এটা বলতে পারি, আমরা একটা নাড়া দেব

২০০৬ সালের পর ২০১৭। প্রায় এক যুগ পর আবার টেস্ট খেলতে বাংলাদেশে অস্ট্রেলিয়া দল। ১১ বছর আগে ও পরের দুই টেস্ট সিরিজ নিয়ে ধারাবাহিক সাক্ষাৎকারের দ্বিতীয় পর্বে আজ থাকছেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন উৎপল শুভ্র

উৎপল শুভ্র: ড্যারেন লেম্যানের সঙ্গে দেখা হয়েছে? অস্ট্রেলিয়ান কোচের বিপক্ষে তো টেস্ট খেলেছেন আপনি। মনে আছে তো?

মাশরাফি বিন মুর্তজা: (হাসি) হ্যাঁ, মনে আছে। ২০০৩ সালে তো? ওকে অনেকক্ষণ বোলিং করেছিলাম। দুই টেস্টেই সেঞ্চুরি করেছিল। তবে একবার আউটও করেছিলাম। এবার দূর থেকে দেখা হয়েছে। কথাবার্তা হয়নি।

শুভ্র: একটা পত্রিকায় দেখলাম, এগারো বছর আগের সেই ফতুল্লা টেস্টে রিকি পন্টিংয়ের ক্যাচ ফেলে দেওয়ার দুঃখে এখনো আপনি কাতর। এটাই কি ক্যারিয়ারের সবচেয়ে দুঃখের স্মৃতি?

মাশরাফি: বলতে পারেন। ওয়ানডেতে আমার সবচেয়ে দুঃখের স্মৃতি জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে এক ওভারে ১৮ রান দেওয়া (২০০৬ সালে)। টেস্টে সবচেয়ে বড় দুঃখ, দুঃখ না বলে আফসোস বলি, ফতুল্লায় পন্টিংয়ের ওই ক্যাচটা নিতে না পারা। সেটি নিতে পারলেই আমরা হয়তো জিতে যেতাম। ওদের আর দুই উইকেট থাকত, তখনো ২৪ রান বাকি ছিল। ওই টেস্টটা জিততে পারলে আমাদের ক্রিকেটের জন্য সেটি একটা টার্নিং পয়েন্ট হতো। দুঃখটা এ কারণেই বেশি।

শুভ্র: টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের দুই দুঃখ বললে ফতুল্লা আর মুলতান আসে। মুলতানে তো আপনি খেলেননি। যদি দুটির তুলনা করতে বলি...

মাশরাফি: দুটি দুই রকম। ফতুল্লাই বেশি দুঃখের। কারণ, অস্ট্রেলিয়ার ওই দল...আমি তো বলব সর্বকালের সেরা দল। আমাদের এখানে যে দলটা এসেছিল, সেটিতে শুধু গ্লেন ম্যাকগ্রাই ছিল না। ওই দলকে কিনা আমরা প্রায় হারিয়েই দিয়েছিলাম! মুলতানের দুঃখটা আবার অন্য রকম। তখন আমি জোরে বোলিং করি। অথচ অমন ঘাসের উইকেটে খেলা আর আমি কিনা বিশ্রামে! উমর গুল আউট হচ্ছে না, এটি চেয়ে চেয়ে দেখতে হচ্ছে। সেটিও ফিল্ডিং করতে করতে। মুলতানে জিতলেও আমাদের ক্রিকেটের জন্য বড় একটা টার্নিং পয়েন্ট হতো। তবে ফতুল্লারটা আরও বড় হতো।

শুভ্র: চট্টগ্রামে দ্বিতীয় টেস্টে নাইটওয়াচম্যান গিলেস্পিকে ডাবল সেঞ্চুরি করতে দেখাও তো খুব কষ্টকর হওয়ার কথা...

ম্যাথু হেইডেনকে আউট করার পর মাশরাফি বিন মুর্তজা, ফতুল্লা, ২০০৬ l ফাইল ছবি
ম্যাথু হেইডেনকে আউট করার পর মাশরাফি বিন মুর্তজা, ফতুল্লা, ২০০৬ l ফাইল ছবি

মাশরাফি: খুবই দুঃখজনক স্মৃতি। অস্বস্তিকরও। ওকে আউট করার সব রকম চেষ্টাই করেছিলাম। সুযোগও দিয়েছিল। কিন্তু ওটা ওর ভাগ্যে ছিল। আসলে প্রথম টেস্টের হতাশার ধাক্কাটাই আমরা সামলে উঠতে পারিনি। সবারই মনে হচ্ছিল, এমন সুযোগ জীবনে আর আসবে না। গিলেস্পির ওই ডাবল সেঞ্চুরি নিয়ে জীবনে অনেক খোঁচা শুনতে হয়েছে।

শুভ্র: কারা খোঁচা দিয়েছে? পরের টেস্টগুলোতে প্রতিপক্ষ দলের খেলোয়াড়েরা?

মাশরাফি: প্লেয়াররা সেভাবে নয়। তবে পত্রপত্রিকায় কম লেখা হয়েছে নাকি! নাইটওয়াচম্যান নেমে ডাবল সেঞ্চুরি করে ফেলে, এটা কেমন বোলিং...আরও কত-কী!

শুভ্র: বাংলাদেশের বোলারদের অভিশাপেই বোধ হয় গিলেস্পির আর টেস্ট খেলা হয়নি...

মাশরাফি: (হাসি) বলতে পারেন...। আসলে ওকে তো আর ডাবল সেঞ্চুরির জন্য দলে নেওয়া হয়নি। বোলিং ভালো করছিল না বলে বাদ পড়েছিল।

শুভ্র: অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বাংলাদেশের আগের চারটি টেস্টেই খেলেছেন। কোথাও কি অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে খেলাটা আলাদা বলে মনে হয়েছে?

মাশরাফি: আমি সব সময়ই বলি, পৃথিবীতে দুইটা দল টেস্টটা হৃদয় দিয়ে খেলে। একটা ইংল্যান্ড, আরেকটা অস্ট্রেলিয়া। এই দুইটা দলের সঙ্গে যত খেলা যাবে, ততই লাভ। নিজেরা কোথায় আছি, এটা বোঝার জন্যও ওদের সঙ্গে খেলাটা খুব জরুরি। অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে যে আমরা এত কম খেলেছি, এটা তাই খুব খারাপ হয়েছে।

 শুভ্র: ২০০৬ সালের ওই অস্ট্রেলিয়া আর এবার বাংলাদেশ সফরে আসা অস্ট্রেলিয়াকে যদি ১০-এর মধ্যে মার্কিং করতে বলি...

মাশরাফি: ২০০৬ সালের অস্ট্রেলিয়া ১০-এর মধ্যে ৮, আর এই অস্ট্রেলিয়া ৪।

শুভ্র: আর সেই বাংলাদেশ আর এই বাংলাদেশ...

মাশরাফি: ২০০৬ সালের বাংলাদেশ ৩। আর এই বাংলাদেশ ৫/৬।

শুভ্র: স্টিভ স্মিথের এই অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা কোনটি?

মাশরাফি: একা ম্যাচ ঘুরিয়ে দিতে পারে, এমন দুজন প্লেয়ার আছে। আগের দলে কিন্তু এমন অনেকে ছিল। আগের অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিংটা মনে করুন না, সাত নম্বরে নামত গিলক্রিস্ট, আটে শেন ওয়ার্ন, নয়ে গিলেস্পি। ব্রেট লি-ও সুন্দর ব্যাটিং করত, অথচ ও নামত ১০ নম্বরে। এই দল ওয়ার্নার আর স্মিথের ওপর অনেক নির্ভরশীল। ভারত সফরে স্মিথ কী ব্যাটিংটাই না করল! সবাই ভালো খেলতে পারেনি বলে হেরেছে, কিন্তু ও তো দুর্দান্ত ছিল।

শুভ্র: ওয়ার্নার আর স্মিথের মধ্যে ডেঞ্জারম্যান হিসেবে কাকে এক নম্বরে রাখবেন?

মাশরাফি: উইকেট যদি ভালো থাকে, তাহলে ওয়ার্নার খুব ভালো। আর স্মিথকে আমি বলি ‘স্লো অ্যান্ড স্টেডি।’ টেরই পাবেন না, কখন এত রান করে ফেলেছে। স্পিন ভালো খেলে, এমন ব্যাটসম্যান অবশ্য ওদের দলে আরও আছে। হ্যান্ডসকম্ব আছে, রেনশ, উসমান খাজাও...। তবে যদি ইংল্যান্ড সিরিজের মতো স্পিনিং উইকেট হয়, তাহলে অবশ্য ওদের জন্যও কাজটা কঠিন হবে। অমন উইকেটে বল কী করবে বোলাররাই তা অনেক সময় জানে না, ব্যাটসম্যান জানবে কীভাবে!

শুভ্র: আপনি কি তাহলে ইংল্যান্ড সিরিজের মতো উইকেট বানানোর পক্ষে?

মাশরাফি: টেস্ট ম্যাচ জিততে হলে ও রকম উইকেটই বানাতে হবে। ফ্ল্যাট উইকেট করে কোনো লাভ নাই। ওদের পেস বোলাররা কিন্তু ১৪৫ কিলোমিটারের বেশি গতিতে বোলিং করবে। সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার ফিল্ডিং তো জানেনই। তাতে আমরা হয়তো বড়জোর ৩০০/৩৫০/৪০০ করব। খুব ভালো উইকেট হলে বড়জোর ড্র হবে। এর চেয়ে স্পিনিং উইকেটই ভালো।

শুভ্র: কিন্তু তাতে একটা ভয়ও কি নেই! অস্ট্রেলিয়ার স্পিন আক্রমণ তো ইংল্যান্ডের চেয়ে ভালো। উল্টো বাংলাদেশই যদি নিজেদের পাতা ফাঁদে ধরা পড়ে যায়...

মাশরাফি: অস্বাভাবিক নয়। ইংল্যান্ডের বিপক্ষেও তো আমরা প্রথম টেস্টে হেরেছি। আবার পরের টেস্টে জিতেছিও। তবে আমরা কিন্তু দুইটা টেস্টেই জিততে পারতাম। যেখানে উইকেট ভালো হলে আমাদের ভালো করার রেকর্ড নেই। এ কারণেই আমার কথা হলো, যেহেতু ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অমন উইকেট বানিয়ে আমরা ফল পেয়েছি, সেটিই বানাই না কেন! তাতে যদি তিন দিনেও খেলা শেষ হয়ে যায় তো যাক, জেতা-হারা দুটিরই সুযোগ আছে। তবে আপনি-আমি এত আলাপ করে তো লাভ নাই। কোচ-অধিনায়ক কী ভাবছে, তাঁদের সিদ্ধান্তই আসল।

শুভ্র: অস্ট্রেলিয়া দলে মিচেল স্টার্ক না থাকাটা তো সিরিজের প্রেক্ষাপটে খুব বড় ব্যাপার, তাই না?

মাশরাফি: অনেক বড় স্বস্তি। ও প্রত্যেকটা বল করে উইকেট নেওয়ার জন্য। প্রতিটা বলেই একই রকম গতি, একই রকম নিজেকে উজাড় করে দেয়। অস্ট্রেলিয়ার যে পেসাররা এসেছে, তাদের মধ্যে কামিন্সও জোরে বল করে। তবে আমি মনে করি, কামিন্সের চেয়ে হ্যাজলউডকে খেলার চ্যালেঞ্জটা অনেক বেশি। ওর পেস একটু কম হতে পারে, কিন্তু লাইন-লেংথের দিক থেকে অনেক বেশি ধারাবাহিক।

শুভ্র: এই সিরিজে বাংলাদেশের ‘বিগ ফোর’-এর কাছ থেকে বড় কিছু চেয়েছিলেন। তামিম-সাকিব-মুশফিক-মাহমুদউল্লাহর মধ্যে মাহমুদউল্লাহ তো দলেই নেই। একটু কি বিস্মিত?

মাশরাফি: খুব একটা না। তবে আমার ধারণা ছিল, ওয়ানডেতে রিয়াদের (মাহমুদউল্লাহ) সাম্প্রতিক যে ফর্ম, তাতে ওর ভালো সুযোগ ছিল। বাকি তিনজনের মধ্যে আমি তামিমের ভূমিকাকে সবচেয়ে বড় করে দেখি। টি-টোয়েন্টিতে অতটা না হলেও টেস্ট ও ওয়ানডেতে শুরুটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই ভালো শুরুটা তামিমের ওপরই নির্ভর করে। তামিম বাংলাদেশের পুরো ব্যাটিংটার সুর বেঁধে দেয়। অন্যদেরও ভূমিকা আছে, তবে তামিম ব্যর্থ হলে ভালো করাটা কঠিন হয়ে যায়। আর ও ভালো করলে এর উল্টো।

শুভ্র: সাকিব আল হাসান কী করেন, সেটাও তো সিরিজে বড় একটা প্রভাব ফেলবে, তাই না?

মাশরাফি: তা তো অবশ্যই। সাকিব সত্যিকার ম্যাচ উইনার। বাংলাদেশ ম্যাচ জিতলে দেখবেন, সেখানে ওর অবদান থাকবেই থাকবে।

শুভ্র: বাংলাদেশের পেস বোলিংয়ে যদি আসি, অভিজ্ঞতার অভাবটা থেকেই যাচ্ছে। শফিউল সাত বছরে টেস্ট খেলেছেন মাত্র ৯টি আর মোস্তাফিজ-তাসকিন তো নতুনই। অভিজ্ঞতার এই অভাব কি তারুণ্যের শক্তিতে ঢেকে দেওয়া যায়?

মাশরাফি: না, না, টেস্ট ক্রিকেটে তা হয় না। আমি তো বলব, এটা আমাদের পেস বোলারদের দোষ। দেখতে হবে, আমাদের আসলেই টেস্ট ক্রিকেটে ভালো করার তীব্র ইচ্ছাটা আছে কি না। আমার মনে হয়, এখানে ঘাটতি আছে। এই মানসিকতাটা তৈরি না হওয়ার একটা কারণ হতে পারে, আমরা খুব বেশি টেস্ট খেলার সুযোগ পাই না। নিয়মিত টেস্ট খেললে পেসাররা ৪ উইকেট-৫ উইকেট পাওয়ার মজাটা বুঝতে পারত। টেস্টের প্রতি একটা প্যাশন তৈরি হতো।

শুভ্র: সুনির্দিষ্টভাবে মোস্তাফিজকে নিয়ে প্রশ্ন করি। মোস্তাফিজ কি এই সিরিজে স্বরূপে দেখা দিতে পারবেন বলে মনে হয়?

মাশরাফি: আমি কিছু বলে বাড়তি চাপ করতে চাই না। শুধু মোস্তাফিজ নয়, সব পেসারের কাছেই আমার চাওয়া হলো, লম্বা স্পেলে ব্যাটসম্যানদের ওপর চাপ তৈরি করার মতো বোলিং করে যাও।

শুভ্র: ইংল্যান্ডকে তো মিরাজ বলতে গেলে একাই ধসিয়ে দিয়েছিল। এবারও তেমন কিছু আশা করা তো বাস্তবোচিত হয় না, তাই না?

মাশরাফি: আমি এই সিরিজেও ওর নির্ধারক হয়ে না ওঠার কোনো কারণ দেখি না। মিরাজের সঙ্গে কথা হয়। ওকে বলি, ক্রমাগত উন্নতি না করে কেউ গ্রেট প্লেয়ার হয়নি। নতুন কিছু শেখার চেষ্টা থাকতে হবে। এই যে সাকলায়েন যখন প্রথম দুসরা করতে শুরু করেছিল, প্রথম এক/দুই বছর ও আনপ্লেয়েবল হয়ে উঠেছিল। মিরাজেরও সামর্থ্য আছে। ও এই সিরিজে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। নাসির খেললে ওর কাছ থেকেও ভালো কিছু আশা করছি। ওকে তো আমি মিরাজের পর দেশের সেরা অফ স্পিনার মনে করি। খুব ভালো বোলার।

শুভ্র: শেষ প্রশ্ন, সিরিজ নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী কী?

মাশরাফি: ১-১ হতে পারে। আসলে জিতব না হারব, বুঝতে পারছি না। তবে এটা বলতে পারি, আমরা একটা নাড়া দেব।