ভুটানের রোনালদোর বাড়িতে...

আঁকাবাঁকা পাহাড় পথটা পেড়িয়ে বাসার সামনে এসে দাঁড়াতেই ‌কানে বাঁজল ' ওয়েলকাম মাই ডিয়ার ফ্রেন্ড '। সুড়ঙ্গের মতো গেট গলে নিচতলায় ছোট একটি রুমে নিয়ে বসালেন । স্যাঁতসেঁতে মেঝের ওপরে তিনটি সোফা পাতা । আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কিছু জামাকাপড় । পুরো ঘরের ছবিটাই এক ফ্রেমে যেন দেখিয়ে দিচ্ছিল ভুটান ফুটবলের অসচ্ছলতার এক বিজ্ঞাপন । শুধু দেয়ালে টাঙানো কিছু রঙিন ছবিই সাক্ষী দিচ্ছিল বাড়িটি বিশেষ একজনের । যার নাম চেনচো গেইলস্টেন। ভুটানের মানুষ আদর করে যাকে ডাকে ‌' ভুটানিজ রোনালদো ' নামে।

বসার রুমের আনুষ্ঠানিকতা সেরে কাঠের পাটাতনের সিঁড়ি পেরিয়ে দুই তলার রোনালদো শোয়ার ঘরে যাওয়ার সৌভাগ্য হলো। সেখানে মেঝেতে একটি তোশক পাতা। একটি খোলা কাপ বোর্ডে সারি সারি সাজানো জার্সি। পাশেই আরেকটি কাপ বোর্ডে সাজিয়ে রাখা আছে ট্রফি ও মেডেল। ছোট ছোট কয়েকটি কামড়া মিলিয়ে এমনই সাদা মাটা রোনালদোর থিম্পুর বাড়ি । আর যাই হোক , ভুটানের রোনালদোর বাড়ির দৃশ্যটা এতটাই সাধারণ হবে সে ভাবনা অলক্ষ্যেও ছিল না। শোয়ার ঘরে বাগ্‌দত্তা স্ত্রী সোনামেং কি কে পাশে বসিয়েই শোনালেন সাদা মাটা জীবন , প্রেম - ভালোবাসা , ফুটবল ও বড় বড় পাহাড় জয় করার গল্প।

থিম্পু থেকে ২০ কিলোমিটার দূরের জেলা পারোর এক কৃষক পরিবারে জন্ম চেনচোর। বাবা-মা দুজনেই কৃষক। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট চেনচো। বড় পরিবারের ছোট সদস্য হওয়ায় আদর যত্ন ভালোই জমা ছিল তার জন্য। কিন্তু সঙ্গে ছিল অভাব - অনটন । তাই সংগ্রাম দিয়েই শুরু , আর এক একটি বাঁধা ডিঙিয়ে হয়েছে বড় বড় পাহাড় জয়ের অভ্যাস।
ভুটানিজ রোনালদো হওয়ার পথে দারিদ্র্যর সঙ্গে অনেক বড় বড় পাহাড় জয় করতে হয়েছে চেনচোকে। সব শেষে তার কৃতিত্বেই ২০১৫ সালের ১৭ মার্চ শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে এবার প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে জায়গা করে নিয়েছিল ভুটান । প্রাক বাছাইপর্বে চেনচোর জোড়া গোলেই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ২-১ গোলে জিতেছিল ভুটান। সেই ১৭ মার্চ থেকেই স্থানীয়রা আদর করে চেনচোর নামের পাশে লাগিয়ে দিয়েছে ভুটানিজ রোনালদো ট্যাগ। এরপরে তার জোড়া গোলেই গত বছর এশিয়ান কাপ প্রাক বাছাইপর্বে বাংলাদেশকে ৩-১ গোলে হারিয়ে এশিয়ান কাপের বাছাইপর্বে জায়গা করে নিয়েছে পাহাড়ি দেশটি। ভুটানের ফুটবলের সাফল্যের সঙ্গে চেনচোর নামটি মোড়ানো । পর্তুগিজ রোনালদোর যেমন গোলের ক্ষুধা , চেনচোরও তাই। কিন্তু বাস্তবতা মেনে নিজেই বললেন ,' কোথায় রোনালদো, আর কোথায় আমি । আমি শুধু তার একজন একনিষ্ঠ ভক্ত '
মাত্র ২১ বছর বয়সে জাতীয় দলের সবচেয়ে বড় ভরসার নাম হয়ে দেশের মানুষের এখন চোখের মণি চেনচো। বিভিন্ন বয়সভিত্তিক দল পেড়িয়ে ২০১১ সালে নেপালের বিপক্ষে এক প্রীতি ম্যাচ দিয়ে জাতীয় দলে অভিষেক হয় তার। এরপর জাতীয় দলের জার্সিতে ২৬ ম্যাচে গোল করেছেন ৯টি। ভুটানের জার্সিতে কোনো এক খেলোয়াড়ের নয় গোল করা বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়!

চেনচোর প্রতিভাকে উপেক্ষা করতে পারেনি বাংলাদেশের ক্লাব চট্টগ্রাম আবাহনী। তাই গত মৌসুমে লিগের দ্বিতীয় পর্বে ডেকে আনা হয়েছিল তাকে। সাত ম্যাচ খেলে করেছিলেন পাঁচ গোলও । চেনচোর স্মৃতির পাতায় এখনো তরতাজা চট্টগ্রামের স্মৃতি। এর আগে থাইল্যান্ডের ক্লাব বুরিরাম ইউনাইটেড নাম লিখিয়েছিলেন তিনি। বর্তমানে খেলছেন ভুটানিজ ক্লাব থিম্পু সিটিতে। সর্বোচ্চ পারিশ্রমিকধারী ফুটবলার হলেও অঙ্কটা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অতি নগণ্য। তাই বদলায়নি চেনচোর থিম্পুর বাড়ির দৃশ্যটাও। বাংলাদেশে খেলে বেশ কিছু যা আয় করেছিলেন , তা পারোতে থাকা বাবা- মায়ের জন্যই ব্যয় করা হয়েছে বলে জানালেন চেনচো।
পোনাখার উগুয়েন একাডেমিতে লেখাপড়া করেছেন ভুটানিজ রোনালদো । ফুটবলের স্বার্থেই উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে ছেড়ে দিয়েছেন পড়াশোনা । তবে ক্লাস টেনে পড়াশোনাকালীন সোনামেং নামের যে মেয়ের প্রেমে পড়েছিলেন , তাকে ধরে রেখেছেন আগলে । স্কুল থেকে শীতকালীন ছুটিতে থিম্পুতে এসেছিল চেনচো । সেখানেই পরিচয় এক ক্লাস ওপরে পড়ুয়া সোনামেংয়ের সঙ্গে এবং ভালোবাসার শুরু । অবশেষে জুটি বেঁধে পাঁচ বছর ধরে আছেন থিম্পুর বাড়িতে। একজন সাধারণ চেনচো কীভাবে রোনালদো হয়ে উঠলেন , ভালোবাসার মানুষটির দিকে তাকিয়ে সে গল্প বলতে বলতে কখনো পাহাড়ের চূড়ায় উঠে বসলেন , আবার কখনো চলে গেলেন স্কুলের স্মৃতিতে । সব স্মৃতির ভেলায় ভুটানের রোনালদোর পাশে বসে বিকেলটা কেটেছিল জম্পেশ।