ফুটবল না খেলেও মেসি-রোনালদোর মতো আয়

একসময় তো রিয়াল মাদ্রিদ একাদশের প্রায় অর্ধেকই জড়িত ছিলেন মেন্ডেজের সঙ্গে। ফাইল ছবি
একসময় তো রিয়াল মাদ্রিদ একাদশের প্রায় অর্ধেকই জড়িত ছিলেন মেন্ডেজের সঙ্গে। ফাইল ছবি

সাদা চোখে যা দেখা যায়, বিষয়গুলো সব সময় আসলে সেভাবে ঘটে না। এ নিয়ে আমরা কিছুটা ভাবনাচিন্তা করেও ছেড়ে দিই। ফুটবলে দলবদল বিষয়টিও ঠিক সে রকমই। কিছুটা সবাই দেখে, বাকি কেউই না। প্রতি দলবদলের মৌসুমেই খেলোয়াড়দের ঠিকানা বদলাচ্ছে। আমরাও দেখছি, শুনছি, বুঝছি। তবে চোখের সামনে দেখা এ ঘটনাতেও থাকে অনেক অদেখা কিছু।

একজন খেলোয়াড়কে খুঁজে বের করার দায়িত্ব থাকে মূলত স্কাউটদের। কোনো খেলোয়াড় সম্পর্কে প্রাথমিক মূল্যায়ন করে ক্লাবের কাছে নিয়ে আসেন তাঁরা। খেলোয়াড়কে দেখে তাঁকে কেনার ব্যাপারে কথা বলেন ‘একজনের’ সঙ্গে। এই লোকই হলো এজেন্ট। মূলত তিনিই থাকেন খেলোয়াড়ের কাছে। তাঁর মূল লক্ষ্য থাকে তাঁর খেলোয়াড়কে আর্থিকভাবে লাভবান করা। দল আর খেলোয়াড়ের মাঝে সংযোগ করাটাই তাঁর কাজ।
বেশির ভাগ সময় এজেন্ট হিসেবে থাকেন তাঁদের বাবা-ভাই-কাজিন কিংবা পরিবারের সদস্য। পাঁচবারের ব্যালন ডি’অর জয়ী লিওনেল মেসি, আরিয়েন রোবেন, নেইমার, হুয়ান মাতারা বাবাকেই রেখেছেন নিজেদের এজেন্ট হিসেবে। আবার চেলসি তারকা এডেন হ্যাজার্ডের কোনো এজেন্ট নেই, সরাসরি যোগাযোগ করলে তাঁর সঙ্গেই করো।
তবে সুপার এজেন্ট নাম হয়ে গিয়েছে কারও কারও। যাঁরা কিনা এ কাজ করেই নিজেদের শীর্ষে নিয়ে গেছেন। নিজেদের নামের পাশে লাগিয়েছেন ‘সুপার এজেন্ট’ ট্যাগ। দুজনের নাম তো এখন ফুটবল–ভক্ত মানেই জানেন—হোর্হে মেন্ডেজ ও মিনো রাইওলা।

হোর্হে মেন্ডেজ

এই পর্তুগিজ খেলার স্বপ্নটা বিসর্জন দিয়েছেন ২০ পেরোনোর আগেই। টানা ৫-৬টি ক্লাব থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে আশাহত মেন্ডেজ বনেছিলেন ডিজে। বার ও নাইট ক্লাবে কাজ করছিলেন। হঠাৎ করেই একটা সুযোগ এসে গেল তাঁর সামনে। কোনো এক শুভক্ষণে দেখা হয় নুনোর সঙ্গে। মেন্ডেজকে তিনি স্পেনের লা করুনাতে যাওয়ার পথ করে দেন। ফলে পর্তুগিজ ক্লাব থেকে স্পেনে যাওয়ার সুযোগ দেখে অনেকেই আকৃষ্ট হয়।
হুগো ভিয়েনাকে নিউক্যাসলে নিয়ে তাক লাগিয়ে দেন মেন্ডেজ। এর মাঝেই চলছিল স্কুল-কলেজ পর্যায়ের খেলোয়াড়দের নিয়ে দলবদলের চিন্তাভাবনা। তবে ২০০৩ সালেই নিজের সেরা কাজটি করে ফেলেন। রিকার্ডো কারেসমা আর ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর এজেন্ট হয়ে যান মেন্ডেজ। এটাই মূলত তাঁর সেরা দলবদল। কারেসমাকে নিয়ে যান বার্সেলোনার কাছে। আর এরপরেই সেই বিখ্যাত ম্যাচ। রোনালদো একা হারিয়ে দেন বেকহামহীন ইউনাইটেডকে। অবশ্য এর আগেই স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের নজর কেড়েছেন। সে ম্যাচে রোনালদোকে দেখে মাদ্রিদ, বার্সেলোনা ও আর্সেনাল চেয়েছিল তাঁকে সেই সময়ে।
হোর্হে মেন্ডেজ বুঝেছেন, রোনালদোকে দিতে হবে ভালো জায়গায়। ফলে হোর্হে মেন্ডেজ বেশি বেতন ও দাম দেওয়া সত্ত্বেও অন্য ক্লাবে নেননি রোনালদোকে। ফার্গুসন বলেছিলেন, শতকরা ৫০ ভাগ ম্যাচেই শুরু থেকে সুযোগ পাবেন রোনালদো। আবার এত কম বয়সেই ইউনাইটেডের খেলাটা যেন চাপ না হয়ে বসে, সেটা নিশ্চিত করতে সব ম্যাচে নামানো হবে না রোনালদোকে।
মেন্ডেজ নিশ্চিন্ত হলেন তাঁর আর এই খেলোয়াড়টার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। রোনালদোর দলবদলের পর তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে দ্রুত। এরপর এজেন্ট হন কোচ হোসে মরিনহো আর লুই ফিলিপে স্কলারির। পোর্তো থেকে মরিনহোকে নিয়ে আসেন চেলসিতে, আর স্কলারিকে জোগাড় করে দেন পর্তুগালের কোচের পদ। স্যার অ্যালেক্সকেও এনে দেন অ্যান্ডারসন আর নানি।
সর্বশেষ ২০১৪ বিশ্বকাপের পরে গ্রীষ্মের দলবদলে মোটামুটি কাঁপিয়ে দিয়েছেন মেন্ডেজ। হামেস রদ্রিগেজকে ৬৩ মিলিয়ন ইউরোতে রিয়াল মাদ্রিদে, ৬০ মিলিয়ন ইউরোতে অ্যাঙ্গেল ডি মারিয়াকে ইউনাইটেডে, কস্তা আর মাঙ্গালাকে চেলসি আর সিটিতে আনেন ৩২ মিলিয়ন ইউরোতে। শোনা যায়, এই ৪টি দলবদল থেকে মোট ২০ মিলিয়ন ইউরো পেয়েছেন মেন্ডেজ। সর্বশেষ ওলভারটন ওয়ান্ডারসের মূল এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন তিনি। মাঝে কর নিয়ে অনেক কিছু হলেও তিনি আছেন বহাল তবিয়তে।

নিজের সবচেয়ে বড় সম্পদ পগবার সঙ্গে মিনো রাইওলা। ফাইল ছবি
নিজের সবচেয়ে বড় সম্পদ পগবার সঙ্গে মিনো রাইওলা। ফাইল ছবি

হোর্হে মেন্ডেজ একাদশ
ফরমেশন: ৪-৪-২

ডেভিড ডি গিয়া (ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড), ফ্যাবিনহো (মোনাকো), পেপে (বেসিকতাস), থিয়াগো সিলভা (পিএসজি), ফ্যাবিও কোয়েন্ত্রাও (স্পোর্টিং সিপি), আন্দ্রে গোমেজ (বার্সেলোনা), হামেস রদ্রিগেজ (বায়ার্ন মিউনিখ), অ্যাঙ্গেল ডি মারিয়া (পিএসজি), নানি (লাৎসিও), ডিয়েগো কস্তা (অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ), ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো (রিয়াল মাদ্রিদ)।

মিনো রাইওলা

প্রথম জীবনে ছিলেন ওয়েটার, চালাতেন পিৎজার দোকান। কাজ করতেন বিভিন্ন ভাষাভাষী হাজারো লোকের সঙ্গে। সেখান থেকেই সূচনা। ইউনিভার্সিটি শেষ করতে করতে তিনি শিখে ফেলেন সাতটি ভিন্ন ভাষা। আর এর মধ্যেই খেলতেন এফসি হেরলেমের হয়ে। কিন্তু সেখানে ১৮ বছর বয়সে খেলা ছেড়ে দেন। কারণ, তাঁর মনে হচ্ছিল, খেলার চেয়ে আরও ভালো কিছু করার ক্ষমতা আছে।
এরপর হতে চান সেখানকার যুব দলের প্রধান। কিন্তু এক বছর প্রশাসনে কাজ করার পর ছেড়ে দেন। এরপর তিনি যোগ দেন স্পোর্টস প্রমোশনে, যা একটি এজেন্ট সংস্থা। যেখানে আয়াক্স থেকে ব্রায়ান রয়, মার্সিয়ানো ভ্রিঙ্ক আর ডেনিস বার্গক্যাম্পকে এনে দেন ইতালিয়ান লিগে। তত দিনে তাঁর মনে হচ্ছিল, একা কাজ করলে আরও ভালো হতে পারবেন। তখনই সব ছেড়ে একা প্রতিষ্ঠান খুললেন।

প্রথমেই রাজি করালেন পাভেল নেদভেদকে। তাঁকে নিয়ে গেলেন লাৎসিওতে। সেখান থেকে জুভেন্টাস। ফলাফল, রাইওলার নাম ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। এরপর থেকেই টপ এজেন্টদের একজন। তারপরও ব্যবসায় শত্রু তো থাকেই। এ ক্ষেত্রে ছিলেন একজন, স্যার ফার্গুসন। পগবার তখনো নাম ছড়ায়নি, কিন্তু রাইওলা কিছু দেখেছিলেন তাঁর মাঝে। ফলে নিজের ক্লায়েন্ট বানিয়ে ফেলেন। এরপর টানা দুই ঘণ্টা রুদ্ধদ্বার মিটিং, পগবা, ফার্গুসন ও রাইওলা। দুই ঘণ্টা শেষে পগবাকে নিয়ে ইউনাইটেড থেকে বেড়িয়ে আসেন রাইওলা।
ফার্গুসনও সব সম্পর্ক ছিন্ন করেন রাইওলার সঙ্গে। পগবাকে জুভেন্টাসে নিয়ে গেলেন রাইওলা, আর চুক্তিতে লেখা হয় পরবর্তী দলবদলের ২০ শতাংশ যাবে তাঁর পকেটে।
ইব্রাহিমোভিচকে যেভাবে ম্যানেজ করেছিলেন, তা আর বলতে! তাঁকে বলেছিলেন, ‘তুমি ফুটবলার, আমি এজেন্ট। তুমি খেলবে আর আমি তোমার টাকা আনার ব্যবস্থা করে দেব।’ এরপর থেকেই, খেলা আর টাকা দুটোই সমান গতিতে উড়ছে। এ ছাড়া মিনো রাইওলা যে ধরনের মানুষ, টাকা কীভাবে বৈধভাবে নিজের পকেটে ভরতে হয়, সেই ক্ষেত্রে তাঁর জুড়ি মেলা ভার।
২০১৬ সালের গ্রীষ্মে, তাঁর ক্লায়েন্ট হিসেবে নাম ছিল ইব্রাহিমোভিচ, পগবা, মাখিতেরিয়ান আর মারিও বালোতেল্লির। আর এই চার দলবদল থেকে তিনি মোটমাট পকেটে পুড়েছেন ৫০ মিলিয়ন ইউরো। এক পগবার দলবদল থেকেই তিনি জুভেন্টাস থেকে পেয়েছেন ২৫ মিলিয়ন, ইউনাইটেড থেকে ৮ আর পগবার কাছ থেকে ২ মিলিয়ন। আর মাখিতেরিয়ানের ডিল থেকে পেয়েছেন মোট ১০ মিলিয়ন। ইব্রা আর বালোতেল্লি থেকে আরও ১০।

আর তাঁর আয়? রোনালদোর সমান, মেসির চেয়েও বেশি। ফুটবলে ঠিকমতো লাথি না মেরেও!

মিনো রাইওলা একাদশ
ফরমেশন: ৩-৪-৩

জিয়ানলুইজি দোনারুমা (এসি মিলান), ভ্যান ডার উইল (ম্যানচেস্টার সিটি), বার্তোজ সালামন (এসপিএএল), ম্যাক্সওয়েল (পিএসজি), ব্লেইস মাতুইদি (জুভেন্টাস), পল পগবা (ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড), হেনরি মাখিতেরিয়ান (ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড), মারেক হামসিক (নাপোলি), ইব্রাহিমোভিচ (ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড), রোমেলো লুকাকু (ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড), মারিও বালোতেল্লি (নিস)।

তাঁরা ফুটবলে লাথি না মেরেও আয় করে তাঁদের চেয়েও বেশি। তাঁরা না খেলে সাইডলাইন থেকে কে কোথায় খেলবে, তা–ই ঠিক করেন। তাঁরাই যেন আড়ালে থেকে কলকাঠি নাড়া বুদ্ধিমান লোক।