বাঘের গর্জন শুনছে বিশ্ব

২০০০ সালের ১০ নভেম্বর ঢাকার বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে বাংলাদেশের অভিষেক টেস্ট দল। ছবি: শামসুল হক
২০০০ সালের ১০ নভেম্বর ঢাকার বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে বাংলাদেশের অভিষেক টেস্ট দল। ছবি: শামসুল হক

প্রত্যাশা ছিল নেলসন ম্যান্ডেলার দেশে গিয়ে আমরা আরও অনেকটাই ভালো খেলব। মুশফিকের দল, মাশরাফির দল বা সাকিবের দল হারতে হারতে জিতবে, জিততে জিততে হারবে, লড়াই করবে। তেমনটা হয়নি, যা আমরা চেয়েছিলাম। এই চাওয়াটার পেছনে অনেকটাই যুক্তিনির্ভর স্বপ্নের তাগিদ ছিল।

সাম্প্রতিক মৌসুমগুলোতে আমাদের ক্রিকেটীয় অর্জনগুলো আমাদের সাফল্যতৃষ্ণা এতটাই বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে আমাদের নিজের মাঠে অন্য দলগুলো আমাদের যেভাবে প্রবল প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচনা করছে, তার নিরিখে আমাদের বিদেশের মাটিতে জেতার আগ্রহ এখন একটা পরিষ্কার অবয়ব পেয়েছে। সে আগ্রহের উড়াল বিঘ্নিত হলে আমরা ব্যথিত হই। নিজেদের দোষ-ত্রুটি নিয়ে আলোচনার ঝোড়ো হাওয়া বইয়ে দিই। বিবেচনায় নিতে চাই না প্রতিপক্ষের খেলাটি নিয়ে দাপুটে উত্তরাধিকার। ঘরের মাঠে আমরা যেমন প্রাধান্যবিস্তারী আবহ নির্মাণে সরগরম হয়েছি, তেমন ব্যাপারটা ওদেরও আছে। এসব আমরা বুঝি না যে তা নয়। তারপরও আমরা জয় চাই এবং না পেলে ব্যথিত হই।

এই চাওয়াটা বা এই আশাহত বেদনার আওতায় প্রবেশ আমাদের ক্রিকেটীয় মানসিকতার একটা অবস্থান। এটাও আমাদের অর্জন করতে হয়েছে দীর্ঘ চর্চা ও অনুশীলনের মাধ্যমে। একটু একটু স্বপ্নপূরণের মাধ্যমে আমরা বড় স্বপ্নের আওতায় ঢুকেছি। যে বিশ্ব ক্রিকেটের এক কোণে জায়গা পাওয়ার জন্য আমাদের চরম আকুলিবিকুলি ছিল দৃষ্টিগোচর নিকট অতীতেই, সেই বিশ্ব ক্রিকেটকে শাসন করার ইচ্ছাটা এখন সাহসী পেখম মেলেছে। তাই দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে ডি ভিলিয়ার্স, আমলা, রাবাদাদের সঙ্গে লড়াইহীন পরাজয়ে আমাদের ক্ষোভ জাগে। আত্মবিশ্লেষণে, কার্যকারণের শিকড় সন্ধানে আমরা ব্যস্ত হয়ে উঠি। খেলোয়াড়দের প্রতি হাপিত্যেশি নির্মম বাক্যবাণ ছুড়ে দিই। সহমর্মিতার অবস্থান থেকে তাৎক্ষণিকভাবে সরে যাই আবার ফিরে আসার আগ্রহে।

তাই বলছিলাম দক্ষিণ আফ্রিকার সফর নিয়ে আমাদের যে নৈরাজ্য, যে গ্লানিবোধ, সেটা বছর কয় আগেও আমরা স্বাভাবিকভাবেই নিতাম। এখন নিতে পারছি না। এই নিতে না পারাটাই একটা বড় মাপের মানসিক অর্জন। এই বোধের জায়গায় আমরা পৌঁছেছি আমাদের ক্রমেই বড় হওয়া, প্রবল হওয়া গত দিনগুলোর ক্রিকেট ও ক্রিকেট ভাবনা নিয়ে। আমাদের ক্রিকেট ইতিহাস নিয়ে। দক্ষিণ আফ্রিকার ফলাফল যদিও নানা করণীয়র নির্দেশ দিয়ে বিচলিত করে, তবু চাহিদা পূরণ না হওয়ার বেদনাটা একই সঙ্গে ভিন্ন ধরনের এক প্রাপ্তির পরশ দিয়ে যায়। আমরা এখন দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে, অস্ট্রেলিয়া বা অন্যান্য দেশে গিয়ে জিততে চাই। এর মধ্যে কোথাও কোথাও জিতেছিও। এই বিদেশের মাটিতে জিততে চাওয়ার প্রাবল্য তো একধরনের অর্জন।

নিজ আঙিনায় আমরা আজ যেমন দাপুটে চেহারা নিয়ে খেলছি, সেখানে পৌঁছাতে সময় লেগেছে। আরেকটু রয়ে-সয়ে এগোই, বিদেশেও প্রবল হয়ে উঠব। শুধু লক্ষ রাখতে হবে পিছিয়ে যেন না পড়ি, অগ্রযাত্রা যেন ক্রমেই মসৃণতার দিকে যায়। পিছিয়ে পড়ার আলামত দৃষ্টিগ্রাহ্য হলেই যেন মুছে ফেলতে যত্নবান হই। ক্রিকেটের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করার উদাহরণ যেমন আছে, তেমনি আছে ঐতিহ্যকে বা ক্রমোন্নতির ধারাকে ধরে রাখতে না পারার করুণ আখ্যান। আমাদের সাবধানে পথ চলতে হবে। ঘরোয়া ক্রিকেটের অযত্ন, সাংগঠনিক অসততা, ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার কূটকৌশলী বিন্যাস, ক্রিকেট কেন, যেকোনো খেলারই অগ্রযাত্রা ব্যাহত করে। ক্ষেত্রবিশেষে অতলে তলিয়ে দেয়। আমাদের একটু চোখ-কান খোলা রেখে চলতে হবে। ওই সব আত্মবিধ্বংসী আলামতের অপছায়া যেন আমাদের স্বপ্নপথের উড়াল না থামায়।

প্রায় শূন্য থেকে শুরু করা আমাদের ক্রিকেট মাত্র চার দশকের চর্চায় দেশকে যেখানে পৌঁছে দিয়েছে, সেটা আমাদের গর্ব করার এক বিশাল উপলক্ষ। বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে মাথা তুলে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে ক্রিকেট আজ আমাদের এক প্রধান উপলক্ষ। মিরপুরে আমাদের ক্রিকেটের যে বাস্তুভিটা, সেখানে যেতে আজ সাধারণ দর্শনার্থীর তকমা লাগে। তিনতলা সদর দপ্তরে। দীর্ঘ অলিন্দ, এ-মাথা ও-মাথা মাড়াতে সময় লাগে। শত শত কর্মকর্তা-কর্মচারী। প্রতিদিন কলম নিয়ে, ক্যামেরা নিয়ে সংবাদমাধ্যমের কর্মীবহর অপেক্ষায় থাকে খবরাখবর নিতে।

তবে যাত্রার উৎসে চিত্রটা ছিল একেবারেই উল্টো। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের দুই খুপরি সদর দপ্তর। সেটা কর্মব্যস্ত হয়ে উঠত সন্ধ্যাবেলা। খণ্ডকালীন এক করণিক, এক অফিস সহকারী, হিসাব বিভাগ বলতে ফুটবল ফেডারেশনের অফিসে রাখা স্টিলের একটি আলমারি। ফুটবলের হিসাব কর্মকর্তা অবসরে ক্রিকেটের নথি সামলাতেন। সেই অনাহারী অবস্থা থেকে আজকের হাজার কোটি টাকার নাড়াচাড়া করা করপোরেট অফিস। বাংলাদেশের ক্রীড়া প্রেক্ষাপটে এ এক তুলনারহিত উজ্জ্বল অগ্রযাত্রার নিদর্শন। যাঁরা চার দশক ধরে এ অগ্রযাত্রা প্রত্যক্ষ করেছেন, আজকের মিরপুরে দাঁড়িয়ে তাঁদের মনে হতেই পারে, এ কি সত্যি সত্যি দেখছেন, নাকি স্বপ্ন, নাকি মায়া।

ক্রিকেটের আজকের যা চাকচিক্য, যে স্ফীত বিত্তের ভার, তা গত দিনের স্বপ্নাতুর ক্রিকেটারদের পরিশ্রমী ঘামের রসদে তিলে তিলে সঞ্চিত, নির্লোভ সংগঠকদের ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো আন্তরিকতায় ভেজা, নিষ্ঠাবান কর্মকর্তাদের বুদ্ধিদীপ্ত পরিচালনার ফসল। পূর্ব প্রজন্মের প্রেরণায় উত্তর প্রজন্ম এগিয়েছে। সময়ের সঙ্গে বেড়েছে খেলার মান। এ এক প্রবহমান ধারা। সহায়ক উপকরণ যত উন্নত হবে, এ প্রবাহ তত বেগবান হবে। তাই বলছিলাম ক্ষণিকের অসাফল্যে আমাদের ক্রিকেটারদের শ্লেষে-বিদ্রূপে জর্জরিত করার আগে আমাদের ভেবে দেখা উচিত, বর্তমান প্রজন্ম আগের প্রজন্ম থেকে ক্রিকেটকে আরেকটু এগিয়ে দিয়েছে কি না। বিষয়টি বিবেচনায় নিলে দেখা যাবে তিরস্কার করা একটু কষ্টকর।

আমাদের খেলোয়াড়, সংগঠক, সমর্থক, বিদেশি কোচ—সবাই মিলে আমাদের ক্রিকেটকে যে জায়গায় পৌঁছে দিয়েছেন, তা নিয়ে আমরা গর্ব করতেই পারি। একটি সফরের ব্যর্থতা সে গর্বকে ম্লান করতে পারে না। বিশ্বসেরা দলগুলোকে যেকোনো ফরম্যাটে আমরা হারিয়েছি। আমাদের হিসেবে অজেয় কেউ নেই। ঘরের মাঠ, বাইরের মাঠের প্রশ্ন এনে আমাদের অর্জনগুলোকে খাটো করার কোনো অবকাশ নেই।

এই যে আমাদের ক্রিকেটের বিকাশে ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রে দেশি প্রশিক্ষকদের কথা উল্লেখ না করে বিদেশি কোচদের কথা বললাম, তার একটা কারণ আছে। কারণ, তাঁদের কথা কেউ জোর দিয়ে বলতে চায় না। বিদেশিদের কথাই বলে। ক্রিকেট বোর্ডের সংবিধানও তাঁদের প্রতি অনুদার। ক্রিকেট পরিচালনা পর্ষদে সংশ্লিষ্ট সব মহলের প্রতিনিধিত্ব আছে। সংগঠক, খেলোয়াড়, আম্পায়ার—সবার। নেই শুধু প্রশিক্ষকদের। তাই চলতি হাওয়ার পন্থী হয়ে আমিও তাঁদের কথা বললাম না। তাঁদের পরিশ্রমের অনুমোদন ক্রিকেটারদের হৃদয়ে হৃদয়ে আছে। সেটা থাকলেই চলবে।

ক্রিকেট নিয়ে দেশজোড়া তোলপাড় দেখে মনে হয় ক্রিকেট নিয়ে কাজ হচ্ছে। বিদেশি দলগুলো যখন সংযত হয়ে আমাদের নিয়ে কথা বলে, তখন মনে হয় আমরা খানিক এগিয়েছি। সাকিবের বিশ্বসেরা হওয়া, এমসিসি ক্রিকেট কমিটির সদস্য হওয়া যখন আমাদের বুকের ছাতি চওড়া করে, তখন বুঝি বিশ্বমঞ্চে আমরাও কেউকেটা।

আর আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন জাতীয় পরিচয়পত্রের প্রথম স্মার্ট কার্ড মাশরাফি-মুশফিকদের হাতে তুলে দেন, তখন বুঝি আমাদের ক্রিকেট কোথাও পৌঁছে গেছে।