ঢাকার ফুটবলে নিয়ম ভাঙার যত কাণ্ড

সিদ্ধান্ত মেনে নিতে না পেরে রেফারির সঙ্গে তর্ক শুরু করে দিলেন জোসেফ আপুসি।  ফাইল ছবি
সিদ্ধান্ত মেনে নিতে না পেরে রেফারির সঙ্গে তর্ক শুরু করে দিলেন জোসেফ আপুসি। ফাইল ছবি
  • নিয়ম ভাঙা ঢাকার ফুটবলে নিয়মিত ঘটনাই।
  • প্রায় ম্যাচেই নিয়মভঙ্গের ঘটনা ঘটে।
  • জরিমানা হয় প্রচুর। নিষেধাজ্ঞাও আছে।
  • তবে অবস্থার পরিবর্তন নেই তেমন।

পেনাল্টির প্রতিবাদে মাঠে ঢুকে রেফারির সঙ্গে তর্কে জড়িয়েছেন রহমতগঞ্জের কোচ কামাল বাবু। যেটির শাস্তি দুই লাখ টাকা জরিমানাসহ এক বছরের নিষেধাজ্ঞা। সদ্য সমাপ্ত ফুটবল মৌসুমে আইন ভাঙার এমন অনেক উদাহরণ আছে। ম্যাচ কমিশনার ও রেফারির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বাফুফের শৃঙ্খলা কমিটি শাস্তিও দিয়েছে অকাতরে। মনে করিয়ে দিলেন মাসুদ আলম

বিদ্যুৎ চলে গেছে তাই...

ম্যাচ শুরুর ঘণ্টা দুয়েক আগে হঠাৎ ড্রেসিংরুমে বিদ্যুৎ চলে গেল। ক্ষোভে ফেটে পড়া রহমতগঞ্জের কোচ কামাল বাবু সমালোচনার তির ছোড়েন বাফুফের দিকে। তাঁর মন্তব্য আচরণবিধির পরিপন্থী হওয়ায় ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয় তাঁকে। গত বছরের ২ জুন এটি ছিল চট্টগ্রাম আবাহনী-রহমতগঞ্জ ফেডারেশন কাপের প্রথম সেমিফাইনালে।

ছবি তোলার জেদ

প্রিমিয়ার লিগে শেখ জামালের বিপক্ষে ম্যাচ শুরুর আগে ওয়ার্মআপ করছিল সাইফ স্পোর্টিং। দলটির ক্যামেরাম্যান তুলছিলেন সেই ছবি। ছবি তুলতে বারণ করেন বাফুফের কর্মকর্তা। কিন্তু সাইফের ফুটবলার হেমন্ত ভিনসেন্ট জোর করে ছবি তুলতে বলেন ক্যামেরাম্যানকে। গত বছরের ১১ ডিসেম্বরের এ ঘটনায় হেমন্তকে গুনতে হয় ১০ হাজার টাকা জরিমানা।

লাল কার্ডের পরও...

প্রিমিয়ার লিগ ম্যাচে চট্টগ্রাম আবাহনী খেলছিল মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে। ৮৩ মিনিটে লাল কার্ড দেখেন মুক্তিযোদ্ধার শফিকুল ইসলাম বিপুল। মাঠ থেকে তিনি বেরিয়ে যাওয়ার পরপরই মুক্তিযোদ্ধা দ্বিতীয় গোল পেয়ে গেল। আর সেই গোলের আনন্দে বিপুল বেঞ্চে ছুটে এসে যোগ দিলেন সতীর্থদের আনন্দে। ভুলে গেলেন লাল কার্ড দেখলে পত্রপাঠ চলে যেতে হয় গ্যালারিতে। গত ১৯ ডিসেম্বর তাঁর এই আবেগের খেসারত বাড়তি আরও এক ম্যাচ নিষিদ্ধ।

লাইনআপে দাঁড়াতে দেরি

ম্যাচ শুরুর আগে ড্রেসিংরুমের সামনে দুই দলকে দাঁড়াতে হয় সার বেঁধে। রেফারি দুই দলকে নিয়ে মাঠে যান। কিন্তু রেফারি অপেক্ষা করছেন, অথচ দলের খবর নেই, এমন যদি হয়! সেটির শাস্তি, প্রতি মিনিট দেরি করার জন্য তিন হাজার টাকা জরিমানা। বিদায়ী মৌসুমে সেই জরিমানা দিয়েছে কয়েকটি দল। ২৯ জুলাই মুক্তিযোদ্ধা-শেখ রাসেল তিন মিনিট করে দেরি করেছিল। দুই মিনিট দেরি করেছিল রহমতগঞ্জ-ফরাশগঞ্জ (৬ সেপ্টেম্বর), মোহামেডানের বিপক্ষে ম্যাচে আবাহনী (৭ আগস্ট) এবং চট্টগ্রাম আবাহনীর বিপক্ষে বিজেএমসি।

ম্যাচ কমিশনারের অনুরোধ অমান্য

লিগ ম্যাচে বিরতির সময় দুই দলকে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের কাদা মাঠে অনুশীলন না করতে অনুরোধ করেন ম্যাচ কমিশনার। কিন্তু তা উপেক্ষা করে চট্টগ্রাম আবাহনী অনুশীলন করে যায় গত বছরের ৩০ আগস্ট বিকেলে। ম্যাচ কমিশনার বাধা দিলে চট্টগ্রাম আবাহনীর দলনেতা শাকিল মাহমুদ চৌধুরী নাকি গালাগালও করেন। তাঁকে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

করমর্দন না করায়...

ম্যাচ শেষে দুই দলের খেলোয়াড়দের করমর্দন করা রীতি। কিন্তু ৩ ডিসেম্বর সেই রীতির তোয়াক্কা না করে ফরাশগঞ্জের খেলোয়াড়দের সঙ্গে করমর্দন করেননি সাইফ স্পোর্টিংয়ের ফুটবলাররা। ১৫ হাজার টাকা জরিমানা হয় সাইফের।

দর্শক পেটানোর অভিযোগ

শাস্তিপ্রাপ্তদের তালিকায় আছেন আরামবাগের কোচ মারুফুল হকও। তাঁকে জরিমানা গুনতে হয়েছে ৫০ হাজার টাকা। ৩১ জুলাই আবাহনীর বিপক্ষে প্রিমিয়ার লিগ ম্যাচ শেষে এক দর্শককে পেটানোর অভিযোগ মারুফের বিরুদ্ধে। তিনি অবশ্য তা অস্বীকার করেন।

বাফুফের প্যাড ও স্বাক্ষর জাল

মৌসুম শুরুর আগে এপ্রিল মাসে চট্টগ্রাম আবাহনীর নাইজেরিয়ান স্ট্রাইকার আফিজ করেছেন এক কাণ্ড। ভিসার মেয়াদ বাড়াতে বাফুফের প্যাডে বাফুফের সাধারণ সম্পাদকের সই জাল করে ধরা পড়ে নিষিদ্ধ হন ছয় ম্যাচ। আপিলে শাস্তি নেমে আসে এক ম্যাচে।

সংবাদ সম্মেলনে না আসার মাশুল

সংবাদ সম্মেলনে আসতে দেরি করেও জরিমানা গোনার উদাহরণ আছে । ২০১৬ প্রিমিয়ার লিগে ম্যাচ শেষে দুই কোচের সংবাদ সম্মেলনে আসা বাধ্যতামূলক ছিল। কিন্তু চট্টগ্রাম এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে সংবাদ সম্মেলনে না আসায় ১০ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হয় মোহামেডানের কোচ জসিমউদ্দিন জোসিকে। ঢাকা পর্বে একই অঙ্কের জরিমানা হয় শেখ রাসেল ক্রীড়াচক্রের কোচ মারুফুল হকের। মারুফ প্রথম আলোকে বললেন, আগের ম্যাচে সংবাদ সম্মেলনে গিয়ে দেখেন কেউ নেই। শূন্য ঘর। তাই আর পরের ম্যাচে যাননি।

প্লে-অফ না খেলার ধৃষ্টতা

২০১৬ লিগে অবনমন প্রশ্নে দুটি দলকে খেলতে হতো প্লে-অফ। হেরে যাওয়া দল নেমে যেত দ্বিতীয় স্তরের চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে। কিন্তু উত্তর বারিধারা ও ফেনী সকার জোট বেঁধে প্লে-অফই খেলল না! পরিণামে দুই দলেরই অবনমন। সঙ্গে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানাও।

সদলবলে মাঠে

গত ১২ সেপ্টেম্বর প্রিমিয়ার লিগের ম্যাচ শুরুর ২০ মিনিট পর হঠাৎ একদল মানুষ মাঠে! ফরাশগঞ্জের সহসভাপতি সারোয়ার হাসান দলবল নিয়ে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের এক নম্বর গেট দিয়ে মাঠে ঢুকে ১৫ নম্বর ভিআইপি বক্সে যাচ্ছেন। শখানেক সমর্থক তাঁর সঙ্গে। ম্যাচ শুরুর পর মাঠে ঢোকা নিষিদ্ধ। তাই ফিফার নিরাপত্তা আইনের ৩০ ধারা অনুযায়ী ফরাশগঞ্জ ক্লাবের সভাপতি, সহসভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এক বছরের জন্য ফুটবলের সব কার্যক্রমে স্থগিত দণ্ডাদেশ পান। অর্থাৎ এমন অপরাধ আবার করলে তবেই তা কার্যকর হবে। ক্লাবকে জরিমানা করা হয় পাঁচ লাখ টাকা। ফরাশগঞ্জের আপিলে অঙ্কটা নেমে আসে আড়াই লাখে।

রেফারি যেন ‘নন্দ ঘোষ’

সবচেয়ে বেশি নিয়ম ভাঙা হয় রেফারির সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে। এটা ঠিক, ঢাকার ফুটবলে রেফারি লাঞ্ছনা সাম্প্রতিক বছরে কমেছে। তবে অফসাইড, পেনাল্টি, গোল...ইত্যাদির প্রতিবাদে তেড়েফুঁড়ে রেফারির দিকে ছুটে যাওয়া নিয়মিত দৃশ্যই।

২৮ জুন ২০১৭

রহমতগঞ্জের বিপক্ষে ফেডারেশন কাপের কোয়ার্টার ফাইনাল। ১০ মিনিটে শেখ রাসেলের গোল। তবে অফসাইডের দাবি তুলে রহমতগঞ্জের কোচ কামাল বাবু ও দলটির খেলোয়াড় ফয়সাল আহমেদ সহকারী রেফারি মনির ঢালিকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেন বলে অভিযোগ। দুজনেরই পাঁচ হাজার টাকা করে জরিমানা হয়। রহমতগঞ্জ ক্লাবকে শোনানো হয় কঠিন সতর্কবার্তাও।

২৮ জুলাই ২০১৭

আবাহনী কোচ দ্রাগো মামিচ অশান্ত হয়ে উঠলেন সাইফ স্পোর্টিংয়ের বিপক্ষে লিগ ম্যাচে। রেফারির একটি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে মাঠেই ঢুকে পড়েন ভদ্রলোক! তবে সেটা রেফারিকে শাসাতে নয়, নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে। এই বিবেচনায় ছাড় পেয়ে যান মামিচ।

২৯ জুলাই ২০১৭

মোহামেডানের বিপক্ষে লিগ ম্যাচে রেফারির সিদ্ধান্তে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন শেখ জামালের কোচ জোসেফ আপুসি। অশোভন আচরণের দায়ে তাঁর শাস্তি কঠোর সতর্কবার্তাসহ এক ম্যাচের নিষেধাজ্ঞা।

৮ আগস্ট ২০১৭

প্রিমিয়ার লিগে চট্টগ্রাম আবাহনীর বিপক্ষে ম্যাচে রেফারিকে গালাগাল, অশোভন আচরণ ইত্যাদি অভিযোগে সাইফ স্পোর্টিংয়ের প্রধান কোচ কিম গ্র্যান্ট নিষিদ্ধ হন পাঁচ ম্যাচের জন্য। সঙ্গে ক্লাবকে জরিমানা করা হয় ৩০ হাজার টাকা।

২৫ আগস্ট ২০১৭

আবাহনী-রহমতগঞ্জ প্রিমিয়ার লিগ ম্যাচে ৪৫ মিনিটে রেফারির সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়া একটু বেশিই দেখিয়ে ফেলেছিলেন আবাহনীর ট্রেনার ও সাবেক ফুটবলার নজরুল ইসলাম। রেফারিকে তিনি প্রাণনাশের হুমকি দেন বলে প্রতিবেদন গেছে বাফুফের দপ্তরে। রেফারি তাঁকে বহিষ্কার করার পরও মাঠের বাইরে যেতে প্রথমে অস্বীকৃতি জানান। পরে দুই ম্যাচের জন্য নিষিদ্ধ হন জাতীয় দলের সাবেক এই ডিফেন্ডার।

২ অক্টোবর ২০১৭

আরিফ খান জয়ের ২০ হাজার টাকা জরিমানা। না, মন্ত্রী আরিফ খান জয় ভেবে ভুল করবেন না কেউ। এই আরিফ খান জয় ব্রাদার্সের তরুণ ফুটবলার, যিনি রেফারির সঙ্গে অশোভন আচরণ করেছেন প্রিমিয়ার লিগ ম্যাচে আবাহনীর বিপক্ষে।

১১ ডিসেম্বর ২০১৭

আরামবাগ ক্লাবের সভাপতি মোমিনুল হক সাঈদ ম্যাচের বিরতির সময় রেফারির দিকে তেড়ে যান। এতে উৎসাহিত হয়ে আরামবাগের ক্ষুব্ধ সমর্থকেরা মাঠে ঢুকে বাফুফের সাউন্ড সিস্টেম দখল করে গালাগাল দিতে থাকেন রেফারিকে। আরামবাগকে দেড় লাখ টাকা জরিমানা করা হয়, সাঈদ নিষিদ্ধ হন চার ম্যাচ।

পাদটীকা: জরিমানার টাকা পাওয়ার জন্য ক্লাবের পেছনে ঘুরতে হয় না বাফুফেকে। টাকা আদায়ে আছে সহজ উপায়। বাফুফের কাছে ক্লাবগুলোর পাওনা থেকেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিয়োগ হয়ে যায় ওই টাকা।