এই আমাদের খেলার পরিবেশ!

ছবিগুলো দেখে কে বলবে, এটাই বাংলাদেশের ‘ক্রীড়া রাজধানী!’ বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম ঘিরে দেশের ক্রীড়াঙ্গনের প্রাণকেন্দ্র রীতিমতো এক বাজার! ছবি: হাসান রাজা
ছবিগুলো দেখে কে বলবে, এটাই বাংলাদেশের ‘ক্রীড়া রাজধানী!’ বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম ঘিরে দেশের ক্রীড়াঙ্গনের প্রাণকেন্দ্র রীতিমতো এক বাজার! ছবি: হাসান রাজা

খেলোয়াড়েরা স্টেডিয়াম এলাকায় ঢুকে স্বস্তিতে মাঠে খেলতে যাবেন, সে উপায় নেই। এদিক থেকে স্রোতের মতো রিকশা ঢুকছে, ওদিক থেকে সাঁই সাঁই করে গাড়ি। একটু এদিক-ওদিক হলেই দুর্ঘটনা। আবার বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের বৃত্তাকার পথ ধরে হাঁটবেন, সেখানেও ঝামেলা। অজস্র দোকান, থরে থরে পণ্য সাজানো। ক্রেতারা ঢুকছেন, বেরোচ্ছেন-গিজগিজে ভিড়। খেলোয়াড়দের কথা বাদ দিন, দর্শকই তো মানসিক প্রশান্তি নিয়ে স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে যেতে পারেন না। 

এই হলো ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম এলাকার চিত্র। আশপাশে আরও কয়েকটি ক্রীড়া স্থাপনা মিলিয়ে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের প্রাণকেন্দ্রই বলা যায় এটিকে। ৭৩৮টি দোকান আছে। আছে আসবাব, হার্ডবোর্ড, বেডিংসামগ্রী ও ক্রীড়াসরঞ্জামের দোকান, বেশির ভাগই অবশ্য ইলেকট্রনিকসামগ্রীর। দোকান বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের নিচতলা থেকে তিনতলাজুড়ে। হকি স্টেডিয়াম ঘিরে। সাঁতারপুলের নিচে। ভলিবল কোর্ট ঘিরে। দোকান, দোকান আর দোকান। প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার বেচাকেনা।

সব ক্রীড়া অবকাঠামোর মালিক যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অধীন জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ। প্রতিষ্ঠানটি স্বায়ত্তশাসিত। সরকারের নির্দেশ, প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব আয় বাড়াতে হবে। ক্রীড়া পরিষদ খেয়ে না-খেয়ে দোকান বাড়িয়েছে। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের ২৪টি শৌচাগার পর্যন্ত ভেঙে দোকান বানানো হয়েছে। সঙ্গে আছে হকারদের ভ্রাম্যমাণ পান-বিড়ি-সিগারেট, চটপটি, ফুচকা এবং আরও নানা রকম খাবারের দোকান। স্টেডিয়াম এলাকায় ঢুকলে মনে হবে খেলা নয়, ব্যবসাই আসল। ব্যবসার জন্যই এই স্টেডিয়াম কমপ্লেক্স।২৫ হাজারেরও বেশি দর্শক ধারণক্ষমতার এই স্টেডিয়ামে দর্শকদের জন্য শৌচাগারের সংখ্যা একেবারেই অপ্রতুল। ফুটবল আগের মতো দর্শক টানলে হাজার হাজার দর্শকের বর্জ্যের গন্ধে স্টেডিয়ামে ঢোকা যেত না। মনুষ্য বর্জ্যজনিত তিক্ত একটা অভিজ্ঞতা আছে এই লেখকের। ১৯৮৮ এশিয়া কাপ ক্রিকেটের আয়োজক ছিল বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম। ভারত-শ্রীলঙ্কা ফাইনাল দেখে বেরোচ্ছি। স্টেডিয়ামের ওপরের গ্যালারি থেকে ঝরঝর করে প্রস্রাব-বর্ষণ। তখন ঢাকায় ষড়ঋতু নিয়মিত ছিল। বৈশ্বিক উষ্ণতার উপস্থিতি এতটা নির্মম হয়ে ওঠেনি। অক্টোবর মাসেই শীতের দাপট। গা ঘিন ঘিনে ভাবটা দূর করতে সন্ধ্যায় ছাত্রাবাসে গিয়ে শাওয়ারের নিচে যেতে থাকলাম বারবার। ঠান্ডা লাগিয়ে বাঁধিয়ে ফেললাম ব্রঙ্কাইটিস!

স্টেডিয়াম এলাকায় আরও কত মনুষ্য বর্জ্যের অবাধ অধিকার! কফ, থুতু, পানের পিক। যত্রতত্র, বাছবিচার নেই। এই থুতু নিয়েই একটি বিব্রতকর গল্প বলা যাক। ২০০৪ সালে নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট দল বাংলাদেশে এল পূর্ণাঙ্গ সিরিজ খেলতে। একদিন বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে অনুশীলন শেষে বেরোচ্ছেন কোচ ডেভ হোয়াটমোর। কী একটা বিষয়ে তাঁর বাড়তি একটি উদ্ধৃতি নেওয়ার জন্য ছুটছি পেছন পেছন। ক্রিকেট বোর্ডের গেট পেরোতেই এক ভদ্রলোক (?) ‘ওয়াক থু’ করে থুতু ফেললেন একদলা। আরেকটু হলেই আমার কিংবা হোয়াটমোরের গায়ে পড়ত। বাংলাদেশের অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট কোচ আমাকে হ্যাঁচকা টান মেরে পিছিয়ে এলেন। তারপর যা বললেন, শুনতে ভালো লাগেনি, ‘বাবা (পাপা) তোমাদের দেশটা ভালো। মানুষগুলো আরও ভালো। কিন্তু এটাই আমার সবচেয়ে খারাপ লাগে, যেখানে-সেখানে কফ-থুতু ফেলা। মানুষের মুখে এত কফ-থুতু থাকে কী করে বলো তো!’ জুতসই উত্তর সেদিন হোয়াটমোরকে দিতে পারিনি। বাঙালি পরিচয়ে কখনো দেওয়া যাবে বলে জোর পাই না। 

দ্রুত ক্রীড়াবান্ধব পরিচিতিটা হারিয়ে ফেলছে এই স্টেডিয়াম এলাকা। ভবঘুরে, মাদকসেবী, মাদক বিক্রেতা, ছিন্নমূল মানুষদের উৎপাত বেড়েই চলছে। আগে একবার এই মাদকের উৎপাত নিয়ে প্রথম আলোয় লেখালেখি হলে ক্রীড়া পরিষদ ‘লাঠি-বাঁশি পাহারা’র ব্যবস্থা করেছিল। একটা ভ্রাম্যমাণ ‘পাহারা দল’ সারা স্টেডিয়াম এলাকা চক্কর দিত রাতে। যদিও অনেকটাই লোক দেখানো ব্যবস্থাটা চালু থাকেনি বেশি দিন।

ছবিগুলো দেখে কে বলবে, এটাই বাংলাদেশের ‘ক্রীড়া রাজধানী!’ বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম ঘিরে দেশের ক্রীড়াঙ্গনের প্রাণকেন্দ্র রীতিমতো এক বাজার! l হাসান রাজা
ছবিগুলো দেখে কে বলবে, এটাই বাংলাদেশের ‘ক্রীড়া রাজধানী!’ বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম ঘিরে দেশের ক্রীড়াঙ্গনের প্রাণকেন্দ্র রীতিমতো এক বাজার! l হাসান রাজা

আবার আসা যাক রিকশা-ভ্যান আর গাড়ির উপদ্রব প্রসঙ্গে। অনেক আগেই বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের গেট ইজারা দিয়েছে ক্রীড়া পরিষদ। তিন গেটেই সতর্ক পাহারা। গাড়ি কিংবা রিকশা নিয়ে ঢুকতে গেলে আপনাকে শুল্ক দিতে হবে। যেতে ২০ টাকা, আসতে ২০ টাকা। অজস্র গাড়ি ঢুকছে আর বেরোচ্ছে। যানজট এড়িয়ে চলার একটা পথ হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে স্টেডিয়াম। বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ প্রান্ত দিয়ে দিলকুশা-মতিঝিল যাবেন, ঢুকে পড়ুন স্টেডিয়াম দিয়ে। যানজটে নাকাল হওয়ার চেয়ে ২০ টাকা খরচ করা খারাপ কী! ক্রীড়া পরিষদের ভান্ডারে যোগ হলো টাকা, ভারী হলো ইজারাদারের পকেট। 

ক্রীড়া পরিষদ আয় বাড়াতে গিয়ে খেলাধুলার সুন্দর পরিবেশের কথাটা বেমালুম ভুলে বসে আছে। বয়োজ্যেষ্ঠ একজন ক্রীড়া সংগঠক সেদিন দুঃখ করে বলছিলেন, পরিষদের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা তো ক্রীড়া উন্নয়নের জন্য আসেননি, এসেছেন চাকরি করতে। আগের কর্মকর্তাদের মতো ক্রীড়ামন এঁদের নেই। এঁরা সকাল ১০টায় আসেন, বিকেল ৫টায় চলে যান। কথার পিঠে অবশ্য কথা আসে। এই যে স্টেডিয়ামেই এত এত ক্রীড়া ফেডারেশনের অধিষ্ঠান, এগুলোর কর্মকর্তারাই বা ক্রীড়াঙ্গনের পরিবেশ রক্ষার জন্য কী করছেন?

নিজেরা ফেডারেশন কার্যালয়ে যাওয়া-আসার পথে, মাঠে যেতে ‘আহা-উহু’ করছেন। হয় অসীম উদাসীনতা নতুবা সীমাহীন ধৈর্যের কারণে তাঁরা এসবের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন না। আজ পর্যন্ত শোনা যায়নি ফেডারেশনের কর্মকর্তারা (বেশির ভাগই যাঁরা ক্রীড়া সংগঠক) একজোট হয়ে বলেছেন, স্টেডিয়ামের পরিবেশটা ক্রীড়া উপযোগী করতে হবে। স্টেডিয়ামে যান্ত্রিক যানবাহনের প্রবেশ বন্ধ করার জন্য ক্রীড়া পরিষদ বা সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন বলেও শোনা যায়নি।

আন্তর্জাতিক খেলায় অর্জন যা-ই থাক, আয়োজক হিসেবে বাংলাদেশ খুব নাম কিনছে। কদিন আগে হয়ে গেল এশিয়ান আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপ। বাংলাদেশসহ ৩৩টি দেশের প্রায় ২০০ খেলোয়াড় তির-ধনুকের খেলাটা খেলেছেন বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে। কিন্তু স্টেডিয়ামের এই ভিড়ভাট্টা, ময়লা-আবর্জনায় আবিল পরিবেশটা কেমন বাংলাদেশকে তুলে ধরেছে তাঁদের সামনে?

অক্টোবর মাসে আট জাতি এশিয়া কাপ হকি হলো মওলানা ভাসানী স্টেডিয়ামে। ওই স্টেডিয়ামের সামনেই তখন রীতিমতো ময়লার ভাগাড়। কর্মকর্তারা ওটা ফেডারেশনের পক্ষ থেকে পরিষ্কার করার উদ্যোগ নেননি। এশিয়ান হকি ফেডারেশন যে তেমন আপত্তি তোলেনি! আহা, কী যুক্তি!

আমাদের ক্রীড়া কর্মকর্তারাও ভুলে গেছেন, ক্রীড়াঙ্গনের সুন্দর পরিবেশ বলে একটা বিষয় আছে। ক্রীড়াদক্ষতা বাড়ানোর জন্য এটির গুরুত্বও কম নয়। যত দিন পর্যন্ত না এই গুরুত্ব উপলব্ধি করা যাবে, তত দিন খেলার পরিবেশ এমন অসুন্দরই থাকবে। তাতে মাঠের খেলার দৈন্য আরও বিদ্রূপ করতে থাকবে জাতিকে।