাবে?

ওর্ড: পলকে আমি চিনি, জানি এবং বাংলাদেশের ফেডারেশন যোগাযোগ করলে আমি আগ্রহী হই। আমাকে তারা জানায়, কী ধরনের কোচ তারা চায়। তাদের চাওয়ার সঙ্গে আমার কাজের ধরনটা মিলে যায়। এভাবেই আসা।

প্রশ্ন: কিন্তু বাংলাদেশের কোচের চেয়ারটা সব সময়ই উত্তপ্ত থাকে। সামলাতে পারবেন তো? এখানে রোমাঞ্চটা উধাও হয়ে যেতে সময় লাগে না...

ওর্ড:  আমি ২০১২ সালে থাই জাতীয় দলের কোচিং স্টাফের সদস্য ছিলাম। তবে জাতীয় দলের প্রধান কোচ এই প্রথম এবং সব ধরনের পরিস্থিতি সামলাতে প্রস্তুত এসেই এসেছি।

প্রশ্ন: ৩০ জুন ৩৮ পূর্ণ হচ্ছে আপনার। অনভিজ্ঞতার কারণে বাংলাদেশের দায়িত্ব নেওয়া কি আপনার জন্য বড় একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে গেল? নাকি এটিকে সুযোগ হিসেবে দেখছেন?

ওর্ড: দুটিই। বাংলাদেশ দলের দায়িত্ব নেওয়া যে কারও জন্যই বড় চ্যালেঞ্জ। হোসে মরিনহোর জন্যও এই চাকরিটা কঠিন বলব। কারণ, বাংলাদেশ সাম্প্রতিক সময়ে ভালো করতে পারেনি। হয়তো আমি অবস্থার উন্নতি ঘটাতে পারি। র‌্যাঙ্কিংয়ে এগোতে পারি।

প্রশ্ন: কিন্তু বাংলাদেশের ফুটবল এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে এখন আর বিদেশি কোচ এলে কেউ আন্দোলিত হয় না। আপনি নিজে সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, আপনার হাতে জাদু নেই। তাহলে আগামী দিনে কতটা আশাবাদী হওয়া যায়?

ওর্ড: আমার প্রথম কাজ ১৯-২৩ জুলাই ফিলিস্তিনে এএফসি অনূর্ধ্ব-২৩ টুর্নামেন্ট। আগামী বছর মে মাসে সাফ হতে পারে। ডিসেম্বরে বঙ্গবন্ধু কাপ। সামনে লিগে জাতীয় দলের জন্য খেলোয়াড় স্কাউট করব। আমি চাই ভালো মানের একটা জাতীয় দল গড়ে ভালো কিছু উপহার দিতে।

প্রশ্ন: ফিলিস্তিনে জর্ডান, তাজিকিস্তান ও স্বাগতিক দলের সঙ্গে খেলা। শুরুতেই কঠিন পরীক্ষা এবং অনেকে বলছেন, বাংলাদেশের কোনো আশাই নেই এই সফরে। আপনি নিজে কী ভাবছেন?

ওর্ড: সফরটা আমাদের জন্য কঠিন ঠিক আছে। তবে এটিকে অন্যদের জন্যও কঠিন করতে চাই আমরা। কিছু গোল যেন করতে পারি। ডিফেন্ডিং যেন ভালো হয়। গোলকিপিংসহ সব বিভাগেই ভালো করার চেষ্টা থাকবে। এই কদিনে ছেলেদের শেখার মানসিকতা দেখে ভালো লেগেছে আমার।

প্রশ্ন: অটো ফিস্টার, নাসের হেজাজিদের মতো ব্যক্তিরা বাংলাদেশ দলের কোচ ছিলেন। সামির শাকির, জর্জ কোটান এখানে কাজ করে সাফল্য দিয়েছেন। বাংলাদেশের কোচ হিসেবে আপনি নিজেকে কোন জায়গায় দেখতে চান?

ওর্ড: এই কোচদের সম্পর্কে আমি জেনেছি। অবশ্যই ভালো একটা জায়গায় যেতে চাই, যা দেখে লোকে বলবে ওহ্‌, ওর্ড!

প্রশ্ন: অস্ট্রেলিয়া, থাইল্যান্ডসহ অন্য দেশে ক্লাব স্তরেও আপনি সহকারী কোচ ছিলেন। তো কোচ হিসেবে আপনার বিশেষত্ব বা কোচিং-দর্শন কী?

ওর্ড: আমার ম্যাচ রিডিং ভালো। তরুণদের নিয়ে কাজ করতে ভালোবাসি। সব সময় জিততে চাই, পজিটিভ থাকি। হ্যাঁ, বড় দলের সঙ্গে ড্র করাও ভালো। তবে অনুশীলনে দল তৈরি করি জেতার জন্যই।

প্রশ্ন: আপনি পেশাদার ফুটবলও খেলেননি। কোচিংয়ে উচ্চ শিক্ষা নিয়েছেন সেটাও নয়। এখন একটা দেশের জাতীয় দলের কোচ। এই জগতে জড়ালেন কীভাবে?

ওর্ড: আমি আধা পেশাদার ফুটবল খেলেছি সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার হিসেবে। সব সময় মনে করতাম, খেলোয়াড় হিসেবে ক্যারিয়ার গড়া আমার জন্য কঠিন। তাই অল্প বয়সেই কোচ হওয়া।

প্রশ্ন: বাংলাদেশে কাজ করে কেমন লাগছে এই কদিনে?

ওর্ড: দারুণ লাগছে। বিকেএসপি সুন্দর জায়গা। ক্লাব-ফেডারেশন সহযোগিতা করায় খেলোয়াড়দের নিয়ে ক্যাম্প করতে পারছি এখানে। সবাইকে ধন্যবাদ।

প্রশ্ন: আপনার জন্ম ইংল্যান্ডের হাডার্সফিল্ডে। কোচিং দীক্ষা অস্ট্রেলিয়ায়। আপনাকে কোন পরিচয়ে পরিচিত করব?

ওর্ড: আমার জন্ম, শৈশব কেটেছে ইংল্যান্ডে। তাই আমি একজন ইংলিশ, আবার অস্ট্রেলিয়ানও বলতে পারেন। কারণ ওখানে আমার কোচিং শেখা, বিয়ে, সংসার...। দুই দেশেরই পাসপোর্ট আছে আমার। কিন্তু এ ধরনের প্রশ্ন করছেন কেন? এটা তো নেগেটিভ প্রশ্ন হলো।

প্রশ্ন: নেগেটিভ প্রশ্ন কীভাবে হলো বুঝলাম না। আপনি ইংলিশ না অস্ট্রেলিয়ান সে নিয়ে বিভ্রান্তি আছে বলে জানতে চাওয়া। আচ্ছা যা-ই হোক, শেষ প্রশ্ন, ফুটবল নিয়ে আপনার জীবনে প্রথম বড় কোনো স্মৃতি?

ওর্ড: ছিয়াশির বিশ্বকাপে ম্যারাডোনার হ্যান্ড অব গড গোল, শতাব্দীর সেরা গোল...টিভিতে সেই ম্যাচ দেখেছি। ফুটবল
নিয়ে ওটাই আমার জীবনে সেরা  স্মৃতি। তখন আমার বয়স মাত্র ৭ বছর।