না জিতেও তারা চ্যাম্পিয়ন

চার রত্নের সঙ্গে কোচ মনিরুল (মাঝখানে)। ছবি: প্রথম আলো
চার রত্নের সঙ্গে কোচ মনিরুল (মাঝখানে)। ছবি: প্রথম আলো

গলায় সোনার পদক ওঠেনি। ক্যামেরা ফ্ল্যাশ লাইটও জ্বলে ওঠেনি। সন্ধ্যায় মঞ্চ আলো করে সবাই যখন মাথা এগিয়ে দিয়ে গলায় পদক ঝুলিয়ে নিচ্ছে, ওপরের গ্যালারিতে বসে শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে আছে চারজন। তবু হতাশা নেই। প্রকৃতি যে অদৃশ্য মেডেল ঠিকই ঝুলিয়ে দিয়েছে তাদের গলায়!

আজ মিরপুরের সুইমিং কমপ্লেক্সে গিয়ে দেখা মিলল এই চার লড়াকুর। জাতীয় বয়সভিত্তিক সাঁতারে অংশগ্রহণ করার জন্য পাবনা থেকে এসেছে। খুশি খাতুন, আরিফ আরমান সোহান, ওবায়দুর কবির তানাম ও যূথী খাতুন। সমাজের চোখে তারা চারজন প্রতিবন্ধী। কিন্তু জাতীয় সাঁতারে ঝাঁপ দিয়ে দেখিয়ে দিল, জীবনের উত্তাল সাগরে সাঁতরে চলতে কোনো বাধাকেই আর বাধা মনে হয় না তাদের।
কেউ কথা বলতে পারে না। শোনে না কানেও। যোগাযোগ করতে হয় ইশারায়। শারীরিক এই প্রতিবন্ধকতার জন্য বিশেষ সুবিধা চায়নি, বিশেষ প্রতিযোগিতা লড়াইও করেনি। সুস্থ-সবল বাকি সব দেশসেরা প্রতিযোগীদের সঙ্গেই লড়াই করেছে। চারজনই নানা ধাপ পেরিয়ে নিজ নিজ ইভেন্টের ফাইনালেও গিয়েছিল। একজনের একটুর জন্য ব্রোঞ্জ হাতছাড়া হয়েছে।
শুধু শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নয়, জয় করতে হয় হাজারটা বাধা। দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত জীবন। প্রতিবন্ধী বলে আশপাশ থেকে খোঁটা শুনতে হয়, অবহেলা থাকে। সহমর্মিতার নামে অনেকে করে করুণা। আর যদি সে মেয়ে হয়? লিখে বোঝানো দূরের কথা, হয়তো আমরা বুঝতেই পারব না তাঁর কষ্ট।
১৩ বছর বয়সী খুশি খাতুনের কথাই শুনুন। ভ্যানচালক বাবা নিজের তিন চাকায় মেয়েকে চাপিয়ে ১০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে নিয়ে আসেন পাবনার সুইমিংপুলে। সেখানেই মেয়ে পানির মধ্যে হাত ছড়িয়ে বোনে স্বপ্ন। এই মেয়েটি অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকায় স্পেশাল অলিম্পিকে সাঁতরে বাংলাদেশকে এনে দিয়েছেন দুটি পদকও।
খুশির মতোই যূথীর জীবনের গল্প। বাবা কাজ করেন ইটভাটায়। কয়েক বছর ধরে খুশি, যূথী, রোহানদের সঙ্গেই সবচেয়ে বেশি মিশতে হয় কোচ মনিরুল ইসলামকে। ওদের সঙ্গে ইশারায় তিনিই সবচেয়ে ভালো যোগাযোগ করতে পারেন। সবার গল্পটাই একে এক শোনালেন তরুণ এই কোচ।
রোহানের বাবা অটোচালক। ১৫০০ মিটার ফ্রি স্টাইলে অল্পের জন্য ব্রোঞ্জ হাতছাড়া করে হয়েছে চতুর্থ। অনুশীলনে এই ছেলেমেয়েদের পেছনে পেছনে অনেক বেশি ঘাম ঝরাতে হয় কোচ মনিরকে। তবুও তাঁর তৃপ্তি,‌ ‌‘ওদের যেন আগ্রহ বাড়ে সে জন্য এই প্রতিযোগিতায় এনেছিলাম। ভাবিইনি ওরা ফাইনাল রাউন্ড পর্যন্ত যাবে। আমাকে ওরাই অবাক করে দিয়েছে। ওদের পেছনে অনুশীলনে অনেক পরিশ্রম হয় সত্যি। কিন্তু ওদের দিক দিয়ে যখন ভাবি, তাদের পরিশ্রম আর চেষ্টার কাছে তো আমি কিছুই না। ওদের সাহসের কথা ভেবে খুব ভালো লাগে।’
তিন দিনব্যাপী জাতীয় বয়সভিত্তিক সাঁতারের পর্দা নামল আজ। এই দুই বালক ও বালিকার জীবনের মঞ্চে পর্দা কখনো নামে না।