তামিম যেখানে রথী-মহারথীদের চেয়ে এগিয়ে

* ওয়ানডের ৬ হাজারি ক্লাবে তামিম
* মাইলফলকটি পেরিয়েছেন তিনি ১৭৫ ম্যাচ খেলে
* ৬ হাজার রানের মাইলফলক তিনি অনেক রথী-মহারথীর আগেই ছুঁলেন


প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ৬ হাজার রান তামিমের। ছবি: প্রথম আলো
প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ৬ হাজার রান তামিমের। ছবি: প্রথম আলো

গ্রায়েম ক্রেমারের বলটা আলতো ঠেলে দিয়ে এক রান নিলেন। কেউ হাততালি দিল না। পশ্চিমে হেলে পড়া সূর্যের তেরছা রোদ পূর্ব গ্যালারির ডিজিটাল স্কোর বোর্ডটাকে ম্লান করে রেখেছে বলে তাতে কোনো অভিবাদন বার্তা এসেছিল কি না, তা-ও বোঝা গেল না প্রেস বক্স থেকে। দর্শকের কেউ হাততালি দিলেন বটে, তা নির্দিষ্ট করে তামিমকে উপলক্ষ করেই, সে-ও জোর দিয়ে বলা যাবে না। মুহূর্তটায় তামিম নিজে থাকলেন নির্লিপ্ত। চাইলে ব্যাট উঁচিয়ে ধরতেই পারতেন। প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে যে ওয়ানডেতে ৬ হাজার রান পূর্ণ করলেন!

খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানদের কেউ ৩ হাজার রান পূর্ণ করলেই সেটিকে বড় অর্জন ধরে নেওয়া হতো। বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানের সেঞ্চুরি-ফিফটি যে কেউ গুনে বলে দিতে পারত। সেদিনের লাজুক নবীন ক্রীড়া সাংবাদিক প্রেস বক্সের এক কোণে মুখচোরার মতো বসে থাকত, আজ তার চুল পেকেছে, বেড়েছে বকবকানিও। আর পাল্টে গেছে বাংলাদেশের ক্রিকেটের ছবিটাও।

এখন এত এত অর্জন আর কীর্তির মাইলফলক পেরিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে, কে রাখে হিসাব! তবে তামিমের এই অর্জন অবশ্যই বিশেষ কিছু। শুধু তাঁর জন্য নয়, বাংলাদেশের ক্রিকেটের ভবিষ্যতের জন্যও।

১৭৫ ইনিংস লাগল তামিমের ৬ হাজারে পৌঁছাতে। ওয়ানডেতে এটা দ্রুততম নয় অবশ্যই। ২০১৪ সালের নভেম্বরে ১৩৪ ইনিংসে এই মাইলফলক ছুঁয়ে ভিভ রিচার্ডসের রেকর্ড ভেঙে দিয়েছিলেন বিরাট কোহলি। কোহলি হাজারির মাইলফলকে রিচার্ডসকে তাড়া করছেন, আর কোহলিকে তাড়া করছেন হাশিম আমলা। ২০১৫-র নভেম্বরে আমলা ৬ হাজারের মাইলফলক পেরিয়ে যান মাত্র ১২৩ ইনিংসে।

আমলার চেয়ে ৫০ ইনিংসের মতো বেশি লাগল তামিমের। তবু তামিমকে নিয়ে আদিখ্যেতা করাই যায়। কেন? ৬ হাজারি ক্লাবে সংখ্যায় তামিমের আশপাশের নামগুলো দেখুন।

১৭৫ ইনিংস লেগেছিল জাভেদ মিয়াঁদাদের। ‘বড়ে মিয়াঁ’র পাশে বসলেন তামিম। মাইকেল ক্লার্কের লেগেছিল ১৭৪ ইনিংস। আরেক অস্ট্রেলীয় গ্রেট অ্যাডাম গিলক্রিস্টেরও লেগেছিল ১৭৪ ইনিংস। ১৭১ ইনিংস লেগেছিল সর্বকালেরই অন্যতম সেরা (টেস্ট বিবেচনায় তো অবশ্যই) রাহুল দ্রাবিড়ের। আর ব্যাটসম্যানদের রেকর্ড পরিমাপের একক শচীন টেন্ডুলকারের লেগেছিল ১৭০ ইনিংস।

তামিমের সামান্য ওপরে থাকা নামগুলোর মধ্যে আছেন ক্রিস গেইল (১৬৮ ইনিংস), জ্যাক ক্যালিস (১৬৭), মার্ক ওয়াহ (১৬৭)। ধোনি-পন্টিংদের লেগেছিল ১৬৬ ইনিংস করে।

তামিমের ঠিক পরে এই কীর্তিতে আছেন ইনজামাম-উল-হক (১৭৬)। মারভান আতাপাত্তুতে গিয়ে দূরত্বটা বাড়ছে (১৮০)। এরপর আছেন হার্শেল গিবস (১৮৪), শিবনারায়ণ চন্দরপল ও বীরেন্দর শেবাগ (১৯০ ইনিংস), কুমার সাঙ্গাকারা ও যুবরাজ সিং (১৯২), অরবিন্দ ডি সিলভা (১৯৪)।

মোহাম্মদ আজহারউদ্দিনের মতো মহারথী তো আছেন দুই শর ওপাশে (২০৫ ইনিংস)। ৬ হাজারি ক্লাবে ঢুকতে সমান ইনিংস খেলতে হয়েছিল অর্জুনা রানাতুঙ্গা ও ইউনিস খানকে। এঁদের চেয়ে এক ইনিংস বেশি লেগেছিল স্টিভেন ফ্লেমিংয়ের। ঝড় তুলে মাতারা হারিকেন নাম পাওয়া সনাৎ জয়াসুরিয়ারই লেগেছিল ২০৯ ইনিংস। মাহেলা জয়াবর্ধনেরও তা-ই।

ঝড় তোলায় বিখ্যাত এ কালের ব্রেন্ডন ম্যাককলামেও লেগেছিল ২২৬ ইনিংস। দুই অস্ট্রেলীয় গ্রেট অ্যালান বোর্ডার (২২৯) বা স্টিভ ওয়াহর (২৪০) চেয়েও তো ঢের এগিয়ে তামিম।

একটি যুক্তি হতে পারে, এঁদের সবাই ওপেনার বা টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানের মতো সুযোগ পাননি। যেমন স্টিভ ওয়াহই ৫৮ বার অপরাজিত থেকে ফিরেছেন, ততক্ষণে ৫০ ওভার বা প্রতিপক্ষের দেওয়া লক্ষ্য ফুরিয়ে গিয়েছিল। তাতেও তামিমের কীর্তি ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। সাঙ্গা-গিবস-শেবাগরাও তামিমের পেছনে। টেন্ডুলকার-গিলক্রিস্ট-দ্রাবিড়রাও খুব বেশি সামনে নেই।

৬ হাজার পূর্ণ করতে ৬৬ দরকার ছিল। থামলেন আরও একটি ফিফটিকে সেঞ্চুরির বেশ কাছে নিয়ে গিয়ে। সিরিজের প্রথম ম্যাচের ধকল এখনো সামলে উঠতে না পারা ধীর ও অসমান বাউন্সের উইকেটে ৭৬ রানের ইনিংস খেলে ফিরলেন যেন কিছুই করতে পারলাম না এমন আক্ষেপ নিয়ে।

৪১তম ফিফটিটাকে আবার ৪০-এর ঘরে নিয়ে যেতে সেঞ্চুরিটাকে দুই অঙ্কের ঘরে নিয়ে যেতে না পারার হতাশাও আছে।

এমনিতেই সতীর্থদের কারণে অনেকটা যেন আড়ালে চলে যায় তাঁর সব চেষ্টা। ব্যাটিংয়ে এখন ভীষণ নিয়মিত তামিম ম্যাচসেরাও হন অনিয়মিত। তবে আজ শেষ পর্যন্ত আর ম্লান হাসি হাসতে হয়নি। কীর্তি গড়ার দিনে দল জিতেছে, নিজেও হয়েছেন ম্যাচ সেরা।

অনেক দিন পর ম্যাচের সেরা হলেন। তামিম অবশ্য জানেন, এর চেয়েও বড় কিছু করার বাকি। ইতিহাস-সেরা কেনইবা হবেন না তিনি!