মেসি+রোনালদো=রোনালদিনহো?

রোনালদিনহোর সেরা সময়। যখন বার্সেলোনায় ছিলেন। ছবি: এএফপি
রোনালদিনহোর সেরা সময়। যখন বার্সেলোনায় ছিলেন। ছবি: এএফপি

লিওনেল মেসি না ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো? সেরা ফুটবলার বেছে নেওয়ার পরীক্ষায় সবাই এ দুটি নামেই বিভক্ত। এটি এমন একটা প্রশ্ন, যেটি একটা ফুটবল প্রজন্মেরই গতিপথ বেঁধে দিয়েছে। সেরার প্রশ্নে এ দুজনের মধ্যে যেকোনো একজন প্রায় সবারই পছন্দ!

কিন্তু ডেকোর কাছে নয়। দুই বছর আগে পর্তুগাল এবং বার্সেলোনার সাবেক এ মিডফিল্ডার এই প্রশ্নের জবাব দেওয়ার সঙ্গে একটা ভুলও ধরিয়ে দিয়েছিলেন, ‘লিও কিংবা ক্রিস্টিয়ানোর চেয়ে ব্রাজিলীয় তারকা রোনালদিনহো অনেক বেশি প্রতিভাবান ছিলেন। তাঁর প্রতিভা ছিল খুবই সহজাত, বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন। তাঁকে বল দিলে তা পায়ে নিয়ে যেসব কারুকাজ দেখাতেন আর গোল করতেন—গোটা ব্যাপারটাই যেন ছিল অন্য গ্রহের।’

ডেকোর সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করা বেশ কঠিন। প্রতিপক্ষের বক্সে ‘নাম্বার নাইন’ স্ট্রাইকারের ভূমিকা নতুন করে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন রোনালদো। ক্রিস্টিয়ানো নন, হোসে মরিনহোর ‘আসল রোনালদো’—ব্রাজিলের ‘ফেনোমেনন’। আর রোনালদিনহো এসে মাঠে একজন ফুটবলারের ভূমিকাই আমূল পাল্টে দিয়েছিলেন! ছোট পরিসরে ‘ফুটসাল’ খেলার ‘ফ্রি-স্টাইল’-সব কৌশল ফুটিয়ে তুলেছেন ফুটবল মাঠে—প্রতিপক্ষ এমনকি তাঁর সতীর্থেরাও যা কখনো করার কথা ভাবেননি, রোনালদিনহো তা বারবার হাসতে হাসতে করে দেখিয়েছেন, একবার-দুবার নয়, বারবার, প্রতিনিয়ত!

ইউটিউবে রোনালদিনহোর ‘ইলাস্টিকো’, ‘গাউচো-স্নেক’, ‘হোকাস-পোকাস’ আর ‘নো লুক পাসিং’-এর ভিডিও ক্লিপসে দর্শকসংখ্যাও ঈর্ষণীয়। ইউটিউবে প্রথম ১০ লাখের ওপর দর্শক পাওয়া ভিডিওটাও কিন্তু ‘রোনি’র—এসি মিলানের অনুশীলনে নাইকির এক বিজ্ঞাপনে বল নিয়ে কসরত করতে করতে একপর্যায়ে কয়েকটি শট মেরেছিলেন গোলপোস্ট লক্ষ্য করে। আশ্চর্যের ব্যাপার, বলটা প্রতিবারই গোলপোস্ট কাঁপিয়ে বাধ্য ছাত্রের মতো ফিরে এসেছে তাঁর বুকে!



কেভিন প্রিন্স বোয়াটেং সেই ঐন্দ্রজালিক মুহূর্তের সাক্ষী। গোল ডট কমকে সেই গল্পই বলেছেন জার্মান তারকা, ‘তখন ভেবে অবাক হয়েছিলাম যে একটা শরীরে কীভাবে এত প্রতিভা থাকতে পারে!’ আইসল্যান্ডের সাবেক স্ট্রাইকার এইডুর গুডজনসেনও সেই প্রতিভার সাক্ষী। বার্সায় রোনালদিনহোর সঙ্গে দুই বছরের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন তিনি, সে পদার্থবিদ্যার সূত্রকে অস্বীকার করতেও সক্ষম ছিল! বার্সা সতীর্থের প্রশংসায় গুডজেনসন শুধু বলেছিলেন, ‘খেলার সময় বল নিয়ে সে যা করে, তার কোনো কিছুই আমাকে আর অবাক করে না। একদিন হয়তো সে বলকে দিয়ে কথা বলিয়ে ছাড়বে!’

স্বাভাবিকভাবেই তা সম্ভব নয়। কিন্তু রোনালদিনহো হয়তো এই ‘অসম্ভব’ ব্যাপারটির সবচেয়ে কাছে পৌঁছানো ফুটবলার ছিলেন। চ্যাম্পিয়নস লিগে ২০০৪ সালে চেলসির বিপক্ষে সেই গোল মনে পড়ে? বক্সের সামনে তিন ডিফেন্ডারদের দেয়াল। রোনালদিনহো কীভাবে যেন পা-টা একটু নাড়ালেন, সবাই থেমে গেল—সেই সুযোগে গোলরক্ষক পিওতর চেককে বিন্দুমাত্র নড়ার সুযোগ না দিয়ে বল পাঠালেন জালে! ইউটিউবে এই গোলটির ভিডিও দেখে নিতে পারেন। 

২০০৩ সালের ৩ সেপ্টেম্বর স্পেনের সময় মধ্যরাত পেরিয়ে বার্সার হয়ে অভিষেক রোনালদিনহোর। সেভিয়ার বিপক্ষে সে ম্যাচে শুধু তাঁর জন্য ন্যু ক্যাম্পে প্রায় ৮০ হাজার দর্শকের সমাগম ঘটেছিল। বাকিটা ইতিহাস, যা নিয়ে ডেভিড বেকহাম একবার বলেছিলেন, ‘বার্সেলোনায় এমন একটা সময় এসেছিল, যখন রোনালদিনহো ছিলেন আক্ষরিক অর্থেই অপ্রতিরোধ্য।’

সেই সময়টা ২০০৪ থেকে ২০০৬—যখন বার্সা টানা দুটি লিগ জয়ের সঙ্গে চ্যাম্পিয়নস লিগও জিতেছিল। রোনালদিনহোর তুলনা তখন চলছে পেলে, ম্যারাডোনা, ক্রুইফ, ডি স্টেফানোদের সঙ্গে। হালের মেসি-রোনালদোদের সঙ্গে যেমন তুলনা চলে আরকি! কিন্তু পতনের শুরুও তারপর থেকেই। নৈশজীবন তাঁকে চুম্বকের মতো টেনেছে। তাই ধূমকেতুর মতো উত্থান ঘটলেও কিংবদন্তিরা যে বয়সে (২৬-২৭ বছর) সেরা ফর্মে পৌঁছায়, রোনালদিনহো সেই বয়সেই পশ্চিম আকাশে হেলে পড়া ‘সূর্য’।

সেই সূর্যকে একসময় সবাই মাথায় করেই রেখেছিল। সেটি তাঁর সমর্থক থেকে শুরু করে ঘোরতর শত্রুও—অন্তত খেলার মাঠে। কারণ একদল মারমুখো প্রতিপক্ষের মধ্যে হাসিমুখে বল নিয়ে যা খুশি তাই করার ক্ষমতা সবার থাকে না! ২০০৫ সালে রিয়ালের ঘরে ঢুকে জয় ছিনিয়ে আনার পর স্বাগতিক দর্শকেরা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান জানিয়েছিলেন রোনালদিনহোকে।

ডিয়েগো ম্যারাডোনার পর রিয়ালের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দলের দ্বিতীয় খেলোয়াড় হিসেবে সেই ‘স্ট্যান্ডিং ওভেশন’ পেয়েছিলেন রোনালদিনহো, যেন সার্কাস দেখে মন্ত্রমুগ্ধ দর্শক করতালি দিয়ে সিক্ত করছে ‘মাস্টার ট্রেনার’কে! মেসি এখন সেই দলটার ‘মাস্টার’ হলেও রিয়াল সমর্থকদের চেয়ার থেকে উঠে দাঁড় করাতে পারেননি। সামনে হয়তো পারবেন। একই কথা প্রযোজ্য ক্রিস্টিয়ানোর ক্ষেত্রে।

রোনালদিনহো সেরা হতে চাননি কখনোই। তিনি মনের আনন্দে খেলেছেন। কীর্তিগুলো এসে পায়ে লুটিয়েছে তাঁর। জীবনটা তাঁর কাছে প্রতিযোগিতার নয়, মজা করার, মজা দেওয়ার। ২০০৬ সালে একবার বার্সার অনুশীলন দেখতে গিয়েছিলেন রোনালদিনহোর বন্ধু এবং বাস্কেটবল তারকা কোবে ব্রায়ান্ট। তাঁকে ‘রোনি’র জিজ্ঞাসা, ‘চলো তোমাকে দেখাই, সর্বকালের সেরা ফুটবলার হবে কে?’ অবাক চোখে ব্রায়ান্টের উল্টো প্রশ্ন, ‘কে আবার? তুমি। রোনালদিনহো মুচকি হেসে আঠারো-উনিশের এক কিশোরকে দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘না, এই ছেলেটা হবে সেরা।’

সেই ছেলেটা আজকের লিওনেল মেসি। বার্সায় তাঁর প্রথম গোলটার উৎস ছিলেন ‘রোনি’। কিন্তু এই দুয়ের যুগলবন্দীটা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। রোনালদিনহো একসময় বার্সা ছাড়লেন। তাঁর জায়গায় এখন মেসি। রোনালদিনহোর অবসর ঘোষণার পর মেসি তাঁকে স্মরণ করেছেন কৃতজ্ঞচিত্তে। এ যেন কিংবদন্তিদের সেই পরম্পরা, যেখানে পূর্বসূরি-উত্তরসূরি কেউ কাউকে ভুলতে পারে না, ভোলা যায় না।

রোনালদিনহো ক্যারিয়ার নিয়ে বাস্তববাদী হলে হয়তো আরও অনেক কিছু জিততে পারতেন। কিন্তু নিজস্ব জীবনদর্শন তাঁকে বলতে শিখিয়েছে, ‘যা চেয়েছি সবই পেয়েছি। সে জন্য আমি কৃতজ্ঞ।’

সত্যি কথা হলো, আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। প্রতিযোগিতার ভূপৃষ্ঠ বনে যাওয়া এই লোভী পৃথিবীতে রোনালদিনহো মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, ফুটবল খেলাটা এখনো মজার। এখনো সুন্দর। হাসতে হাসতে খেলা যায়, খেলতে হয়।
কিন্তু আমরা কি তাঁকে সেই হাসি ফিরিয়ে দিতে পেরেছি? নাকি ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছি। প্রতিযোগিতা যে আমাদের সবারই খুব প্রিয়।