সাকিব আরও একবার

অস্ট্রেলিয়া অলআউট। মাঠ ছেড়ে আসার সময় হাসিতে উদ্ভাসিত বাংলাদেশের বোলিংয়ের দুই নায়ক সাকিব আল হাসান ও মেহেদী হাসান মিরাজ। সাকিবের হাতে সেই বলটি, যেটি দিয়ে কাল তুলে নিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার ৫টি উইকেট l শামসুল হক
অস্ট্রেলিয়া অলআউট। মাঠ ছেড়ে আসার সময় হাসিতে উদ্ভাসিত বাংলাদেশের বোলিংয়ের দুই নায়ক সাকিব আল হাসান ও মেহেদী হাসান মিরাজ। সাকিবের হাতে সেই বলটি, যেটি দিয়ে কাল তুলে নিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার ৫টি উইকেট l শামসুল হক

ছাত্রজীবনে অদ্ভুত এক ক্ষমতা ছিল তাঁর। পরীক্ষার আগে কী করে যেন বুঝে যেতেন, অমুক প্রশ্নটা আসবে। অনেক সময় এমনও হতো, প্রশ্ন হাতে পাওয়ার আগেই উত্তর লেখা শুরু করে দিতেন! কানে কানে কে যেন বলে দিত, ‘ওই প্রশ্নটা তো আসবেই। লিখে ফেলো।’

ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের ক্ষমতা সাকিব আল হাসান নিশ্চয়ই ক্রিকেটার হয়েও কাজে লাগিয়েছেন। আর এই ক্ষমতা যাঁর আছে, তিনি বুদ্ধির খেলায় অন্যকে বোকা বানাতে পারবেন, সে তো জানা কথাই। সাকিবের স্পিনঘূর্ণি কথা বলে তাঁর মস্তিষ্কের হয়ে। যে ভাষা বোঝা বেশির ভাগ সময়ই দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে ব্যাটসম্যানদের জন্য। মেহেদী হাসান মিরাজের মতো তরুণ প্রজন্মের ক্রিকেটারদের চোখে, ‘তাঁর কথা বলে শেষ করা যাবে না। সাকিব ভাই ওনলি ওয়ান।’

১০ বছরের ক্যারিয়ারে সাকিবের অর্জন কম নয়। সর্বশেষ কাল মুকুটে যোগ হলো আরেকটি পালক। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে মিরপুর টেস্টের প্রথম ইনিংসে ৬৮ রানে তুলে নিলেন ৫ উইকেট। টেস্ট খেলুড়ে ৯টি দলের বিপক্ষেই ইনিংসে ৫ উইকেট পাওয়ার গৌরবান্বিত মালিক এখন। এর আগে এই গৌরব ছিল শুধু মুত্তিয়া মুরালিধরন, ডেল স্টেইন আর রঙ্গনা হেরাথের। জশ হ্যাজলউডকে ইমরুল কায়েসের ক্যাচ বানিয়ে শূন্যে মুষ্টি ছুড়লেন সাকিব। হয়ে গেলো আরেকটা রেকর্ড। সব টেস্ট দলের বিপক্ষে ৫ উইকেট পাওয়া প্রথম বাংলাদেশি বোলার!

বোলার-ব্যাটসম্যান দুইভাবেই সাকিবের সাফল্যের স্বীকৃতি বিশ্বের এক নম্বর অলরাউন্ডার হওয়া। কিন্তু খেলার বাইরে অনুশীলন বা অন্য কিছুতে ব্যাটসম্যান সাকিবের সত্তা যতটা প্রকাশিত, বাঁহাতি স্পিনার সাকিবের সত্তা ততটা নয়। নেটে দীর্ঘ সময় ব্যাটিং তিনি করেন, কিন্তু বোলিংয়ে সময় দেন কম। একটা সময় তো এমনও ছিল, ম্যাচের আগের দিন নেটে বলই করতেন না। এ নিয়ে তাঁর যুক্তিও ছিল। নেটে ওভারের পর ওভার বল করে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। নির্দিষ্ট কোনো বিষয় নিয়ে কাজ করার থাকলে শুধু সেটার জন্যই অনুশীলনে বল হাতে নেওয়া যায়। নয়তো নয়।

আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের শুরুটা যেভাবে হয়েছিল, তাতেও মনে হয়নি সাকিব কোনো দিন এত বড় বোলার হয়ে উঠবেন। ৫০তম টেস্টের এক ইনিংস এখনো বাকি, তাঁর উইকেট ১৮১টি। ইনিংসে ৫ উইকেট পেয়েছেন ১৬ বার, ১ বার দুই ইনিংসেই পেয়েছেন পাঁচটি করে উইকেট। সবচেয়ে বেশি তিনবার ৫ উইকেট পেয়েছেন জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। শ্রীলঙ্কা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে পেয়েছেন দুবার করে। অথচ ১০ বছর আগে ফিরে গেলে দেখবেন, এই সাকিবই তাঁর ক্যারিয়ারের প্রথম তিন টেস্টে ছিলেন উইকেটশূন্য!

২০০৭-এর মে মাসে চট্টগ্রামে ভারতের বিপক্ষে অভিষেক টেস্ট, ঢাকায় ওই সিরিজেরই দ্বিতীয় টেস্ট এবং পরের মাসে কলম্বোয় শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে তৃতীয় টেস্ট। সব মিলিয়ে মোট ৪৮ ওভার বল করে সাকিব উইকেট পাননি। ক্যারিয়ারের প্রথম ছয় টেস্টে উইকেট পেয়েছিলেন মাত্র ৩টি।

‘সন্তুষ্ট’ শব্দটা বোধ হয় ঠিক গেল না এ প্রসঙ্গে। কারণ সাকিব অনেক অনেক উইকেট পাবেন, এই প্রত্যাশাটাই যে তখনো তৈরি হয়নি! মূলত ব্যাটসম্যান, সঙ্গে বাঁহাতি স্পিনটাও পারেন, তখন এটাই ছিল তাঁর পরিচিতি। বোলার সাকিবকে বের করে আনেন মূলত বাংলাদেশ দলের সাবেক কোচ জেমি সিডন্স। ২০০৮-এর অক্টোবরে নিউজিল্যান্ড সিরিজে সিদ্ধান্ত নিয়েই বোলার সাকিবের ওপর আস্থা রাখেন কোচ। খণ্ডকালীন স্পিনার থেকে সাকিবকে বানিয়ে ফেলেন বিশেষজ্ঞ স্পিনার।

মাশরাফি-শাহাদাতের পর প্রথম পরিবর্ত হিসেবে বল হাতে নিয়ে ২৫.৫ ওভারে ৩৬ রানে ৭ উইকেট। মেডেন ওভার ৭টি। এরপর থেকেই যেন সাকিব আগে স্পিনার, পরে ব্যাটসম্যান। ওই বছরই দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে পরপর দুই টেস্টে ৫ উইকেট। ইনিংসে পাঁচ শিকারের অগ্রযাত্রা চলতে থাকল। যার সর্বশেষটি কাল মিরপুরে।

অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে জীবনের প্রথম টেস্টের প্রথম ইনিংসেই বৃত্তপূরণ? সাকিব হয়তো এই প্রশ্নটি যেমন জানতেন, সেটির উত্তরও!

সাকিবের কীর্তি

সব কটি টেস্ট খেলুড়ে দলের বিপক্ষে ইনিংসে ৫ উইকেট নেওয়া চতুর্থ বোলার সাকিব আল হাসান। প্রথম তিনজন—মুত্তিয়া মুরালিধরন, ডেল স্টেইন ও রঙ্গনা হেরাথ।

৫০তম টেস্টে সাকিবের এই কীর্তি। মুরালির লেগেছিল ৬৬ টেস্ট, স্টেইন ও হেরাথের ৭৫।

মুরালি, স্টেইন ও সাকিব নবম প্রতিপক্ষের বিপক্ষে প্রথম দেখাতেই ৫ উইকেটের বৃত্ত পূরণ করেছেন।

ইনিংসে ৫ উইকেট পেতে কোনো দলের বিপক্ষে চার টেস্টের বেশি খেলতে হয়নি সাকিবকে। তবে প্রথম টেস্টেই তা পেয়েছেন শুধু অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেই।