রোনালদোদের 'জুতা আবিষ্কারের' গল্প

>

• ফুটবল বুটকে অনেক পথ পাড়ি দিতে হয়েছে আজকের এ রূপ পেতে।
• এখন খেলোয়াড়দের স্কিলের কথা চিন্তা করে স্পেশালাইজড বুট বানানো হয়।

ফুটবলের প্রথম দিককার বুট। ফাইল ছবি
ফুটবলের প্রথম দিককার বুট। ফাইল ছবি

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা ‘জুতা আবিষ্কার’ পড়া আছে অনেকেরই। কবিগুরু বুঝিয়েছেন, রাজার পা ধূলিমুক্ত রাখতেই জুতার জন্ম। তবে এখন সেই জুতার বিচরণ সর্বত্র এবং যখন ফুটবলের কথা আসে, তখন এই জুতা কিংবা বুটের প্রয়োজনীয়তার কথা বলে শেষ হবে?

বুট এখন আর বুটে সীমাবদ্ধ নেই, খেলোয়াড়দের কারিকুরি থেকে শুরু করে বলের বাঁক দেখাতেও বুটের জুড়ি মেলা ভার। তবে এতটা উঠে আসতে ফুটবল বুটকে কিন্তু অনেক পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। প্রথম দিকে বুটের নিচে ‘স্পাইক’ ছিল অত্যন্ত ধারালো। তাতে সে সময়ের খেলোয়াড়দের ট্যাকলগুলো হতো খুব কড়া, এমনকি ক্যারিয়ারঘাতী ইনজুরিও হতো। এসব বুটের জন্য অনেক খেলোয়াড়ের পুরো ক্যারিয়ারই তো শেষ হয়ে গিয়েছে!

তখন ফুটবলের সরঞ্জাম তৈরি করত ‘ভ্যালস্পোর্ট’ ও ‘গোলা’। তবে ফুটবল খেলার সরঞ্জামাদির হালচাল বদলে দেয় দুই বিশ্বযুদ্ধ।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে যখন জার্মানির জুতার কারখানা বন্ধের পথে, তখন ড্যাজলার ভ্রাতৃদ্বয় গড়ে তোলেন জুতা তৈরির কারখানা। দুই ভাই সেই ‘গারব্রুডার ড্যাজলার শু-ফ্যাব্রিক’ নামের জুতার কারখানা খুলেছিলেন নিজেদের ভাগ্য পাল্টানোর লক্ষ্যে। তখন যুদ্ধবিধ্বস্ত জার্মানির শুধু খেলার জুতা বানানো ছিল বিলাসিতা। কিন্তু সেই বিলাসিতার মাঝেও তাঁদের ভাগ্য বদলেছে। ছোট ভাই অ্যাডলফ চাহিদা অনুযায়ী জুতা বানাতেন, তা খদ্দেরের কাছে পৌঁছে দেওয়াই ছিল বড় ভাই রুডলফের কাজ। আর অবসরে নিজেদের বানানো বুট দিয়ে খেলতেন দুই ভাই, তাঁরা নিজেরাই একে-অপরের প্রতিপক্ষ। খেলার বাইরে দুজনের মধ্যে বিরোধও ছিল।

তাঁদের ভাগ্য পাল্টে গেল হিটলার ক্ষমতায় আসার পর। জার্মানিতে তখন খেলাধুলা আর শরীরচর্চার ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়েছিল, এতে জুতা বানানোর ব্যস্ততা বাড়ল ড্যাজলার ভাইদের। সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল। জার্মানি ফুটবল দলকেও স্পনসর করছিল তাঁদের কারখানা। এ ছাড়া ১৯৩৬ অলিম্পিকে এই ড্যাজলার ভাইদের জুতা দিয়েই ৪টি স্বর্ণ জিতে নেন জেসি ওয়েন্স। এতে তাঁদের জুতার কারখানার বিজ্ঞাপনও হয়ে যায়। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তাঁদের ভাগ্য আবারও পাল্টে দিল!

বিশ্বযুদ্ধ শেষে বন্দী হলেন বড় ভাই। তিনি ভাবলেন এর পেছনে নিশ্চয়ই ছোট ভাইয়ের হাত আছে! ছোট ভাই তখন ব্যস্ত ব্যবসার প্রসারে। এদিকে বড় ভাইয়ের ধারণা, ছোটজন ব্যবসা হাতিয়ে নিতে চায়। ধারণা থেকে জন্ম নেওয়া ভুল বোঝাবুঝিতে সৃষ্ট বিরোধ গড়াল বিচ্ছেদ পর্যন্ত। দুই ভাই তাঁদের ব্যবসা আলাদা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। এই সিদ্ধান্ত থেকে জন্ম হলো বিশ্বখ্যাত দুটি ক্রীড়াসরঞ্জাম প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের—অ্যাডলফ ড্যাজলার তাঁর প্রতিষ্ঠানের নাম দিলেন ‘অ্যাডডাস’ আর রুডলফ ড্যাজলারের প্রতিষ্ঠানের নাম হলো রুডা। চিনতে পারলেন কী? সেই ‘অ্যাডডাস’ বর্তমানের অ্যাডিডাস আর রুডা হলো ‘পিউমা’!

১৯৩৬ অলিম্পিকে ড্যাজলার ভাইদের জুতা দিয়ে ৪ টি স্বর্ণ জিতে নেন জেসি ওয়েন্স। ফাইল ছবি
১৯৩৬ অলিম্পিকে ড্যাজলার ভাইদের জুতা দিয়ে ৪ টি স্বর্ণ জিতে নেন জেসি ওয়েন্স। ফাইল ছবি

ছোট ভাই অ্যাডলফ কিন্তু শুরুর ‘অ্যাডডাস’ নামটা ধরে রাখতে পারেননি। এই নামে আরও একটি প্রতিষ্ঠান থাকায় নাম পাল্টে রেখেছিলেন অ্যাডিডাস। আর বড় ভাই রুডলফ আর ড্যাজলার নাম মিলিয়ে ‘রুডা’ নাম দিলেও পরে তা পাল্টে রেখেছিলেন পিউমা। তাঁদের বিরোধ এমন পর্যায়ে চলে যায় যে আরাখ নদীপাড়ের লোকজন কারও সঙ্গে কথা কিংবা সম্পর্ক শুরুর আগে দেখে নিত, পায়ে কোন ব্র্যান্ডের জুতা!

তাঁদের বিরোধের কথা না হয় অন্যদিন হবে, তবে অ্যাডিডাস ও পিউমা কিন্তু ভিন্ন ধরনের এক বুটের সূচনা করেছিল। ১৯৫৪ বিশ্বকাপের আগে জার্মানির স্পনসর থাকার কথা ছিল পিউমার। কিন্তু শেষ মুহূর্তে কোচ সেপ হারবার্জার ও পিউমা মালিক রুডলফের ঝামেলার ফলাফল হিসেবে প্রতিষ্ঠানটি বাদ পরে যায়। এ সুযোগে জার্মানি দলের স্পনসর হয় অ্যাডিডাস। সেবার প্রথম নিজেদের জুতায় ‘Screw in Studs’ পদ্ধতি ব্যবহার করে অ্যাডিডাস। পিউমা এর স্বত্ব দাবি করলেও নাম হয়েছিল অ্যাডিডাসের।

পিউমা আর অ্যাডিডাসের মধ্যে এক বড়সড় চুক্তি হয় সে সময়ের সেরা খেলোয়াড়কে নিয়ে—তারা কেউই পেলেকে স্পনসর চুক্তির প্রস্তাব করবে না। পেলে অবাক হয়ে দেখলেন, ব্রাজিলের সব খেলোয়াড়কে নিজেদের চুক্তির ছায়াতলে করে নিচ্ছেন পিউমার এজেন্ট, কিন্তু তাঁর দিকে তাকাচ্ছেও না। তবে পেলে পিউমার কাছ থেকে চুক্তির প্রস্তাব পেয়েছিলেন একেবারে শেষ মুহূর্তে। শুধু ফাইনালের জন্যই ২৫ হাজার ডলার, আর পরবর্তী চার বছরের জন্য ১ লাখ ডলার দিয়ে পিউমার শর্ত ছিল একটাই—কিক অফের আগে রেফারির কাছ থেকে সময় নিয়ে শুধু জুতো বাঁধবেন পেলে। ব্রাজিল কিংবদন্তি সেই কথামতোই কাজ করায় দারুণ ব্র্যান্ডিং হয়েছিল পিউমার।

আশির দশকে বুটের বাজারে প্রবেশ করে আমব্রো আর লোটো। তবে বিশাল পরিবর্তনের সূচনা হয় অ্যাডিডাসের হাত ধরে। অ্যাডিডাস এক নতুন শুরুর প্রত্যাশা জাগায়। তারা বাজারে নিয়ে আসে নতুন মডেলের বুট ‘অ্যাডিডাস প্রিডেটর’। এই বুটের পাশের তিনটি স্ট্রাইপ বলে যে পরিমাণ ফোর্স তৈরি করে তা বলের গতিকে আরও বৃদ্ধি করে। শুধু তাই নয় প্রায় ৩০০ গ্রামের কাছাকাছি এ বুটের সামনের অংশ ছিল টেবিল টেনিস ব্যাটের ওপরের রাবারের মতো। এতে বল খুব সহজে গ্রিপ করা যেত এবং শট করলে বল বাঁকও নিত সহজেই। এই বুট বানানো হয়েছিল ক্যাঙারুর চামড়া দিয়ে। প্রথম এই বুট বানানোর বুদ্ধি দিয়েছিলেন লিভারপুলের ক্রেইগ জনসন।

বুটের ব্র্যান্ডিংয়ে সবচেয়ে বেশি আয় করেন ক্রিস্টিয়ানো রোনলাদো। ফাইল ছবি
বুটের ব্র্যান্ডিংয়ে সবচেয়ে বেশি আয় করেন ক্রিস্টিয়ানো রোনলাদো। ফাইল ছবি

নাইকিও পিছিয়ে থাকেনি। ১৯৬৪ সালে প্রতিষ্ঠা হওয়া যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রতিষ্ঠান ১৯৯৮ বিশ্বকাপের আগে নিজেদের সেরা বুটটি নিয়ে আসে। নাইকির এই বুটকে সেই বিশ্বকাপে ব্র্যান্ডিং করে দিয়েছিলেন রোনালদো লুইজ নাজারিও দ্য লিমা। মার্কোরিয়ালের বিখ্যাত নীল-রুপালি রঙের এই বুট সবাইকে ছাড়িয়ে যায়। ড্রিবলিংয়ের জন্য উপযোগী আর দ্রুত গতিতে ছুটে চলতে পারা এই বুটের মূল বৈশিষ্ট্য। বুটে ছিল সিনথেটিক লেদার আর ওজন ছিল মাত্র ২৪০ গ্রাম। এই চামড়া বলের ওপর টাচকে আরও শাণিত করে।

তবে নিত্যনতুন ডিজাইনের ‘পিউমা কিং’ প্রতি বিশ্বকাপেই কোনো না কোনো কিংবদন্তি মাঠে নেমেছেন। ১৯৬৬ সালে প্রথম পর্তুগিজ ‘ব্লাক প্যান্থার’ ইউসেবিও, পরের বিশ্বকাপে পেলে তারপর ডাচ কিংবদন্তি ইয়োহান ক্রুইফ। এ ছাড়া মারিও কেম্পেস এবং তিনটি বিশ্বকাপে এই পিউমা কিং পরেছেন ডিয়েগো ম্যারাডোনা।
বুটে পরিবর্তন কতটা এসেছে তা বলে বোঝানো যাবে না। ফিতা বদলেছে আবার ফিতা ছাড়া বুটও বানানো হয়েছে। তবে খেলোয়াড়দের বুট বাবদ দেওয়া স্পনসরের তালিকায় শীর্ষ পাঁচে নেই লিওনেল মেসি। শীর্ষ দশে রয়েছেন নাইকির ওয়েইন রুনি (১০), মার্কো ভেরেত্তি (৭)। আর অ্যাডিডাসের মেসি ও পগবা রয়েছেন ৮ ও ৬–এ। শীর্ষ পাঁচে রয়েছেন মেসুত ওজিল। চারে সেস্ক ফ্যাব্রিগাস, তাঁকে স্পনসর ফি হিসেবে পিউমা দেয় ৪ মিলিয়ন। তিনে অ্যাডিডাসের গ্যারেথ বেল, পান ৪.১ মিলিয়ন। দুইয়ে যিনি আছেন, নামটি দেখে চমকে যেতে পারেন—মারিও বালোতেল্লি! তিনি পিউমার কাছ থেকে পান প্রায় ৫ মিলিয়ন পাউন্ড। অবশ্য তাঁর নিত্যনতুন বুটের ডিজাইন দেখলে ৫ মিলিয়ন কেন দেওয়া হয় তা বুঝতে পারবেন। বুটের সবার ওপরে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, তিনি পান ৬.২ মিলিয়ন পাউন্ড।

কবিগুরুর কবিতার সেই রাজার বানানো জুতা আর এখন জুতা নেই। এখন তা ফ্যাশনের অনুষঙ্গ। বুটের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়। খেলার জন্য বানানো বুট এখন প্রতিষ্ঠানগুলোর টাকার খনি আর তারকা খেলোয়াড়েরা যেন সেই খনির শ্রমিক!